জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – দ্বিতীয় পর্ব

[পর্ব ১] -এর পরে …

alarm clockচারটেতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল, ঘুম খুবই পাতলা ছিল, সাথে সাথে উঠে অ্যালার্ম বন্ধ করলাম। ঘুমন্ত সিকিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল। ওকে বলি নি, আমি আসলে একা যাচ্ছি। সুখদীপের নম্বর কাল রাতে ওকে দিয়ে রেখেছি, জানি যে একবার ফোন করলেই জেনে যাবে যে সুখদীপ আমার সাথে যায় নি – তবুও নিজে থেকে ওকে বলতে পারি নি।

পাশের ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পরলাম। হাঁটুগার্ড কনুইগার্ড পরলাম একা একা। ব্যাগ গোছানোই ছিল। বাকি সমস্তকিছু প্রিপারেশনবিহীন। দুটি ব্যাগ হয়েছে, একটি ভায়াটেরা ক্ল, অন্যটি একটি বাঙলি লাগেজ ব্যাগ, আর বাঁধবার জন্য খানিক লম্বা নাইলন দড়ি। বানজি কর্ড তো নেই, কিনি নি সুখদীপের ভরসায়, নাইলন কর্ড দিয়ে কতটা কী লাগেজ বাঁধা যাবে, কে জানে।

রেডি হয়ে অবশেষে সিকিনীকে ডাকলাম। নিচে গিয়ে পার্কিং থেকে বাইক বের করলাম। লাগাতে গিয়ে বুঝলাম, পালসার এনএসের জন্য স্পেশালি তৈরি ভায়াটেরা ব্যাগও আসলে আমি লাগাতে জানি না। দড়িদড়াক্লিপআংটা সবই আছে, কিন্তু কখনও ট্রাই করে দেখি নি এটা আমার বাইকের পেছনের সিটে কীভাবে লাগায়। বিস্তর চেষ্টা করে মনে হল ফিক্স করেছি, এইবারে তার ওপরে দ্বিতীয় ব্যাগ, নাইলনের দড়ি দিয়ে কোনওরকমে বাঁধলাম। বিস্তর ঘাম ঝরিয়ে অবশেষে মনে হল বেঁধেছি। দড়িটা একটু ছোটই হল, কিন্তু টিকে যাবে মনে হল।

পথের দেবতা তখন বুঝি অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন। সিকিনীকে টা-টা করে আমি লাগেজবোঝাই বাইক নিয়ে এগোলাম।

আমাদের সোসাইটিটা বেশ বড়সড়। মেন গেট অবধিও পৌঁছই নি, মনে হল ব্যালেন্সের গড়বড় হচ্ছে। দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে দেখলাম, ঠিক তাই – ওপরের ব্যাগটা হেলে গেছে ডানদিকে। বেশ টাইট করেই তো বেঁধেছিলাম নাইলনের দড়ি দিয়ে, কিন্তু কীভাবে যেন দড়ির গোড়ার দিকটাই ঢিলে হয়ে গেছে। অগত্যা, আবার পুরো দড়ি খুলে নতুনভাবে আবার কষে বাঁধলাম।

একটি প্লাস্টিকের জেরিক্যানে পাঁচ লিটার পেট্রলও নিয়েছিলাম, যদি রাস্তায় দরকারে লাগে – লাগে মানে, লাগবে তো বটেই। তার হ্যান্ডেলের মধ্যে দিয়ে দড়ি গলিয়ে কষে ব্যাগ, স্যাডল ব্যাগ সমস্ত টাইট করে বেঁধেছেঁদে অবশেষে যখন সোসইটির মেন গেট পেরোলাম, ঘড়িতে তখন পাঁচটা পাঁচ বাজছে। পূবের আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হবো-হবো করছে।

অচল সিকির যাত্রা শুরু হল।

আপনারা জানে ভি দো ইয়ারোঁ সিনেমাটা দেখেছেন নিশ্চয়ই? মৃতদেহ হিসেবে সতীশ শাহের সেই অসাধারণ অভিনয় সিনেমা জুড়ে? একবার এর গায়ে, একবার ওর গায়ে হেলে হেলে পড়ে যাচ্ছে, আর নাসিরুদ্দীন আর তার সঙ্গী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে রোলার স্কেটস পরা সেই মৃতদেহকে খাড়া রাখবার? সেই রকম এক সতীশ শাহকে পেছনে বেঁধে ব্রাহ্মমুহূর্তে শুরু হল আমার যাত্রা।

প্রথম দিনের লক্ষ্য, দিনের শেষে জম্মু পৌঁছতে হবে। দিল্লি থেকে দুরত্ব – ছশো কিলোমিটার। সূর্য ওঠে নি এখনও, উঠব উঠব করছে। বাইক গড়াতেই হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগল। মনটা বেশ খুশি-খুশি হয়ে গেল। বেরোতে পারলাম তা হলে। চেনা রাস্তাগুলো আস্তে আস্তে পার হতে থাকলাম। আনন্দ বিহার, হসনপুর ডিপো, করকরডুমা, গীতা কলোনি ছাড়িয়ে লালকেল্লার পাঁচিলের কাছে এসে পড়লাম। এইখান থেকে মোটামুটি হাইওয়ে শুরু হচ্ছে। বেশ খানিকটা এগিয়ে মুকারবা চক, সেইখানে ডানদিকে টার্ন নিলে সো-জা জম্মুর রাস্তা, দিল্লির শেষ প্রান্ত হিসেবে সঞ্জয় গান্ধী ট্র্যান্সপোর্ট নগর, আর আলিপুর বিদায় জানাবে, তারপরেই ঢুকে যাব হরিয়ানায়া।

মুকারবা চকের একটু আগেই আবার মনে হল বাইক টলমল করছে। দাঁড় করিয়ে পেছনে ফিরে দেখি, ঠিক তাই, সতীশ শাহের মৃতদেহ ডানদিকে হেলে পড়েছে, সাইডের পকেট থেকে পাঁচ লিটারের পেট্রলের জেরিক্যানটা বিপজ্জনকভাবে উঁকি মারছে – একদিকের নাইলনের দড়ি কীভাবে যেন লুজ হয়ে ঢলঢল করছে। … এ তো মহা আপদ! এইভাবে আমি পঞ্চাশ কিলোমিটারও আসি নি, এতদিনের রোড ট্রিপ সামলাবো কী করে? নাহ্‌, দোকান পেলে আগে ভালো দেখে নাইলনের দড়ি অথবা বানজি কর্ড কিনতেই হবে। কিন্তু এই সুবিশাল হাইওয়েতে আমি হার্ডওয়্যারের দোকান পাবো কোথায়? আম্বালা? লুধিয়ানা? জালন্ধর? জম্মু?

খুব ভালো করে আবার চেপেচুপে বাঁধলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম এইভাবে হবে না। দড়ি কম পড়েছে, আমার আরও বেশি দড়ি কিনে রাখা উচিত ছিল। শুধু ওপরের ব্যাগই না, নিচের ভায়াটেরা ব্যাগও ঢলঢল করছে, আমি ওটাকেও আটকাতে পারি নি ঠিক করে। এইভাবে বাইক চালানো খুবই সমস্যার। তবু চালাতে তো হবেই। আবার শুরু করলাম যাত্রা।

মুকারবা চকে একটা সুবিশাল ফ্লাইওভার আছে, সেইখানে উঠলাম যখন, তখন ফ্লাইওভারের অন্যদিক থেকে সূর্যও উঠল। দিল্লিতে তো নীল আকাশ দেখা যায় না। সাদা ফ্যাকাশে বিবর্ণ আকাশের প্রান্ত থেকে টুক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল কমলা রঙের বিশাল সূর্য। তিরিশে মে-র দিন শুরু হল। দেখতে দেখতে ঢুকে গেলাম সোনেপত। (কথিত আছে, পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে দুর্যোধন এইখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বর্ণপ্রস্থ। সেই স্বর্ণপ্রস্থই আজকের সোনেপত) এর পরে মুরথাল। সামালখা। একে একে শহরগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাইক মোটামুটি স্টেবল চলছে দেখে আমি আর নাইলন দড়ির খোঁজ করি নি – আর বানজি কর্ড তো স্পেসিফিক দোকান ছাড়া পাওয়া সম্ভবই নয়, সে দোকান হাইওয়ের ধারে মিলবে না।

সাড়ে নটার সময়ে আম্বালা পেরোলাম। দুশো কিলোমিটার। পেট্রল পাম্পের ধারে একটা ছোট্ট দোকানে দাঁড়ালাম। বাড়িতে খবর দিলাম। শুধু এটুকু জানালাম না যে, এইখান থেকে সুখদীপ পা-জির আমার সঙ্গ নেবার ছিল, সে আর নেই। বাকি রাস্তাটাও আমাকে একাই যেতে হবে।

ছোট্ট দোকান, কোন জায়গা এটা জিজ্ঞেস করতে বলল এটা আম্বালার পরে একটা কী যেন ছোট জায়গা, এখান থেকে জালন্ধর প্রায় দুশো কিলোমিটার, লুধিয়ানা আর নব্বই কিলোমিটার দূরে। … ব্রেড ওমলেট পাওয়া যাবে? – জিজ্ঞেস করাতে লোকটা খুব লজ্জা পেয়ে জিভ টিভ কেটে বলল, এটা বৈষ্ণো ঢাবা, এখানে ডিম রাখা হয় না। কী পাওয়া যাবে তবে? পরোটা। আলু পরাঠা।

তাই দাও, সঙ্গে এক গ্লাস চা। জঘন্য একটি আলু পরোটা চা দিয়ে কোনওরকমে ঠেসেঠুসে খেলাম। ব্যাগের সাইড পকেট থেকে কাপড়ের গ্লাভস বের করে পরলাম। গরম বাড়তে শুরু করেছে। একটা জলের বোতল কিনে, তার অর্ধেক এক নিশ্বাসে শেষ করে বাকিটা পিঠের ব্যাগে পুরে উঠলাম। বাইকে দেখাচ্ছে সকাল থেকে দুশো তিরিশ কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি আমি।

ক্রমশ লোকবসতি কমতে লাগল। রাস্তা অসাধারণ। কখনও চার লেনের রানওয়ে, কখনও মোটামুটি ভালো, মাঝে এক সময়ে তো একশো পর্যন্ত স্পিড তুলে দিলাম, তার পরে নিজেই ভয় পেয়ে কমিয়ে আনলাম, বাইকের পেছনটা যেন দুলছে। বাইক থামিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, সতীশ শাহের মৃতদেহ আবার হেলে পড়েছেন, এইবারে বাঁদিকে। যেহেতু বাইকের সাইডস্ট্যান্ডটাও থাকে বাঁদিকে, বাইক তাই বাঁদিকে হেলিয়ে রাখাই যাচ্ছে না, ওজনের চোটে উলটে পড়ে যাচ্ছে সাইডস্ট্যান্ড দুমড়ে।

এ তো মহাজ্বালা! কোনওরকমে ধরাধরি করে বাইকটাকে দাঁড় করালাম। পুরো দড়ি আবার খুললাম, টানতে গিয়ে হাতের নুনছাল উঠে গেল, রক্ত বেরোচ্ছে, ব্যান্ড এইড আছে অবশ্য, তবে হাতের কাছে নেই, ব্যাগ খুলতে হবে। … থাক, গ্লাভসের ভেতরেই তো থাকবে আঙুল।

যে ভাবেই হোক, বাঁধাছাঁদা আবার সারলাম। মনের মধ্যে ভয় ঢুকছে, পৌঁছতে পারব তো সন্ধ্যের মধ্যে জম্মু? তিনশো কিলোমিটার মাত্র এসেছি। লুধিয়ানা এখনও পঁচিশ কিলোমিটার দূরে, জালন্ধর আরও একশো দশ। কোমর টাটিয়ে যাচ্ছে, গলার ভেতর থেকে জিভের ডগা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে শেষ পর্যন্ত জল খেলাম, মাথার ওপরে গনগনে রোদের তেজ। জল পেটে ঢুকল, কিন্তু জিভ-গলা সাথে সাথে শুকিয়ে কাঠ। এমন শুকিয়ে, যে জিভ নাড়াতে পর্যন্ত পারছি না। বাইসেপের কাছে অল্প ব্যথা করছে, তা বাইক একনাগাড়ে চালাবার জন্য যতটা না, তার থেকে বেশি এই বারবার লাগেজ বাঁধবার জন্যে। কেন যে এত লাগেজ নিয়ে বেরোতে গেলাম! অবশ্য এর থেকে কম করতামই বা কী করে? তাও তো বাইকের কিট কিছুই নিই নি সাথে, স্লিপিং ব্যাগও নিই নি।

মনে হয় এইবারে ঠিকঠাক বেঁধেছি, বাইক আর হেলছে না। আস্তে আস্তে স্পিড বাড়ালাম, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, চুয়াত্তর। মসৃণ রাস্তা।

লুধিয়ানা এসে গেল। শিখদের বোধ হয় আজ কিছু কার্নিভাল আছে, জায়গায় জায়গায় গামা গামা বক্স বাজিয়ে তারা ঠাণ্ডা শরবত খাওয়াচ্ছে পথচলতি গাড়ি, বাইক, ট্রাক ড্রাইভারদের, প্যাসেঞ্জারদের। দুতিনবার থামলাম। জলের বোতল তো কখন শেষ। ওই শরবৎ খেয়েই আবার একটু আধটু তেষ্টা মেটালাম। লুধিয়ানা শহরের মধ্যে রাস্তার অবস্থা ভয়ংকর। তার সাথে জ্যাম। ওপরে আগুন ঢালছে সূর্য। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, দাঁড়াবার জায়গা নেই। বেলা সাড়ে বারোটা। চোখে ধাঁধা দেখছি তেষ্টার চোটে।

শহর ছাড়াতে রাস্তার অবস্থা একটু ভালো হল। ট্রাফিকও কমল। বাঁ দিকে দেখি ফেলে দেওয়া গাড়ির কঙ্কাল দিয়ে বানানো একটা বিশাল রোবট। রোবটের পেছনে একটা বিল্ডিং – লাভলি প্রোফেশনাল ইউনিভার্সিটি। টিভিতে এদের খুব বিজ্ঞাপন দেখি।

হঠাৎ, মনে হল, আমার পেছনে বাঁধা লাগেজ থেকে কী যেন একটা ছিটকে গিয়ে রাস্তায় পড়ল, অনেক দূর থেকে দুড়ুম করে একটা আওয়াজ এল। ঝটিতি ব্রেক কষলাম। হায় কপাল, তাড়াহুড়োয় বাঁধতে গিয়ে শেষবারে ব্যাগ বেঁধেছি, পেট্রলের জেরিক্যানটা বাঁধা হয় নি, ব্যাগের সাইড পকেট থেকে গতিজাড্যে উড়ে বেরিয়ে গেছে পাঁচ লিটারের পেট্রল ভর্তি ক্যান। লম্বা সফরে অতি মহার্ঘ জিনিস।

দূরে রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে প্লাস্টিকের ক্যানটা। গাড়ি থামালাম। নেমে পেছনে দৌড়ে গিয়ে আনতে যাবো, মূর্তিমান যমদূতের মত উদয় হল একটা মুশকো ট্রাক। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ট্রাকের সামনের চাকায় পিষে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেল প্লাস্টিকের ক্যান, রাস্তা ভিজে গেল পেট্রলে। আমি সামনে দাঁড়িয়ে জাস্ট দেখলাম। কিচ্ছু করার ছিল না।

শেষ। সিকি, তুমি আস্ত একটা ফেলিওর। জল নেই, স্পেয়ার টুল নেই, এখন বাড়তি পেট্রলও নেই। লাগেজ টলোমলো, খালিখালি ডানদিক নয় বাঁদিকে হেলে যাচ্ছে, এই প্রস্তুতি তুমি নিয়েছো তিন বছর ধরে? ল্যাদাড়ুশ সিকি, ক্যাবলাকাত্তিক সিকি – তুমি দ্যাখো, জালন্ধর পর্যন্ত পৌছতে পারো কিনা।

বাইকে উঠে বসলাম ধীরে ধীরে। কোথাও ছায়া নেই। গাছপালা আছে বটে, তবে হাইওয়ে থেকে বেশ দূরে দূরে, বাইক নিয়ে ওখানে যাওয়া যাবে না। আগে কোথাও ছায়া পেলে সাইড হতে হবে। হ্যান্ডেল ধরতে গিয়ে দেখি – হাতের আঙুলগুলো আপনাআপনি বেঁকে যাচ্ছে, আমি চেষ্টা করেও তাদের সোজা করতে পারছি না। শিরায় টান। এ সিম্পটম আমার বেশ চেনা, ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ।

ছায়া নেই কোথাও। … রোদের মধ্যেই খানিক দাঁড়ালাম। গ্লাভস খুললাম অতিকষ্টে। হাত ঝাঁকাতে শুরু করলাম। জল শেষ অনেকক্ষণ। খানিক পর মনে হল, হাত স্বাভাবিক হয়েছে। দুচারবার মুঠো করলাম, খুললাম। হ্যাঁ, আঙুল কথা শুনছে এবার। আবার স্টার্ট দিলাম বাইকে। রাস্তায় আরও দু চারটে শিখ সমাবেশ চোখে পড়ল, শরবত বিলি করছে। খেলাম। যতই খাচ্ছি, কোনও উপকার হচ্ছে না। জিভ আরও বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছে, গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ।

শেষ ঘটনাটা ঘটল লুধিয়ানা আর জালন্ধরের মাঝামাঝি কোনও এক জায়গায়। রাস্তাটা একটু ভাঙাচোরা ছিল। সামনে মাউন্টে লাগানো মোবাইল, সেখান থেকে হেডফোন এসে ঢুকেছে হেলমেটের মধ্যে দিয়ে আমার কানে, হঠাৎ তাতে লাগল একটা হ্যাঁচকা টান, আর আমি দেখলাম, সত্তরের স্পিডে চলছি আমি, সামনে থেকে মোবাইল সমেত মাউন্ট উধাও, হেলমেটের ভেতর থেকে ক্যাবলার মত ঝুলছে হেডফোনের তার। সাথে সাথে ব্রেক মারলাম। পেছনে ট্রাকের সারি, এবং মাঝখানে রাস্তার ওপরে পড়ে আছে মোবাইল।

পাগলের মত হাত দেখাতে দেখাতে দৌড়লাম। পেট্রল গেছে যাক, মোবাইল গেলে আমি ছবি হয়ে যাবো। আজ সবে প্রথম দিন।

ট্রাক থামল, চাকার প্রায় সামনে থেকে মোবাইল উদ্ধার করলাম। অক্ষত। ট্রাকওলা কটি বাছাবাছা খিস্তি দিয়ে এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম বাইকের কাছে। মাথা ঘুরছে। হাতের শিরাগুলো আরো টেনে ধরছে। পারবো কি পারবো না?

ঘড়িতে প্রায় দুটো কুড়ি বাজে। জালন্ধর আরও পঞ্চাশ কিলোমিটার। একটা দোকান দেখে সেখানে জলের বোতল কিনলাম। নিমেষের মধ্যে শেষ করে ফেললাম এক লিটার জল। খানিক স্বস্তি পেয়ে বাইকের স্পিড বাড়ালাম। দেখতে দেখতে এসে গেল জালন্ধর সিটি। এইখান থেকে ডানদিকে টার্ন নিতে হবে জম্মুর জন্য। সোজা রাস্তা ঢুকে গেছে শহরের মধ্যে। ডানদিকে পরের মাইলস্টোন দেখাচ্ছে, পাঠানকোট। একশো কিলোমিটার। পৌনে তিনটে বেজে গেছে, খাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, তবুও, খালিপেটে যাওয়া ঠিক নয়। একটা ভদ্রগোছের খাবার জায়গা দেখতে হবে।

জালন্ধর শহরের সীমা পেরোতেই শহুরে ভাবটা কমে এল। চারপাশে ফসলের ক্ষেত, সাধারণ দোকানপাট, নয় তো কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ফাঁকা রাস্তা। ছশো কিলোমিটারের দুই তৃতীয়াংশ মেরে দিয়েছি। বাকি আর দুশো মত কিলোমিটার।

একটা ছোট ধাবা মত জায়গায় গাড়ি থামালাম। লোকটা গড়গড় করে বলে গেল কী পাওয়া যাবে – রাজমা চাওল, কঢ়ি চাওল, ছোলে চাওল … পনীরের তরকারিও পাওয়া যাবে। তাই সই। ভাত আর পনীরের তরকারি।

ভাত এল, মুখে দেওয়া যায় না এমন অখাদ্য তার টেস্ট। কোনওরকমে খানিক পেটে ঢোকালাম। জগে করে জল দিয়েছে, তার মধ্যে কোথা থেকে কে জানে, একখণ্ড বরফের ডেলা দিয়ে দিয়েছে জল ঠাণ্ডা রাখার জন্য। বরফের ডেলাটা কোথায় রাখা ছিল কে জানে, গুচ্ছখানেক কালো কালো নোংরা ভেসে বেড়াচ্ছে জলের ওপর। তাই দিয়েই কোনওরকমে খাচ্ছি, আঙুলের ডগায় ডগায় ব্যথা, ভাত মাখতে পর্যন্ত অসুবিধে হচ্ছে।

খেতে খেতে হঠাৎ দেখি, খুব কাছেই ট্রেনের আওয়াজ। তার পরেই দেখি রাস্তার ঠিক উল্টোদিক দিয়ে কুঝিকঝিক করে ছুটে চলেছে একটা ট্রেন। পাঠানকোটের দিকে।

খেয়ে উঠে আবার এক বোতল জল কিনলাম। দড়ি খুলে আবার লাগেজ বাঁধলাম। প্রত্যেকবারের মতই এবারেও মনে হল, এইবারে বুঝি ঠিকমত বাঁধা হয়েছে। … নিজের তো খাওয়া হল, এইবারে বাইককে খেতে দিতে হয়। সোয়া চারশো কিলোমিটার চলে এসেছি, সঙ্গের পেট্রলের ক্যান তো রাজপথকে উৎসর্গ করে এসেছি, এইবারে তেল ভরতে হবে।

পেট্রল পাম্পের কমতি নেই এই রাস্তায়। খানিক এগোতেই পাম্প পেলাম, ট্যাঙ্ক ফুল করিয়ে নিলাম। শেডের ছায়ায় খানিক দাঁড়িয়ে ভাবলাম, একটু চকলেট খাই, এনার্জি আসতে পারে। চকলেট খেয়ে জল খাই।

ছোট ছোট ক্যাডবেরিজের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়েছিলাম, রাস্তায় খাবার জন্য। একটা প্যাকেট খুলতে গিয়ে দেখি, প্রচণ্ড গরমে ভেতরে সব ক্যাডবেরি গলে জল হয়ে গেছে। চেটে চেটে কোনওরকমে খেলাম। চারটে বাজে। এইবারে রোদ পড়ছে, আর ততটা অস্বস্তি হচ্ছে না, কিন্তু হাতের আঙুলে ভীষণ ঝিঁঝি ধরার মত অনুভূতি হচ্ছে। হাতের গায়ের ব্যথা তো আছেই।

না, লাগেজ আর সে রকম ঝামেলা করল না। আস্তে আস্তে পাঠানকোটের দিকে এগোতে থাকলাম।

বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মুখে। এখান থেকে আরো একশো কিলোমিটার দূরে গেলে জম্মু সিটি। সুন্দর মসৃণ রাস্তা।


সন্ধ্যে প্রায় সাতটার সময়ে জম্মু শহরে এন্ট্রি নিলাম। মেরে এনেছি প্রায়। এইবারে হোটেল খুঁজতে হবে। কিন্তু, হাইওয়ের ধারে তো কোথাও কোনও হোটেল দেখছি না! একটা পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাসস্ট্যান্ডের কাছে অনেক হোটেল আছে। অতএব চলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে।

প্রচুর এই রাস্তা, সেই রাস্তা, মাঝে ভুল ইনপুট পেয়ে ঢুকে গেলাম কোনও এক বাজারে। সে এক ভয়ঙ্কর গলিঘুঁজিওলা বাজার। দোকানে গাড়িতে বাইকে জ্যামজমাট একটা দীর্ঘ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে খানিক গোলোকধাঁধার মত ঘুরপাক খেলাম, সেখানেই দুটো হোটেল টাইপের জিনিসও দেখলাম, তার একটায় আবার কারেন্ট ছিল না, রিসেপশনের ছেলেটি যদিও আশ্বাস দিল যে রাত এগারোটা নাগাদ রোজই কারেন্ট চলে আসে – তবু বিশ্বাস করতে মন চাইল না। বেরিয়ে এসে আবার গলিঘুঁজিতে ঘুরপাক খেয়ে তারপরে আবার দিক ঠিক করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম।

প্রথমেই চোখে পড়ল, কী একটা যেন, যাত্রী নিবাস। রুম আছে? আছে, তবে এসি রুম, সাড়ে তেরশো টাকা ভাড়া।

আমার তখন যা অবস্থা, দু হাজার চাইলেও আমার আর না করবার ক্ষমতা ছিল না। ছশো কিলোমিটার চলেছি, এই উচ্চণ্ড গরমে। কত টেম্পারেচার ছিল, কে জানে! এখনও জিভ নাড়াতে পারছি না। ঘড়িতে কাঁটা রাত সাড়ে আটটা পেরিয়ে পৌনে নটার দিকে এগোচ্ছে। রুম বুক করে নিচে নেমে এলাম, লাগেজ খুলতে হবে। দড়িদড়া খোলাপড়া – সারাদিনের শেষে এখন আমার কাছে জলভাত।

জামাকাপড় বদলে খাটের ওপর চিত হলাম। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় আস্তে আস্তে শরীরে সাড় আসতে লাগল। হিসেব করলাম, সারাদিনে প্রায় ছ বোতল, মানে ছ লিটার জল খেয়েছি। একবারও টয়লেট যাই নি।

গ্লুকোজ এনেছিলাম, একটা গ্লাস চেয়ে নিয়ে গ্লুকোজ জলে গুলে পর পর তিন গ্লাস খেলাম। টয়লেট পেল এইবারে।

ফ্রেশ হয়ে বাইরে থেকে একটা লে’জ-এর প্যাকেট আর একটা কোকের বোতল নিয়ে এলাম। এই দিয়েই আজ ডিনার সারি, আর বেশি কিছু খাবার ইচ্ছে নেই। কাল আবার সকাল সকাল বেরোতে হবে। সিকিনীকে ফোন করলাম। খেয়ে দেয়ে কম্বলটা টেনে নিলাম। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে।

কিন্তু, ঘুমোতে পারছি না কেন? জীবনে প্রথম, সারাদিন এই রকম বাইক রাইডিং-এর পর রাতেও তার হ্যাংওভার কাটছে না। চোখ বুজলেই খালি মনে হচ্ছে, আমি বাইক চালাচ্ছি, আর এই সামনে একটা ট্রাকে গিয়ে বোধ হয় সপাটে ধাক্কা মারলাম। চোখ খুলে গেল, কই, না তো! আমি তো বাইক চালাচ্ছি না, আমি তো বিছানায় শুয়ে আছি। … আবার চোখ বুজলাম, আবার মনে হতে লাগল, ফোকাস সরে যাচ্ছে, আমি চোখ বুজছি কেন? পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটা ট্রাক ছুটে আসছে … আমি চোখ বুজলেই ও আমাকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে যাবে, চোখ বুজলে চলবে না, কাম অন ওয়েক আপ, সিকি, ওয়েক আপ, আবার চমকে জেগে ওঠা, না তো, আমি তো হোটেলের বিছানায়, সুন্দর এসি চলছে, গরম নেই একটুও। আবার চোখ জুড়িয়ে আসছে, আবার ট্রাকেরা এগিয়ে আসছে আমাকে পিষে ফেলার জন্য …

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে গেল, জানলা দিয়ে দেখি, আকাশে কালো মেঘ, রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে।

এসিটা বন্ধ করে উঠলাম বিছানা ছেড়ে।

আমার একলা জার্নির আজ দ্বিতীয় দিন শুরু হল।

200ns


2 thoughts on “জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – দ্বিতীয় পর্ব

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.