জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – তৃতীয় পর্ব

[পর্ব-১] এবং [পর্ব-২] -এর পরে …

৩১শে মে ২০১৫ – দ্বিতীয় দিন

হোটেল থেকে বাইরে নিচে এলাম। কাল রাতে এদের রিসেপশনের কাচের ঘরের ভেতর মোটরসাইকেলটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ঠিকঠাকই আছে। বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি সে, কিন্তু আমার যে গায়ে আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথা। … সে তো হবারই ছিল, প্রথম দিনেই এক ধাক্কায় এতটা পথ, তার ওপরে এতবার করে লাগেজ খোলা বাঁধা, মানসিক প্রস্তুতি যতই থাক, শারীরিক প্রস্তুতি তো আমার শূন্যের ঘরে, সে তো আমি জানি। কখনও কোনওরকমের ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করি নি, ভারি জিনিস বলতে বাজারের ব্যাগ তোলা-নামানো – তার বাইরে তো কিছুই করি নি কখনও। ভোলিনি স্প্রে লাগিয়ে শুয়েছিলাম কাল রাতে, তাতে একটু সীমার মধ্যে আছে ব্যথা, কিন্তু পুরোপুরি তো এক রাত্রে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন পর পর চারদিন জার্নি, তারপরে রেস্ট মিলবে। আজ দ্বিতীয় দিন। আজ আর অতটা নয়, কালকের থেকে কম পথ। তিনশো কিলোমিটার, অতএব একটু দেরি করে বেরোলেও চলতে পারে, তবে কালকের পুরো পথটাই ছিল সমতলের পথ, আজ পুরো পাহাড়ী পথ, কালকের মত স্পিড উঠবে না।

আকাশ মেঘলা। সামনে রাস্তার অন্য পারে ফলবিক্রেতারা বসেছে তাদের ঝাঁকা নিয়ে। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। কালকের শুকনো গরমের সঙ্গে আজকের সকালের কোনও মিল নেই। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বৃষ্টি কি এখানে রোজই হচ্ছে, নাকি আজই প্রথম হল? লোকটা জানাল, কাল রাত থেকেই মেঘ হয়েছে, আজই প্রথম বৃষ্টি হল। চিন্তার কিছু নেই, কমে যাবে।

তা কমে গেল। আটটা নাগাদ আকাশ ফর্সা হতে শুরু করল, বৃষ্টি ধরে গেল। আমি জামাকাপড়ের ওপরে রেনস্যুট চাপিয়ে নিচে গেলাম লাগেজ বাঁধতে।

ভায়াটেরার লাগেজ ব্যাগ আজ খুব সহজেই লেগে গেল। স্ট্র্যাপগুলো কোনখান দিয়ে গলিয়ে কোনখানে বেল্টে লাগালে ওটা শক্তপোক্তভাবে লেগে যায়, সেটা এইবারে বুঝে নিয়েছি। কাল ব্যাগটা লাগিয়েছিলামই ভুলভাবে, তাই দুটোই ঝামেলা করছিল। অন্তত একটা ব্যাগের ঝামেলা তো মিটল। এইবারে এর ওপরে দ্বিতীয় ব্যাগটা। সেই নাইলন দড়ি, সেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন, সেই বাঁধা শেষ হবার পরে দেখা – যে প্রান্ত থেকে কষে বাঁধা শুরু করেছিলাম, সেইদিকটা লুজ হয়ে ঢলঢল করছে, অতএব, সেদিকেও আবার খুলে কষে বাঁধা।

পৌনে নটা নাগাদ স্টার্ট করলাম। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে উঁকি মারছে নীল রঙ, যে নীল দিল্লিতে দেখা যায় না। সূর্যের ঝিলিক আসছে তার মধ্যে দিয়ে, কিন্তু সে ঝিলিকে আজ তেমন তাপ নেই। একটু এগোতেই জম্মু শহরের বাইরে এসে পড়লাম, চমৎকার হাইওয়ে শুরু হল। একেবারে এক্সপ্রেসওয়ে। পাহাড় কেটে ঢেউখেলানো রাস্তা, ঠিক যেমন বিদেশে দেখা যায়, পিন পড়লে কুড়িয়ে নেওয়া যায় এত ঝকঝকে। দুধারে লালচে খয়েরি রঙের পাহাড়, অল্প অল্প উঁচু আভাস দিচ্ছে আসল হিমালয় খুব বেশি দূরে নেই। বাইক উড়িয়ে দিলাম। এটা টোল রোড, তবে টু হুইলারের জন্য কোনও টোল নেই।

ঘণ্টাখানেক চলার পরে রাস্তার ধারের একটা দোকানে থামলাম কিছু খেয়ে নেবার জন্য। লাগেজের দিকে তাকিয়ে মনে হল ঠিকঠাকই আছে বাঁধা। খেয়েদেয়ে আবার শুরু করলাম। যতক্ষণ খাচ্ছিলাম ততক্ষণে উৎসুক জনতার ভিড় জমতে শুরু করেছিল বাইক ঘিরে, বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট, কিছু লোকাল ড্রাইভার, তবে প্রশ্ন শুরু হবার আগেই আমি স্টার্ট দিলাম বাইকে। আবার ওড়া শুরু।

হাল্কা ছোট ছোট দুটো টানেল এল। কী সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো। তার পরে টোল বুথও এল, আমি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

সামনে বোর্ডে বড় বড় করে লেখা কাটরা-উধমপুর-পাটনিটপ-শ্রীনগর, সঙ্গে একটা সোজা তীরচিহ্ন। কী রকম সন্দেহ হচ্ছিল, কাটরা তো বৈষ্ণোদেবী যাবার রাস্তা, সেটা তো শ্রীনগরের পথে পড়ে না, ওটা তো জম্মু থেকে অন্য রুট! আমি ২০০১ সালে বৈষ্ণোদেবী গেছিলাম। যাই হোক, যেতে যেতে এক সময়ে দেখি, রাস্তার ভালোত্ব কমে এল, তারপরে রাস্তা সরু হয়ে ভাঙাচোরা পথ, আর কোথাও কোনও সাইনেজ নেই। রাস্তা এবড়োখেবড়ো শুরু হতেই পেছনে ব্যাগের নাচন শুরু হল, ফলে মাঝে আবার দু-দুবার থেকে ব্যাগ শক্ত করে বাঁধতে হল। কীভাবে যে আলগা হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। হাতের গাঁটে গাঁটে তখন তীব্র যন্ত্রণা – আর ভালো লাগছে না।

মাঝে এক জায়গায় চেকিং পয়েন্ট, কারবাইনধারী জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ আমাকে থামাল সাইডে। কোথায় যাচ্ছো? কোথা থেকে আসছো? … বললাম। ব্যাগ মে কেয়া হ্যায়? তা-ও বললাম। একলা যাচ্ছো? সাথে কেউ নেই? মিথ্যে বললাম এইবারে, হ্যাঁ আছে, আগে বেরিয়ে গেছে, আমি পেছন পেছন আসছি। কে জানে, একলা শুনলে যদি হ্যারাস করার চেষ্টা করে? পুলিশ এইবারে বলল, ব্যাগমে দারু কা বোতল তো নেহি হ্যায়?

তাই বলো। এইবারে পয়েন্টে এসেছে, একগাল হেসে বললাম, না নেই। আমি দারু খাই টাই না। পুলিশ বলে, তা হলে ব্যাগ সার্চ করি?

আমি বললাম, হ্যাঁ, করতে পারো, তবে এই দড়িদড়া খুলতে কিন্তু আধঘণ্টা লাগে, আর বাঁধতে আধঘণ্টা। আমাকে আজ শ্রীনগর পৌঁছতে হবে, এইবার বলো, খুলব কি খুলব না।

পুলিশ কী ভেবে কাটিয়ে দিল, হাতের ইশারায় বলল, এগিয়ে যেতে, আমি এগিয়ে গেলাম।

চলতে চলতে হঠাৎ একটা চৌমাথার মোড়ের সামনে এসে থমকে গেলাম। চারদিকে চার রাস্তা গেছে, চতুর্দিকে বৈষ্ণোদেবী সংক্রান্ত হোর্ডিং পোস্টার, এর মধ্যে কোন রুট নেবার?

চকে ছিল এক ট্রাফিক পুলিশ, তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ও হরি, উধমপুর হয়ে শ্রীনগর তো অন্য রুট, সেটা আমি হাইওয়েতেই মিস করে এসেছি, এটা কাটরা, এখান থেকে বৈষ্ণোদেবীর যাত্রা শুরু হয়। আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে পাঁচ কিলোমিটার, তার পরে বাঁদিকে টার্ন নিলে উধমপুরের কানেক্টর রাস্তা পাবো।

রাস্তা তখন জঘন্য – যেমন হয়ে থাকে টিপিকালি যে কোনও তীর্থস্থানের। ভাঙা রাস্তা, অজস্র ভক্তিমান পেডেস্ট্রিয়ান, ঘোড়া, খচ্চর, তাদের নাদি – সে এক পুঁদিচ্চেরি কেস। বাইক ঘোরালাম। পুলিশের কথা মত পাঁচ কিলোমিটার এগোতে বাঁদিকে কাটও পেলাম, জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটাই উধমপুরের কানেক্টর, সোজা পনেরো কিলোমিটার গেলে আবার সেই স্বপ্নের হাইওয়েতে পড়ব, তারপরে সেই রাস্তা ধরে সি-ধা শ্রীনগর।

গলির মুখে একটা দোকান, দোকানদারই সমস্ত বলে দিল। আমি বাইকটাকে সাইডস্ট্যান্ডে দিয়ে নেমে দাঁড়ালাম। একটু জল খেতে হবে এইবারে – গরম বাড়ছে। সতীশ শাহের ডেডবডিও ডানদিকে বিপজ্জনকভাবে হেলে পড়েছে, ওকে আবার বাঁধতে হবে, দোকানদারটি ভালো, ওকে রিকোয়েস্ট করলে বোধ হয় সাহায্য করে দেবে। আগে একটু জল খাই।

দোকানদারটিকে বলতে সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল লাগেজ বেঁধে দিতে, বলল, আগে বাইককে মেন স্ট্যান্ডে লাগাও।

ইতিমধ্যে পেছনে এসে গেছে মূর্তিমান যমদূতের মত একটা বিশাল ট্রাক, সে ঢুকবে পাশের গলিতে, আমার বাইকের জন্য সে ঢুকতে পারছে না, আমাকে তাই সাইড করতে হবে।

বাইক পিছোলাম, কিন্তু মেন স্ট্যান্ড দিতে গিয়ে হল এক চিত্তির। ওপরে যে সতীশ শাহের মৃতদেহ ডানদিকে হেলে রয়েছেন, সেটা ভুলে গেছিলাম। সাইড স্ট্যান্ড (এটা বাইকের বাঁদিকে থাকে) থেকে সোজা করতেই লাগেজ সমেত পুরো বাইকের ওজন শিফট হয়ে গেল ডানদিকে, আমি দুহাতেও আর ধরে রাখতে পারলাম না, চোখের সামনে সপাটে ডানদিকে লাগেজ-সমেত আছাড় খেয়ে পড়ল আমার বাইক, ডানদিকের ভিউ ফাইন্ডারটা কড়াৎ করে ডান্ডাসমেত ভেঙে গিয়ে ট্রাকের নিচে, সেই ডান্ডার ওপরেই বসানো ছিল আমার হেলমেট, সেটা গড়িয়ে ট্রাকের নিচে, ডানদিকের চাকার ঠিক তলায়।

বাইকের ওজন আটানব্বই কিলো, সে সমধ্যে আমার সম্যক ধারণা ছিল, কিন্তু লাগেজসমেত যে ওজন আরও চল্লিশ কিলো বেড়ে গেছে, সেটা বুঝতে পারি নি, আর সেই একশো আটত্রিশ কিলো পুরোটা ডানদিকে শিফট হয়ে গেলে আমার ক্ষমতা কী তাকে বাঁদিকে টেনে ধরব? আমার নিজের ওজন তো ষাট কিলো।

ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমার এত প্রিয় বাইক, তাকে দ্বিতীয় দিনেই কানা করে দিলাম! লোকজন ধরাধরি করে বাইকটা সোজা করে দিল, মেন স্ট্যান্ডে দাঁড়ও করিয়ে দিল। আমি দৌড়ে গিয়ে চাকার তলা থেকে হেলমেটটা উদ্ধার করে আনলাম। আমি আর সেই দোকানদার, দুজনে মিলে আবার সেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন বাঁধলাম, দোকানদার বলল, নাইলনের দড়ি কখনও থাকে নাকি টাইট, পিছলে পিছলে সরে যায় ঝাঁকুনি পেলেই। তুমি ভালো দেখে সুতলি দড়ি, মানে পাটের দড়ি সামনে কোথাও পেলে কিনে নাও, ঐটা দিয়ে ভালো বাঁধা যাবে।

এইসব দড়িদড়া পাওয়া যায় হার্ডওয়্যারের দোকানে, তা কাটরায় আর হার্ডওয়্যারের দোকান পাই কোথায়। বেঁধেছেঁদে আবার জল খেয়ে উঠলাম। এইবারে ডান দিকের ভিউ ফাইন্ডার নেই। ডানদিক থেকে কেউ ওভারটেক করতে এলে দেখতে পাবো না, অতএব এক্সট্রিমলি কশাস হয়ে চালাতে হবে।

ধীরে ধীরে পনেরো কিলোমিটার পার হয়ে আবার সেই ভালো রাস্তা পেলাম, এইবারে সামনেই দেখি লেখা আছে উধমপুর-পাটনিটপ-শ্রীনগর। বাইক থামিয়ে আবার দড়ি কষে বাঁধলাম, তারপরে এগোতে থাকলাম।

অনেকটা এগোবার পরে জম্মু সিটির চৌহদ্দী ছাড়িয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সীমা খতম হল। তারপরে সাধারণ রাস্তা। মসৃণ নয়, তবে খুব বাজেও নয়। গঢ়ী বলে একটা জায়গায় এসে দেখি রাস্তার বাঁদিকে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, তাতে বিভিন্ন জিনিসের সাথে সামনে লাইন দিয়ে ঝুলছে বিভিন্ন থিকনেসের নাইলনের দড়ি। বাইক থামালাম। কমবয়েসী একটি ছেলে, তাকে বললাম, এই বিত্তান্তো, আমাকে আজ সন্ধ্যের মধ্যে শ্রীনগর যেতেই হবে। তোমার যে দড়িটা মনে হয় এই লাগেজ বাঁধার পক্ষে আদর্শ, সেইটা দিয়ে একটু লাগেজ বেঁধে দাও, লাগেজ যেন একটুও না হেলে।

ছেলেটি এক্সপার্ট। জাস্ট একলা হাতে দড়িদড়া খুলে আমাকে বলল, বাঁধা ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু আপনার দড়িটা ছোট। সে নিজেই একটা দড়ি নিয়ে এল সবুজ রঙের। তারপরে এমন কষে বাঁধল, বাম্পি রাস্তা তো কোন ছাড়, বাইক ঠেলে খাদে ফেলে দিলেও বাইক ভেঙে যাবে কিন্তু বাঁধন আলগা হবে না। দেখে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

পুরো কাজটার জন্য সে নিল শুধু দড়ির দাম, কুড়ি টাকা। ঘড়িতে তখন বেলা বারোটা, সূর্যের তেজ চড়ছে, রেনকোটের ভেতরে ঘেমেনেয়ে যাচ্ছি। রেনকোট খুলে পিঠের ব্যাগে ঢোকালাম, বসতে গিয়ে দেখি – সে এমন বেঁধেছে, সে বাঁধন শক্ত তো হয়েছে বটেই, খেসারত হিসেবে আমার বসার সীটের আয়তন কমে গেছে। এখন আমি যতই রোগা হই, আমার পাছুর একটা তো বেসিক আয়তন আছে, সেটুকু রাখতে গিয়ে সম্মুখভাগ বাজেভাবে বাইকের ট্যাঙ্কারে চেপ্টে যাচ্ছে।

কী করব? আবার খুলে বাঁধব? ছেলেটা এত সুন্দর বেঁধে দিয়েছে, এইবারে আমি খুললে যদি আর বাঁধতে না পারি? থাক, কষ্ট করেই না হয় যাই। মাঝে মাঝে একটু দাঁড়িয়ে কোমর সিধে করে নেব।

বললে বিশ্বাস করবেন না, সত্যিই সারাদিন, ওইভাবে চালিয়ে আমি শ্রীনগর পৌঁছেছিলাম। লাগেজ আর এক ইঞ্চিও হেলে নি।

বেলা প্রায় আড়াইটের সময়ে পাটনিটপ। পাহাড়ের মাথায়, এইবারে বেশ শীত করতে লাগল। কিন্তু সোয়েটার সমস্তই ব্যাগে, সে ত কঠিন বাঁধনে বদ্ধ। ততক্ষণে রাস্তা যথেষ্ট খারাপ হয়ে গেছে। নুড়িপাথর বিছনো রাস্তা, সর্পিল পাকদণ্ডী, ডানদিকের ভিউ ফাইন্ডার নেই, বসার জায়গা কমে এতটুকুনি, তার মধ্যে আর কতটুকুই বা শীত লাগে! রেনকোটটা বের করে পরলাম, ওটা পিঠের ব্যাগে আছে।

পাটনি টপের পরে আবার ডিসেন্ড। আবার গরম, অনেকটা নামার পরে একটা কী যেন জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে লাঞ্চ সারলাম। শরীর তখন একেবারেই বইছে না। হোয়াটস্যাপ খুলে বাড়িতে খবর দিলাম। খেলাম। আরও ট্যুরিস্ট খেতে এসেছে এখানে, সবাই শ্রীনগর যাচ্ছে, কিংবা শ্রীনগর থেকে এসেছে বৈষ্ণোদেবী দর্শনে। একটি বাঙালি ফ্যামিলির সাথে খানিক হ্যাজ হল, ওই “বাইক নিয়ে এসেছো”, “এতদূর চালিয়ছো”, “ওব্বাবা” এইসব এক্সপ্রেশনগুলো এখন বেশ পুরনো হয়ে এসেছে। প্রায় চারটে বাজে, দিন শেষ হয়ে আসছে, শ্রীনগর এখনও প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে, জওহর টানেল নব্বই কিমি, ঐটি পেরোলে তবে শ্রীনগর ভ্যালিতে এন্ট্রি।

একটানা একঘেয়ে বাইক চালিয়ে যাচ্ছি, পাহাড়ি রাস্তা, কখনও বেশ ভালো, কখনও মন্দের ভালো, কখন বেশ খারাপ, সেই বুঝে গতি বাড়িয়ে কমিয়ে চলছি।

জওহর টানেলের দু কিলোমিটার আগে একটা চেকপোস্ট। সেখানে এক বয়স্ক ভদ্রলোক থামালেন, সেই একই গতের প্রশ্ন, কোত্থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি, সঙ্গে কে কে আছে। প্রথমেই বাইক থামাতে গিয়ে আমি উলটে পড়ে যাই যাই অবস্থা। হাতেপায়ে খিল ধরে গেছে কখন, বুঝতেই পারি নি। আমার মুখের অবস্থা দেখে কী মনে হল, তিনি জলের জাগ নিয়ে এলেন। জল খাও। রেস্ট নাও, তার পরে এগিও। চা খাবে?

নাঃ, চা নয়, আমি জলই খেতে চাই। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাইক সাইড করে একটু বসলাম। উনি ঘুরে ঘুরে আমার বাইকটা দেখলেন, সামনে ভিউ ফাইন্ডার মিরর নেই কেন জানলেন, বাইকের কোন মডেল, এই মডেলের স্পেশালিটি কী, বাইকে এক্সহস্ট নেই কেন – সমস্ত জেনে খুব খুব তারিফ করলেন আমার প্রচেষ্টার। আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠলাম খানিক পর। এইবারে এগোই। উনি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন।

তার পর একটু এগোতেই দেখি লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে জওহর টানেল। খানিক দূরে দূরে এলএমজিধারী সেনাবাহিনীর জওয়ান। তারা আমাকে ইশারা করল, বাইকওয়ালেঁ আগে চলা জাও। আমি গাড়িগুলিকে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে গেলাম টানেলের মুখে। ক্যামেরা বের করে টানেলের ছবি নিতে যাবো, এমন সময়ে টানেল গেল খুলে আর হুড়মুড়দূর করে প্রথম সামনে দাঁড়ানো গোটাদশেক বাইক ঢুকে পড়ল টানেলের মধ্যে। আমিও পড়িমড়ি করে ক্যামেরা ঢুকিয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম। প্রথমে বাইক, তার পরে গাড়ি, পর পর ঢুকে গেলাম জওহর টানেলে। এখানে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ।

২৫৩১ মিটার। প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা এই টানেলের ভেতরে একটু ভ্যাপসা গন্ধ, তবে অসহনীয় কিছু নয়। পার হতেই দেখি অন্য রকমের পাহাড়, সুন্দর গাছপালায় ছাওয়া শ্রীনগর ভ্যালি দেখা যাচ্ছে। একটা বাঁকের মুখে খানিকটা জায়গা করা, সেখান থেকে ভালো ভিউ পাওয়া যায়, জায়গাটার নাম টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট।

জায়গাটার নাম বানিহাল। টিপিটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে টানেলের এইবারে, গরম আর নেই, হাল্কা ঠাণ্ডা। একটু দূরে সাইনেজ বলছে শ্রীনগর আরও আশি কিলোমিটার, এর পরে অনন্তনাগ, অবন্তীপুরা, পামপোর হয়ে শ্রীনগর। জম্মু থেকে শ্রীনগর মোট তিনশো কিলোমিটার, তার মধ্যে দুশোর ওপর পেরিয়ে এসেছি, আর একশো মত বাকি রয়েছে।

অনন্তনাগ এসে গেলাম দেখতে দেখতে। শ্রীনগর আর ৬৮ কিমি। লম্বা জার্নির শেষদিকে এমন হয়, তখন সামান্য পঞ্চাশ, এমনকি দশ কিলোমিটারও মনে হয়, শেষ হতে চাইছে না।


অনন্তনাগ থেকে পাহাড় শেষ – কাশ্মীর ভ্যালিতে ঢুকলাম, সমতল রাস্তা চলে গেছে সোজাসুজি, দূরে গিয়ে হারিয়ে গেছে কোথাও, ইতিউতি বসতি শুরু হচ্ছে। সবুজে সবুজে ছয়লাপ। লম্বা লম্বা গাছে ছাওয়া চারদিক। বিকেল তখন প্রায় ছটা। এখনও অন্তত পৌনে দুঘণ্টা দিনের আলো থাকবে, শ্রীনগরে ঢুকে পড়তে অসুবিধে হবে না। দেখতে দেখতে অবন্তীপুরা এসে গেল, এইবারে দেখলাম এক নতুন দৃশ্য, বাঁদিক জুড়ে সারিসারিসারিসারি দোকান, কোথাও বড় করে বিরাট কোহলি, কোথাও এমএস ধোনির বিগ সাইজ পোস্টার, কোথাও পাকিস্তানের কোনও প্লেয়ারের পোস্টার (আমি নাম জানি না, তবে মুখ দেখেছি খবরের কাগজে), আর দোকানের সর্বাঙ্গে সারিসারি ঝুলছে ব্যাট। বিভিন্ন সাইজের ক্রিকেট ব্যাট। উইলো কাঠের ব্যাট তৈরিতে কাশ্মীর এক নম্বরে, এই হচ্ছে তার বাজার। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা দোকান পরপর চলেছে, প্রতিটাতেই ডিসপ্লেতে এবং দোকানের ভেতরে ডাঁই করে রাখা শয়ে শয়ে ব্যাট, আবার বাইরে কাটিং করে শুকোতে দেওয়া আছে ব্যাট না-হয়ে ওঠা কাঠের টুকরোদের। প্রতিটা দোকান পিছু একটি করে ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি ক্রিকেটারের বিশাল পোস্টার।

দোকানের সারি শেষ করতেই দেখি, আকাশে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। বেশি বড় নয়, কিন্তু বেশ ঘোলাটে হয়ে আসছে আকাশ। চলতে চলতেই বৃষ্টি শুরু হল।

আজকের অভিজ্ঞতা কালকের থেকে পুরো আলাদা। গরম একেবারেই নেই, বরং কাশ্মীর ভ্যালিতে ঢোকার পর থেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে, যদিও গায়ে রেনকোট জড়ানো, তবুও দুচারফোঁটা গায়ে পড়াতে হিহি করে কাঁপুনি শুরু হল। বেশ শীত। একবার থেমে রেনকোটটাকেই বেশ টেনেটুনে পরলাম, গলা থুতনি অবধি চেন টেনে, বিশেষ সুবিধে হল না, এদিকে ধারেকাছে রাস্তার ধারে গাছও নেই বা কোনও শেল্টারও নেই, যার নিচে দাঁড়িয়ে একটু রেস্ট নিতে পারব। অতএব, হাল্কা কাঁপতে কাঁপতে, ভিজে ভিজেই এগোতে থাকলাম।

শহর এগিয়ে আসছে, দোকানপাট এগোচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ট্র্যাফিক, ফলে গাড়ির স্পিডও কমছে। শ্রীনগর আর পঁচিশ কিলোমিটার, তবু সেইটাই যেন আর শেষ হতে চাইছে না।

একটা ঝাঁকড়া দেখে গাছের নিচে বাইক দাঁড় করালাম। হোটেল বুকিং করতে হবে। মোবাইল খুলে মেকমাইট্রিপে হোটেলপাড়ার সন্ধান করতে লাগলাম। কিন্তু সবাই যা জানে, দেখলাম মেকমাইট্রিপ তার বেশি কোনও খবর দিতে পারল না। হয় ডাল লেকের আশেপাশে, নয় তো বুলেভার্ড রোড, যেগুলো পশ হোটেল এলাকা বলে পরিচিত আর কি, সর্বত্রই এই মে-জুন মাসে উরিত্তারা দাম।

কী করব ভাবছি, এমন সময়ে একটা ইয়াব্বড়ো লরির চাকার টিউব হাতে এগিয়ে এল একটা লোক। কোথায় যাচ্ছি, কী বৃত্তান্ত, এইসব খেজুর করতে শুরু করল। আমি তখন শীতে দস্তুরমত কাঁপছি, খেজুর করার একেবারে ইচ্ছে নেই, কিন্তু এ হল কাশ্মীর, এখানে যত আম আদমি, তত সেনাবাহিনি, কারুর মনে সন্দেহ হলেই কেস বিগড়ে যেতে পারে, অতএব দেঁতো হাসি হেসে যথাসম্ভব তার সন্দেহ নিরসন করতে লাগলাম। মূল প্রশ্ন তার ঘুরেফিরে সেই একই, আমি একা এসেছি কিনা। বারবার বললাম আমার বন্ধু আছে, তারা এগিয়ে গেছে, আমি পেছন পেছন আসছি, ইতিমধ্যে ভিড় জমে গেছে। আরও চারপাঁচজন এসে গেছে, ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন।

এইবারে প্রমাদ গণলাম। অ্যাকচুয়েলি এরা সবাই টিপিকাল গ্রাম্য লোক, দিল্লির নাম্বারওলা মোটরসাইকেল, তাতে লাগেজ এবং আমাকে দেখে কৌতূহল হয়েছে, তাই ভিড় জমিয়েছে, কিন্তু মনে হল এদের কৌতূহল আর বাড়ানো উচিত নয়। বিরক্ত লাগলেও একা একা তো এতগুলো অচেনা লোকের সাথে পাঙ্গা নেওয়া সম্ভব নয়, অতএব, মোবাইল পকেটে পুরে আবার বাইকে চড়ে বসলাম। পেছনটা টাটিয়ে গেছে, বসার জায়গা খুবই কম লাগেজ বাঁধার ফলে, খোলার সাহসও হচ্ছে না। খুলতে পারলে তো একটা সোয়েটার বের করেই পরে নিতাম। আপাতত রেনকোট পরেই কাজ চালাই। এগোলাম।

খানিক এগোতেই – সামনে লম্বা জ্যাম, অনেকটা সামনে আর্মি আর পুলিশে মিলে কী যেন করছে। আর সারিসারি গাড়ি ট্রাক দাঁড়িয়ে। বাইকের এই একটা সুবিধে, জ্যামজটের মধ্যেও এদিক ওদিক করে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার মধ্যেই খানিকটা এগোতেই দেখি এক এক করে গাড়ি পেরোচ্ছে। বিশেষ কিছু না, একটা গাছ উলটে পরে অর্ধেক রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে, তাই জ্যাম। কিন্তু কাশ্মীরের খাঁজেখোঁজে সেনার উপস্থিতি চোখে পড়ার মত।

সে আগের বারেও দেখেছিলাম। মানে, সেই দু হাজার বারোতে। প্লেন যখনই শ্রীনগর এয়ারপোর্টের রানওয়ের মাটি ছুঁল, দেখলাম রানওয়ের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে কার্বাইনধারী সেনা জওয়ান। আর দেখেছিলাম শ্রীনগরের রাস্তায়। সে-ও ছিল জুন মাস। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল সেদিনও। দেখেছিলাম অপরূপ শ্রীনগর। পর পর বাড়ির পাঁচিল বেয়ে উঠেছে গোলাপচারার দল, তাতে ফুটে আছে রংবেরংয়ের গোলাপ। থোকা থোকা। আর, যত গোলাপ, তত সেনা। দশ ফুট দূরে দূরে। সবার হাতে কার্বাইন, এল এম জি, হাতের আঙুল ট্রিগারে বসানো। কাশ্মীর।

সেবার গন্তব্য ছিল ডাল লেক। হাউসবোটে রাত কাটিয়েছিলাম আমরা, সে বড় রোম্যান্টিক রাত ছিল এক। কিন্তু আজ, দু হাজার পনেরোতে আমি একা। রোম্যান্টিসিজমের থেকেও বড় কনসার্ন এই মুহূর্তে রাতে মাথা গোঁজার জন্য একটা শস্তার আস্তানা খোঁজা। কোমরটাকে সিধে করতে হবে। টানা দু দিন একা একা চলছি, শুরুর ভালো লাগাটা কেমন যেন কমে আসছে। একটা একঘেয়ে ব্যাপার চলে আসছে। যেতে যেতেই ঠিক করলাম, লাল চক যাবো। ডাল লেক আগের বারে দেখেছি, লেকের ধারে শুধু রাত কাটাবার জন্য হোটেল নিয়ে লাভ নেই, বরং লাল চকে শস্তার হোটেল পাবো।

শ্রীনগর তথা কাশ্মীর উপত্যকা সম্বন্ধে যাঁরা ওয়াকিফ-হাল, তাঁরাই জানেন লাল চক জায়গাটার নাম। শ্রীনগর শহরের একদম মাঝখানে, ঝিলম নদীর ধারে একটা বিজনেস এরিয়া। প্রচুর দোকানপাট হোটেল, আর, আর, লাল চক নামকরা কাশ্মীরের সমস্ত বিক্ষোভের উৎসস্থল হিসেবে। যত বোমাবাজি, যত স্টোন পেল্টিং, যত মিলিটারির দমন-পীড়ন, যত জঙ্গি-হানা – সব কিছুর সাক্ষী থেকেছে এই লাল চক।

শ্রীনগর সিটিতে ঢুকতে ঢুকতে বৃষ্টি ধরে গেল। সাইনেজ দেখে দেখে লাল চক পৌঁছলাম যখন, তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। সমস্ত দোকান বন্ধ। কেমন অন্ধকারে ঢাকা চারদিকে। একটা হোটেল পেলাম সামনে, নামটাও দেখি নি, কথা বলতেই সাতশো টাকায় সাথে সাথে রফা হয়ে গেল। কিন্তু গাড়ি তো এখানে রাখা যাবে না। লাল চকে রাতে পুলিশ আর মিলিটারি রাউন্ড দেয়, গাড়ি দেখলে তুলে নিয়ে যায়।

হোটেলের লোকটাই বলল, এখানে কাছেই একটা অথরাইজড পার্কিং লট আছে, সেখানে বাইক রেখে আসা যেতে পারে, সারারাতের জন্য নিশ্চিন্ত, সকালে গিয়ে নিয়ে আসলেই হবে। দশ টাকা নেয়।

খুব ভালো কথা। দড়িদড়া খুলে লাগেজ রুমে পাঠিয়ে আমি হোটেলের একটা ছেলেকে নিয়ে গেলাম পার্কিং-এ গাড়ি রাখতে। গাড়ি ছেড়ে আসার সময়ে ট্রিপমিটারের রিডিং দেখলাম। আজ সকাল থেকে চলেছি ৩০৬ কিলোমিটার। পার্কিং লট হোটেলের খুব কাছেই, হাফ কিলোমিটার হবে। হেঁটে হেঁটে ফিরে এলাম। চিকেন কোর্মা আর তন্দুরি রুটি দিয়ে ডিনার। হোটেলে খোঁজ নিলাম, জোজিলা পাস সম্বন্ধে ওদের কাছে আলাদা কোনও তথ্য নেই, খোলাই আছে।

দুদিনে একলা জার্নি হল প্রায় নশো কিলোমিটার। কাল শেষ করেছিলাম গরমে ঝলসে, আজ শেষ হল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে।

ভরপেট খেয়ে ঘরে এসে লেপ মুড়ি দিতেই ঘুম নেমে এল দুচোখ জুড়ে। আজ আর কোনও ট্রাক আমাকে তাড়া করে বেড়াল না ঘুমের মধ্যে। শান্তির ঘুম দিলাম। কাল সকালে উঠে প্রথম বরফ দর্শন হবে। জোজিলা পাস।

200ns


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.