[পর্ব ১], [পর্ব ২] এবং [পর্ব ৩] -এর পরে …
১লা জুন ২০১৫ – তৃতীয় দিন
ঘুম ভাঙলেও আজ আর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। প্রথম দিন ছশো, দ্বিতীয়দিন তিনশো কিলোমিটারের পর আজ চাপটা কম। আজকের টার্গেট দুশো কিলোমিটার। কারগিল। যদি জোজিলা পাস খোলা থাকে, তা হলে আরামসে হয়ে যাবে। তবে, খুব সত্যি কথা বলতে – প্রথমদিনে যে জোশটা ছিল, আজ আর সেই জোশ নেই। বাইকের ভিউ ফাইন্ডার ভেঙে গেছে কাল, লাগেজ নিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছি। প্রপার লেহ্ সিটিতে না পৌঁছনো পর্যন্ত বানজি কর্ডের সন্ধান পাওয়া যাবে না। আর লেহ্ এখনও চারশো কিলোমিটার। চারশো পঁচিশ। একলা একলা তৃতীয় দিনেও টেনাসিটি ধরে রাখাটা এইবারে একটু অসম্ভবই মনে হচ্ছে। সারাদিনে, দিনের শেষে কারুর সাথে কোনও কথা বলার নেই।
কী ভেবে বেরিয়ে এসেছিলাম? আজ যখন পেছন ফিরে সেই দিনগুলোর দিকে তাকাই, নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজি। প্রশ্নটা অনেকে অনেকবার করেছে। কী পাও? কী পাস? কেন ভালো লাগে প্রচণ্ড গরমে বা উদ্দাম ঠাণ্ডায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বাইক চালাতে?
জীবনে এর আগে কখনও একসাথে এতটা বাইক চালাই নি এর আগে। নিতান্তই শহরের মধ্যে ঘোরাঘুরি যতটা হয় – ততটা। কিন্তু যে মুহূর্তে ভোররাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম – মাত্র দুদিন আগে, একটা জেদ যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল ক্রমশ আমাকে। চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম আমি, আমি পারি। আমি একদম ঠিকঠাক সুস্থ মানুষের মত অনেকটা রাস্তা একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইক রাইডিং করে চলে যেতে পারি। আমার কোনও অসুবিধে হয় না।
সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সারা গায়ে টাটানো ব্যথা, কিন্তু সে ব্যথাও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে – সামনে জানলা দিয়ে খানিক দূরের পর আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, কারণ পুরোটা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা পাহাড়। হিমালয়। লাল চক জেগে উঠেছে ভোর ভোর। ঠেলাগাড়িতে করে এদিক ওদিক যাচ্ছে সবজি, প্যাকিং বাক্স, দোয়ানপাট খুলব খুলব করছে। ফুলের মত সুন্দরী সুন্দরী বালিকারা তিনচারজনের দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে চলেছে স্কুলের দিকে। পোশাক তাদের আকাশী নীল। কে বলবে দেখে, এই লাল চকে কত রক্তের দাগ শুকিয়েছে?
এখনও লেহ্-যাত্রী কোনও বাইকার দেখতে পেলাম না। অবশ্য, শ্রীনগর পর্যন্ত দেখতে পাওয়াও মুশকিল, ম্যাক্সিমাম অর্ডিনারি টুরিস্ট এই পর্যন্ত আসে সারা ভারত থেকে। সাধারণ “কাশ্মীর” বেড়াতে আসা টুরিস্ট। লেহ্-র যাত্রীদের আলাদা করে দেখতে পাওয়া যাবে সোনমার্গ ছাড়াবার পরেই।
হোটেল থেকে বেরোলাম। হাল্কা সুন্দর একটা ঠাণ্ডা আমেজ চারদিকে, আর ভিজে ভিজে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা ভিজে। ফুটপাথ ভিজে। সেখানে নীলচে পাহাড়ের ব্যাকড্রপে জলপাই পোশাকে সেনারা বড়ই বেমানান লাগছে। বরং নীল সালওয়ার কামিজে স্কুলবালিকারা অনেক বেশি ম্যাচিং।
পার্কিং লট থেকে বাইক নিয়ে এলাম। একবার সুইচ টিপতেই গর্জন করে উঠল – বাইক পুরো ফিট। আমারই গা-গতরে ব্যথা। আবার টেনে-টেনে নাইলন দড়ি দিয়ে সেই বাঁধনপর্ব সারলাম। সিকিনীকে একটা ফোন করে প্রায় নটা নাগাদ যাত্রা শুরু করলাম। এখনও খিদে পায় নি, সোনমার্গ এখান থেকে আশি কিলোমিটার, একেবারে সেইখানে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া করব। গতবারে স্টপেজ দিয়েছিলাম সোনমার্গে, ঘোড়ায় চেপে গেছিলাম মন্দাকিনী গ্লেসিয়ার দেখতে, ফিরে এসে ওখানকার রেস্টুরেন্টে গরমাগরম খাবার খেয়ে ঠাণ্ডা কাটিয়েছিলাম।
আগের বারে শ্রীনগর থেকেই বাই রোড জার্নি শুরু করেছিলাম। একবার এন এইচ ওয়ানটা ধরে ফেলতে পারলেই আর কোনওদিকে বাঁকাবাঁকি নেই, সোজা লে। কিন্তু, সেই ন্যাশনাল হাইওয়েতে পৌঁছব কী করে? মোবাইলের মাউন্ট পরশু ভেঙে গেছে, সেই থেকে আর জিপিএস দেখে বাইক চালানোর উপায় নেই। মোবাইল পকেটে। কাল রাতে অনেককে জিজ্ঞেস করে অনেকটা ডাইভার্সন নিয়ে লাল চকে এসে পৌঁছেছিলাম। বেরোতে গেলে কোথা দিয়ে বেরোব? প্রথমে এক লোকাল কাশ্মীরিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে একটা রাস্তা দেখাল। সেইখান দিয়ে অনেকটা যাবার পরে মনে হল আবার জিজ্ঞেস করা দরকার। রাস্তার মোড়ে এক মিলিটারি দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম। এইভাবে খানিক জিজ্ঞেস করে করে এগোতে এগোতে মনে হল, এভাবে হচ্ছে না, একেকজন একেক দিকের রাস্তা বলছে। মোবাইল মাউন্টও আর নেই যে জিপিএস দেখে দিক ঠিক করব। কী আর করা, পকেটে মোবাইল রেখে জিপিএস অন করে কানে হেডফোন গুঁজলাম। তারপরে ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে করতে একটা চকে এসে পৌঁছলাম, চকের মাঝে একটা সাইনেজে লেখা গান্ডেরবাল, আর হজরতবাল। দুদিকে দুটো অ্যারো চিহ্ন দেওয়া।
আমাকে নিতে হবে গান্ডেরবালের রাস্তা। সেই রাস্তা নিয়ে আরও এক দুজনকে জিজ্ঞেস করে কনফার্মড হলাম যে এই রাস্তাটাই সোনমার্গে যায়। চোদ্দ পনেরো কিলোমিটার যাবার পরে মনে হল হাইওয়ে তো দূর, আমি মনে হচ্ছে একটা গ্রামে ঢুকে পড়েছি, সরু রাস্তা, ভাঙাচোরা, গাছপালা খুব বেশিবেশি। এমন তো হবার কথা নয়! আবার থামলাম, আবার জিজ্ঞেস করে জানলাম, পাঁচ কিলোমিটার পেছনে একটা কাট ছিল, সেখান থেকে ডানদিক নিতে হত। নাকি সাইনেজ ছিল, আমি মিস করে গেছি।
ইতিমধ্যে ঝাঁকুনি খেয়ে আমার সতীশ শাহ আবার লুজ হয়ে গেছেন। আবার দড়ি খুলে আবার বাঁধলাম। এখন আমি ফ্রাস্ট্রেশনের সীমা পার করে এসেছি। লোকজনের উৎসুক চাহনি আর গায়ে মাখি না। বাঁধা শেষ করে আবার ফেরত, এবং হ্যাঁ, পাঁচ কিলোমিটার পিছিয়ে সেই মোড় এবং সেখানে দিকনির্দেশ এইবারে খুঁজে পেলাম। ব্যস, খানিক এগোতেই ন্যাশনাল হাইওয়ের সাইন দেখতে পেয়ে গেলাম। মাঝখান থেকে ঘন্টাদুয়েক বরবাদ হল।
এইবারে আর কোনওদিকে বাঁকাবাঁকি নেই, সো-জা সোনমার্গ। আঁকাবাঁকা সুন্দর রাস্তা চলেছে, ইন ফ্যাক্ট আগেই যেটা বোঝা উচিত ছিল, সকাল থেকে দলে দলে টুরিস্টবোঝাই গাড়ি চলেছে সোনমার্গের দিকে, যে কোনও একটা ট্যাক্সিকে গান্ডেরবাল থেকে ফলো করলেই হয়ে যেত। যাই হোক, আস্তে আস্তে উচ্চতা বাড়ছে, হাল্কা হাল্কা পাহাড় শুরু হচ্ছে আবার, আমি ঠাণ্ডা আরামদায়ক হাওয়া কাটতে কাটতে এগিয়ে চলেছি। তিন বছর আগেও এই রাস্তায় এসেছি, মনে পড়ছিল পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার কথা, এবারে দেখি সেই নদী জমে বরফ হয়ে জমে আছে ওপরের দিকে, আর নিচের দিকে গর্জন করে ছুটে চলেছে শ্রীনগরের দিকে।
বেলা বারোটায় সোনমার্গ পৌঁছলাম। সেই ঘোড়া নিয়ে ঘোড়াওলাদের ভিড়, মন্দাকিনী গ্লেসিয়ার নিয়ে যাবার জন্য। তাদের পেরিয়ে আরেকটু এগোলাম। ডানদিকে একটা হোটেল ছিল, যেখানে বৃষ্টিতে তুমুল ভিজে এসে আমরা গরম স্যুপ খেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম আগের বারে। … সেই হোটেলটা লোকেট করতে পারলাম না আর, অনেক কনস্ট্রাকশন হয়ে গেছে রাস্তার দুপাশে। আর মিলিটারিদের সংখ্যাধিক্য।
মূল ভিড়টা পেরিয়ে একটু এগিয়ে বাঁদিকে বেশ কয়েকটা খাবার জায়গা। সারি সারি মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে, বুলেট, অ্যাভেঞ্জার, পেছনে সাইডে লাগেজ বাঁধা। লেহ্-র যাত্রী। আমিও দাঁড়ালাম। দোকানে ঢুকে ধোসা আর কফি অর্ডার করলাম। আসলে দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ ছিল আলু পরাঠা, কিন্তু আমি যাত্রাপথে এই তেল চুপচুপে উত্তরভারতীয় আলু-পরাঠা সযত্নে অ্যাভয়েড করে চলি, মসালা ধোসা তাচ্চেয়ে অনেক সেফ বেট।
খাবার আসতে আসতে সিকিনীকে হোয়াটস্যাপে মেসেজ করলাম, এর পরে জোজিলায় ঢুকব, নেটওয়ার্ক থাকবে না, নেটওয়ার্ক এলেই আমি ফোন করে দেব, যেন চিন্তা না করে। বাড়িতে বাবাকেও ফোন করে নিজের খবরাখবর দিলাম। এর পরে ফোনে সিগন্যাল মিলবে সে-ই কারগিলে।
আকাশে ভর্তি মেঘ, টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে, তবে তার জন্য বাইরে বসা আটকাচ্ছে না। আমার সামনের টেবিলেই দুজন বসে মন দিয়ে মসালা ধোসা খাচ্ছে, একটি টিপিকাল তামিল, কুচকুচে কালো, ঝাঁটার মত গোঁফ, অন্যজন নর্থ ইন্ডিয়ানদের মতই দেখতে। পুরো দস্তুর রাইডারের পোশাক পরনে, নীগার্ড এলবো গার্ড লাগানো, মাথায় ফেট্টি – তামিলের মাথায় হলুদ রঙের, অন্যজনের মাথায় মাল্টিকালার।
জয়গুরু, এইবারে মনে হচ্ছে সাথী জুটে যাবে। ওদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমি এগিয়ে যেচে আলাপ করলাম, গোয়িং টু লে? দুজনেই সমস্বরে বলল, ইয়েস ইয়েস, অতঃপর হিন্দিতে, আপ ভি দিল্লি সে আ রহে হো?
আপ ভি? মানে এরাও দিল্লি থেকে? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও দিল্লি থেকে। তামিল টাইপের ছেলেটি এইবারে জিজ্ঞেস করল, তো বস আজ কা কেয়া ঠিকানা রাকখা হ্যায় – কারগিল?
আরেব্বাস, তামিল তো বেশ চোস্ত হিন্দি বলে! এতটুকু টান নেই! বললাম, হ্যাঁ, কারগিলই টার্গেট। অতঃপর কিছু খেজুর।
– তোমরা দুজনই বেরিয়েছো?
– হ্যাঁ, তুমি একাই বেরিয়েছো?
– হ্যাঁ, চলো তা হলে একসাথেই যাওয়া যাবে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা তো এইবারে এগবো, তুমিও খেয়ে নিয়ে এগোও। যদি জোজিলা বন্ধ থাকে তো মুখেই দেখা হয়ে যাবে, নয় তো দ্রাস বা কারগিলে দেখা হবে।
– তোমাদের ফোন নাম্বারটা …
তামিল এগিয়ে এল, নিজের ফোন নাম্বার দিল, জিজ্ঞেস করলাম, কী নামে সেভ করব?
– গুরদীপ। গুরদীপ সিং।
অ্যাঁ, এ তামিল নয়? সর্দার??? … মুখে কিছু বললাম না, আমিও আমার ফোন নম্বর দিলাম, নাম বললাম। নাম বলামাত্র পেছন থেকে, “এই যে বাবা, তুমি কি লাদাখ যাচ্ছো?”
পেছনে তাকিয়ে দেখি এক বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোক, পরিবার সমেত পেছনে দাঁড়িয়ে, পদবিটি শুনে বাঙালি বলে ঠাউরেছেন আমাকে। “তুমি কি ভাই কলকাতা থেকে আসচো?” “ও, দিল্লিতেই থাকো?” “তুমি দিল্লি থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে এসচো?” “একা এসচো?” “একা একা এতটা যেতে পারবে?”
স্পেল শেষ হতে হতে গুরদীপ আর তার বন্ধু বাইক স্টার্ট করে ভোঁ কাট্টা। আমার থালায় অর্ধেক ধোসা তখনও পড়ে। দ্বিতীয় সঙ্গীর নাম জানা হল না।
*** *** ***
খাওয়া শেষ করে বাইকে স্টার্ট দিলাম। এইবারে জোজিলা পাস। এখান থেকে দ্রাস ষাট কিলোমিটার। মাঝামাঝি পড়বে জোজিলা।
খানিক পরেই ভালো রাস্তার শেষ, ভাঙাচোরা রাস্তা শুরু। ধীরে ধীরে ওপরে ওঠা, সামনে পেছনে মিলিটারি ট্রাকের কনভয়। তাদের কাটিয়ে কাটিয়ে এগনো, হঠাৎ বোল্ডারে চাকা পড়ে লাফিয়ে উঠতেই পেছনে হাত রেখে অনুভব করা, সতীশ শাহের ডেডবডি কতটা হেলে পড়েছে, আরও কিছুদূর চালানো যাবে, নাকি এখনই দাঁড়াতে হবে। দুপাশে ইতস্তত বরফ, তারপরেই জোজিলা পাস এসে গেল। সেই চেনা টাইল বসানো রাস্তা, দুদিকে বরফের দেওয়াল। তিনদিনের জার্নির মাথায় প্রথম বরফ, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় দূরত্বে।
কিন্তু জোজিলার বরফ আর আগের মত দুধসাদা নেই। বিরক্তিকর টুরিস্টের দল এখন জোজিলা অবধি চলে এসেছে, তাদের সঙ্গে এসেছে স্লেজ, ম্যাগি, চা-কফি, ধোসা, ফটোগ্রাফার। বরফে কালচে কালচে ছোপ।
… বেশ খানিকটা যাবার পরে জোজিলা শেষ হল, কোথাও আটকাবার কোনও সীন নেই, তবে মাঝে কয়েকটা স্ট্রেচ পার হতে গিয়ে চাপ হয়েছিল। রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে বরফগলা জল। জলের নিচে এবড়োখেবড়ো বোল্ডার। সে জল কোথাও সামান্য, কোথাও গভীর। একবারও ক্লাচ না টিপে সোজা ফার্স্ট গিয়ারে গাড়ি বের করতে হবে, ব্যালেন্স ঠিক রেখে। তৈরি ছিলাম না, জুতো ভিজল, মোজাও ভিজল, তবে পেরিয়ে গেলাম।
জোজিলা এমন কিছু উঁচুতে নয়, মাত্রই এগারো হাজার ফিট, তবু কীভাবে যেন এখানে বরফ জমে, অথচ এর থেকেও উঁচু পাস আছে পরে, সেখানে বরফ জমে না। যাই হোক, নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেলাম, এইবারে ডিসেন্ড। সেই একই রকমের ভাঙাচোরা রাস্তা। অনেকটা যাবার পরে মনে হল এইবারে আবার লাগেজ নতুন করে না বাঁধলেই নয়, দড়ির প্রতিটা পাক আলগা হয়ে এসেছে।
এক নির্জন জায়গায় দাঁড়ালাম। দড়ি খুলে ব্যাগ গুছিয়ে তার ওপরে রেনকভার চাপাতে জান বেরিয়ে গেল, পলিথিন শীট বাগে আনতে পারছি না, এত তীব্র বরফিলা হাওয়া চলছে। আমাকে শুদ্ধু উড়িয়ে নিয়ে যায় আর কি। দুটো গাড়ি স্লো হয়ে গেল আমার কসরত দেখে, তবে ইন্টারফিয়ার করল না। এর পরে এসে দাঁড়াল একটা সাদা-কমলা হন্ডা সিবিআর বাইক। রাইডারের মাথায় হেলমেট, হেলমেটের ওপরে গো-প্রো লাগানো।
সে এসে শুধলো, ইউ নীড এনি হেল্প?
(বাবা, জিগেস করেছো, এতেই বর্তে গেছি, এ হেল্প করা তোমার কম্মো নয়।) ওকে হেসে বললাম, না না, ঠিক আছে, আমি জাস্ট লাগেজ বাঁধছি।
– শিওর তো? আমি তা হলে এগোই?
– শিওর। এগোও।
অনেক কসরত করে আবার বাঁধা হল, বেশ খানিকটা এগিয়ে পাহাড় শেষ হল, ফ্ল্যাটল্যান্ড। রাস্তাও একটু ভালো হল। খানিক এগিয়ে দেখি সেই দুই মূর্তি, গুরদীপ আর তার সঙ্গী রাস্তার ধারে বাইক রেখে ফটোগ্রাফি করছে। সামনে চরছে একপাল ভেড়া।
তাদের দেখে আমিও একগাল হাসলাম, আমাকে দেখে তারাও একগাল হাসল। এইবারে সঙ্গীর নাম জানলাম। সুমিত শর্মা। চালাচ্ছে অ্যাভেঞ্জার, আর গুরদীপ চালাচ্ছে বুলেট। একটি আড়াইশো একটি পাঁচশো সিসি। আমার দুশো সিসির পালসারের ক্ষমতা কী তাদের সঙ্গে দৌড়য়?
অতএব তাদের সাথে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম, রাস্তায় একবার দেখা পেয়েছি, আর ছাড়ান নেই। ক্যামেরা বের করে আমিও তাক করতে লাগলাম ভেড়ার পালকে।
খানিক পরে আমরা একসাথেই শুরু করলাম। গুমরি বলে একটা চেকপোস্ট এল, সেখানে আমাদের সব্বাইকে নিজের নাম, গাড়ির নাম আর ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর রেকর্ড করতে হল। তারপরে আবার শুরু হল খারাপ রাস্তা। সুমিত আর গুরদীপের বুলেট আর অ্যাভেঞ্জার লাফাতে লাফাতে অদৃশ্য হয়ে গেল সামনে, আমি পেছনে টলমলায়মান লাগেজের পাহাড় নিয়ে ল্যাগব্যাগ করতে করতে এগোলাম। প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার সেই খারাপ রাস্তা যখন শেষ হল, দেখি সামনেই আমার সেই পরিচিত বোর্ড, ওয়েলকাম টু দ্রাস। তিন বছর আগে দেখে গেছিলাম।
সামনেই বাঁদিকে একটা স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম। সামনে বেশ কয়েকটা বাইক দাঁড় করানো, ওর মধ্যেই দুটো মনে হল গুরদীপ আর সুমিতের, কিন্তু আশেপাশে তাদের দেখতে পেলাম না। মোবাইলে এখানে নেটওয়ার্ক নেই, দ্রাসে শুধু বিএসএনএল চলে। তাই ভাবলাম একটু এগিয়েই যাই, সাত কিলোমিটার দূরেই কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল, সেখানে ওরা নিশ্চয়ই দাঁড়াবে, ওটা ফাঁকা জায়গা, স্পট করা সুবিধে হবে।
কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল আমার আগের বারেই দেখা। সেবারে রাতে ছিলাম দ্রাসে, মিলিটারির আতিথ্যে। সুইস মেড স্লিপিং ব্যাগে সেই প্রথম শোবার অভিজ্ঞতা ছিল। পরদিন সকালে দ্রাসের মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতালে মিলিটারি ব্রেকফাস্ট, সঙ্গে সেই অসহ্য ফ্যামিলি চৌহান অ্যান্ড কোংয়ের কাঁদুনি। … যাক, সে সব এখন অতীত।
মেমোরিয়ালে পৌঁছলাম, না, ওরা আসে নি। আলগোছে ভেতরে গিয়ে দুটো ক্লিক নিলাম। নতুন কিছু তো দেখার নেই। মানে দেখার অবশ্যই আছে, এর মিউজিয়ামটা, তবে সেটা আগের বারেই সুন্দরভাবে দেখে এসেছি। আবার যাবার কোনও মানে হয় না। তাই দশ মিনিট পরেই বেরিয়ে এলাম।
বেরিয়ে আসতেই দেখি সেই হেলমেটে গো-প্রো লাগানো ছেলেটি এসে দাঁড়িয়েছে। বাইকের পেছনে লাগেজ বাঁধা, সেসব ছেড়ে ভেতরে যাবে কিনা, ভাবছিল। ওকে বললাম, যাও যাও দেখে এসো, আমি বাইরে আছি। তুমি নিশ্চিন্তে লাগেজ ছেড়ে যাও।
ছেলেটির নাম জীবন, পুণের ছেলে, চাকরি করে চেন্নাইতে। ট্রেনে করে বাইক এনেছে চণ্ডীগড়, সেখান থেকে চালিয়ে আসছে। একা। …জীবন গেল ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে, আমি বাইক পাহারা দিতে দিতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম।
খানিক বাদেই এসে পৌঁছলো গুরদীপ আর সুমিত, ওরা নাকি দ্রাসে আমাকে খুব ডাকাডাকি করেছিল এটিএমের সামনে, আমি শুনতে পাই নি। ওদেরও বললাম, যাও দেখে এসো, আমার তো অলরেডি দেখা, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।
ওরাও ভেতরে গেল। তার পরে দেখি, বুলেটে করে আরও দুটো টীম এসে দাঁড়াল। মিড ফর্টিজের দু জোড়া দম্পতি। আলাপ করলাম, মথুরা থেকে বাইক চালিয়ে এসেছেন এক দম্পতি, অন্য দম্পতি এসেছেন চণ্ডীগড় থেকে।
ততক্ষণে গুরদীপ, সুমিত, জীবন সবাই চলে এসেছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিক আলাপ পরিচিতি হল, গুরদীপ একগাল হেসে বলল, আপনি সিকিস্যার, আপনার নাম না বলা পর্যন্ত আপনাকে আমি হিমাচলি বা কাশ্মীরি ভেবেছিলাম। আপনাকে দেখে তো বাঙালি বলে মনেই হয় না! আমিও হে-হে করে বললাম বাপু তোমার ওই ঝাঁটার মত গোঁপ আর হামলে পড়ে ধোসা খাওয়া দেখে আমিও তো তোমাকে তামিল ভেবেছিলাম। নাম শুনে বুঝলাম সর্দার।
মোদ্দা কথা হল, আমি ওদের প্রথমেই বলেছি লেহ্ লাদাখ আমার অলরেডি ঘোরা আছে, তাই ওরাও খুব ইচ্ছুক ছিল আমার সাথে পেয়ার আপ করবার, এদিকে আমিও একা চলে চলে হেজে যাচ্ছিলাম, আমারও খুব ইচ্ছে ছিল ওদের সাথে জুড়ে যাবার। তো, কারগিল ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে এসে সবাই নিজের নিজের মনোবাসনা ব্যক্ত করে হাল্কা হল। এরা সবাই প্রথমবারের জন্য লাদাখ এসেছে, এদিকে আমার তো দ্বিতীয়বার, রাস্তা পুরো চেনা।
বিকেল সাড়ে ছটা নাগাদ স্টার্ট করলাম সবাই মিলে। এইবারে সবাই একসাথে যাবে কারগিল পর্যন্ত। আর ষাট কিলোমিটার। সে এক দেখার মত দৃশ্য। সামনে একটি দুশো সিসির পালসার চলেছে, পেছনে লাইন লাগিয়ে তিনটি সাড়ে তিনশো আর পাঁচশো সিসির বুলেট, একটি অ্যাভেঞ্জার এবং একটি হন্ডা সিবিআর।
রাত আটটা নাগাদ কারগিল ঢুকলাম। আবার একটা পুলিশ পোস্টে গিয়ে এন্ট্রি করতে হল সবাইকে, সামনেই একটা হোটেলে মথুরা আর চণ্ডীগড়ের দম্পতি চেক ইন করে গেলেন। আমরা একটু এগিয়ে কারগিল শহরের শেষমাথায় অন্য একটা হোটেল খুঁজে নিলাম। এটা জানস্কার রোডের ভেতর, এই রাস্তা দিয়ে জানস্কার ভ্যালি যাওয়া যায়। সে অবশ্য অন্য রুট, আরও বেশ কদিনের ছুটি লাগে এ পথে যেতে। আপাতত আমাদের প্ল্যানে নেই।
রুম পছন্দ করে লাগেজ খুলতে বেরোলাম। আজ অন্তত আর একা থাকার চাপ নেই। আমি আর জীবন একটা রুম শেয়ার করব, ওদিকে সুমিত আর গুরদীপ আরেকটা রুম নিল। রুমও বেশ শস্তা – আটশো টাকা মাত্র। সুন্দর ঘর, এক রাতের থাকার জন্য বেশ ভালো। গরম জলও আছে। রাত প্রায় পৌনে নটা বাজছে।
দড়িদড়া সবে খুলেছি কি খুলি নি, সিকিনীর ফোন। কারগিলে এয়ারটেল আছে, তাই নেটওয়ার্কও আছে। ফোন রিসিভ করা মাত্র হাঁউমাউখাঁউ, খুব করে আমাকে ঝাড়ল, আমি কেন দ্রাসে খবর দিই নি পৌঁছে। … মানে? খবর দেব কেমন করে? দ্রাসে তো বিএসএনএল ছাড়া নেটওয়ার্কই নেই! – তা হলে আমি হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছিলাম কেন দ্রাসে পৌঁছে খবর দেব? দুপুর দেড়টায় সোনমার্গ ছেড়ে দ্রাস পৌঁছতে তো এতক্ষণ লাগার কথা নয়, এদিকে আমার ফোন নট রিচেবল, সুখদীপের নম্বরও ছেড়ে আসি নি (বাড়িতে এখনও জানে আমি সুখদীপের সাথে চলেছি), প্রচণ্ড চিন্তা করছিল সবাই।
আমি লিখেছি দ্রাসে পৌঁছে কল করব? মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখি, এ বাবা, তাড়াহুড়োয় দুপুরে সোনমার্গে বসে কারগিল লিখতে গিয়ে ভুল করে দ্রাস লিখে ফেলেছি, তাই থেকে বিপত্তির সূত্রপাত। যাই হোক, ভেরিভেরি সরি মশলা খাবি ইত্যাদি বলে সিকিনীকে শান্ত করে ওকে এইবারে গুরদীপের নম্বরটা দিয়ে দিলাম, দরকার হলে এই নম্বরে যেন ফোন করে। এটাও বললাম, রাস্তায় আরও কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছে, আমরা একসাথেই লেহ্-র দিকে এগোচ্ছি।
কারগিলে নেটওয়ার্ক আছে বটে, তবে খুব একটা ভালো চলে না। খানিক বাদেই ফোন থেকে ইনকামিং আউটগোয়িং বন্ধ হয়ে গেল, কল করাও যায় না, কল আসেও না। জীবন – যার সাথে আজ রুম শেয়ার করছি, সে এসেছে একটি প্রিপেড নাম্বার নিয়ে, এদিকে পুরো জম্মু-কাশ্মীরে তো প্রিপেড নাম্বার চলে না, সে খবর জীবনকে কেউ বলে দেয় নি, সে কেমন ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমাকে তো কেউ বলে দেয় নি এখানে শুধু পোস্টপেড চলে। কী আর বলব, এ তো বেসিক নলেজ, কাশ্মীরে প্রিপেড রোমিং হয় না। দেখলাম, ফোন না গেলেও এসেমেস যাচ্ছে, আসছেও। রাতের দিকে আরেকবার সিকিনীর সাথে কথা বলে নিলাম, (সুখদীপের কেসটা বলি নি অবশ্য, ওটা লেহ্ থেকে ঘুরে এসেই একেবারে বলেছি,) জীবনের সাথেও ওর বাড়ির লোকের কথা বলিয়ে দিলাম। বাচ্চা ছেলে। একলা একলাই বেরিয়েছে, একলাই ঘুরবে। কাল আমরা লেহ্ পৌঁছব, পরের একদিন রেস্ট নেব, জীবন নাকি পরদিনই খারদুং লা বিজয়ে বেরোবে, রেস্ট নেবে না। অনেক বারণ করলাম, কে শোনে – ওর এক কথা, আমার ছুটি কম। তা বাপু এত কম ছুটি নিয়ে আসা কেন! … যাই হোক, খাবারটিও বেশ জম্পেশ ছিল, জীবন নন-ভেজ, দুজনে মিলে চিকেন কালিয়া আর গরম গরম রুটি খেয়ে গরম জলে চান টান সেরে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুম দিলাম।
এক হাজার কিলোমিটার একা একা চলার পরে দেখলাম একা চলাটা মোট্টেও উপভোগ্য নয়। ঠিক এক হাজার কিলোমিটারের মাথায় সঙ্গীদের পেয়েছি। জীবন দুদিন বাদেই আলাদা হয়ে যাবে, কাল সকালে গুরদীপ আর সুমিতের সাথে বসে প্ল্যান ছকতে হবে। দরকার হলে আমার প্ল্যান সেই মত মডিফাই করিয়ে নেওয়া যাবে।
আমি যতক্ষণ ঘুমোচ্ছি, আপনারা ভিডিও দেখুন।
কাল সকালে আবার যাত্রা শুরু। লে আর মাত্র দুশো পঁচিশ কিলোমিটার।