[পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫] এবং [পর্ব ৬] -এর পরে …
৪ জুন ২০১৫ – ষষ্ঠ দিন
গায়ের ব্যথা ট্যথা সব মরে গেছে, লে-র হাওয়ার এমনই গুণ। সক্কাল সক্কাল উঠে পড়লাম। বাড়তি লাগেজ সব হোটেলে জমা রেখে একটা করে লাগেজ নিজের নিজের বাইকের পেছনে বেঁধে নিলাম। আমার পেট্রলের ক্যান সুমিতের জিম্মায়। লে-তে সবার বাইক এবং পেট্রলের ক্যান ভর্তি করে রওনা দেব প্যাংগং-এর উদ্দেশ্যে।
যাই হোক, সোয়া সাতটায় সব্বাই রেডি। বেরিয়ে পড়া গেল। দুটি বুলেট, একটি অ্যাভেঞ্জার এবং একটি পালসার বেরিয়ে পড়ল কারুর উদ্দেশ্যে। ম্যাপ দেখুন, বুঝতে পারবেন রুটটা। কারু, সাক্তি, চাং লা, ডুর্বুক, তাং শে হয়ে লুকুং থেকে শুরু হচ্ছে প্যাংগং। আর লুকুং-এর একটু আগে ফোবরাং গ্রাম দিয়ে মারসিমিক লা যাবার রাস্তা।
প্রথমে লে-তে পেট্রল ভরা। সবাই একে একে ভরলাম বাইকের ট্যাঙ্ক আর পেট্রলের ক্যান। এগোতে যাবো দাম মিটিয়ে – আচমকা কানে এল বিবেকের আর্তনাদ, ওহ শিট্, আমার পেট্রলের ক্যান ফুটো হয়ে গেছে।
পেছনে তাকিয়ে দেখি বিবেকের বাইকের নিচেটা পেট্রলে ভিজে গেছে – কিছু না হোক হাফ লিটার পেট্রল বেরিয়ে গেছে। হাত বুলিয়ে ফুটোটা লোকেট করা গেল, দশ লিটারের ক্যান। এইবারে বন্ধ হবে কী করে?
গুরদীপ বের করল একটা সেলোটেপের রিল। তার সাথে বেরলো এক ধরণের গ্লু, মেনলি সাইকেলের টিউবের পাংচার বন্ধ করা হয় যে গ্লু দিয়ে। মুচিরাও সম্ভবত এই গ্লু ইউজ করে। তাই দিয়ে চেষ্টা করা হল খানিক। কিন্তু রবারের ফুটো আটকানোর গ্লু দিয়ে কি পলিথিনের ফুটো বন্ধ করা যায়? যায় না। তাও ওই গ্লু আর সেলোটেপ খানিক মাখামাখি করে মনে হল একটু কমেছে পেট্রলের আউটফ্লো। গোটা ক্যানটাকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে আবার কেরিয়ারে বেঁধে সাড়ে আটটা নাগাদ যাত্রা শুরু হল।
মাখনের মত রাস্তা পেরোতে থাকলাম। গাছে ছাওয়া বুলেভার্ড, কখনও ন্যাড়া দিগন্তবিস্তৃত জমির মাঝখান দিয়ে চমৎকার রাস্তা – তার মাঝে পেরিয়ে গেল শে প্যালেস, ঠিকশে মনাস্ট্রি – সে যাক, ও সব ফেরার পথে দেখা হবে। ইন ফ্যাক্ট, আমার সবই দেখা।
সাড়ে নটায় কারু পৌঁছলাম। সামনে সাইনবোর্ডে লেখা – প্যাংগং লেক – ১১৩ কিমি।
সাইনবোর্ডের ঠিক পেছনে ড্রুক রেস্টুরেন্টে বসে পড়লাম সকালের খাবার খেতে। যতটা পারি পেট ভরিয়ে নিই।
রেস্টুরেন্টের একটু সামনেই রাস্তা বাইফার্কেট করে গেছে। বাঁদিকের রাস্তা আমাদের নিয়ে যাবে প্যাংগং। সব চেনা। সব।
খেতে খেতেই কে যেন বলল, আপনাদের কারুর পেট্রলের ক্যান থেকে পেট্রল লিক হচ্ছে। তড়িঘড়ি বেরিয়ে দেখি, সেই বিবেকের দশ লিটার থেকে তখনও চুঁইয়ে পড়ছে পেট্রল। এদিক সেদিক দোকানে খোঁজ করে গোটা তিনেক এক লিটারের খালি জলের বোতল জোগাড় করা গেল। তিন লিটার পেট্রল বের করে নেওয়া গেল, কিন্তু এখনও আরও পাঁচ লিটার মত রয়েছে। দেখা যাক, একটু এগিয়ে সবাই না হয় নিজের নিজের বাইকের ট্যাঙ্কে আবার একটু একটু করে পেট্রল ঢেলে নেবে। লে থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার এসেছি, এক লিটার করে পেট্রল তো সবারই কমেছে।
কিছু বিস্কিটের কার্টন যোগাড় করে তাই দিয়ে নিজেদের ক্যানগুলোকে গার্ড করে নিল সুমিত আর গুরদীপ, বাই চান্স কোনওভাবে যেন লোহার ফ্রেমে ধাক্কা লেগে তাদের ক্যান (আমারও একটা ক্যান) ফুটো না হয়ে যায়।
জোগাড়যন্তর করে এগনো হল। একটু এগোতেই পুলিশ পোস্ট – সেখানে ফর্ম ভরে জমা দিতে হল। একটা ফর্মেই সবার নাম লিখে জমা করে দেওয়া যায়। তারপরে এগনো। সাক্তি পেরিয়ে জিংরাল বলে একটা আর্মি পোস্ট আছে – আগের বারে চৌহানের পাল্লায় পড়ে এখানে সবাই ব্রেকফাস্ট করেছিলাম। ক্রমশ জিংরালও এসে গেল। সেই আর্মি ক্যাম্প, সেই রাস্তা, আর সেই অলটিটিউড মার্কিং স্টোন।
চারপাশ থেকে বরফমাখা পাহাড়েরা উঁকি মারছে। চাং লা পাস এখান থেকে মাত্র তেরো কিলোমিটার। পিকগুলো দেখলে মনে হয় – কেউ যেন খাবলা খাবলা নুন ঢেলে দিয়েছে ওপর থেকে।
জিংরালে দশ মিনিটের বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম – কিন্তু খানিক এগিয়েই দাঁড়াতে হল। সামনে গাড়ির লাইন। ধস নেমেছে, ব্রো রাস্তা সাফ করছে। টু হুইলার হবার এই এক সুবিধে – জ্যাম থাকলেও পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার মত রাস্তা থাকে। অতএব, গোটা তিরিশ গাড়ির পাশ দিয়ে খাদের ধার বরাবর অনায়াসে এগিয়ে চললাম আমরা – থামলাম একেবারে সেইখানে গিয়ে, যেখান থেকে রাস্তা আটকানো। সামনে থেকে দেখতে পেলাম বুলডোজার দিয়ে রাস্তা সাফ করা (ছবি তুলি নি যদিও)। খানিক বাদেই রাস্তা খুলে গেল। আমরা এগোতে শুরু করলাম। ক্রমশ অল্প খারাপ রাস্তা, তারপরে বেশ খারাপ, তারপরে অসম্ভব খারাপ রাস্তা – তার সঙ্গে ব্রেথটেকিং সব ভিউ, দু পাশে বরফের দেওয়াল, তার মাঝখান দিয়ে চলেছি – আমার বাইক এইবারে মনে হল একটু কাহিল হচ্ছে – খালি খালি স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফার্স্ট গিয়ারে চালাচ্ছি, তাও মনে হচ্ছে টানতে অসুবিধে হচ্ছে।
হাই অলটিটিউডে এটা হয়, স্বাভাবিক ব্যাপার, আসলে গাড়ির ইগনিশনের জন্য যেটুকু অক্সিজেন দরকার, সেটাও ওখানে পাওয়া যায় না, তাই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। আবার খানিক পরে স্টার্ট দিলেই চলে। বাকিরা তাদের বুলেট আর অ্যাভেঞ্জার নিয়ে কখন এগিয়ে গেছে টের পাই নি, আমি ধীরেসুস্থে চলতে লাগলাম, উঁচুনিচু মোটাপাতলা পাথরের ওপর দিয়ে। মাঝে কখনও রাস্তাই নেই, জল বয়ে চলেছে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে। এইখানে সেই আমোঘ উপদেশ কাজে আসে, ক্লাচ পে নেহি, গিয়ার পে চালাও। ক্লাচ লাগালেই অ্যাক্সিলারেটর কমাতে হবে, আর সেটা কমালেই এক্সহস্টে জল ঢুকে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবার প্রভূত চান্স। যদিও পালসার ২০০ এনএস-এর এক্সহস্ট আন্ডারবেলি, এতে জল ঢুকে বন্ধ হবার চান্স নেই, তবুও সাবধানের মার নেই, সরাসরি ফার্স্ট গিয়ারে রেখে গাড়ি এগোতে লাগলাম, গোঁ গোঁ করে নিজের প্রচন্ড অপছন্দ জানিয়ে বাইক এগোতে লাগল।
আর তারপরেই সেই দৃশ্য খানিক বাদে। শেষ মোড়টা ঘুরতেই, একটা ছড়ানো চাতাল, ওয়েলকাম টু মাইটি চাং লা লেখা সেই গম্বুজ। জয়গুরু, বাইক চালিয়ে শেষে চাংলা পাসও জয় করে ফেললাম।
লাভবার্ডস –
চাং লা থেকে সামনের দৃশ্য –
আর এই আমার সেলফি –
অ্যাক্কেবারে টেররিস্ট-কাটিং
চাংলা টপে তখন হট্টমেলা বসে গেছে। গাদাগুচ্ছের টুরিস্টের গাড়ি, বাঙালি আর গুজরাতিতে ভরপুর, তারই মধ্যে আমাদের দেখে কোনও কোনও উৎসাহী পার্টি, দাদা একবার আপনার বুলেটের সামনে পোজ দেব? একবার আপনার পালসারে চেপে ফটো তুলব? আপনারা দিল্লি থেকে এসেছেন? …
সকলের বায়না মিটিয়ে পনেরো কুড়ি মিনিট বাদে আমরা এগোলাম। এর চেয়ে বেশিক্ষণ এই উচ্চতায় থাকা বিপজ্জনক। তার ওপরে আকাশ ভর্তি মেঘ, হাল্কা করে স্নো-ফল শুরু হয়েছে। এইবারে ডিসেন্ড শুরু হল।
মোটামুটি স্নো-লাইনটা পার করে নিচে নেমে একটু দাঁড়ালাম। রেনকোট জড়িয়ে নিলাম। আজ আর হাতে কোনও কষ্ট হচ্ছে না, নতুন গ্লাভস সত্যি কাজের জিনিস। আর তেমনি জিনিস এই পালসার। আপহিলসে উঠতে যতটা কষ্ট পায়, ডাউনহিলসে সে একেবারে বাঘের বাচ্চার মত দৌড়য়।বুলেট অ্যাভেঞ্জারকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে গেলাম। বেশ অনেকটা এগোবার পরে মনে হল ভিউ ফাইন্ডারে আমি পেছনে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। কী হল? কত পিছিয়ে পড়ল সবাই?
খানিক এগিয়ে দেখি একটা ছোট্ট তাঁবু ঘেরা ধাবা। সেইখানে তখন এক বিশাল গুজরাতি ফ্যামিলি খাওয়াদাওয়া করছিল, আর ফোটো লিউ ছু, গাড়ি মা আউ ছু করে বিশ্রম্ভালাপ করছিল। সামনে একটা টেম্পো ট্র্যাভেলার দাঁড়িয়ে। আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম।
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, কারুর কোনও পাত্তা নেই। এখানে ফোনের কোনও নেটওয়ার্ক নেই যে কল করব। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, বেশ কিছু গাড়ি বাইক বেরিয়ে গেল আমার সামনে দিয়ে – গুরদীপ-সুমিত-বিবেক-প্রিয়াঙ্কার কোনও পাত্তা নেই।
এইবারে একটু টেনশন হল। কী করা উচিত? অপেক্ষা করব? এগিয়ে যাবো? নাকি পিছিয়ে গিয়ে দেখব? চাং লা থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার এসেছি। কারুর কি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হল? অন্য কিছু ঘটল?
আধঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পরে দূরে দেখা গেল তিনটে চেনা বিন্দু। সেগুলো বড় হতে বুঝলাম তারা দুটি বুলেট এবং একটি অ্যাভেঞ্জার। আমার চেনা। সবাই এসে আমাকে দেখে দাঁড়াল। … কী ব্যাপার? এত দেরি?
জানা গেল, বিবেকের তো বটেই, আমার পেট্রল ক্যানেও ফুটো হয়েছে, পেট্রল লিক করছে। তাই সবাই মিলে নিজের নিজের বাইকের ট্যাঙ্কে তেল ভরে ওই ক্যানটাকে খালি করেছে। আরও একটু তেল ছিল, সেটা আমার বাইকে ঢালা হল। হায় কপাল। লম্বা জার্নিতে শুরুতেই পনেরো লিটারের ক্যান বরবাদ। আশা করি ফিরতে অসুবিধে হবে না। তেল সব মিলিয়ে হয় তো দেড় দু লিটার নষ্ট হয়েছে।
ধাবাতেই সবাই মিলে খানিক খেয়ে নিলাম, দুপুর তখন দুটো বাজে। আড়াইটের সময়ে আবার শুরু। এইবারে সবাই একসঙ্গে।
তাং শে-তে আবার চেকপোস্ট – সেখানে আবার ফর্ম ভরে জমা দিতে হল। এর পরেই ফ্ল্যাট রাস্তা শুরু, পাহাড় শেষ, আর আশেপাশে মারমট দেখতে পাবার চান্সও আছে এর পর। চোখকান খোলা রেখে এগনো শুরু করলাম আবার।
আগের বারে দেখেছিলাম। এই লেক যে উপত্যকায়, তার নাম চাংথাং। চাং লা পাস পেরোবার পরেই অপেক্ষাকৃত সমতল রাস্তা, হাল্কা উঁচুনিচু এই উপত্যকায় কাঠবেড়ালি-ভোঁদড়সদৃশ এই প্রাণীর দেখা মেলে খুব সহজেই। খুব হিউম্যান ফ্রেন্ডলি, চট করে কাছে চলে আসে। বিস্কুট বাদাম দিলে আগ্রহ সহকারে চেটেপুটে খায়।
কিন্তু নাঃ, এ যাত্রায় আমরা মারমট দেখতে পাই নি। তবে ঘোড়া দেখেছি অনেক, জংলি ঘোড়া।
আরও খানিক এগোতে এল সেই পয়েন্ট, যেখান থেকে প্যাংগং লেক-এর প্রথম ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। সকাল থেকে একটানা চালিয়ে সবাই টায়ার্ড, তাই একটু হাত পা ছাড়িয়ে নেবার জন্য দাঁড়ালাম সবাই। কিঞ্চিত ফটোসেশন হল –
মথুরাবাসিনী ভ্যাজ-খুকি আমার কাছ থেকে নীল সানগ্লাসটা চেয়ে নিয়ে চড়ে বসলেন আমার বাইকে।,
তাঁর বয়ফ্রেন্ডও –
এইসব সেরে আবার এগনো হল। প্যাংগং লেক আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।
খানিক এগোতেই দেখি একটা শুকনো নদীখাত, তার ওপর সুন্দর একটা ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে এগোতে গিয়ে দেখি নদীর বালি উঠে এসে ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর। বালির ওপরে বাইক চালানো বেশ রিস্কি, তবে দু চারবার বালির সামনে এসে স্লো করে চালিয়ে দেখলাম বালির লেয়ার এমন কিছু মোটা নয়, জাস্ট রাস্তার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে, স্পিডে বাইক চালালে কোনও অসুবিধে নেই।
কনফিডেন্সটিই কাল হল। খানিক দূরেই আবার রাস্তার ওপর বালি, বালির লেয়ার অগভীর মনে করে এগোতে যেতেই বাইক সমেত স্কিড করে পড়লাম বাঁদিকে। নাহ, লাগে নি, কিন্তু বেকায়দায় আমার একটা পা আটকে গেছে বাইকের তলায়, এখন একপায়ে আমার পক্ষে বাইক তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সাহায্য লাগবেই।
বাকিরা একটু পেছনে ছিল। তারা এসে পৌঁছনো পর্যন্ত আমি ওই পা-চাপা অবস্থাতেই রাস্তায় পড়ে রইলাম – হার্ডলি দেড় মিনিট। তারা এসে আমার বাইক তুলে আমাকে উদ্ধার করল। লাগে নি একটুও, কিন্তু দাঁড়াবার পরে খেয়াল করলাম, আমার বাঁ-পায়ের নী-গার্ডটা ফেটে দু টুকরো হয়ে গেছে। … অর্থাৎ, নী-গার্ডের জন্য আমার পা বেঁচে গেছে, আমি টেরও পাই নি। নী গার্ড না থাকলে আমার মালাইচাকিটা ফাটত।
একবারের চেষ্টাতেই বাইক স্টার্ট নিয়ে নিল, একটু এগোবার পরে – কী খেয়াল হল, আবার গাড়ি স্লো করলাম। গলায় ক্যামেরা ছিল ঝোলানো, সেটা ঠিক আছে তো? দেখা হয় নি। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে দেখলাম, ঠিকই আছে, কেবল লেন্স ক্যাপটা হাওয়া। কখন খুলে পড়ে গেছে ধাক্কায়, টের পাই নি। লেন্সটা এক্সপোজড নয়, সামনে একটা ইউভি প্রটেক্টর আছে, এই যা রক্ষে।
অতঃপর প্যাংগং লেকে পৌঁছে যাওয়া, সেই বিখ্যাত মাইলস্টোনের ছবি নেওয়া, এবং আরও খানিক এগিয়ে টেন্ট বুকিং। খাওয়া দাওয়া সমেত এক হাজার টাকা। খাওয়া মানে রাতের ডিনার আর সকালের ব্রেকফাস্ট।
কিন্তু প্যাংগং-এর কোনও রঙ নেই। সেই বিখ্যাত নীল রঙ নেই কোথাও। হবে কী করে? আকাশ ভর্তি তো মেঘ। প্যাংগং-এর জলের রঙ তাই জাস্ট জলের মতন।
মনে পড়ল, ঠিক তিন বছর আগে এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে সে কী স্বর্গীয় জিনিস দেখেছিলাম। প্রকাণ্ড, অন্তহীন ক্যানভাসে কে যেন রংতুলি নিয়ে বসে যত্ন করে ধৈর্য ধরে এঁকে রেখেছে পাহাড়, আকাশ, মেঘ আর … প্যাংগং লেক। সম্পূর্ণ নীল রঙের জল, আর এক এক দিক থেকে এক এক রকমের নীলের শেড। হাল্কা আকাশী থেকে পুরো ইন্ডিগো ব্লু রঙ।
প্রায় দেড়শো কিলোমিটার লম্বা এই লেকের দুই তৃতীয়াংশই পড়ে চীনে, মানে, তিব্বতে। শীতকালে এই সুবিশাল লেকের পুরোটাই জমে বরফ হয়ে যায়। লেকের জলে কোনো মাছ নেই, কেবল বিভিন্ন ধরণের পাখি দেখা যায়, মূলত সীগাল এবং পানকৌড়ি টাইপের জলজ পাখি।
তিব্বতীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই লেক। দলাই লামা একদিন এই লেকের ধার ধরেই তিব্বত থেকে চলে এসেছিলেন ভারতে। এই লেকের ধার ধরেই ছিল সুপ্রাচীন সিল্ক রুট।
দু একটা ছবি, আমার তিন বছর আগের ট্রিপ থেকে, সেবার আকাশ ছিল ঘন নীল, জলের রঙও তাই –
আর এবারের প্যাংগং বিবর্ণ। আকাশে মেঘ, আকাশেও নীল নেই, তাই লেকের জলেও রঙ নেই এবারে।
আমাদের বাহনেরা …
এই আমাদের টেন্ট –
একটি প্যানোরামা –
এবং, দিনের আলো নিভে যাবার আগে, প্যাংগং-এর শেষ ছবি।
সূর্য ডুবে যাবার সাথে সাথে জাঁকিয়ে নামল ঠাণ্ডা। দু প্রস্থ চা খেলাম, তাতেও কাঁপুনি থামে না। দুদিন আগে পূর্ণিমা গেছে, ভেবেছিলাম রাতের বেলায় চাঁদের আলোর রিফ্লেকশনের ছবি তুলব। কিন্তু ক্ষমতায় কুলোল না। গ্লাভস পরে ক্যামেরা কন্ট্রোল করা যায় না, আর খালি হাত বাইরে বেরনোমাত্র জমে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে একটামাত্র ছবি তুললাম, আকাশেও ভর্তি মেঘ, চাঁদ বেশিক্ষণ দেখাও গেল না।
নটা নাগাদ রাতের খাওয়া সেরে লেপের তলায় ঢুকে তোফা ঘুম। অবশ্য, ডায়ামক্স খেতে ভুলি নি। কাল সকালে মারসিমিক লা যেতে হবে। কী কোজি হয় এই টেন্টগুলো। সুমিতের বীভৎস নাক ডাকা বাদ দিলে ঘুমটা মন্দ হল না। গায়ে হাতে পায়ে আর কোনও ব্যথা নেই, মানে আমি সিজনড হয়ে গেছি এইবারে।
কাল কি হবে, মারসিমিক লা?
Darunnn Siki ek jaygay kor ek songe chhobi dekhe miliye abar porbo please
LikeLiked by 1 person