জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – অষ্টম পর্ব

[পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬] এবং [পর্ব ৭] -এর পরে …

৫ই জুন ২০১৫ – সপ্তম দিন

এক সপ্তাহ হয়ে গেল বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। অবশ্য এখন আর দিন-তারিখের হিসেব নেই। প্রকৃতির মধ্যে রেস লাগাতে লাগাতে আমার যেন মানসিকতাটাই এখন অন্য রকমের হয়ে গেছে। সকাল ঠিক সাড়ে ছটায় বিবেক এসে আমাদের তাঁবুতে উঁকি দিল। সিকিস্যার, আকাশ অনেকটা ক্লিয়ার হয়েছে, চলুন, ছবি তুলে আসি।

লেপ থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে বুঝলাম, ঠাণ্ডাটা এখনও বেশ হাড়কাঁপানোই আছে। অতএব, চুলোয় যাক ছবি, আমাকে আরেকটু শুতে দাও। এমনিতেই সারারাত সুমিতের নাকডাকায় ঘুম অনেকবার ব্যাহত হয়েছে।

কোই বাত নেহি, আমিই ছবি তুলতে যাই, বলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও পেছন ফিরে এল বিবেক – সিকিস্যার, কাল আপনি যে ডায়ামক্সটা দিয়েছিলেন, সেটা কি একটু হাই ডোজ ছিল, নাকি? সারারাত মেরা দিল অ্যায়সে ধড়কনে লাগা, কি ঠিক সে সো নেহি পায়া। … মনে মনে বললাম, লোকে নতুন বিয়ে করা বউকে নিয়ে তাঁবুর মধ্যে রাতে শুলে সারারাত ঘুমোতে পারে না, হার্টবীট বেড়ে যায়, আর এ তো তোমার বিয়ে না-করা প্রেমিকা, দিলেরই বা আর দোষ কি, ডায়ামক্সেরই বা আর দোষ কি। তা, প্রিয়াঙ্কারও নিশ্চয়ই ঘুম হয় নি?

না স্যার (আমি কিনা ওদের সবার চেয়ে সিনিয়র, তাই আমাকে সর্বদা ওরা স্যর স্যর করে ডাকছিল – উত্তর ভারতীয় কলচর), হম দোনো কে দিল বহোত তেজ দওড় রহা থা।

আহা রে, ফাগোল, বড় বাচ্চা ছেলে, কোনটা বলতে হয়, কোনটা বলতে নেই, এখনও শেখে নি। মিষ্টি হেসে আমি পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম আবার ভাঙল কারুর কথা বলার আওয়াজে। দেখি একটা ছেলে, গুরদীপের সাথে গপ্পো করছে তাঁবুতে ঢুকে। এ ছেলেটিকে আমি কাল দেখেছি লে-র পেট্রল পাম্পে। বিবেকের ক্যান যখন ফুটো হয়ে গেছিল, তখন এ-ও সাহায্য করেছিল সেলোটেপ লাগাতে। গুরদীপের পূর্বপরিচিত, নয়ডার ছেলে। সে আলাদা গ্রুপের সাথে কালই প্যাংগং এসে পৌঁছেছে। আজ ওদেরও মারসিমিক লা যাবার কথা – সেই গল্পই হচ্ছে। … কিন্তু বলে কি এ?

সকালেই নাকি বেরিয়ে পড়েছিল ওদের গ্রুপ, মারসিমিক লা-র উদ্দেশ্যে। ফোবরাং পার হতেই একটা আর্মি চেক পোস্ট আছে, সেইখানে কোনও এক আর্মি জেনারেল ওদের আটকে উত্তাল ঝেড়েছে – তোদের তো প্যাংগং যাবার কথা, এখানে কীভাবে এলি তোরা? ওরা যতই লে থেকে আনা পারমিট দেখায়, আর্মির পাবলিক কোনও কথাই শোনে না – এর আগে কাউকে যেতে দেওয়া হবে না। দরকার হলে তাং শে যাও, সেখানে আরেক ডিসি বসেন, তাঁকে অনুরোধ করে দ্যাখো, তিনি যদি পারমিশন দেন তা হলে আমরা ভেবে দেখতে পারি। – মানে সোজা কথায়, যেতে নাহি দিব।

ওরা দু চারবার আর্গু করে, জাস্ট গত বছরেই তো লোকে মারসিমিক লা গেছে, সজল শেঠ গেছেন। – জেনারেল সাহেব কথাই শোনেন নি – গত বছর যা হয়েছে হয়েছে, গত বছরের শেষদিক থেকেই ওখানে সিভিলিয়ানদের যাওয়া মানা করে দেওয়া হয়েছে, বেশির ভাগটাই রাস্তা নেই, প্রচুর গাড়ি অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে ব্রেকডাউন হয়ে যায়, তারপরে আর্মিকেই দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে উদ্ধার করে আনতে হয়, না, মারসিমিক লা তে কোনওভাবেই যেতে দেওয়া হবে না, বেশি কথা বাড়ালে ঝামেলা বাড়বে, ভালো ছেলের মত যে রাস্তায় এসেছো, সে রাস্তাতেই ব্যাক করে যাও। অতএব, ওরা ব্যাক করে আবার প্যাংগং-এ এসেছে, এবং গুরদীপের পূর্বপরিচিত হবার কারণে গুরদীপকে এই স্টেটাস আপডেটটি দিতে এসেছে।

সদ্য ঘুম থেকে উঠে এই গল্প শুনে আমরা তিনজনে হতভম্বের মত এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী করা যায় এইবারে?

প্রথমে ঠিক হল, আমরাও এগোই, যদি আর্মি আটকায় তো ফিরে আসব। কিন্তু পরক্ষণেই আইডিয়া ক্যানসেল করতে হল, যদি আটকায়, তা হলে একটা টাইম তো নষ্ট হবেই, অলরেডি এখন আটটা বাজে, প্লাস পেট্রলও নষ্ট হবে। আমাদের যে রেটে পেট্রল নষ্ট হয়েছে, এখন আর রিস্ক নিয়ে নতুন ভেঞ্চার করতে যাওয়া পোষাবে না।

মারসিমিক লা ক্যানসেল হল। তা হলে প্ল্যান বি? চাং লা পাস দিয়ে গিয়ে লে ফেরত? তাতে আর চার্ম কী রইল? হোয়াট অ্যাবাউট সামথিং এলস? … ম্যাপ খুলে বসা হল।

তাং শে থেকে একটু দূরেই ডুর্বুক, যেখান দিয়ে আমরা এসেছি। ডুর্বুক থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা গেছে, শিওক, আগম হয়ে খালসার হয়ে ডিস্কিটে, মানে নুব্রা ভ্যালিতে। মাঝে অবশ্য আটচল্লিশ কিলোমিটার খারাপ রাস্তা আছে, তা সে না হয় দেখা যাবে। গুরদীপের সেই বন্ধু বলল, সে নাকি আগে একবার ওই রাস্তা দিয়ে গেছে, এমন কিছু খারাপ রাস্তাও নয়। প্যাংগং থেকে মোট একশো ষাট কিলোমিটার ডিস্কিট, এই রাস্তায়। আমাদের বাইকে আর বাকি ক্যানে যা তেল আছে, তাই দিয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যাবে, খুব দরকার হলে ডিস্কিটে দেখছি পেট্রল পাম্প আছে, সেখানে আবার রি-ফুয়েল করিয়ে নেওয়া যাবে। খারদুং লা খুলেছে কি খোলে নি শিওর নই – এই রাস্তায় গেলে অন্তত একটা দিন সেভ করা তো যাবে। নুব্রাও ঘোরা হয়ে যাবে। তারপরে খারদুং লা খোলা পেলে আবার এই রুটেই ফিরে এসে চাং লা হয়ে লে ফেরা যাবে।

সবাই রাজি?

ডান?

ডান।

বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশে সাদা মেঘ, নীল আকাশ প্রায় দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে, প্যাংগং-এরও সে রঙ এবারে নেই। আগের বারে যে জিনিস দেখে গেছিলাম, সেটা এইবারে পুরোটাই মিস হল। আমরা কি ভুল সময়ে এসে পড়েছি?

এদিকে বিবেক আবার তার বুলেটকে নিয়ে পড়েছে ফ্যাসাদে। নাকি তেল লিক করছে, কোথায় কোন ভালভ কেটে গেছে, ট্যাঙ্কার থেকে নিচের দিক দিয়ে গলগলিয়ে তেল বেরোচ্ছে। বিবেক আমায় এসে জিজ্ঞেস করল, সিকিস্যার, বুলেটে তেলের ফ্লো বন্ধ করার কোনও নব আছে?

কেলো করেছে। আমি বুলেটের ব-ও জানি না। আমার বাইকে আছে, নর্মাল যে কোনও বাইকে থাকে জানি। বুলেটে থাকে কিনা জানি না তো। তাও খুঁজেখাঁজে দেখলাম, কোথাও এমন নব চোখে পড়ল না। ধুর ধুর, বাজে বাইক। এদিকে তেলের লিকেজ বন্ধ হচ্ছে না। এ তো মুশকিল, এইভাবে তেল নষ্ট হলে তো পুরো ট্রিপ চৌপাট হয়ে যাবে। সুমিত ভালভের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল, তেল বন্ধ হল, কিন্তু আঙুল বের করতেই আবার তেল বেরোচ্ছে। কী ঝাম!

তারপর, খানিক বাদেই তেলের ফ্লো বন্ধ হয়ে গেল। নিজে নিজেই। কেসটা কী হল? খানিক আর অ্যান্ড ডি করে যা বোঝা গেল, জেরিক্যান থেকে আজ সকালে বিবেক বাকি তেল নিজের বাইকের ট্যাঙ্কারে গলা অবধি ভরেছিল। আমাকেও দিয়েছে, আমিও ভরে নিয়েছি। বুলেটের ট্যাঙ্কারের একটা থ্রেসহোল্ড লিমিট থাকে, তার ওপরে তেল চলে গেলে নিজে নিজেই বাইরে বেরিয়ে যায়, যতক্ষণ না আবার সেই থ্রেসহোল্ড পয়েন্টে চলে আসে তেলের লেভেল, অনেকটা ওয়াশিং মেশিনের বাকেট ভরার মত। তো, সেই বাড়তি তেল বেরিয়ে যেতেই সব ঠিকঠাক। স্টার্ট দিতেই দিব্যি স্টার্ট নিল, এক চক্কর ঘুরেও এল, কোনও অসুবিধে নেই। একটু এগিয়ে দাঁড় করাল, না, আর কোথাও কোনও তেল লিক হচ্ছে না, কোনও ভালভ কাটে নি, আল ইজ ওয়েল।

সকাল নটা। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে, ব্রেড অমলেট, আলু পরোটা আর চা-কফি। আমাদের টেন্টটা প্যাংগং-এর একেবারে শুরুতে। সিজন জাস্ট শুরু হয়েছে বলে এখনও ভিড় নেই, আগের বারে এইখানে মেলা বসে যেতে দেখেছিলাম। আমরা এগিয়ে গেছিলাম আরও বেশ খানিকটা দূরে, থ্রি ইডিয়টস পয়েন্ট বলে খ্যাত যে জায়গাটা। দূরে দেখা যাচ্ছে, সেখানে লেক অনেকটা চওড়া, আর লেকের মধ্যে খানিকটা ল্যান্ড রয়েছে, বাইক নিয়ে চলে যাওয়া যায়। আশা করি ওখানে জলের বেটার রঙ পাওয়া যাবে।

এগোলাম। আমার মনে ছিল, খানিকটা রাস্তা দিয়ে যাবার পরে খানিকটা অফরোডিং, বোল্ডারের ওপর দিয়ে চালিয়েছিল দোরজি। সেই পয়েন্টটা বুঝতে না পেরে আমি বেশ খানিকটা আগে চলে গেছিলাম, এইখানে রাস্তা আবার পাহাড়ের ওপরে উঠছে। সামান্য ওপরে উঠে বুঝতে পারলাম ভুল রাস্তায় এসেছি, ওপর থেকে এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কোথা থেকে ডিট্যুর নিতে হয়, একটা কোয়ালিস ঢুকল ওই পথে। টায়ারের দাগ মোটামুটি স্পষ্ট, বোল্ডারের ওপরে।

নেমে এলাম আবার। এইবারে বোল্ডারে চালানো। এখন আমি বুঝে গেছি এই রকমের রাস্তায় কী ভাবে চালাতে হয়। ফার্স্ট গিয়ারে রেখে ফুট-রেস্টে নয়, দু পাশে পা ঝুলিয়ে রেখে যেতে হয়, যাতে কোনওভাবে বাইক টাল খেলেই মাটিতে পা দিয়ে ব্যালেন্স রাখা যায়। দু একবার এমন সিচুয়েশন হলও, কিন্তু এখন আমি বেশ অভিজ্ঞ।

বেশ অনেকটা বোল্ডারের ওপর দিয়ে যাবার পরে নুড়িপাথর, ক্রমশ সেটা হয়ে গেল ফাইন ঝুরঝুরে বালি, ভিজে এবং শুকনো। সেই শেডটা পার হয়ে গেলাম, যেখানে আগের বারে চৌহানকন্যা মুখ গোমড়া করে বসে ছিল।

কী যে কঠিন এই বালির ওপরে বাইক চালানো, সবাই জানেন। চার চাকা হলে ফোর হুইল ড্রাইভ মাস্ট, তার ওপর দিয়ে টলমল করতে করতে এসে পৌঁছলাম সেই ল্যান্ডের শেষ টিপে – এখন আমার চারদিকে প্যাংগং লেক।

ফটোসেশন, ফটোসেশন এবং ফটোসেশন।

চারপাশে বরফের পাহাড়।

সুমিত জলে নেমে দেখতে চাইল, জল আসলে কতটা ঠাণ্ডা।

ইতিমধ্যে সেখানে আবার জুটে গেছেন দু তিনটি দিল্লির এবং গুজরাটের টুরিস্ট পার্টি। আমাদের হাতে ক্যামেরা দিয়ে অনুরোধ, তাঁদের ছবি তুলে দিতে হবে। সুতরাং তাঁদের দিয়েও আমাদের গ্রুপ ফটো তুলিয়ে নেওয়া হল। তার পরে শুরু হল বাইক নিয়ে সেই টিপিকাল অনুরোধ। আপকে বুলেট কে সাথ …

আমি আমার বাইক নিয়ে এগিয়ে আসছিলাম, বালির ওপর দিয়ে টলমল করতে করতে, খপ করে ধরলেন এক দিল্লিওয়ালা – আপ দিল্লি সে আ রহে হো? ক্যায়সে আয়ে? কিতনে দিনোঁ মে আয়ে? ক্যায়সে জাওগে? থকান নেহি আতা? দিক্কৎ নেহি হোতি? … এর পরেই, আপকে বাইক কে সাথ এক ফোটো …

বাইক রীতিমত স্ট্যান্ডে লাগিয়ে তিনি তার ওপরে চড়ে ফটো তুললেন, হায়, এখানেই যদি শেষ হত, এর পরে মেরি ওয়াইফ, এর পরে মেরা বেটা, মেরি বড়ি বেটি, মেরি ভাবী, উনকা বেটা, উসকা কাজিন – সে এক রাবণের গুষ্টি। সবাই আলাদা আলাদা করে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে বা বাইকে চড়ে পোজ দিয়ে ফটো তুলে ক্ষান্ত হল – আমি মুক্তি পেলাম।

অতঃপর আবার সেই বালি, তারপরে পাথরের ওপর দিয়ে মেন রাস্তায় ফেরা, এবং এগিয়ে চলা। চৌত্রিশ কিলোমিটার দূরে তাং শে।

প্যাংগং থেকে যখন স্টার্ট করলাম, তখনই প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। একশো ষাট কিলোমিটার, সন্ধ্যের মধ্যে হবে কি হবে না? আগে রাস্তা কেমন, কতটা খারাপ, জানি না। আর সময় নষ্ট করা চলবে না। যতক্ষণ ভালো রাস্তা আছে, উড়িয়ে নিয়ে চলো।

প্যাংগং-এর মুখেই যে আর্মি চেক পোস্ট, সেইখানে আজ প্রচন্ড ভিড়। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা স্কুলের ইউনিফর্ম পরে রাস্তার এক সাইডে বসে, অন্য সাইডে আর্মির সমাবেশ, একজন কী যেন বক্তৃতা দিচ্ছেন স্থানীয় ভাষায়। গাম্বাট বিশাল একটা জাতীয় পতাকা উড়ছে সামনে।

আমাদের দেখে একজন ইশারা করে বললেন পেরিয়ে যেতে। পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম, সুমিত জিজ্ঞেস করে এল, আজ পাঁচই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। তাই আর্মির উদ্যোগে স্থানীয় স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে পরিবেশ সচেতনতা দিবস পালন হচ্ছে।

ঠিক এক ঘন্টায় তাং শে চেকপোস্টে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে ন কিলোমিটার আগে ডুর্বুক, সেখান থেকে ডাইভার্সন।

নয় লেখা আছে বটে, তবে ছ কিলোমিটারের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম সেই ডাইভার্সনে। পরিষ্কার লেখা, ডানদিকে শিওক, আগম। এইটাই আমাদের আজকের রুট। সামনে মিলিটারি জিপে এক ফৌজি বসে ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েই দেখি বুকে ব্যাজে লেখা শোভন বসাক। বাঙালি?

একগাল হেসে আলাপ পরিচয় হল। জিজ্ঞেস করলাম, রাস্তা কেমন? শোভন বললেন, শিওক অবধি তো ভালো রাস্তা – তার পরে একটু আধটু খারাপ আছে, তবে বাইক চলে যাবে।

টা-টা-বাই বাই করে আমরা শিওকের রাস্তা ধরলাম।

একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। গতকাল থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হিসেবমত আজ আমাদের বিকেলে লে-তে ফেরার কথা ছিল, সেখানে পৌঁছে সিকিনী এবং বাবাকে ফোন করে আপডেট দেবার ছিল – না হলে ওরা চিন্তা করবে। কিন্তু এখন যদি আমরা ডিট্যুর করে নুব্রা ভ্যালি চলে যাই, তা হলে তো মুশকিল, ওখানে তো আমার ফোন কাজ করবে না, ডিস্কিট হুন্ডারে শুধু বিএসএনএল চলে। পৌঁছেই একটা ফোন বুথ খুঁজে বাড়িতে কথা বলে নিতে হবে, নইলে অনর্থক টেনশন।

যাই হোক, ডুর্বুক থেকে বাঁক নিয়ে আমরা শিওকের রাস্তা ধরলাম। শিওক নদী এইখান থেকে আমাদের সাথে সাথে চলবে নুব্রা, সেখান থেকে তুর্তুক হয়ে এই নদী পাকিস্তানে ঢুকে যাচ্ছে। তো, নদীর ধার বরাবরই রাস্তা, সেই রাস্তায় প্রথম গ্রাম নদীর নামে – শিওক। মসৃণ রাস্তা, রানওয়ের মত, দেখতে দেখতে আমরা সবাই শিওক পৌঁছে গেলাম। হাল্কা রেস্ট।

এই সময়ে দেখি উল্টোদিক থেকে একটা বাইকার টিম আসছে। সেই টিম, যাদের সাথে মুলবেক আর নামিক লা-তে দেখা হয়েছিল। এরা আসছে নুব্রা থেকে। দাঁড়িয়ে খানিক সৌজন্য বিনিময় হল। রাস্তা কেমন? প্রথম বুলেটের লোকটা একগাল হেসে বলল – অ-সাম্‌। … তার পরে একটু থেমে বলল, জীবনে যত অফরোডিং-এর অপূর্ণ সাধ আছে, সব মিটে যাবে এই রাস্তায় গেলে। একটু বাদেই দেখবে রাস্তা বলে কিছু নেই, আমরা তো এই প্রথম ভালো রাস্তা পেলাম। শুধু নুড়ি, পাথর, কাঁকর আর বোল্ডার। রাস্তা আন্দাজ করে নিতে হবে। নদের পাশ ধরে ধরে চলে যেও, তা হলেই পৌঁছে যাবে আগম হয়ে খালসার। চেষ্টা কোরো টায়ারের দাগ আন্দাজ করে চলতে, তা হলে পথ হারাবে না, নইলে পথ হারিয়ে ফেলার যে কোনও রকমের প্রব্যাবিলিটি আছে সামনে।

শুনে তো আমার হয়ে গেছে। বলে কী? সবাইকে বললাম, সাথ ছেড়ো না, সবাই নিজের নিজের ভিউ ফাইন্ডারে পেছনের জনকে নজর রাখতে রাখতে এগিও।

বুলেট টিমকে বিদায় জানিয়ে আমরা এগোলাম। কিন্তু কোথায় খারাপ রাস্তা? রাস্তা তো বেশ ভালোই, সুন্দর পিচরাস্তা। জায়গায় জায়গায় সাইনেজ দেওয়া, মাইলস্টোন বসানো, দিব্যি দেখছি লেখা আছে আগম ৩৯ কিলোমিটার দূরে।

কিন্তু ভুল ভাঙল। আরও দু তিন কিলোমিটার যাবার পরেই দেখলাম হঠাৎ করে রাস্তাটা উধাও হয়ে গেছে। সামনে নুড়িপাথর বিছানো রাস্তা, যদিও রাস্তা বলে চেনা যায়। ও হরি, এই তা হলে অফরোডিং? এর চেয়ে খারাপ রাস্তা তো আমরা চাং লা পাসে পেয়েছি। চাং লা টপের আগে পিছে পাঁচ পাঁচ দশ কিলোমিটার তো ভয়ঙ্কর রাস্তা ছিল।

কয়েক কিলোমিটার যাবার পরে আবার পিচরাস্তা শুরু। আবার সাইনেজ, সামনে টার্ন, আগম আর ৩৪ কিলোমিটার। এবং, খানিক বাদে আবার রাস্তা ভ্যানিস – সো-কলড অফরোডিং। আবার কয়েক কিলোমিটার বাদে পিচরাস্তা – যদিও এইবারের পিচ রাস্তা আগের মত মসৃণ নয়, মনে হল অন্তত সাত বছর আগে এখানে লাস্ট পিচ পড়েছে।

একটা বুনো ফুলের ঝাড়ে ঢাকা অঞ্চল পেরিয়ে এলাম। চারদিক গোলাপি রঙের ফুলে ভরে আছে, তার মাঝখান দিয়ে চলেছি, চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, ত্রিসীমানায় কেউ কোত্থাও নেই, শুধু চারটে বাইক চলেছে, আর ডানদিকে বয়ে চলেছে নীলচে সবুক শিওক নদী।

হঠাৎ একটা জায়গায় এসে ব্রেক মারতে হল। রাস্তা হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে, সামনে মোটা মোটা বোল্ডার, নুড়িপাথর। বাঁদিক ঘেঁষে একটা রাস্তা মনে হল ওপর দিকে গেছে, ডানদিকে অস্পষ্ট কিছু গাড়ি চলার দাগ, নিচের দিকে নেমে একটা জলে ঢাকা অঞ্চল, সে দিকে চলে গেছে। কোনটা রাস্তা?

পিছিয়ে এলাম খানিক। ঠাহর করে মনে হল, ডানদিকের রাস্তাটাতেই গাড়ি চলার ছাপ বেশি, বাঁদিকের রাস্তাটা খানিক ওপরে উঠেই শেষ হয়ে গেছে। সামনের জলে ঢাকা অঞ্চলটা ছোট, তার পরেও নুড়িপাথরের মধ্যে গাড়ি চলেছে – বোঝা যাচ্ছে। অতএব, চলো সবাই।

এইবারে বুঝলাম অফরোডিং কাকে বলে। যত এগোচ্ছি, নুড়ি পাথরের সাইজ ক্রমশ বড় হচ্ছে। বোল্ডার। তবু তার মধ্যেই কিছু কিছু নুড়ি বোল্ডার দেবে যাওয়া – বোঝা যাছে এইগুলোর ওপর দিয়ে গাড়ি চলেছে। বাইক এত লাফাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে সেকেন্ড গিয়ারে রেখে চালাতে হচ্ছে।

কতক্ষণ এভাবে চলেছি, জানি না – হঠাৎ আবার থামতে হল। সামনে বোল্ডার বিছানো জমিটা যেন ঢেউ খেলিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে হঠাৎ করে, এমনভাবে ঢেউ খেলানো, সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুসমান উঁচু জমি দেখা যাচ্ছে। বাইপাস করার কোনও উপায় নেই। এইবারে?

পাঁচজনেই দাঁড়ালাম। সুমিত বলল, কুছ পরোয়া নেই, এক এক করে বাইক পার হবে, প্রথমে বিবেক যাক, আমি পেছন থেকে ধাক্কা দেব।

বিবেক ফার্স্ট গিয়ারে গাড়ি নিল, সুমিত আর গুরদীপ দুজনে মিলে দুদিক থেকে পেছনে ধরে ঠেলা দিল – যাতে ব্যালেন্স বিগড়ে গেলেও পড়ে না যায়। গোঁ-গাঁ আওয়াজ করে উঁচু জমিতে চড়ে গেল বিবেকের বুলেট।

এর পর সুমিত পেরলো একইভাবে। এইবারে আমার পালা।

আমার বাইকটিই সবচেয়ে কমজোরি। দুশো সিসি, পারবে কি? তাও – না পেরে তো উপায় নেই, অন্য রাস্তাও নেই, ফার্স্ট গিয়ারে রাখলাম গাড়ি, একটু আড়াআড়ি করে ওপরের দিকে ফোর্স দিলাম, পেছনে গুরদীপ ঠেলা দিল – আমার দু পা দুদিকে মাটিতে লাগানো। দুবারের চেষ্টা, বাইক ওপরে চলে এল।

লাস্টে এল গুরদীপ, ওকে আমরা সাহায্য করলাম। এইবারে, প্রথমবারের জন্য অনুভব করলাম, একা আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে কী ভুল করেছিলাম। ভাগ্যিস, ভাগ্যিস এত ভালো একটা গ্রুপের সাথে দেখা হয়ে গেছিল।

এর পর? রাস্তা কোনদিকে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, দূ-রে আবার হাল্কা পিচ ঢালা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। মানে আমাদের ওখানে পৌঁছতে হবে।

অতএব, এগনো গেল – এইভাবে।

আকাশে তখন আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো মেঘ জমছে। নেমে আসছে পাহাড়ের ওপর। আমরা আবার মোটামুটি একটা আইডেন্টিফায়েবল রাস্তা দিয়ে চালাচ্ছি, পাশেই নীলচে শিওক নদী।

রাস্তা কখনও সমতলভূমির ওপর দিয়ে, দূরে দূরে পাহাড়, কখনও পাহাড়ের গায়ে পাক খেতে খেতে ওপরে ওঠা বা নিচে নামা। সুবিশাল সব পাথর ঝুলে আছে মাথার ওপরে, দেখলেই মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাবে, তাদের নিচ দিয়ে চলা, এ অ্যাডভেঞ্চার অতুলনীয় – ভুলতে সময় লাগবে।

কতটা জানি না, অনেক অনেকটা যাবার পরে সামনে বিবেক হাত দেখিয়ে আমাকে থামতে বলল। পেছনে সুমিত আর গুরদীপকে দেখা যাচ্ছে না। আমার তো একেই একটা ভিউ ফাইন্ডার নেই, বাঁদিকেরটা দিয়ে ভালো দেখা যায় না, খেয়াল করি নি পেছনে কখন তারা ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়ালাম, নিশ্চয়ই পেছনে রয়ে গেছে, আসবে। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

হাওয়ার তেজ বাড়ছে। ছুরির মত বিঁধছে প্রায়, নেহাত সর্বাঙ্গ ঢাকা তাই কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, কিন্তু হাওয়ার ঝাপটায় দাঁড় করানো বাইক পর্যন্ত কাঁপছে। আকাশের মেঘ প্রায় আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। ওরা এখনও আসছে না কেন?

অন্তত পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পরে দূ-রে, অনেক দূরে দুটো ডট দেখা গেল, ব্লিঙ্কিং লাইট সমেত। (আমাদের কোড আমরা শুরুতেই ফিক্স করে নিয়েছিলাম, চলব যখন, ব্লিঙ্কার বা একদিকের ইন্ডিকেটর অন করে চলব। আর তিনটে লম্বা পরপর হর্ন মানে – থামতে হবে)

সুমিত আর গুরদীপ এল আরও পাঁচ মিনিট পরে, সত্যিই অনেকটা দূরে ছিল। খানিক অফরোডিং করতে গিয়ে বালির গাদায় পড়ে উলটে গেছিল সুমিতের বুলেট। তাই আসতে দেরি হল।

গাড়ি আবার স্টার্ট দিতে যাবো, খেয়াল হল, সিটের ওপর গ্লাভসদুটো খুলে রেখেছিলাম, সেগুলো কই? … সর্বনাশ করেছে, কোথাও আটকে রাখি নি, খোলা রেখেছিলাম, এত তেজ হাওয়া বইছে, নিশ্চয়ই উড়ে বেরিয়ে গেছে। হিমস্রোত নামল একটা – শিড়দাঁড়া বেয়ে। এত দাম দিয়ে কেনা মাইনাস কুড়ি ডিগ্রির গ্লাভস … এখন আমি আগে যাব কী করে? এক্ষুনি তো বৃষ্টি কিংবা স্নো-ফল শুরু হবে। কেলো করেছে।

সুমিতই একটু এগিয়ে আবিষ্কার করল আমার গ্লাভস। খাদের কিনারায় একটু নিচে একটা, আর তারও আরো বেশ খানিকটা নিচে আরেকটা ঝুলছে, দুটো আলাদা আলাদা পাথরের খাঁজে। এমন পজিশনে, চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তুলে আনার উপায় নেই।

হাওয়ার তেজ তখন আরো বাড়ছে, মেঘ আমাদের প্রায় ওপরে এসে পড়েছে। সুমিত বলল, চিন্তা করবেন না – আমার কাছে এক্সট্রা গ্লাভস আছে একজোড়া, ওগুলো পরে চলুন।

আর কোনও উপায়ও নেই, আমার নিজের এক্সট্রা গ্লাভস, যেটা দিল্লি থেকে এনেছিলাম, সে তো লে-তে হোটেলের লাগেজের সাথে রেখে এসেছি।

এমন সময় গুরদীপ বলল, সিকিস্যার, আপনার গ্লাভস আমি নিয়ে আসছি, আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

দৈববাণীর মত শোনাল কথাটা। বলে কি ছোকরা? পাগল হল নাকি? সুমিত বিবেক আমি সবাই মিলে ওকে বারণ করলাম, কিন্তু ও অ্যাডামেন্ট, আপলোগ ফিকর মত করো, ম্যায় লে আতা হুঁ। … পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে আমার হাতে দিল, তারপরে রাস্তার ধার দিয়ে নিচের প্রথম পাথরে পা রাখল।

আমার হৃৎপিণ্ড তখন গলায় উঠে এসেছে। কোনও সাপোর্ট নেই, কিছু নেই, ও নামছে কী করে?

কিন্তু গুরদীপ মনে হল ট্রেনড। কীভাবে সেই পাথর থেকে পরের পাথরে, সেখান থেকে নিচের পাথরে হাত পা সব ব্যালান্স করে রেখে, নেমে নেমে একটা একটা করে আমার দুটো গ্লাভসই উদ্ধার করে, একইভাবে উঠল ওপরে।

প্রথমে সুমিত, তারপরে আমি, তারপরে বিবেক জড়িয়ে ধরলাম ওকে। গুরু, কী করেছো? ছবি তুলব কী, নিজের চোখকে তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। গুরদীপ, জাস্ট কিছুই হয় নি, এই রকম একটা ভাবে হেসে বলল, কোই বড়ি বাত নেহি, আমি মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিং নিয়েছিলাম কিছুদিন। এইটুকু নামাওঠা তো আমার কাছে সাধারণ ব্যাপার।

আমি তখন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, কী বলব কিছু বুঝতে না পেরে ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম। জাস্ট দুটো গ্লাভসের জন্য এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে কেউ! একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের জন্য। দুদিনের আলাপ, দুদিন বাদেই আবার যে যার বাড়ি চলে যাব, আর কোনও দিনও দেখা হবে কিনা ঠিক নেই – আমি পারতাম?

পারতাম না। নিঃশব্দে গ্লাভস পরে – ফের স্টার্ট করলাম।

সেই একই রকমের বাম্পি রোড, আলো কমে আসছে। পৌনে পাঁচটা মত বাজে। হাওয়ায় ভিজে ভাব এসেছে, মানে সামনে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে।

এইখানে আমার গ্লাভস উড়ে পড়েছিল সামনের খাদে।

চলতে চলতে, তখন আর দূরত্ব বা সময়ের ঠিকঠিকানা নেই, জাস্ট ক্লাচ-গিয়ার অ্যাক্সিলারেটরে হাত-পা রেখে চলেছি তো চলেছি, হঠাৎ করে – সামনে ফ্যান্টাস্টিক রাস্তা, একেবারে ঝকঝকে। একটা দুটো বাড়ি, মানে কুঁড়েঘর টাইপের, আর খানিক এগোতেই দেখি মাইলস্টোনে লেখা – খালসার ২০ কিলোমিটার। … তার মানে আমরা প্রায় এগারো কিলোমিটার আগেই আগম পেরিয়ে এসেছি? আগমে তার মানে কেউ থাকে না।

জয় গুরু। এইবারে ভালো রাস্তা, কিন্তু বৃষ্টি শুরু হবার আগে কি খালসার পৌঁছতে পারব? খালসার থেকে আবার আমার চেনা রাস্তা।

কিন্তু না – তুমুল বেগে ছুটে এসে মেঘ আমাদের ধরে ফেলল, এইভাবে –

তড়িঘড়ি গাড়ি থামিয়ে রেনকোট পরতে পরতেই ভিজে গেলাম প্রায়। না, এখানে স্নো-ফল নয়, আমরা এখন নুব্রা ভ্যালির কাছে এসে গেছি, এখানে অলটিটিউড অনেক কম। দশ হাজার ফুট। রীতিমত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা এগোলাম।

খালসার তখন তেরো কিলোমিটার।

খালসার পৌঁছলাম সন্ধ্যে সোয়া ছটায়। গরমের দিন, তাই দিনের আলো এখনও সুন্দর রয়েছে। প্রথম যে খাবার দোকানটা দেখলাম, সেখানে ঢুকে পড়লাম। সারাদিন খাওয়া হয় নি। রুটি, পনীরের তরকারি, ডাল আর ভাত – তাই নিয়ে হামলে পড়ে খেলাম সবাই। খাবার মাঝেই বৃষ্টি শেষ হল, আবার পরিষ্কার আবহাওয়া। আকাশে যদিও ভর্তি মেঘ। দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে ফোন বুথ আছে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, কোথায় ফোন করবেন? বললাম, বাড়িতে, দিল্লিতে।

ছেলেটা নিজের ফোন বাড়িয়ে দিল। বিএসএনএল, ফুল সিগন্যাল। সবাই একে একে বাড়িতে ফোন করলাম। লেহ্‌-র হোটেলে মিসেস লিন্ডাকেও ফোন করলাম, যে আজ ফিরছি না, আমরা নুব্রা চলে এসেছি। লাগেজ যেন রেখে দেন। মিসেস লিন্ডাকে একটুও বিচলিত মনে হল না – উনি তো এসবের সাথে অভ্যস্ত। বললেন, কোনও টেনশন নেই, আরাম সে এসো, লাগেজ সব ঠিক আছে।

প্রায় গোটাসাতেক ফোন হল। ছেলেটা এক পয়সাও নিল না ফোনের জন্য। শুধু খাবারের দাম নিল। বৃষ্টি ততক্ষণে পুরোপুরি ধরে গেছে। আমরা বেরোলাম। ডিস্কিট এখান থেকে বাইশ কিলোমিটার, আর আরও সাত কিলোমিটার দূরে হুন্ডার। আমি আগের বারে ডিস্কিটে ছিলাম, কিন্তু বাকিরা বলল, হুন্ডারে থাকবে, ওখান থেকে স্যান্ড ডিউনস কাছে পড়বে। আমি আপত্তি করলাম না – আগের বারে ডিস্কিটে তো থেকেইছি, এইবারে হুন্ডারেও থাকা হয়ে যাবে। অসুবিধা কী আছে।

ডিস্কিট। পুরনো স্মৃতিরা হঠাৎ দৌড়ে এসে সঙ্গ দেয়।

তিন বছর আগে সপরিবারে, আরও একটি বিরক্তিকর পরিবারের সাথে, প্রায় এক রকম জোর করেই এসে ঘুরে গেছিলাম লাদাখ। সেবারে খারদুং লা পার করে থাকা হয়েছিল এই ডিস্কিটে। ছোট্ট গ্রাম ডিস্কিট। সপ্তদশ শতকে এখানে রাজার রাজত্ব ছিল, নুব্রা কিংডম। তার রাজধানী ছিল এই ডিস্কিট।

সেবারে, দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়েছিলাম গ্রামটা দেখতে, সিকিনীর সাথে। নোর্বে-র গেস্টহাউসের থেকে একটু বেরোতেই দেখি মোড়ের মাথায় এক বিরাট বৌদ্ধ জপযন্ত্র, তিব্বতী ভাষায় এদের বলে “মানে”, সেখানে ঠিক গল্পের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা দুই তিব্বতী বুড়ি বসে। সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা, নরুণচেরা চোখ আর কাঁচাপাকা চুলে কী মিষ্টি মিষ্টি বিনুনি বাঁধা। আমাদের দেখেই একগাল হেসে ছোট ছোট চোখ প্রায় বুজে ফেলে, দুলে দুলে “জুলে জুলে জুলে” বলতে লাগলেন তাঁরা।

এতক্ষণে মনে পড়ল, জুলে মানে কী, জিজ্ঞেস করা হয় নি। বুড়িদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা কেউই হিন্দি বোঝেন না। অগত্যা, অনুমান করে নিলাম, তিব্বতী ভাষায় কোনো অভিবাদন টাইপের শব্দ হবে এই “জুলে”। ক্যামেরা দেখিয়ে বললাম, ফটো? (ঠিক যেন চিড়িয়াখানা সিনেমায় জাপানি সাজা উত্তমকুমার) খুব খুশি হয়ে মেয়ের সঙ্গে তারা ফটো তুললেন।

বাজারে সামান্য কুড়িবাইশটা ছোটমেজবড় দোকান। তার বেশির ভাগই সেদিন বন্ধ। নাকি কীসের স্ট্রাইক চলছে। একটা বিজেপির পার্টি অফিস আর কিছু পোস্টারও দেখলাম। কান কটকট থেকে বাঁচার জন্য অন্য পরিবারটির গিন্নিমা দোকানে দোকানে টুপি খুঁজে বেড়াতে লাগলেন, আমরা সেই সুযোগে আলগা হয়ে গেলাম। মেন মার্কেট থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে, সেখানেই ডিস্কিটের নাম করা স্যান্ড ডিউনস গেস্ট হাউস, তার উল্টোদিকে একটা মণিহারি দোকান। তিব্বতী মানে, অর্থাৎ জপযন্ত্র, তারপরে বৌদ্ধদের সেই লালনীলহলুদ মন্ত্রলেখা কাপড় লাগানো সুতো, ধূপের প্যাকেট, তার সাথে গ্লাভস, মাফলার, মোজা ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে একটা খোলা দোকান, দোকানে কোনো লোক নেই। একটু দূরে একজন লামা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার ওপরে।

খানিক দোনামোনা করে, ঢুকব-কি-ঢুকব-না ভাবতে ভাবতে ঢুকেই পড়লাম। নেবার তো  নেই কিছু, জাস্ট দেখব বলে এসেছি।

ঘুরে ঘুরে জিনিস দেখছি, এমন সময়ে সেই লামা স্মিত হেসে ঢুকলেন দোকানে। লামা এমনিই এসেছেন, না ক্রেতা হিসেবে এসেছেন বুঝতে না পেরে আমরা হালকা হাসতেই লামা দুচোখ বুজিয়ে হেসে বললেন, জুলে, জুলে।

তখনো জুলে মানে বুঝি না। তাই হেসে বললাম, হ্যালো। শহুরে ভদ্রতা। লামা জিজ্ঞেস করলেন, কেয়া লেনা হ্যায়?

আচ্ছা। লামাই তা হলে দোকানদার! এইবার সাহস পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা আসলে কিছু নেব না, এখানে বেড়াতে এসেছি তো – একটু দেখতে এসেছি দোকানটা। দোকানটা কি আপনার?

লামা হেসে বললেন, হ্যাঁ।

আমি পুরো হুব্বা। দোকানদার লামা আমি এর আগে কোনোদিন দেখতে পাবো, ভাবিই নি। প্রথমেই জানতে চাইলাম, জুলে মানে কী?

যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই, অভিবাদনের তিব্বতী সংস্করণ। হাই বলতেও জুলে, বাই বলতেও জুলে। দেখা হলেই হেসে জুলে বলতে হয়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে জুলে বললাম, অল্প ঝুঁকে। তারপরে উনি এক এক করে জ্ঞান দিতে লাগলেন আইটেম সম্বন্ধে। “মানে”, আসলে একটা মন্ত্র পড়ার যন্ত্র। ওর ভেতরে মন্ত্র লেখা কাগজ রোল করে ঢোকানো থাকে। মানে ঘোরাতে হয় ক্লকওয়াইজ। ওটা ঘোরালেই মন্ত্রোচ্চারণের পুণ্যি হয়, মুখে মন্ত্র বলার দরকার পড়ে না।

মন্ত্রলেখা কাপড়ের স্ট্রিংটার কী একটা নাম বলেছিলেন উনি, ভুলে গেছি এখন। ওটা যে কেউ কিনে টাঙাতে পারে না। আগে নিয়ারেস্ট গুম্ফাতে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রপূত করে শুদ্ধ করতে হয়, তারপরে পাহাড়ে যত উঁচুতে সম্ভব, গিয়ে সেটা লাগিয়ে আসতে হয়, যত দূর থেকে দেখা যায় ওই কাপড়ের স্ট্রিং, ভগবান বুদ্ধ ততদূর পর্যন্ত তাঁর করুণা প্রসারিত করে সবাইকে “বুরি নজর” থেকে বাঁচান।

তিব্বতী ধূপদানি দেখলাম। বাটিতে ধূপের গুঁড়ো রেখে তার নিচে মালসায় আগুন লাগিয়ে সেই ধূপ জ্বালানো হয়। আমরা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলে পারব না। ওর পুরো সেটআপ না থাকলে জ্বালানো যায় না। প্রদীপ দেখলাম এক ধরণের, গুম্ফাতে ব্যবহার করার জন্য।

দাম জিজ্ঞেস করতে গেলাম, উনি আবার হেসে বললেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?

বললাম, দিল্লি।

উনি বললেন, এগুলো সব আসে চীন-তিব্বত থেকে। প্রথমে আসে দিল্লিতে, আমরা দিল্লি থেকে লেহ্‌ হয়ে ডিস্কিটে নিয়ে আসি এইসব জিনিস। এখানে আপনাকে যা দাম বলব, আপনি দিল্লির টিবেটান মার্কেটে এর অর্ধেকেরও কম দামে পাবেন এই জিনিস। এখান থেকে কিনবেন না।

একজন দোকানদারের এই সারল্যে আমরা অবাক। উনি নিজেই বললেন, আমি কালই বেরোচ্ছি দিল্লির দিকে। চারদিনে পৌঁছবো দিল্লি। জিনিস লোড করে আবার বাসে করে ফিরব।

অনেকক্ষণ গল্প করে বেরোবার মুখে দেখি ঘড়ি সারাইয়ের যন্ত্রপাতিও রয়েছে ওঁর দোকানে। … আপনি ঘড়িও সারান? লামা আবার হাসলেন, হ্যাঁ, এখানে তো আর কোনো ঘড়ি সারানোর দোকান নেই।

সিকিনীর হাতঘড়ির ব্যান্ডের পিন হারিয়ে গিয়েছে চারদিন হল, পরতে পারছে না। বের করে দিতেই, উনি তিরিশ সেকেন্ডে নতুন পিন লাগিয়ে ব্যান্ড সেট করে দিলেন।

কত দেব?

লামা অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে বললেন, আরে না না, এইটুকু তো কাজ, এর আবার পয়সা কী? কিচ্ছু দিতে হবে না।

আমরা, পাঁড় দিল্লিওয়ালারা, এইসব কথা শুনতে অভ্যস্ত নই। ভাবলাম, লামা হয় তো এমনি কথার কথা বলছেন। কী ভেবে পকেট থেকে পার্স বের করে একটা দশ টাকা দিতে গেলাম ওঁকে।

নরম দুটো হাত দিয়ে আলতো করে আমার হাত চেপে ধরলেন লামা। – আপনারা আজ এসেছেন, কাল চলে যাবেন, আমাদের এখানে কয়েক ঘণ্টার অতিথি। আপনার কাছে পয়সা নিতে পারব না। আমি তো কিছুই করি নি, একটা পিন লাগিয়েছি শুধু, একটা পিনের আবার দাম হয় নাকি? আপনাদের সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আর তো কেউ এসে এইভাবে আমাদের সম্বন্ধে এত কিছু জিজ্ঞেস করে না। আমি কিছুই করি নি, দয়া করে আমাকে কোনো টাকাপয়সা দেবেন না।

আমরা হতবাক। চোখে জল এসে গেছিল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ভদ্রলোকের সময় নষ্ট করলাম, কিচ্ছু কিনলাম না, ঘড়ির ব্যান্ড সারিয়ে নিলাম, তারপরেও কেউ বলতে পারে, আমি কিছুই করি নি? মহানগর তো আমাদের এই মহানুভবতা শেখায় নি কোনওদিন!

মাথা নিচু করে আস্তে করে “জুলে” বলে বেরিয়ে এসেছিলাম, আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

এই জন্যেই তো রাস্তায় নামতে হয়। মাথা নিচু করতে শেখা যায়।

… তিন বছর পেরিয়ে গেছে, তবু মনে হয়, এই তো সেদিনের গল্প।

প্রায় সাড়ে সাতটার সময়ে ডিস্কিট পেরোলাম। সেই চেনা মার্কেট, মার্কেট পেরোতেই একটা পেট্রল পাম্পের কঙ্কাল, মানে কিছু মেশিন আছে, কিন্তু ছাউনি নেই, লোক নেই, মেশিনগুলোও সম্ভবত জং ধরা।

তারপরে আরও এগোনো – ডানদিকে দেখা গেল স্যান্ড ডিউনস, কেউ কোত্থাও নেই, সব বৃষ্টি ধোয়া।

হুন্ডারে ঢুকলাম তখন রাত আটটা, চারদিক অন্ধকার, শুধু আমাদের বাইকের হেডলাইট জ্বলছে। প্রথমে একটা টেন্ট অ্যাকোমোডেশন। দাম শুনে ছিটকে গেলাম, বলে চার হাজার টাকা। কমে করে দেব – সাড়ে তিন হাজার।

ফোটো শালা। হুন্ডারে কি অ্যাকোমোডেশন কম পড়িয়াছে? আরও এগনো যাক।

অনেকটা এগিয়ে, একটা মারুতির দেখা পেলাম, স্থানীয় লোকজন কোথায় যাচ্ছিল, তাদেরই একজন গাড়ি থেকে নেমে টর্চ দেখিয়ে আমাকে একটা গেস্টহাউসে নিয়ে গেল। নির্জন এলাকার মাঝে পাথর বিছানো রাস্তা, একটা দোতলা গেস্টহাউস। রুম দেখে তোফা পছন্দ হয়ে গেল, এক হাজার টাকা করে। রাতের খাওয়া সমেত। আর কী চাই?

ফিরে এসে সবাইকে ডেকে নিলাম, হইহই করে লাগেজ খুলে ঘরের দখল নিলাম। অ্যাটেন্ডেন্টের হিন্দি শুনেই সন্দেহ হল – ভাই তুমি কি নেপালি?

হাঁজি শাআব। নেপাল শে হুঁ শাআব।

নাম নিশ্চয়ই বাহাদুর?

একগাল হেসে সে বলল, জী শাআব। মিত বাহাদুর।

তার পর? তার পর আর কি। ফ্রেশ হয়ে মিত বাহাদুরের আপ্যায়নে টিপিকাল লাদাখি স্টাইলে লাদাখি কিচেনে বসে গরম গরম রুটি – আলুর তরকারি, ডাল ভাত আর অমলেট।

এমন ঘুমোলাম যে রাতে সুমিত নাক ডেকেছিল কিনা, টের পাই নি।


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.