[পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭] এবং [পর্ব ৮] -এর পরে …
৬ই জুন ২০১৫ – অষ্টম দিন
আগের দিন প্রায় সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সকালে উঠে মনে হল, আকাশ পরিষ্কার। অন্তত বৃষ্টি হবার মত পরিস্থিতি নেই। বাহাদুর এবং হোটেলের মালিক জানালেন, হেভি স্নো-ফলের জন্য খারদুং লা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। আজ ক্রস করা যাবে না। তা হলে উপায়?
দু রকমের প্ল্যান বেরলো। বিবেক আর আমার মতে, বন্ধ হলেও টু হুইলার নিশ্চয়ই বেরিয়ে যেতে পারবে, হয় তো ফোর হুইলারের জন্য বন্ধ রেখেছে। একবার পৌঁছে তো যাই, তার পরে দেখা যাবে। সুমিত আর গুরদীপের মতে, বন্ধই যখন, তখন আর ওদিকে গিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে বরং তুর্তুক ঘুরে আসা যাক।
আমি বোঝালাম, এখান থেকে তুর্তুক – কিছু না হোক আশি কিলোমিটার। রাস্তাও পুরোটা ভালো নয়। যাওয়া আসা মিলিয়ে একশো ষাট সত্তর কিলোমিটার পড়বে। আমাদের কাছে যা তেল আছে, তাই দিয়ে প্রথমত চলবে না, আর দ্বিতীয়ত, তুর্তুকে গিয়ে একদিন থাকাটা দরকারি – জাস্ট গেলাম, বুড়ি ছোঁয়া করে ফিরে এসে স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম তুর্তুক ঘুরে এসেছি, এইভাবে তুর্তুক দেখার কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে বরং খারদুং লা ট্রাই করি, যদি বন্ধ থাকে, তা হলে কালকের রুটেই ডুর্বুক ফিরে গিয়ে সেখান থেকে চাং লা পাস পেরিয়ে লে ফিরে যাবো।
সুমিত গুরদীপ খুব কনভিন্সড হল না। ওদের দাবি, যা তেল আছে, তাই দিয়ে আমাদের সবারই হয়ে যাবে। সে যা হয় দেখা যাবে – আগে তো হুন্ডারে ক্যামেল রাইডিং হোক! জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এখন সমস্ত রাস্তা আমার চেনা – বাকিদের লীড করে নিয়ে গেলাম স্যান্ড ডিউনসে। তো, গিয়ে দেখলাম, উটে চড়তে কেউই খুব একটা উৎসাহী নয়। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ফটোগ্রাফি করতে লেগে গেল।
ডিস্কিট থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, শিওক নদী এখানে অনেকটা চওড়া, আর পাহাড়ের মাঝে উপত্যকার অনেকখানি এলাকা জুড়ে রয়েছে বালি। মরুভূমি। পৃথিবীর উচ্চতম মরুভূমি। শীতল মরুভূমি। সেইখানে চরে বেড়ায় দুই কুঁজওলা উট। ডাবল হাম্পড ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল। গুগুল করে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন, আপাতত এইটুকু জেনে রাখুন, সুপ্রাচীন কালে এদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল মঙ্গোলিয়া থেকে, পরে এখানেই রয়ে গেছে। আদি বাসস্থান ছিল এদের গোবি মরুভূমি, আর তাকলামাকান মরুভূমি। রাজস্থানী উটের মত এরা কাঁটা ঝোপ খায় না, গুল্ম ইত্যাদি খায়, এবং বরফ খায়, শরীরে জলের চাহিদা মেটানোর জন্য।
তো, গিয়ে দেখলাম, উটে চড়তে কেউই খুব একটা উৎসাহী নয়। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ফটোগ্রাফি করতে লেগে গেল। অগত্যা, আমি একাই একশো। দিব্যি উটের পিঠে চড়ে হেলতে দুলতে পনেরো কুড়ি মিনিট চরকিপাক খেয়ে এলাম মরুভূমিতে। উটওয়ালার সাথে গপ্পো জুড়লাম। তোমাদের কদিন চলে সিজন? উটওলা বলল, এই তো, মে থেকে অক্টোবর। তারপরে কী করো? কী আর করব, বাচ্চা উটগুলোকে পরের বছরের জন্য তালিম দিই, আর লেহ্-র দিকে কোনো কাজ থাকলে সেদিকে চলে যাই।
এতে তোমাদের চলে যায়?
… উটওলা হাসল।
বেচারি প্রিয়াঙ্কার খুব সর্দি লেগেছে। নাকি পরশুদিন চাং লা টপে বরফে শুয়ে ফটো তোলার ফল। বিবেক খুব শুকনো মুখে আমার কাছে ডায়ামক্সের খোঁজ করে গেল। ডায়ামক্স দিয়ে সর্দি সারে কিনা এমন কথা জিজ্ঞেস করতে বলল, না, খারদুং লা টপে যদি শরীর খারাপ করে, তাই প্রিকশন। আবার বোঝালাম, এইভাবে ইচ্ছেমত ডায়ামক্স খেতে নেই। আমরা এই কদিনে দিব্যি হাই অলটিটিউডে থাকা অভ্যেস করে নিয়েছি, সর্দির জন্য আলাদা করে কোনও অসুবিধে হবে না। তাও, দরকার মনে হলে, ডায়ামক্স আছে আমার কাছে – খেয়ে নিও।
খানিক সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম ডিস্কিটে, যদি তেলের কিছু বন্দোবস্ত হয়, তা হলে হয় তো সবাইই তুর্তুকে চলে যেতে পারি। সুমিতকেও টাকা তুলতে হবে – ডিস্কিটে এটিএম আছে। আর ডিস্কিটের বুদ্ধমূর্তিও দেখতে হবে।
ডিস্কিটে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানে পেট্রল পাম্প টাম্প কিছুই নেই, তবে ব্ল্যাকে পেট্রল পাওয়া যায় – দুশো টাকা লিটার। বাপ্ রে! দরকার নেই আমার তুর্তুকে। আমরা এগোই। খারদুং লা বন্ধ থাকলে খালসার বা ডিস্কিটেই রাতে থেকে যাবো, ওরা চাইলে তুর্তুক ঘুরে আসুক।
ডিস্কিটের মনাস্ট্রি দেখলাম একসঙ্গে, তার পরে গুরদীপ আর সুমিত বাই বাই করে পেছনে ফিরল, ওরা তুর্তুক যাবে, বললাম, আমরা আজ হোক বা কাল, লে পৌঁছলে ওদের জন্য অপেক্ষা করব হোটেলে।
আমি না হয় না-ই গেলাম, আপনাদের তো ঘুরে আসতে অসুবিধে নেই, বেরিয়েই যখন পড়েছেন – না হয়, ভার্চুয়ালি একটু ঘুরেই আসা যাক। আসলে, সেই এক ঘ্যানঘ্যান, তিন বছর আগে, আমরা ডিস্কিট থেকে সোজা গিয়ে তুর্তুক ঘুরে এসেছিলাম, এক রাত থেকেও এসেছিলাম।
একটু বলি তা হলে, সেবারের গল্প?
ভারত পাকিস্তান সীমান্তে শিওক নদীর ধারে শেষ ভারতীয় গ্রাম হল তুর্তুক, যেখানে ভারতীয় ট্যুরিস্টরা যেতে পারে। মাত্র ২০১০ সাল থেকে এই জায়গা ট্যুরিস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, অবশ্যই পারমিট সাপেক্ষে। সম্ভবত বিদেশীদের জন্য তুর্তুক এখনো অগম্য। বাকি জম্মু কাশ্মীরের থেকে এই গ্রামের তফাৎ মূলত হল এই যে, পুরো লাদাখ এলাকায় বৌদ্ধ পপুলেশন বেশি হলেও, তুর্তুক পুরোপুরি মুসলিম পপুলেশন। এরা পাকিস্তানের বালটিস্তানী উপজাতি সম্প্রদায়ভূক্ত। বালটিক বলে এদের। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই গ্রাম ছিল পাকিস্তানের মধ্যে। তুর্তুক একা নয়, ছিল মোট পাঁচটি গ্রাম। তুর্তুক, তিয়াক্শি, থাং, পাচাথাং আর চালুংকা। একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাকে পিছে হটাতে হটাতে নিয়ে যাওয়া হয় আরও পাঁচ ছ কিলোমিটার পেছনে, যেখানে এখন এলওসি। এই পাঁচটা গ্রাম রাতারাতি পাকিস্তান থেকে ভারতের অংশ হয়ে যায়। তারপর অনেক বছর অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল এদের ওপরে, ভারত সরকার, ভারতীয় সেনা। এরা কাল ছিল পাকিস্তানী, আজ ভারতীয়, এরা ভারতে এসে চরবৃত্তি করবে না তো? তুর্তুকবাসীদের গ্রামের বাইরে বেরোতে দেওয়া হত না। আর্মির সাপ্লাই করা রেশনের ওপর বাঁচিয়ে রাখা হত এদের। এক দু বছর নয়। দীর্ঘ তিন দশক।
তারপর হল কারগিল যুদ্ধ। ১৯৯৯ সাল। তুর্তুকবাসীরা প্রথম নিজেদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেল। মূলত স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহায়তায় ইন্ডিয়ান আর্মি পাকিস্তানীদের পেটাতে পেটাতে পিছু হঠাতে পারে। অনাস্থার মেঘ কেটে বিশ্বাস ফিরে আসে এই সরল, সাদাসিধে মানুষগুলোর ওপর।
হুন্ডার পেরোবার একটু পরে আসে থোইস এয়ারস্ট্রিপ। থোইস, একটি মিলিটারি এয়ারবেস। মূলত সিয়াচেন এবং তুর্তুক সীমান্তে মোতায়েন সেনাদের যুদ্ধের সামগ্রী এবং রসদ লাগাতার পাঠাবার জন্য ব্যবহার করা হয় ভারত সীমান্তের এই শেষতম এয়ারস্ট্রিপটি। ১৯৯৯ সালের কারগিল অনুপ্রবেশের সময়ে পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে এই থোইস পর্যন্ত এলাকা ক্যাপচার করে নিয়েছিল। শিওক নদীর উপত্যকায় বানানো এই এয়ারস্ট্রিপ আসলে একটি অ্যাক্রোনিম। THOISE কথাটার পুরো অর্থ হল Transit Halt Of Indian Soldiers Enroute (to Siachen)।
থোইস পেরিয়ে, পাহাড়ের কোল দিয়ে সুন্দর আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে, কখনো ছোট ছোট ব্রিজে করে নদীর এপার থেকে ওপার, ওপার থেকে এপার করে করে বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা পৌঁছেছিলাম তুর্তুকে। যাত্রাপথে যে কত রকম শেপের আর কতরকম রঙের পাথর দেখেছিলাম, তার বিবরণ দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
নদী, পাহাড় আর গাছপালা দিয়ে ঘেরা তুর্তুক এক রূপকথার দেশ। সবুজে সবুজে ভরপুর। নীল জল, সবুজ শস্যক্ষেত, আর খয়েরি-সাদা পাথর, সবুজ ব্রিজ, আর নদীর পার ধরে আঁকাবাঁকা পথ, স্বর্গের রাস্তা বোধ হয় এখানেই। সেই ব্রিজ থেকে ডানদিকে গেলে এক সপ্তম শতাব্দীর মসজিদ দেখা যাবে। মসজিদ দেখে ফিরে আপনি যেই ব্রিজে উঠবেন, দেখবেন দু একটা বুড়ো বসে আছে ব্রিজের ওপর। গিয়ে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করুন, আপনি তো একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে এখানেই ছিলেন, না? একটু বলবেন, গল্প?
বুড়ো, তার নাম মনে নেই, হাসলেন, হ্যাঁ, বহোত ভারি জঙ্গ হুয়া থা। এক দিন পহলে হম পাকিস্তান মে থে, ফির এক দিন বাদ হম হিন্দুস্তানী বন গয়ে।
আর কারগিল যুদ্ধ? …উজ্জ্বল হয়ে উঠল বুড়োর মুখ, আমরাও জঙ্গ লড়েছি তো। ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে। তাদের সামান বয়ে নিয়ে গেছি পাহাড়ে, আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা ফৌজিদের জন্য রুটি বানিয়ে দিত, ওপার থেকে দুশমন এলে আমরাই খবর পৌঁছে দিতাম ফৌজিদের কাছে।
… দুশমন? পাকিস্তানীরা আপনাদের কাছে দুশমন? পাকিস্তানে এখনো আপনাদের রিশতেদারেরা আছেন না? – পুরো প্রশ্নটা অবশ্য করে ওঠা যায় না, শেষটুকু ছাড়া। উত্তর তো জানা, নেহাতই ভেরিফিকেশনের দায় থেকে একজন বৃদ্ধকে কেন অপমান করবেন আপনি?
বৃদ্ধ আবারও হাসলেন, আছে। তাদের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ছ বছর আগে, মক্কায় গেছিলাম হজ করতে। ওরাও গেছিল।
পাকিস্তানে যান না? পাকিস্তান তো মক্কার থেকে কাছে।
না। আমাদের পাকিস্তানের ভিসা দেওয়া হয় না। আমাদের পাকিস্তান যাওয়া বারণ। আমরা পুরোদস্তুর হিন্দুস্তানি।
… বৃদ্ধর হাসিতে কি আয়রনি মিশে ছিল? আর কথা না বাড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম বুড়ো আর তার সঙ্গীসাথিদের। বুড়োর বন্ধু হেসে শুধোলেন, এই ক্যামেরার ছবি তো আমরা দেখতে পাবো না। তাই না?
কথা দিয়েছিলাম, দিল্লি পৌঁছে তুর্তুকের ক্যাম্পের মালিকের কাছে ছবি পাঠাব। কথা রাখা হয় নি আর। এতগুলো বছর কেটে গেছে।
আরও একজনের কথা মনে পড়ছে। ইমতিয়াজ।
তুর্তুক থেকে ফেরার পথে বা যাবার পথে রাস্তায় একটা ছোট্ট গ্রাম পড়ে, বুকাদাং নামে। ছোট্ট গ্রাম, লোকজন, বিশেষত বাচ্চারা অপূর্ব সুন্দর দেখতে। আমাদের গাড়ি যখন যাচ্ছিল, তখন দেবদূতের মত বাচ্চারা হাত নেড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে “জুলে জুলে” বলে চলেছিল। রাস্তার একপাশে খয়েরি রঙের পাহাড়, অন্যপাশে শিওক নদীর পাড়ে যতটা ফাঁকা সমতল জায়গা পাওয়া গেছে, সেই জায়গা জুড়ে গমের ক্ষেত, ডালের ক্ষেত। সবুজ ক্ষেত, নীল নদী আর খয়েরি পাহাড়ের সে যে কী অসাধারণ কম্বিনেশন, সে পরের বার যখন বাইক নিয়ে যাবো, স্পেশালি এই গ্রামের ছবি তুলে আনব, এখন থেকেই ঠিক করে রেখেছি।
বুকাদাং গ্রাম পেরোতেই একটা চেকপোস্ট, সেখানে রিপোর্ট করতে হয়। আমাদের ড্রাইভার দোরজি গেল রিপোর্ট করতে, ফিরে এল একজন বয়স্ক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি লিফট চান সামনের আরেকটা গ্রাম পর্যন্ত। গ্রামের নামটা এখন ভুলে গেছি, হুন্ডার ফেরার রাস্তাতেই পড়ে, থোইস এয়ারস্ট্রিপের একটু আগে।
দিল্লিতে কোনও অচেনা মানুষকে লিফট দেওয়া স্ট্রিক্টলি নো-নো। কিন্তু এটা লাদাখ। এখানে দিল্লির তুলনায় অক্সিজেন কম ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস দিল্লির থেকে অনেক, অনেক বেশি। প্রচুর পড়েছি লাদাখ অঞ্চল সম্বন্ধে, তাই জানি, এখানে অচেনা লাদাখিকে লিফট দেওয়া সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ নিরাপদ। যানবাহন এত অপ্রতুল, লোকের সাহায্যের ওপরেই বেঁচে থাকে এরা।
তুলে নিলাম ভদ্রলোককে। নিজের পাশেই বসালাম। জায়গা সেরকম ছিল না, তবে মেয়েকে কোলে নিয়ে নিল সিকিনী। আমরা গল্প জুড়লাম লোকটির সঙ্গে।
তিনি একজন স্কুলটিচার। নাম, ইমতিয়াজ। বয়েসে প্রবীণ, হয় তো রিটায়ারমেন্টের বয়েস হয়ে গেছে আগেই, কিন্তু এই বয়েসেও তিনি সাঙ্ঘাতিক ফিট। রোজ সকালে তুর্তুক থেকে একটা আর্মির গাড়ি আসে বা ট্রাক আসে, তাতে করে তিনি পরের সেই গ্রামের স্কুলে যান পড়াতে, সন্ধ্যের দিকে অন্য কোনো ট্রাক ধরে ফেরত আসেন বাড়িতে। প্রায়ই যেমন হয়, আজও তেমনি, অনেকক্ষণ কোনো গাড়ি আসে নি এই রাস্তায়, উনি স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছেন। তাই লিফট নেবেন বলে আর্মি চেকপোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর্মি এঁদের রোজ গন্তব্যে পৌঁছতে সাহায্য করে।
ছোট ছোট গ্রাম, লোকসংখ্যা কম, তাই শিক্ষকতা করার মত মানুষও কম। তাই ষাটোর্দ্ধ হয়েও তাঁর ছুটি মেলে নি। এখানে সমস্ত গ্রামেই আর্মি থেকে স্কুল সেটআপ করে রেখেছে। তাদের নাম আর্মি গুডউইল স্কুল। আসার পথে এরকম বেশ অনেক গুডউইল স্কুল দেখেছি। এমনকি ডিস্কিটে একটা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ও দেখেছি। গুডউইল স্কুলগুলোতে বোর্ডিং ফেসিলিটিও থাকে, গ্রামের লোকজন এত গরীব, শীতে বাচ্চাদের উষ্ণ রাখার মত পর্যাপ্ত রসদ থাকে না তাদের বাড়িতে প্রায়ই। আর্মি থেকে সেই বাচ্চাদের স্কুলেই থাকার জায়গা দেওয়া হয়, আধুনিক সুযোগসুবিধা সমেত।
ইমতিয়াজ প্রথম যৌবনে পাকিস্তানি ছিলেন। এই অঞ্চল তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল। এখন ভারতীয়। কথায় কথায় বললেন, এই নুব্রা ভ্যালির লোকজন মনেপ্রাণেই ভারতীয়। পাকিস্তানের জন্য এদের মনে কোথাও কোনো সহানুভূতি নেই। পাকিস্তান তো এদের জন্য কখনোই কিছু করে নি। বরং ইন্ডিয়ান আর্মি এদের জন্য অনেক কিছু করেছে। সরকার থেকে এদের অনেক অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। বছরে একবার থেকে দুবার কালটিভেশন করতে পারে, সেই চাষের জন্য এইড, পড়াশোনার জন্য এইড, ডেইলি রেশনের জন্য এইড, লোকাল প্রডাক্ট যেমন অ্যাপ্রিকট, আখরোট ইয়াকের পশমের চাদর ইত্যাদি লেহ্-র মার্কেটে নিয়ে গিয়ে বেচার জন্য এইড, মানে ইন্ডিয়ান আর্মি যে এদের জন্য কী না-করে, সে এখানে না এলে বোঝা যায় না। এদের তাই জীবনযাত্রার মান ফিরে গেছে, অনেক সুখেশান্তিতে আছে, শিক্ষাদীক্ষার প্রসার হচ্ছে, অনেকেই বড় হয়ে আর্মিতে জয়েন করে, বা বাইরে ব্যবসা করে। ভারতের বিরুদ্ধে এদের তাই কোনও রকমের অসূয়া নেই।
পরের গ্রামে নেমে গেলেন ইমতিয়াজ, আমাদের অনেক ধন্যবাদ দিতে দিতে।
* * * * *
এবারে আমার আর তুর্তুক যাবার গল্প নেই। সুমিত আর গুরদীপ গেল তুর্তুকের দিকে, আমি, বিবেক আর প্রিয়াঙ্কা হুন্ডার থেকে ফিরে চললাম উলটোপথে। বিবেকেরও ছুটি শেষ হয়ে আসছে, ওদেরকেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিল্লি ফিরতে হবে। তিনদিনে শ্রীনগর রুট ধরে লেহ্ থেকে দিল্লি ফিরবে, যেটা আমরা এসেছি চারদিনে।
হুন্ডার থেকে ডিস্কিট হয়ে খালসার পর্যন্ত একই পথ, তারপরে রাস্তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বাঁদিকের রাস্তা হল সেই শিওক-আগম রুট, যেখান দিয়ে আমরা কাল এসেছি, আর ডান দিকের রাস্তা চলে যাচ্ছে, খারদুং-নর্থ পুলু হয়ে খারদুং লা টপ, সেখান থেকে নামলেই লে।
খালসারে পৌঁছে সেই হোটেলেই লাঞ্চ সারলাম। হোটেলের ছেলেটার কাছ থেকে আবার ফোন চেয়ে নিয়ে সিকিনীকে ফোন করলাম, বললাম এই ব্যাপার। আজ লে ফিরতেও পারি, না-ও পারি, চিন্তা যেন না করে, আমি লে পৌঁছলেই খবর দেব। খারদুং লা বন্ধ আপাতত।
সিকিনীও রিমোটলি এইসব টেনশন নিয়ে তিতিবিরক্ত, বার বার করে বলল, লে পৌঁছেই যেন আমি বাইক গতি কার্গোতে বুক করিয়ে ফ্লাইটে ফিরে আসি। আমার মনেও যে তেমন ইচ্ছে হচ্ছে না তা নয়, শ্রীনগর রুট দিয়ে ফেরা বেশ চাপের ব্যাপার হয়ে যাবে। মানালি খোলে নি। সুতরাং আমাদের সোমোরিরি এবারেও দেখা হল না, হবে না। কিন্তু যে এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে ফিরছি, সেটাও খুব কম কিছু নয়। এই শিওক আগম রুটে খুব খুব কম ট্রাফিক আসে, সেই রকম একটা প্রায় দুর্গম রুট ধরে আমরা নুব্রা ভ্যালি পৌঁছেছি কাল, ঐ রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে, এই অভিজ্ঞতাই বা কজনের হয়?
একটা জিনিস খেয়াল করলাম, সকাল থেকে আমরা হুন্ডার হয়ে ডিস্কিট হয়ে এখন খালসারে এসে বসে আছি, একটাও টুরিস্ট গাড়ি কিন্তু লে-র দিক থেকে আসে নি। যেখানে যেখানে খোঁজ নিয়েছি, সবাই বলেছে এক কথা, খারদুং লা বন্ধ, আট ফুট বরফ জমে গেছে, ব্রো রাস্তা সাফ করছে, কালকের আগে কোনও চান্স নেই খোলার। … টু হুইলারও কি যেতে পারবে না? – না। বন্ধ মানে, বন্ধ। আর্মি থেকে একটা প্রাণীকেও আগে এগোতে দেবে না।
হোটেলের ছেলেটাই বলল, এক কাজ করুন, আরও খানিকটা এগিয়ে যান, এখান থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে খারদুং গ্রাম। সেখানে বেশ কিছু হোটেল হোম-স্টে অপশন পেয়ে যাবেন। পারলে এগিয়ে যাবেন খারদুং লা-র দিকে, না পারলে ওখানেই রাতে থেকে যান। ফিরে আসতে হবে না। একান্তই ফিরে আসতে চাইলে আমাদের এখানে হোমস্টে আছে, ঘর পেয়ে যাবেন।
আমি, বিবেক আর প্রিয়াঙ্কা মিলে আলোচনায় বসলাম আবার। কী করা উচিত। আমি বললাম, ওয়র্স্ট কেস ধরে নিয়ে প্ল্যান করা উচিত। আমরা এগবো, যদি খারদুং গ্রামে ঘর না পাই, তা হলে আবার পঁচিশ কিলোমিটার ফিরে আসতে হবে। এখান থেকে লে একশো পঁচিশ কিলোমিটার। আমার কাছে যা তেল আছে, তাতে লে পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে, তবে এর পরে অর্ধেক রাস্তা আপহিলস, তেল বেশি টানবে, তাই ওয়র্স্ট বিবেচনা করতে হলে আগে তেলের খোঁজ নিতে হবে। তেল পাওয়া গেলে এক রকমের প্ল্যান, না পেলে আর কোনও রিস্ক নেবার নেই, আমরা এখানেই রাতে থেকে যাবো।
খোঁজ নিলাম, পেট্রল এখানেও পাওয়া যাবে, দেড়শো টাকা নেমে পার লিটার।
তাই সই। আমি দু লিটার, বিবেক দু লিটার – ভরে নিলাম নিজের নিজের বাইকে তিনশো টাকা করে দিয়ে। আমার বাইকের যা মাইলেজ, দু লিটারে আশি কিলোমটার এক্সট্রা তো কনফার্ম করে নিলাম।
আশেপাশে আরও দু একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল – এরা নুব্রা থেকে লে ফেরত যাবার টুরিস্ট, আমাদের মতই – সবাই আটকে গেছে। ড্রাইভারদের সাথে কথা বললাম, সবাই জানাল, শিওক আগম রুট দিয়েও আসা যাচ্ছে না, কালকের বৃষ্টিতে অনেকটা এলাকা জল ভরে গেছে। গাড়ি একটা পয়েন্টের পরে এগনো যাবে না। আর এগোনো গেলেও, চাং লা পাসও বন্ধ হয়ে গেছে হেভি স্নো-ফলের জন্য। সুতরাং, আপাতত লে যাবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ।
যা থাকে কপালে, বলে আমরা তিনজন দুটো বাইকে এগোলাম। ছ-সাত কিলোমিটার এগিয়েছি কি এগোই নি, পেছন থেকে বিবেকের বাইকের হর্ন – পি-প, পি-প, পি-প। থামতে বলছে।
থামলাম। কী ব্যাপার? সিকিস্যার, আমার না, বুকে হাল্কা হাল্কা ব্যথা করছে, মনে হয় অক্সিজেনের কমতি হচ্ছে, তাই জন্য। ডায়ামক্স দিন।
যতভাবে পারলাম চিয়ার আপ করলাম, তোমার কিছু হয় নি বাপু, মনে হচ্ছে তাই ও রকম হচ্ছে, এইভাবে মঠো মুঠো ডায়ামক্স খেও না। এক কাজ করো, খারদুং পর্যন্ত গিয়ে ডায়ামক্স দেবো। একটু রেস্ট নাও, নিয়ে চলো।
বিকেল সাড়ে তিনটে চারটে নাগাদ পৌঁছলাম খারদুং গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম, মেরেকেটে কুড়িখানা ঘর হবে হয় তো, একটা সরকারি গেস্ট হাউস আছে, আর বেশ কিছু বাড়ির গায়ে নোটিস লাগানো – লাদাখি হোম-স্টে। নেমে দু একটাতে খোঁজ নিলাম। কিন্তু ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই – সে রাস্তার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। রাস্তার দু পাশে সারি সারি পার্ক করা গাড়ি, সব দিল্লি, ইউপি, পাঞ্জাব কিংবা কাশ্মীরের নাম্বারপ্লেট। প্রচুর লোক এখানে এসে আটকে আছে। এমনকি গোটাতিনেক মোটরসাইকেলও দেখলাম দাঁড় করানো রয়েছে।
অনেক খুঁজেপেতে একটা ঘর পেলাম, প্রায় আধপাকা ঘরের মধ্যে গোঁজা দুটো খাট। কিন্তু আমরা তো তিনজন। লাদাখি মহিলা স্মার্ট হেসে বললেন, কোই বাত নেহি হ্যায় জি, এক ম্যাট্রেস এক্সট্রা লাগা দুঙ্গি। পার বেড একশো টাকা।
এইবারে আমি পড়লাম একটু চাপে, লাভবার্ডসের সাথে একঘরে থাকাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? মানে, আমার নিজের কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু অসুবিধে তো এদের – বিপন্ন মুখে বিবেকের দিকে তাকালাম। বিবেকেরও অস্বস্তি হচ্ছিল না, তা নয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর নেই, সেটা দুজনেই উপলব্ধি করলাম। অতএব, একটা ঘরেই তিনজনকার ব্যবস্থা হল, রাতে কয়েক ঘন্টাই তো শোবার প্ল্যান। সবাই টায়ার্ড।
আপাতত বিকেল ছটা বাজে। আকাশ ঝকঝকে নীল, সাদা সাদা মেঘেরা ঘোরাফেরা করছে, চারপাশে ঝকঝক করছে বরফের পিক – লাদাখি হোমস্টে মালকিন দূরে একটা পাহাড় দেখিয়ে বললেন, ওই পাহাড়ের ওপাশে খারদুং লা টপ – এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
ফ্রেশ হবার মত বিশেষ কোনও প্রভিশন নেই – আমাদের ঘরের সামনে গোয়ালঘর, একটু পরেই সেখানে নিঃশব্দে এসে শেল্টার নিল গোটাপাঁচেক গরু, সম্ভবত হোমস্টে-মালকিনের নিজস্ব গরু। সেই গোয়ালঘরের ওপাশে একটা কোনওরকমে খাড়া করা মাটির ঘর, সামনে টিনের দরজা, সেখানে মাটির টয়লেট – ইন্ডিয়ান স্টাইলের কমোড, সেখানেই হাল্কা হবার প্রভিশন, ধারেকাছে জলের সোর্স দেখলাম না, অতএব – ছোট দরকার ছাড়া ওমুখো হবার চেষ্টাই করলাম না।
বাইক থেকে লাগেজ খুলে ঘরে রেখে ক্যামেরা নিয়ে বেরোলাম। আপাতত আজ সারা সন্ধ্যে কিছুই করার নেই, আগে যাওয়া সম্ভব নয়। কাল সকালেই চেষ্টা করতে হবে। আর কাল যদি সুমিত-গুরদীপরা ফিরে আসে এই রাস্তায়, তা হলে ওদের সাথেই ফেরা যাবে।
এই বাড়িটায় ছিলাম, ডান দিক থেকে দু নম্বর দরজা।
ওপরে ছাদেও উঠেছিলাম মই বেয়ে – ঘুঁটে শুকোতে দেওয়া ছিল। তবে সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছিল পাহাড়ের।
ঘরের সামনে সোলার হিটার – জল গরম করার জন্য –
হোমস্টে-র সামনের দিকটা একটা ছোট রেস্টুরেন্ট। সেখানে কটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল পাতা। চা বিস্কুট পাওয়া যায়। সেখানে জমিয়ে বসেছেন এক প্রৌঢ় আর এক মাঝবয়েসী লোক। দূর থেকে হনুমান টুপিই বলে দিচ্ছে – বাঙালি। কাছে এসে দেখলাম, হ্যাঁ, বাংলাতেই কথা হচ্ছে। বেড়াতে এসেছিলেন নুব্রাতে, এখন লে-তে ফিরতে পারছেন না, তাই কাছের আরেকটা হোমস্টে-তে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃদ্ধ যারপরনাই বিরক্ত, ধুর ধুর, এর চেয়ে নৈনিতাল গেলেই হত, এতদূর ঠেঙিয়ে এখানে এসে কী হল? কী আছে এই ভ্যালিতে? এ তো আর পাঁচটা পাহাড়ি ভ্যালির মতই। শীতে মরে যাছি, এখন কাল আমাদের ফেরার ফ্লাইট, যদি কাল না পৌঁছতে পারি?
মাঝবয়েসীর স্ত্রী এলেন খুব বিরক্ত মুখে – বাবা, ঠাণ্ডায় একটু লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছিলুম, আবার চা খেতে ডেকে নিয়ে এলে? এখানে তো ব্রিটানিয়ার বিস্কুট পাওয়া যায় না – চা-টাও খেতে কেমন পানসেপানা …
এগোলাম। এদিক ওদিক ইতস্তত লোকজন ছড়িয়েছিটিয়ে আছে – সামনেই একটা কোয়ালিস দাঁড় করানো, নয়ডার নম্বর। পাড়ার লোকজনকে দেখে আলাপ করতে এগিয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে ছিলেন এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক। পরিচয় করলেন, মিস্টার আসাদ আহমেদ। প্রপার্টি ব্রোকার। লক্ষনৌতে বাড়ি, এখন নয়ডায় থিতু। আসার ইচ্ছে ছিল না, ভায়রাভাই জোর করে টেনে এনেছে, উনি কাল বিকেল থেকে আটকে আছেন। খারদুংলা টপের এগারো কিলোমিটার আগে নর্থ পুলু, সেইখানে গেছিলেন, তদারকিতে ব্যস্ত এক কর্নেলসাহেবের ফোন নম্বর নিয়ে এসেছেন, কর্নেলসাব ওঁকে বলেছেন টাইম টু টাইম ফোন করে যেতে, পাস খুললে উনিই জানাবেন। তো, কাল থেকে দু তিনবার ফোন করে জেনেছেন এখনও পর্যন্ত অর্ধেক বরফ সাফ হয়েছে, আর বৃষ্টি না হলে কাল খুলে যেতে পারে। দুদিকেই প্রচুর ট্র্যাফিক জমে গেছে।
আসাদবাবু আমাদের পাশের হোমস্টে-তেই আছেন। একটা আশার কথা – আজ সকাল থেকে আর বৃষ্টি হয় নি – আকাশও মোটামুটি পরিষ্কার। খানিক গল্পগুজব করে আমরা এগোলাম। আমি একটা ভিডিও নিচ্ছিলাম আশপাশের –
হঠাৎ দেখি বিবেক হাওয়া, খানিক বাদে ফিরে এল একটা ছোট প্যাকেট হাতে করে, তাতে ছোট ছোট শিশি। কী ব্যাপার? না পুপ্পু-র (প্রিয়াঙ্কার আদরের নাম) জুখাম হয়েছে কিনা, তাই এখানে খুঁজে ও একটা হোমিওপ্যাথি ডিসপেনসারি খুঁজে বের করে সেখান থেকে সর্দির ওষুধ নিয়ে এসেছে। চার পাঁচটা বড় ছোট শিশি। পুপ্পু ওখানেই চেয়ারে বসে ছিল, বিবেক তাকে গিয়ে ধৈর্যধরে সব বোঝাল – পুপ্পু, পহলে এক নাম্বার অওর তিন নাম্বার, ফির এক ঘন্টা বাদ দো নাম্বার অওর পাঁচ নাম্বার, ফির এক ঘন্টা বাদ তিন নাম্বার অওর দো নাম্বার …
খানিক শুনে আমার মাথা ঘেঁটে গেল, আমি সরে এলাম। বাপরে কী প্রেম! যাবতীয় শিশি কিনে নিয়ে চলে এসেছে প্রেমিকার সর্দি সারাবার জন্য। আমরা যে কেন এসব দেখেও শিখি না।
আস্তে আস্তে সূর্য ঢলে এল, পাহাড়ের চূড়োগুলো রূপোলি থেকে সোনালি হয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকার নামতে শুরু করল। সেই সময়ে বিবেকই দেখাল একটা জিনিস – রেস্টুরেন্টের জন্য পাতা চেয়ারের সামনে কেউ অর্ধেক জাগ জল ঢেলেছিল, সেই জল মাটির ওপর জমে বরফ হয়ে গেছে।
জমাট বাঁধা বরফ ঠিক নয়, ঝুরো বরফ –
কী ব্যাপার, এখানে এত ঠাণ্ডা নাকি? তা হলে জাগের জল কেন বরফ হয় নি? আমার কেন এত ঠাণ্ডা লাগছে না?
সাড়ে আটটা নাগাদ হোমস্টে-র মালকিন আমাদের ডিনারের জন্য ডাকলেন, তখন বেশ ঠাণ্ডা। গরম গরম রুটি আর আলু-ক্যাপসিকামের তরকারি এতই উপাদেয় ছিল যে আমি ছখানা রুটি খেয়ে ফেললাম, আর তরকারি দেখেও প্রিয়াঙ্কার “ইয়ে ভ্যাজ হ্যায় না?” প্রশ্নটাকে আমি বিলকুল ক্ষমা করে দিলাম।
এইবারেই সবচেয়ে অস্বস্তিকর পর্বটা। রাতে এক ঘরে শোয়া। দুটি খাট, আর মাঝে নিচে একটা গদি পাতা। লেপ কম্বল প্রচুর দেওয়া আছে – ঠাণ্ডা লাগার কথা নয়। আমিই নিচে শুতে চাইছিলাম, কিন্তু আমি কিনা খুব সিনিয়র – সিকিস্যার, তাই সমীহ করে বিবেক আমাকে একটা বেডে শোয়াল, অন্য বেডে প্রিয়াঙ্কা, আর নিচে বিবেক।
আজ খুব বেশি চলা হয় নি, নিতান্তই হুন্ডার থেকে খারদুং এসেছি। খুব টায়ার্ড নই, ফলে ঘুম আসতেও দেরি হচ্ছে – এদিকে বেশি নড়তে চড়তেও পারছি না, কে জানে, লাভবার্ডস কী ভাববে। লেপের নিচে কাঠ হয়ে শুয়ে আছি, খানিক বাদে বিবেকের গলা কানে এল।
– পুপ্পু, এক নাম্বার অওর তিন নাম্বার গোলি খা লি থি?
– হুঁ (নাক টানার আওয়াজ)
– ঠিক হ্যায়, ম্যাঁয় ইয়াদ দিলা দুঙ্গা, এক ঘন্টা বাদ ফির দো নাম্বার অওর পাঁচ নাম্বার।
-হুঁ (নাক টানার আওয়াজ)
সব নিস্তব্ধ। এইবারে আমার আস্তে আস্তে ঝিমুনি এল, আবার কতক্ষণ বাদে কে জানে, চটকা ভাঙল বিবেকের আওয়াজে – পুপ্পু, সো গয়ি? দো নাম্বার অওর পাঁচ নাম্বার দে দুঁ?
-হুঁ (নাক টানার আওয়াজ)
– ইয়ে লে – ফির এক ঘন্টা বাদ …
রাতে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল ওই এক নম্বর পাঁচ নম্বরের আওয়াজে, এর বেশি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি – শেষমেশ দুর্দান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল পৌনে সাতটায় এক্কেবারে ঘুম ভাঙল, তখন ঘরের মধ্যে সোনালি রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আজ কি খারদুং লা খুলবে?
প্রিয়াঙ্কা যখন প্রেমিকা থেকে বৌ হবে তখন ওকে ঘন্টা পাত্তা দেবে 😥
LikeLike