[পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭], [পর্ব ৮] এবং [পর্ব ৯] -এর পরে …
৭ই জুন ২০১৫ – নবম দিন
ঝকঝকে রোদ্দুরে বেরিয়ে এলাম। আকাশে হাল্কা সাদা মেঘ, আর তার চারপাশে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া লাদাখের বিখ্যাত নীল আকাশ! হায় রে, এই আকাশ আর দুদিন আগে পেলে প্যাংগং-এর কত ভালো ছবি উঠত। যাক গে, যা গেছে তা গেছে।
নিচে নামলাম চায়ের দোকানে। কালকের বাঙালি ফ্যামিলির আর দেখা পেলাম না, তারা হয় তো লেপ ছেড়ে বেরোন নি। আসাদজির সঙ্গে দেখা হল। সদাহাস্যময় মানুষটি এক রকম জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন, চা খাওয়ালেন। আরও দুটি ছেলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। একেবারে ইয়ং ছেলে – চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়েস। কাল যে দুটো বুলেট দেখছিলাম, সেগুলো এদের। কেরালার ছেলে, ইন্ডিয়ান নেভিতে কাজ করে, লাক্ষাদ্বীপে পোস্টেড। লাদাখ বেড়াতে এসেছে। মোটামুটি ভালোই হিন্দি বলে। দিব্যি আলাপ জমে উঠল।
সকাল বেলার খারদুং গ্রামের রাস্তা।
নাম-না-জানা পাখি – লাদাখে এদের খুব দেখা মেলে।
চায়ের দোকানের ছোট্ট বাচ্চাটা –
সকালবেলার দৃশ্য
আকাশে হেলিকপ্টার পাক খাচ্ছে। এটা এখানকার রুটিন। সারাদিন ধরে আর্মির হেলিকপ্টার পাসগুলোতে টহল দেয়, কেউ কোথাও ফেঁসে গেছে কিনা দেখার জন্য। আসাদজি কি সেই কর্নেলসাবকে একবার ফোন করবেন?
আসাদজি বললেন, দশটা নাগাদ করব। এখন তো একটু রোদ পুইয়ে নিই, এমন সুন্দর রোদ উঠেছে। বারবার ফোন করলে কর্নেলসাব বিরক্ত হতে পারেন।
তা ঠিক। বসে গল্পগুজব হল। দিল্লির গল্প, কেরালার গল্প। অরুণ বলে কেরালিয়ান ছেলেটার ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম, যখন কেরালা যাবার প্ল্যান করব, ওর সাথে যোগাযোগ হবে, কোচিতে ওদের বড় বাড়ি আছে, সেখানে আমাদের নেমন্তন্ন করে রাখল। এইভাবে আস্তে আস্তে নটা বাজল, সোয়া নটা নাগাদ দেখতে পেলাম হুশ হুশ করে কতকগুলো ইনোভা কোয়ালিস ট্যাভেরা নেমে এল খারদুং লা-র দিক থেকে, তার পরে আরও কিছু, তার পরে আরও আরও আরও গাড়ি, ট্যুরিস্টবোঝাই গাড়ি সব চলেছে নুব্রার দিকে।
জয় গুরু, খারদুং লা খুলেছে তার মানে। আসাদজি দোকানদারের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে কর্নেলকে ফোন করলেন। কর্নেল জানালেন হ্যাঁ, খারদুং লা খুলেছে, এখন লে-র দিক থেকে ট্র্যাফিক ছাড়া হচ্ছে। একটার সময়ে নুব্রার দিক থেকে ট্র্যাফিক খুলবে। আমরা যেন সাড়ে বারোটা নাগাদ নর্থ পুলু পৌঁছে যাই। … আমাদের অবস্থা তখন, সেই বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওরের যাবার খবরে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের যেমন আনন্দ হয়েছিল, সেই রকমের এক্সট্যাসি। অবশেষে আজ খারদুং লা জয় হবে নিজের বাইকে।
দশটা দশ নাগাদ উল্টোদিক থেকে বেশ কয়েকটা মোটরসাইকের গ্যাং আসতে শুরু করল। এরা তার মানে খবর পেয়েছে নুব্রাতে বসে, এইবারে জড়ো হচ্ছে একে একে। দু চারটে দল বেরিয়ে যাবার পরে দেখি দূর থেকে দুটো চেনা মোটরসাইকেল এগিয়ে আসছে – একটা বুলেট, একটা অ্যাভেঞ্জার।
তিন থেকে আবার আমরা পাঁচ হলাম। পাঁচ না বলে এখন সাত বলাই ভালো, কেরালার ছেলেদুটোও রয়েছে। আসাদজি তো গাড়ি নিয়ে যাবেন ভায়রাভাইয়ের সাথে – কোয়ালিস। গুরদীপ আর সুমিতের গল্প শুনলাম। তুর্তুক নয়, ওরা গেছিল পানামিকের দিকে। পানামিক সেক্টরে পৌঁছে সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মিদের আপ্যায়ন পেয়েছে, তারা ওদের কাজু কিশমিশ ফ্রুট জুস খুব খাইয়েছে, তারপরে ওরা ফেরত এসে কাল খালসারে রাত কাটিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই এসেছে। দুজনেই আর্মির এই আপ্যায়নে খুব খুব খুশি। (আগের বারে আমি আর্মির আপ্যায়নের এক্সট্রিম লেভেল অবধি এনজয় করে এসেছি, সুতরাং আমার কাছে ব্যাপারটা নতুন নয়)
সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোমস্টে-র বিল মিটিয়ে আমরা সবাই স্টার্ট করলাম। বিবেক আবার ঘ্যানঘ্যান করে দুখানা ডায়ামক্স নিয়ে নিল। গুরদীপ জনান্তিকে আমাকে বলল, এরা তো বিয়ের পরে কনট্রাসেপ্টিভ পিলের বদলে ডায়ামক্সই খাবে মনে হচ্ছে।
খানিকক্ষণের মধ্যেই নর্থ পুলু পৌঁছে গেলাম, সেখানে তখন সারি সারি গাড়ির মেলা বসে গেছে, কয়েকশো গাড়ি।
উল্টোদিক থেকে তখনও গাড়ি আসছে – লে-র দিক থেকে।
বারোটা বাজে। টু হুইলারদের এন্ট্রি করতে হবে – এন্ট্রি সেরে এলাম। প্রচুর লোক তখন হাজির হচ্ছে, দিল্লি, পঞ্জাব, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, অস্ট্রিয়া। আলাপ হল, গল্পগুজব হল। চকলেট এক্সচেঞ্জ হল।
ঠিক একটার সময়ে নুব্রার দিক থেকে গাড়ি ছাড়া হল। যে কোনও পাসেই এটা নিয়ম – প্রথমে যাবে টু হুইলার, তার পরে ফোর হুইলার, শেষে ভারী ট্রাক, সিক্স হুইলার ইত্যাদি। আমরা সবার আগে বেরিয়ে গেলাম। ভালো রাস্তা একেবারে ভ্যানিশ – আবার সেই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, ঝাঁকুনি, বরফগলা জলে মিশে সে এক এক্সপিরিয়েন্স। খানিক ওপরে ওঠার পরেই বুঝতে পারলাম, বাইকের টানতে কষ্ট হচ্ছে, তবে আজ আর বন্ধ হল না, সুন্দর চলতে থাকল।
আগের বারের সঙ্গে এবারের অভিজ্ঞতার তফাৎ হচ্ছে, বরফ সাঙ্ঘাতিক বেশি। কী লেভেলে স্নো-ফল হয়েছিল তার আন্দাজ পাচ্ছি, যত ওপরে উঠছি, তত। ক্রমশ দেখলাম মাটিতেও কাদায় বরফে মাখামাখি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে উঠছি, বেশি পাওয়ারের গাড়িগুলো ক্রমশ আমাকে ওভারটেক করে বেরিয়ে যাচ্ছে, একবার দূর থেকে খারদুং লা টপ দেখা গেল, তারপরে আবার বাঁকে হারিয়ে গেল। আর বোধ হয় দু চার কিলোমিটার দূরে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, অক্সিজেনের কমতি বেশ বোঝা যাচ্ছে, খুব হাল্কা চালে চালাতে লাগলাম, কোনওভাবে যেন শ্বাসের গতি না বেড়ে যায়।
কিন্তু কোথা হইতে কী হইয়া গেল, একটা জায়গায় এসে – বুঝতে পারি নি, বাইকের চাকা চলে গেল বরফের ওপরে, দুদিকে এবং রাস্তার মাঝেও চাপ চাপ বরফ, জাস্ট সামনের গাড়ির টায়ারের দাগ ধরে চলা উচিত এইসব রাস্তায়, চলছিলামও তাই, কিন্তু বরফে একবারের জন্য চলে গেল সামনের চাকা, স্কিড করল, আমি ব্যালেন্স হারালাম, এবং ছিটকে পড়লাম।
লিখছি বটে “ছিটকে পড়লাম”, আসলে পড়লাম যারপরনাই নরম একটা কুশনের ওপর, থুপুস করে। পাশে ডাঁই করে রাখা বরফের ওপরে। বাইকটা এদিকে কাত, আমি ওদিকে কাত। একটুও লাগে নি, কিন্তু পাছে নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, তাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলাম বরফের ওপরেই। পেছন থেকে দুটো গাড়ির ড্রাইভার বেরিয়ে এসে ধরাধরি করে আমার বাইকটাকে দাঁড় করাল, আমার লাগে নি জেনে নিশ্চিন্ত হল, আমাকেও হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।
দেখলাম, বাইকের ইঞ্জিনের জায়গাটা দিয়ে হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ভয়ে ভয়ে এক মিনিট পরে বাটন দাবালাম। গাড়ি একবারে স্টার্ট হল, যেন কিছুই হয় নি। ফার্স্ট গিয়ারে ফেলে গাড়ি একটু এগোতেই দেখি সামনে খারদুং লা টপ। আমি টপ থেকে জাস্ট একশো মিটার আগে পড়ে গেছিলাম।
খারদুং লা টপ বরফে বরফে ভর্তি। আগের বারে যে পাঁচিল দেখেছিলাম, সেই পাঁচিল এইবারে উধাও, বরফের মধ্যে জাস্ট জেগে রয়েছে বোর্ডটা।
প্রিয়াঙ্কাকে বলতে সে আমার একটা ছবি তুলে দিল। তাড়াহুড়োয় ঘোমটা খুলতেই ভুলে গেছিলাম। এতও কিছু ঠাণ্ডা ছিল না।
ভিডিও তুলব বলে মোবাইলটা বের করতে গেলাম, দেখি ছটা মিসড কল, দুটো মেসেজ, আর, আর, ফুল সিগন্যাল। এয়ারটেল, রোমিং। খারদুং লা টপে এয়ারটেল পোঁছে গেছে? ভিডিও তোলার কথা ভুলে গিয়ে সিকিনীকে আর বাবাকে পর পর ফোন করলাম, তিন দিন প্রায় নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম, আর প্রথম ফোন করছি কে-টপ থেকে। ভাবা যায়?
এর পর ডিসেন্ড। সেই একই রকমের ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে দুলকি চালে যখন সাউথ পুলু এসে পৌঁছলাম, তখন বাকে সাড়ে তিনটে। একটা ছোট চায়ের দোকান সেখানে, আর্মির জন্য। সেখানে বসে ম্যাগি আর কফি খেলাম। খানিক বাদে সুমিত এল, মুখটা শুকনো। কী ব্যাপার? ওর অ্যাভেঞ্জারের শকার ভেঙে গেছে, ও-ও নাকি একবার পড়ে গেছিল। এখন শকার না সারানো গেলে বাকি রাস্তা কভার করা সম্ভব নয়। আমাকে বলল, সিকিস্যার, আমি আজ দেখছি যদি লে-তে গিয়ে সারানো যায়, না হলে কাল সারিয়ে তার পরেই বেরোব।
আমার মনে তখন কী যেন হয়ে গেল। এতদিন একসাথে চলেছি, একে অপরের গাড়ি ঠেলে দিয়েছি, স্পেশালি গুরদীপ প্রায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার গ্লাভস উদ্ধার করে এনে দিয়েছে, আর আমি আমার নিজের কথা ভেবে ওদের ছেড়ে ফ্লাইটে ফিরে যাবো, বাইক কার্গোতে বুক করে?… না, যাই ঘটুক। এখন যাত্রাশেষ পর্যন্ত আমরা একসাথেই থাকব।
সাউথ পুলুর পরে আবার ঝকঝকে রাস্তা। প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময়ে লে-তে ফিরলাম, আবার মিসেস লিন্ডার গেস্টহাউসে ওঠা। এইবারে লাভবার্ডসের জন্য আলাদা ঘর, আর আমরা তিনজনে একটা ঘর নিলাম, এক্সট্রা বেডসমেত।
টুকটাক শপিং হল, আমি নিজের জন্য একটা বাফ কিনলাম – এতদিন এদের মাথায় দেখেছি, এটাকে যে বাফ বলে জানতাম না। দীর্ঘক্ষণ হেলমেট পরে থাকলে চুলের ক্ষতি হয়, ঘাম বসে। বাফ জড়ানো থাকলে চুল বেঁচে যায়। সুমিত আমাদের তিনজনের জন্য একটা একটা করে লাদাখ ফ্ল্যাগ কিনে দিল, বাইকে লাগানোর জন্য। তড়িঘড়ি অ্যাভেঞ্জারের “শকার”-এর খোঁজ করা হল, শকার কেনাও হল, কিন্তু আজ রোববার, লে পুরো বন্ধ। কাল সকাল নটার আগে কিছু করা যাবে না।
বিবেক প্রিয়াঙ্কার উপায় নেই, তারা ভোরবেলাই বেরোবে, তাদের তিনদিনে দিল্লি পৌঁছে অফিস জয়েন করতে হবে। নেভির ছেলেদুটোও ভোর সাড়ে পাঁচটায় স্টার্ট করবে, সুমিত আমাকে বলল, সিকিস্যার, আপনি ওদের সাথেই বেরিয়ে যান, আমি আর গুরদীপ পরে আসব, খামোকা আমার জন্য কেন লেট করবেন?
আমি তখন মন বদলে ফেলেছি, আর যাই হোক, আমার অফিসের তাড়া নেই। আমি সুমিত গুরদীপের সাথেই আসব। এই দুজনের সাথে আমি যতটা সেফ আর সিকিওর্ড অনুভব করি – সেটা বাকিদের সাথে হবে না। একটা বন্ডেজ গড়ে উঠেছে আমাদের তিনজনের মধ্যে। সেটাকে স্বার্থপরের মত ভাঙা যায় না। সুমিতের কাঁধে হাত রেখে বললাম, গুরু, চাপ নিও না, আমরা দিল্লি পর্যন্ত একসাথেই যাবো। আমার বাইকেও ইঞ্জিন অয়েল ঢালতে হবে, চেন টাইট করতে হবে, একসাথেই রিপেয়ার করে কাল আমরা বেরোব।
লাদাখের পালা শেষ। অনেক কিছুই হল না – মারসিমিক লা, মানালির দিকের রুট, সো মোরিরি। ঠিক আছে, ফির কভি।
রাতে গ্র্যান্ড ডিনার হল – চাইনিজ। গলা পর্যন্ত ভরে আমরা হোটেলে ফিরলাম। বিবেক প্রিয়াঙ্কার সাথে হ্যান্ডশেক হল, ওরা কাল ভোর ভোর বেরিয়ে যাবে, আপাতত আর দেখা হবে না। ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে ঘুম। কাল থেকে ফেরার যাত্রা শুরু। চারদিনেরই টার্গেট রাখছি, যদিও সুমিতকে তিনদিনেই পৌঁছতে হবে। মানালি রুট এবারে হল না। ফির কভি। গুরদীপ ততক্ষণে চিটকুল আর স্পিতির গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে দিয়েছে, কথা দিলাম, আবার আমরা একসাথে বেরোব, সময়সুযোগ হলেই।