জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – একাদশ পর্ব

[পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭],  [পর্ব ৮], [পর্ব ৯]এবং [পর্ব ১০] -এর পরে …

৮ই জুন ২০১৫ – দশম দিন

লাদাখের ইতিহাস বহু প্রাচীন। সিল্ক রুটের মাধ্যমে প্রথম এখানে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হয়। সে প্রায় দ্বিতীয় শতাব্দীর ঘটনা। তখন এখানে ছিল কুশান সাম্রাজ্যের বিস্তার। ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই জনপদের উল্লেখ করেন বৌদ্ধ পরিব্রাজক ফা-হিয়েন। লাদাখের কথা জানতে পারে মানুষ। এর পরে এই জায়গার অধিকার নিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে বহু বছর ধরে লড়াই হয় তিব্বতের, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বিভিন্ন রাজবংশ এখানে রাজত্ব করে গেছে এবং তিব্বতের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।

ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু হয় মুসলমান আক্রমণ। এলাকায় মুসলিম পপুলেশন বাড়তে থাকে। লাদাখিদের নিজেদের মধ্যেই মারামারি শুরু হয়, লাদাখ ভাগ হয়ে যায় আপার আর লোয়ার লাদাখে। শেষে উনিশ শতকে এসে শে-বাসগো গোষ্ঠীর রাজা ভাগান, দুই লাদাখকে ফের এক করেন এবং নামগিয়াল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

এই নামগিয়াল রাজবংশ আজও আছে। এঁরা বৌদ্ধই ছিলেন, পরে সপ্তদশ শতকে আবার যখন তিব্বত আক্রমণ করে, রাজা কাশ্মীরিদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই সময়ের ভারত অধীশ্বর সাহায্য মঞ্জুর করেন এই শর্তে যে রাজা দেলদান নামগিয়াল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন এবং লেহ্‌ শহরে একটি মসজিদ বানাবেন।

ভারত অধীশ্বরের নাম, আওরঙ্গজেব। সেই জামা মসজিদ আজও রয়েছে লেহ্‌ মার্কেটের একপ্রান্তে।

এর পরে উনিশ শতকে শিখ সাম্রাজ্য দখল করে নেয় লাদাখকে। ১৮৩৪ সালে জেনারেল জোরাওয়ার সিং, রাজা শেসপাল নামগিয়ালকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং নির্বাসন দেন স্টক এলাকায়। স্টক কাংড়ি, আজ যেখানে লোকজন ট্রেক করতে যায়, সেখানেই আজও বাস করেন নামগিয়াল রাজার বংশধরেরা।

এর পর ১৯৪৭এর বাঁটোয়ারায় লাদাখ পড়ে ভারতে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান লাদাখ এবং কারগিল দখল করে নেয়। তাদের তাড়াতে না তাড়াতেই ১৯৪৯ সালে চীন নুব্রা ভ্যালির বর্ডার চিরতরে বন্ধ করে দেয়। পরিসমাপ্তি ঘটে সহস্রাব্দপ্রাচীন সিল্ক রুটের। পরের বছর, ১৯৫০এ, চীন তিব্বত দখল করে নেয়, দলাই লামার সাথে হাজার হাজার তিব্বতী চলে আসে এই এলাকায়, আশ্রয় নেয় ভারতে।

এর পর ১৯৬২ সালে চীনের আগ্রাসী মনোভাব দেখে, চীন যুদ্ধের পরে পরেই ভারত সরকার তৈরি করে শ্রীনগর লেহ্‌ হাইওয়ে। সেই সময়েই চীন লেহ্‌ থেকে তিব্বতে যাবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে লাদাখকে নিয়ে পরের পর প্রকল্প তৈরি হয়, কারগিল থেকে লাদাখকে আলাদা করে দেওয়া হয়। লাদাখ অটোনোমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল তৈরি হয়। এই সমস্তকিছুর পরিণতি আজকের লাদাখ।

অনেকদিন পর্যন্ত লাদাখ ছিল অ্যাডভেঞ্চার যাত্রীদের গন্তব্য। ট্যুরিজম সেইভাবে পল্লবিত হয়ে ওঠে নি বহুকাল, যতদিন না ১৯৯৯ সালে কারগিলে পাকিস্তানি সেনাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। কারগিল যুদ্ধের পর নতুন উদ্যমে সেনাবাহিনির তরফে রাস্তাঘাট মেরামত করা শুরু হয়, এবং যথাসম্ভব বেশিমাত্রায় ট্রাফিক ফ্লো বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে ট্যুরিজমকে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে তোলা হয়। তখনও পর্যন্ত ছুটকো ছাটকা দুটো একটা সিনেমায় লাদাখের সীন থাকত, ১৯৯৮ সালে রিলিজ হওয়া দিল সে সিনেমা তার মধ্যে একটা ছিল।

লাদাখ নতুন করে আমজনতার কাছে পপুলার হয়ে ওঠে থ্রি ইডিয়টস সিনেমা রিলিজ করার পর। সালটা ছিল দিল সে-র ঠিক এক দশক পরের – ২০০৯। সেই সময় থেকেই আমি এদিক সেদিক পড়তে শুরু করি লাদাখ যাত্রার ট্র্যাভেলগ।

এর পর ২০১০। আচমকা হওয়া হড়কা বান – যাকে ইংরেজিতে বলে ক্লাউড বার্স্ট বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড, লেহ্‌ শহরকে প্রায় ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। প্রচুর জীবনহানি হয়, সম্পত্তি নষ্ট হয়। এমনিতে লেহ্‌ শহরে বৃষ্টি হওয়া খুবই রেয়ার ব্যাপার। পামীর মালভূমির এই অংশটা – আমরা ছোটবেলায় ভূগোলে যেমন পড়েছিলাম, বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল। এদিকে বৃষ্টি বিশেষ হয় না। লাদাখিরা তাই তাদের ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে – না, বৃষ্টির নয়, ম্যাঘ দে পানি দে বলে কেউ গান করে না এ দেশে, এখানে প্রার্থনা করা হয় ঈশ্বরের কাছে, যেন তিনি আশপাশের সমস্ত গ্লেসিয়ারে বরফের সাপ্লাই অব্যাহত রাখেন। এই হিমবাহের জলই লেহ্‌ শহরে জলের মূল উৎস। তো, সেই হিমবাহ উপচে পড়ে লেহ্‌ শহরকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ২০১০ সালে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশাল, কিন্তু ততদিনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে বহু বহু লাদাখ-প্রেমী অনলাইন এবং অফলাইন ফোরাম। সাহায্য উপচে পড়েছিল লাদাখকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। সরকারি বেসরকারি সবরকমের সাহায্যে খুব তাড়াতাড়িই লাদাখ আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়।

সেই লাদাখে আমার দ্বিতীয়বারের জার্নিও শেষ।

ঠিক ছিল, একই রাস্তা দিয়ে যখন ফেরা হবে, আর কোথাও থামাথামি নেই, যতক্ষণ না গায়ে ব্যথা হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা চলব, সম্ভব হলে আজকের মধ্যেই সোনমার্গ বা শ্রীনগর পৌঁছে যাব। কিন্তু আপাতত সুমিতের বাইকের শক-অ্যাবজর্ভার – যাকে চলতি ভাষায় “শকার” বলা হয় (ভাবো – দুটোর মানে পুরোপুরি উলটো, শকার আর শক-অ্যাবজর্ভার) ফিট না করিয়ে বেরনোর কোনও উপায় নেই। তাই ঠিক হল আজ আমরা যাবো কারগিল পর্যন্ত। পরের দিনগুলোয় যত বেশি সম্ভব টানব।

দোকানপাট খোলে সাড়ে নটা নাগাদ। সেই মত ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট সেরে গেস্ট হাউসে চেক আউট করে নটার সময়ে স্টার্ট করলাম। অসংখ্য স্মৃতি পেছনে ফেলে আমরা লে থেকে বেরোবার পথ ধরলাম। পেট্রল পাম্প থেকে একটু এগিয়ে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে একটা মোড় থেকে একটু বাঁদিকে ডাইভার্সন নিয়ে মেকানিক শপ। সুমিত তো আগের দিনই শকার কিনে রেখেছিল, আমি একটা ইঞ্জিন অয়েল কিনে নিলাম। আমাদের তিনজনকার বাইকেরই অল্পবিস্তর চেক আপ হল, ব্রেক টাইট, চেন টাইট, ইঞ্জিন অয়েল ঢালা।

সব সেরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফাইনাল স্টার্ট করা হল। মন খুবই খারাপ, মানালি রুট হল না। গুরদীপেরও মন খারাপ। সবাই মিলে বললাম, আবার হবে। আবার আসব। এবার মানালি দিয়ে এসে সো-কার, সোমোরিরি দেখে মানালি দিয়েই ফিরে যাবো।

লে ছেড়ে বেরিয়ে নিমুর দিকে একটু এগোতেই আকাশ আবার কালো হয়ে এল, সঙ্গে বৃষ্টি। আবার গাড়ি থামিয়ে রেনকোট পরতে হল।

নিমু পৌঁছবার আগেই অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেল। এখানে মেঘ প্রায় মাথার কাছাকাছি উচ্চতায় থাকে বলে তাদের তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়া যায়। নিমু যখন ঢুকলাম, তখন সামনে নীল আকাশ। রানওয়ের মত মসৃণ রাস্তা। উড়িয়ে দিলাম গাড়ি – ওড়াতে গিয়ে দেখতে পেলাম, পাহাড়ী রাস্তায় গাড়িতে স্পিড তোলা অত সহজ নয়, স্পেশালি যখন পেছনে লাগেজ বাঁধা থাকে। সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স কাজ করে বাঁকের সময়ে, ফলে ব্রেক মারতে গেলেও ডানদিকে টার্ন নেবার সময়ে বাইকের পেছনদিকে একটা বাঁদিকে হেলে যাবার টেনডেন্সি চলে আসে।

যাই হোক, ক্রমশ পেরিয়ে গেলাম লামায়ুরু, আলচি, ফোটুলা – মাঝে একটা কী যেন নাম গ্রামের, সেখানে বসে খানিক ম্যাগি আর চা খেলাম। মাথার ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘেরা ভাসছে।

এর পর ফোটুলাও পেরিয়ে গেলাম। খানিক এগিয়ে একটা বাঁকের মুখে আবার খানিক বসে বিশ্রাম নিলাম – সামনেই মুলবেক, সেটা পেরোলেই তো কারগিল। সামনে পাহাড়ে একপাল ভেড়া চরছে নিশ্চিন্তে।

ফিরতে সত্যিই ইচ্ছে করছে না।

চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম, নিজের কাছেই। সেই চ্যালেঞ্জের জবাব আমি দিয়েছি। আর আমাকে সেই দিনগুলো হন্ট করে বেড়াবে না।

চ্যালেঞ্জ। নিজের কাছে। জীবনের কাছে।

ফ্ল্যাশব্যাক। আবার দু হাজার বারো। ফ্যামিলির সাথে প্রথমবার লাদাখ ভ্রমণ শেষ করে ঘরে ফিরে আবার সুটকেস গুছিয়েছি। অফিসের দীর্ঘ অ্যাসাইনমেন্ট, দুবাই যেতে হবে। অন্তত এক দেড় বছরের জন্য।

জুলাই মাসের উনিশ তারিখে গিয়ে পৌঁছেছিলাম দুবাই। যাওয়া হয়েছিল বিজনেস ভিসায়, কথা হয়েছিল ওখানে পৌঁছে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়া হবে। তো সেই মত আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ওয়ার্ক পারমিটের কাজকর্ম শুরু করলাম। একগাদা ফর্ম ভরতে হয়, পারমিটের কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করতে হয়, মেডিক্যাল এক্সামিনেশন দিতে হয়, এই সব।

আমি গেছিলাম জুলাই মাসের কুড়ি তারিখে, আমার ঠিক একমাস আগে সেখানে পৌঁছেছিল আরেকটা ছেলে, বাঙালিই, তার তখন ওয়ার্ক পারমিটের কাজকর্ম চলছিল, তা সেই নিয়েই টুকটুক এগোচ্ছিলাম। বয়েসে অনেকটা ছোট হওয়া সত্ত্বেও নীলাঞ্জনের (আসল নাম নয়) সঙ্গে বেশ জমে গেল। একই হোটেলে আমরা ছিলাম, একই ফ্লোরে।

আগস্টের দশ তারিখ মত হবে সেদিন, নীলাঞ্জন আমাকে জানাল, ওর ওয়ার্ক পারমিট বোধ হয় হবে না, রিজেক্ট হতে চলেছে। … কেন রে?

নীলু বলল, আর বোলো না সিকিদা, এদের নিয়মকানুন খুব কড়া। আমার বছর দুয়েক আগে একটা নিমোনিয়া মতন হয়েছিল, লাঙসে জল জমে ইনফেকশন হয়ে গেছিল। সেই প্যাচ দেখে এরা মনে করছে আমার টিবি হয়েছিল। আর কারুর টিবির হিস্টোরি থাকলে এরা কোনও অবস্থাতেই ডাব্লু-পি, মানে ওয়ার্ক পারমিট, দেয় না।

সে আবার কী? যক্ষ্মা বা টিবি তো ইন্ডিয়াতে অনেকেরই হতে পারে, সেটা তো দীর্ঘস্থায়ী কোনও ব্যাপার নয়, চিকিচ্ছে করলে সেরে যায়, তাই নিয়ে দু বছর বাদে কারুর পারমিট আটকানোর মানে কী?

মানে আবার কী। এখানে ঐ শরিয়তি নিয়ম টিয়ম। শুধু দুবাই বলে নয়, মিডল ইস্টের সমস্ত মুসলিম দেশেই এই নিয়ম। পৃথিবীর বাকি কোনও দেশে অবশ্য এই নিয়ম নেই। এই মুহূর্তে তোমার কোনও অ্যাকটিভ ইনফেকশন না থাকলে তুমি যে কোনও দেশের ওয়ার্ক পারমিট পেতে পারো। কিন্তু এই মিডল ইস্টের দেশে নিয়ম হচ্ছে, লাঙসে কোনও প্যাচ পাওয়া গেলেই তাকে বের করে দেয়, একেবারে নো এন্ট্রি। আমি অবশ্য বলেছি, আমার টিবি নয়, নিমোনিয়ার কেস ছিল, কিন্তু ট্রিটমেন্ট হয়েছিল টিবিরই, আর লাঙসে প্যাচ রয়ে গেছে। কিন্তু এরা মানবে বলে মনে হয় না।

আমি মুখে বললাম বটে, চিন্তা করিস না, ডাক্তাররা নিশ্চয়ই এখানে গোমুখ্যু নয়, নিমোনিয়া আর টিবি নিশ্চয়ই আলাদা করে বুঝতে পারবে। … বললাম বটে, কিন্তু আমার ভেতরে তখন প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেছে। নীলুর না হয় নিমোনিয়ার হিস্টোরি, কিন্তু আমার তো একেবারে টিবিরই কেস ছিল। চার বছর আগের ঘটনা, কিন্তু তাতে কী? ফুসফুসে সে দাগ তো আমার রয়ে গেছে, রয়ে যাবে আজীবন! তবে কি আমারও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে?

হোটেলে ফিরে গুগলে খুঁজতে বসলাম, দুবাইয়ের এ ব্যাপারে কী নিয়ম নীতি। যা পড়লাম, মনটা বেশ দমে গেল। নীলু যা বলেছে, ঠিক তাই। অসহায় অবস্থায় অনেকেই অনেক খিস্তিখাস্তা করেছে মিডল ইস্টের দেশের নামে, ইসলামের নামে, শরিয়তের নামে, কিন্তু হাজারে হাজারে এ রকমের উদাহরণ বেরোতে লাগল, স্ত্রীয়ের ওয়ার্ক পারমিট হয়ে গেছে, স্বামীর হয় নি, কারণ স্বামীর টিবি হয়েছিল, স্বামী-স্ত্রীর হয়ে গেছে, বাচ্চা রেসিডেন্স পারমিট পায় নি কারণ বাচ্চার টিবি হয়েছিল, হাজারে হাজারে উদাহরণ। প্রত্যেককেই হয় ফ্যামিলি থেকে আলাদা হয়ে দুবাইতে বা কাতারে চাকরি করতে হচ্ছে, নয় তো এখানে চাকরির সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে হয়েছে।

আর এটা শুধু ভারতীয় নয়, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান, পাকিস্তানি, চীনা, জাপানী, রাশিয়ান, সবার, সব্বার একই গল্প। টিউবারকিউলোসিসের কোনও চিহ্ন ফুসফুসে পাওয়া গেলে, যত পুরনো ঘটনাই হোক, তাকে চারদিনের নোটিসে বের করে দেওয়া হয় এই সমস্ত দেশ থেকে, এবং আজীবন নো এন্ট্রি।

আমার তখন বোঝা হয়ে গেছে, আমার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে, তবু আশা, আমি তো একদম সুস্থ, ভীষণ ফিট, আসার আগে আমার কোম্পানির হয়েও মেডিক্যাল টেস্ট দিয়ে এসেছি, সেখানেও আমি কিছু লুকোই নি, সব জানা সত্ত্বেও ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে ফিট ফর ট্র্যাভেল সাট্টিফিটি দিয়েছেন, ফুসফুসে ঐ একটি দাগ ছাড়া আমার শরীরে আর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই, আমাকে কি তবুও আটকাবে এরা? দেখাই যাক না।

চব্বিশ পঁচিশ তারিখ নাগাদ, আমার কোম্পানির যে ভিসা কোঅর্ডিনেটর, তার ফোন এল, আপনি তো আগে বলেন নি আপনার টিবির হিস্ট্রি ছিল?

আমি বললাম, আলাদা করে কিছু বলতে হয় সেটাও তো জানতাম না বস্‌, আসার আগে কোম্পানি থেকে আমাকে মেডিকাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাতে বিস্তারিত আমার কেস হিস্ট্রি লেখা আছে, আমি তো লুকোই নি, সেটা দেখেও বা না দেখেও আপনারা কেন আমাকে দুবাই নিয়ে এলেন?

মহম্মদ নাদিম, কোঅর্ডিনেটর, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলেন না, আসলে তিনি আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট খুলেও দেখেন নি, ওটা বিদেশে পাঠানোর আগে সবাইকে করাতে হয়, তাই করানো হয়েছিল, কেউ খুলে দ্যখে ট্যাখে না। চিন্তিত গলায় বললেন, আপনার মেডিক্যাল রিপোর্টে এভিডেন্স এসেছে ওল্ড টিবি প্যাচের, আপনাকে আরও মেডিক্যাল টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আমি গাড়ি পাঠাবো, আপনি মঙ্গলবার এগারোটা নাগাদ এদের মেডিক্যাল সেন্টারে যাবেন একবার।

টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে আমার আপত্তি নেই, আমি তো জানি, আমার মধ্যে অ্যাকটিভ ইনফেকশন পাওয়া যাবে না। ঐ দাগটা ছাড়া আর কিছুই নেই আমার। কিন্তু তবু, নার্ভাসনেস আস্তে আস্তে ঘিরে ধরল আমাকে। নীলু বলল, ও চিন্তা করার কিছু নেই সিকিদা, যা হবে তা হবে। আমাকেও যেতে হচ্ছে মেডিকেল সেন্টারে স্পুটাম স্যাম্পল দিতে। তোমাকেও দিতে হবে।

গেলাম, কৌটো ধরিয়ে বলল, স্পুটাম স্যাম্পল দিতে হবে, পরপর তিনদিন। কাল প্রথম স্যাম্পল দিয়ে দ্বিতীয় কৌটো নিয়ে যাবেন।

এই মেডিক্যাল সেন্টারটা দুবাই শহরের একদম বাইরে। অফিস থেকে অনেকটা যেতে হয়, মরুভূমির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। আপনারা এয়ারলিফট সিনেমাটা দেখেছেন তো? সেখানে যে রকমের রাস্তা দেখাচ্ছিল, মসৃণ চকচকে হাইওয়ে, তার মধ্যে পাতলা লেয়ারের মত ঢেউ খেলে যাচ্ছে বালির কণা, সেই রকমের রাস্তা ধরে শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে সেন্টার, সেখানে গিজগিজ করছে লেবার টাইপের লোকজন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এইসব দেশ থেকে আসা গরীব লোকজন। পরণের পোশাক, আচার আচরণ প্রতিটা জিনিস থেকেই দৈন্য ফুটে বেরোচ্ছে, চারপাশটা বেশ নোংরা, এবং সেন্টারের কর্মীদের এই ধরণের লোকজন দৈনিক হ্যান্ডল করতে হয় বলে, অবভিয়াসলি, তাদের মেজাজটাও বেশ উগ্র। সেই উগ্র মেজাজের ঝাঁঝ আমিও পেলাম, বেশ ধমকের সুরে একটা প্লাস্টিকের কৌটো আমার হাতে দিয়ে একজন বললেন, সম্ভবত তিনিও ভারতীয়, কাল এতে স্পুটাম স্যাম্পল দিয়ে পরের কৌটো নিয়ে যাবেন।

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, কিন্তু আমার তো কাশি টাশি হয়ই না, স্পুটাম দেব কী করে? গলা তো একেবারে পরিষ্কার?

তিনি আরও উষ্ণ গলায় বললেন, ও সব জানি না, যেভাবে হোক, দরকারে গলায় আঙুল দিয়ে কাশবেন, যা আসবে, সেটা এতে দেবেন। কীভাবে করবেন জানি না, মোদ্দা কথা আপনাকে স্পুটাম দিতে হবে।

এ কী শাস্তি রে বাবা! হোটেলে ফিরে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করালাম। জোর করে কাশবার চেষ্টা করলাম, কাশি এল না। গলায় আঙুল দিতে হয় নি কোনওদিন, জীবনে প্রথম গলার ভেতরে আঙুল ঢোকালাম, ওয়াক উঠল শুধু, কাশি কি আর ঐভাবে হয়?

সকালে উঠে সেইভাবেই যা বেরলো, তা নিতান্তই মুখের লালা। তাই নিয়ে গেলাম। স্যাম্পল দেখে সেই লোকটি বলল, সেই একই রকমের ধমকের সুরে, এটা স্পুটাম নয়, স্পুটাম চাই।

আমিও ধৈর্য হারাচ্ছি এবার, বললাম, এর বেশি কিছু বেরোচ্ছে না তো আমি কী করব?

সে লোক কোনও কথা শুনতেই রাজি নয়, ওসব জানি না, সবাই দিচ্ছে, তোমাকেও দিতে হবে, বাইরে পার্কিংয়ে চলে যাও, যেভাবে হোক স্পুটাম নিয়ে এসো এই কৌটোয়।

আগস্ট মাসের দুবাইতে রোদের বড় তেজ। আমি দিল্লির ছেলে, রোদে আমার অসুবিধে হয় না, কিন্তু সেদিনের রোদও বড় কড়া লাগছিল। শেডবিহীন পার্কিং লট, গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি হাস্যকার বিবিধ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি নকল কাশি কেশে গলা থেকে একটু “স্পুটাম” বের করার জন্য।

কী বেরলো কে জানে, দ্বিতীয়বারে কৌটো দেখে লোকটা নিয়ে নিল। আরেকটা কৌটো দিয়ে বলল, পরের দিনও একইভাবে।

তিনদিন চলল এই অমানুষিক ব্যাপার স্যাপার। তারপরে আরও একদিন, ব্লাড স্যাম্পল নিল, স্কিন টেস্ট হল, এবং তারও তিনদিন পরে আবার একদিন যেতে হল। সেখানে আমার মতন অনেককে বসানো হল একটা ঘরে, বিভিন্ন দেশের লোকজন, প্রত্যেককে একটা করে মাস্ক দিয়ে বলা হল পরে থাকতে।

কী ঝামেলা রে ভাই। আমার যখন অ্যাকটিভ ইনফেকশন ছিল, তখন আমাকে কোনও মাস্ক পরতে হয় নি, আজ কেন পরতে হবে? তবু, ধমক চলছে এলোপাথাড়ি, সেইভাবেই একঘন্টা বসে থাকার পরে ডাক্তারের ঘরে ডাক এল, তিনি বললেন, শ্বাস নাও, পিঠে স্টেথো ছোঁয়ালেন, বুকে ছোঁয়ালেন, “বাস, হো গয়া। এবার তুমি অফিসে যাও, তোমার রিপোর্ট সাতদিনের মাথায় তোমার কোম্পানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”

অন্তত আমাকে তো বলুন, কী পেলেন? “এখন কিছু বলা যাবে না,” জোরে জোরে মাথা নাড়লেন বদমেজাজি লোকটি, “সমস্ত রেজাল্ট এক করে রিপোর্ট বানানো হলে তবেই বলা যাবে। আর প্রশ্ন নয়, এখন বেরোও, পরের লোককে পাঠিয়ে দাও।”

কোম্পানির গাড়িতে আবার মরুভূমি পেরিয়ে ফিরলাম অফিসে। দুবাই ফেস্টিভাল সিটিতে।

ছ দিন বাদে আমার কোম্পানির ম্যানেজারবাবু আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর রুমে। সেখানে মুখ কালো করে বসে আমার প্রোজেক্ট ম্যানেজার, এইচআর, ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক নিজে – ইনিও ভারতীয়, আমাকে বিশেষ পছন্দ করতেন।

আমি তৈরিই ছিলাম মানসিকভাবে, খবরটা পেয়েও তাই বিশেষ কোনও হেলদোল হল না মনে। চোদ্দ তারিখের মধ্যে আমাকে দুবাই ছাড়তে হবে। শুধু বললাম, সবই ঠিক আছে, আমাকে শুধু ওদের মেডিকাল রিপোর্টটা একটু দেখতে দেবেন?

কোম্পানির ম্যানেজারবাবু বললেন, ও তুমি কিছু বুঝবে না, পুরোটাই আরবী ভাষায় লেখা। বললাম, তবুও দেখান, আরবী ভাষা ট্র্যানস্লেট করিয়ে নেওয়া যাবে কোথাও। উনি বললেন, ঠিক আছে, আমি অফিসে ফিরে তোমাকে সফট কপি পাঠাবো।

এত বছর কেটে গেছে, সে রিপোর্ট আমি আজ পর্যন্ত আর চোখে দেখতে পাই নি। তিন দিনের নোটিসে আমাকে দুবাই ছেড়ে ভারতে ফিরে আসতে হয়েছিল।

তার পরেও অন্য ঘাটের জল খেয়ে, জীবনের কাছে আপাতভাবে পরাজিত আমি বাড়ি ফিরেছিলাম আরো তিন মাস বাদে। সম্পূর্ণভাবে সুস্থ একটা মানুষের ওপর একটা স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া হয়েছিল, তুমি বাতিল – আমাদের দেশে।

এমন নয় যে আমি বিদেশ দেখি নি, বিদেশে থাকি নি। দেখেছি, বেশ কিছু দেশ। কিন্তু নিজের শরীরে কোনও রকমের সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল, সেটা শুধু আমি বলে নয়, যে কোনও মানুষের অপমানিত বোধ করার জন্য যথেষ্ট।

অপমানের প্রাথমিক অভিঘাত কেটে যাবার পরে চেপে বসেছিল জেদ। আমাকে বাতিল করে দেবে? ওরা? অমানবিক, পাশবিক শরিয়তি নিয়মের দোহাই দেখিয়ে? আমি বাতিল নই। অন্য সুস্থ সবল অনেক অনেক লোকের থেকেও আমি বেশি সুস্থ। এটা আমি প্রমাণ করে ছাড়বোই। আমি বাতিল হবো না।

দু হাজার বারো। সেই আমার বদলে যাবার শুরু। চিরকালের রোগা আমি, দুর্বল আমি, আন্ডারওয়েট আমি নিজের ভেতর নিজের শক্তি খুঁজতে শুরু করতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারি, এই মোটরসাইকেলই আমার আশ্রয়। প্রথমবারের জন্য লেহ্‌ লাদাখ ঘুরে এসে বুঝেছিলাম আমার ফুসফুস এতটাও কমজোর নয় যে হাই অলটিট্যুডে অক্সিজেনের অভাব সইয়ে নিতে পারবে না। বরং অনেক অন্য লোকের তুলনায় আমি বেশি সহজ থাকতে পারি কম অক্সিজেনেও। লাদাখ তাই আমাকে টানছিল, সেদিন থেকেই। সেই সময় থেকেই। নিজের কাছেই নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছিল দীর্ঘদিন। ঘুমের মধ্যে হাতছানি দিয়ে যেত শেষরাতের নির্জন হাইওয়ে। সঙ্গী পেলে ভালোই হত, কিন্তু না পেলেও একা এগিয়ে যেতে দুবার ভাবি নি, কারণ ফিরে আসাটা আমার কাছে কোনও অপশন ছিল না। ফিরে এলে আমি হয় তো আর বাঁচতে পারতাম না।

এবং, এবারে একলা বেরিয়ে পড়েও সঙ্গী পেয়ে গেলাম। যাদের সঙ্গে আমি এখন বাড়ির দিকে ফিরছি। এর চেয়ে ভালো সঙ্গী এই জার্নিতে কেউ আশা করতে পারে না। দেখা হল না বেশ কিছু জায়গা, কিন্তু যাদের সঙ্গ পেলাম, সে প্রাপ্তি তো কারুর থেকে কোনও অংশে কম নয়। পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি। কিচ্ছু উপায় থাকে না, সময়ে অসময়ে সেই দাড়িওলা জোব্বা-পরা কবি দার্শনিককে উদ্ধৃত করা ছাড়া।

খানিক বসে থাকার পর উঠলাম। কারগিল আর খুব বেশি দূরে নেই।

এর পরে মুলবেক পেরোলাম, সামনে দশ কিলোমিটার মত খারাপ রাস্তা, ধীরে ধীরে যাচ্ছি, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সুন্দর একটা রামধনু উঠেছে। … ক্যামেরা তখন ব্যাগবন্দী, ব্যাগ আটকানো বাইকের পেছনে, বের করা সম্ভব ছিল না – তাই রামধনু দেখতে দেখতে এগোলাম। সন্ধ্যের ঠিক মুখে কারগিল পৌঁছনো গেল। এবারে অন্য একটা হোটেলে।

খুব সুন্দর হোটেলের ভিউটা, একদম পার্কিং-এর সামনের ঘরটা পেলাম, ফলে আমাদের বাইক থেকে আর লাগেজ খুলতে হল না। জাস্ট ঘরে ঢুকলাম, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ও হ্যাঁ, দিনের আলো নেভার আগে পার্কিং-এর পেছনে নেচে নেচে বয়ে চলা সুরু নদীর ভিডিও নিতে ভুলি নি।

সুরু নদীর ধারের হোটেলে যখন আরাম করছি, হঠাৎ আসাদজীর ফোন – সেই আসাদজী, যাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল খারদুং গ্রামে। ভায়রাভাই আর তিনি পালা করে ননস্টপ গাড়ি চালিয়েছেন গতকাল থেকে – একটু আগে দিল্লি পৌঁছেছেন – দু দিনে। আমরা কেমন আছি, কতদূর পৌঁছলাম, সেসব খোঁজ নেবার জন্য ফোন করেছিলেন। ভালো লাগল, কত অল্প আলাপে মানুষ আপন হয়ে যায়।

কারগিলে কেন জার্নি শেষ করলাম? … কারণ, কারগিলের পরে দ্রাস, ষাট কিলোমিটার আগে। দ্রাসে কোনও থাকার জন্য হোটেল নেই। একটা না দুটো গেস্ট হাউস – খালি না থাকার চান্সই বেশি। আর দ্রাসের পরেই সাঙ্ঘাতিক খারাপ রাস্তা শুরু হবে – জোজিলা পাস হয়ে সোনমার্গ। দ্রাসে পৌঁছতেই আমাদের অন্ধকার হয়ে যেত, আর অন্ধকারে জোজিলা পাস ক্রস করার মত বোকামো একেবারে করা উচিত নয় – তাই কারগিল।

কাল ভোর পাঁচটায় ওঠা, আর ছটার মধ্যে বেরনো। সাড়ে সাতটার মধ্যে যাতে দ্রাস পৌঁছতে পারি, আর জোজিলা পাস পেরিয়ে বারোটার মধ্যে শ্রীনগর পেরোতে পারি।

=================================================================================

৯ই জুন ২০১৫ – একাদশ দিন

স্বর্গ থেকে ক্রমশই দূরে সরে আসছি। কারগিলে মনোরম ঠাণ্ডা ছিল – রাতে একটা কম্বল চাপা দিয়ে তোফা ঘুম হল, অবশ্য তার আগে টিভি চালিয়ে নব্বইয়ের দশকের একটা ঝুল সিনেমা দেখে উপভোগ করতে ছাড়ি নি আমরা। সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়লাম সক্কলে। কাল রাতেই হোটেলের বিল মেটানো হয়ে গেছে, জাস্ট ওঠা, মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরা, আর বেরিয়ে পড়া। লাগেজ তো বাইকেই বাঁধা আছে।

স্টার্ট করতে করতে সাড়ে ছটা বেজেই গেল, দেরি না করে এগিয়ে গেলাম। আর কোথাও থামাথামি নেই। কারগিল শহর পেরোতেই চারিদিক নির্জন, কেবল পাহাড়, ভোরবেলার রোদের মিষ্টি আলোছায়ার খেলা, আর পাশ দিয়ে নাচের ছন্দে বয়ে চলা সুরু নদী। কারগিল থেকে দ্রাসের রাস্তা যে এত সুন্দর, আগে কেন খেয়াল করি নি? … মনে পড়ল, এই রাস্তায় আমি এসেছি এর আগে দুবার। এক ২০১২ সালে, আর দুই, কদিন আগেই। প্রথমবারে গাড়িতে বসে ছিলাম, কোনওভাবে মিস করে গেছি। আর দ্বিতীয়বারে তো অন্ধকারে পেরিয়েছি। আজ প্রকৃতির রূপ দেখে মোহিত হয়ে গেলাম – কেবলই মনে হচ্ছিল, গাড়ি থামিয়ে খানিক ছবি নিই, ভিডিও তুলি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে – না, আর কোথাও থামাথামি নয়, সম্ভব হলে আজ রাতের মধ্যে জম্মু, না পারলে উধমপুর পর্যন্ত তো পৌঁছতেই হবে, যাতে তিনদিনে দিল্লি ফেরা যায়।

লে থেকে তিনদিনে দিল্লি ফেরার ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়, অত্যন্ত স্ট্যামিনা না থাকলে সাড়ে তেরোশো কিলোমিটার তিনদিনে কভার করা বেশ চাপের ব্যাপার, আর আমরা তো তিনদিনও নয়, আড়াইদিন হাতে নিয়ে নেমেছি। বিবেক-প্রিয়াঙ্কা কাল ভোরে বেরিয়ে পড়েছিল, আমরা বেরিয়েছি দুপুর পার করে। অর্ধেক দিন কাল লে-তেই নষ্ট হয়েছে, দেখা যাক, কতদূর পৌঁছনো যায় আজ।

দ্রাস যত কাছে এগিয়ে আসছে, আমরা নিচের দিকে নামছি, কিন্তু ঠাণ্ডা যেন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একটু পরেই দেখলাম অলমোস্ট আমাদের লেভেলে সামনের পাহাড়ে একটা ঝর্ণা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত জমে আছে। আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে বরফের ছোপ। শীতের প্রকোপ চার লেয়ার পেরিয়ে গায়ের চামড়ায় মালুম দিচ্ছে। সত্যিই অদ্ভূত অবস্থান এই দ্রাসের, লে থেকে এতটা নিচে হয়েও দ্রাস হল পৃথিবীর সেকেন্ড কোল্ডেস্ট ইনহ্যাবিটেটেড প্লেস। শীতকালে এখানে মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত টেম্পারেচার নেমে যায়।

সাতটা কুড়িতে আমরা দ্রাস পৌঁছে গেলাম। হাল্কা বিরতি, চা বিস্কুট আর পকোড়া দিয়ে জলখাবার সারা হল। তারপর আবার এগনো।

দ্রাসের সাইনবোর্ডটা পেরোতে যতটুকু সময়, তার পরেই ভাঙাচোরা রাস্তা শুরু। খানিক এগোতেই গাড়ির লম্বা লাইন, ছোট্ট একটা নদীর ওপর সরু ব্রিজ, আর সেই ব্রিজ পেরোচ্ছে উল্টোদিক থেকে আসা মিলিটারি ট্রাকের দল। একটার পর একটা, একটার পর একটা, একটার পর একটা … যতদূর চোখ যায়, ওই ওখানে একটা বাঁক আছে রাস্তায়, কেবলই দেখছি একটা করে ট্রাক বেরিয়ে আসছে সেই বাঁক থেকে। বেশ খানিকক্ষণ বাদে একটা ট্রাকের দয়া হল, সে ব্রিজের আগে সাইড করে দাঁড়িয়ে আমাদের ইশারা করল পার হয়ে আসতে।

এর পর রাস্তার অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, চালচামড়া ওঠা, পাথরভরা রাস্তা। এতটা কি খারাপ ছিল আসার দিন? কে জানে, মনে পড়ল না।

প্রায় তিরিশ কিলোমিটার এইভাবে চলার পরে আচমকা রাস্তা ভালো হয়ে গেল, আবার স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। খানিক বাদেই গুমরি পৌঁছে গেলাম। গুমরি চেকপোস্টে ট্রাফিক আটকে রাখা ছিল, কারণ সোনমার্গের দিক থেকে ট্রাফিক আসছিল। আমরা যাওয়ামাত্র দ্রাসের দিকের ট্র্যাফিক ছেড়ে দেওয়া হল। আমরা উঠতে শুরু করলাম জোজিলার দিকে।

এই নিয়ে তিনবার জোজিলায় পা পড়ল। সেই দু হাজার বারোতে একবার, আর কপালের ফেরে এইবারে দু বার। খানিক এগোতে আবার রাস্তা খারাপ, তারপরে রাস্তার দুপাশে অল্পবিস্তর বরফের স্তুপ, আর তার পরে দূর থেকে দেখা গেল জোজিলা পাস।

পাঁচ মিনিটের বিরতি দিলাম জোজিলায়, ততক্ষণেই ছেঁকে ধরেছিল চা-কফি-ম্যাগি-স্লেজওলাদের দল। কোনওরকমে ওদের পাশ কাটিয়ে আবার চলা শুরু, কিন্তু আবার খানিক দূর যেতে না যেতেই – জ্যাম। সারি সারি ট্রাক, ট্যুরিস্টবোঝাই গাড়ি, প্রাইভেট গাড়ি, স-ব দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? না আগে রাস্তা বন্ধ। কেন? ট্রাক ফেঁসে গেছে। সকাল থেকেই সব্বাই দাঁড়িয়ে, যতক্ষণ না ব্রো এসে সেই ট্রাক সরাতে পারবে, ততক্ষণের জন্য রাস্তা বন্ধ।

তখন সকাল দশটা বাজে। একটা একটা করে গাড়ি কাটিয়ে এগোতে শুরু করলাম আমি আর গুরদীপ। সুমিত আগে বেরিয়ে গেছে, ওকে দেখা যাচ্ছে না – নিশ্চয়ই আগে কোথাও ওয়েট করবে আমাদের জন্য।

একটা … দুটো … দশটা … পনেরোটা … কুড়িটা … চল্লিশটা … কত যে গাড়ির পাশ দিয়ে এগোলাম, আর খেয়াল নেই, অনন্ত জ্যাম, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। সবাই ধৈর্যভরে অপেক্ষা করছে।

শেষমেশ আটকে গেলাম একটা ট্রাকের পেছনে এসে। রাস্তাটা সরু, এদিকে পাহাড়ের দেওয়াল, ওদিকে খাদ, ট্রাকটা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোনওদিক দিয়েই সেভাবে বেরোবার উপায় নেই।

ভালোভাবে অ্যানালাইজ করে যা বুঝলাম, খাদের সাইডে যেটুকু জায়গা আছে, সেখান দিয়ে আমার বাইক বেরিয়ে যাবে। খুব সাবধানে বের করতে হবে অবশ্য, একটু এদিক ওদিক হলেই খাদের নিচে … হাল্কা হাল্কা করে ক্লাচ ছেড়ে, হ্যান্ডেল সোজা রেখে দিব্যি আরামসে পেরিয়ে এলাম, সামনে পরের ট্রাকটার আগে একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে বাইক দাঁড় করিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম।

গুরদীপ আটকে পড়েছে। পালসার যত সহজে বেরিয়েছে, দুদিকে লাদাখ ক্যারিয়ার আটকানো বুলেট তো অত সহজে বেরোতে পারবে না, তার জন্য বেশি স্পেস চাই। ফিরে এলাম আবার জায়গাটা দেখবার জন্য, এইবার উল্টোদিক থেকে ওই খাদের ধারের স্পেসটা দেখে আমার বুক কেঁপে গেল, আমি এইখান দিয়ে পেরিয়ে এসেছি? আক্ষরিক অর্থে লাইফ রিস্ক করে পেরিয়েছি, বুঝতেই পারি নি কী ডেঞ্জারাস রকমের সরু স্পেস! অজান্তেই একবার ঢোঁক গিললাম।

সামনে আবার বাইক এগিয়ে যাবার জন্য জায়গা আছে, কিন্তু গুরদীপকে ছেড়ে এগনো সম্ভব নয়। ট্রাকওলাকে বললাম একটু আগিয়ে পিছিয়ে ট্রাকটাকে আরেকটু সাইড করে রাখতে, ড্রাইভার জাস্ট পাত্তাই দিল না। শেষমেশ পাহাড়ের সাইডেই যেটুকু স্পেস ছিল, গুরদীপ বলল, ওখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব, যদি কয়েকটা পাথর সরিয়ে দেওয়া যায়। … তাই হল। দুজনে মিলে সামনে পড়ে থাকা কয়েকটা পাথর হাত লাগিয়ে সরিয়ে ফেললাম, গুরদীপের বাইক তাদের পাশ কাটিয়ে টুক করে ট্রাকের সামনে চলে এল।

এর পরে জ্যাম খুব অল্পই অবশিষ্ট ছিল, জ্যামের একেবারে সামনে এসে দেখলাম দুই বরফের দেওয়ালের মাঝে পাথরের খাঁজে ইন্ডিয়ান অয়েলের একটা ট্যাঙ্কারের চাকা বসে গেছে। এমনভাবে বসেছে, এগোতে বা পিছোতে গেলেই ট্যাঙ্কার কাত হয়ে খাদে পড়ে যাবে। সোনমার্গের দিক থেকে ক্রেন এসেছে – চেষ্টা চলছে ট্যাঙ্কারটাকে উদ্ধার করার। দুদিকেই তুমুল জ্যাম।

তবে বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হল না, খানিক বাদেই ট্যাঙ্কার উদ্ধার হল, ব্রো এবং আর্মির জওয়ানেরা মিলে উল্টোদিকের ট্রাফিক সব সাইড করে দিল, আমরা বেরোবার রাস্তা পেয়ে গেলাম। কিছু পাথর, কিছু জল, কিছু মাটি – এইসবের ওপর দিয়ে আরও প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার চলার পরে আবার সামনে কাশ্মীর ভ্যালি দেখতে পেলাম।

সোনমার্গের সেই রেস্টুরেন্ট – যেখানে গুরদীপ আর সুমিতের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেইখানে যখন পৌঁছলাম, তখন বাজে সাড়ে বারোটা। ঝটপট কিছু খাবারের অর্ডার দিলাম, বাড়িতে ফোন করলাম। এইবারে ননস্টপ, অন্তত শ্রীনগরে থামার কোনও সীন নেই।

সোয়া একটাতে আবার শুরু হল পথ চলা। মন্দাকিনী নদীর পাশ দিয়ে সুন্দর রাস্তা, তারপরে আবার খানিক ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে শ্রীনগরে যখন পৌঁছলাম, তখন পিঠ তেতেপুড়ে একসা – এত গরম। একটা কোথাও থামা দরকার, এই জ্যাকেট সোয়েটার খুলে হাল্কা হতে হবে। কিন্তু শ্রীনগরের মধ্যে হাইওয়ে এত চওড়া যে ধারেকাছে কোথাও ছায়া নেই থামবার জন্য। ওইভাবেই এগোতে থাকলাম, চলতে চলতে এক সময়ে আমরা শ্রীনগর পারও হয়ে গেলাম। শ্রীনগরের বাইরে পামপোর বলে একটা জায়গা আছে, সেইখানে একটা জলখাবারের দোকানের সামনে থামলাম। গা থেকে ধরাচূড়ো খুলে কোল্ড ড্রিঙ্কস অর্ডার দিলাম, তেষ্টা পেয়েছে বেজায়। এই সেই জায়গা, যেখানে আসার দিন বৃষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, আর লোকাল কাশ্মীরিরা আমাকে প্রায় ঘিরে ধরেছিল। সেদিন বৃষ্টিতে শীতে কাঁপছিলাম, আজ রোদে তেতেপুড়ে যাচ্ছি।

জ্যাকেট, পুলোভার খুলে ফেললাম, অল্প কষ্ট হলেও জামার নিচে থার্মাল ইনারটা খুললাম না, কারণ এই কাশ্মীর ভ্যালি শেষ হলেই আবার পাহাড় শুরু হবে, গরম কমে যাবে।

দেখতে দেখতে পামপোর পেরোলাম, তাওপরে লেথিপোরা, অবন্তীপোরা, কাজিগুন্দ – এইখানেই সেই সারি সারি ক্রিকেট ব্যাটের দোকান, এখন আর আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না, জাস্ট ঐ, সান্দা যেমন বলল, ক্রুজ কন্ট্রোল, আমি যেটাকে বলছিলাম অটো মোড, ওই অটো-মোডে চলেছি তো চলেছি। সকাল থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি, বিকেল সাড়ে চারটে মত বাজে, এখন জম্মু আরও আড়াইশো কিলোমিটার। জম্মুর হাইওয়ে ধরে নিয়েছি, মোটামুটি চলনসই রাস্তা, যদিও সরু, কিন্তু নির্জন, সোজা রাস্তা, মাঝেমধ্যে দু একটা ছোট ছোট জনবসতি পড়ছে, সেইখানে একটু ট্রাফিক, তা ছাড়া শুধু চরৈবেতি, চরৈবেতি, আর কিছু দেখার নেই, কোথাও দাঁড়াবার নেই।

সোয়া পাঁচটায় জওহর টানেল পার হলাম। টানেলের ভেতরে আরেকটু হলেই সুমিত বাইক স্কিড করে পড়ে যাচ্ছিল, মাঝে কাদা জমে ছিল, যাই হোক, সামলে নিয়ে টানেল থেকে বেরিয়ে আবার একটু দাঁড়ালাম। বনিহাল। এবারে আবার পেটে কিছু না দিলে নয়। গুরদীপ সুমিতের স্টেপল ফুড আলু পরোটা, আমার হল ব্রেড অমলেট। মজার ব্যাপার, টানেলের এপারে ওপারে ওয়েদার অদ্ভুত রকমের আলাদা, টেম্পারেচারও আলাদা হয়, এদিকে জম্মু ভ্যালি, ওদিকে কাশ্মীর ভ্যালি। কাশ্মীর থেকে ঢুকলাম যখন সব শুকনো, টানেলের ভেতর দিয়ে যখন বনিহালে ঢুকলাম – জম্মুর দিকে, টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ভিজে। স্নো-পিকের আর কোনও দেখা নেই।

খেতে খেতে আলোচনা হল, আজ সম্ভবত জম্মু পৌঁছনো সম্ভব নয়। এখনও জম্মু প্রায় দুশো কিলোমিটার, বাজে প্রায় সোয়া ছটা। পাহাড়ি রাস্তায় অ্যাভারেজ তিরিশ-চল্লিশের বেশি স্পিড ওঠানো যাবে না – সেক্ষেত্রে দুশো কিলোমিটার পার করতে পাঁচ থেকে ছ ঘন্টা লাগবে, ননস্টপ চললেও। উধমপুর জম্মু থেকে সত্তর কিলোমিটার আগে, টার্গেট উধমপুরই রাখা হোক। সুমিত বলল, অত টার্গেট রাখার কিছু নেই, চলতে থাকি, রাত নটা সাড়ে নটার সময়ে যেখানে পৌঁছব, সেখানেই স্টে করব।

ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল। আসার দিন একা এসেছিলাম, প্রথমবারের জন্য নতুন রাস্তা, চলার আনন্দ বেশি ছিল, রাস্তার অবস্থার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখি নি, আর সকাল সকাল জম্মু থেকে বেরিয়েছিলাম, সারা রাস্তায় খুব বেশি ট্র্যাফিকও পাই নি – সেদিন ছিল রবিবার। আর আজ? একে তো অন্ধকার, তার ওপর মাঝেমধ্যে টিপিটিপি বৃষ্টি, আর উল্টোদিক থেকে – মানে জম্মুর দিক থেকে, আসতে থাকা কাউন্টলেস ট্রাক, ট্যাক্সি। হেডলাইটে কখনও চোখ ধাঁধিয়ে যায়, পরক্ষণেই রাস্তার গর্তে পড়ে বাইক লাফিয়ে ওঠে, সাথে সাথে ব্রেক মেরে বাইক স্লো করতে হয়, সেই ট্রাকের ক্যারাভান পেরিয়ে যাবার পর দেখা যায় সামনে জম্মুর দিকে চলেছে আরও দশটা ট্রাকের ক্যারাভান, তাদের একটা একটা করে ওভারটেক করা – এ যে কী অপরিসীম নার্ভের ওপর জোর লাগে, সেদিনের সন্ধ্যেটা আমি ভুলব না। যত রকমের অবস্ট্যাকল হওয়া সম্ভব অন্ধকার পাহাড়ী রাস্তায়, সমস্ত এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেছিল ওই এক সন্ধ্যেয়। রাস্তা একনাগাড়ে খারাপও নয়, একনাগাড়ে ভালোও নয়, কখন যে খারাপ রাস্তা আসে, কখন যে ভালো রাস্তা আসে, – মানে, জম্মু শ্রীনগর রুটটা এই রকম, প্রথমদিকে মনে হবে, বাঃ, দারুণ রাস্তা তো, খানিক বাদে মনে হবে, বেশির ভাগটাই ভালো, মাঝেমধ্যে দু একটা খারাপ প্যাচ। ঘন্টাদেড়েকের মধ্যে মতটা পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায় – তখন মনে হয়, আসলে বেশির ভাগ রাস্তাই খারাপ, কয়েকটা প্যাচ আসলে ভালো, তারপরে আবার মনে হয়, না না, বেশির ভাগ রাস্তাই আসলে ভালো … এই করতে করতে ডেস্টিনেশনে পৌঁছে বোঝা যায় – রাস্তাটা আসলে ভালো আর খারাপ মিশিয়ে – ফিফটি ফিফটি।

দাঁড়ালে তাও দু চারটে কথা বলার সুযোগ জোটে, একনাগাড়ে চলতে থাকলে খানিক বাদে একটা একঘেয়েমি গ্রাস করে। এই অন্ধকার, ট্রাকের সাথে নেগোশিয়েশন – মাথাটা কেমন যেন জ্যাম হয়ে যায়। নিজের মনেই একটা গান ধরলাম, তারপরে কী মনে হল, গানটা থামিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা ছড়া – একেবারেই আনরিলেটেড, আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকেবাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। যতটা মনে ছিল, বিড়বিড় করে বকলাম, তার পরেই মাথায় এল জব কোই বাত বিগড় জায়ে – খানিক পরে খেয়াল করলাম আমি আবার ছড়া বলছি – আমি যখন ছোট ছিলাম, খেলতে যেতাম মেঘের দলে।

এগুলো কি পাগলামির লক্ষণ? কে জানে? লে-তে গিয়ে যেটা আর সইতে হয় নি, সেই গায়ের ব্যথা ফিরে আসছে আবার। পিঠ টনটন করছে, হাতের আঙুলে সাড় নেই, জাস্ট নিজেকে এন্টারটেইন জরার অছিলায় কখনও ছড়া কাটছি, কখনও গান গাইছি – সে-ও আর কতক্ষণ ভালো লাগে? একটা সময়ে চুপ করে গেলাম নিজে নিজেই।

রামবন পার হলাম, ঘড়িতে তখন আটটা কুড়ি। একটা চায়ের দোকান দেখে থামালাম। সুমিত প্রচণ্ড চা খায়, আমি দিনে দুবারের বেশি খাই না, আমি একটা ছোট লিমকার বোতল নিলাম। দোকানের সামনে তখন দাঁড়িয়ে ছিল একটা হাইওয়ে পুলিশ পেট্রল ভ্যান। জেঅ্যান্ডকে পুলিশের কয়েকটা কনস্টেবল আর একজন সর্দার পুলিশ অফিসার সেখানে তখন চা খাচ্ছিল। তিনখানা লাগেজবোঝাই বাইক দেখে এগিয়ে এল – লে যাচ্ছো?

আমরা বললাম, না না, লে থেকে আসছি। শুনেই সর্দারের চোখ কপালে, লে থেকে আসছো? কটার সময়ে স্টার্ট করেছিলে?

সর্দারকে আশ্বস্ত করলাম, না না, আজ সকালে আমরা কারগিল থেকে স্টার্ট করেছি। সাড়ে ছটায়। সর্দারের বিস্ময় তাও কমে না – কারগিল থেকে আসছো? উরেবাবা! এতটা নিজে নিজে চালিয়ে এসেছো? উরেবাবা! পারলে কী করে? উরেবাবা!

তা, এসেছি কম না। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার তো হবেই কারগিল থেকে। পাহাড়ি রাস্তায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার খুব একটা কম দূরত্ব নয়, তার ওপর এই রকমের ট্রাফিক, আর এই রাস্তার কন্ডিশনে। সকাল বেলায় আবার জোজিলা পাসও পেরিয়েছি, ওখানে জ্যামটা না হলে হয় তো এতক্ষণে আমরা পাটনি টপ পৌঁছে যেতাম। পাটনি টপ এখান থেকে আরও পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে।

চা লিমকা খেয়ে সর্দারকে গুডবাই জানিয়ে আবার শুরু করলাম, হাত আর চাইছে না বাইকের হ্যান্ডেল ধরতে, অদ্ভূত শিরা টেনে টেনে ধরছে এইবারে। উধমপুরও বোধ হয় সম্ভব নয়, তা হলে পাটনি টপে?

সেই ভালো, পাটনিটপে ঠাণ্ডা থাকে, (এটা জম্মু আর শ্রীনগরের মাঝে হায়েস্ট পয়েন্ট) আরামসে রাতে ঘুমনো যাবে। … এগোলাম। নিকষ কালো অন্ধকার। য়ালো বলতে শুধু আমাদের বাইকের হেডলাইট। খানিক বাদে আবিষ্কার করলাম, আমি বিড়বিড় করছি, টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার।

জোর করে চুপ করালাম নিজেকে। ক্লান্তিতে মাথা ভারী হয়ে আসছে, আর চলতে পারছি না। সামনে সুমিত, কিন্তু গুরদীপকে পেছনে দেখা যাচ্ছে না। একটু দাঁড়ালাম। খানিক পরে গুরদীপ এল, সে-ও আর টানতে পারছে না। আবার এগোলাম, আবার একটু বাদে পেছনে হারিয়ে গেল গুরদীপ। সামনে এবং পেছনে ট্রাকেদের ক্যারাভানের কোনও কমতি নেই, এই অবস্থায় মিনিটে মিনিটে ট্র্যাক রাখা সম্ভবও নয়।

অনেকটা এগিয়ে যখন পাটনিটপ আর দশ কিলোমিটার মতন বাকি, সুমিত আবার দাঁড়াল, আমিও দাঁড়ালাম। বেশ খানিকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে গুরদীপ এল। ওকে চাঙ্গা করলাম এই বলে, আর মাত্র দশ কিলোমিটার, আজ পাটনিটপেই থাকব। এইবারে গুরদীপকে আমাদের আগে রাখা হল, ও যতই আস্তে চলুক, আমরা ওকে ওভারটেক করব না। পেছনে ধীরে ধীরে আমি আর সুমিত চলছি।

রাত সাড়ে নটায় পাটনিটপে পৌঁছলাম। এক জায়গাতেই পর পর লাইন দিয়ে বেশ কয়েকটা হোটেল, ওর মধ্যেই একটা শস্তা দেখে হোটেলে তিন বেডের রুম নিয়ে আমরা চেক ইন করলাম। খাবারের অর্ডার করলাম। জম্মু এখনও একশো কিলোমিটার দূরে রয়ে গেল। মানে, আজকের ট্র্যাভেল, চারশো কিলোমিটার। কাল মেগা-রান। সুমিতকে কাল দিল্লি পৌঁছতেই হবে, পরশুদিন সকাল দশটায় ওর ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে।

দিল্লি এখনও সাতশো কিলোমিটার। জম্মুর পরে কী লেভেলের গরম, সে আমরা সবাই জানি। আমি জানি, আমি পারব না, বললাম, তোমরা এগিয়ে যেও, আমি যেখানে মনে হবে, পারব না – সেখানে হোটেল খুঁজে থেকে যাবো। আমার জন্য তোমরা আটকে থেকো না।

গুরদীপ বলল, সিকিস্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার বাড়ি আম্বালায়। আম্বালা, দিল্লি থেকে ঠিক দুশো কিলোমিটার আগে। কালকের টার্গেট পাঁচশো কিলোমিটার রাখুন, রাতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আপনি গেস্ট। রাতে আমাদের ঘরে আপনাকে আসলি পঞ্জাবী আলু-পরাঠা খাওয়াবো। সকালে চা লস্যি খেয়ে আপনি দিল্লি চলে যাবেন, আমি রোববার স্টার্ট করব।

তাই সই। খানিকক্ষণ ফর্মালিটি করে অবশেষে এই প্ল্যানই ঠিক হল। আম্বালা অ্যাট এনি কস্ট, সমস্যা হলে গুরদীপের গ্রামের বাড়িতে থেকে যাওয়া, না হলে সোজা দিল্লি।

সিকিনীকে ফোন করলাম, সিকিনী বলল, তোর বাবাকে এক্ষুনি ফোন কর, উনি খুব চিন্তা করছেন। – কেন, চিন্তা কেন?

– আজ খারদুং লা পাসে ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে, দুজন মারা গেছেন – বাঙালি। আমাকে দু বার ফোন করেছেন তোকে না পেয়ে – আমি বলেছি যে তুই গতকালই লে থেকে বেরিয়ে এসেছিস, আজ দুপুরে তুই সোনমার্গ থেকে ফোনও করেছিস, কিন্তু তুই নিজে একবার কথা বলে নে, বুড়ো মানুষ, টেনশন করছেন।

বাবাকেও ফোন করে আশ্বস্ত করলাম।

রুমটা খুব একটা পদের না, শস্তা দেখতে গিয়ে রুমের পরিচ্ছন্নতাটা দেখা হয় নি, যাই হোক, কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে সারা গায়ে ভোলিনি স্প্রে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

কাল কি দিল্লি হবে? পারব, পৌঁছতে?


4 thoughts on “জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – একাদশ পর্ব

  1. Etodin vabtam ami ekayi bok bok kori bike chalatey chalatey. Gan gayi…chhora kati….putro der bochon gulo repeat kori nijer money. Subject ar genre eto wide thakey bolar noy. Ekhon dekhchi onekeyi same jinis korey.. 🙂

    Ekbar mobile e speech recorder ta on korey headset er microphone ta mukher kachey kono vabey atkey puro rastar audio dharabiboroni diyechhilam. Kintu hawar awaj e aar bike er jhakuni tey mic sorey giye bapar ta jomey ni.

    Liked by 1 person

  2. Siki-babu,
    Tomar thriller porchhi.
    Khub mon diye … asole date gulo important.

    Khardung la te je dujon mara giyechhilen taNder khabor pouchhe dey ekjon biker.
    Bhabchhilam tomader keu ki na?
    Onara amar onek senior ekjon colleague er stri aar chhele.

    Khub bhalo lekha hoyeche eta.

    Kausik

    PS : Tumi-i bollam. Kichhu mone koro na!

    Like

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.