জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – দ্বাদশ ও শেষ পর্ব

আগের পর্বেরা এইখানেঃ [পর্ব ১], [পর্ব ২] ,[পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭],  [পর্ব ৮], [পর্ব ৯], [পর্ব ১০] এবং [পর্ব ১১]

১০ই জুন ২০১৫ – দ্বাদশ দিন

ঘুম ভাঙল সাড়ে সাতটায় – কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। পাশে সুমিত তারস্বরে এবং গুরদীপ মৃদুস্বরে নাক ডেকে চলেছে। আমার কিনা নাক ডাকে না, আমি তাই নাক ডাকার আওয়াজ একদম সহ্য করতে পারি না, অবিশ্যি খুব ঘুম পেয়ে গেল অন্য ব্যাপার। যাই হোক, ধাক্কাধাক্কি দিয়ে তুললাম তাদেরকে। বাথরুমটা অতি জঘন্য, এখানে চান করার প্রশ্নই আসে না, তায় ঠাণ্ডাটাও বেশ ভালোই সকালের দিকে – তাই তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না।

ঘর থেকে বেরোতেই বিশালবপু দুই মহিলা পাকড়াও করলেন, আচ্ছা, পাটনিটপে কী দেখার আছে?

আমি পড়লাম মুশকিলে, কিছু দেখার আছে বলে তো শুনি নি, পাটনিটপ এমনিই ছোট্ট একটা হিল স্টেশন, জম্মু আর শ্রীনগরের মাঝে হায়েস্ট পয়েন্ট, দশটা হোটেল আর চোদ্দটা দোকান। এর বেশি আমার নিজেরও কিছু জানা নেই। কিন্তু মহিলাদ্বয় ছাড়লেন না – তা হলে দিল্লি থেকে এতদূর এলাম কেন? কিছুই দেখার নেই যদি?

কী মুশকিল! আমাকে জিজ্ঞেস করে তো আসেন নি – আর আমাকে না জিজ্ঞেস করে হোটেলের লোককে জিজ্ঞেস করুন না কী দেখার আছে – ওরাই ভালো বলতে পারবে। আমরা তো ঠিক পাটনিটপ দেখতে আসি নি! বিনীতভাবে সেটাই বললাম – আমরা ঠিক জানি না, আপনারা হোটেলের রিসেপশনে জিজ্ঞেস করুন। … বিশালবপু মহিলাদ্বয় খুব অখুশি হলেন তাঁদের ঝেড়ে ফেলায়, কিন্তু আর কথা বাড়ালেন না।

ঘরের সামনেই বাইক দাঁড় করানো ছিল – তাই লাগেজ খোলবার দরকার হয় নি। বাইরে বেরিয়ে সামনের চায়ের দোকান থেকে অল্প করে একটু চা আর আলু চিপস ইত্যাদি খেলাম। নটার সময়ে স্টার্ট করা গেল।

গায়ের ব্যথা মরে নি, যদিও এক রাতের ঘুমে আর ভোলিনির স্পর্শে একটু হলেও আয়ত্ত্বের মধ্যে ব্যথা। কিন্তু রাস্তা কি ভুলতে দেয়? নটা মানে বেশ বেলা, সমস্ত ট্রাফিক নেমে পড়েছে রাস্তায়, হলেই বা পাহাড়ের রাস্তা, ট্রাকের কোনও কমতি নেই, হয় উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাককে পাশ দাও, নয় তো সামনে চলতে থাকা ট্রাককে রিস্ক নিয়ে ওভারটেক করো, আর তেমনি ভাঙাচোরা রাস্তা।

উধমপুর আসার একটু আগে রাস্তা ভালো হয়ে গেল। উধমপুরে পাহাড় মোটামুটি শেষ, সেই রকমের উঁচু পাকদণ্ডী রাস্তা আর নেই। মোটামুটি ভদ্রগোছের। সাড়ে দশটার সময়ে উধমপুরের মার্কেটে আমরা থামলাম, ভারী কিছু খেয়ে নেবার জন্যে। সিঙারা, পকোড়া, আর কোল্ড ড্রিঙ্কস। খেতে খেতে বিশ্বদুনিয়া নিয়ে খানিক ভাট হল – দেখলাম সুমিত ছেলেটা বেশ পড়াশোনা করা। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা কি ইরান সিরিয়ার সংকট নিয়ে আমার থেকেও বেশি খবর রাখে। এবং বেশ ব্যালান্সড ভিউ – এদিকে গুরদীপই খালি কাশ্মীরিদের খিস্তি মেরে যাচ্ছে প্রথম দিন থেকে। শালা চুতিয়া কাশ্মীরিদের একটা পয়সাও হেল্প করা উচিত নয়, শালাগুলো পাকিস্তানে চলে যায় না কেন – ইন্ডিয়ার জঞ্জাল বালের দল – ঢ্যামনা – ইত্যাদি বেশ কয়েকদিন ধরেই শুনছি ওর জবানিতে। বেসিকালি – আমাদের ফেরার পথে শ্রীনগরে এক সেকেন্ডের জন্যেও না থেমে প্রথম স্ন্যাক্স কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবার জন্য পামপোরে থামার কারণও সেই গুরদীপই। শালা চুতিয়াদের শহর শ্রীনগরে আমি একটা পয়সাও খরচা করব না।

আমি শুনেছি, আর কাটিয়ে দিয়েছি – হতে পারে কোনও বাজে অভিজ্ঞতা – হতে পারে কাশ্মীরিদের নিয়ে কিছু বেসিক মাইন্ডসেট – যেটা প্রায় সমস্ত উত্তর ভারতীয়দেরই আছে, আলাদা করে আর জিজ্ঞেস করি নি। আজ, উধমপুরে সিঙারা খেতে বসে যখন কথায় কথায় বাংলাদেশ আর ইরান আর সিরিয়া উঠে এল, তখন মনে হল এইটাই সঠিক সময় গুরদীপকে জিজ্ঞেস করার – কেসটা কী? কাশ্মীরও নয়, স্পেশালি শ্রীনগরের নাম শুনলেই গুরদীপ কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে যায়, এমনিতে বেশ শান্ত ছেলে।

গল্পটা শুনলাম, গুরদীপের ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা নয়, সেকেন্ড হ্যান্ড অভিজ্ঞতা। সেই যে যাবার দিনে মথুরা থেকে আসা মাঝবয়েসী বুলেট কাপলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কারগিল ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে? সুমিত-গুরদীপদের সাথে তাঁদের প্রথম আলাপ হয় শ্রীনগরেই। দুই পার্টিই হাউসবোটে ছিল। এইবারে শিকারায় চড়ে ঘুরতে বেরিয়েছে, সেইখানে পাশ দিয়ে একটা শিকারা যাচ্ছিল – তাতে গরম গরম চিকেন শিক কাবাব ঝলসানো হচ্ছিল। মথুরার কাপল সেই শিকারাওলাকে জিজ্ঞেস করে, শিককাবাব কত করে – তাতে নাকি শিকারাওলা খুব মুখ বেঁকিয়ে জানায়, ইয়ে আপনে ঘরবালোঁ কে লিয়ে হ্যায়, তুম ভিখারী ইন্ডিয়ানলোগোঁ কে লিয়ে নেহি হ্যায়। বলে শিকারা নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। এঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় এতই হতভম্ব হয়ে গেছিলেন যে প্রতিবাদ করার কথাও মাথায় আসে নি। গুরদীপরা শুনেছে, পরে, এঁদের কাছ থেকে – গুরদীপের মধ্যে হাল্কা করে মুসলিম হেট্রেড ছিলই, এই ঘটনা শোনার পরে স্পেশালি শ্রীনগর শহরটাই ওর কুনজরে চলে যায়।

চায়ে-পে-চর্চা করে এই সব মনোভাব সারানো সম্ভব নয়, তাই হাল্কা করে ওকে বললাম, একটা দুটো ইনস্ট্যান্স দিয়ে এইভাবে পুরো একটা শহর বা কমিউনিটিকে জাজ কোরো না। মানুষ তো আলাদা হয় – এখানে অনেকেই ইন্ডিয়ার পার্ট হিসেবে নিজেদের মানতে চায় না, তার কারণও আছে, আফস্পা বলে একটা আইন চলে – এইসব নিয়ে খানিক হ্যাজ হল। যাই হোক, সোয়া এগারোটার সময়ে আমরা আবার উঠলাম এবং বাইকে স্টারট দিলাম। সকাল বেলার পাটনিটপের ঠাণ্ডা আর নেই, এখানে বেশ গরম, জ্যাকেট খুলে বানজি কর্ডে আটকে নিলাম, গায়ে এখন জাস্ট একটা সোয়েটার – জম্মু ছাড়িয়ে খুলব।

অনেকটা এগিয়ে, কোন জায়গা কে জানে, সেইখানে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সুমিত আর গুরদীপ দুজনেই পেছনে। মোড়ের মাথায় একটা পুলিশ পোস্ট। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সোজা রাস্তাটি জম্মু যাচ্ছে – বাঁদিকেরটি নয়। বেশ খানিকক্ষণ বাদে সুমিত এল, তাকে হাঁইমাই করে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, সে-ও এল সঠিক রাস্তায়, এবার দুজনেই ওয়েট করতে থকলাম গুরদীপের জন্য।

গুরদীপ এল খানিক বাদেই – আমরা যেমন তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার ইতস্তত করেছি, তারপরে পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বা অন্যের হাঁকডাক শুনে সঠিক রাস্তায় এসেছি, গুরদীপ সেসবের ধার দিয়েই গেল না – রাস্তার এদিকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, গুরদীপ এল, সোজা বাঁদিকের রাস্তায় বেরিয়ে গেল তিরবেগে।

খাইসে। ওকে এবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সুমিতকে বললাম, তুমি দাঁড়াও, আমি ধরে আনছি। বলে বাইকে স্টার্ট দিয়ে ফুলস্পিডে এগোলাম।

অনেকদূর, প্রায় সাত আট কিলোমিটার দূরে গিয়ে গুরদীপের দেখা পেলাম। তারস্বরে হর্ন মেরে যাচ্ছি, গুরদীপ শুনতেই পাচ্ছে না – ফুলস্পিডে চালাচ্ছে ওর বুলেট, আমার ক্ষমতা কী ওকে ধরি।

প্রায় আরও আড়াই কিলোমিটার পরে গিয়ে ওকে থামাতে পারলাম। আবার ফেরত সেই আমড়াতলার মোড়ে, তারপরে আবার জম্মুর দিকে এগনো। খানিক বাদেই জম্মুর অ্যাপ্রোচের সেই স্বপ্নের হাইওয়ের ওপরে গিয়ে পড়লাম, ছোট ছোট টানেল, দুদিকে লালচে ছোট ছোট টিলা-পাহাড়, আর রানওয়ের মত রাস্তা।

জম্মু সিটিতে ঢোকার আর প্রশ্ন নেই – বাইপাস ধরে নিয়ে সোজা জম্মুর বাইরে। খানিকক্ষণের মধ্যেই দুপুর দেড়টার গরম টের পেলাম। প্রথমে একটা বড়সড় চকে দাঁড়ানো হল – রোদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না, এত তেজ। সেখানে দাঁড়িয়ে পর পর এক গ্লাস লেবুজল আর দু গ্লাস গন্নে কা রস, মানে আখের রস খেলাম সবাই মিলে। খানিক বল এল। আবার এগোলাম, তিরিশ কিলোমিটার এগিয়ে আবার থামা, গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ, এক লিটার জলের বোতল কিনে – তিনজন তিন ঢোঁকে শেষ করে ফেললাম। আবার এগনো – পাঠানকোট এখনও অনেক দূর। জালন্ধর দুশো কিলোমিটার। আমরা সকাল থেকে সবে একশো মত কিলোমিটার এসেছি – আজকের টার্গেট ছিল সাতশো।

আবার সেই প্রথম দিনের মত স্মৃতি ফিরে আসছে – গায়ের মধ্যে জামাগেঞ্জি ফুটন্ত কাপড়ের মত লাগছে। জিভ শুকিয়ে ভারী, গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। তফাত এটুকুই – আসার দিনে মুখ ঢাকা ছিল হেলমেটে, আজ হেলমেট আর মুখের মাঝে একটা কাপড়ের লেয়ার জড়িয়ে নিয়েছি – বাফ বলে, নাক মুখ ঢেকে চালাছহি, ফলে একটু কম কাহিল লাগছে।

কিন্তু … আজ এ রকম হচ্ছে কেন? এখনও জমু কাশ্মীরের চৌহদ্দি পেরোই নি, অলরেডি তিনবার দাঁড়িয়ে বান্টা (আমাদের ফটাশ জল), গন্নে কা রস, শিকঞ্জী (লেবু শরবৎ) খেয়েছি, তবু গরমের প্রকোপ ছাপিয়ে অদ্ভূত একটা ফীলিং হচ্ছে আজ – অসম্ভব কনসেন্ট্রেশনের কমতি ঘটছে। বাইক বা যে কোনও গাড়ি চালাতে যে টুকু অ্যালার্টনেসের দরকার হয়, সেই অ্যালার্ট থাকতে পারছি না মনে হচ্ছে। এখন আমরা সমতল রাস্তায়, পাহাড় দূরে সরে গেছে, ট্রাফিক বেড়ে গেছে সেই পরিমাণে – পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে বড় বড় গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, কেমন মনে হচ্ছে, আমি কনসেন্ট্রেট করে চালাতে পারছি না। এতদিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছি, কখনও এই ধরণের ফীলিং হয় নি, কেমন মনে হচ্ছে, আমি পারলে এইখানেই রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ব, যেন আমি কতকাল ঘুমোই নি।

ভয় পেয়ে স্পীড কমিয়ে দিলাম, চল্লিশ-পঞ্চাশ। কিন্তু তাতেও লাভ হল না, কেমন মনে হচ্ছে ব্যালান্স রাখতে পারছি না, জাস্ট পড়ব আর ঘুমিয়ে পড়ব। এ এক্সপিরিয়েন্স কখনও হয় নি আমার। এ কি ডিহাইড্রেশনের ফল?

সুমিত গুরদীপ নব্বইয়ের স্পিড তুলে বেরিয়ে গেছে কোন আগে, কিন্তু আমি আর এগোতে পারব বলে মনে হচ্ছে না – কিন্তু সেটা তো ওদের জানাতে হবে। ওদের দেখা যাচ্ছে না।

মরীয়া হয়ে স্পিড তুললাম। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-পঁচাত্তর-আশি-নব্বই। দূরে দেখা যাচ্ছে ওদের। আরও বাড়াতে হবে। শরের মনের সমস্ত অ্যালার্টনেস, কনসেন্ট্রেশন একত্র করে স্পিড আরও বাড়ালাম, পঁচানব্বই – সামনে মনে হল ওরা থামছে। … হ্যাঁ, থামছে। আবার বান্টা খাবে। আমি পৌঁছলাম ওদের কাছে। পেটের মধ্যে আগের খাওয়া জল শরবৎ খলবল করছে, গলা থেকে জিভ শুকনো। একটা গ্লাস তুলে সুমিত বলছে, স্যার, নিম্বুপানি পিওগে? আমার চোখে ঝাপসা লাগছে, জিভ নড়ছে না – বললাম, কিচ্ছু খেতে চাই না, সামনে যেখানে ছায়া পাবো, আমি – বেশি না, জাস্ট আধঘণ্টা – একটু ঘুমোতে চাই। তোমরা চাইলে এগিয়ে যেতে পারো, আমি আর পারছি না।

ওরা বোধ হয় বুঝল – বলল, চিন্তা করবেন না, আপনি এগিয়ে যান, সামনে যেখানে প্রথম ধাবা পাবেন, সেইখানে চারপাই নিয়ে শুয়ে পড়ুন, আমরা পেছন পেছন আসছি।

তাই হোক, বলে আমি আবার এগিয়ে গেলাম ওদের পেছনে রেখে। বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখলাম বাঁদিকে একটা ধাবা, বেশ গাছপালার ছায়া আছে, আর বেশ কয়েকটা চারপাই-খাটিয়া বিছানো আছে। আমি সেইখানে গিয়ে দাঁড়াতেই, যেমন হয়, ধাবার লোক এসে, আইয়ে, খানা মিলেগা, ব্যায়ঠিয়ে, এইসব বলতে শুরু করল, আমি বললাম, দাঁড়াও, আমার সাথে আরও লোক আছে, তারা আসছে।

খানিক বাদেই সুমিত-গুরদীপ চলে এল, আমি জাস্ট বললাম, তোমরা চাইলে এখানে লাঞ্চ করে নাও, আমার লাগেজটা দেখো – বলে চেয়ারে বসেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুম দিলাম।

ঘুম, কিন্তু ঘুম নয়, আধঘুম যেন, ঘুমের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছি, ধাবার ভেতরে বক্সে পুরনো দিনের হিন্দি গান বাজছে – মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে, এটা কি বাণী জয়রাম? – শুনতে পাচ্ছি, ওরা লস্যি খাবে বলছে, – শুনতে পাচ্ছি, ধাবার মালিক বলছে, গরমি বহোত হ্যায়, য়ঁহা সে দো কিলোমিটার আগে এক নহর হ্যায়, বঁহা ঠন্ডা পানি মিলেগা, চাহো তো জা কর নহা কে আ জাও। -শুনতে পাচ্ছি, ওরা বলছে, দরকার নেই – শুনতে পাচ্ছি, ওরা খাবার অর্ডার দিচ্ছে। কী রকম একটা বেহুঁশ অবস্থায় ছিলাম, খানিকক্ষণের জন্য। ধীরে ধীরে ঘোরভাবটা কাটল। উঠে জল চাইলাম। পর পর দু গ্লাস জল খেলাম। এইবারে মনে হল একটু ধাতস্থ লাগছে। উঠে বসলাম। আধঘণ্টার জায়গায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঘুমিয়েছি। মাথা এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে, আর সেই ঝিমভাবটা নেই। গরমও কম লাগছে। মুখ তুলে দেখলাম, নিমগাছ মাথার ওপরে। শুনেছি নিমগাছের ছায়া ঠাণ্ডা হয়।

আস্তে আস্তে উঠলাম। রাস্তার ধারে হাতমুখ ধোবার জন্য একটা জলের ড্রাম রাখা ছিল ধাবার তরফে, আর একটা ভাঙা জাগ, মগ হিসেবে। জাগে করে জল তুলে থাবড়ে থাবড়ে মাথামুখঘাড় সব ভেজালাম। আবার এক গ্লাস জল খেলাম। জলটা মুখেমাথাতেই শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে – আবার এক জাগ জল তুলে মুখেমাথায়ঘাড়ে। তারপর আবার বাফ দিয়ে মুখ ঢেকে বাইকে স্টার্ট দিলাম। বিকেল চারটে কুড়ি।

আআহ্‌! হাওয়া আর তত গরম লাগছে না, বেশ ঠাণ্ডা। ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ শান্তি হচ্ছে, আর কোনও কনসেন্ট্রেশনের অভাব নেই – এবার আমি চালাতে পারব। …কিন্তু সে আরামও আর বেশিক্ষণ রইল না। খানিক বাদেই মুখের জল শুকিয়ে গিয়ে আবার লু-এর ঝাপটা লাগতে লাগল, আবার গলা থেকে জিভ শুকিয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্য আমার একার হচ্ছে না, সবারই হচ্ছে, আবার দাঁড়ানো, আবার বান্টা বা আখের রস। এইবারে আখওলার কাছ থেকে আবার এক মগ জল চেয়ে সবাই মাথায় হুশ হুশ করে ঢেলে নিয়ে হেলমেট চাপালাম। আমাদের নিশ্চয়ই তখন পুরো কাকতাড়ুয়ার মতন দেখাচ্ছিল, কেউ ছবি তুলে রাখে নি, চুলগুলো সব আঠা-আঠা হয়ে গেছে, মুখের চারপাশে নুন নুন স্বাদ, গায়ে জামা চিপটে বসেছে, জুতোর ভেতরে পায়ের যে কী অবস্থা নিজেই বুঝতে পারছি না, কেবল সাড় আছে, এই পর্যন্ত।

পাঠানকোট ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এই স্ট্রেচটায় অনেকখানি রাস্তা জুড়ে রাস্তার পাশ দিয়ে যায় রেললাইন, কী সব অদ্ভূত নামের স্টেশন, একটার নাম উঁচি বস্‌সি, তার পরে আরেকটা স্টেশন এল, তার নাম কালা বকরা। ছোট ছোট জনপদ। সেগুলো পেরোলেই খেত দুপাশে, মাঝখানে মসৃণ হাইওয়ে। টিপিকাল পঞ্জাব।

পাঠানকোট পেরোলাম, নব্বই কিলোমিটার আগে জালন্ধর। জালন্ধরে হাইওয়েতে একটা টার্ন আছে, বাঁদিকে ঘুরতে হবে। মনে জোর এনে চালিয়ে একসময়ে সেখানেও পৌঁছে গেলাম, টার্ন ঘুরে জালন্ধর সিটির বাইরে এসে বুঝলাম, আবার গলা না ভেজালে এগনো সম্ভব নয়। সুমিত গুরদীপ পেছনে কোথায় রয়ে গেছে কে জানে, বলাই আছে, আম্বালাতে পৌঁছে আমরা রি-ইউনাইট হবার চেষ্টা করব, তার আগে একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। একটা শিকঞ্জীওলার ছাতার তলায় এসে বসলাম, একগ্লাস লেবু শরবৎ খেয়ে আবার প্রাণ ফিরে এল। ছেলেটাকে বললাম, তোমার এখানে একটু বসি? সে বেশ দাঁত কেলিয়ে বলল, বসুন না। কোথায় যাবেন? বললাম, আম্বালা – সে বলল, সে তো বহুদূর, এখন সামনে আসবে ফাগুয়ারা, তারপরে লুধিয়ানা, তারপরে খন্না, তার পরে আসবে আম্বালা।

আমি ফ্যাকাশে হেসে বললাম, এই তো, এখন ছটা বাজে, আরেকটু পরেই সূরয ঢল জায়েগা, তব ইতনি তকলিফ নেহি হোগি। শরবতওলাও ঘাড় নাড়িয়ে বলল, হাঁ, আজ গরমি কুছ জাদা হি হ্যায়, সারা রিকর্ড আজ তোড় দিয়া লাগতা-সি।

সোয়া ছটা অবধি বসে আবার বাইকে স্টার্ট দিয়েছি, দেখি পাশ দিয়ে গুরদীপ আর সুমিত বেরিয়ে গেল – এগিয়ে গিয়ে ওদের ধরলাম, কী ব্যাপার, তোমরা এতক্ষণ পরে? ভুল রাস্তায় চলে গেছিলে নাকি? – ওরা বলল, না না, আমরাও শিকঞ্জী খাচ্ছিলাম।

সাড়ে ছটা নাগাদ গরম কমতে থাকল, আর অতটা কষ্ট তখন হচ্ছে না – আমার তো একেই একটা ভিউ ফাইন্ডার ভাঙা, অন্যটা দিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করছিলাম সুমিত আর গুরদীপ পেছনে আছে কিনা – পেছনে তাকিয়েই কেমন অন্যরকম লাগল, আকাশটা এত কালো লাগছে কেন? আমি কি সানগ্লাস পরে আছি, আর সন্ধ্যে হয়ে এসেছে বলে এমন লাগছে?

খানিকটা এগিয়ে দাঁড়ালাম, ওরা অনেক পেছনে চলে গেছিল, চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পেছনে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলাম, আকাশ ভর্তি কালো মেঘ, আর সেই মেঘ খুব তাড়াতাড়ি ছেয়ে যাচ্ছে পুরো আকাশে। জয়গুরু, বৃষ্টি হবে? হোক হোক!

লুধিয়ানা এগিয়ে আসছে। এই স্ট্রেচটা খুব খারাপ রাস্তা, আর ভয়ঙ্কর জ্যামজট হয়। একটা ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, ফলে খানিক ডাইভার্সন আছে, আর সেখানে তিনদিক থেকে অটোরিক্সা ঠেলাগাড়ি চারচাকা দুচাকা সব্বাই মিলে একদম ক-রে কমললোচন শ্রীহরি খ-রে খগআসনে মুরারি কেস। আর ঠিক সেইখানেই ঘটল ঘটনাটা।

পেছন থেকে একটা তুমুল হাওয়া এল, আর নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের ঠিক পাশে তখন আমরা, সেই ফ্লাইওভারের ওপর যত বালি-মাটি-স্টোনচিপস জমা করা ছিল, সমস্ত একসাথে উড়িয়ে নিয়ে একটা প্রকাণ্ড কুণ্ডলী তৈরি হল, আর সেটা আছড়ে পড়ল আশেপাশে। নিমেষে চারদিক অন্ধকার, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, জ্যাম আরও তিনগুণ বেড়ে গেল, সমস্ত গাড়ির হেডলাইট জ্বলে গেল, আর চারদিক ঝাপসা।

আঁধি, আঁধি। ধূলোঝড়। দিল্লিতে বসে অনেক আঁধি দেখেছি, এমন মেগাসাইজের আঁধি দেখি নি কখনও। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সাইজের কুণ্ডলী সব – চারপাশের ধূলোবালি নিয়ে উঠছে, আছড়ে পড়ছে, উঠছে, আছড়ে পড়ছে। আর সে কী দৃশ্য, সামনে দুটোর পরে তিনটে গাড়ি দেখা যাচ্ছে না, ভিজিবিলিটি প্রায় জিরো, পুরো মনে হচ্ছে কেউ যেন জলরঙ দিয়ে ধূসর রঙে লেপে দিয়েছে চারিদিক। লাকিলি সুমিত আর গুরদীপকে স্পট করলাম, একে অপরের ব্লিঙ্কার দেখে দেখে ফলো করতে থাকলাম। খানিক বাদেই আমরা লুধিয়ানা শহর পেরিয়ে এলাম।

পেরিয়ে তো এলাম, কিন্তু আঁধি তো থামে নি। ফাঁকা জায়গায় হাওয়ার তাণ্ডব আরও তীব্র। এইখানে আমি বুঝলাম পালসারের মাহাত্ম্য। আমাদের সবারই মাথামুখচোখনাক-সারা গা প্রপারলি ঢাকা, ফলে উড়ন্ত ধূলোবালিতে আমাদের চালাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না, কিন্তু হাওয়ার ঝাপটা সত্ত্বেও আমি খুব আরামসে পালসার নিয়ে ষাটের ওপর স্পিড তুলে এগিয়ে যাচ্ছি, আর ক্ষণে ক্ষণে সুমিতদের হারিয়ে ফেলছি। একবার অনেকখানি এগিয়ে যাবার পরে সুমিতদের জন্য অপেক্ষা করছি, ওরা এল, এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না? আমরা তো চল্লিশের ওপরে তুলতেই পারছি না, বুলেট হেলে যাচ্ছে হাওয়ার ধাক্কায়।

সে কী কথা? বুলেট হেলে যাচ্ছে, আর পালসার হেলছে না? ঝড়ের তেজ কমে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, রাস্তায় ট্র্যাফিকও কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। আবার এগোতে থাকলাম, মাঝে মাঝেই গতি কমিয়ে দিতে হচ্ছিল ওদের সাথ দেবার জন্য।

খান্না পেরোলাম রাত আটটায়। অন্ধকার ঘনিয়ে গেছে, হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে শুধু, শরীরে তেমান আর কোনও ক্লান্তি নেই, গলা শুকিয়ে যাওয়া নেই, এখন মনে হচ্ছে, চাইলে আমি আরও সাত আট ঘণ্টা টেনে দিতে পারি – কিন্তু না, আজ বেশি চাপ নেব না, আম্বালায় গুরদীপের বাড়িতে থাকাই মনস্থ করলাম। গুরদীপ বলল, চলুন স্যার, গ্রামের বাড়ি দেখবেন –

অনেকক্ষণ চলার পরে হরিয়ানা ঢুকলাম। বাঁদিকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একটা দুটো মল, হোটেল, মোটেল, ঝকমক করছে আলোর বন্যায়। সেই রকম একটা মোটেলের ধারে এসে গুরদীপ সবাইকে দাঁড়াতে বলল, এটা রাজপুরা – এখান থেকে আম্বালা আরও কুড়ি কিলোমিটার।

মোটেলে খানিক পনীর পকোড়া আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেলাম, খিদেও পেয়েছিল। রাত সোয়া নটা। আর কুড়ি কিলোমিটার এগোলেই কি গুরদীপের বাড়ি? – না না, আম্বালার ক্রসিং থেকে আরও কুড়ি কিলোমিটার এগোলে শাহবাদ। সেই শাহবাদের জংশন থেকে বাঁদিকে দশ কিলোমিটার ভেতরে গুরদীপের গ্রাম। মানে, এখান থেকে কুড়ি প্লাস কুড়ি প্লাস দশ – পঞ্চাশ কিলোমিটার আরো।

নটা চল্লিশে স্টার্ট করলাম – এবং, বেশ খানিকটা – প্রায় দশ কিলোমিটার যাবার পরে প্রথম রাজপুরার সাইনবোর্ড দেখলাম, মানে, যেখানটায় আমরা রাজপুরা ভেবে থেমেছিলাম, সেটা রাজপুরা ছিল না। এইখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার।

আম্বালা আসতে আসতে বৃষ্টি থেমে গেল, হাওয়াও পালটে আবার শুকনো হয়ে গেল – মানে এদিকে বৃষ্টি হয় নি।

রাত দশটা চল্লিশে সেই শাহবাদ ফ্লাইওভারের নিচে এসে দাঁড়ালাম সবাই। সুমিতের থামলে চলবে না, ওকে আজ রাতের মধ্যেই দিল্লি পৌঁছতে হবে – দিল্লি এখান থেকে আরো দুশো কিলোমিটার। গুরদীপ আর আমি এখানেই থামব আজ। সবাই হাতে হাত মেলালাম, কাঁধে কাঁধ মেলালাম, বুকে জড়িয়ে ধরলাম একে অপরকে। যাত্রা প্রায় শেষের মুখে। কথা দিলাম, পরে কখনও আমরা নয়ডায় মীট করব।

সুমিত বেরিয়ে গেল, আমার পকেটে তখন মোবাইল বাজছে, সিকিনীর ফোন, এত রাত হয়ে গেছে, তবু ফোন করি নি – যাই হোক – বললাম, গুরদীপের বাড়িতে থাকব, আর দশ কিলোমিটার চলতে হবে। বললাম, বাবাকেও জানিয়ে দিতে, আমি আর ফোন করছি না এখন।

ফোন রেখে বাঁদিকে বেঁকলাম আমরা।

গ্রামের রাস্তা বটে, কিন্তু সুন্দর মসৃণ। সরু পাকা রাস্তা, দুধারে লম্বা লম্বা গাছের সারি, পুরো বুলেভার্ড, মাঝখানে আমরা দুটি মোটরসাইকেল চলেছি, আমাদের হেডলাইটের আলোর বন্যায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে জনপ্রাণী নেই।

সোয়া এগারোটায় ঢুকলাম গুরদীপের “গ্রামের বাড়ি”। চারদিকে ক্ষেতখামার, কিন্তু সমস্ত বাড়িই পাকা, দোতলা বা তিনতলা। সম্পন্ন চাষীদের ঘর সব। পাক্কা পঞ্জাবী ফ্যামিলি – যাদের সাথে দেখা হলে নমস্কার বা নমস্তে বলা যায় না, বলতে হয় সৎশ্রী অকাল জী। আমার মুখ দিয়ে অবশ্য ওসব বেরনো মুশকিল, আমি হাতজোড় করে নমস্কারই জানালাম। গুরদীপের ছোট্ট দশমাসের ছেলে, প্রথমে তো বাবাকে দেখে চিনতেই পারছিল না, তারপরে বাবার কোল ছেড়ে আর নড়েই না, বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল শেষে। গুরদীপের বাবা অবশ্য পুরো সর্দার, পাগড়িদাড়িসম্বলিত। গুরদীপ সর্দার নয়। এটা জানতাম শিখ ফ্যামিলিতে সবাইকে ব্যাপটাইজড না হলেও চলে, জাস্ট বংশের এক ছেলে হলেই হয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গুরদীপের দাদা সর্দার। গুরদীপ তাই সর্দার হবার চাপ নেয় নি।

গুরদীপের কোলে যখন তার দশমাসের বাচ্চা খেলা করছিল – আবিষ্কার করলাম পঞ্জাবী ভাষাতেও কোল-কে কোলই বলে। অনেকেই হয় তো জানেন, বাংলা আর পঞ্জাবী দুই ভাষাতেই what মানে “কী”। এই প্রথম জানলাম, lap মানেও দুই ভাষাতেই কোল, যাকে হিন্দিতে গোদ বা গোদি বলে। … হাল্কাছলে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তো সর্দার নও, ছেলেকে সর্দার বানাবে? গুরদীপ হেসে ফেলল, নাঃ, ছেলেকে আর সর্দার বানাবো না। বড় কষ্টের জীবন – ওই সারাজীবন পাগড়ি পড়ে থাকা, গরমে মাথা চুলকোয়, হেব্বি কষ্ট হয়।

কতদিন বাদে কে জানে, চান করলাম, শ্যাম্পু মাখলাম। সাড়ে বারোটায় খেতে বসলাম, গরম গরম রুটি, ঢ্যাঁড়শভাজা, ডাল, ভাত, দই।

আমাদেরও আর শরীর চলছিল না। খেয়ে উঠে ঘুমিয়ে পড়তে এতটুকু সময় লাগল না। সারাদিন ওই গরম সহ্য করার পর রাতের এসি খুব আরাম দিচ্ছিল।

=====================================================================
১১ই জুন, ২০১৫ – ত্রয়োদশ দিন

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। গুরদীপ নিয়ে গেল ছাদে, সেখান থেকে খানিক গ্রামের শোভা দর্শন হল। বাংলার গ্রামের সঙ্গে পঞ্জাবের গ্রামের কোনও মিলই নেই। তাগড়াই তাগড়াই জাঠ গরু, দূরে ময়ূর দেখা যাচ্ছে, ক্ষেতের কোনওদিক সবুজ, কোনওদিক সোনালী।

ব্রেকফাস্ট হল ঘিয়ে চোবানো আলু পরোটা আর দই দিয়ে। খেয়ে দেয়ে নিয়ে, তৈরি হয়ে, গুরদীপের কাঁধে হাত রেখে বললাম, গুরদীপ, এবার তা হলে বিদায় দাও, এগোই – এর পরে আবার রোদ চড়ে যাবে, এগনো মুশকিল হবে।

আজ বৃহস্পতিবার। গুরদীপ এখন এখানেই থাকবে। রবিবার ও ফ্যামিলি নিয়ে নয়ডা ফিরবে, আজকে আমার শেষ দুশো কিলোমিটার একা জার্নি। নটা কুড়ি নাগাদ স্টার্ট করলাম। যেতে যেতেই গরম বেড়ে গেল, দু জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার শিকঞ্জী বা লেবু শরবৎ খেতে হল। পৌনে বারোটা নাগাদ প্রথম যখন রাস্তাজোড়া সাইনবোর্ডটা দেখতে পেলাম – ওয়েলকাম টু ন্যাশনাল ক্যাপিটাল ডেলহি, সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল, নিমেষে। পেরেছি, আমি পেরেছি, দীর্ঘ বারো দিনের জার্নি শেষ করে এখন আমি বাড়ি থেকে আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূর।

এর পর? আলিপুর-মুকারবা চক-মজনু কা টিলা-শাহদরা-দিলশাদ গার্ডেন-আনন্দ বিহার পেরিয়ে বাড়ি আসতে কতক্ষণই বা লাগে? … তা লাগে, দিল্লির ট্র্যাফিক, দিল্লির জ্যাম। সাড়ে বারোটায় বাড়ির পার্কিং-এ এসে দাঁড়ালাম। সিকিনী তো অফিসে, মেয়েকে ফোন করে বললাম ফ্রিজ থেকে দুটো জলের বোতল নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে পার্কিং-এ আসতে।

মেয়ে তো বাবাকে দেখে পুউরো চমকে চৌতিরিশ। দেখার মত চেহারা হয়েছিল – সানগ্লাসের দাগ ধরে চোখের চারপাশ সাদা, বাকি মুখটা ঝুপ্পুস কালো, একেবারে জায়েন্ট প্যান্ডার মতন। ঘরে ঢুকে প্রথমে চিতপাত। একে একে সিকিনীকে ফোন করলাম, বাবাকে ফোন করলাম – বাবা তো নিজের জন্মে এমন পাগলামি কখনও শোনে নি – কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে দিল্লি থেকে কাশ্মীরের শেষমাথায় যেতে পারে – বেদম টেনশনে ছিল বেচারা, আমার ঘরে ফেরার খবর পেয়ে খুব শান্তি পেল। এই শান্তির ডিক্লারেশনটাই আমার কাছে খুব বড় পাওনা, আমিও বোধ হয় শান্তি পেলাম।

পেলাম কি?

রাতের দিকে সুমিতকে ফোন করলাম। সুমিত আগের দিন রাত সাড়ে তিনটেয় দিল্লি পৌঁছেছিল, পরদিন সকালে অফিসে মীটিং সেরে ঘুমিয়েছে।

নিজেকে চেনার তাগিদ ছিল, নিজের সামনাসামনি হবার দরকার ছিল। হয়েছি। কিন্তু চিনলাম কি নিজেকে? জানি না। শহরের চেনা ছকে ঢুকলে নিজের কাছে নিজেই কেমন অচেনা হয়ে যাই। আরও দুচারবার বেরিয়ে পড়তে হবে হয় তো শেষরাতে, এবার বেশি ম্যাচিওরিটি নিয়ে, বেশি ভালো প্রিপারেশন নিয়ে। এবার অন্য কোনও রুটে, অন্য কোনও গন্তব্যে। ঘরের মধ্যে একলা বসে থাকি যখন, আমাকে ভেতর থেকে তাড়া দেয় আরেকটা কেউ, তাড়া দিচ্ছে এখনও। অপেক্ষায় আছি, কতদিনে এই তাড়া খাওয়াটা অসহ্য হয়ে ওঠে। আবার রাস্তায় নামব। নামবই।


7 thoughts on “জুলে, আবার, জুলে লাদাখ – দ্বাদশ ও শেষ পর্ব

  1. ভীষণ ভালো লাগলো। বাইক টা এবার ভালোভাবে শিখে ফেলবো। একটা প্রশ্ন ছিলো। পুপ্পু আর তার হবু কি আলাদা আলাদা বাইক এ গেছিলো? আর তা না হলে পিলিয়ন রাইডার নিয়ে চাপ হয়নি?

    Like

    1. নাঃ। এনফিল্ড বুলেট তো সেই ভাবেই তৈরি। চারপাশে ক্যারিয়ার থাকে, ফলে পিলিয়ন সীট খালিই থাকে, আর পেছনে হেলান দেবার জন্য ব্যাকরেস্টও থাকে। পেছনে বসতে কোনওই সমস্যা হয় না। ওরা একটা বাইকেই এসেছিল।

      Like

  2. 3 দিন আগে আপনার ব্লগ টার খোজ পাওয়া থেকে গোগ্রাসে গিলেই চলেছি. বেশ কিছু লেখা পরলাম. খুব দরকারী কিছু লেখা, উপকারে লাগছে. আর এই লেখাটা পড়ে, যেটা হলো – ভিতরের যন্তরণা গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে. একে তো আমি সেই ছা-পোষা মিড্ল ক্লাস. শুধু একটু আধটু গ্প্প লিখি ইচ্ছে হলে, আর রাতের বেলা, ওথবা একলা ফাক ফোকরে একা একা বেরিয়ে পরার স্বপ্ন দেখা. কিন্তু জানি কিচ্ছু হবার নয়, বাইক টাও তো চালাতে শিখি নি সেভাবে. তবুও এত স্ব ইচ্ছে তো মরেণা আর. যেটুকু পারা যায় মেলা খেলা আর কাছে পিঠেতেই দুধের স্বাদ জলে মেটানোর চেষ্টা চলএ,,,আপনার এই লেখা যেটুকু স্বাদ মেটালো তার চেয়েও বেশি কেড়ে নিল রাতের ঘুম…ধন্যবাদ

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.