নাম জানা হয় নি …

অনেক দিনের পুরনো একটা লেখা। রমজানের মাসে আবার তাকে মনে পড়ল – ঝেড়েবেছে তুলে রাখলাম আমার ব্লগের পাতায়।

সে ছিল এক রমজানের মাস। তুমি চলেছিলে তোমার প্রিয় সেই সুফি দরগার দিকে, অজানা অনামা সেই দরগা, খ্যাতিমান শানদার হুমায়ুঁ কা মকবরার ছায়ার আড়ালে, খ্যাতির আড়ালে চিরদিনের অনাদৃত সেই দরগার দিকে।

তার নাম পত্তেওয়ালি দরগা। লোকমুখে চলে আসা কাহিনি অনুযায়ী, কোনো এক সুফি সন্ত এইখানে এক গাছের তলায় বসে সাধন-ভজন করতেন। সেই সুফি আজ আর নেই, কিন্তু সেই গাছ আজও রয়ে গেছে, রয়ে গেছে গাছের নিচে তাঁর মাজার। গাছের গুঁড়িতে পরতে পরতে জরিয়ে গেছে বয়েসের ভার, কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পাতা আজও সবুজ! ভক্তেরা আসে মানত রাখতে, এই গাছের একটি দুটি পাতা চিবিয়ে যায় তারা, মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা চাঁদির পাতা ভেট দিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি রেখে যায় এই মাজারের কানে কানে।

একদিন তুমিও এসেছিলে, দাঁতে কেটে গেছিলে এই গাছের পাতা। আর আস্তে আস্তে তোমার যাওয়া আসা বাড়তেই থেকেছিল, বাড়তেই থেকেছিল, আলাপ পাতিয়েছিলে এই দরগার বুড়ো চৌকিদারের সাথে। সময়ের সাথে সাথে সেই বন্ধুত্বেও এসেছিল পরিপক্কতা। তুমি তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলে। নাম জানার দরকার হয় নি কারুরই। প্রতি বছর রমজানের সময়ে তুমি তার জন্য ফল নিয়ে দেখা করতে যাও তার সাথে, একবারের জন্য হলেও। … এবার খুব দেরি হয়ে গেছে। রমজান প্রায় শেষ, তোমার যাবার সময় হয়ে ওঠে নি। শহরের বাইরে থাকতে হয় এখন তোমাকে, হাজারটা কাজের ভিড় ঠেলে তুমি যখন দিল্লির মাটিতে পা রাখতে পারলে, তখন বেলা পড়ে আসছে। একটু পরেই রোজা ভাঙার সময় হবে, তোমার খুব ইচ্ছে আজ তোমার আনা ফল খেয়ে বাবার রোজা ভাঙুক। সূর্যাস্তের আগেই, তাই, তোমায় পৌঁছতে হবে।

এদিকে ট্যাক্সিটাও জঘন্য। এক আধা গাঁইয়া ভূত ড্রাইভার, ট্যাক্সি সাজানোর তাগিদে একইসঙ্গে সামনের উইন্ডশিল্ড আর পেছনের ডিকির ঢাকনা ভরিয়ে ফেলেছে যতরাজ্যের ভগবান আর ফিল্ম নায়িকাদের লাস্যময়ী ছবিতে। চলন্ত ট্যাক্সিতে এখন ছড়িয়ে পড়ছে বাপ্পি লাহিড়ীর এক পুরনো গান, গানের তালে তালে ড্রাইভারের আঙুল নেচে যাচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের ওপর, বোঝা যাচ্ছে বেশ খোশমেজাজেই আছে সে, কোনো তাড়াহুড়ো তার আছে বলে মনে হচ্ছে না। মোটের ওপর, তোমার এই মুহূর্তের মানসিক অবস্থার সঙ্গে তার অবস্থার আসমান জমিন তফাত। কিন্তু তাতে কার কী?

‘হুমায়ুঁ কা মক্‌বরে পে লে চলনা’, তার ট্যাক্সির নোংরা দাগধরা পেছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে তুমি বললে, ‘জলদি চলো, সুর্য ঢলবার আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে, ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে।’ ড্রাইভার মনে হয়, বুঝল গুরুত্বটা, ট্যাক্সির স্পিড বাড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো নিজামুদ্দিনের এক ফলের দোকানের সামনে। এক পক্ককেশ সর্দারজি ফল বেচছেন সেখানে। তুমিই ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলেছিলে। ‘রোজেদার কে লিয়ে এক ফল কি টোকরি বনা দোগে আপ?’ সর্দারজিকে শুধোলে তুমি। ঝটপট উঠে দাঁড়ালেন সর্দারজি, ‘জরুর জি’। তাড়াতাড়ি সামনে থেকে সরিয়ে নিলেন আগে-থেকেই রেখে দেওয়া দুটো ফলের বাস্কেট, হয় তো তত ভালো ফল ছিল না তাতে, কিংবা, কে জানে, ফলগুলো হয় তো ইফতারে ব্যবহৃত হবার জন্য অতটা পবিত্র ছিল না। পেছন থেকে আরেকটা বাস্কেট বের করে দিলেন তিনি। ‘অওর ইয়ে দোনো মেরি তরফ সে’, বলে আরো দুটো কমলালেবু  চাপিয়ে দিলেন সর্দারজি, ভরে ওঠা বাস্কেটের ওপরে। কোথাও একটা মানুষ পবিত্র মাসভর উপবাস করছে, তার দোকানের এই ফল সেই পবিত্র উপবাসের অবসান ঘোষণা করবে, এই বিশ্বাস হয় তো তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দুজনকার ধর্মবিশ্বাস আলাদা, তবু কীভাবে যেন দুটি স্রোত একসাথে মিশে গেল আজ, এই ফলের দোকানে।

স্রোতে গা ভাসালো আমার সারথিটিও। সেই আধা গাঁইয়া ড্রাইভার। চুপ করে সে দেখছিল এক রোজেদারের জন্য যত্ন করে এক সর্দারজির ফলের ঝুড়ি সাজিয়ে দেওয়া। বাকি রাস্তাটা সে ট্যাক্সির রেডিও বন্ধ করে রেখেছিল। আর, সূর্যাস্তের ঠিক আগে সে তোমাকে পৌঁছে দিল দরগার মুখে। গোধূলির আবছায়া গাঢ় হল হুমায়ুঁর সমাধির চূড়ায়, তোমাদের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো দরগার সামনে। বুড়ো গাছের পাতারা হাত নেড়ে স্বাগত জানালো তোমাকে।

পা বাড়াতেই, সেই আধা গাঁইয়া ড্রাইভার তোমায় ডাকল পেছন থেকে। “কেয়া ম্যায় অন্দর আ সক্‌তা হুঁ?’’ আমি কি ভেতরে আসতে পারি? তার হাতে তোমার সেই ফলের ঝুড়ি। সে তোমাকে অনুসরণ করে ঢুকল বুড়ো গাছের নিচ দিয়ে, দরগার ভেতরে। সেখানে সেই নাম-না-জানা সুফীর মাজার সবুজ চাদরে ঢাকা, দেখতে পেয়েই সে পায়ের থেকে জুতো খুলে ফেলল। তোমাকে আর কিছুই বলতে হল না। সে নিজে থেকেই তার মাথা ঢেকে নিল রুমালে, নতজানু হয়ে নাক ঠেকাল ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝেতে। … বাইরের উঠোনে তখন এক ময়ূর নাচছিল, আর এককোণে খাটিয়ায় বসে ছিলেন সেই বুড়ো চৌকিদার, তুমি যাঁকে ‘বাবা’ বলে ডাকো। তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসে কিছু লোক। তারা সবাই ইফতারের আয়োজন করছিল। তোমার সাথে সেই জমায়েতে আমন্ত্রণ পেল সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারও। কী তার ধর্মবিশ্বাস, সে সব প্রশ্ন, অন্তত সেই সময়ের জন্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ। নীরব আমন্ত্রণ আর ততোধিক নীরব আমন্ত্রণ স্বীকারের এই যে মেলবন্ধন, এই মেলবন্ধন যদি এই মুহূর্তে এই দরগার উঠোন পেরিয়ে, ছড়িয়ে পড়তে পারত সারা বিশ্বে, হয় তো এই মুহূর্ত থেকে, বিশ্বে অবিশ্বাস বলে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকত না।

সাধারণ, অতি সাধারণ এক কলরবমুখর জনবহুল দিল্লির সন্ধ্যায়, সকলের নজরের আড়ালে সেই মেলবন্ধনের সাক্ষী হয়ে থাকলে তুমি, বিকেলবেলার ফলের দোকানের সর্দারজির দেওয়া কমলালেবুর মাধ্যমে, তোমার এই গাঁইয়া ভূত ট্যাক্সি ড্রাইভারের ইফতারের ভোজে জুটে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে … এরাই হয়ে রইল আজকের সময়ের সমন্বয়ের কুশীলব।

তুমি তাদের নাম জিজ্ঞেস করো নি।

তাকে দেখা যায় দরগার প্রবেশপথের মুখে, পবিত্র মাজারের দিকে হেঁটে যেতে। পত্তেওয়ালি দরগার মাজার। সেই বুড়ো চৌকিদার সেখানে চৌকিদারি করে চলেছে সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে। অর্ধেক জীবন ধরে। তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছো, এক বুড়ো মানুষ, মাথাভর্তি নরম সাদা চুল, নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত, মাথায় সাদা এম্ব্রয়ডারি করা সাদা ফেজটুপি সেই চুলকে সামলে রাখতে পারে নি।

টুপিটা ছিল তার অতি সাধারণ, ফুলপাতার নকশা তোলা সূতির টুপি, হয় তো কোনো গাঁয়ের কোনো মহিলার হাতে তোলা নকশা। কিন্তু টুপিটা ছিল তার অস্তিত্বেরই একটা অংশ, যেমন অংশ ছিল তার হুঁকোটি। অতি পুরনো ধাতব একটা হুঁকো, কোনো চাকচিক্য নেই, নেই কোনো জৌলুশ, অতিব্যবহারে সেটি জীর্ণ। হয় তো তারই মতন বুড়ো, বয়েসের দিক দিয়ে ধরতে গেলে, এই হুঁকো তার আজীবনের সঙ্গী। সন্ধ্যের ঝোঁকে যখন চারদিক আবছায়াতে ঢেকে যায়, তখন তুমি তাকে অনেকবার দেখেছো — বুড়ো বটগাছের নিচে পাথরের বেঞ্চিতে বসে বুড়ো চৌকিদার একমনে হুঁকো টেনে যাচ্ছে। এই বোধ হয় তার একমাত্র নেশা ছিল, একমাত্র আগ্রহের বস্তু, দীনদুনিয়ার বাকি সমস্ত যা কিছু, সমস্তই তার কাছে বহমান, অর্থহীন। দরগার উঠোনের এককোণে একটা ছোট্ট খুপরি ঘরেতে তার থাকার জায়গা, সেই ঘরে একটা সবুজ রংয়ের দরজা আছে, কোনো জানলা নেই। ঘরের ভেতরে যখনই যাও, দেখতে পাবে একটা কাঠের খাট, তাতে এক মোট্টা গদি পাতা, আর বেগনি রংয়ের চাদর দিয়ে ঢাকা। খাটের নিচে একটা টিনের তোরঙ্গ, তার জীবনধারণের সমস্তকিছু দিয়ে ভর্তি; রান্নার বাসন, পরণের কাপড়, আর কিছু কাপড় বোঁচকা করে বাঁধা, সম্ভবত মাজারের ওপরে যে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো হয়, সেইসব শুকনো পাপড়ি জড়ো করে রাখা। ঘরের এককোণে একটা ছোট কেরোসিনের স্টোভ, যাতে সে নিজের খাবার দাবার রান্না করে, যাতে রান্নার থেকে ধোঁয়া হয় বেশি। কিন্তু রান্নাটা সে করে খুব যত্ন নিয়ে, তার রান্নার মেহনত দেখলেই তুমি বুঝে যেতে পারো, সে পরার থেকে খাওয়ার প্রতি বেশি শৌখিন। পরবার বলতে তো ছিল তার একটা চেক লুঙ্গি, নীল কিংবা ধূসর রঙের, আর একটা বিবর্ণ কুর্তা, প্রতিদিন ধুয়ে ধুয়ে তার আসল রং আর চেনা যায় না। কিন্তু তার পরিধানের দিকে কে-ই বা কবে তাকিয়েছে, লোকে তো দেখত তার মুখে সেই সাদা চুলদাড়ির ফাঁকে আলৌকিক স্বর্গীয় হাসি, যা নীরবে সামনের মানুষটিকে তার কাছে ডাকত, বসাত তার পাশে, নীরবে।

‘ক্যায়সে হো, বাবা?’ তুমি যখনই তাকে জিজ্ঞেস করতে, তার একটাই উত্তর ছিল, ‘ঠীক হুঁ বেটা, বিলকুল ঠীক হুঁ’। বাইরে হয় তো তখন ধবধবে সাদা আকাশে সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে। কিংবা অসম্ভব বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। বাইরের আবহাওয়া তার ভালো থাকা-না-থাকাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারত না, সে নিজের জগতে এমন এক সুন্দর আবহাওয়া বানিয়ে থাকত, যা কখনো পরিবর্তিত হত না। পারিপার্শ্বিক সমস্ত ঘটমান পরিবর্তনকে সে জয় করেছিল অনায়াসে। তুলকালাম শীতেও তাকে দেখা যেত একটা কম্বল জড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে, কিন্তু পায়ে তার কখনো কোনও জুতো দেখা যায় নি। সবসময়েই তাকে দেখা যেত খালি পায়ে, মার্বেলের মেঝের ওপর ঝাঁটা হাতে ঘুরে ঘুরে শুকনো পাতা পরিষ্কার করতে, কিংবা গাছে জল দিতে, কিংবা তার সংসারের দুই প্রতিপালিত জীব, দুই বিড়ালকে খাবার দিতে। সে কখনো তার নাম বলে নি, যেন তার কখনোই কোনো নাম ছিল না, ‘আমি তো এখানেই থাকি’ – এটাই তার একমাত্র উত্তর যখনই তাকে তার সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করা হত।

ধীরে ধীরে তোমাদের সখ্যতা বাড়তে থাকল, বিশাল এই শহরের এক নির্জন কোণে। সবার চোখের আড়ালে। সে তোমায় শোনাত বিভিন্ন সুফি কাহিনি, হয় তো সে নিজে যখন ছোট ছিল, তখন শুনেছিল। প্রায় সব গল্পই এইভাবে শুরু হত, এক যে ছিল ছেলে, আর ছিল এক পরমাসুন্দরী কন্যে। জন্ম নিল ভালোবাসা। গল্পে যেমন হয়ে থাকে, ছেলেটি ছিল খুব গরীব, আর মেয়েটি ছিল কোনো আমীরের মেয়ে। অসম প্রেমে জন্ম নেয় অসংখ্য বাধাবিপত্তির। …ছেলেটি ছিল ধোপা, আর কন্যেটি? হয় তো কোনো রাজকুমারী! তার রাজপ্রাসাদ ছিল হুই দূরে সেই পাহাড়ের মাথায়। যাদের ছুঁতে চেয়েও ছুঁতে পারা যায় না, রাজকুমারী হোক বা কোনো ভগবানের অবতার, তারা সবসময়েই দূরপাহাড়ের বাসিন্দা হয়। গল্পের মাঝে তুমি কখনো জানতেও চাওনি সেই রাজপ্রাসাদওলা পাহাড় কোন দেশে ছিল। কে জানে, হয় তো তা ছিল এই যমুনাপারেই, হয় তো তোমরা এখন যেখানে বসে আছো, তার থেকে খুব বেশি দূরে কখনো ছিল না। হয় তো সে পাহাড় কখনো ছিলই না বাস্তবে। যাই হোক, প্রাসাদ এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার মুখ থেকে গল্প শোনা।

এক প্রেমের গল্প, সুফিয়ানার তবকে মোড়া। আগেই শুনেছো, ছেলেটি ছিল এক ধোপানীর ছেলে, রাজকন্যের প্রতি তার ভালোবাসার কোনো তল ছিল না। তার মা যেত সেই প্রাসাদে, রাজকন্যের ময়লা জামাকাপড় নিয়ে আসত সাফ করার জন্য। ছেলেটি সেই সমস্ত জামাকাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করত, অন্তরের গভীরতম ভালোবাসা দিয়ে। রাজকন্যেকে সে কোনোদিন চোখেও দেখে নি, কেবল সেই জামাকাপড়গুলিকে সে দু’হাতে অনুভব করত, আর কল্পনা করত, যার পরিচ্ছদ এত সুন্দর, না জানি সেই মানুষটি কত সুন্দর হবে! অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে, অত্যন্ত পেলব হাতে সে ধুয়ে পরিষ্কার করত সেই অদেখা রাজকুমারীর সমস্ত কাপড়, শুকিয়ে নিত, ভাঁজ করার সময়ে তাতে ছড়িয়ে দিত জেসমিনের পাপড়ি। সেই কাপড় আবার বোঝায় বেঁধে পাহাড়ের ওপরে প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসত তার ধোপানী মা, আর এত সুন্দর ধৌতকর্মের জন্য অর্জন করে আনত প্রাসাদবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা। এইভাবে, প্রতি সপ্তাহে, ছেলেটির ভালোবাসার স্পর্শে কাপড়গুলি হয়ে উঠত নতুন থেকে নতুনতর। কিন্তু ধোপানী যে মা, সে থাকে আশংকায় কাঁটা হয়ে; যদি সুলতানের কানে গিয়ে পৌঁছয় এই অসম একতরফা ভালোবাসার খবর? তিনি তো ছেলের গর্দান নেবেন!

মায়ের আশংকা একসময়ে স্পর্শ করে ছেলেকে। ছেলে বুঝতে পারে মায়ের মন। সে মা-কে বোঝায়, সুলতানের কানে এ ভালোবাসার খবর শোনার আগে সে নিজে নিজেকে শেষ করে দেবে।

এবং সে সত্যিই তাই করে। শেষ করে দেয় নিজের জীবন। তার মা, বুড়ি ধোপানী এখন পুকুরধারে একা একা কাপড় ধোয়, একা একাই শুকোয়, ভাঁজ করে, বোঝা বেঁধে প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসে। কিন্তু কাপড়ে তো আর সেই জৌলুস আসে না! দিন-কে-দিন কাপড় যেন কেমন বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। রাজকুমারী ক্রুদ্ধ হয়, ‘কে ধুয়েছে এই কাপড়?’ জড়োসড়ো হয়ে জবাব দেয় ধোপানী, ‘আমি নিজের হাতে ধুয়েছি, হুজুরাইন।’ কিন্তু কাপড়ে তো আর সেই পেলবতা নেই, নেই তার ভাঁজে ভাঁজে জেসমিনের পাপড়ি। ‘কে পরিষ্কার করত তাহলে, এতদিন, আমার কাপড়?’

সন্তানহারা মায়ের হাহাকার এইবার প্রকাশ পায়। নিজের গর্দানের তোয়াক্কা না করে সে রাজকুমারীকে খুলে বলে তার নিজের ছেলের গোপন ভালোবাসার কথা, বলে, স্বীকৃতি না-পাবার ভয়ে তার আত্মহননের কথা। শুনতে শুনতে রাজকুমারীরও চোখ ভরে ওঠে জলে। জলভরা চোখে সে ধোপানীকে শুধোয়, ‘আমাকে নিয়ে যাবে একবার, তার সমাধির কাছে?’

এক নির্জন শীতের রাতে রাজকুমারীকে নিয়ে ধোপানী পৌঁছয় পাহাড়ের নিচে, তার সন্তানের সমাধিস্থলে। পৌঁছয় সেই দীঘির ধারে, যেখানে অব্যক্ত প্রেম বুকে নিয়ে চিরঘুমে শুয়ে আছে সে, একবুক মাটির আড়ালে। সেই সমাধির সামনে গিয়ে রাজকুমারী অস্ফুটে শুধোয়, কেমন প্রেমিক, তুমি? যাকে পাগলের মত ভালোবাসলে, তাকে একবারটি চোখের দেখা না দেখে তুমি চলে গেলে এই দুনিয়া ছেড়ে? …বলামাত্র মাটি চিরে দুভাগ হয়ে গেল, রাজকুমারী পা বাড়াল সেই গহ্বরের দিকে। মাটির ফাঁক আবার বুজে গেল। পৃথিবীর অভ্যন্তরে মিলিত হল তারা দুজন।

‘পেয়ার কী কোই মওত নহী হোতি, না কোই শরহদ্‌ হোতা পেয়ার মে।’ গল্প শেষ করে মাথা নাড়ে বুড়ো চৌকিদার। শীতের নম্র বিকেলে কমলা সূর্য গোলাপি হয়ে মুখ লুকোয় এক দুখী সম্রাটের মকবরার পেছনে।

গত রমজানের সময়ে এসে তুমি তাকে দেখতে পাও নি পত্তেওয়ালি দরগার উঠোনে। ‘বাবা’ ছিল না সেখানে তোমায় অভ্যর্থনা করার জন্যে। উঠোনে বসে-থাকা কেউ একজন তোমায় জানালো, বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এক কমবখ্‌ত মারুতি কার সামনের রাস্তায় বাবাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে গেছে কদিন আগে। বাবার পিঠে অনেকগুলো হাড় ভেঙেছে। বেশ বড়সড় দুর্ঘটনাই ঘটেছে। সারতে সময় লাগবে। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগবে আরও বেশি। বাবা এখন তার খুপরির ঘরে শুয়ে আছে, একা একা। … বাবা আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারে নি, আজান দিতে পারে নি, নমাজ অদা করতে পারে নি, উঠোন থেকে শুকনো পাতা সরাতে পারে নি। আর কখনো তার পোষা বেড়ালদের নিজের হাতে খাবার দিতে পারে নি। নিজে উঠে বাথরুমে যাবার ক্ষমতাও আর ছিল না তার, রোজা রাখা তো অনেক পরের কথা। এর পরেও যখন তুমি গিয়ে বসলে তার শয্যার পাশে, শুধোলে, ‘ক্যায়সে হো, বাবা?’ – উঠে বসার অক্ষম চেষ্টা করতে করতে সেই একই সহাস্য উত্তর দিল সে, ‘ঠীক হুঁ বেটা, বিলকুল ঠীক হুঁ।’ কিন্তু এবারে গলার আওয়াজ যেন অনেক নিষ্প্রভ। ‘এখানে সবাই আমার যত্ন নিচ্ছে।’ তার একমাত্র অনুযোগ ছিল, সে আর রমজানের মাসে রোজা রাখতে পারছে না।

রমজানের শেষে ঈদের দিনে, আজ তুমি আবার এসেছো বাবাকে ঈদ মুবারক জানাতে। কিন্তু বাবা তো নেই সেখানে! না দরগার উঠোনে, না সেই সবুজ দরজাওলা খুপরি ঘরের ভেতরে। হুঁকোটা পড়ে রয়েছে পাথরের বেঞ্চির একপাশে, বাবা সেখানে নেই, টানার জন্য। অবশ্য ওই পাথরের বেঞ্চিতে বসা বাবা অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্টেরও আগে। কারণ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, যে পিপলগাছের ছায়ায় বানানো হয়েছিল বেঞ্চিটা, সেই গাছটা কেটে দিয়ে গেছে দরগার নতুন অথরিটি। ‘আল্লাহ্‌ কি মর্জি …’ শুধুমাত্র এইটুকু বলেই বাবা চুপ করে গেছিল, বলায় কোনো তিক্ততার লেশমাত্র ছিল না। যারা তাকে অনেকদিন ধরে জানত, তারা জানত ওই গাছ ছিল বাবার সন্তানতুল্য, বাবা তাকে নিজের হাতে লাগিয়েছিল একদিন। তার সাথেই বেড়ে উঠেছে সেই পিপলগাছ, একসঙ্গেই বুড়ো হয়েছে তারা। গাছটা কেটে ফেলার পরে বাবার মুখে কোনো খেদোক্তি কেউ শুনতে পায় নি কোনোদিন, কোনো হতাশাও গ্রাস করে নি বাবাকে। পরম মমতায় বাবা নিজের হাতে, সেই কেটে ফেলা গাছের জায়গায়, আবার রোপণ করেছিল নতুন কিছু ফুলের চারাগাছ। আজ তুমি ঈদের দিনে এসে দেখছো সেই জায়গাটা আবার ছেয়ে গেছে গুল্মলতায়, আর সেই ঝোপ আলো করে ফুটে আছে রাশি রাশি ফুল। বাকি সব শুনশান। নমাজের জায়গায় একটিও লোক নেই, সেই ময়ূরটাও নেই, নেই সেই বেড়ালগুলোও। বাবার খুপরির সবুজ দরজায় একটা ছোট্ট পেতলের তালা ঝুলছে।

‘কঁহা গয়ে বাবা?’ তুমি শুধোলে একজনকে। তার মুখটা বুঝি তোমার চেনা-চেনা ঠেকল, কোনো একসময়ে তুমি তাকে দেখেছো বাবার সঙ্গে একই হুঁকোয় তামাক খেতে। লোকটা,  উদাসীন গলায় জানালো তোমায়, ‘বহ্‌ তো অপনা ঘর চলে গয়ে। আমি এখন এই ঘরে থাকি।’

‘কিন্তু বাবার তো এটাই ঘর ছিল। সারা জীবন এখানেই কাটিয়েছে। আর কোনো যাবার জায়গা তো বাবার ছিল বলে শুনি নি!’ তুমি বললে, কিন্তু লোকটি কান দিল বলে মনে হল না। কিন্তু অন্তত তার তো জানা উচিত যে, বাবার আর কোনো ঘর ছিল না! বাবা সারাটা জীবন এখানেই কাটিয়েছে, তার খুব ইচ্ছে ছিল, মরে গেলে তাকেও যেন এখানেই দফন করা হয়, তার প্রিয় সুফির মাজারের কাছেই। সেই সব ইচ্ছেরা রয়ে গেছে এই দরগার আনাচে কানাচে, কিন্তু বাবা নেই।

লালচে সূর্য ধীরে ধীরে মুখ লুকোয় হুমায়ুঁ কা মকবরার পেছনে। তোমার মন ছটফট করে। ‘বাবার গাঁয়ের ঠিকানা কী?’ শুধোও তুমি, আর থাকতে না-পেরে, ‘আর নাম কী?’

‘গাঁয়ের নাম সিপালাই, গজরৌলা। মোরাদাবাদ জিলায়।’ লোকটির মুখ থেকে এর বেশি কিছু বেরোয় না। তুমি অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করো, বাড়ির কোনো নম্বর? রাস্তার নাম? … অওর, বাবা কা নাম? বাবার নিজের নাম কী?’

অন্যদিকে লোকটি নির্বিকার, এখনও। ‘বস্‌ “বাবা” লিখকে এক খত্‌ ভেজ দেনা। সির্ফ বাবা, লিখ দো। পৌঁছে যাবে।’

একলা তুমি, ধীর পায়ে বেরিয়ে আসো দরগা থেকে। আর হয় তো তোমার এখানে আসার দরকার হবে না। … বাবাকে একটা চিঠি লেখা যেতে পারে। কিন্তু কী লিখবে, তুমি? সাধারণ লোকে চিঠিতে যে-সব কথা লেখে, সে রকমের কথাবার্তা তো কখনও হয়ই নি তোমাদের মধ্যে। তোমাদের সখ্যতার মাঝে তো তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনের আলাপচারিতা ছিলই না। তোমাদের দীর্ঘমেয়াদী, কিন্তু স্বল্পকালীন দেখাসাক্ষাতের বিষয় জানে এখানকার ফুল-পাতারা, এখানকার একলা বাতাস। তিন কোটি লোকে ভরা এই বিশাল শহরের আর কেউ জানে না। এই বাতাস বয়ে যাবে না এখান থেকে, বাবার গাঁয়ে? তোমাদের নিভৃত আলাপচারিতার অসামান্য বিষয়বস্তু কি চিঠিতে লিখে ফেলা যায়? অতই সহজ? তা ছাড়া, বাবা এমন কি চিঠি লেখার দূরত্বে রয়েছে? সুফি মতে তো, কোনো ব্যবধানই আসলে ব্যবধান নয়, মনের গ্রন্থিই আসল, সে যদি পোক্ত থাকে, তবে সহস্র যোজন দূরত্বও নিমেষে উধাও হয়ে যায়। সেই নৈকট্যের বেড়াজালে কোনো চিঠিরই আর প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন পড়ে না কোনো নামেরও।

সে ছিল, শুধুই তোমার এক বন্ধু। এক প্রিয় বন্ধু।

তার নামটা জানা হয় নি।


না, এটা আমার নিজের লেখা নয়। খুশবন্ত সিং সম্পাদিত বই “ Delhi: The City Improbable ‘ বইয়ের একটি নিবন্ধ I never knew his name থেকে সরাসরি বঙ্গানুবাদ। মূল লেখাটির লেখক: আনীস জঙ্গ।

আনীস জঙ্গ — জন্ম রৌরকেল্লাতে। পড়াশোনার জন্য প্রথমে হায়দ্রাবাদ, পরে আমেরিকানিবাসী। পরে ভারতে ফিরে লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়ে কেরিয়ার শুরু করেন। ভারতে ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাথে সম্পাদনার কাজে যুক্ত থেকেছেন তিনি।


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.