মহেশ শর্মা, গরুর মাংস এবং কিছু প্রলাপ

মহেশ শর্মা ব্যক্তিটিকে আমি ঠিক চিনি বললে ভুল বলা হবে, আবার চিনি না বলাও ঠিক নয়। সামনাসামনি একবারই দেখেছিলাম, কথা বলার সময় সুযোগ জোটে নি অবশ্য।

নয়ডাতে একটা হাসপাতাল আছে, বেশ এসট্যাবলিশড, নামকরাও বলা যায়। কৈলাশ হাসপাতাল। নয়ডা জেলাশাসকের বাংলোর একেবারে গা ঘেঁষে। আজ থেকে প্রায় তেরো বছর আগে আমরা প্রথম যখন দিল্লিতে সংসার করা শুরু করি, তখন এই কৈলাশ হাসপাতালের ঠিক সামনেই কুড়ি সেক্টরের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। কৈলাশে যেতে হয়েছিল দিল্লি আসার কিছুদিনের মধ্যেই – আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন – সেই আমাদের প্রথম দিল্লির গরমের অভিজ্ঞতা; ২০০৩ সালের মে মাস, বাড়িওয়ালি বৌদিই আমাদের ছাদ থেকে দেখিয়ে দেন কৈলাশ হাসপাতাল। কৈলাশে গিয়ে দেখি তিনজন গাইনিকোলজিস্ট বসে আছেন, কার কাছে যাওয়া ঠিক হবে বুঝতে না পেরে কাউন্টারেই জিজ্ঞেস করলাম – কোন গাইনির কাছে যাবো? কাউন্টারের মেয়েটি সাথে সাথে উত্তর দিলঃ উমা শর্মার নামে স্লিপ কাটুন। উনিই বেস্ট।

চেম্বারের সামনে গিয়ে দেখি লম্বা ভিড়। সামনে বোর্ডে নাম লেখা উমা শর্মা, এইচওডি।

লাইনের শেষে যখন আমাদের ডাক এল, ডাক্তার উমা শর্মা নিজে দেখার আগে দুজন জুনিয়র ডাক্তার আমার স্ত্রীকে দেখে অর্ধেক প্রেসক্রিপশন তৈরি করে শ্রীমতি শর্মার ডেস্কে পাঠালেন। সেখানে শ্রীমতি শর্মা প্রথমে আলট্রাসাউন্ড করানোর পরামর্শ দিলেন। আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট হাতে নিয়ে পরদিন যেতেই তিনি জানালেন – ওভারিতে সিস্ট হয়েছে, আগামী পাঁচ মাস ধরে একটি মহামূল্যবান ইঞ্জেকশন পাঁচবার পুশ করতে হবে, চিন্তার কিছু নেই, ঠিক হয়ে যাবে।

তখন নতুন চাকরি, সাধ্যের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করালাম, কিন্তু স্ত্রী সুস্থ হলেন না। মুশকিল হয়েছিল – পাঁচমাসে আমরা দুবার বাড়ি পালটে ফেলেছিলাম, ফলে দুবার স্থানবদলে সেই প্রথম দিনের প্রেসক্রিপশন কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল। পাঁচ মাস পরে আমরা আবার উমা শর্মার দ্বারস্থ হলাম, তিনি কথা অর্ধেক শুনেই প্রথমেই আলট্রাসাউন্ডের আদেশ দিলেন, এবং তার রিপোর্ট হাতে নিয়ে আবার একই ইঞ্জেকশন লিখে দিলেন আগামী পাঁচ মাসের জন্য।

ইঞ্জেকশনটি লিউপ্রিন গোত্রের। ডাক্তারির ছাত্ররা জানবেন এই ইঞ্জেকশনের ক্ষমতা কতটা। মিনমিন করে জানালাম শ্রীমতি শর্মাকে, আপনি পাঁচ মাস আগে এই ইঞ্জেকশনই লিখে দিয়েছিলেন, সেটা শেষ করেই আপনার কাছে আসছি।

– আমি লিখে দিয়েছি? কই, কোথায় সে প্রেসক্রিপশন?

প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারি নি, উনি রীতিমত ধমকে উঠলেন, প্রেসক্রিপশন হারিয়ে ফেলেছো তো আমার টাইম খারাপ করতে এসেছো কেন? যাও!

এর পরে সেই আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট নিয়ে অন্য হাসপাতাল, অন্য ডাক্তারকে দেখিয়ে জানা গেল সিস্ট আদৌ হয়ই নি, ঐ ইঞ্জেকশন দেবার ফলে স্ত্রীর শরীরে হরমোনাল ডিসব্যালেন্স ঘটে গেছে, সেটা ঠিক করার জন্য এখন রিভার্স ট্রিটমেন্ট চালাতে হবে। ততদিনে এদিক ওদিক থেকে ফীডব্যাক শুনে নিয়েছি – উমা শর্মার প্রচুর বদনাম। খুব বাজে ব্যবহার করেন, ঠিকমত পেশেন্ট দেখেন না, উল্টোপাল্টা ওষুধ দেন।

আমরা আর উমা শর্মার কাছে যাই নি। সেই শেষ দেখা। ওই হাসপাতালেই আরেকজন গাইনি বসেন, তাঁর কাছে চিকিৎসা করিয়ে পরে আমরা প্রচুর উপকার পেয়েছিলাম, ফলে কৈলাশ যাতায়াত আমাদের কমে নি। আমার মেয়েও এই দ্বিতীয় গাইনির হাতেই জন্মায় কৈলাশ হাসপাতালে।

এই যাতায়াতের মাঝেই একবার মহেশ শর্মাকে দেখেছিলাম। উমা শর্মার স্বামী, এবং কৈলাশ হাসপাতালের মালিক। শুনেছিলাম – লোকাল নেতা, প্রচুর পাওয়ারফুল লোক। দিল্লিতে তখন নতুন জীবন, সামনে থেকে একজন “পাওয়ারফুল” লোককে দেখতে পেয়ে বেশ শিহরিত হয়েছিলাম। … এখন অবশ্য একাধিক কৈলাশ হাসপাতাল আছে, একটি নয়ডায়, একটি গ্রেটার নয়ডায়। এ ছাড়াও দিল্লিতে কৈলাশের মালিকানায় আরও দুখানা অন্য নামের হাসপাতাল আছে।

তো, বারো বছর বাদে আবার মহেশ শর্মার নাম এখন প্রায় রোজদিন খবরের শিরোনামে। তিনি এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী – কালচার এবং ট্যুরিজম মিনিস্টার। ক্লোজেট চাড্ডি ছিলেন – এতদিন জানতাম না। অবশ্য এতদিন অনেকেরই অনেক কিছু জানতাম না। ২০০৪ পর্যন্ত অটলবিহারি বাজপেয়ীর জমানা চলেছিল, এই লেভেলের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা তখন দেখি নি। হয় তো টেকনোলজি তখন অত উন্নত ছিল না। মনে আছে, ২০০৪ ভোটের আগে শাইনিং ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন চলছে প্রমোদ মহাজনের তত্ত্বাবধানে, একদিন আমার মোবাইলে কল এল, রেকর্ডেড মেসেজ – ন্যামস্কার, ম্যায় অটল বিহারী বাজপেয়ী বোল রহা হুঁ – বাকিটা শোনার আগেই কেটে দিয়েছিলাম, কারণ ততদিনে খবরের কাগজ পড়ে জানা হয়ে গেছে বাজপেয়ীজির কী বক্তব্য।

তার পরে হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ল এনডিএ-র প্রাসাদ, ক্ষমতায় এল ইউপিএ, দশ বছর রাজত্বের পরে তারাও এখন বিলীয়মান, গুজরাতের বিকাশপুরুষের হাত ধরে হইহই করে ক্ষমতায় এসে গেছে নতুন এনডিএ। নতুন প্রধানমন্ত্রী কিনা বিকাশপুরুষ, তাই বিকাশের চিন্তা ছাড়া তিনি একটা দিনও কাটাতে পারেন না, অতএব, স্বচ্ছতার বিকাশ, মনের কথার বিকাশ, বাণিজ্যের বিকাশের সাথে সাথে এখন খুব তাড়াতাড়ি হিন্দুত্বেরও বিকাশ ঘটছে – নতুন মোড়কে নতুন স্বাদে – সে আমরা দেখছি গত এক দেড় বছর ধরে। এই হিন্দুত্বের বিকাশে আগে হুঙ্কার ছাড়তেন উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্ভরা টাইপের লোকেরা। এখন এঁরা আর তেমন ফোরফ্রন্টে নেই। এসে গেছেন যোগী আদিত্যনাথ, বাবা রামদেব, আর তাঁদের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে উঠে আসছেন হিন্দুত্বের নব ঝাণ্ডাধারীরা – সঙ্গীত সোম, মহেশ শর্মা ইত্যাদি প্রাণীরা। ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্রে বীফ ব্যান হয়ে গেছে, সরকারের সলামোচনা করাও একপ্রকার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানে। শেষতম সংযোজন হয়েছে জৈনদের উৎসবের সময়ে মাংসের দোকান আইন করে বন্ধ করে দেওয়া। মহারাষ্ট্রের রেশ কাততে না কাটতেই নয়ডা আবার খবরের শিরোনামে। গ্রেটার নয়ডার কাছে দাদরি গ্রামে “বীফ খেয়েছেন” – এ রকম একটা গুজবের বশবর্তী হয়ে ৭০ বছরের প্রতিবেশি পরিবারের কিছু নওজোয়ান ছেলের হাতে গণপিটুনি খেয়ে মারা গেছেন এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তাতে হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেজরিওয়াল থেকে, অখিলেশ যাদব থেকে – সব নেতামন্ত্রীরা বিসাদা গ্রামে এসে লাশ নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছেন, আর দাঁড়ে বসে বাণী দিচ্ছেন মহেশ শর্মারা। রোজ নতুন নতুন বাণী দিচ্ছেন তাঁরা, কখনও তাঁদের দাবি – নবরাত্রের ন’দিনে নন ভেজ বন্ধ করে দেওয়া হোক, কখনও বক্তব্য – সারা দেশেই গোহত্যা বন্ধ করা হোক, কারণ কোনও ধর্মগ্রন্থেই গরু মারার কথা লেখা নেই।

গোহত্যা সংক্রান্ত কোনও কেন্দ্রীয় আইন নেই। এক এক জায়গায় এক এক রকমের নিয়ম। পশ্চিমবঙ্গে যেমন সার্টিফিকেট পাওয়া গরু হত্যা করা লিগাল। তেমনি উত্তর পূর্বের রাজ্যসমূহ, কেরালা ইত্যাদি রাজ্যে কাউ স্লটার বা বীফ – কারুর ওপরেই কোনও রকমের নিষেধাজ্ঞা নেই। আর গরু কেবল মুসলমানরা খায় – এমন কথা যাঁরা ভাবছেন, তাঁরাও ভুল ভাবছেন, ভারতকে তাঁরা চেনেন না। এই ভারতেই প্রছুর প্রদেশে হিন্দুরা দিব্যি গরু খায়। অনেক রাজ্যে হিন্দু ব্রাহ্মণরা নিরামিষাশী হন, কিন্তু অব্রাহ্মণরা আমিষ দিব্যি খান। পশ্চিমবঙ্গে আর কাশ্মীরে ব্রাহ্মণরাও আমিষাদি খান। ধর্মের সঙ্গে এর একেবারেই কোনও যোগাযোগ নেই। মাংস খাওয়া বা না খাওয়া, নিতান্তই রাজ্যভিত্তিক কালচার। উত্তর প্রদেশেই – গোহত্যা নিষিদ্ধ, গোরুর মাংস বিক্রি করাও নিষিদ্ধ, কিন্তু খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। যার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিক্রয়জাত বীফের সর্বাধিক পরিমাণের ক্রেতা এই উত্তরপ্রদেশই। কোনও ধর্মগ্রন্থেই ডালভাত মাছেরঝোল খাবারও নিদান দেওয়া নেই বলেই জানি, তা হলে কি এবার হিন্দুত্ববাদীরা এইসবও ব্যান করে দেবার দাবি তুলবেন?

সরকারিভাবে না হলেও, চোরাগোপ্তা বিভিন্ন ভাবে এই বীফ খাওয়া ব্যাপারটাতে সেনসেশন গড়ে তোলা হচ্ছে। এই রবিবার দিল্লির অশোক রোডে বিজেপির সদর দফতরের সামনে একটি প্রতিবাদ আয়োজন করেছিলেন গৌরব জৈন, বীফ ফেস্টিভাল। কেরালাতে ইতিমধ্যেই এই ধরণের ফেস্টিভাল আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু দিল্লি পুলিশ ওঁত পেতে ছিল। গৌরবকে তুলে নিয়ে যায় পার্লামেন্ট স্ট্রীট থানায় এবং সেখানে প্রচুর দুর্ব্যবহার এবং হ্যারাসমেন্টের পর রাতের দিকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় – বীফ ফেস্টিভাল শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। গৌরবের সাথে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় স্ক্রোল ডট ইন পত্রিকার এক সাংবাদিককেও, তাঁর রিপোর্ট থেকেই আমরা জানতে পারি পুলিশ ওই ফেস্টিভালের ফেসবুক ইভেন্টের প্রতিটা প্রোফাইলের ওপর নজর রাখছে। থানায় বসে ধমক চমকের সময়ে পুলিশদের বক্তব্য ছিল “বাবা মা কি তোমাদের এইসব শিখিয়েছে? কারুর অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া?’

পুলিশ সাতজনকে ধরেছে, দাদরির খুনের ঘটনায়। আরও তিনজন এখনও অধরা। প্রায় প্রত্যেকের সাথে বিজেপির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই সঙ্গীত সোম এসে সংগীত শুনিয়ে গেছেন – বন্দী যুবকদের ছাড়িয়ে আনার জন্য তিনি যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন। এই সঙ্গীত সোম, বিজেপির মুজফফরনগর এলাকার নেতা, গত বছরের কুখ্যাত মুজফফরনগর দাঙ্গার মূল হোতা। মহেশ শর্মা কিনা মন্ত্রী, তিনি তাই সরাসরি আইন হাতে তুলে নেবার কথা বলতে পারেন নি, তবু খুনী ছেলেগুলোর জন্য তাঁরও প্রাণ কাঁদছে, তিনি জানিয়েছেন, কী এমন দোষ করেছিল ওরা? মৃত বৃদ্ধের বাড়িতে একটা সতেরো বছরের ডবকা মেয়েও তো ছিল, তার গায়ে তো একটা আঙুলও লাগায় নি কেউ! জাস্ট বুড়ো বাপটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। এর জন্য কি ওদের জেল খাটানো উচিত?

বেশ ভালো লাগছে, বক্তব্যগুলো শুনতে। কেমন মুখোশছাড়া মুখ দেখা যাচ্ছে আস্তে আস্তে। মুখগুলো আমাদের আশেপাশেই ছিল, এতদিন চিনতে পারি নি। আর এঁরা তো নেতামন্ত্রী, এঁদের চিন্তাভাবনা বিচারই আলাদা, সাধারণ লোকজন, আমার পরিচিত মহলেই আস্তে আস্তে কিছু মানুষের যে রূপ দেখছি, তাতে আচ্ছে দিন যে আর খুব বেশি দূরে নেই, বুঝতে পারছি। আন্দাজ করেছিলাম, এ রকমই হবে। মুজফফরনগর, দাদরি হয়ে পরের স্টেপ যে দিল্লিতেই পড়বে, এ বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। ঘাড়ের কাছে হিন্দুত্বের গরম নিশ্বাস অনুভব করছি।

মহেশ শর্মারা শুধু সংসদেই বসেন না, তাঁরা বসেন সুপ্রিম কোর্টে, গুরগাঁওয়ের মাল্টিন্যাশনালে, গাজিয়াবাদের হাউসিং সোসাইটিতে। আমাদের আশেপাশেই থাকেন, ঘোরাঘুরি করেন। চোখকান খুব খোলা রেখে চলতে হচ্ছে আজকাল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হচ্ছে। মুখ আর মুখোশের তফাতটা সময় থাকতে ধরে ফেলাটা খুব দরকার। খুব।


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.