গৌরব জৈন, ৪ঠা অক্টোবর বীফি পিকনিক ইভেন্টের উদ্যোক্তা,তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতা লিখেছেন www.thequint.com ম্যাগাজিনে। সেখান থেকে সরাসরি অনুবাদ, গৌরবের অনুমতি সহ।
আপনার যদি ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টের মধ্যে দু-তিনজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকে, তা হলে আপনি অবশ্যই জানবেন ১১, অশোকা রোড, ভারতীয় জনতা পার্টির সদর দফতরের সামনে গত রোববারের বীফি পিকনিকের কথা।
কিন্তু একটা পিকনিক নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটা আরও সহজ, উত্তর আছে পিকনিকের মেনুতে – বীফ। গরুর মাংস। সম্প্রতি বীফ-এর নাম শুধু খাবার জিনিস হিসেবে পরিচিতির বাইরেও ছড়িয়েছে। এটা এখন মানুষ মারার একটা অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার শেষতম সংযোজন হল দাদরিতে নিজের গ্রামবাসীদের হাতে বৃদ্ধ মহম্মদ আখলাকের খুন হবার ঘটনা, ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে। ঘটনাস্থল, দিল্লি থেকে খুব বেশি হলে ৬০ কিলোমিটার দূরে।
খবরটা পড়ে আমার মনে ভয় জেগেছিল। গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কী ভাবে একজন মানুষকে মেরে ফেলা যেতে পারে, আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। একটি প্রাণী, যাকে কিনা কিছু মানুষ নিজেদের “মা” মনে করে – তার প্রাণ কীভাবে একজন মানুষের প্রাণের থেকে মূল্যবান হয়ে যেতে পারে?
আর তার থেকেও বড় আশ্চর্যের কথা হল – পুলিশ নাকি আখলাকের বাড়ির ফ্রিজ থেকে সেই মাংস তুলে নিয়ে গেছে ফরেনসিক টেস্ট করার জন্যে! কী জন্য? এই গরু-উপাসক, উগ্র জাতীয়তাবাদী জাতির একটা বর্বর কীর্তিতে বৈধতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য?
শুধু এতেই শেষ হয় নি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত, তথাকথিত শাসকদল – বিজেপির নেতারাও এই হত্যাকাণ্ডকে লঘু করে দেখানোর প্রয়াসে তাঁদের ভয়ঙ্কর বয়ানবাজি শুরু করে দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডটির তাঁরা নাম দিয়েছেন “দুর্ঘটনা” – যা নাকি নিছক সন্দেহের বশে হওয়াটা “উচিত হয় নি”।
নিহত আখলাকের মেয়ে, গ্রামের বাড়িতে।
নেতাদের বক্তব্যে সেই প্রতিবাদ আমি দেখতে পেলাম না, পেলাম না যন্তর-মন্তর স্টাইলের কোনও ধর্ণাবাজিও। তাই ভাবলাম, আমিই কিছু করি। আমি খুব জোরে চীৎকার করে জানাতে চাইছিলাম আমার মৌলিক অধিকার কারুর ব্যক্তিগত মানসিকতা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতির লক্ষ্য হতে পারে না। আমি কী খাবো সেটা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। আমার পরিণতি আখলাকের মত হোক – আমি চাই না।
আমি শুক্রিবার রাতের দিকে ইভেন্টটা বানালাম এবং আমার বন্ধুদের মধ্যে ৪০-৫০ জনকে বীফি পিকনিকে নেমন্তন্ন করলাম। রবিবার, বিজেপি অফিসের সামনে। এটা ছিল একটা BYOB স্টাইলের পিকনিক – ব্রিং ইওর ওন বীফ। পরদিন সকালে আমি অবাক হয়ে গেলাম প্রতিক্রিয়া দেখে এবং ইভেন্ট শেয়ারিং-এর সংখ্যা দেখে। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে এক বিশাল পরিমাণ রেসপন্স মিলেছিল। রবিবার আমি যখন পিকনিকে যোগ দেবার জন্য বেরোচ্ছি, তখনও পর্যন্ত ইভেন্টটা ১,৪০০ জনের কাছে শেয়ার হয়েছে আর ৩০০ জন “গোয়িং” সিলেক্ট করেছে।
আমি হেসে ফেলেছিলাম কারণ ভার্চুয়ালি “যাওয়া” আর সত্যিকারের যাওয়ার মধ্যে তফাতটা আমি জানতাম। আসলে আমার কাছে ওখানে যাওয়াটা জরুরি ছিল কারণ ভার্চুয়াল প্রতিবাদের সবসময়ে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া হয় না, যতটা সঠিক জায়গায় নিজে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানালে হয়।
শুরু না হতেই থামা
পিকনিকের দিনে আমি আমার বন্ধু গায়ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলাম আইএনএ মার্কেটে, “বীফ” কিনতে। মজার ব্যাপার হল রেস্তোরাঁর মেনুতে সব জিনিসের নাম ইংরেজিতে লেখা ছিল – বীফ বাদে। বীফ কথাটা লেখা ছিল স্থানীয় ভাষায়।
প্যাটেল চক মেট্রো স্টেশনের সামনে – যেখান থেকে আমাদের হেঁটে বিজেপির অফিসের দিকে যাবার ছিল – সিকিওরিটির ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মত। বীফ সঙ্গে নিয়ে কারুরই সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার জো ছিল না। যদিও কোনও চেকিং ছাড়াই আমি সেখান দিয়ে দিব্যি বেরিয়ে গেলাম, কী করে সে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।
একজন সাংবাদিক আমার সাথে চলতে শুরু করলেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই। আমরা তিনজন হলাম – ঠিক যতজন “গোয়িং” সিলেক্ট করেছিল, তার ১%।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি ঠিক জানি না কতজন শেষমেশ এসেছিল, কারণ মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোবার ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় সাংগ্রি-লা হোটেলের সামনে আমাদের দাঁড় করালেন পার্লামেন্ট স্ট্রীট থানার SHO, যিনি আমাদের আসার “খবর” পেয়েছিলেন একজন ইনফর্মারের কাছ থেকে।
ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা, ফোন ছাড়া
পুলিশের গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পার্লামেন্ট স্ট্রীট পুলিশ থানায়; ঠিক গ্রেফতার করে না, ধরে নিয়ে যাওয়া হল। ধরে নিয়ে যাবার পরে পুলিশ অফিসার প্রথম যে কাজটি করলেন, সেটি হল আমার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেওয়া। সাত ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয়েছিল আমাকে – তার মধ্যে আমার আইনজীবি বা বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাকে একবারও কথা বলতে দেওয়া হয় নি।
আমার ব্যাগ থেকে সফলভাবে একবাক্স “বীফ” উদ্ধার করবার পরে সেই অফিসার এবং তাঁর সিনিয়র আমার বিরুদ্ধে বীফ রাখা এবং খাওয়ার কেস লাগাতে উদ্যত হলেন (এই অপরাধে জামিন-অযোগ্য ধারায় পাঁচ বছরের জেল হয়)। তাঁরা আমার নামে ভারতীয় পেনাল কোডের আরও কিছু ধারা, যেমন, দাঙ্গায় প্ররোচনা, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ, ইত্যাদি ধারায় কেস দিতে উদ্যত হলেন।
এক থেকে দুই ঘন্টা তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল, আমার থেকে উদ্ধার করা জিনসটা “বীফ” কিনা, সেটা এক্সপার্টদের তরফে কনফার্ম করার জন্য। কিন্তু কোনও এক্সপার্ট পাওয়া গেল না। অবশেষে তাঁরা সেই রেস্টুরেন্টে ফোন করলেন যেখান থেকে আমি ওটা কিনেছিলাম – তারা জানাল, ওটা বীফ নয়, “বাফ” অর্থাৎ মোষের মাংস ছিল।
আইনি প্রক্রিয়ায় আমার বিরুদ্ধে কোনও ধারা লাগানো যাবে না দেখে তাঁরা এইবারে নীতি-জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, “তুমি জৈন হওয়া সত্ত্বেও এমন নোংরা জিনিস খেতে পারো কী করে?’ ‘তোদের মতন লোকেদের পাকিস্তানে যাওয়া উচিত’, ইত্যাদি।
আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা পুলিশের মূল কাজ, যদিও আমার জানা নেই গ্রেফতার না করে কাউকে “ধরে রাখার” (একজন মহিলা এবং একজন সাংবাদিক সহ) আইনী অধিকার তাদের আছে কিনা – এত ঘন্টা ধরে কোনও কমপ্লেন্ট না লিখে, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে রেখে দিয়ে, কোনও রসিদ ছাড়াই। একটা পিকনিককে “দাঙ্গা” বানিয়ে দেবার ক্ষমতা দেখানো কি পুলিশের পক্ষে খুব বাড়াবাড়ি নয়?
সত্যিই কি প্ররোচনা ছিল?
কেউ কেউ বলছেন আমার অ্যাপ্রোচ সঠিক ছিল না। চোখের বদলে চোখ সারা দুনিয়াকে অন্ধ করে দেয়। হ্যাঁ, দাদরির ঘটনার প্রেক্ষিতে ওঠা বিরুদ্ধ মতকে আমি স্বাগত জানাই, কিন্তু আমার মনে হয় না আমার প্রতিক্রিয়াটা ঠিক “চোখের বদলে চোখ” ছিল। বরং আমি জানাতে চেয়েছিলাম – “এই যে, এইখানে আরো একটা চোখ আছে – পারো তো এটাকেও অন্ধ করে দাও, কিন্তু আমি আমার দেখা থামাব না”।
একদিকে যেমন আমি কিছু বিচ্ছিন্ন রাইট-উইং এলিমেন্টের থেকে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য পেয়েছি, অন্যদিকে হাজারে হাজারে সমর্থন পেয়েছি এই ইভেন্টের সমর্থনে এবং ইভেন্ট যে কারণে এই ইভেন্ট করতে চেয়েছিলাম, সেই কারণের সমর্থনে। এটাও আমার ভালো লেগেছে যে মিডিয়া এই কারণটাতে ফোকাস করেছে – কতজন এসেছিল শেষ পর্যন্ত – সেটায় ফোকাস না রেখে।
আমি আশা রাখি এই বীফি পিকনিক আরও বেশি বেশি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হবে, প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে। বীফ নিয়ে এই অন্যায়, অনৈতিক এবং অহেতুক উগ্রতার চর্চা বন্ধ হওয়া দরকার। এটা ভারতের লাখ লাখ মানুষের খাবার, হিন্দুরাও খায়। বীফ খাওয়া নিয়ে কোনও ঘেন্না বা অসহিষ্ণুতা ছড়ানো উচিত নয়। খাবার ভাগ করে খেলে যে ভালোবাসার প্রকাশ পায়, সেই ভালোবাসার প্রকাশ ঘটুক।
==========================
মূল লেখার লিঙ্কঃ http://www.thequint.com/opinion/2015/10/06/you-deserve-pakistan-police-tell-organiser-of-beefy-picnic