একটি অতিসাধারণ ভ্রমণকাহিনি – তৃতীয় পর্ব

পর্ব ১ আর পর্ব ২-এর পরে

জ্ঞানবাপী চিনেন? জ্ঞানবাপী? আমার লোগ থাকবে উখানে। নীল শার্ট। মনোহর। সি আপনাকে চিনে নিয়ে আসবে।

আজ আমরা যে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দেখি, সেটা এমন কিছু প্রাচীন নয়। আসল, আদি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির অনেকবার ভেঙেছে আর গড়েছে। জ্ঞানবাপীর উল্লেখ কেন করলাম, সেটা বলছি একটু পরে। অবিশ্যি, আপনারা জ্ঞানীগুণী মানুষ, আপনারা সবই জানেন। তাও একটু বলি।

অজ্জিনাল মন্দিরটি সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে। আর আজ যে মন্দিরটি আমরা দেখতে পাই, সেটি তৈরি করেছিলেন অহল্যা দেবী হোলকার, ১৭৭৭ সালে। বারাণসীর আরেকটি বিখ্যাত মন্দির, কালভৈরবের মন্দির, তৈরি করে দেন শ্রীমন্ত বাজীরাও পেশোয়া, ১৮৫২ সালে।

তখন ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল। তিনি দিল্লি থেকে যাচ্ছেন বাংলায়, নদীপথে। সঙ্গে কতিপয় হিন্দু রাজা ও তাঁদের পরিবার। রাজাদের অনুরোধে সম্রাট একদিনের হল্ট দেন বারাণসীতে, যাতে রাজা এবং রাণীরা গঙ্গায় চান করে পবিত্র হতে পারেন এবং পুজো ইত্যাদি করতে পারেন।

পুজো সেরে সবাই ফিরলেন, কেবল এক রাণী ফিরলেন না। সেই রাণীকে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেল না। খবর যখন ঔরঙ্গজেবের কানে এসে পৌঁছলো, তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে লোক পাঠালেন চারিদিকে খুঁজতে। তারা খুঁজতে খুঁজতে বের করল, মন্দিরের গায়ে একটি সুন্দর কাজ করা গণেশমূর্তি, আসলে দেওয়ালে প্রোথিত নয়, চাপ দিলে সেটা সরে যায়। … সরানো হল গণেশমূর্তি, দেখা গেল সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। মন্দিরের নিচে। সেইখানে পাওয়া গেল হারিয়ে যাওয়া রাণীকে, তাঁর সম্মানহানি হয়েছে, তিনি বসে বসে কাঁদছেন।

এই ভয়ঙ্কর অপরাধের খবর পেয়ে ঔরঙ্গজেব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। যতই পাঁড় চাড্ডি হোন, আফটার অল রাজা রাণীরা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন, তাঁদের সুরক্ষাহানি সম্রাটের উপস্থিতিতে, সম্রাট সেটা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি হুকুম দেন, মন্দির মাটিতে মিশিয়ে দেবার।

… অনেক গল্পকথা প্রচলিত এই মন্দির ধ্বংস নিয়ে, তার মধ্যে এটাও একটা। এর কোনও ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, যে যেমন পেরেছে গল্প বানিয়েছে। ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট শুধু এটুকুই – কাশী বিশ্বনাথের মন্দির ঔরঙ্গজেবের আদেশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। মাসির-ই-আলমগীরি, ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রামাণ্য দলিলে স্পষ্ট লেখা আছে, ৯ই এপ্রিল ১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেবের আদেশে এই সুপ্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লিখিত হুকুম দেন সমস্ত রাজ্যের মন্দির এবং স্কুল – যেগুলো কাফেরদের দ্বারা পরিচালিত, সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার। এবং সেই লিস্টে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরও ছিল।

জ্ঞানবাপী এই মন্দির প্রাঙ্গণেই অবস্থিত। বাপী মানে কুয়ো। কথিত আছে, প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দিরের যে শিবলিঙ্গ, সেটিকে উপড়ে ফেলে এই কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সেই লিঙ্গ নাকি আজও কুয়োর মধ্যে রয়েছে। মোটামুটি ১৬৬৯ সালের আগস্ট মাসে এই ধ্বংসের কাজ সম্পন্ন হয়। যেখানে মন্দিরটি ছিল, সেটাকে ভেঙে মাঠ করে ফেলে সেখানে একটি মসজিদ বানানো হয়। জ্ঞানবাপী আসলে এখন একটি মসজিদ, সেই কুয়ো সমেত। এর একদিকের দরজা এখনও সেই প্রাচীন মন্দিরের দরজার সাক্ষ্য বহন করছে, যদিও আমজনতা তা দেখতে পায় না। অনেক পরে, ঔরঙ্গজেব মারা যাবার পরে এই মসজিদের গায়ে লাগোয়া মন্দিরটি, সেটা আজ লোকে দেখতে পায়, তৈরি করেন অহল্যা দেবী হোলকার। এই মন্দির তৈরি করার সময়েও যথেষ্ট কম্যুনাল টেনশন তৈরি হয়েছিল, মন্দিরে গরুর মাংস এবং মসজিদে শুওরের মাংস ছোঁড়া হয়েছিল, যার ফলে শুরু হওয়া দাঙ্গায় কয়েকশো লোকের প্রাণ গিয়েছিল বেনারসে। শেষমেশ দুই তরফেরই শুভবুদ্ধির জয় হয়, এবং মন্দির আর মসজিদ, আজ একই পাঁচিলের এদিক ওদিক করে বিরাজ করছে।

মন্দির হম ওঁহি বনায়েঙ্গে – বলে যে বাঁদরের দল আদবানি আর বাজপেয়ীর কথায় নেচে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল, তারা বারাণসীতেও এসে এই জ্ঞানবাপী মসজিদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে মন্দিরের পরিসর বাড়ানোর তালে ছিল, কিন্তু বারাণসীর মানুষ এখানে অযোধ্যা রিপিট হতে দেন নি। আজও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অ্যাজেন্ডায় আছে এই মসজিদ ভাঙা, তবে তারা কবে সফল হবে, এখনই বলে যাচ্ছে না।

********

পৌনে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। মঙ্গল পাণ্ডে আসবেন আমাদের নিতে, তাই তৈরি হতে হবে। চোখে তখন সর্ষেফুল দেখছি। ঘুম কমপ্লিট হয় নি। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। সোয়া পাঁচটায় গাড়ি আসার কথা। সিকিনী আর ভূতোকে তৈরি হবার সময় দিয়ে আমি নিচে নেমে এলাম। কিন্তু কোথায় গাড়ি?

মঙ্গল পাণ্ডের ফোন নাম্বার ছিল, পাঁচটা কুড়ি নাগাদ ফোন লাগালাম। তিনি জানালেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছেন, গাড়ি এখন চৌকা-ঘাট পেরোচ্ছে।

সত্যিই পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি চলে এল। গাড়ির সাইডে লেখা এনডিআরএফ, আর সামনে লেখা, পুলিশ। সিকিনীর “ভেতর থেকে” ব্যবস্থা করিয়ে দেবার ফলে এনডিআরএফের একজন কনিষ্ঠবল সকালবেলায় এসেছেন আমাদের রিসিভ করতে। ততক্ষণে সিকিনী আর ভূতোও চলে এসেছে, আমরা গাড়িতে চেপে বসলাম। ক্যামেরা হোটেলেই রেখে এসেছি, কারণ মন্দিরে ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ।

ভোরবেলা গাড়িঘোড়া একটু কম, তবে গোধূলিয়া মোড়ে এসে দেখলাম বেশ জমজমাট ব্যাপার। অনেক বড় বড় বাস এসে দাঁড়িয়ে আছে এই ভোরবেলাতেও, প্রচুর পুণ্যার্থী সমাগম হয়েছে আর কি। আগের দিন আমাদের ব্যাটারি-রিক্সা এই মোড়েই নামিয়ে দিয়েছিল, আজ পুলিশের গাড়ি বাঁদিকে টার্ন নিয়ে ঢুকে গেল খানিকটা। একেবারে মন্দিরের গেটে এসে দাঁড়াল গাড়ি। পাণ্ডেজি আদেশ দিলেন – জুতো খুলে, পার্স রেখে তবে নামতে। কারণ মন্দিরে নাকি ওসব কিছুই অ্যালাওড নয়। – সে হতেই পারে। বেশির ভাগ হিন্দু মন্দিরেই এইসব নিয়ম হয় টয়। সিকিনীর পরামর্শমত দুশো টাকা পকেটে নিয়ে পার্স মোবাইল জুতো গাড়িতে ছেড়ে নামলাম খালিপায়ে।

মন্দিরের সামনে সাতখানা পুলিশ, উদ্যত কারবাইন এলএমজি নিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা মেটাল ডিটেক্টর গেট লাগানো, সেইখান দিয়ে সারা ভারতবর্ষ ঢুকছে মন্দিরে। লিটারেলি সারা ভারতবর্ষ। বাঙালি গুজরাটি তামিল রাজস্থানী – কে নেই সেই লাইনে। গেট দিয়ে ঢুকছে, তারপরে পুলিশ তাদের গায়ে থাবড়ে থাবড়ে চেক করছে, তারপরে মেটাল ডিটেক্টর ডাণ্ডা বুলোচ্ছে, তারপরে যেতে পারছে। পাণ্ডেজি গিয়ে কারবাইনধারী পুলিশের কাছে গিয়ে আমাদের দেখিয়ে কী সব বললেন, আমরা সাড়ে তিনজন পাশ দিয়ে সুট করে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের পরিসরে, চেকিং ছাড়াই।

লাইন ভেতরে চলে গেছে সর্পিল ভাবে। আমরা লাইনের পাশ দিয়ে দিয়ে এগোতে থাকলাম। ভেতরে বেশ কিছু দোকান, সবাই পুজোর ডালি বিক্রি করছে, ফুল, বেলপাতা, আর প্লাস্টিকের গ্লাসে করে দুধ টাইপের একটা জিনিস, প্রসাদী দুধ বোধ হয়, কিরম হাফ চন্নামেত্ত হাফ দুধ টাইপের দেখতে। ও হ্যাঁ, আর মিষ্টির বাক্সও ছিল ডালিতে। পাণ্ডেজি আমাদের দাঁড় করিয়ে তিন খানা ডালি কিনলেন, একটি নিজের জন্য, বাকি দুটি আমাদের দুজনকার জন্য।

খেলতে নেমে ঘোমটা দেবার মানে হয় না। নিলাম, নিয়ে এগোলাম। লাইন ডানদিকে বেঁকে গেছে। সামনেই একটা পেল্লায় সিংদরজা, কাঠের, বন্ধ। এখানেও চারজন পুলিশ বসে আছে। পাণ্ডেজি আবার পুলিশদের গিয়ে কী বললেন, পুলিশ একগাল হেসে আমাদের জন্য দরজা খুলে দিল। ভিআইপি গেট। ঢুকতেই একটা সরু চাতাল, তাতে একদিকে সারিসারি মন্দির, সেই মন্দিরের সিরিজের শেষে একটা বড় চাতালওলা মন্দির, বেশ কারুকার্য করা, ওপরটা পেতল মোড়া। এটাই আসল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। পুণ্যার্থীদের লাইনটা আমাদের পাশ দিয়ে মন্দিরের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে ঢুকছে, আর আমাদের সামনেই মন্দিরের যে দরজা, সেইখান দিয়ে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসছে একে একে। আমি দেখতে পেলাম, দরজার ঠিক ভেতরেই একটি ঘেরা জায়গা, সেইখানে লোকে ফুল-বেলপাতার ডালি উপুড় করে দিচ্ছে, আর রেলিং-এ মাথা রেখে কী কী সব প্রার্থনা করছে, দেড় সেকেন্ডের মধ্যেই একটা পুলিশ তার হাত কিংবা ঘাড় ধরে টেনে আমাদের সামনের দরজাটা দিয়ে বের করে দিচ্ছে।

মঙ্গল পাণ্ডে জানালেন, চূড়াটা সোনার তৈরি। আসল সোনা। … লে হালুয়া। এটা সোনা? এমন ম্যাড়মেড়ে? (পরে গুগল করে দেখলাম, এই সোনার চূড়াটা বানিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহ। কে জানে, ভেজাল মিশিয়েছিলেন কিনা!)

ঘাড়ধাক্কারত পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলেন পাণ্ডেজি। এইবারে পুজোর ডালি নিয়ে আমিও এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, তিনি পুলিশকে বলছেন, ইয়ে ডিআইজি সাব কে রিশতেদার আয়ে হুয়ে হ্যাঁয়, ইনকো জলদি নিকালনা হ্যায়।

বিশ্বাস করুন, আমার রিশতায় খানদানে কখনও কোনও ডিআইজি সাব নেই, ছিলেনও না। পাতি ঢপ মেরে আমাদের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন, আর আমি দেখলাম রেলিং-ঘেরা জায়গার মাঝে ওই দুধ-টাইপের লিকুইডের একটা মিনি পুকুর হয়ে আছে, তাতে ভাসছে ডাঁই করে ফুল আর বেলপাতার দল, তার মাঝে জেগে রয়েছে এত্তটুকু একটা শিবলিঙ্গ। এইখানে পুজো দিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। আর প্রসাদের প্যাকেটটা একবার ঠেকিয়ে নিতে হয়।

লোককে ফুল বেলপাতা উপুড় করে ফেলতে অবজার্ভ করেছি – কিন্তু দুধের গ্লাসটা কী করে – সেটা তো দেখি নি। লাইনকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে ডিআইজি সাবের রিশতেদারদের জন্য, যা করার আমাদেরকেই করতে হবে, অন্য কাউকে দেখে কপি করারও উপায় নেই। আমি ডালি উপুড় করে ফুল বেলপাতা ঢেলে দিলাম, গ্লাসটাও উপুড় করে ওখানেই ফেলে দিলাম, শিবলিঙ্গের একেবারে ওপরে। আমার দেখাদেখি সিকিনীও তাই।

রেলিং-এর ভেতরে বসে ছিলেন এক পুজারী মহন্ত টাইপের কেউ। তিনি তো খেপে বোম – গিলাস য়ঁহা নেহি ফেকতে, ইয়ে তো থোড়াসা ডালকে বাকি পীনে কে লিয়ে হ্যায়, বলে গ্লাসদুটো তুলে সাইডে সরিয়ে দিলেন। পাণ্ডেজি একটু হতভম্ব হয়ে বললেন – আপনারা পুরো গ্লাস ঢেলে দিলেন কেন, ওটা তো বাবাজির প্রসাদী দুধ, ভাঙ মেশানো, ওটা তো খেতে হয় –

পাগল নাকি! কী দিয়ে বানানো কে জানে, এখন আমায় সারাদিন ড্রাইভ করতে হবে, আমার সাতসকালে ভাঙ খেতে বয়ে গেছে। হেঁহেঁ করে হেসে বেরিয়ে এলাম দরজা দিয়ে। পাণ্ডেজি এইবারে নিয়ে চললেন মন্দিরের পাশের একটা গলি দিয়ে – কাশী বিশ্বনাথকে দর্শন করার পরেই নাকি অন্নপূর্ণা মাতার দর্শন করতে হয়। এগোলাম। এখানেও লম্বা লাইন, আমরা লাইনের বাইরে দিয়েই হেঁটে এলাম। গলির শুরুতেই দেখলাম লেখা আছে – কাশী বিশ্বনাথ গলি।

বিশ্বনাথ মন্দিরেও ছিল শ্বেতপাথরের চাতাল, অন্নপূর্ণা মন্দিরেরও সিঁড়ি শ্বেতপাথরের, তার স্টেপে স্টেপে লেখা নাম, বিভিন্ন ডোনারের নাম, প্রথম ধাপেই দেখলাম লেখা আছে – (নাম মুছে গেছে) রক্ষিত, চন্দননগর। বাংলায়। আশেপাশে অনেক জায়গাতেই নোটিস হিন্দি আর ইংরেজির সাথে বাংলায় লেখা। সেখানে মাথা নুইয়ে নমো করলে পুরুতমশাই একমুঠো চাল দেন। এইবারে সেই চাল আঁচলের খুঁটে (অভাবে ওড়নায়) বেঁধে বাড়ি নিয়ে ঘরের চালের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হয়, তা হলেই নাকি মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে ঘরে কখনও ভাতের অভাব হয় না।

সবই পাণ্ডেজি বলে দিলেন, তাই জানলাম। নইলে আমার আঁচলও নেই, ওড়নাও নেই। সিকিনী চাল নিল হাতের মুঠোয়, নিয়ে রুমালে বেঁধে নিল। এইবারে বেরিয়ে আসার পালা। বেরোবার মুখে সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে পাণ্ডেজি বললেন, ঐখানে নন্দীজি বসে আছেন, ওঁর কানে মুখ ঠেকিয়ে মনস্কামনা জানালে সে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। তাকিয়ে দেখি, একটা গরুর মূর্তি, কালো রঙের। দুজন মহিলা এক এক করে সেই গরুর গলা জড়িয়ে ধরে কানে মুখ ঠেকিয়ে কী সব বলে যাচ্ছেন। পাণ্ডেজি খুব ইনসিস্ট করলেন ঐভাবে নন্দীজির কানে মনস্কামনা জানাতে, কিন্তু আমরা দুজনেই কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম – আমাদের তেমন কোনও মনস্কামনা নেই। পাণ্ডেজি একটু ক্ষুণ্ণ হলেন অবিশ্যি, কিন্তু আমরা ডিআইজি সাবের রিশতেদার বলে কথা, কিছু বললেন না।

একই রাস্তা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। বেরোবার মুখটা অবশ্য আলাদা, বাঁদিকে একটা পাঁচিল, তার সামনে ইয়া উঁচু উঁচু লোহার গরাদ বসানো। পাণ্ডেজি বললেন, এইটা একটা মসজিদ, এখানে এন্ট্রি নিষিদ্ধ। বুঝলাম, এর জন্যেই এত পুলিশ, এত কারবাইন, এত সুরক্ষা, আর এত গরাদ। এই সেই জ্ঞানবাপী মসজিদ।

গাড়িতে চেপে বসে জুতো পরলাম, পার্স পকেটে ঢোকালাম, এবং দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি আমাদের হোটেলের দরজায় পৌঁছে দিল। ঘড়িতে দেখি ছটা চল্লিশ বাজে। তুমুল তাড়াতাড়ি হল তো! এমনিতে শুনেছি এখানে “দর্শন” করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিতে হয় টয়। মঙ্গল পাণ্ডের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে খুব ধন্যবাদ জানালাম এমন দ্রুত দর্শন করিয়ে দেবার জন্যে।

হোটেলের ক্যান্টিনে হাল্কা স্ন্যাক্স এবং কফি খেয়ে রাস্তায় নামলাম যখন, তখন সাড়ে সাতটা বাজে। শক্তিগড়ে কোনওভাবেই সন্ধ্যের আগে পৌঁছনো আর সম্ভব নয়, তাই আগেই কোথাও লাঞ্চ করতে হবে। কাল সারাদিন লেগেছে শুধু উত্তর প্রদেশ কভার করতে, ইউপির পশ্চিমতম প্রান্ত থেকে শুরু করে আটশো কিলোমিটার পেরিয়ে আজ আমরা ইউপির পূর্বতম প্রান্তে। আজ আমরা পেরোব তিনটে রাজ্য। বিহার, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গ।

তার মধ্যে আজ আবার বিহারে কাউন্টিং। নীতিশ কুমার বনাম নমো।

ঠিক আটটায় আমরা ইউপি পেরিয়ে বিহারে ঢুকে গেলাম। সুপার স্মুথ রাস্তা, জায়গায় জায়গায় টোল দেওয়া ছাড়া আর কোথাও দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই। একে একে পেরিয়ে গেলাম সাসারাম, ডেহরি-অন-শোন, ঔরঙ্গাবাদ। হাজারিবাগের কাছে যখন আমরা বিহার পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডে ঢুকছি, তখন বাবার ফোন এল – বিহার ইলেকশনের ফল বেরিয়েছে, নীতিশ কুমারের জোট বিশাল মার্জিনে এগিয়ে, নরেন মোদী ধুয়েমুছে সাফ। বললে হবে? পুউরো কাউন্টিং-এর সময়টা আমি বিহারের রাস্তায় ছিলাম।

dsc_0242

ঝাড়খণ্ড বড় মায়াবী জায়গা। যেমনি এখানকার ন্যাচারাল বিউটি, তেমনি সুন্দর সুন্দর নাম। ঝুমরি তালাইয়া, কোডারমা, মধুপুর, এইসব নাম দেখছি এদিক ওদিক বোর্ডে, আর দূরে দেখছি হাল্কা ঢেউখেলানো ছোটছোট পাহাড়ের সারি, রাস্তার দুধারে তালগাছের সারি, আর নাম-না-জানা অসংখ্য ফুল। রাস্তাও চলেছে ঢেউ খেলিয়ে, কখনও উঁচু, কখনও উতরাই। ছোটনাগপুরের মালভূমি। আপনারা যারা ড্রাইভ করতে ভালোবাসেন, একবার অন্তত ঝাড়খণ্ডের রাস্তায় ড্রাইভ করবেন, মন খুশ হয়ে যাবে।

dsc_0244dsc_0247

দুপুর দুটোর পরে, বারাণসী থেকে ঠিক তিনশো বাহান্ন কিলোমিটার চলার পরে আমরা পৌঁছলাম গিরিডি। তিলুবাবুর বাড়ি এখানে। অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর সঙ্গে তো দেখা হল না, কিন্তু আমরা দেখলাম রাস্তার ধারেই একটা ছোট রিসর্ট টাইপের বিল্ডিং। গাড়ি ঢোকালাম সেখানে, নুডলস আর কী কী যেন অর্ডার করেছিলাম। খুবই নমিনাল দাম, কিন্তু অসাধারণ টেস্ট। তেমনি টেস্টি জল। অশোক ইন্টারন্যাশনাল না কী যেন নাম, কার্ডটা রেখে দিয়েছি, সবাইকে রেকো করলাম, এইখানে লাঞ্চ করবেন। চারদিকে ফাঁকা জমি, একটু দূরেই একটা ন্যাড়া পাহাড়ের টিলা, আর এদিক ওদিক তাল খেজুরের গাছ। সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য, কী বলব।

খেয়ে উঠে তিনটে নাগাদ আবার স্টার্ট করলাম। এর পরে এল তোপচাঁচি। এইখানে একটা মজার জিনিস দেখা যায়, আমি ট্রাভেলগে পড়েছিলাম, এইবারে দেখলাম।

তোপচাঁচি টাউনে আসার একটু আগে, রাস্তার দুধারে সারিসারি দোকান। সেই দোকানে বিক্রি হচ্ছে, তলোয়ার। ঢাল, তলোয়ার, ছোরা, চাকু, নেপালা, চাপাতি, ভোজালি, কুঠার, আর, আর, বিভিন্ন সাইজের খেঁটে লাঠি। তেল মাখানো বাঁশের লাঠি। বিভিন্ন সাইজের। ও হ্যাঁ, হকিস্টিকও ছিল। রাস্তার দুধারে সারি সারি পনেরো পনেরোটা করে প্রায় তিরিশটা দোকান। এত অস্ত্রের এমন খুল্লমখুল্লা দোকান বোধ হয় এই একটি জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়।

dsc_0475dsc_0478

এর পরে ধানবাদ পেরিয়ে কুলটি. পশ্চিমবঙ্গের শুরু। এবং শুরু খারাপ রাস্তার। তখন প্রায় পৌনে ছটা বাজে, অন্ধকার করে এসেছে, আমার গাড়ির একটি হেডলাইট খারাপ। আর তেমনি বাজে রাস্তা। জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন, ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। আস্তে আস্তে পেরোতে থাকলাম আসানসোল, রাণীগঞ্জ, দুর্গাপুর।

সমস্ত ট্রাভেলগে পড়েছিলাম, এই রুটের মেন গাঁট হচ্ছে পানাগড়। একটা পাঁচ ছ কিলোমটারের স্ট্রেচ আছে, ভাঙা রাস্তা, সরু রাস্তা, রাস্তার ওপরেই বাজার বসে এবং ভর্তি ট্রাফিক থাকে – বেশির ভাগই ট্রাক। সেই পানাগড়ে এসে পৌঁছলাম। তখন বেশ অন্ধকার, তাই ছবি তোলা হয় নি। পানাগড়কে বলা হয় গ্রেভইয়ার্ড অফ ভেহিকলস। রোড রোলার থেকে মিলিটারি ট্রাক থেকে মারুতি এইট হানড্রেড, সব রকম গাড়ির কঙ্কাল পাওয়া যায় এই পানাগড়ে। তা, জ্যাম ছিল, সরু আর বাজে রাস্তাও ছিল, কিন্তু ট্রাফিক মুভিং ছিল। একটু ধীরে হলেও পেরিয়ে গেলাম টুক করে। আর তার একটু পর থেকেই শুরু হল দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েটা খুব সুন্দর রাস্তা, কিন্তু এর শেষ পর্যন্ত আমাদের যাবার ছিল না, কারণ আমরা কলকাতা যাবো না।

শক্তিগড়ে পৌঁছলাম সন্ধে সোয়া সাতটায়। রাস্তার দু ধারে সারি সারি দোকান, সব ল্যাংচা দিয়ে নাম। ল্যাংচা ধাম, ল্যাংচা হাট, ল্যাংচা কুটীর, ল্যাংচাপণ, ল্যাংচালয়, মানে রাস্তার দুধার পুউরো ল্যাংচাময়। প্রচুর রিভিউ পড়েছি এই জংশনটার। তাই গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম একটা দোকানে। দুটো করে ক্ষীরের ল্যাংচার অরডার দিলাম। দশ টাকা পিস।

মুখে দিতেই হৃদয় ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। রামোঃ, এত্তো বাজে টেস্ট? কী জঘন্য কী জঘন্য। এই খেয়ে লোকে ভালো ভালো রিভিউ লেখে? এর চেয়ে তো আমাদের বালির মোড়ের সুইটস সেন্টারের ল্যাংচা অনেএক ভালো খেতে হয়! খানিক সীতাভোগ চেয়ে নিলাম, সে-ও পদের টেস্ট না। সিকিনীরও একই অবস্থা। ল্যাংচার স্বাদ চেখে মুখ বিকৃত করে ফেলেছে।

মুখের টেস্ট ফেরাতে দুটো করে বেগুনির অর্ডার দিলাম। হ্যাঁ, বেগুনিটা দারুণ ভালো বানিয়েছে।

খেয়েদেয়ে উঠলাম। কেমন খটকা লাগছিল, তা হলে কি আমরা ভুল দোকানে ঢুকেছি? গাড়ি বের করে একটু চালিয়েও, আবার সাত আটটা দোকানের পরে দাঁড় করালাম। দাদা, একটা পাঁচটাকার ল্যাংচা দিন তো!

খেলাম, এবং একই রকমের বিচ্ছিরি লাগল। আর রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, বাড়ি চলো।

বাড়ির খুব কাছে এসে গেছি এইবারে। ভূতো আর বসে থাকতে পারছে না গাড়িতে, ক্ষণে ক্ষণে বলছে, আর কতক্ষণ? আর কতদূর?

মেমারি থেকে ডাইভার্সন ওল্ড জি টি রোডে। বাবা বলেছিল, জিটি রোড এখন চকাচক বানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। সে আমি দেখেওছি দোখনেশ্বর থেকে ব্যান্ডেল আসার সময়ে। ফাটাফাটি রাস্তা হয়ে গেছে পুরনো জিটি রোড।

কিন্তু, এ কোথায় এসে পড়লাম? ট্রাকের সারি পেরিয়ে জিটি রোড শুরু হতেই শুরু হল তীব্র ভাঙাচোরা রাস্তা। সে কী বড় বড় গর্ত রে ভাই! এর আগের খারাপ রাস্তাগুলোকেও তখন ভালো বলে মনে হচ্ছিল। মেমারি পেরোলাম। বৈঁচি থেকে হুগলি জেলা শুরু হল, কিন্তু রাস্তা একই রকমের খারাপ। এক জায়গায় তো গাড়ির নিচটা ঠুকেই গেল গর্তে চাকা পড়ে। এ কী বিড়ম্বনা বাড়ির কাছে এসে।

বৈঁচি, বৈঁচিগ্রাম, সিমলাগড়। এর পরে একটা লেভেল ক্রসিং। পাণ্ডুয়া এল। কালীপুজো আসছে, রাস্তার দু ধারে তাই আলোর মালা। ট্র্যাফিক। গ্যাঞ্জাম।

পাণ্ডুয়া বাজারটা ছাড়াতেই ম্যাজিকের মত রাস্তা ভালো হয়ে গেল। ঠিক বালী থেকে হুগলি যেমন আছে, তেমনি – দুদিকে রিফ্লেক্টার বসানো মাখনের মত মসৃণ জিটি রোড শুরু হল। বুঝলাম, কাজ চলছে, কাজ পাণ্ডুয়া পর্যন্ত এগিয়েছে।

এর পর? এর পর আরও দুটো লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে আদিসপ্তগ্রাম। সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তাটা গেছে ব্যান্ডেল মোড়। আর ডানদিকের রাস্তাটা “দিল্লি রোড” নাম নিয়ে গেছে বালীতে, সেখানে মিশেছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের সাথে। আমরা বাঁদিকের রাস্তা নিলাম। সোয়া নটায় আমাদের পাড়ায় ঢুকলাম। বাবা দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার মোড়ে। আস্তে আস্তে গলির ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে নিলাম।

দিল্লি কলকাতা একদিকের জার্নি কমপ্লিট। ট্রিপ মিটার দেখলাম, আজকের দৌড় হয়েছে ছশো চুয়ান্ন কিলোমিটার।

কাল যেতে হবে বহরমপুর। কিন্তু ভোর সাড়ে চারটের ট্রেন আর কোনওভাবেই ধরা সম্ভব নয়। আটটা পঞ্চাশেরটাই চেষ্টা করব। রাণাকে কাল সকালে ফোন করে নিয়ে বেরোব।


2 thoughts on “একটি অতিসাধারণ ভ্রমণকাহিনি – তৃতীয় পর্ব

  1. রাণাদার বাড়ির ঘটনাগুলো জলদি আসুক… শোধ নিতে সুবিধে হবে… তবে,
    ইয়ে, সিকিদা, “খেলতে নেমে ঘোমটা দেবার মানে হয় না’ টা “নাচতে নেমে…” হবে না?

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.