পর্ব ১ , পর্ব ২ , পর্ব ৩ , পর্ব ৪ ,পর্ব ৫আর পর্ব ৬-এর পরে
ঘুমোতে গেলেই কি ঘুম আসে? এটা প্রত্যেকবার আমার হয়, পরদিন ভোরে উঠে কোথাও বেরোবার থাকলে আমার রাতে ঘুম আসতে চায় না। ফল যদিও মারাত্মক হতে পারে, গাড়ি বা বাইক চালাতে চালাতে ঘুম পেয়ে যাওয়ার মত বাজে জিনিস খুব কমই হয় লং জার্নিতে – যেটা আমার হচ্ছিল লাদাখ থেকে ফেরার সময়ে, মনে হচ্ছিল, বাইক চালাতে চালাতেই ঘুমিয়ে পড়ব, মনে হচ্ছিল চারপাশের ট্র্যাফিকে কনসেনট্রেট করতে পারছি না। যদিও তার আগের রাতে ভালোই ঘুমিয়েছিলাম, ওই ঘুম-ঘুম ভাবটা সেবারে হয়েছিল অত্যধিক গরমের কারণে, শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছিল।
তবে এবারে অতটা চাপ নেই। সঙ্গে দুজন যাবে – দুজনেই গাড়ি চালাতে জানে, যদিও এই লেভেলের লং ড্রাইভ কেউই করে নি এর আগে। সারাদিনে এরা চালিয়েছে ম্যাক্সিমাম একশো কিলোমিটার – ঐ লাদাখ যাবার আগে আমার যে রকম স্টেটাস ছিল আর কি। তফাৎটা হচ্ছে, সেই স্টেটাস নিয়েও আমি স্বপ্নটা দেখে গেছিলাম, এরা ঠিক সেই রকমের স্বপ্ন দেখা লোক নয়, জাস্ট আমার শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়ের পাল্লায় পড়ে আমার সঙ্গী হচ্ছে আর কি। তবু, এক আধ ঘন্টা এদের কেউ ড্রাইভ করে দিলেই আমি ঘুমিয়ে নিতে পারব রাস্তায়।
চাপ আরও একটি, একটি নয় – বেশ কয়েকটি, একজনকে তো আমি চিনিই না, জানি না সে কেমন লোক হবে, অন্যজন প্রায় চেন স্মোকার বললেও কম বলা হয়। এই বস্তুটি আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না – আমার পাশে বসে সিগারেট খাওয়া। কিন্তু আত্মীয়তার নাম বাবাজীবন – অনেক জিনিসই সইয়ে নিতে হবে; যাক, যা হয় দেখা যাবে, বলে পাশ ফিরলাম।
এমনিতেই সিকিনীর সঙ্গে অল্প যুদ্ধ হয়েছে। বাড়ি থেকে এবার বেশ কিছু জিনিস যাচ্ছে – পোস্ত, মুসুর ডালের বড়ি, মোচা, রসগোল্লা, সন্দেশ। এর মধ্যে প্রায় সবকটাই সিকিনী আমার হাতে গছিয়ে দিতে চাইছিল, কারণ আমার গাড়িতে জায়গা আছে। সিকিনী ভূতোকে নিয়ে লাগেজ নিয়ে একা ট্রেনে ম্যানেজ করতে পারবে না। তো অনেক নেগোশিয়েশনের পরে রসগোল্লা-সন্দেশগুলো সিকিনীর হস্তগত করিয়েছি, কারণ, এক তো আমি পৌঁছবো দু দিনে, তায় সর্বক্ষণ গাড়িতে এসি চলবে না, ওয়েদার মনোরম, মিষ্টি খারাপ হয়ে যাবেই।
ফেরাটা অনেক সময়েই বেশ কষ্টকর হয়, কারণ জাস্ট পাঁচদিন আগে যে রাস্তা দিয়ে এসেছি, সেই একই রাস্তা দিয়ে আবার ফেরত যাওয়া, খুবই ফ্রাস্ট্রেটিং অভিজ্ঞতা হয়। তাও – আমার সঙ্গে দুজন যাচ্ছে, তাদের তো এটাই প্রথম।
মা নারকোল কুরিয়ে রেখেছে গোটাকয়, সেগুলো আমি নিয়ে যাবো, আপাতত কোরানো নারকোল ফ্রিজে রাখা আছে, কাল সকালে উঠে মনে করে ফ্রিজ থেকে বের করে নিয়ে ভরতে হবে।
ব্যান্ডেলের থেকে শুনেছি বর্ধমানে পেট্রলের দাম কম। এখান থেকে পাঁচশো টাকার তেল ভরে নিয়ে যাবো, বর্ধমানে গিয়ে ট্যাঙ্ক ফুল করতে হবে।
একটা মিষ্টি মিউজিক বাজছে। কোথায়? … মিউজিকটা আমি শুনেছি, কোথায় যেন … কোথায় যেন … আমার মোবাইলেই কি?
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভোর পাঁচটা পঁচিশ। আমার মোবাইলে অ্যালার্ম বাজছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে, টেরই পাই নি! যাক, ঘুমটা মন্দ হয় নি। ফোনটা হাতে নিয়ে দু মিনিট শুয়ে রইলাম। গৌরব হিসেবমত এতক্ষণে ট্রেনে চেপে বসেছে। একবার ফোন করব? উঠেছে কি আদৌ? হাওড়া স্টেশনে কি পৌঁছেছে? গৌরব তো সাধারণত বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে বলে শুনি নি … নাঃ, থাক, ছটাতেই করব।
টয়লেটে গেলাম, ফ্রেশ হলাম, দাঁত মাজলাম। ছটা বাজল। গৌরবকে ফোন করলাম। “আরে বোলো না, ছটা ছাব্বিশে ট্রেন, তার আগে কোনও ট্রেনই নেই – আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছি, ছটা ছাব্বিশের লোকালে বসব, সাড়ে সাতটায় তোমাদের বাড়ি।”
সিরাজদোউল্লাকে পলাশীর আমবাগান চেনাচ্ছো, মিস্টার ক্যালকেশিয়ান গৌরব? ছটা ছাব্বিশের আগে ব্যান্ডেলের জন্য ট্রেন নেই? ঢপটা অন্য কারুর জন্য রেখে দিলে পারতে, অফ অল পার্সনস, আমার সঙ্গে কেন মারতে গেলে? সকাল চারটের সময় হাওড়া থেকে ব্যান্ডেলের প্রথম লোকাল ছাড়ে। কিংবা তারও আগে।
এসব, মুখে বলা যায় না। মনে মনেই বললাম, এবং ক্যালকুলেশন সারলাম, শুরুতেই একঘণ্টা লেট। সাড়ে সাতটায় ট্রেন ব্যান্ডেলে আসবে মানে – আমাদের বাড়ি এসে চা খেয়ে বেরোতে বেরোতে কিছু না হোক, সাড়ে আটটা। কত রাতে বারাণসী পৌঁছবো আজ, কে জানে।
মা, গৌরব, স্টিফেন আর আমার জন্য ব্রেড-মাখন বানাবার তাল করছিল, আমি বারণ করলাম – শুধু চা করো, ব্রেকফাস্ট আমরা শক্তিগড়ে গিয়ে করব। ওখানে অজস্র ল্যাংচার দোকানের প্রায় প্রত্যেকটাই সকালবেলায় জম্পেশ মটরশুঁটির কচুরী আর ছোলার ডাল করে বলে শুনেছি। ওখানে পৌঁছেই পেটভরে খাবো – আর ল্যাংচার দিকে ভুলেও হাত বাড়াবো না।
দিদি বলল, তোরা ভুল করেছিস – ওই লাইনে সব দোকানে ভালো ল্যাংচা বানায় না, অথেন্টিক একটাই দোকান আছে, গৌরব চেনে – ও এলে আমি বলে দেবো – সেইখানে গিয়ে ল্যাংচা খাস, বাকি সব ল্যাংচার দোকান ফেক, ওই একটাই জেনুইন। খেয়ে জানাস, কেমন লাগল।
সুটকেস গোছানোই আছে, বাকি শেষমুহূর্তের যা প্যাকিং, সেগুলো সেরে গাড়ির দিকে এগোলাম, অন্তত লাগেজ ভরার কাজটা তো সেরে রাখি। ছটা কুড়ি বাজে। … আমাদের বাড়িতে আজও সকালে রেডিও চলে। আকাশবাণী কলকাতা। খবর শুরু হয়েছে, প্রথমেই বলল, প্যারিসে ভয়ঙ্কর আতঙ্কবাদী হামলা হয়ে গেছে।
আমি সুটকেস ছেড়ে টিভি চালালাম, যা দেখলাম, তাতে … কী বলব, একটা অপরিসীম খারাপ খবর দিয়ে দিন শুরু হল। সুটকেস আবার হাতে নিয়ে এগোলাম গাড়ির দিকে। ডিকিতে ভরা হল সুটকেস। সামনের দিকে বাঁদিকের চাকার হাওয়াটা মনে হচ্ছে বেশ কম। পাংচার হল নাকি? কাল তো চন্দননগর বাঁশবেড়িয়া করেছি, রাস্তা একটু খারাপ ছিল বটে, এমন কিছু খারাপ তো নয়! যাক গে – পরে দেখা যাবে। পাংচার নয় বলেই মনে হচ্ছে, বাকি তিনটে চাকার থেকে সামান্য হাওয়া কম।
সাতটা চল্লিশে গৌরব আর স্টিফেন এসে পৌঁছল, চা-বিস্কুট খেয়ে টেয়ে, সবাইকে টা-টা করে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। ঘড়িতে সময় সকাল আটটা পনেরো। সিকিনী আর ভূতো দুপুরে বেরোবে খেয়ে দেয়ে, বাবা ওদের পৌঁছে দেবে হাওড়া স্টেশনে। ওদের ট্রেন বিকেল চারটে পঞ্চান্নয় ছাড়বে।
প্রথমে একটা পেট্রল পাম্পে ঢোকা হল, কিন্তু ওদের হাওয়া মেশিন খারাপ, এর পরে রাস্তার ধারে আরেকটা দোকান, সেখানে মেশিন আছে, কিন্তু লোকটা নেই, তার বউ বসে দোকান সামলাচ্ছে। কী আর করা, আমরাই বসে পাইপ নিয়ে চাকায় হাওয়া ভরে নিলাম। মনে হল, ঠিকই আছে। আবার স্টার্ট করলাম।
পুরনো জিটি রোডই নিলাম – যে রাস্তা দিয়ে এসেছি। এখন দিনের বেলা, খানাখন্দ দেখতে অসুবিধে হবার কথা নয়। … খুব অসুবিধে হলও না। সময় লাগল বটে সোয়া ঘন্টা, নটা চল্লিশ নাগাদ আমরা শক্তিগড়ে পৌঁছে গেলাম। গৌরব আমাকে বলল গাড়ি থামাতে একটা দোকানের সামনে – তার নাম আদি ল্যাংচা হাট।
আহা, কিছু খেলাম। কচুরী আর ছোলার ডাল। কতগুলো কচুরী যে খেলাম, আর গুণি নি। এইবারে আসল টেস্ট – গৌরব বলল, ল্যাংচা খাবে তো?
আমি কী বলব, ভেবে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ।
একটা করে ল্যাংচা পড়ল আমাদের থালায়। খেলাম। সত্যি বলছি, এবারেও ভালো লাগল না। আমাদের বালির মোড়ের সুইটস সেন্টারে এর চেয়ে ঢেরগুণ ভালো ল্যাংচা পাওয়া যায়। এ কী টেস্ট? রসে চোবানো না জলে চোবানো বোঝাই যাচ্ছে না। ভাগ্যিস খানিক ছোলার ডাল বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, সেইটা খেয়ে আবার মুখের টেস্ট ফেরালাম। দশটা কুড়িতে আবার গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে একবার চাকাটা দেখে নিলাম, না একদম ঠিক আছে। বোধ হয় হাওয়াই কমে গেছিল। এখন আর কোনও সমস্যা নেই।
গৌরব বসল স্টিয়ারিং-এ, আমি পাশের সীটে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে চলল আরও কিছুক্ষণ, বর্ধমান ছাড়িয়ে।
শক্তিগড়েও তেমন ট্রাফিক পেলাম না, সুন্দর পেরিয়ে গেলাম। গৌরবকে বলে দিয়েছিলাম স্পিড যেন একশো টাচ না করে, তা হলে গাড়ি ভাইব্রেট করবে, যত ভালো রাস্তাই হোক, নব্বইয়ের মধ্যে যেন চালায়। গৌরব সেইমতই চালাতে লাগল।
একে একে পেরিয়ে গেল দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, আসানসোল। আসানসোলে তেল ভরে নিলাম ট্যাঙ্ক ফুল করে। এখানে রাস্তা মোটেই ভালো নয়, জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন, যাই হোক, এক সময়ে দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার।
গাড়ি নিজে না চালালে ক্যামেরাটা হাতে পাওয়া যায়, দু চারটে ছবি তোলা যায়।
ঝাড়খণ্ডে ঢোকার একটু পরেই রাস্তাটা সুন্দর হয়ে গেল। ধানবাদ এসে গেল তার পরেই।
এর পরে পেরিয়ে এলাম তোপচাঁচির সেই সব তলোয়ারের দোকানগুলো, গৌরব আর স্টিফেন তো এসবের গল্প শোনে নি এর আগে। সারি সারি ঢালতলোয়ারের দোকান দেখে দুজনেই খুব উত্তেজিত। গৌরব তো একবার বলল গাড়ি দাঁড় করিয়ে একবার দর করে আসবে। অনেক কষ্টে তাকে নিরস্ত করলাম।
আমি নজর রাখছি ট্রিপ মিটারের দিকে – ঠিক সাড়ে তিনশো কিলোমিটারের মাথায় পড়বে গিরিডির সেই অশোকা রিসর্ট। ওখানেই লাঞ্চ করব।
অশোকা রিসর্ট পৌঁছলাম – তখন প্রায় তিনটে বাজে। গাড়ি ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে নিলাম পার্কিং-এর দিকে। গাড়ি থেকে নেমে বেরোতে যেতেই চোখ পড়ল সামনের বাঁদিকের চাকায়, আর দেখামাত্রই আমার মাথায় হাত!
একেবারে বসে গেছে চাকা। একফোঁটা হাওয়া নেই।
যে ভয়টাকে এতক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখছিলাম, ইগনোর করছিলাম জোর করে, সেইটাই হল, কারণ এই পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত নই। ওভারকনফিডেন্স বলুন কিংবা ভুলোমনা – আমি আসার আগে আমার গাড়ির টুলকিট-টি বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছি। ডিকিতে যদিও একটি স্টেপনি আছে, অক্ষত, কিন্তু সঙ্গে না আছে জ্যাক, না আছে স্ক্রু-রেঞ্চ। এখন কী উপায়? হোটেলে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি “পাংচার শপ” কোথায় আছে – ওরা বলল, দু কিলোমিটার আগে পেয়ে যাবো। এখন, গাড়ি তো অতদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না, হাওয়াবিহীনভাবে এতটা এল কী করে সেটা ভেবেই আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি, গৌরবই বলল, মনে হচ্ছে এটা সকালের কেস নয়। সকালে পাংচার ছিল না, পাংচার হয়েছে খুব রিসেন্টলি, রাস্তায় কোথাও। নইলে এইভাবে একেবারে হাওয়া নেই, অথচ নব্বইয়ের স্পিডে আমরা আসছি – এটা জাস্ট হতে পারে না। টের পেতামই। এটা এই রিসর্টে ঢোকার মুখেই হয়েছে।
তাই হবে। সেটুকু ভেবে সান্ত্বনা পেলেও, এখন উপায় কী? টুলকিট চাই যে!
রিসেপশনে কথা বললাম, ওরা বলল, এখানে আরও তিন চারটে গাড়ি আছে, কারুর না কারুর গাড়ি থেকে জ্যাক আর টুল জোগাড় হয়ে যাবে, আপনারা আরাম করে খাওয়া দাওয়া করুন, আমরা দেখছি।
আস্বস্ত হয়ে খেতে ঢুকলাম। রুটি, চিকেন কালিয়া আর কী যেন – খিদেও পেয়েছিল খুব। খেয়েদেয়ে উঠে শুনি তারা খোঁজই নেয় নি, যেমন হয় আর কি। একটি গাড়ির ড্রাইভার সামনে ছিল – সে মানা করে দিল, তার কাছে টুল নেই। এর পরে “দাদা দেখুন্না দাদা দেখুন্না” করতে করতে পাওয়া গেল একটি ছেলেকে, অশোকা রিসর্টেরই একটা মারুতি ভ্যান, বাইরে দাঁড় করানো ছিল, তার ড্রাইভার। সে চাবি নিয়ে চলল আমাদের জ্যাক আর টুলকিট দেবে বলে।
প্রচুর ধ্বস্তাধস্তি করেও ভ্যানের ডিকি খোলা গেল না। অতঃপর পাশের দরজা খুলে তার সিটের নিচে মুন্ডূ গলিয়ে যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে আমাদের হাতে দিল।
স্টেপনি ছিলই, এটা অবশ্য টিউবলেস নয়, তবে যেমনই হোক, একেবারে আনইউজড টায়ার। মানে, এর আগে আমার পাংচার হয়েছে, কিন্তু শহরের মধ্যে, তাই স্টেপনি লাগাবার দরকার কখনও পড়ে নি। কাছেই পাংচার শপ পেয়ে গেছি, সারিয়ে নিয়েছি। স্টেপনি এই প্রথম লাগল।
খানিক সময় নষ্ট হল – তবু ঝটপট চাকা বদলে আমরা এগোলাম, এইবারে স্টিফেন নিল স্টিয়ারিং। একটু এগিয়ে একটা পেট্রল পাম্পের সাথে একটা পাংচার সারাইয়ের দোকান পেলাম, সেখানে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাকাটা আবার ডিকি থেকে বের করে সারিয়ে নিলাম, বেশ বড়সড় একটা ফুটো হয়েছিল। টিউবলেস টায়ারে ফুটো বোজানো বেশ সহজ কাজ, পাংচার কিটটা থাকলেই হয়।
মুখ বুজে থাকা ছাড়া এখন গত্যন্তর নেই, কারণ দোষ সম্পূর্ণ আমারই। স্টিফেন বেশ কয়েকবার হাসতে হাসতে আমাকে বলল, এমন কাজ কেউ করে? কিট না নিয়ে এত লম্বা জার্নিতে …? মনে মনে কত গালাগাল দিয়েছিল, সে আমি সম্যক বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বলার কিছু নেই, এরা দুজন না থাকলে কী হত, সে আর আমি ভেবে উঠতে পারছি না তখন।
লিক সারিয়ে হাওয়া ভরে সেটাকে আবার ডিকিতে ভরে – এইবারে ঝড়ের গতিতে এগোতে থাকলাম। স্টিফেন গৌরবের থেকেও পাকা ড্রাইভার, খুব স্মুথ চালাচ্ছে গাড়ি, এইবারে একটা অদ্ভূত জিনিস খেয়াল করলাম, গাড়ির স্পিড একশো টাচ করল, একশো পাঁচ-দশ, গাড়ি একটুও ভাইব্রেট করছে না আর। … তা হলে কি আগের চাকাটাতেই কোনও সমস্যা ছিল? প্রথম থেকেই সমস্যা ছিল?
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটাতেও আমরা ঝাড়খণ্ড পেরোতে পারলাম না, এর পরে পড়ে আছে পুরো বিহার। হাজারিবাগের কোথাও একটা ধাবায় আমরা ছোট হল্ট দিলাম, একটু চা-চিপস খেয়ে আবার দৌড় শুরু – এবারে গৌরব চালক।
মোটামুটি আটটার পরে বিহারে ঢুকলাম, নটা কুড়িতে ডেহরি অন শোন। বারাণসী যখন আর আশি কিলোমিটার, তখন আবার গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করতে ঢুকলাম একটা পাম্পে। রাত তখন পৌনে দশটা। গৌরবকে বললাম, বারাণসী যখনই দেখবে আর পঁচিশ কিলোমিটার লেখা আছে, আমাকে চালাতে দিও – কারণ তোমরা ওই হোটেল খুঁজে পাবে না, আমি একবার এই রাস্তা দিয়ে গেছি, আমি চিনতে পারব।
বিহার বর্ডার ক্রস করেই গৌরব আমাকে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল, আমি খানিক গুগল ম্যাপ দেখে খানিক একে তাকে জিজ্ঞেস করে এগোতে থাকলাম। মুঘলসরাই জংশনের পাশ দিয়ে গেলাম, লম্বা একটা ব্রিজ দিয়ে গঙ্গা পেরোলাম। এইবারে এক চান্সে ঢুকে গেলাম রাহী ট্যুরিস্ট বাংলোয়। পৌনে এগারোটা।
সরকারী হোটেল তাই ডাইনিং হল বন্ধ। সামনেই বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন, জমজমাট এলাকা, অসংখ্য হোটেল। সেখানে গিয়ে খাবার প্যাক করিয়ে আনলাম। গৌরব আর স্টিফেনের জন্য একটা রুম বুক করা হল, মাত্র আটশো টাকায় ডবল বেডরুম বুক হয়ে গেল।
খেয়েদেয়ে শোয়ামাত্র ঘুমে তলিয়ে গেলাম, অবশ্য, পাঁচটায় অ্যালার্ম দিতে ভুলি নি। কালকের জার্নিটাই বড় – আটশো কিলোমিটার। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেরোতেই হবে। এখানে খাবার পাওয়া যাবে না; রাস্তায় খেয়ে নেওয়া যাবে।
বেশ স্মুদই তো এগোচ্ছে… আর ক’টা পর্ব?
LikeLike
আর একটাই। দেখি, আজ রাতে বসব।
LikeLike
এটা কি ভালো হল স্যার…..সোয়া চারটেয় শুরু করে একঘন্টা পরে বলছেন दिल्ली अभी दूर है…
বাকিটা কবে পাবো?
LikeLike
আজ রাতে নয় তো কাল সকালে। পাক্কা।
LikeLike
অতিসাধারণ ভ্রমণেকাহিনীর লেখাটা অসাধারণ হচ্ছে, শমীক। আপনার লেখা লাদাখ সিরিজটা পড়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আপনি যদি পুরনো পোস্টের কমেন্ট না খেয়াল করেন, তাই এখানে সেলাম জানিয়ে গেলাম। ওইভাবে বেড়ানোর সাহস করার জন্য, আমাদের লাদাখ যাওয়ার ইচ্ছেটা চাগিয়ে দেওয়ার জন্য আর অত সুন্দর লেখাটা পড়তে দেওয়ার জন্যও।
LikeLike
অসংখ্য ধন্যবাদ, কুন্তলা। 🙂
LikeLike
দূর্দান্ত…প্রায় এক নিঃশ্বাসে সবকটা পর্ব পড়ে ফেললাম…পরেরটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি…সেই লাজবাব দিল্লী থেকে আমি তোমার লেখার ভক্ত হয়ে গেছি শমীক.. তোমার ব্লগের ব্যাপারে জানা ছিলো না…ভাগ্যিস সায়ন্তনী শেয়ার করলো…:)
LikeLike
থেঙ্কু থেঙ্কু 🙂
LikeLike
Tomar aager ladakh trip aar eta dutoi bhaloi likhechho.aarushi tao porlam.besh bhalo likhchho.jaak tumi bhalobhabe pouchhe gechho eta bhalo.wish u best of luck for upcoming roadtrip.tumi bodhhoy kaalebhodre baari aaso tai janiye rakhi amader elakay best holo sweet centre.majhe majhe to mone hoy ora bodhhoy Misti niye research korchhe.satyi durdanto.
LikeLike
সুইটস সেন্টারের নাম তো লিখেছি। সুইটস সেন্টার, মানে অরূপদার দোকান একদিন ইতিহাসের পাতায় নিজের পাকা জায়গা করে নেবে, এ আমি লিখে রাখলাম।
LikeLike