বিশ্বেস করুন, মা শেতলা আর বাবা ইন্টারনেটের দিব্যি, দু হাজার চোদ্দ শেষ হয়ে যখন দু হাজার পনেরো শুরু হয়েছিল, খুব ঘুরব, খুব বেড়াব, হাঁই হাঁই জার্নি করব – এমন কোনও প্রকারের রেজলিউশন আমি নিই নি। ইন ফ্যাক্ট, ওই রেজোলিউশন নেবার গল্পটাই আমার বেজায় বোকাবোকা লাগে। তাও যখন শেষমেশ পনেরো শেষ হয়ে দু হাজার ষোলতে এসে পড়লাম, পেছন ফিরে দেখি, গোটা বছরটায় মনে রাখার মত বেশ কটা ট্রিপ করে ফেলেছি। প্রথমে জুন মাসে এন এইচ ওয়ান এন্ড টু এন্ড – লাদাখ, বাইকে করে, তার পরেই নভেম্বরে অলমোস্ট এন্ড টু এন্ড এন এইচ টু, দিল্লি থেকে কলকাতা গাড়িতে করে। এর পরে হতেই পারত এন এইচ থ্রি – কিন্তু সেটা যে কোথা থেকে কোথা যায়, ইন্টারনেটে খুঁজবার আগেই দানা বাঁধতে লাগল পরের বেড়াবার প্রস্তুতি। এবারে আর দু-চাকাও নয়, চার-চাকাও নয়, বেড়াবার মাধ্যম হবে এগারো নম্বর বাস।
আজ্ঞে হ্যাঁ, ট্রেকিং। হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে চড়া আর নেমে আসা। এই গুরুচন্ডালিতেই আমাদের এক চন্ডাল আড্ডা মারে – বুনান, সে মোটামুটি হামাগুড়ি দেবার বয়েস পেরোবার পর থেকেই ট্রেক করতে শুরু করেছে। আমার যেমন নেশা হচ্ছে বাইক রাইডিং, বুনানের তেমনি ট্রেকিং। ছেলেটা নেহাৎ লেখে না – নইলে আপনারা জানতে পারতেন ওর মোটামুটি হিমালয়ের বেশির ভাগ পাস আর কল্ই পায়ে হেঁটে ঘোরা হয়ে গেছে। প্রথাগত মাউন্টেনিয়ারিং-এর বা ট্রেকিং-এর তেমন কোনও ট্রেনিং নেই, কিন্তু জাস্ট অদম্য নেশা আর মনের জোরে সে যে কোন কোন রুটে ঘুরে আসে নি, আর কোন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নি, সে বলা মুশকিল।
বুনানই আমাকে প্রস্তাব দিল, ডিসেম্বরে চলো আমাদের সঙ্গে ট্রেকিং করতে – খুব সোজা রুট, দয়ারা বুগিয়াল। সাত আট দিনের মামলা দিল্লি থেকে দিল্লি, কোনও চাপ হবে না, চলে এসো।
জুটে যেতে একেবারেই আপত্তি ছিল না, পঁচিশে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি অফিসে মোটামুটি ছুটির মেজাজই থাকে, কিন্তু আমি কি পারব? এমনিতে আমি বেজায় কুঁড়ে টাইপের জনতা। বাইকে বা গাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা ড্রাইভ বা রাইড করতে আমার যদিও এতটুকুও ক্লান্তি আসে না, কিন্তু পায়ে হেঁটে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পেরনো কি আমার পক্ষে সম্ভব? আমার দম এমনিতেই কম, ছোট থেকে আমাকে বহু চেষ্টা করা হয়েছিল খেলাধূলোয় জুতে দেবার, কিন্তু অচিরেই ফুটবলের মাঠে আমি গোলকীপারের পোস্টটিই বেছে নিয়েছিলাম কারণ ওতে ছুটতে হত না। সাঁতার শিখেছি দীর্ঘ পাঁচ বছর, সাঁতারের সমস্ত কলাকৌশল আমি জানি – কিন্তু জীবনে কোনওদিন সাঁতার কম্পিটিশনে মেডেল পাই নি, প্রত্যেক বছরেই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পাতলা স্টিলের টিফিন বাক্সো নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। স্কুলে কলেজে কোনওদিন স্পোর্টসে নাম দিই নি, কোনওদিন একশো মিটারও দৌড়ই নি, ক্রমশ খেলাধূলো, স্পোর্টস জিনিসটাকেই আমি আমার জীবন থেকে বের করে দিয়েছি, খেলার চ্যানেল খুলি নি কোনওদিন, ইন্ডিয়ান টিমের ক্যাপ্টেনেরও নাম জানি না, সপ্তাহে এক দুদিন পায়ে হেঁটে বাজার যাই বটে, তবে সেটা ঐটুকুই – খুব বেশি হলে এক দু কিলোমিটার হন্টন। আমার পক্ষে কি সম্ভব?
বুনান শুনেটুনে বলল, আরে অত ভাবছো কেন? আমরা তো থাকছি সঙ্গে, ধীরে ধীরে থেমে থেমে উঠব। আমাদের ট্রেক গাইড হবে প্রেম, সে এক দারুণ লোক, অনেকগুলো পীক ও জয় করেছে মাউন্টেনিয়ারিং টিমের সঙ্গে, প্রচুর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে ওর, শুনতে শুনতে চলবে, কোনও চাপ হবে না।
সে না হয় নিলাম না, কিন্তু জিনিসপত্র কী লাগবে? খরচা কেমন হবে? রুট কী রকম? মোদ্দা কথা – আমরা যাচ্ছি কোথায়?
সিকিনী যতবারই আমাকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি ট্রেক করতে, আমি কিছুতেই বলতে পারি না, কারণ নামটাই তো মুখস্ত হয় নি। দয়ারা বুগিয়াল – এই নাম মনে রাখা কি সম্ভব? হোয়াটস্যাপের চ্যাট খুলে স্ক্রোল আপ করে যতক্ষণে সে নাম বের করি, তখন সিকিনী অফিস চলে গেছে, আর সে যখন ফিরে এসে আবার জিজ্ঞেস করে, আমি ততক্ষণে নামটা ভুলে যাই। প্রায় দশদিন লেগেছিল নামটা মেমোরাইজ করতে।
খরচ নাগালের বাইরে কিছু নয় – অন্ততপক্ষে লাদাখ বা কলকাতা যাবার খরচের থেকে অনেক অনেক কম খরচে ঘোরা হবে।
জিনিসপত্র যা যা লাগতে পারে – তার দেখলাম সবই আমার কাছে আছে – মোটা জ্যাকেট, গ্লাভস, চার জোড়া মোজা। বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে, ফলে ট্রেকিংএর উপযুক্ত স্পাইক-জুতোও লাগবে। আমার উডল্যান্ড জুতোটা যদিও ঠিক ট্রেকিং শু নয়, তবে নিচের খাঁজকাটা দেখে মনে হল, এটা পরেই হাঁটা সম্ভব। আর তাই জুতো কেনার পেছনে ইনভেস্ট করলাম না। বুনান বলল, ওয়াকিং স্টিক লাগবে, সেটা ও আমার জন্য নিয়ে আসবে, বাকি দু সেট জামা সোয়েটার ইত্যাদি ভরে একটা নর্মাল ব্যাগ পিঠে নিলেই হয়ে যাবে। বাকি যা যা লাগবে, গেটার, টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, সমস্ত আমাদের গাইড প্রেম প্রোভাইড করবে।
ব্রাউজার খুলে দয়ারা বুগিয়াল দিয়ে সার্চ মেরে বেশ নয়নমনোহর ছবিপত্র পেলাম। উত্তরকাশী থেকে বেশ খানিকটা ওপরে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা মেডো, ঢেউখেলানো বিস্তীর্ণ ময়দান – একেই গারোয়ালি ভাষায় বলে বুগিয়াল। জায়গাটার নাম দয়ারা, তাই দয়ারা বুগিয়াল। গরমকালে স্থানীয় পশুপালকরা তাদের গরু-ছাগল চরাতে নিয়ে আসে এখানে, শীতে এই এলাকা ধূধূ বরফে ঢেকে যায়। আমাদের হাঁটা হবে এই বরফে ঢাকা বুগিয়ালের ওপর দিয়ে। ছবিটবি দেখে দিল্লির হাল্কা ঠাণ্ডাতে বসেও বেশ কেঁপে গেলাম। দিগন্তবিস্তৃত বরফের চাদর। সামনে দেখা যায় বান্দরপুঞ্ছ পীক।
দু চারটে ট্রেক আইটিনেরারি খুঁজে বের করলাম। দৈনিক তিন চার, ম্যাক্সিমাম পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক, এই রকম জায়গায় হাঁটতে মোট্টেই কষ্ট হবার কথা নয় – কিন্তু, কিন্তু, সমস্ত ট্রেকের টাইম দেখাচ্ছে এপ্রিল থেকে নভেম্বর, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কেউই কোনও ট্রেক অ্যারেঞ্জ করে না। তার মানে কি … এত বরফ পড়ে সেখানে, যে ট্রেক করা যায় না?
অগতির গতি বুনান, সে আবার অভয় দিল, আরে তেমন কিছু ব্যাপার না, ওগুলো ফ্যান্সি ট্রেকারদের জন্য, যারা বরফ পড়ার আগেই ঘুরে আসে। আমরা তো যাচ্ছিই বরফ দেখতে। আর ওই ওয়েবসাইটের রুটে তো আমরা যাবো না, ওগুলো যায় বারসু হয়ে, আমরা যাবো উত্তরকাশী হয়ে। এটা একটা আনকনভেনশনাল রুট।
অ্যাপারেন্টলি বোঝাই গেল, বিশেষ চাপের কিছু নেই, কিন্তু সিকি যাচ্ছে যেখানে, সেখানে ঘটনার ঘনঘটা থাকবে না, তাই কি হয় নাকি? ঘটনা ঘটেই, তাই তো সিকি ভ্রমণকাহিনি লেখার অনুপ্রেরণা পায়।
হাঁটা তো শেষ চোদ্দ কি ষোল কিলোমিটার, উত্তরকাশী অবধি যাবো কেমন করে?
বুনান বলল, আমি তো কত ট্রেক করেছি উত্তরকাশী হয়ে। দিল্লি থেকে বাস নিয়ে প্রথমদিন হরিদ্বার, পরের দিন ভোরবেলায় বাস ধরে আবার উত্তরকাশী। ব্যাস। আমরা তো তিনজন, তুমি, আমি আর আমার অফিসের এক ছানা যাবে।
আমার মন অতএব আবার গুণগুণায় – তিনজনে যাচ্ছি যখন, খামোকা বাসে করে যাবো কেন? আমার গাড়ি আছে কী কত্তে? তোরা ট্রেনে করে দিল্লি আসছিস আয়, আমি তোদের রিসিভ করে সো-জা চলে যাবো হরিদ্বারে, পরের দিন হরিদ্বার থেকেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাবো উত্তরকাশী, সেখানেই গাড়ি রেখে ট্রেক শুরু করব।
বুনান বলল, আইডিয়াটা মন্দ নয়, তবে তুমি গাড়িটা হরিদ্বারেই হোটেলে রেখে দাও, তোমার তো পাহাড়ে ড্রাইভ করা অভ্যেস নেই, উত্তরকাশীর রাস্তাও শুনেছি খুব একটা ভালো নয়, ওটা গাড়িতে রিস্ক না নেওয়াই ভালো। হরিদ্বারের হোটেলে কথা বলে নাও, ওদের পার্কিং আছে, ওরা ছদিনের জন্য তোমার গাড়িটা রেখে দেবে।
বেশ, তাইই সই। হরিদ্বারের হোটেল শিবমূর্তিতে কথা বলে নিলাম। লোকটি প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজি হয়ে গেল আমাদের গাড়ি রাখতে।
কিন্তু একটা চাপ আছে – বুনান বলল আবার হোয়াটস্যাপে। – আমাদের আসার ট্রেন ওয়েটিং লিস্ট। সেটা কনফার্ম হবার চান্স কম।
সম্ভাব্য সবরকম সোর্স কাজে লাগিয়েও বোঝা গেল সেটা কনফার্ম না হবার দিকেই চান্স বেশি, তখন বললাম, ফ্লাইটে চলে আয় না।
বুনান বলল, ফ্লাইটে প্রচুর খরচা হবে এখন, দশ হাজারের নিচে টিকিটই নেই, আর আমার সঙ্গে যে আসছে সে অনেক জুনিয়র, ওর পক্ষে ফ্লাইটের টিকিট অ্যাতো বেশি দামে কেনাটা খুব বেশি চাপ হয়ে যাবে।
আমি সাথে সাথে মেকমাইট্রিপ খুলে দেখলাম – বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দামের টিকিট, তার মধ্যেই জেট এয়ারওয়েজের টিকিট দেখলাম অনেক শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, পঁচিশে ডিসেম্বর সন্ধ্যেবেলায়। বুনানকে দেখাতেই বেশ খুশি হয়ে ঝটপট টিকিট কেটে ফেলল। ফাইনালি তা হলে ঠিক হল – পঁচিশে ডিসেম্বর রাত নটায় ফ্লাইট এসে নামবে দিল্লিতে, আমি এয়ারপোর্ট থেকে বুনানকে আর তার ছানাকে রিসিভ করে সোজা দৌড় লাগাবো হরিদ্বারের দিকে। যত রাতই হোক, সোজা পৌঁছে যাবো হোটেলে। পরদিন ভোরবেলা একটু চাপ নিয়ে উঠে বাস ধরে উত্তরকাশী যেতে হবে, সে দরকার হলে বাসেও বাকি ঘুমটা ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
অল্ সেট। আমার ব্যাগ গুছনোও কমপ্লিট। সকালে শুধু দাঁত মেজে ব্রাশটা ভরে নিতে হবে।
আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলিইইইই 😐
LikeLike
আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলিইইইইইই 😐 😐
LikeLike
এমন ঘনঘন কাঁদার কী আছে? একবার কাঁদলেই তো হত 🙂
LikeLike
এখনও দাঁত মাজা হয়নি?
LikeLike
আর বোলো না – বইমেলা, এডিটিং, প্রুফ রিডিং। সকাল থেকে চলছে – এখনও নাওয়া খাওয়ার সময় পাই নি।
LikeLike
eto ghurte gele ghorar jonyo ekta alada toothbrush rakha uchit. Vije toothbrush bag e bhorle fungus tar theke peter gondogol. Bhaaggis byangdi janena.
LikeLike
না না, ভিজে কোথায় – দাঁত মেজেছি সকালে, আর জার্নি তো রাতের বেলায় শুরু।
LikeLike