তালেগোলে হরিবোলে, দয়ারা বুগিয়ালেঃ দ্বিতীয় পর্ব

পর্ব ১ -এর পরে …

মোটামুটি এই ঠিক হল যে, পঁচিশ তারিখে রাত নটার পরে বুনান আর তার ছানাকে পিক আপ করে আমরা এগবো হরিদ্বারের দিকে, পরদিন সেখান থেকে বাস ধরে উত্তরকাশী। ২৭ তারিখ সকালবেলায় দয়ারা বুগিয়ালের জন্য ট্রেক শুরু, উত্তরকাশী ফিরব ৩১শে ডিসেম্বর। পয়লা জানুয়ারি আবার হরিদ্বার, এবং দোসরা সকাল সকাল স্টার্ট করে দিল্লি, করিমসে লান্‌চ সেরে ওরা ফেরার ট্রেন ধরবে।

পঁচিশ তারিখ, বড়দিনের রাতে, নটা পঁচিশ নাগাদ এয়ারপোর্টের বাইরে বুনানের ঝাঁকড়া চুল দেখা গেল, পিঠে একটা ইয়া গাবদা ব্যাগ, সঙ্গে একটা নিরীহ, মিষ্টি দেখতে ছেলে, চোখে শিয়াল পন্ডিতের মত চশমায় তাকে আরও নিরীহ দেখাচ্ছে, তার পিঠেও অনুরূপ একটা গাবদা ব্যাগ। ঝটপট ডিকিতে ব্যাগ ভরে সাড়ে নটা নাগাদ আমরা যাত্রা শুরু করলাম। বুনান আলাপ করিয়ে দিল – ছেলেটার নাম হচ্ছে অর্পণ, একই অফিসে কাজ করে, এ-ও ট্রেক ইত্যাদি করে, আগে নাকি কোথায় কোথায় ঘুরে এসেছে, এইবারে বেরিয়েছে বুনানের সঙ্গে। যা বুঝলাম, এই দলে একমাত্র আমিই সে অড ব্যক্তি, যে জীবনে এক কিলোমিটারও ট্রেক করে নি। যা থাকে কপালে – বলে অ্যারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।

হরিদ্বার যাবার একটিই রাস্তা, আমার বাড়ির পাশ দিয়ে। যেতে যেতে বুনান বলল, তুমি উত্তরকাশী অবধি গাড়ি চালাতে পারবে? পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভ্যেস আছে তোমার?

গাড়ি চালানোর কথায় আমার তো কখনওই ‘না’ নেই। যদিও এর আগে পাহাড়ে চালানো বলতে সেই ধরমশালা ম্যাকলিওডগঞ্জ যাত্রা, তাও সে তো পাহাড়ই বটে। হিমালয় পাহাড়, হোক না অনেক নিচু হাইটে! বললাম, হ্যাঁ দিব্যি পারব। বুনান এবং অর্পণ দুজনেই বলল – তা হলে এক কাজ করো, হরিদ্বারে গাড়ি না ছেড়ে সোজা গাড়ি চালিয়ে পরদিন উত্তরকাশী যাই চলো। একে তো হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীর বাসগুলো ছাড়ে খুব ভোরের দিকে, আমাদের ভোর পাঁচটায় উঠে বাস ধরতে হবে – এদিকে হরিদ্বার পৌঁছবোই আজ হয় তো রাত দুটো আড়াইটেয়, ঘুম হবে না। সঙ্গে গাড়ি থাকলে আমরা আরামসে বেলা পর্যন্ত রেস্ট নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বেরোতে পারি, হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী মোটামুটি দুশো কিলোমিটার – দিল্লি থেকে হরিদ্বারের যা দূরত্ব। পাহাড়ি রাস্তায় মোটামুটি আরামসে চালালেও পাঁচ থেকে ছ ঘন্টায় দিনের আলো থাকতে থাকতে উত্তরকাশী পৌঁছে যাবো। বুনান বলল, আমি প্রেমের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি, উত্তরকাশীতে তোমার গাড়ি পার্ক করার জায়গা থাকবে, আর রাস্তাও খুব কিছু খারাপ নয়। চলে যাওয়া যাবে।

জিও পাগলা – আমার তো কোনও চাপই নেই, গল্প করতে করতে ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলাম গাজিয়াবাদ, মীরাট, মুজফফরনগর। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার সময়ে একটা ছোট ধাবায় দাঁড়িয়ে একপ্রস্থ চা খাওয়া হল, জল কেনা হল। অর্পণ দেখছি একটা একটা করে জায়গা পেরোচ্ছে, আর ফোন করে কাকে যেন সময়ে সময়ে স্টেটাস আপডেট দিচ্ছে – হুঁ, বুঝলে, এই মীরাট পেরোলাম, হ্যাঁ, এর পরে মুজফফরনগর, হ্যাঁ-হ্যাঁ, দেরাদুন – না না, হরিদ্বার পৌঁছবো হয় তো রাত দেড়টা নাগাদ, হ্যাঁ হ্যাঁ, খেয়ে নিয়েছি, হুঁ, জল কিনেছি।

বুনান পাশের সীট থেকে বলল – স্টেটাস কল। কথায় কথায় কাহিনি বেরলো, এবং অর্পণের লজ্জা লজ্জা মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না স্টেটাস কলগুলো এত রাতে কাকে দেওয়া হচ্ছিল।

একটু পরেই রুড়কী ঢুকল, আর সাথে সাথে কোথা থেকে যেন রাস্তার ওপর জেঁকে বসল চাপ চাপ কুয়াশা। অলমোস্ট কিছু দেখা যায় না, তবে সে কুয়াশা বেশিক্ষণ রইল না। রুড়কী টাউনের ভেতরে ঢুকতেই কুয়াশা কমে গেল, আইআইটি গেটের পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলাম, হরিদ্বার আর মাত্র তিরিশ কিলোমিটার।

হরিদ্বারে হোটেল শিবমূর্তিতে পৌঁছনোর রাস্তাটা খুঁজে পেতে অবশ্য একটু সময় লেগেছিল, জিপিএস ঠিক করে দেখাতে পারছিল না, হাইওয়ে থেকে হরিদ্বার সিটিতে ঢোকার রাস্তা ঠিক কোনটি। তবে খানিক এদিক ওদিক করার পর অবশেষে একজনকে জিজ্ঞেস করে সঠিক রাস্তার দিশা পেলাম এবং যতক্ষণে হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম, তখন বাজে রাত দুটো বেজে আটচল্লিশ।

রুমে ঢুকে চমৎকার বিছানা, হাল্কা ঠাণ্ডা আর মোটা লেপ। ঘুম আসতে কি সময় লাগে?

নাহ্‌, বুনানের বা অর্পণের সময় লাগে না বটে, কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না। আসবে কী করে? কী সাংঘাতিক নাক ডাকে রে ভাই বুনান! সাধে কি লোকে ওকে দেখলেই মাথার চুলে চিউয়িং গাম আটকে দেবার চেষ্টা করে?

অগত্যা, কী আর করা, ভেড়া গোনার অভ্যেস নেই, ওর নাক ডাকাই গুণতে শুরু করলাম, এক … দুই … তিন … চার … … একশো পঞ্চান্ন … একশো ছাপ্পান্ন …

ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। একগুচ্ছ বাঙালির ক্যালোর ব্যালোরে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

চারপাশের রুমগুলোয় সম্ভবত অনেক বাঙালি এসেছে, গামা গামা পরিবার-পরিজন সাথে নিয়ে। তারা বেড়াতে বেরোবে, সবাই তৈরি হচ্ছে – তারস্বরে বাক্যালাপ চলছে, হ্যাঁরে তোর বাদরুম এখনও হল না? আর কতক্ষণ ডাঁড়িয়ে থাগ্‌বো? ওদিকে তো বাস এসে গেল। আরে সুবল, তোদের পায়খানায় কি জল পড়ছে রে? এদিকের পায়খানাটায় ব্লা ব্লা ব্লা …

বুনানের আর নাক ডাকছে না, বুঝতে পারছি, বাইরের তর্জন গর্জনে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেছে, কেবল দায়িত্ব নিয়ে কেউ উঠতে পারছে না। … আমিই উঠলাম, বাইরে বেরিয়ে দেখি, ঠিক তাই, একগুচ্ছ বাঙালি, আটপৌরে শাড়ি পরা গোটা তিনেক বিভিন্ন বয়েসের মহিলা, লুঙ্গি এবং বার্মুডা পরা (দুটোই আমার দু চক্ষের বিষ) মুশকো গুঁপো কয়েকটা ছেলে, তাদের গায়ে গেঞ্জি, সোয়েটার, মাথায় মাফলার – এ ঘর সে ঘর করে বেড়াচ্ছে। আশেপাশের গোটা তিনেক রুমের দরজা হাট করে খোলা, তার মধ্যে দুটির ভেতর থেকে বিচিত্র স্বরে দাঁত মাজা এবং জিভ ছোলার আওয়াজ আসছে – একেবারে পুঁদিচ্চেরি কাণ্ড। এর মধ্যে একজন লুঙ্গি দেখি বালতি হাতে করিডরে যাতায়াত করছেন।

ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাকিদের ডেকে তুললাম। অর্পণ ঘুম থেকে উঠেই হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিল, এবং দিনের প্রথম স্টেটাস কল্‌ দেওয়া শুরু করে দিল। বাথরুমে ঢুকে দেখি সে বিচিত্র বাথরুম। কল দিয়ে জল পড়ে না, বেসিনে পড়ে, তবে গরম জল নেই, মানে গীজার কাজ করছে না। এত সকালে চান করার কোনও মানেই হয় না – তবে মুখ টুখ তো ধুতে হবে। প্রথমে রিসেপশনে দুবার ফোন করলাম, কেউ এল না, অগত্যা ঠাণ্ডা জলেই দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ফেললাম। এর পরে অর্পণ বাথরুমে ঢুকেই বেরিয়ে এল কলের মুখটা হাতে নিয়ে – সে নাকি জোর করে কলটা খুলতে গেছিল, জল তো পড়েই নি, মুখটা আলগা হয়ে খুলে চলে এসেছে, আর লাগছে না।

অগত্যা, নিচে গিয়ে তাগাদা লাগিয়ে এলাম। সুবিশাল বাঙালি গ্রুপ তখন রিসেপশনে ভিড় জমিয়েছে, তাদের বাস এসে গেছে, বেড়াতে যাবে। রিসেপশন থেকে একটা ছেলেকে পাঠাল, সে ছেলেও আমাদের বাথরুমে বিস্তর কোস্তাকুস্তি করে না গরম জল বের করতে পারল, না কলের মুখ লাগিয়ে দিতে পারল। অগত্যা আমিই তাকে বললাম, অন্য কোনও রুম খালি থাকলে একটু খুলে দাও, আমরা বাথরুমটা ইউজ করব। … তা সে খুলেও দিল, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের সকলেরই বাথরুমের কাজ শেষ – মানে, এত সকালে চান করার তো প্রশ্নই আসে না, সবে ভোর সাড়ে আটটা বাজে – বাকি কাজ সব কমপ্লিট। আমরা নিচে নেমে এলাম।

সামনেই মিষ্টির দোকান, একটু কাজু বরফি কেনা হল, রাস্তায় খাবার জন্য, পাশে চায়ের ঠেলা, সেখানে দাঁড়িয়ে চা খেলাম। ধীরেসুস্থে সোয়া নটা নাগাদ গাড়ি বের করে আমরা বেরোলাম। জিপিএসে যদিও দেখে নিয়েছিলাম রুটটা – তা, বুনান বলল, সে এর আগেও উত্তরকাশী গেছে, ও রুট চেনে, এখান থেকে দেবপ্রয়াগ হয়ে শ্রীনগর হয়ে (এটা উত্তরাখণ্ডের শ্রীনগর) যেতে হয়। শ্রীনগরের পরে জিপিএস অন করলেও হবে।

খুব ভালো কথা। হরিদ্বার থেকে বেরিয়ে পড়লাম। একটু এগোতেই রাস্তার দুপাশে বেশ জঙ্গল এলাকা শুরু হল, বুনান বলল, এটাই নাকি রাজাজি ন্যাশানাল পার্ক। সেটা পেরোতেই আবার লোকবসতি শুরু হল, একটা রাস্তা ‘দেরাদুন’ লেখা – বাঁদিকে বেঁকে গেল, আমরা সোজা রাস্তা ধরে হৃষিকেশ ঢুকে গেলাম। খানিক পরেই পেরিয়ে গেলাম লছমনঝুলা, বিশাল চওড়া গঙ্গা নাচতে নাচতে চলেছে। হরিদ্বার, হৃষিকেশ – জায়গাগুলো খুবই ভালো সন্দেহ নেই, কেবল এখানে পিওর ভেজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ফেরার সময়ে আমাদের আবার হরিদ্বারে থাকতে হবে, একবেলা কীভাবে ভেজ খেয়ে থাকব, সেই ভেবে যাবার সময়েও চিন্তায় পড়ে গেলাম, বুনান একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, চাপ নিও না, আমি একটা জায়গা জানি, যেখানে গুছিয়ে নন ভেজ পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে খেয়ে আসব।

বেশ অনেকটা চালাবার পরে পৌঁছলাম একটা ফাটাফাটি সুন্দর জায়গায়, জায়গাটার নাম দেবপ্রয়াগ। সামনে একটা খাদের মধ্যে গঙ্গার বুকে এসে মিশেছে অলকানন্দা, দু রকমের জলের রঙ, সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

dsc_0002

খানিক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই বুনানের কাছে ফোন এল প্রেমের। প্রেম, মানে আমাদের ট্রেকিং গাইড। তাকে জানানো হল যে আমরা দেবপ্রয়াগে পৌঁছেছি, শ্রীনগর পৌঁছে তাকে খবর দেব। প্রেম, মনে হল একটু চিন্তায় পড়েছে। বলল, আপনারা তো বেশি ঘোরা রুট নিয়েছেন, একটা শর্ট রুট ছিল, তাতে করে পঞ্চাশ কিলোমিটার কম পড়ত রাস্তা। যাই হোক, শ্রীনগর পৌঁছে ফোন করে দেবেন।

গাড়ি চলেছে, চলেছে, সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে ওপরে উঠছে, নিচে নামছে, এই করে আমরা মোটামুটি বেলা একটা নাগাদ শ্রীনগরে এসে পৌঁছলাম। শুরুর সময়ে ওডোমিটারের রিডিং দেখি নি, তবে আন্দাজ সোয়া শো কিলোমিটার তো এসে গেছিই, আর খুব বেশি হলে আশি কিলোমিটার মত রাস্তা বাকি আছে। এইবারে জিপিএস অন করি।

অলকানন্দা নদীর ওপর ছোট্ট ব্রিজ, ব্রিজ পেরিয়েই দুদিকে দুই রাস্তা বেঁকে গেছে, বাঁদিকের রাস্তায় লেখা – শ্রীনগর। গাড়ি সাইড করে জিপিএস অন করতেই চক্ষু চড়কগাছ!

জিপিএস বলছে, উত্তরকাশী থেকে আমরা এখন রয়েছি একশো আটানব্বই কিলোমিটার দূরে, এবং – আমাদের যেতে হবে উল্টোদিকে, যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকেই পয়েন্ট করছে ম্যাপ। মানে, আমরা কিনা সকাল থেকে এক ইঞ্চিও এগোই নি? তড়িঘড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুটো লোককে জিজ্ঞেস করলাম, তারাও খুবই কনফিউজড হয়ে উল্টোদিকেই হাত দেখাল।

গাড়ি ঘোরালাম। উল্টোদিকে মানে, কতদূর যেতে হবে? কোনও কাট কি আমরা মিস করে গেছি? জিপিএসে পুরো রুটটা এইবারে ভালো করে মন দিয়ে দেখলাম – রাস্তা যাচ্ছে টিহরি ড্যামের পাশ দিয়ে – নিউ টিহরি বলে একটা গ্রাম পড়বে – যেটা মোটামুটি মাঝামাঝি, এখান থেকে একশো কিলোমিটারের মাথায়, সেটা ছাড়িয়ে চাম্বা, সেখান থেকে উত্তরকাশী যাবার রুট। এইবারে মনে পড়ল, দেবপ্রয়াগ ছাড়াবার পরেই বাঁদিকে একটা রাস্তা দেখেছিলাম নিউ টিহরি লেখা, সে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার আগে, আমরা সেটা না নিয়ে সোজা এসেছি শ্রীনগরের দিকে। তার মানে সেই অবধি পৌঁছতে হবে।

আমাদের সবারই মুখ চুন প্রায় – নেহাত গাড়িতে পর্যাপ্ত তেল আছে, আর সবে দুপুর একটা বাজে, এখন নতুন করে আবার দুশো কিলোমিটার পাড়ি দিতে গেলে সন্ধ্যে ছটার মধ্যে আরামসে পৌঁছে যেতে পারব, সন্ধ্যে হবার মুখেই।

এগনো গেল, অবিশ্যি দেবপ্রয়াগ অবশি যেতে হল না, তার আগেই ডাইভার্সন পেয়ে গেলাম, সোজা রাস্তা পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে নিউ টিহরি গ্রামের দিকে। আর জিপিএস বন্ধ রাখার প্রশ্নই নেই, গাড়ি চালাতে থাকলাম। অনেকখানি আসার পরে চোখে পড়ল গঙ্গা – ক্রমশ চওড়া হচ্ছে ওপরের দিকে, আর চারপাশে কংক্রিটের কাজ। এখানে অবশ্য গঙ্গার নাম ভাগীরথী। আরও খানিক এগিয়ে বুঝলাম, আসল নদী নয়, নদীর জল বাঁধ দিয়ে এই হচ্ছে টিহরি ড্যামের শুরু। ভারতের বৃহত্তম ড্যাম এটা। চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার, আর তেমনি নীলচে সবুজ জল। পড়ন্ত দুপুরের সূর্যের আলো পড়ে আরও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। একটা জায়গায় গাড়ি থামাতেই হল, টিহরি ড্যামের ছবি তোলার জন্য। খানিক ফটো তুলে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম, কিন্তু ড্যাম শেষই হয় না, ক্রমশ আরও চওড়া হচ্ছে, আরও চওড়া। তার পরে এক জায়গায় দেখি ড্যাম সরু হয়ে এসেছে, আর রাস্তা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে – রাস্তা বলেই কিছু নেই, ধূলো আর বোল্ডারের ওপর দিয়ে চলা। জিপিএস কিন্তু রাস্তা দেখাচ্ছে, খানিক এগোতেই ছোট্ট একটা ব্রিজ আমাদের ভাগীরথী পার করিয়ে দিল, এইবারে শুরু হল টিহরি ড্যামের অন্য দিক দিয়ে আমাদের ফিরতি যাত্রা। চারটে বাজে – রাস্তা খারাপ, সামনে এখনও সাতানব্বই কিলোমিটার, প্রেম আরও দু তিনবার ফোন করেছে বুনানকে, বলেছে ল্যাম্ব গাঁও এলে যেন ওকে একবার ফোন করে দেয়, ওখান থেকে উত্তরকাশী কাছেই।

খিদে পেয়েছে, লান্‌চ হয় নি, সকালে কেনা কাজু বরফি দিয়েই চলেছে মোটামুটি। একটু এগোবার পরে খারাপ রাস্তা শেষ হল, আর আবার সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা শুরু হল। একটা সময়ে আমরা চাম্বা এসে পৌঁছলাম – সেখানে দেখি ডানদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে ধারাসু বেন্ড হয়ে উত্তরকাশী, আর বাঁদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে হরিদ্বার হৃষিকেশ। বোঝো কাণ্ড! হৃষিকেশ নাকি এখান থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার? আমরা তার মানে শুরু থেকেই ভুল রাস্তায় চলেছি? সব ব্যাটা বুনানের ওভার-কনফিডেন্সের ফল।

ধারাসু বেন্ড মানে, রাস্তাটা ওখানে চুলের কাঁটার মত বেঁকে গিয়ে অন্য এন এইচে উঠেছে। ধারাসু একটা ছোট গ্রামের নাম। জিপিএস বলছে এটা এন এইচ নাইন্টি ফাইভ, কিন্তু রাস্তার বোর্ড, মাইলস্টোনে সর্বত্র দেখছি লেখা আছে এন এইচ থার্টি ফোর। এটা কী রকম হল? এন এইচ চৌত্রিশ তো জানি কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যায়! আমরা বাই এনি চান্স শিলিগুড়ির দিকে যাচ্ছি না তো? না, বোর্ডে তো লেখা উত্তরকাশি পঁয়ষট্টি কিলোমিটার।

ধারাসু বেন্ড আসার আগে একটা ছোট গ্রাম, কামান্দ, সেখানে দাঁড়ালাম চা খাবার জন্য। কোনওরকমে এক গ্লাস করে চা চোঁ চোঁ করে মেরে দিয়ে বুনান আর অর্পণ দৌড় লাগালো ইসের খোঁজে, সারাদিন জার্নি করার পর নাকি রাতে কয়েক গেলাস ইসে না হলে ওদের চলবে না। আমি ধীরেসুস্থে গাড়ির কাচ-আয়না মুছে আবার স্টার্ট করে বাজারের শেষপ্রান্ত থেকে দুই মূর্তিমানকে তুলে নিয়ে এগোলাম।

ধারাসু বেন্ড আসতেই রাস্তাটা ঘুরে গেল, আর শুরু হল এন এইচ একশো আট। ওরেবাবা, সে কী রাস্তা। জায়গায় জায়গায় বোল্ডার, ভাঙা রাস্তা, আবার জায়গায় জায়গায় বেশ পরিষ্কার রাস্তা। কোথাও কোথাও অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে আজ দুপুরেই এখানে ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে। বুনান খানিকক্ষণ দেখে গম্ভীরভাবে বলল – রাস্তাটা স্পেশাল, এটা পার্টলি এন এইচ, আর পার্টলি ‘একশো আট’। দুটো একসঙ্গে কোনওমতেই নয়। … মনে ধরে গেল কথাটা। এর পর যখনই ভাঙা রাস্তা শুরু হয়, আমরা সমস্বরে বলি, এই একশো আট শুরু হল, আবার ভালো রাস্তা পেলেই – এই এন এইচ শুরু হল।

সবই হল, কিন্তু ল্যাম্ব গাঁও কোথাও পেলাম না। প্রেমকে ফোন করব কী করে? ঠিক হল, মাইলস্টোনে যখনই দেখাবে উত্তরকাশী আর পাঁচ কি সাত কিলোমিটার, আমরা প্রেমকে ফোন করব। উত্তরকাশীই যখন এসে যাচ্ছি, আর ল্যাম্ব গাঁও কি মাটন গাঁও দেখে কী করব? এমনিতেই এইসব নাম শুনলে আমার প্রচণ্ড খিদে পায়, তার ওপরে দুপুরে কাজু বরফি খেয়ে খিদে মেটাতে হয়েছে।

প্রেম বুনানের পূর্বপরিচিত, ওরা একসাথে এর আগেও ট্রেক করেছে, তাই উত্তরকাশী ঢোকার মুখে প্রেমকে পিক আপ করে নিতে অসুবিধে হল না। রোগাসোগা একজন লোক, এ কিনা পীক টিকে উঠে ঘুরে এসেছে? তাও এক নয়, একাধিকবার? মুখ দেখে সন্দেহ হচ্ছিল, তা প্রেম নিজেই খোলসা করে দিল – সে আসলে নেপালী, কেবল জন্ম আর বেড়ে ওঠা উত্তরকাশীতে। প্রচণ্ড খাতির করে প্রেম নিয়ে গেল হোটেল মন্দাকিনীতে, ভাগীরথীর একদম সামনেই। সুন্দর রুম, খানিক বসে হাত পা ছাড়িয়ে আবার প্রেমের সাথেই নেমে এলাম – একটু সামনেই প্রেমের ভাই আর ভাই-বৌয়ের দোকান, সেইখানে আমাদের ডিনারের ক্ষুদ্র আয়োজন। বুনান সমানে জিজ্ঞেস করছে, প্রেম ভাইয়া, চিকেন টিকেন হ্যায় তো? আর প্রেম ছোট ছোট চোখদুটোকে আরও ছোট করে হাসছে, সবকুছ হ্যায় দুইপায়ন্দা (বুনানকে ওই নামেই ডাকে) বাকি সব ইন্তেজাম ভি হাম কার দেঙ্গে।

ঠান্ডা, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক কিছু নয় – আমরা টুক টুক করে হেঁটে সেই দোকানে গিয়ে অমৃতসমান মাংসের চাট আর রুটি খেলাম। সঙ্গে ডালও ছিল, কিন্তু অমন ডেলিসিয়াস চিকেন পেলে আর ডাল কে খায়? খেয়ে দেয়ে উঠে এক গ্লাস করে চা, তারপরে হোটেলে ফেরত।

এদিকে আমি ব্যাগের সাইড পকেটে একটা ছোট থামস আপের বোতলে করে খাবার জল এনেছিলাম, সেইটা দেখি আর নেই। কোথায় পড়ল? নিচে গিয়ে আবার গাড়িতে খুঁজে এলাম, না, গাড়িতেও নেই – ওপরে এসে দেখি, বুনান, অর্পণ আর প্রেম তিনজনেই গ্লাস সাজিয়ে বসেছে, আর তাদের সামনে, ঠিক আমার থামস আপের বোতলটার মতই একটা বোতল, তাতে লাল জল ভরা। অবিশ্যি সব থামস আপের বোতলই এক রকমের দেখতে হয়। সামনে প্রেম আছে, জিজ্ঞেসও করতে পারছি না, সবার চাপাচাপিতে এক গ্লাস লাল পানি নিয়ে আমিও বসলাম।

রামোঃ! কী অখদ্দে টেস্ট। লোকে যে কী সুখে এইসব খায়!

প্রেম চলে গেল খানিক বাদেই। কিন্তু কিন্তু করে আমি বোতলটার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম বুনানকে। ও মা, বুনান দেখি হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ওটা তো তোমার ব্যাগেরই সাইড পকেট থেকে নিইচি। হাফ লিটারের বোতল, ক্যারি করা সুবিধে হবে – এত বড় বোতল (আসল রাম-এর বোতলটার দিকে দেখিয়ে) নিয়ে ট্র্যাভেল করা চাপ হয়ে যায় না? তাই তোমার বোতলটা আমি নিয়ে নিয়েছি। তুমি চাপ নিচ্ছো কেন, আমার কাছে তো জলের বোতল আছে, তেষ্টা পেলেই খেয়ে নেবে।

আমি তখন মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছি। এক বিশেষ কারণে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর যাই করি, বুনানের দেওয়া জলের বোতল থেকে জল খাবো না – কিছুতেই না। অবশ্য, এখনও পর্যন্ত হোটেলে আছি, পাকা বাথরুম আছে, কিন্তু এর পর? আর হতভাগা বুনান কিনা প্রথম দিনেই আমার একমাত্র জলের বোতল ঝেড়ে দিল? তাতে রাম ঢেলে দিল?

রাগ করে আর দ্বিতীয় গেলাস নিলাম না। একে তো ওই পচা টেস্ট, তার ওপর কিনা আমার জলের বোতল ঝেড়ে দেওয়া? ওচ্চেয়ে গুলতানি মারা ভালো। বুনান অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, ধীরেসুস্থে চুমুক মারছে। কিন্তু বুনানের ছানা তো ঢকঢক করে খাচ্ছে আর পরের গ্লাস বানাচ্ছে। খানিক বাদেই যা হবার তাই হল। …

… তখন বোধ হয় বইটই নিয়ে খানিক নষ্টলজি হচ্ছিল। অর্পণ হঠাৎ খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে আমাকে বলল, আচ্ছা সিকিদা, জুল ভের্নের একটা বই পড়েছিলাম, তাতে একটা লোক সাবমেরিন চালাতো –

আমিঃ হুঁ, টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস

অর্পণঃ হ্যাঁ, কিন্তু গল্পটা শেষ হয়ে গেল, তারপরে ক্যাপ্টেন নিমোর কী হল, সেটা কোথাও লেখা নেই? নিমোর কী হল? সে কি বেঁচে রইল, না মরে গেল?

অর্পণ রীতিমত সিরিয়াস। হাল্কা করে জিজ্ঞেস করলাম, জুল ভের্নের সবকটা লেখা পড়েছিস?

অর্পণঃ না, সবকটা পড়া হয় নি – মানে কয়েকটাই পড়েছি।

আমিঃ তা হলে এক কাজ করিস, বাড়ি ফিরে জুল ভের্নের দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড বইটা খুঁজে নিয়ে পড়ে ফেলিস। ওতেই ক্যাপ্টেন নিমোর শেষটা আছে।

অর্পণ শুনে কী খুশি। আরও খানিকক্ষণ এতোল বেতোল বকে, তার যে একেবারেই নেশা হয় নি, সেটা প্রমাণ করে ধপাস করে শুল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।

সারাদিন ড্রাইভ করে আমিও এখন অল্প ক্লান্ত। ঘুমোতে হবে, তার আগে জামাকাপড় চেঞ্জ করতে হবে। প্যান্টুল খুলতে গিয়ে চমকে গেলাম – আমার রাতে পরার পাজামা কই?

ব্যাগ খুলে হাঁটকালাম, আঁতিপাঁতি খুঁজলাম, কিন্তু না – আমার সেই নীল পাজামা, যা পরে কিনা আমি কাল রাতেও হরিদ্বারের হোটেলে ঘুমিয়েছি এবং সকালে উঠে ছেড়েছি, তার দেখা নেই। তবে কি …?

সে রকমই মনে হল। সকালে বাথরুমে একটা বড় ক্যাও হয়েছিল, কল খুলে এসে গেছিল অর্পণের হাতে, গরম জল পাওয়া যাচ্ছিল না, এর পরেই আমি পাজামা ছেড়ে প্যান্টুল পরতে ঢুকেছিলাম বাথরুমে, তখনই রিসেপশনের ছেলেটা এসেছিল গীজার চেক করতে, আর আমি কোনওরকমে প্যান্ট পরেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মানে, পাজামা এখনও সেই হোটেলের বাথরুমেই দোল খাচ্ছে।

কী চাপ! পাজামা না হলে শোব কী করে? জিনস পরে ঘুমনো যায় নাকি? ফোন করলাম হরিদ্বারের হোটেলে, বললাম, এত নম্বর রুম, যদি একটা নীল রঙের পাজামা পায়, যেন রেখে দেয়, আমরা ফেরার পথে নিয়ে যাব।

আমার অবস্থা দেখে বুনানের দয়া হল – বলল, চিন্তা কোরো না, আমি একটা এক্সট্রা পাজামা এনেছিলাম, দ্যাখো ওটা পরে চালিয়ে নাও আপাতত।

তাই সই। বুনানের থেকে পাজামা নিলাম, এবং পরে ফেললাম। বুনান ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। আমারও ঘুম পাচ্ছে এবার বেজায় …

কিন্তু ঘুমোই তার জো আছে নাকি? কাল ছিল একা বুনান, আজ জুড়েছে অর্পণ। দুটো আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে আমার পাশ থেকেই ভেসে আসছে নাসিকাগর্জন। এ আর কাঁহাতক সহ্য হয়? খানিক এপাশ ওপাশ করে আমিও কালকের মতই গুণতে শুরু করলাম একষট্টি … বাষট্টি … পঁয়ষট্টি …

ঘুম এসে গেল খানিক বাদেই।


2 thoughts on “তালেগোলে হরিবোলে, দয়ারা বুগিয়ালেঃ দ্বিতীয় পর্ব

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.