পর্ব ১ , পর্ব ২ এবং পর্ব ৩-এর পরে …
ভোর হল। যদিও বুনান মানতে চাইছিল না ভোর হয়েছে। তিন দিন আগে পূর্ণিমা গেছে, কাল তাই চাঁদ একটু দেরিতে উঠেছিল, আর আজ সকালের আকাশেও তাই চাঁদকে এখনও দেখা যাচ্ছে – সে তখনও অস্ত যায় নি। বুনানের দাবি, আকাশে যতক্ষণ চাঁদকে দেখা যায়, ততক্ষণ রাত। সে ঘড়িতে যা টাইমই হোক না কেন। তবে ট্রেকে যাবার আগে আজই শেষ পাকা পায়খানা, তাই চাঁদ মাথায় নিয়েই টয়লেটে ঢুকতে হবে এবং হাল্কা হতে হবে। প্রকৃতির এই কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে বুনান অবশেষে লেপের তলা থেকে বেরোল।
ব্যাগগুলো রিশাফল করা হচ্ছে, বড় ব্যাগে অদরকারি জিনিস রেখে জাস্ট নিজেদের প্রয়োজনের জিনিস ছোট পিঠের ব্যাগে নিয়ে হাঁটা শুরু হবে এখান থেকে। বুনান বার বার করে বলেছিল জিনস পরে বেশিক্ষণ ট্রেক করা সম্ভব হবে না, আমি তাই আমার সেই জংলাছাপ কার্গো নিয়ে এসেছিলাম, সেইটা এবার পরে ফেলতে হবে। … কিন্তু সেটাই বা কোথায়? ছোট্ট ব্যাগ, সব জিনিস বের করে ফেললাম, কিন্তু আমার সেই জংলাছাপ কার্গো কোথাও নেই!
কেলো করেছে। এটাও কি হরিদ্বারে ফেলে এলাম নাকি? কী ঝামেলা! পেলাম না তো পেলামই না। অগত্যা, জিনস পরেই চলতে হবে। আমার অবশ্য এমনিতে তাতে কোনও অসুবিধে নেই, তবে কিনা আট কিলোমিটার … এমনিতেই হাঁটতে পারব কিনা, কে জানে!
গরম গরম আলু-জিরা তরকারি আর হাতরুটি সহ অমলেট দিয়ে বেকফাস্ট সারলাম। প্রেম আমাদের তিনজনকার হাতে ধরিয়ে দিল তিনটে পলিথিনের প্যাকেট, তাতে ভরা আপেল, কমলালেবু, আর টফি। বলল, রাস্তায় চলতে চলতে দরকার হলে খেতে। আর বলে দিল, পলিথিন যেন কোথাও ফেলবেন না, আপনাদের সঙ্গেই রাখবেন।

এর পরে আর সিগন্যাল থাকবে না মোবাইলে, তাই ঝটপট আমরা সবাই যে যার মত স্টেটাস কল সেরে নিলাম, অবশ্যই অর্পণ পর পর তিন চারখানা স্টেটাস কল করল ব্যাক টু ব্যাক।
আমাদের সঙ্গে যাবে কুক বিজেন্দর, পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেমের ভাগ্নে সন্তোষ, আর দুটি মালবাহক খচ্চর। খচ্চরের পিঠে মালপত্র বাঁধতে একটু সময় লাগবে, বুনান বলল, আমরা ততক্ষণে হাঁটা শুরু করি। তোমরা পরে ধরে নিও আমাদের।
নটা নাগাদ যাত্রা শুরু হল। যে বাড়িটায় আমরা ছিলাম, তার সামনেই খানিক উঁচু পর্যন্ত কংক্রিটের সিঁড়ি উঠে গেছে, এই পথ ধরেই আমাদের চলা শুরু।
চারটে স্টেপ উঠেই আমার কেমন হাঁফ ধরে গেল। এমনিতেই এখানে অক্সিজেন কম, তবে জানি না সেইজন্যেই কিনা – বাকিদের অবশ্য কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। এক মিনিট দাঁড়িয়ে দম নিয়ে আবার উঠলাম – আবার খানিক বাদেই হাঁফ ধরে গেল।
বুনান আর অর্পণ খানিক ওপরে উঠে পড়েছিল টুক টুক করে, এখন ওরা পেছনে ফিরে আমার অবস্থা দেখে দাঁড়াল। আমি ধীরেসুস্থে ওদের কাছে পৌঁছলাম। সিঁড়িগুলো পেরনো গেছে, এইবারে পায়ে চলা রাস্তা। আর কোনও ফর্মাল রাস্তা নেই। খানিকটা সমতল এলাকা – একসঙ্গেই পেরোলাম, তারপরে আবার চড়াই। খুব খাড়া চড়াই কিছু নয়, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম আমি পারছি না টানতে – হাপরের মত বুকে পিটছে, চোখের সামনে দেখছি অজস্র ঝুলন্ত লালসুতো-নীলসুতো, গলা শুকিয়ে কাঠ, ইচ্ছেশক্তির শেষসীমায় পৌঁছে আবার কয়েক পা চললাম – নাহ, মনে হচ্ছে বুক ফেটে যাবে।
অসহায় হয়ে একবার সামনে এগিয়ে যাওয়া বুনান আর অর্পণদের দিকে, একবার পেছন দিকে ফিরলাম। নিচেই রায়থাল গ্রাম দেখা যাচ্ছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, এত কাছে। কী করব? আট কিলোমিটার তো অনেক দূর – আমি এক কিলোমিটারও এগোই নি। নেমে যাবো রায়থালের দিকে? এতটা কাছে এসে দয়ারা বুগিয়াল দেখা হবে না? পারব না, সত্যিই?
সত্যিই পারছিলাম না। মাথা ভারী হয়ে যাচ্ছে, বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে, গায়ের মধ্যে যেন অজস্র পিন ফুটছে। লাগাতার। অথচ পায়ে ব্যথা হয় নি – হবার কথাও না, দু তিন কিলোমিটার একটানা চলবার অভ্যেস আমার আছে। কিন্তু কিছুতেই এগোতে পারছি না কেন?
সামনে একটু উঁচু থেকে বুনান বলছে, এই তো – এটুকু উঠে এসো, এখানে উঠে এসে দুজনে মিলে খানিক হ্যা হ্যা করব, তারপর এগবো। বুঝতে পারছি আমাকে বুস্ট আপ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওটুকু ওঠবার মত শক্তি আমার হৃৎপিণ্ডে আর নেই, শুনতে পাচ্ছি ওর কথা, ঘাড় নাড়ছি, কিন্তু অপেক্ষা করছি কতক্ষণে হার্টবীট নর্মাল হবে, তারপরে পরের স্টেপ ফেলব।
হার্টবীট কমল, যতক্ষণে বুনানের জায়গায় পৌঁছলাম, ততক্ষণে বুনান চলে গেছে আরো একটু উঁচুতে। অর্পণ রইল আমার সাথে। দুজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা এতটুকু হাঁফায় নি, সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার সময়ের মতই ফ্রেশ আছে দুজনে।
এক কিলোমিটার কি এসেছি? এসেছি বোধ হয়। সন্তোষ ছিল আমাদের সাথে, বলল, জ্যাকেটটা খুলে দিন, হাল্কা লাগবে। মুখে বললাম বটে, জ্যাকেটের জন্য আলাদা করে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না – নিজের শরীরের ওজন তো খুব একটা বেশি নয়, তাই এই ধরণের অসুবিধে কখনও হয় নি আগে। তবে, জ্যাকেটটা খুলে দিলাম। সতেরো আঠেরো বছরের ছেলেটা, ইতিমধ্যেই তার পিঠে ইয়াব্বড়ো একটা ব্যাগ নিয়ে হাল্কা চালে উঠছে আমাদের সাথে, এই রায়থালের কাছেই একটা কলেজে পড়ে, তার কাঁধে চাপিয়ে দিলাম আমার জ্যাকেটটা।
যদিও তাতেও কোনও সুবিধে হল না। অর্পণ আর সন্তোষ থেমে থেমে চলতে লাগল আমার সাথে বুনান ছবি তুলতে তুলতে আর শিস দিতে দিতে ওপরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল – অবশ্য খুব দূরে যায় নি। বেজায় এমব্যারাসিং লাগছিল, আমার কারণে এতগুলো লোককে তাদের চলার স্বাভাবিক ছন্দ থেকে বঞ্চিত করছি – আমি তা হলে বোধ হয় বুড়ো হয়েই গেলাম।
… নাকি ফুসফুসের সমস্যা? আমার ফুসফুসের তিন ভাগের একভাগ নষ্ট চিরতরে। সেটাই কি কারণ? কিন্তু না, আমার দম তার আগেও আর পাঁচজনের থেকে কম ছিল। কম দম নিয়ে শয়ে শয়ে কিলোমিটার বাইক বা গাড়ি চালানোটা জাস্ট কোনও ব্যাপারই না, কিন্তু ফিজিকাল এক্সারসাইজের ক্ষেত্রে আমি চিরকালই পেছনের সারির ছেলে।
পেছনে নিচের দিক থেকে টুং টুং ঘন্টার আওয়াজ পাচ্ছি, প্রেম আসছে খচ্চরগুলোকে নিয়ে। সঙ্গে বিজেন্দর। দেড় কিলোমিটার বোধ হয় চলেছি এতক্ষণে। প্রেম আসতে আসতে হাঁচোড় পাঁচোড় করে মেরে দিলাম আরও পাঁচশো মিটার মত। একটু ছোট্ট সমতল জায়গা। বসে পড়লাম একটা পাথরের ওপর। খানিক বাদেই প্রেম এল। বিজেন্দর খচ্চরগুলোকে নিয়ে এগিয়ে গেল, প্রেম বসল আমার পাশে। বুনান দেখলাম নেমে এসেছে ওপর থেকে – সে প্রেমকে ডেকে নিয়ে আবার ওপরে গিয়ে কী কথা বলল টলল, বোধ হয় আমার মুণ্ডপাতই করছিল। হেব্বি এমব্যারাসিং ব্যাপার স্যাপার, কিন্তু কিছু করারও নেই। কুল্লে দু কিলোমিটার এসেছি, এগারোটা বাজে। এই রেটে চললে পৌঁছে তো যাবো আজকের গন্তব্যে, কিন্তু সূর্যাস্ত নাগাদ, এদিকে বাকিরা হয় তো আর দুত্তিন ঘন্টাতেই পৌঁছে যাবার ক্ষমতা রাখে। খামোকা তারা আমার জন্য সারাদিন নষ্ট করবে নাকি?
আজ আমাদের গন্তব্য গোই। দয়ারা বুগিয়ালের রাস্তায় মাঝপথে পড়ে একটা ছোট সমতল জায়গায়। সেখানেই আজ আমাদের রাত্রিবাস হবে।
প্রেম আবার ফিরে এল আমার কাছে। জিজ্ঞেস করল, যেতে পারবেন বলে তো মনে হচ্ছে না, নাকি?
আমি অসহায়ভাবে মাথা নাড়লাম দু দিকে।
প্রেম বলল, ঘোড়া বলব? ঘোড়ায় চেপে যেতে পারবেন?
পারব, আমি বললাম। ঘোড়ায় চড়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে দু-দুবার, একবার বৈষ্ণোদেবী থেকে ফেরার সময়ে চোদ্দ কিলোমিটার, একবার লাদাখ যাবার পথে – সোনমার্গ থেকে মন্দাকিনী গ্লেসিয়ার এবং ফেরত, নয় নয় আঠেরো কিলোমিটার। খুব অসম্ভব কিছু ব্যাপার নয় ঘোড়ায় চড়া।
আমরা রায়থাল থেকে এখনও বেশিদূরে আসি নি, চাইলে ঘোড়া আনিয়ে নিতে পারি। প্রেম আবারও বলল, তবে পাওয়া যাবে কিনা শিওর নই, এখন তো ঘোড়া ভাড়া নেবার সীজন নয়।
কী বলব? চুপ করে রইলাম। প্রেমকেও অস্বস্তিতে ফেলেছি, বুঝতে পারছি।
আমার মোবাইলে আর সিগন্যাল নেই, প্রেমের বিএসএনএল, তার সিগন্যাল আছে। ফোন করল, গাড়োয়ালি ভাষায় কার সঙ্গে যেন কথা বলল খানিকক্ষণ, তার পরে ফোন রেখে আমার দিকে একটু তাকিয়ে রইল – তারপরে বলল, ঘোড়া পাওয়া যাবে, তবে একটা নয়, দুটো নিতে হবে, তবেই পাওয়া যাবে।
মানে, দুগুণ টাকা?
না – পুরো দুগুণ হয় তো নেবে না, তবে দেড়গুণ তো নেবেই। থাক, একটা ঘোড়া বাড়তি থাকলে সুবিধেই হবে, অন্য কেউ দরকার হলে দ্বিতীয় ঘোড়াটা ইউজ করতে পারবে। … হ্যাঁ বলে দেব?
অবশ্যই। না বলার তো আর কোনও প্রশ্নই নেই। টাকাপয়সার চিন্তা এক্ষুনি করে তো লাভ নেই। আর বেশি হাঁটতে গেলে আমি নির্ঘাৎ হৃদ্পিণ্ড ফেটে মরে যাবো, এত চাপ পড়ছে বুকে।
প্রেম বোধ হয় ফোন করে কনফার্ম করল ঘোড়ার ব্যাপারে। আরও একটা দুটো ফোন করল। আমি পলিথিনের প্যাকেট খুলে একটা টফি মুখে পুরলাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছপালা জঙ্গল আর পাথরের সমারোহ, হঠাৎ করে সেই জঙ্গল ফুঁড়ে একটা লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে, তার হাতে ধরা একটা রঙীন মোরগ। আমাদের সামনে নামিয়ে রাখল সেটা। প্রেম আমার দিকে তাকিয়ে এইবারে একগাল হেসে বলল, আগের দিন আপনাদের ব্রয়লার খাইয়েছিলাম, এটা দেশি মুর্গা। আরও টেস্টি।
গুরু, সে আর বলতে? বরফ যদি না-ও পাই, শুধু এই দেশি মুরগির ঝোল খাবার জন্যেই আমাকে দয়ারা পৌঁছতে হবে। এ প্রেম বোধ হয় আমাদের খাইয়ে খাইয়েই মেরে দেবে।
মুরগিটা বেজায় বড়সড় সাইজের, প্রায় পাঁচ কিলো ওজন তো হবেই। ওপর থেকে দেখি বুনান আর অর্পণও নেমে এসেছে। ওরাও মুরগি দেখে ডবোল উল্লসিত হয়ে গেল। ওদের জানানো হল ঘোড়া আসবার খবর। ভালো কথা, বুনান বলল, আর একটু তো ততক্ষণ হেঁটে নাও, ঘোড়া আসতে আসতে, একটু ওপর থেকেই রাস্তার ওপরে বরফ জমে রয়েছে – সেখান পর্যন্ত তো হাঁটো। আমি তো ওখান থেকে নেমে এলাম তোমাকে নিয়ে যাবো বলে।
বুনানকে সম্মান জানাতেই আমি উঠে পড়লাম। অনেকক্ষণ রেস্ট নেওয়া হয়েছে, এখন আর অতটা অস্বস্তি হচ্ছে না। ওয়াকিং স্টিক হাতে নিয়ে এগোলাম। ধাতস্থ লাগছে। বুনান পাশেই ছিল, বলল, ও কোনও ব্যাপার না, কখনও পাহাড়ী রাস্তায় ট্রেক করো নি তো, আজকের দিনটাই চাপ যাবে, কাল থেকে দেখবে আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
খানিক ওপরে উঠে অবশ্য সত্যিই রাস্তার ধারে একটু আধটু বরফের প্যাচ দেখতে পেলাম, হাল্কা ফ্রস্টের লেয়ার। তবে ততক্ষণে আবার পুরনো সিম্পটম ফিরে এসেছে, দম বেরিয়ে যাচ্ছে, চোখে প্রায় সর্ষেফুল দেখছি।
আবার থামলাম। অর্পণও থামল। খানিক বাদে নিচ থেকে প্রেম এসে বলল, ঘোড়া রওনা দিয়েছে রায়থাল থেকে দশ মিনিটে এসে যাবে, আমি সিকিস্যারকে নিয়ে এখানেই দাঁড়াচ্ছি, অর্পণস্যার আপনি সন্তোষের সাথে এগোতে থাকুন, একটু ওপরেই দুইপায়নদা আছেন।
ঘোড়া এল অবশ্য প্রায় চল্লিশ মিনিট বাদে। ততক্ষণে আমি মোবাইল বের করে দেখে নিয়েছি এখানে হাল্কা সিগন্যাল আসছে এয়ারটেলের, বোধ হয় অনেকটা ওপরে চলে এসেছি, দূরের কোনও টাওয়ার থেকে সিগন্যাল পাচ্ছে, একটা দুটো কল সেরে নিলাম। কুল্লে বোধ হয় তিন কিলোমিটার এসেছি সকাল থেকে. এখনও পাঁচ কিলোমিটার বাকি।
এর পর ঘোড়া এল, ঘোড়া মানে খচ্চর আর কি, পাহাড়ী খচ্চর। সঙ্গে দুটি লোক, এবং আরও খানিক খাবার দাবার। এই লোকগুলো এবং বাড়তি দুটো খচ্চর আগামী তিনদিন আমাদের সাথে থাকবে, তাদের রসদও ক্যারি করতে হবে বই কি। আমি অনায়াসেই খচ্চরের পিঠে চড়ে বসলাম, অন্যটার পিঠে উঠল প্রেম, আর খচ্চরওয়ালারা পাশে হাঁটতে হাঁটতে চলল। আমার খচ্চরটা একটু বেআদব টাইপের ছিল, তাই প্রায়ই মালিকের জোরদার বকুনি ধমক খাচ্ছিল – অ্যা্য় চল্ চল্ চল্, তার পরেই একটা অধৈর্য মত উঁচুর দিকে সুর করে – ইরেএএএএ খাচরাআআআআ। কয়েকবার শোনার পর আমিও টোনটা তুলে নিলাম, নেহাত নিজের খচ্চর নয়, তাই গালাগালটা না দিয়ে শুধু দেখলাম, চল্ চল্ চল্ বললেই খচ্চর চলে, আর সামনে ঘাস বা গাছের পাতা পেলেই চলতে ভুলে গিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন আবার চল্ চল্ চল্ বলে চলার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়।
ক্রমশ রাস্তা আরও খাড়া হতে শুরু করল, রাস্তা তেমন কিছু নয়, পুরোটাই পায়ে চলা একটা ট্রেল, সেইখানে পাথর টপকে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি টপকে আমাকে নিয়ে চলতে খচ্চরেরও বেশ কষ্ট হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম, খানিক উঠে তারপরে ব্ররররররর ব্ররররররররর করে আওয়াজ করে দম নিচ্ছিল।
আরেকটু উঠতেই চারদিকে বরফের রাজত্ব শুরু হল। যেদিকে চোখ যায়, শুধু বরফের প্যাচে ঢাকা পাহাড়। লোকগুলো অবলীলায় তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকল, পিঠে মালপত্তর এবং আমাকে নিয়ে খচ্চরগুলোও খচমচ করতে করতে চলল বরফে ঢাকা রাস্তার ওপর দিয়ে। ইচ্ছে হচ্ছিল না তা নয় – একটু বরফের ওপর দিয়ে নিজেও চলতে, তা প্রেম বলল, এর পরে শুধুই বরফ, বরফে চলার অনেক সুযোগ জুটবে এর পরে, পরে হেঁটে নেবেন।
আরো খানিক এগোতেই দেখা পেলাম বুনান আর অর্পণের, ওরা খানিকক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছে। আর তার ঠিক দুশো মিটার সামনেই আমাদের সামনে দেখা গেল বরফে ঘেরা সবুজ এক টুকরো গালিচা, আমাদের আজকের গন্তব্য, গোই।
ঘোড়া, মানে খচ্চরগুলোকে আনলোড করা হল, আর ছেড়ে দেওয়া হল চরে খাবার জন্য। প্রেম, বিজেন্দর, আর খচ্চরওয়ালা মিলে অপরিসীম দ্রুততায় খাটিয়ে ফেলল একটা টেন্ট। সেইখানেই আমাদের শোবার জায়গা। আর বাকিদের জন্য?
সামনে পর পর কয়েকটা কাঠপাথরের কুঁড়েঘর টাইপের, ওপরে খড়ের চাল, তার ওপরে পুরু হয়ে বরফ জমে আছে, এইখানেই থাকবে প্রেম, বিজেন্দর, সন্তোষ, খচ্চরওয়ালা ইত্যাদিরা।
তাড়াতাড়ি কাঠাকুটো কুড়িয়ে এনে বন ফায়ার স্টাইলে আগুন জ্বালিয়ে ফেলল বিজেন্দর, আরও দুজন লেগে পড়ল মুরগী কাটাকুটিতে, সঙ্গে কেরোসিনের স্টোভও এসেছিল, আমরা চারপাশে একটু শোভা দেখে ছবি তুলে টেন্টে ঢুকে জুতো খুলতে না খুলতেই প্রথমে চলে এল মশলা দেওয়া এক এক বাটি ম্যাগি – আহা ম্যাগি, তোমা বিনে পাহাড় অচল। তার পরে এল চা আর ওই ইয়াব্বড়ো মুরগিটার মেটেভাজা। বুনান আর অর্পণ গেলাস সাজিয়ে বসল, একটা কুড়কুড়ে আর একটা কাজুবাদামের প্যাকেট খোলা হল, তার আগে চা খেয়ে একটা টফি আর একটা গোটা কমলালেবু খেয়ে বুনান আর অর্পণ বসল লাল পানি খেতে। আমিও এক গ্লাস পেলাম।
এদিকে বুনানের খাবার গতিপ্রকৃতি দেখে আমি তো হাঁ হয়ে যাচ্ছি। মেটেভাজা খাবার আগে বিজেন্দরের কাছ থেকে চারখানা কাঁচালঙ্কা চেয়ে আনল, এবং কচকচ করে চারটে লম্বা লম্বা কাঁচালঙ্কা একাই খেয়ে নিল। মানুষ না টিয়াপাখি রে বাবা? অবিশ্যি বাঙালও হতে পারে। অর্পণ তিন গ্লাস খেয়েই খুব খুশি হয়ে স্টেটাস কল দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল আমাদের কারুর মোবাইলেই আর সিগন্যাল নেই। তখন ও গেল খচ্চরওলার কাছে – তার আইডিয়ার ফোনে নাকি কোন টাওয়ার থেকে এক দাঁড়ির সিগন্যাল আসছে। সে খচ্চরওলার ফোন প্রায় ছিনতাই করে বউকে স্টেটাস কল দেওয়া শুরু করল – সামনে শ্রীকণ্ঠ পিক দেখা যাচ্ছে, এদিকে বান্দরপুঞ্ছ, ওদিকে ডিকেডি, ক্লিয়ার আকাশ, না, তেমন ঠাণ্ডা নেই – এইসব।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে এল, ঠাণ্ডা বাড়ল, আমরা গোল হয়ে গিয়ে বসলাম বন্-ফায়ারের চারপাশে। আকাশে ফুটে উঠল একটা দুটো করে হাজার হাজার তারা। স্পষ্ট দেখলাম এক নোম্যাডকে, এক হাতে ধনুক নিয়ে শিকারের প্রতীক্ষায়, কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে তলোয়ার। কালপুরুষ। পায়ের কাছে ঝকঝক করছে লুব্ধক। সিরিয়াস। তাদের প্রতিফলিত আলোয় নীলচে হয়ে আছে চারপাশের বরফ। শুধু খচ্চরগুলোর কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, দেখে দেখে অভ্যস্ত বোধ হয় – একমনে ঘাস আর বরফ খেয়ে যেতে থাকল।
রান্না বা খাবার জন্য জলের সোর্স এখানে আলাদা করে পাওয়া যায় না। চারপাশে যত বরফ জমে আছে, প্লেটে করে চেঁছে চেঁছে টিনে ভরো, আর সেই টিনকে দাঁড় করিয়ে দাও বন্-ফায়ারের পাশে, খানিকক্ষণের মধ্যেই তা রূপান্তরিত হয়ে যাবে ঈষদুষ্ণ জলে। সেই জলেই রান্না, সেই জলেই পান-ভোজন, তাতে কতটা ঘাস মিশে আছে আর কতটা নোংরা – সন্ধ্যের অন্ধকারে কে দেখছে?
সাতটার মধ্যেই ডিনার তৈরি। আজকের চিকেনটা কালকের থেকেও উমদা খেতে হয়েছে। তবে বুনান খেল না, তার পেটে সমস্যা। হবে না? পর পর চা, কমলালেবু, নিমকি, কাজুবাদাম, মেটেভাজা, টফি এবং রাম একসাথে পেটে ঢোকালে পেটের আর দোষ কী?
সকালে যে হাঁসফাঁস অবস্থা হয়েছিল চড়াই ভাঙতে গিয়ে, এখন আর তার লেশমাত্রও নেই। এতটুকুও ক্লান্ত লাগছে না। ঘুম আসছে না। মনে আরেকটা চাপ রয়েছে। পরের দিনের নিত্যক্রিয়াটা কীভাবে সম্পন্ন হবে – না আছে ল্যাট্রিন, না আছে ভালো দেখে একটা মগ, ওই বোতল দিয়ে কাজকম্মো যে আদৌ কীভাবে চালায় … যতক্ষণ পারি চেপে রাখা প্যাকটিস করতে হবে।