পর্ব ১ , পর্ব ২ , পর্ব ৩ , পর্ব ৪ এবং পর্ব ৫ -এর পরে …
সকাল হল একটা ঝকঝকে নীল আকাশের প্রান্তে গোলাপি কমলা আভা দিয়ে। আজ একত্রিশে ডিসেম্বর। সোনালী রোদ এসে পড়ছে এক এক করে পাহাড়চূড়োয়। আজ আমাদের ফিরে যাওয়া, স্বর্গ থেকে। একটানা চোদ্দ কিলোমিটার নেমে রায়থাল, সেখান থেকে গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে উত্তরকাশী। আমার যদিও মনে হচ্ছিল, নিচে নামা অত কিছু চাপ হবে না, তবু প্রেম বলল, যতটা পারেন নামুন, তারপরে ঘোড়ায় বসবেন।
যতই দূষণমুক্ত জায়গা হোক, যে বরফগুলো চেঁছে গলিয়ে জল বানানো হচ্ছিল খাবার আর রান্নার জন্য, সেটি মোটেই বিশুদ্ধ জল তো নয় – তাতে মিশে থাকছে মাটি, ঘাস, না জানি আরও কত কী। খচ্চরগুলো সেখানেই চরে বেড়িয়েছে, আমরাও জুতো পরে দাপাদাপি করেছি – আলাদা করে জল পরিশ্রুত করার তো কোনও ব্যবস্থা নেই। সন্ধ্যের অন্ধকারে জল খেলে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু দিনের বেলায় গ্লাস বা বোতলের জলের রঙ দেখলেও ভয় করে। আগের দিন রাত থেকে আমারও পৈটিক গোলযোগ শুরু হয়ে গেছিল। সকালের দিকে একটু ধাতস্থ লাগল, যদিও প্রেমের একগুচ্ছ ব্রেকফাস্টের প্ল্যানকে হেলায় প্রত্যাখ্যান করে আমি জাস্ট একটা ডিমসেদ্ধ খেয়ে মুখ বন্ধ করলাম।
জার্নি শুরু হবার নিয়মটা সেই একই। আমি, বুনান আর অর্পণ হাঁটা শুরু করলাম, সঙ্গে সন্তোষ। বাকিরা আসবে জিনিসপত্র গুছিয়ে, টেন্ট গুটিয়ে, খচ্চরের পিঠে বেঁধে – তবে। তাদের তো থামার বা বিশ্রাম নেবার দরকার হয় না, তাই তারা আসবে ননস্টপ, রাস্তায় আমাদের ঠিক ধরে নেবে। নটায় আমরা হেঁটে নামা শুরু করলাম।
খানিক নামার পরেই বুঝলাম, ওঠার মত অতটা শক্ত না হলেও, নামাটাও খুব সোজা কাজ নয়। পায়ের পেছনের দিকের পেশিগুলোর ওপর বেশ চাপ পড়ে, কিন্তু সেটা খুব একটা অসহনীয় ব্যাপার নয়। অর্পণ এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে নামতে থাকল, আমি আর বুনান ননস্টপ নেমে এলাম গোই-তে, মাত্র এক ঘন্টায়।
গোইতে এসে আমরা পুরো চমকে গেলাম। আসার দিন আমরা তো এক রাত্তির ছিলাম এখানেই – এই ঢিবিটার সামনে। ঢিবিটার পেছনেই যে এই রকমের একটা জমাট পুকুর আছে, আগের দিন তো কেউ খেয়াল করি নি!
চারদিক বরফের চাদরে ঢাকা, মাঝখানে একটা কাচের জলাশয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে নিচে জল রয়েছে, কিন্তু ওপরের লেয়ারটা পুরু। আস্তে আস্তে পা ফেলে প্রথমে বুনান, তারপরে আমি চলে গেলাম একেবারে পুকুরের মাঝখানে। জমাট বরফ, চলতে কোনও অসুবিধেই হল না।
খানিক বাদে প্রেম এল। সে বলল, এটা তো এখানে দিব্যি ছিল, আসার দিন আমরা ঢিবির উল্টোদিকে আসি নি তাই দেখতে পাই নি। … কী নাম এই পুকুরটার? – নাম? নাম তো কিছু নেই। অতএব, আমি সসম্মানে নামকরণের দায়িত্ব নিলাম। বুনান যেমন এক অনামা পীককে নিজের নামে করে নিয়েছে – মাউন্ট ডিডাব্লুপি, আমিও এই পুকুরটার নাম দিলাম মুখার্জি-তাল।
গোইতে আধঘন্টার বিশ্রাম শেষে আবার চলা শুরু হল।
আমি যদিও দিব্যি হাঁটার কন্ডিশনে ছিলাম, তবু প্রেম আমাকে জোর করে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে দিল। পয়সা দেওয়া হচ্ছে, খচ্চর খালি কেন যাবে। দাদা, খ্যাল রাখবেন, আমি কিন্তু হাঁটতে চেয়েছিলাম। তা যাই হোক, হাঁটা আর খচ্চরে চাপা – দুটোই এখন আমার কাছে সমান। কিলোমিটার তিনেক আসার পরে খচ্চরওয়ালা আমাকে বলল, সাব, এবার একটু নেমে যান, এখানটা বেশি খাড়াই, আপনাকে পিঠে নিয়ে ও নামতে পারবে না। হড়কে যেতে পারে। আরেকটু নিচে নেমে আবার চাপবেন।
আমি নেমে পড়লাম খচ্চরের পিঠ থেকে। আসার দিনও চড়াইটা এই জায়গায় বেশ ভয়ঙ্কর উঁচু লেগেছিল। নামাটাও তাই তত সাবধানে। নামতে থাকলাম ধীরেসুস্থে। দু আড়াই কিলোমিটার আসার পরে একটা ছোট সমতল জায়গা, সেখানে খচ্চরগুলো জল খাবার জন্য দাঁড়িয়েছে, কিন্তু জল খেতে পারছে না। কারণ, দূর থেকে মাটির গর্তে জমা জিনিসটা জলের মত দেখতে লাগলেও, আসলে তার ওপরে স্বচ্ছ বরফের লেয়ার। জল রয়েছে তার নিচে। খচ্চরওয়ালা একটা পাথর জোগাড় করে ঠুকে ঠুকে সেই লেয়ার ভাঙল, তবে তার খচ্চররা আবার জল খেতে পারল।
বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ আমরা রায়থাল পৌঁছে গেলাম। আমার সিউডোট্রেকিং এখানেই শেষ। খানিক বাদেই হ্যাঃহ্যাঃ করতে করতে বুনান আর অর্পণও এসে পৌঁছল। খচ্চরওলা তার খচ্চর নিয়ে বিদায় নিল। প্রেম জানালো, সে গাড়িকে ফোন করে দিয়েছে, এক ঘন্টার মধ্যে এসে যাবে। চা এল, ম্যাগি এল, একটা কী ঘরে বানানো মিষ্টি এল যেটা খেতে হুবহু আমাদের ভাজা পিঠের মত। খেয়েদেয়ে অনেকদিন বাদে ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ আর মেল টেল চেক করবার ফুরসত পেলাম।
গাড়ি এল বেলা দুটোয়। সব জিনিস লোড করে আমরা বসলাম গাড়িতে। খানিক নিচে নামতেই আমাদের পাশে চলে এল অ্যাকোয়া সবুজ রঙের ভাগীরথী। চলন্ত গাড়ি থেকে খানিক ভিডিও নেবার চেষ্টা করছিলাম, তা প্রেম বলল, আপনাদের ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবো, সেখানে গিয়ে ছবি তুলবেন।
প্রেম আমাদের কোথায় দাঁড় করালো জানেন? সো-জা সেই পাইলট বাবার আশ্রমে। উৎকট বিকট ভজকট সব দেবতাদের মূর্তিতে ভর্তি। লোকজন বিশেষ নেই। কেবল পাইলট বাবা আর এক জাপানি মায়ের প্রোপাগান্ডায় সমস্ত দেওয়াল ভর্তি। একটা মন্দিরের ডেকোরেশন কতটা কুরুচিকর হতে পারে – দেখতে হলে পাইলট বাবার মন্দিরে আসুন। উত্তরাখণ্ডের বেশ কয়েক জায়গায় তাঁর আশ্রম আছে। উত্তরকাশীরটা এই রাস্তায়, ভাটওয়ারির কাছে, ভাগীরথীর কিনারে। পাইলট-বাবা কে, কী বা কেন, সে আপনারা গুগুল করে জেনে নিন গে, মোদ্দা কথা আমরা নিচে নেমে মন্দিরের মধ্যে দিয়ে পেছন দিকে গিয়ে দেখি একটা আধভাঙা টেরেস ভাগীরথীর কিনারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এমন কিছু ভালো ভিউ নয়।
ফিরে আসছি, সিঁড়ি দিয়ে তড়বড় করে নেমে এল তিনচারখানা খচ্চর, এরাও মন্দির দর্শন করতে এসেছে না ভাগীরথী দর্শন করতে এসেছে, কে জানে।
বিকেল চারটেয় উত্তরকাশীতে ফেরত। সেই একই হোটেলে। প্রেম বলল, আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন – আমি সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় আপনাদের নিতে আসব। খাসী কাটা হয়েছে, আজ রাতে আমার গরীবখানায় আপনাদের জম্পেশ নেমন্তন্ন।
ফ্রেশ হওয়া? সে ত বটেই। কদিন চান করি নি কে জানে – নিজের গায়ে হাত দিতে ঘেন্না করছিল এমন অবস্থা। সাবান তোয়ালে শ্যাম্পু নিয়ে ঝটপট জমিয়ে চান করে ফেললাম, দাড়ি কামিয়ে ফেললাম। বুনান আর অর্পণও আস্তে আস্তে রেডি হয়ে গেল। ফেরার প্ল্যান নিয়ে কথা হচ্ছিল। দিল্লিতে পৌঁছে করিমসে লাঞ্চ তো হবেই, কাল কোথায় থাকা যায়? হরিদ্বার, না হৃষিকেশ? বুনান বলল, ভাগীরথীর ধারে জিএমভিএনের একটা চমৎকার হোটেল আছে হৃষিকেশে, সেইখানে থাকা হোক।
আমি রাজি, কিন্তু হরিদ্বারের সেই হোটেলে যে আমার পায়জামাটা পড়ে আছে? ওটা উদ্ধার করতে যেতে হবে না? বুনান বলল, সে তো যাওয়াই যায় – হৃষিকেশ থেকে হরিদ্বার তো মাত্র পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। টুক করে একবার গিয়ে নিয়ে চলে আসব। আর যাবার পথেই একটা জায়গা পড়বে, আমি চিনি, সেইখানে হুলিয়ে নন ভেজ পাওয়া যায়। সেইখানে আমরা লাঞ্চ বা ডিনার কিছু একটা করে নেব। হরিদ্বার আর হৃষিকেশ – দুটোই ভেজিটেরিয়ান জায়গা, কোথাও নন ভেজ খাবার বিক্রি হয় না।
সেই প্ল্যানই সাব্যস্ত হল। সন্ধ্যেবেলায় প্রেম এল, আমাদের নিয়ে মার্কেটে গিয়ে খানিক কেনাকাটা করল, কেনাকাটা বলতে মূলত বুনান আর অর্পণের জন্য লালপানির বোতল।
প্রেমের বাড়ি আমাদের হোটেলের কাছেই। সেখানে দিব্যি সন্ধ্যেটা কাটল হইহল্লা গল্পগুজব এবং খাওয়াদাওয়া সমেত। মাটনটা খেতে সত্যি ভালো হয়েছিল, সেটা না বললে পাইলট-বাবা পাপ দিতে পারে। প্রেম তার ছবির অ্যালবাম খুলে দেখাচ্ছিল, কীভাবে কবে কোথায় আর্মির মাউন্টেনিয়ারিং টিমের সাথে এক্সপিডিশনে গেছিল। একেকটা পীক একাধিকবার উঠেছে প্রেম, বিভিন্ন গ্রুপের সাথে।
অবশেষে রাত সাড়ে দশটায় সবাইকে গুডবাই এবং আগাম হ্যাপি নিউ ইয়ার জানিয়ে আমরা উঠলাম। ফেরার পথে বুনান বলছিল, আজব মানুষ এই প্রেম। ওর এক ভাগ্নে, সে-ও পীক সামিট টিমের সাথে পোর্টারের কাজ করত। একবার একটা এক্সপিডিশনে গিয়ে অ্যাভালাঞ্চে ভেসে বেরিয়ে গেছিল। এক বছর পর, সেই রাস্তাতেই গিয়ে প্রেম তার ভাগ্নের মৃতদেহ তুলে এনেছিল। এই সন্তোষ, প্রেমের আরেক ভাগ্নে। পাহাড়েই এদের জীবন, পাহাড়েই এদের মৃত্যু। প্রেমের সাথে কথা হল, দিল্লি এলে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করবে।
*************************************
ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা তৈরি হয়ে বেরোলাম। অত সকালেও প্রেম এসেছিল আমাদের সী অফ করতে। আজ জিপিএস দেখে রুট চিনে নিয়েছি, আর রাস্তা ভুল হবার চান্স নেই। ছটায় গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলাম উত্তরকাশী শহর থেকে, আবার সেই ভয়ঙ্কর এন এইচ একশো আট, তবে আজ দিনের আলোয় ততটা ভয়ঙ্কর লাগছিল না, মাঝেমধ্যে খানিক ব্যাড প্যাচ ছাড়া। প্রায় পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার চলে আসার পরে আমাদের গাড়ি দাঁড় করাতেই হল।
ভাগীরথীর বুকে সকালের সূর্যের আলো পড়েছে। নতুন বছরের প্রথম সূর্য। চারদিক কমলা হয়ে আছে। এ জিনিস দেখে না দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া যায়?
চাম্বা পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দশটা, সেখানে দাঁড়িয়ে গরমাগরম আলু পরোটা আর চা খেয়ে পেট ভরানো হল, খালি বুনান ছটা বড় বড় কাঁচালঙ্কা বেশি খেয়েছিল। আসলে চতুর্থবার যখন বুনান “একটা কাঁচালঙ্কা” চায় দোকানদারের কাছ থেকে, দোকানদার তখন খুব হতাশ মুখ করে পুরো এক বাটি কাঁচালঙ্কা এনে দিয়েছিল। লজ্জায় তার পরে বুনান আর তিনটের বেশি খায় নি।
হৃষিকেশের গঙ্গা রিসর্ট জিএমভিএন হোটেলটা সিম্পলি দুর্দান্ত। গঙ্গার ধারে বিশাল এলাকা নিয়ে বানানো ঝকঝকে তকতকে একটা হোটেল, ইয়াব্বড়ো বড়ো ঘর, আর প্রতিটা ঘরের সাথে একটা করে ঢাউস বারান্দা, যেখানে বসে গঙ্গা দেখা যায়।
আমরা পৌঁছে গেলাম বারোটার মধ্যে, খানিক রেস্ট নিয়ে তিনটে নাগাদ বেরোলাম খাবারের সন্ধানে। কিন্তু আগের দিন ভোরবেলায় যে রাস্তা ফাঁকায় পেরিয়ে গেছিলাম, আজ দিনের বেলায় সে রাস্তা জ্যামে ভরপুর। হৃষিকেশ শহরের ঠিক বাইরেই আছে রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক, রাস্তা আর রেললাইন চলে গেছে তার মধ্যে দিয়েই। এই রাজাজি পার্কের শেষেই একটা ছোট্ট জনপদ, রায়ওয়ালা। হৃষিকেশে নন ভেজ পাওয়া যায় না, হরিদ্বারেও নয়, তাই দলে দলে নন ভেজিটেরিয়ানরা এই রায়ওয়ালায় আসে, রাস্তার ধারে সারি সারি দোকান, মাংসের এবং মদ্যের। পেট পুরে মাছ মাংস সমেত ভাত খেলাম। একেবারে গলা অবধি। তার পরে এগোলাম হরিদ্বারের দিকে, হরিদ্বার ওখান থেকে আর মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার। আমার পায়জামাটা উদ্ধার করতে হবে, আর যদি সম্ভব হয় – সন্ধ্যেবেলার গঙ্গা আরতি দেখতে হবে। ওটা নাকি দেখার মত জিনিস।
কিন্তু এগোতেই সেই যে অনন্ত জ্যামে পড়লাম, হরিদ্বারে ঢুকলাম, তখন সাড়ে ছটা বাজে, অন্ধকার। সে কী ট্র্যাফিক রে বাবা! এগোয় না। গঙ্গা আরতি তো আর দেখা হলই না – হোটেল থেকে সেই পায়জামা উদ্ধার করে, টুকটাক আরও দু চারটি কেনাকাটা করে আমরা আবার সেই জ্যাম ঠেলে প্রায় রাত নটা নাগাদ আবার হৃষিকেশের হোটেলে পৌঁছলাম। মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে।
ট্রেকিং-এর গল্প এখানেই শেষ করে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু পরের দিন এমন একটা ঘটনা ঘটল, সেটা না বলা অবধি শেষ করা যাচ্ছে না – অতএব, আরও এক কিস্তি।