পর্ব ১ , পর্ব ২ , পর্ব ৩ , পর্ব ৪ , পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ -এর পরে …
বেড়ানো শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। জানুয়ারির আজ দু তারিখ। সন্ধ্যেবেলায় পুরনো দিল্লি থেকে বুনানদের ট্রেন। দুপুরে ওদের নিয়ে করিমসে খাওয়ানোর দায়িত্ব আছে, আর সেখানে প্রায় প্রতিদিনই লম্বা লাইন পড়ে, তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার দিল্লি। বাকি তো রয়েছে আর মাত্র সোয়া দুশো কিলোমিটার, সকাল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লে ফাঁকায় ফাঁকায় সাড়ে নটা দশটার মধ্যে আরামসে বাড়ি পৌঁছে যাবো। দিল্লিতে ওদিকে অড ইভেন রুল চালু হয়েছে। তা আমার কোনও চাপ নেই, আমার গাড়ি আজকের জন্য কমপ্যাটিবল।
বুনান ছেলেটাও পোচোন্ডো কমপ্যাটিবল। তিন রাত্তির সহ্য করার পরে যখন রসিকতার ছলে ওর নাক ডাকা নিয়ে বললাম, অটোমেটিকালি সেদিন রাত থেকে প্রতি রাত ও নাক না ডেকে ঘুমিয়েছে। কী করে পারল, কে জানে! বুনানের ছানা অর্পণ অবশ্য অত কমপ্যাটিবল নয়। ওর স্টেটাস কল নিয়ে আমরা অত খিল্লি করলাম, কিন্তু ছোকরা আনঅ্যাবেটেড অবস্থায় প্রতি ঘন্টায় স্টেটাস কল করে গেছে, এমনকি রাতে লেপের তলায় ঢুকেও। মনে আছে – দয়ারা বুগিয়াল থেকে নামার তোড়জোর করছি, বুনান আর আমি পা বাড়িয়েই ফেলেছি, ফেলার আগে বুনান লাস্ট ছবি আপলোড করছে ইনস্টাগ্রামে, তখন শুনি অর্পণ খুব নিচু গলায় স্টেটাস কল দিচ্ছেঃ “হ্যাঁ … এই তো, এইবারে নামব, … হ্যাঁ, ডিমসেদ্ধ খেয়েছি, … ইয়ে, দুটো, … হ্যাঁ, আর একটা ওমলেট, …হ্যাঁ, দু কাপ, না না, বেশি খাই নি। (খানিক নীরবতা) … হুঁ, হুঁ, সক্কালবেলাই গেছিলাম, … হ্যাঁ হয়েছে … ওই … বোতল দিয়েই … হ্যাঁ গরম জল ছিল … হ্যাঁ ভালো করেই ধুয়ে নিয়েছি …”
আমি আর বুনান দূরে দাঁড়িয়ে খ্যা-খ্যা করে হেসে কুটিপাটি হচ্ছি আর বেচারা অর্পণ প্রতিটা অ্যাক্টিভিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে চলেছে ফোনে।
সেই সব দিনগুলো এখন অতীত হয়ে গেল। সে যাক, হচ্ছিল বুনানের কথা। ছেলেটা খুব কমপ্যাটিবল। যেমন নাক ডাকার ব্যাপারে, তেমনি ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারে। এমনিতে বুনান ব্রাহ্মমুহূর্তে ওঠে, ভোর দশটা, এগারোটা – কিন্তু দরকার পড়লে সকাল সাড়ে চারটেতেও উঠে পড়তে পারে। তো, পাঁচটায় সবাই উঠে পড়ল, এবং পাঁচটার সময়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়।
হরিদ্বার পৌঁছতে সময় লাগল পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট, এত ভোরে রাস্তায় একটাও ট্র্যাফিক নেই, শনিবারের সকাল, কালকের দুর্বিষহ জ্যামের জাস্ট কোনও চিহ্ন নেই। খুব তাড়াতাড়ি হরিদ্বারের সীমা পেরিয়ে এগোতে থাকলাম।
লোকালয় শেষ হতেই কুয়াশা দৃশ্যমান হতে থাকল। রাস্তার দুপাশে সবকিছু ঢেকে আছে কুয়াশায়, শিল্যুয়েটের মত কিছু গাছপালা চেনা যাচ্ছে, আস্তে আস্তে রাস্তাতেও ভিজিবিলিটি কমতে লাগল। হেডলাইট আর হ্যাজার্ড লাইট অন করে চলতে থাকলাম। ঘন কুয়াশা, ভিজিবিলিটি অলমোস্ট শূন্য।
রুড়কী এসে গেল। চারদিক শান্ত, নিস্তব্ধ। সারি সারি বন্ধ দোকান। ইতস্তত দু একটা চায়ের দোকান খোলা। এদিকে সমস্যা হচ্ছে – ঠাণ্ডাতে গাড়ির ভেতরেও ভেপার জমে যাচ্ছে, সামনে জাস্ট কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এই সময়ে হয় কাচ নামিয়ে নিতে হয়, নয় তো গাড়িতে ব্লোয়ার অন করতে হয়, সেটাই করব বলে গাড়িটা স্লো করে এক সেকেন্ডের জন্য ব্লোয়ারের সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছি, হঠাৎ … কী হল বুঝতে পারলাম না, বুক-কাঁপানো একটা আওয়াজ হল, প্রথমে দ্দড়াম করে, আর মুহূর্তের মধ্যে আমার গাড়িটা আমাদের সবাইকে নিয়ে বাঁদিকে হেলে গেল … পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি? নাকি তারও বেশি? আমরা উলটে যাচ্ছি … গাড়ি এক্ষুনি বাঁদিকে আছড়ে পড়বে, ড্রাইভারের স্বভাবজাত রিফ্লেক্সে আমি সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিং বাঁদিকে মোচড় দিলাম আর সাথে ব্রেক মারলাম সজোরে। … আমাদের কি বাড়ি ফেরা হবে না?
তিন থেকে চার সেকেন্ড। একটানা কানফাটানো কর্কশ মেটালিক আওয়াজটা শেষ হল, আর আমি ঐ পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেলে থাকা অবস্থান থেকে সজোরে আগের পজিশনে ফিরে এলাম। গাড়ি সোজা হল। চাকাটা কি খুলে বেরিয়ে গেছে? … না, গাড়ি গড়াচ্ছে এখনও। আমি আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় স্টিয়ারিং তখনও পুরোপুরি বাঁদিকে মুচড়ে রেখেছি। … ব্রেক কাজ করছে, রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করালাম। গাড়ি এখনও চালু।
প্রথম মাথায় যেটা এল, সেটা হচ্ছে – আমরা বেঁচে গেছি। রুড়কীতে ঢোকার পরে রাস্তায় কোনও ডিভাইডার ছিল না, এই স্ট্রেচটায় হঠাৎ করে ডিভাইডার শুরু হয়েছে, গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন ঝাপসা থাকায় বুঝতে পারি নি, ডানদিকের চাকা সোজা উঠে গেছে ডিভাইডারের ওপর। ঝটপট দরজা খুলে বাইরে এলাম সবাই। … বুনানের পায়ে অল্প চোট লেগেছে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে – যেন কিছুই হয় নি। সামনে থেকে পাশ থেকে – কোথাও কোনও ডেন্ট নেই, কিচ্ছু নেই। নিচু হয়ে দেখলাম, বনেটের নিচের দিকে ঝরঝর করে পড়ছে একটা লিকুইড। … পেট্রল?
ঝুঁকে গন্ধ শুঁকলাম। নাহ্, পেট্রলের গন্ধ নয়। লিকুইডটাও কেমন সবজেটে রঙের। বুনান বলল, নিশ্চয়ই কুল্যান্ট, কিংবা ইঞ্জিন অয়েল।
তাই হবে। এবার কী উপায়? গাড়ি স্টার্ট হয় তো নেবে, কিন্তু কোথায় আর কী ভেঙেছে নষ্ট হয়েছে না বুঝে তো এগনো সম্ভব নয়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রুড়কী শহরের একেবারে কেন্দ্রে, একশো মিটার সামনেই রুড়কী আইআইটির গেট। সকাল সাড়ে সাতটা। চারপাশে জনমনিষ্যি নেই, খালি সাদা কুয়াশা পাক খাচ্ছে। কী বিশাল বড় ভাগ্য যে রাস্তায় কোনও ট্র্যাফিকও নেই। এই অবস্থায় যদি ফুলস্পিডে আরেকটা কোনও গাড়ি এসে পড়ত, তো আমরা জাস্ট উড়ে বেরিয়ে যেতাম। … কিন্তু, কী করা যায়?
মারুতি ব্রেকডাউন সার্ভিসের নম্বর। ডায়াল করলাম, অটোমেটেড আইভিআর বেজে গেল, বেজেই গেল, কেউ তুলল না। আবার চেষ্টা করলাম, আবার, আবার, আবার। একই ফল। কেউ তুলল না।
গাড়ির ভেতরটা একবার চোখ বোলালাম। দুটো ছোট ক্যাজুয়াল্টি। উইন্ডস্ক্রিনে লাগানো মোবাইল মাউন্টটা, সম্ভবত আমারই গায়ের ধাক্কায় ভেঙে দু টুকরো হয়ে আছে। আর নিচে মোবাইল চার্জারটা মাঝখান থেকে ফেটে ফাঁক হয়ে আছে, সেটাও সম্ভবত আমারই পায়ের চাপে। বাকি গাড়ির নিজস্ব জিনিসপত্র, সমস্ত ইনট্যাক্ট, এমনকি মিউজিক সিস্টেম চলছে, সেন্ট্রাল লকিং কাজ করছে, সব একেবারে ঠিক।
আরও দুবার ফোন লাগালাম মারুতিতে। প্রায় আটটা বাজে, কেউ তো তুলুক। কিন্তু না, সারা ভারত জুড়ে মারুতির ওয়ান এইট হান্ড্রেড নম্বর নিদ্রামগ্ন। আইভিআর শেষ হবার পরে ফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে।
অর্পণ আর বুনানের সাথে আলোচনা করে স্থির করলাম, গাড়ি গড়াচ্ছে যখন, চালাই। সামনে যেখানে ছোটোখাটো কোনও ওয়ার্কশপ পাবো, গাড়ি ঢুকিয়ে দেব। পেট্রল ট্যাঙ্কারের যখন কোনও ক্ষতি হয় নি, আস্তে আস্তে চললে দিল্লি আমরা পৌঁছে যাবোই।
গাড়ি স্টার্ট করলাম, সামনের মিটারে দেখলাম, না, ইঞ্জিন গরম হচ্ছে না, টেম্পারেচার নর্মালই দেখাচ্ছে। কিন্তু একটু চালিয়েই বুঝলাম, বিপত্তি হয়েছে আরেক জায়গায়। ধাক্কার ইমপ্যাক্টে আমার স্টিয়ারিং হুইল বেঁকে গেছে নাইন্টি ডিগ্রি। মানে, স্টিয়ারিং বাঁদিকে নব্বই ডিগ্রি ঘোরালে তবে চাকা সোজা থাকছে, আর স্টিয়ারিং সোজা করলে গাড়ি সরে যাচ্ছে ডানদিকে। কিন্তু গাড়ি চলছে। একটু আধটু আওয়াজ হচ্ছে বটে, তবে সেটা অ্যালার্টিং কিছু নয়।
ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। পঞ্চাশ, ষাটের স্পিডে। কিন্তু ফাঁকা রাস্তা, অত কম স্পিড কি মেনটেন করা যায়? গাড়ি আস্তে আস্তে পৌঁছে গেল সত্তরে। তাতেও দেখলাম স্মুথই চলছে। যাই হোক, আমি নিজেকে এইবারে কন্ট্রোল করলাম, সত্তরের ওপরে গাড়ির স্পিড তুলব না।
রুড়কী পেরোতে কুয়াশার তীব্রতা আরও বাড়ল। ভয়ের চোটে ব্লোয়ারও চালাতে পারছি না, জানলার কাচ নামিয়ে চালাচ্ছি, ডান হাত একেবারে জমে বরফ – কিন্তু কিছু করার নেই, কে জানে ব্লোয়ার চালাতে গিয়ে যদি গাড়ি বিগড়ে যায় এই মাঝরাস্তায়? তার চেয়ে এ হাত ও হাত করে স্টিয়ারিং ধরা অনেক ভালো।
দাঁতে দাঁত চেপে সেইভাবেই এলাম। মুজফফরনগর আসতেই কুয়াশা উধাও হয়ে গেল। কিন্তু সারা রাস্তায় একটাও গাড়ির ওয়ার্কশপ খোলা পেলাম না। পাংচার শপ অবশ্য অনেক ছিল।
মোদীনগর পেরিয়ে গাজিয়াবাদে ঢোকার মুখে ট্র্যাফিক জ্যাম শুরু হল। গাড়ি নির্বিঘ্নে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিল, তখন বাজে সোয়া এগারোটা।
********************
তার পর? তার পর এক রাউন্ড চা, একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়া এবং আবার ঐ গাড়ি নিয়েই পুরনো দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা। নিউ দিল্লি স্টেশনে মালপত্র সমেত গাড়ি রেখে মেট্রোয় চেপে চৌরিবাজার, করিমসে গিয়ে দাঁড়াতেও হল না, একটার সময়ে পৌঁছে দিব্যি টেবিল দখল করে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া হল। এর পরে জামা মসজিদে ঢুকতে গিয়ে প্রথম জানলাম এখন ক্যামেরার জন্য তিনশো টাকা দিতে হয়। আমি ২০১৩তে শেষ ঢুকেছিলাম, তখন পয়সা লাগত না। তবে বুনান জামা মসজিদের যা সব ফাটাফাটি ছবি তুলেছে, তাতে ওর পয়সা উসুল হয়ে গেছে।
গপ্পো এখানেই শেষ।
বরাবরের মত ভালো লাগল, চতুর্থ পর্বের পর দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হল, কিন্তু একটা ব্যাপার দারুন লাগলো, আমার এক আত্মীয়ের ও Wagon R, কলকাতার ই এম্ বাইপাশে এক সকাল বেলায় তারো এইভাবে ডিভাইডারে উঠে ফ্রন্ট্ এক্সেল, স্টিয়ারিং বেঁকে ঠিক আপনার মত ই অবস্থা হয়েছিল, কিন্তু সেও ঠিক আরো শ খানেক কিমি ড্রাইভ করে প্রায় নির্বিঘ্নেই বাড়ি ফেরে, আমাদের একটা অল্টো ৮০০ আছে। সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে একটা মারুতি ভ্যানের প্রায় ঐ অবস্থায় ও ৭০০ কিমি পাড়ি দিয়ে ছত্তিশগড় থেকে কাঁথি ফেরার গল্প শুনেছিলাম। সত্যি, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে এই ইন্দো-জাপানি সংস্থা কখনোই ধোকা দেয়না, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বললেও ভূল নেই, ভারতের অটোমোবাইলের ইতিহাসে প্রথম মডার্ন car মারুতি ৮০০ এর যাত্রা শুরু এদের হাতেই, লিট্যার্যালি ভারতীয়দের নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে ঐ গাড়িটাই। আমেরিকানদের কাছে ফোর্ডের মডেল টি, ইউরোপিয়ানদের কাছে ফোক্সভাগেন বিটিল্ যা, ভারতীয়দের কাছে মারুতি ৮০০ একদম তাই, আরো ঘুরুন, আরো অসাধারন সব ট্রাভেলগের অপেক্ষায় থাকলাম।
LikeLike
ও বলা হলনা, সময় করে পারলে অবশ্যই Pepsi MTV Indies এর Way Back Home- এই ট্রাভেলগ টা ইউটিউব থেকে দেখবেন, ভারতের টেলিভিশনের ইতিহাসে এই ধরনের ট্রাভেলগ এই প্রথম, জাস্ট অসাধারন, গতানুগতিক নয় একেবারেই। ১৩ টা এপিসোড, প্রতিটা ২২মিনিট করে, সিনিক বিউটিটাই আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আশা করি ভালো লাগবে, কেমন লাগলো জানাতে ভূলবেন না যেন।
LikeLike
নিশ্চয়ই দেখব।
LikeLike