মূল লেখাটি এনডিটিভি ইন্ডিয়ার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ এডিটর শ্রী রবিশ কুমারের, এনডিটিভি সাইটে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত। রবিশজির অনুমতিক্রমে তার বঙ্গানুবাদটা এখানে দিলাম সকলের পড়ার জন্য।
কটা বাজছিল, আমার মনে নেই। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মিছিল থেকে আমি ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কত টাইমজোন, কত দেশ-দেশান্তরের ঘুম আমার চোখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিচে একটা চেঁচামেচির শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙল।
ঘুমচোখে শব্দগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, সেগুলোও যেন অন্য কোনও দেশ থেকে ভেসে আসছিল, অন্য কোনও টাইমজোন থেকে। সন্ধ্যেবেলায় যদিও দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছিল, কিন্তু সেই গোলমালের শব্দের উত্তাপ যেন মাটি থেকে সেটুকু জলও শুষে নিচ্ছিল। কেউ চিৎকার করে বলছিল কাদের যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুন করে আসার কথা। সেই চিৎকারের শব্দের হিংস্রতা আমাকে পাথরের মত ভারী করে দিছিল। খুনের জন্য চিৎকার, আর টিভিতে শোনা কিছু মানুষকে গুলি করে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি – এই দুটোর মাঝে পড়ে আমি লুকোবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেমন যেন মনে হচ্ছিল, আমার চেনা-পরিচিত সক্কলের পিঠে কেউ “টার্গেট” এঁকে দিয়ে গেছে।
রাজপথে যখন জেএনইউউএর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠল, টিভি অ্যাংকররা লোকজনকে বেঁধে রাখল স্টুডিওর ডিবেটে। দিল্লির দ্বারকা এবং রাজেন্দ্র নগরে এই রকমের কিছু মিছিল বেরিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এই ধরণের জিঘাংসু চিৎকার, জেএনইউর বিরুদ্ধে তৈরি করা এই ভয়ংকর হিংস্র শত্রুতার বাতাবরণে কোনও মিডিয়ারই কিস্যু যায় আসে না। সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই, তবে আমি জানি, ঠিক এই ধরণের হিংস্র মিছিল আমার চারপাশের অনেক পাড়া, অনেক বাজার এবং শপিং মলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছে।
একটা রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটা স্ক্রিনশট শেয়ার করা হয়েছে। তাতে লেখা – “এই মেয়েটি আফজল গুরুর সমর্থক – সংসদ আক্রমণের কুচক্রী।” মেসেজে দেখলাম, ছবিতে মেয়েটার মুখটায় গোল করে কালো কালি ঘষে দেওয়া হয়েছে। তার নামের পাশে লেখা – “মেয়েটি বাঙালি এবং এর ছবি এতবার শেয়ার করুন যাতে সারা দুনিয়া জানতে পারে যে ও আফজলকে সাপোর্ট করছিল”। ছবিতে শেয়ার করা মেয়েটি জেএনইউতে প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন।
আমরা সাংবাদিকরা প্রায়ই এইভাবে চিহ্নিত হই, এবং আমাদের সবসময়েই অসংখ্য এই ধরণের গুজব ঘিরে রাখে – আমরা দেশের কত বড় শত্রু, একটা টুইটও দেখেছিলাম যাতে লেখা ছিল – রবিশ কুমার একশো শতাংশ বেশ্যাসন্তান। যদিও নিজের মা-কে ভারত-মা হিসেবে ভাবার পাশাপাশি একজন “বেশ্যা”কেও আমার মা ভাবতে তেমন কোনও আপত্তি নেই।
কিন্তু একদিন একটা সাধারণ নেক্সট-ডোর গার্লকেও যে এইভাবে চিহ্নিত এবং আক্রমণ করা হবে – এটা আমার কল্পনারও অতীত ছিল।
একটা রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা যে এইভাবে একটা মেয়েকে টার্গেট করবে, এই ব্যাপারটাই খুব ভয়ঙ্কর। হয় তো মেয়েটি সেখানকার বাসিন্দা নয়, কিন্তু এই অভ্যেস যদি আমাদের মধ্যে একবার ঢুকে যায়, আপনারা বুঝতে পারছেন, এর পরের ঘটনা কী হবে? এ ঘটনা কি আমাদের মৌলিক স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়? প্রথমে ওরা মেয়েটির স্কার্টের দৈর্ঘ্য মাপার চেষ্টা দিয়ে শুরু করলে, অচিরেই তারা স্বনিয়োজিত ওয়াচডগ হয়ে আমাদের ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস ফেলবে।
এই মতাদর্শের মানুষগুলো কি সদ্য এসেছে আমাদের সমাজে, নাকি তারা আগে থেকেই ছিল, স্রেফ মতাদর্শের প্রচারে এখন ময়দানে নেমেছে? মানুষের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের এটা ভাবার সময় এখন এসেছে। কাল এমনটা হতেই পারে, কেউ একটা ছবি তুলে বা ফেসবুক থেকে কোনও একটা কমেন্ট শেয়ার করে ভাইরাল করে দিল – অন্তরা নামের এই মেয়েটি কলেজ বাংক করে সেক্টর ৬-এর রাজীবের সাথে বাইরে ঘোরাঘুরি করে। ছবিটি এতবার শেয়ার করুন, এতবার শেয়ার করুন যাতে তাদের বাবা-মা জানতে পারেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা কী করে বেড়াচ্ছে! – ঠিক এই ভাষাতেই লেখা ছিল হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজটা। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যদি এখনও এর কুফল বুঝতে না পারেন, তা হলে বুঝতে হবে দেশের জন্য এক ভয়ংকর দুর্দিন সামনে আসছে।
আমরা কি জাতীয়তাবাদের নামে চাইব এই জোচ্চোরগুলো আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করুক? একদিন যদি ঐ কিশোরকিশোরীকে “কালচার বাঁচানো”র নামে এই জনতাই পিটিয়ে, খুঁচিয়ে মেরে ফ্যালে? অথবা যদি তারা নিজেরাই আত্মহত্যা করে ফ্যালে এই গণ-শেয়ারিং-এর মাধ্যমে চিহ্নিত হয়ে যাবার লজ্জায়?
সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ এ দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতাকে দাবিয়ে দেবার একটা যন্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিন যে আশার আলো দেখিয়েছিল এটা, আজ সে আলো নিভে যেতে বসেছে। এইসব ঘটনা মিডিয়াতে প্রচারিত হয় না, কারণ আমজনতা তো টিভির সামনে বসে “দেশভক্ত” আর “দেশদ্রোহী”দের পরস্পরের ওপর গোলাবর্ষণ করতে দেখতে ভালোবাসে, আর সবার অলক্ষ্যে এই সব ক্ষমতাবান সংস্থাগুলো মানুষের স্বাধীনতা চুরি করার ষড়যন্ত্র করে চলে। সমস্তই চলে পূর্বপরিকল্পিতভাবে।
সামগ্রিকভাবে, টেলিভিশন এখন জনতার মধ্যে “দেশদ্রোহী” খোঁজার খেলায় মেতেছে। অ্যাঙ্কররা চেঁচিয়ে যায় এবং মতাদর্শরা জন্ম নেয়। এই সহিংস শব্দাবলীর মধ্যে আমি ডুবে যেতে থাকি। ভারসাম্য হারাই, মনে হয় কিছু কিছু জিনিস বোধ হয় খুব বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে গেছে। ঠিক বা ভুলের প্রশ্ন নয়। আমরা যখন মনে করতে শুরু করি যে আমাদের কথাই শেষ কথা, তখনই আমাদের থেমে গিয়ে অন্যমতকে শোনা উচিত। বিরুদ্ধমত ও অসহমতকে জায়গা দেওয়া উচিত। আবার, আবার প্রশ্ন তোলা উচিত।
অর্গানাইজেশনের মধ্যে আমরা এই ধরণের নিয়ন্ত্রণের কথা শুনি, কিন্তু বৃহত্তর সমাজের মধ্যে এই নিয়ন্ত্রণের কথা বলার গল্পটা নতুন। রাস্তায় জেএনইউ-এর বিরুদ্ধে স্লোগান পড়ছে এবং জেএনইউ সমর্থকদের বাড়ি চিহ্নিত করার, তাদের টার্গেট বানানোর ডাক উঠছে – এ বড় সামান্য কথা নয়। সমাজের নিয়ন্ত্রণে হাত লাগায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে ঢুকে পড়ে সমাজ। আপনিও যদি এটা সমর্থন করেন, তা হলে আপনাকে অভিনন্দন, আপনার মহল্লায় মিষ্টি বিলি করুন এবং বাড়িকে গুডবাই বলে চলে যান, কারণ আপনাদের বাচ্চাদের জন্য নতুন অভিভাবক এসে গেছে, আর আপনাকে মাথা না ঘামালেও চলবে।
এই সেই কোলাহল যা নিয়ে আপনাদের আমি বলতে চেয়েছিলাম। এইজন্যই আমি আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমরা কথা বলতে পারি কিন্তু যাতে কেউ “চিহ্নিত” হতে না পারে। যাতে আমাদের কথা আপনারা শুনতে পান।
নিজেদের মতাদর্শকে তুলে ধরার চেষ্টায় টিভি অ্যাঙ্কররা আলোচনাচক্রকে আগুনের ঝড় বানিয়ে দেন – সমস্ত কার্যকারণকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় নাটকীয়ভাবে। কেউ সেই ডিবেটে বসে ভয়ে কাঁপতে থাকেন আর বাকিরা তার ওপর আগুন বর্ষাতে থাকেন, নিরন্তর। আমরা এর আগেও ভুল করেছি, প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু আমরা আমাদের পদ্ধতি বদলাতে পারি নি।
প্রাইম টাইমে এই অনুষ্ঠানটা আমি কোনও টিভিকে “ফিক্স” করার উদ্দেশ্যে হোস্ট করি নি, শুধু এইটুকু আশা নিয়ে করেছি যে অন্ধকারে আমরা নিজেদের দিকে তাকাতে পারব, আত্মানুসন্ধান করার চেষ্টা করব, নিজেকে প্রশ্ন করতে এবং বিচার করতে শিখব। আমরা আজ এটা করেছি, কেউ হয় তো এই কাজ গতকাল করেছিল, আবার কেউ আগামীকালও করবে এই কাজ। কিন্তু বর্তমানে টেলিভিশন তার “ভিশন” হারিয়েছে। ডিবেট টিভি নির্মমভাবে যুক্তি আর কারণের স্পেসকে খুন করে চলেছে। এর মাধ্যমে খুন করা হচ্ছে জনমতকে, বিরুদ্ধমতকে। কিন্তু এর থেকে কেউ যেন এই সিদ্ধান্তে না আসেন যে টিভি নামক মিডিয়াটি মরণোন্মুখ। মরণোন্মুখ তাঁরা, যাঁরা মুখ বুজে এই ডিবেটগুলো দেখে যান।
আমি কৃতজ্ঞ, আমার প্রাইম টাইম আপনাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। যেভাবে আপনারা আপনাদের ভালোলাগা জানিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে আপনারা একটা ভয়ের মধ্যে ছিলেন আর তারপরে কোথাও থেকে আপনারা ভয় কাটিয়ে ওঠার সাহস পেয়েছেন। আপনারা যখন এপিসোডটিকে ভাইরাল করে তুলছেন, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল আপনারা আসলে আরও কারুর হাত ধরতে চাইছেন, আরও কাউকে সাহস জোগাতে চাইছেন। কিন্তু সৎভাবে বলতে গেলে, যদি আপনাদের এই প্রতিক্রিয়ায় ভয় কাটিয়ে ওঠার এতটুকু লক্ষণ থাকে, তা হলে এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় আমি খুশি নই। আমি চিন্তিত। আমাকে বলুন, আপনারা কেন ভয় পাচ্ছিলেন, কাকে ভয় পাচ্ছিলেন? ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে স্বস্তি পাবেন না, ভিড় থেকে একটু আলাদা হয়ে দাঁড়ান। নিজের ঘরের থেকে, নিজের ভয়ের থেকে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ান। ভয় পাওয়ানো-কে ভয় পাবেন না।