মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী (বাড়তি পর্ব)

সোশাল মিডিয়ার এই একটা মহান শক্তি, দু পক্ষের মাঝখান থেকে টেবিলটাকে পুরোপুরি ভ্যানিশ করে দেয়। ইন্টার‍্যাকশন, জনসংযোগ এর আগে এত ভালো করে কেউ করতে পারত না। আর ঠিক সেই কারণেই আমি কখনও সুনীল গাঙ্গুলি, আনন্দ পাবলিশার্স, দূরদর্শন কিংবা আনন্দবাজার পত্রিকাকে ভালো মনে নিতে পারি নি, কারণ এই সব মাধ্যমগুলির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি বা হয়ে থাকি, কেবল একতরফা ভাবে, এঁরা লেখেন, পাবলিশ করেন, দেখান; আর আমরা, দর্শক, শ্রোতা, পড়ুয়া যারা, তারা সবসময়েই থাকি রিসিভিং এন্ডে। ইন্টার‍্যাক্ট করা বা কথোপকথনে যাবার কোনও সহজ সরল চটজলদি উপায় আমরা কখনও পাই নি।

সোশাল মিডিয়া, ব্লগিং এই সীমাবদ্ধতাকে উড়িয়ে দিয়েছে বহুকাল। এখন আমরা পছন্দের লেখক, গায়ক, শিল্পী, রাজনীতিক, বা অন্য কোনও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই মায়াপাতায়, ফলো করি, ফ্রেন্ড লিস্টে অ্যাড করি, দেয়ালে গিয়ে কমেন্ট করি, এবং সময়মত নিজের মতামতের উত্তরও পাই। এই যে মাঝখানের টেবিলটা আর থাকে না, আমরা সবাই এক জায়গায়, একটাই শতরঞ্চির ওপর বসে আড্ডা বা তক্কাতক্কি করার অনুভূতিটা নিতে পারি, এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে।

মন কি বাত যখন লিখতে বসেছিলাম – ঠিক কিছু লিখব ভেবে লিখতে বসি নি। সেই দিনটা, সেই দিনগুলো আমাকে ধরে ঘাড় ধরে কিছু লিখিয়ে নিয়েছিল। প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে বসে লিখে ফেলেছিলাম অনেককিছু। সত্যিই মনের কথা লিখেছিলাম। এই ব্লগ সাইটটা আমি চালাচ্ছি এক বছরের কিছু কম সময় হল। এর আগে এইভাবে আমার কোনও লেখাতে এত বেশি রেসপন্স আসতে দেখি নি, এত বেশি কমেন্ট পড়তে দেখি নি। স্ট্যাটিসটিক্স দেখে বুঝলাম, শুধু ফেসবুকেই দু হাজার বারের বেশি শেয়ার হয়েছে আমার লেখাটা। আমি আবেগে প্রায় গদগদ হয়ে যাচ্ছিলাম, এই সময়ে কে যেন এসে আমার কানে কানে বলে গেল, আপনার লেখাটা কিন্তু কিছু ভুলভাল লোক শেয়ার করে “অ্যান্টি-ইন্ডিয়া সেন্টিমেন্ট” ছড়ানোর চেষ্টাও করছে।

… আমার চোখদুটো গোল্লা-গোল্লা হয়ে গেল, গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। বলে কী কত্তা? ভারতবিরোধী এলিমেন্ট পাওয়া গেছে আমার লেখায়? তা হবে। মানে যে কোনও জিনিসেরই দুটো পিঠ তো থাকেই – এই যেমন দেখুন, দুই পর্বে লেখা আমার মন কি বাত-এর নিচে প্রচুর কমেন্ট পড়েছে। কেউ লিখেছেন – এক্কেবারে একমত, কেউ কিন্তু-কিন্তু করে আমার লেখার তথ্যসূত্র হিসেবে আরও ক্রেডিবল ইনফর্মেশনের দাবি করেছেন, কেউ সরাসরি জানিয়েছেন আমার মতের সঙ্গে তিনি বা তাঁরা একেবারেই একমত নন, আবার কেউ কেউ সুন্দর ভাষায় আমাকে গালমন্দ করে মনের জ্বালা মিটিয়ে গেছেন।

আমি মাত্র একটি কমেন্ট অ্যাপ্রুভ করি নি, কারণ সেটি ডুপ্লিকেট কমেন্ট ছিল – মানে একজন একই বক্তব্য লিখে দুবার পোস্ট করে দিয়েছিলেন, তাই একটি আমি সরিয়ে দিয়েছি। বাকি কমেন্টগুলো আমি রেখে দিয়েছি এবং যথাসাধ্য উত্তর দেবারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি জানি সে উত্তর যথেষ্ট নয়। এই পর্বটা তাই আমি লিখতে বসছি আমার সাধ্যমত ক্ষমতামত সকলের সমস্ত বক্তব্যের উত্তর দেবার উদ্দেশ্যে।

মার্চ মাসের তিন তারিখের সেই ভাষণে – যা ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে ভাইরাল হয়ে গেছে, কানহাইয়া বলেছিল – প্রধানমন্ত্রীজি মন কি বাত বলেন ঠিকই, কিন্তু শোনেন না। ঠিকই বলেছে কানহাইয়া, কারণ আমার এই লেখার শুরুতেই যেটা বলেছি, রেডিও সেই ধরণের প্রিমিটিভ যন্ত্র, যা শুধু “ব্রডকাস্ট” করতে পারে একতরফা, দুই তরফের ইন্টার‍্যাকশনের পরিধি – যা সোশাল নেটওয়ার্ক দিতে পারে, সেটা রেডিও পারে না। তাই শুধু প্রধানমন্ত্রীজি কেন, রেডিওতে পারফর্ম করা সকলেই নিজের বক্তব্য গান কবিতা খবর কলাকৃতি – “বলেন”, “শোনবার” অবকাশ সেখানে নেই।

আজ এইখানে আমি আপনাদের মন কি বাত শুনে তার ওপর আলাপচারিতা করব, তার ওপর আবার আপনারা কমেন্ট দেবেন, কেউ বলবেন ভালো, কেউ বলবেন একপেশে, কেউ আমার বা আমার মা-বোনের নাম তুলে খিস্তি দেবেন, যদি সেগুলো একত্রে দাবি করে আবার একটা পর্ব লেখার, তা হলে আবার আমি লিখতে বসব।

কিন্তু সরাসরি আলাপচারিতায় যাবার আগে আমি আরও কিছু কথা বলতে চাই, যা আমার মনে হয়েছে, আগের পর্বদুটিতেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় বলে উঠতে পারি নি।

আমার আগের লেখায় ইন্ডিয়ান আর্মির অনেক অত্যাচারের গল্প আমি শুনিয়েছি, যাতে এমন একটা ধারণা জন্মাতে পারে, আর্মির মত খারাপ বোধ হয় আর কিছু হয় না। অনেকেই সেই ধারণা নিয়ে আমার লেখার নিচে কমেন্ট করেছেন, আমি স্বীকার করছি, আমার বোঝাবার ভুল। আমি সেইটাকে বরং আগে একবার শুধরে নেবার চেষ্টা করি।

শুধু ভারতে নয়, বিভিন্ন দেশেই লোকে প্রথাগত পড়াশুনো শেষ করে বিভিন্ন পেশা বেছে নেয় – ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক, ব্যবসা, মিলিটারি, পুলিশ, রাজনীতি। ভালো খারাপ সব পেশাতেই আছে, তাই তো? হাজারটা শকুন মরলে একটা উকিল জন্মায়, আমাদের বাংলাভাষারই প্রবাদ। এ লোকটা ডাক্তার না কশাই – আমরাই বলি। প্রথম দেখা দিনদুপুরে পুলিশ ঘুষ খায় – আমরাই গেয়েছি কলেজবেলায়। তো, মিলিটারির বেলায় এসে আমরা থমকে যাই কেন? একেবারে দুর্নীতিহীন ধোয়া তুলসীপাতা দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এমন মনে করি কেন?

কারণ, মিলিটারি বা আর্মিকে স্পেশালি এইভাবে লার্জার দ্যান সেলফ প্রজেক্ট করা হয় জনমানসে। রাষ্ট্র এইটা করে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে। শুধু ভারত রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর যে যে দেশ মিলিটারি পোষে তারাই তাদের আর্মিকে একটা গ্লোরিফায়েড স্টেজে রাখে। কিন্তু ঐ গ্লোরিটাই সব নয়, সেটা বুঝে নেওয়াটাও দায়িত্বপরায়ণ নাগরিকের কর্তব্য। আগের পর্বগুলোতে আমি শুধুমাত্র কাশ্মীরে ভারতীয় আর্মির কীর্তিকলাপ বলেছি, আমি বলি নি মণিপুরে ভারতীয় আর্মি কী করেছে। কারণ সেটা লেখা আমার লেখার পরিসরে আসে না, কিন্তু আজকে আর্মি নিয়ে আলোচনা করতে বসে, আমার মনে হয় এটাও লেখা উচিত। আমাদের অনেকেই শর্মিলা বললে বুঝি সইফ আলি খানের মা। আমরা ইরম শর্মিলা চানুর নাম সবাই শুনি নি। শুনলেও, সদ্য শুনেছি, এই সোশাল মিডিয়া, বিকল্প মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের পরে – গত দু তিন বছরের মধ্যে শুনেছি। মেয়েটি সুদীর্ঘ পনেরো বছর ধরে অনশন চালিয়ে আসছে আজ। মাঝে মাঝেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, হাসপাতালে জোর করে নাসারন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে খাবারের টিউব ঢুকিয়ে দেয়, আবার মাঝেমধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে মুখ দিয়ে খাওয়াতে পারে নি রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রের সেনাবাহিনি।

শর্মিলার প্রতিবাদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনির বিশেষ ক্ষমতা, আফস্পা – তার বিরুদ্ধে। এই আফস্পা – আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল প্রোটেকশন অ্যাক্ট, দেশের “নিরাপত্তা”র নামে চালু আছে মণিপুরে আর কাশ্মীরে। বিনা প্রমাণে সেনা যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, অত্যাচার করতে পারে, গুলি করতে পারে, কোনও বিচার বা প্রমাণের দরকার নেই এই আইনের বলে। দেশের নিরাপত্তার জন্য এটা জরুরি। সেই নিরাপত্তার স্বার্থে যে কত কাশ্মীরি তরুণ পঙ্গু হয়ে গেছে চিরদিনের মত, কত কাশ্মীরি তরুণী যে ধর্ষিত হয়েছে সেনার হাতে, তার আজ আর কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। এ রকমই একজন ছিল থাংজম মনোরমা। মণিপুরের জঙ্গীগোষ্ঠী পিএলএ-র সাথে যুক্ত আছে, এই সন্দেহে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মনোরমাকে – তার ঘর থেকে। পরদিন পাশের ক্ষেতে তার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়, স্কার্টে এবং যৌনাঙ্গে পাওয়া যায় বীর্য। ভারতীয় সেনার একটা অংশ – আসাম রাইফেলস্‌-এর জওয়ানরা তাকে ধর্ষণ করেছিল মেরে ফেলার আগে। আফস্পা-র “বিশেষ” ক্ষমতাবলে।

২০০৪ সালের ঘটনা। ততদিনে শর্মিলার অনশন চার বছরে পড়তে চলেছে। তার চেয়ে বড় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মণিপুরের মহিলারা। নগ্ন হয়ে তাঁরা প্রতিবাদ জানান আসাম রাইফেলসের সদর দফতরের সামনে। সারা পৃথিবী সেদিন জেনেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনির রূপ। আপনারা অনেকেই হয় তো সে ছবি দেখেছেন।

কিন্তু এটাই কি ভারতীয় সেনাবাহিনির একমাত্র রূপ?

না। সেনাবাহিনি একটা দেশের মানুষের জন্য কী করতে পারে, কতটা করতে পারে, সেটা দেখতে পাই আমরা যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উদ্ধারকার্যের জন্য সেনা নামানো হয়। কাশ্মীরে সেনার যে অত্যাচারের গল্প আমি আপনাদের এতদিন ধরে শুনিয়ে এসেছি, সেখানে কাশ্মীর বলতে আমি শুধুমাত্র কাশ্মীর ভ্যালির কথা বলেছি। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটা মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা এবং লাদাখ অঞ্চল। আমি দুবার লাদাখ ঘুরে এসেছি, তার মধ্যে একবার ভারতীয় সেনাবাহিনির আতিথ্যে। সেনা সেখানে যে কীভাবে স্থানীয় লোকেদের সাথে মিলেমিশে কাজ করে, তাদের সাহায্য করে, দেখলে অসাধারণ লাগে। লে-তে খারদুংলা পাসের কথা জানেন হয় তো আপনারা। সেই খারদুং লা পাস পেরোলে শিওক নদী বরাবর উপত্যকাটির নাম নুব্রা উপত্যকা। এই শিওক নদী এঁকেবেঁকে পরে ঢুকে গেছে পাকিস্তানে। লাদাখ উপত্যকার এই অংশটা হিমালয়ে নয়, এটা অবস্থিত কারাকোরাম রেঞ্জে। এর একটা বড় অংশ এক সময়ে পাকিস্তানের অধীনে ছিল। পরে ভারতের অংশ হয়। শীতকালে যখন খারদুংলা বন্ধ হয়ে যায়, তখন এখানকার মানুষজনকে বাঁচিয়ে রাখে সেনা। স্থানীয় লোকজনের ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা, ক্ষেতের ফসল কেটে লে বা শ্রীনগরে বিক্রি করে টাকা এনে দেওয়া, শীতের সময়ে স্থানীয় বাচ্চাদের জন্য হীটার-লাগানো হস্টেল রুম, সেখানে আজও অনেক মানুষ বেঁচে আছেন যাঁরা জন্মেছিলেন পাকিস্তানি হয়ে, এখন তাঁরা ভারতের নাগরিক। পাগলের মত তাঁরা ভালোবাসেন ভারতকে, ভারতীয় সেনাকে। দুর্গম এই সব অঞ্চলে মূলত স্থানীয়রাই সেনার হয়ে ইনফর্মারের কাজ করে দেয় স্বেচ্ছায়, পাকিস্তানের দিক থেকে কোনও ইনফিলট্রেশনের সম্ভাবনা তারাই রুখে দেয় অনেকাংশে।

এই নুব্রা ভ্যালি থেকেই একটা রাস্তা চলে যায় ডানদিকে, সিয়াচেন বেস ক্যাম্প। তার কাছাকাছি গিয়ে আমি ঘুরে এসেছিলাম। সেনাবাহিনির কর্নেল থেকে ডাক্তার থেকে সাধারণ সিপাহী, বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে আমি কথা বলেছি। লাদাখ, সেখানকার লোক আর সেখানকার সেনাবাহিনিকে নিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেতে পারি – আমার দু দুখানা ট্র্যাভেলগও আছে এই ব্লগেই।

তো, মূল ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ভারতীয় সেনাবাহিনি ভগবানের অংশ না শয়তানের দল?

কোনওটাই না। অথবা দুটোই। ঠিক যেমন ভালো ডাক্তার হয়, খারাপ ডাক্তার হয়, ভালো শিক্ষক হয় আবার খারাপ শিক্ষক হয়, পুলিশ উকিল ব্যবসায়ী – সব প্রফেশনেই যেমন ভালো বা খারাপ দুইই থাকে, ভারতীয় সেনাও তাই। এরা মহানও নয়, শয়তানও নয়। কিংবা দুটোরই একটা সমসত্ত্ব মিশ্রণ। এই সময়ে, কানহাইয়া জেলে যাওয়া থেকে ছাড়া পাবার পর পর্যন্ত – প্রচুর দেশপ্রেমিকের উষ্মায় ভেসে আসছে একটা কমন ফ্রেজ, সে কমন ফ্রেজ শোনা গেছে এমনকি দিল্লি হাইকোর্টের ধর্মাবতার শ্রীমতি প্রতিভারানীর বয়ানেও – ভারতীয় সেনা কী মহান, সেনা সীমান্তে দাঁড়িয়ে দিনরাত পাহারা দিচ্ছে বলেই না তোমরা জেএনইউতে বসে দেশবিরোধী স্লোগান দিতে পারছো! একবার ওদের মহত্ব, ওদের আত্মত্যাগের কথা ভাবো, ভাবো একবার শহীদ হনুমন্তাপ্পার স্ত্রী এই সব দেশবিরোধী স্লোগান শুনে কতটা দুঃখ পাচ্ছেন। তোমাদের যদি এক্ষুনি ঘেঁটি ধরে সিয়াচেনে ছেড়ে আসা হয়, ওখানে অক্সিজেন এত কম যে সেখানে তোমরা একঘন্টাও সারভাইভ করতে পারবে না।

আরও শোনা যাচ্ছে, শিক্ষার কী প্রয়োজন? অল্পশিক্ষিত জওয়ানরা ওখানে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য জান কুরবান করে দিচ্ছেন, আর পিএইচডি করা শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলছেন। এ যদি দেশদ্রোহিতা না হয়, তা হলে দেশদ্রোহিতা কী?

শ্রীমতি প্রতিভারানীকে সবিনয়ে জানাই, আপনি আইন সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছেন, আপনি আইনজ্ঞ, আপনার জাজমেন্ট আইনের পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে মনে হয় আরেকটু বেশি অ্যাপ্রিশিয়েশন পেতেন আপনি। লাদাখ বা সিয়াচেন বা সেনাবাহিনির দেশপ্রেম আপনার ডোমেনের বিষয় নয়, খামোকা কেন সে সব নিয়ে জাজমেন্টে লিখে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুললেন? শ্রীমতি প্রতিভারানী, হুট করে কাউকে সিয়াচেনের টপে নিয়ে গেলে কেউই এক ঘন্টা বা দু ঘন্টার বেশি সারভাইভ করতে পারে না, আপনিও না, আমিও না, কানহাইয়াও না, এমনকি সেনাবাহিনির একটি জওয়ানও না। এর জন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়, অ্যাক্লাইমেটাইজেশন বলে একটা ব্যাপার আছে, সেইটা করতে হয়, ধাপে ধাপে তাকে হাই অলটিটিউডের সাথে সইয়ে নেওয়া হয়, তার পরে তাকে সিয়াচেন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এটা সেনাবাহিনির কোনও একস্ট্রা তাকত নয়, এই ট্রেনিং  পেলে যে কেউই সিয়াচেনে তিন মাস সারভাইভ করে যেতে পারে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এত ট্রেনিং-এর পরেও সিয়াচেনে তিন মাসের বেশি কাউকে রাখা হয় না। ট্রেনিং পেলে আমিও সারভাইভ করে যাবো, এবং আনন্দের সঙ্গে আমি আজও এই ট্রেনিং নিয়ে সিয়াচেনে তিন মাস কাটিয়ে আসতে ইচ্ছুক। এর সাথে দেশপ্রেমের কুনও সম্পকো নাই ম্যাডাম। আগেই বলেছি, বেশ কিছু বিভিন্ন র‍্যাঙ্কের সেনাবাহিনির লোকের সাথে আমি কথা বলেছি, ম্যাডাম, বুকভরা দেশপ্রেম নিয়ে বিশেষ কেউ সেনাবাহিনিতে চাকরি করে না। তারা, চাকরি করে বলে চাকরি করে। যেমন আপনি চাকরি করেন হাইকোর্টে, আমি করি অন্যত্র, তেমনি ওরাও এই কাজগুলোর পরিবর্তে মাইনে পায়, সিএসডি ক্যান্টিন থেকে সাবসিডাইজড র‍্যাশন পায়। পার্ট অফ জব হিসেবেই ওদেরকে সীমান্ত পাহারা দিতে হয়, মৃত্যুকে যে কোনও সময়ে ওয়েলকাম জানানো তাদের চাকরিরই অঙ্গ, সেটা জেনেই লোকে সেনাবাহিনিতে ভর্তি হয়, ডিউটি করে আর দিন গোনে – কবে ছুটি পেলে “দেশে” যেতে পারবে, ঘরের লোকজনের মুখ দেখতে পারবে। দিনের পর দিন একই ডিউটি দিতে ওরা “বোর” ফীল করে। লাদাখের অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ওদের টানে না। আমি যখন কর্ণেলকে বললাম, আমি আবার আসব, এবার দিল্লি থেকে বাইক চালিয়ে – কর্ণেল আঁতকে উঠে বললেন, ওরেবাবা, শুনেছি অনেক পাগল আসে এখানে বাইক চালিয়ে – আমি ওইসব অ্যাডভেঞ্চারে একেবারে নেই। আমাকে ওসব টানে না। চাকরির প্রয়োজনে থাকতে হয়, তাই আছি – চেষ্টা করছি যাতে দিল্লিতে বা চণ্ডীগড়ে একটা পোস্টিং পেয়ে যাই।

মানে মোদ্দা কথা হচ্ছে, মনে এই অ্যাডভেঞ্চার স্পিরিটটা থাকলে আর সঠিক ট্রেনিং পেলে আমি আপনি রামাশ্যামাযদু যে কেউ ওই অলটিটিউডে গিয়ে সারভাইভ করতে পারে, এতে সেনাবাহিনির আলাদা বিশেষ কোনও ক্রেডিট নেই। সেনার তরফে এই ট্রেনিং দেওয়া হয়, তাই সেনার লোকজন ওখানে সারভাইভ করতে পারে। এটুকুই।

কথায় কথায় দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহিতার বিতর্কে সেনাবাহিনির আত্মত্যাগের প্রসঙ্গ টেনে এনে যাঁরা তাঁদের মহান প্রমাণ করতে সর্বদাই ব্যগ্র, তাঁদের জন্য এটুকুই – সেনাবাহিনির চাকরি আর পাঁচটা চাকরির মতই চাকরি। বাড়তি মহান টহান কিস্যু নয়, ওটা রাষ্ট্রের তৈরি করা একটা ফাঁপানো বেলুন। যে লোকটা মহারাষ্ট্রে মধ্যপ্রদেশে চাষ করে ফসল ফলাচ্ছে আর ঠিকমত দাম না পেয়ে কীটনাশক খেয়ে সপরিবারে আত্মহত্যা করছে, যে লোকটা হাই টেনশন ইলেক্ট্রিকের পোলে উঠে লাইনের ফল্ট সারাচ্ছে, যে লোকটা ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নেমে ফুসফুসে টেনে নিচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস, যে লোকটা স্রেফ দু পায়ে দড়ি বেঁধে হাঁইহাঁই করে নারকোলগাছে উঠে যাচ্ছে, নারকোল পেড়ে দিচ্ছে আপনি বিক্রি করবেন বলে – এরা সকলেই কিন্তু “দেশের” জন্যই কাজ করছে এবং এদের প্রত্যেকের কাজে জড়িয়ে রয়েছে সাঙ্ঘাতিক জীবনের ঝুঁকি, এক বিন্দু ভুল হলে মৃত্যু। কিন্তু এদের মহান বলে ভাবতে শেখানো হয় না। কারণ দেশপ্রেম এমন একটা জিনিস, যেটা দেখাতে গেলে আমাদের সামনে একটা “শত্রু” খাড়া করতে হয় সামনে – সীমাপারের শত্রু, অন্যদেশের দুশমন। এই লোকগুলোর সামনে তো কোনও শত্রু নেই, দুশমন নেই – তাই এদের মহান বলা যায় না। অথচ সকলেই এই ঝুঁকিগুলো নেয় পয়সার বিনিময়ে, সুবিধের বিনিময়ে। সেনার জওয়ান থেকে নারকোল গাছে ওঠা লোকটা – সক্কলে। ফ্রি সার্ভিস কেউ দিচ্ছে না স্যার।

ইন্ডিয়ান আর্মিকে তাই, “মহান” হিসেবে প্রজেক্ট করতে, আমি অপারগ। তাই বাকি তর্কগুলোর মধ্যে আমি ঢুকছি না।

কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ এবং অনির্বাণ ভটাচার্যের সমর্থনে যাঁরা কথা বলছেন, লেখালিখি করছেন, তাঁদের মধ্যে, স্পষ্টত, দুটো ভাগ রয়েছে। একদল বলছেন, কানহাইয়া তো দেশদ্রোহমূলক কোনও স্লোগান দেয়ই নি, ওকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল ইত্যাদি। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে এইটা স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, দেশদ্রোহমূলক স্লোগান দিলে হয় তো কানহাইয়াকে গ্রেফতার করাটা জাস্টিফায়েড হত, পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে কিছু উকিলবেশী গুণ্ডা দ্বারা তার মার খাওয়াটারও একটা সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যেত। এবং উমর খালিদ যে হেতু প্রকারান্তরে স্বীকার করেই নিয়েছে যে সে সেই “দেশদ্রোহমূলক” স্লোগানের সাথে যুক্ত ছিল, তাই সিডিশনের চার্জ তার ওপর লাগাটা অযৌক্তিক কিছু নয়।

অন্যদলের বক্তব্য আরেকটু এক্সট্রিম। তাঁরা বলছেন, স্লোগান দিয়েছে বেশ করেছে। আমরা সমর্থন করি না সেই সব স্লোগান, কিন্তু এটাও মানি না যে শুধু স্লোগান দেবার জন্য কাউকে গ্রেফতার করা যেতে পারে, সিডিশনের চার্জ লাগানো যেতে পারে। এটা অনৈতিক, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী, ইন ফ্যাক্ট সিডিশন অ্যাক্টটাই একটা ভুলভাল অ্যাক্ট, অবিলম্বে এটা তুলে দেওয়া হোক।

আমাদের মধ্যে অনেকেই দেশকে ভালোবাসার প্রসঙ্গ উঠলে অ্যাকেবারে মুক্তকচ্ছ হয়ে যান, যুক্তিতক্কের একেবারে ধার ধারেন না। এক দুজন দেশপ্রেমিক, যাঁরা এমনিতে দলিতদের ঠিক অমানুষ মনে না করলেও “ভদ্রলোকের” মর্যাদা দিতে চান না, তাঁরাও খুব ইমোটিকন সহ বলতে লাগলেন, হুঁহুঁ বাবা, আম্বেদকর স্বয়ং এই জিনিসটি সংবিধানে রেখেছিলেন, সে কি এমনি এমনি? কে বলেছে দেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিলে সেটা দেশদ্রোহ হয় না? জেল তো তুচ্ছ ব্যাপার, এদের ফাঁসি হওয়া উচিত। স্লোগান তো পরের ব্যাপার, দেশকে টুকরো করার কথা ভাবলেও ফাঁসি হওয়া উচিত বলে জানালেন ফেসবুকে তর্ক চালানো আরেকজন।

এঁদের অনেকেই জানেন না, এই সিডিশন অ্যাক্ট বা দেশদ্রোহমূলক আইন – এটি ভারতীয় সংবিধানে নেই। এটি আসলে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা আইপিসি-র অন্তর্গত, যা মূলত ব্রিটিশ জমানায় বানানো হয়েছিল এবং তার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি আজও।

আলোচনায় যাবার আগে, আসুন একবার দেখে নেওয়া যাক, কী এই সিডিশন অ্যাক্ট। গুগল করলেই পাওয়া যায়, তবুও আমি লিখে দিই।

Section 124A (Sedition) as it read in the 1860 original version of the Indian Penal Code:

Whoever, by words, either spoken or written, or by signs, or by visible representation, or otherwise, brings or attempts to bring into hatred or contempt, or excites or attempts to excite disaffection towards [Her Majesty or](1) the Government established by law in [British India](2), [British Burma](3) shall be punished with [Transportation for life or any shorter term](4), to which fin…e may be added, or with imprisonment which may extend to three years, to which fine may be added, or with fine.

১৮৬০ সালের আইন, একটু অদল বদল করে চলছে আজও। 1 আর 3 সরিয়ে দিন, 2-কে রিপ্লেস করুন ইন্ডিয়া দিয়ে, আর 4-কে রিপ্লেস করুন লাইফ ইমপ্রিজনমেন্ট দিয়ে। এসে যাবে আজকের সিডিশন অ্যাক্ট। এই আইন ব্রিটিশরা বানিয়েছিল ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে ভারতকে শাসন করার জন্য। ক্ষুদিরামের ফাঁসি, ভগৎ সিং সুখদেব রাজগুরুর ফাঁসি, গান্ধীর কারাবাস, নেতাজি সুভাষ বোসের গৃহবন্দী দশা বা তার আগের কারাবাস, ইত্যাদি সমস্তই করা হয়েছিল এই সিডিশন অ্যাক্ট দ্বারা। বৃটিশ আমলে এই আইনে এমন অনেকে অভিযুক্ত হয়েছেন যাঁদের আমরা পরবর্তীকালে দেশনায়ক হিসেবে সম্মান করেছি। বৃটিশ আমলের সব জিনিসই খারাপ এমন কথা আমি বলি না। কিন্তু মজার ব্যাপার, যাঁরা এই আইন দেখিয়ে টপাটপ লোকজনকে জেলে পুরতে চাইছেন তাঁরাই কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করেন, পশ্চিমা প্রভাবকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তাঁদের আমি শুধু এটাই মনে করিয়ে দিতে চাই সেকশন 124A ভারতীয় সংস্কৃতি নয়, এটা একান্তই পশ্চিমা আমদানী।

আর আজ এই আইনকে নিজের মত ব্যবহার করছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে সুচারুভাবে “দেশদ্রোহিতা” হিসেবে প্রজেক্ট করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে উমর খালিদকে, অনির্বাণকে, কানহাইয়াকে। রাষ্ট্র আর দেশের মধ্যে যে একটা মোটা দাগের পার্থক্য আছে, সেটাকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সীমাপারের সেনাবাহিনির আত্মত্যাগের কাহিনি শুনিয়ে। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোকে সরাসরি দেগে দেওয়া হচ্ছে “দেশদ্রোহিতা” নামে। যে কোনও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মতানৈক্য হবার যে স্বাধীনতা, যা আসলে বাকস্বাধীনতারই একটা রূপ, ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসেন্ট (Dissent), তাকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে রাষ্ট্রের মদতে।

সংস্কৃতির কথা যখন উঠলই তখন একবার ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন নিয়ে প্রাচীন ভারত কি ভাবত দেখে নেওয়া যাক। আমার বন্ধু শুচিস্মিতার কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এই অংশটুকু মনে করিয়ে দিতে আমাকে সাহায্য করার জন্য।

ছোটবেলায় সহায়ক পাঠে উপনিষদের গল্প, পুরাণের গল্প আমার খুব প্রিয় ছিল। এই বইগুলোতেই আমি যম ও নচিকেতার গল্প পড়ি, উদ্দালক ও শ্বেতকেতুর গল্প পড়ি, গার্গী ও যাজ্ঞবল্ক্যের গল্প পড়ি। এগুলো সবই প্রশ্নোত্তরের গল্প। নচিকেতা যমের কাছে মৃত্যুর স্বরূপ জানতে চাইছেন। শ্বেতকেতু আত্মার স্বরূপ জানতে চাইছেন। গার্গী ব্রহ্মের স্বরূপ জানতে চাইছেন। ভারতের সংস্কৃতি চিরকালই প্রশ্ন করার অধিকারকে মান্যতা দিয়েছে। মহাভারত সকলেই পড়েছেন। না পড়ে থাকলেও বি আর চোপড়ার টিভি সিরিয়াল তো অবশ্যই দেখেছেন। সেখানেও দ্রৌপদী ভরা রাজসভায় যুধিষ্ঠিরকে ভর্ত্সনা করছেন। যুধিষ্ঠির রাজা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সেই নিন্দা সহ্য করতে হয়েছে। যুদ্ধের শেষে সন্তানহীনা গান্ধারী কৃষ্ণকে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছেন। যদিও তিনি জানতেন কৃষ্ণ ভগবানের অংশ, তবু অভিশাপ দেওয়া আটকায় নি। কৃষ্ণও মাথা পেতে সেই অভিশাপ নিয়েছেন। পদমর্যাদায় খাটো হলেই বিনাপ্রশ্নে সব অন্যায় মেনে নিতে হবে ভারতীয় সংস্কৃতি একথা বলে না। ভারতীয় সংস্কৃতি বরং শেখায় অন্যায় যুদ্ধের শেষে অর্জুনের হাত থেকেও গান্ডীব খসে যায়, ভগবানও সবংশে ধ্বংস হন।

নির্বংশ হওয়াকে কি হিন্দী অনুবাদে “বরবাদী” বলা চলে? জেএনইউতে সেরকমই কিছু শোনা যাচ্ছিল না?

ন্যাশনালিজম, জাতীয়তাবাদ আসলে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবদান। ইওরোপ থেকে আগত। সেখানে ছোট ছোট একেকটা নেশন তাদের জাতীয়তাবাদকে নিজ নিজ পদ্ধতিতে রক্ষা করত। ভারত তো ইওরোপিয়ান কোনও নেশন নয়, বরং ভারতের বহুত্ববাদের কথা বিবেচনা করে বলা যায়, ভারত হল নেশন অফ নেশনস। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। এই যে বিবিধতা, এই যে বৈচিত্র্য, এর মধ্যেই কিন্তু রয়েছে “নানা মত”-এর কথাও। ভিন্নমতকে সহ্য করার ক্ষমতার ওপরেই টিকে থাকবে এর বহুত্ব, এর বৈচিত্র্য। রাষ্ট্র যত বেশি গলা টিপে ধরার চেষ্টা করবে এই ভিন্নমতের, তত বেশি বিভেদকামী শক্তি মাথাচাড়া দেবে, শান্তির পথ ছেড়ে অন্য পথ বেছে নেবে। দমননীতি শর্ট টার্মে সফল হয়, লং টার্মে সফল হয় না। কাশ্মীর, মণিপুর তার একেকটা জলজ্যান্ত উদাহরণ।

দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে তাকানো যাক। আগের পর্বে আমি ইংলন্ড আর স্কটল্যান্ডের গল্প লিখেছিলাম, এমনকি আমেরিকাতেও বিভিন্ন সময়ে দেশবিরোধী স্লোগান শোনা গেছে, আমেরিকার জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়েছে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে, এবং সমস্ত দেশের মত এই দেশেও এই বিপ্লবে আগ্রণী হয়েছিল ছাত্ররাই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে, বা হালফিলের ইরাক যুদ্ধের সময়ে।

একটি লোককেও গ্রেফতার করা হয় নি, একজনের নামেও সিডিশনের চার্জ লাগানো হয় নি, একজনকেও ফাঁসি দেওয়া হয় নি। আমেরিকা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, মতপার্থক্যে বিশ্বাসী, যতক্ষণ না কেউ আমেরিকার বরবাদী চেয়ে সত্যি সত্যি হাতে অস্ত্র তুলে না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকা তার নাগরিকদের বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

আবার দেশের দিকে তাকানো যাক। তামিলনাড়ুর কুডানকুলামে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা চলছিল গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। স্থানীয় লোকজন দীর্ঘদিন ধরে এর বিরোধিতা করে আসছিল বিভিন্ন কারণে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে, তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হবে। উন্নয়নকামী দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা অবশ্য তাদের এই প্রতিবাদকে মান্যতা দেয় না, তাদের মনে করে উন্নয়নের পরিপন্থী, কিছু দুষ্টু এনজিও-র সাথে হাত মিলিয়ে তারা দেশের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

ভারত সরকারও সেই পথেই ভাবেন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি বসানোর যে সব সেফটি নর্মস মেনে চলতে হয়, তা মানা হচ্ছে না বলে প্রতিবাদকারী জনতা এবং এনজিও-দের ওপরে রাষ্ট্র নামিয়ে এনেছিল দেশদ্রোহের ডাণ্ডা। আজ পর্যন্ত কমবেশি আট হাজারের ওপর মানুষ দেশদ্রোহের দায়ে সেখানে অভিযুক্ত।

তো, সেই অন্যদলের যা বক্তব্য, সেইটুকু বক্তব্য আমারও – স্লোগান দেওয়াটা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়, আমি একমত হতে না-ই পারি, তবে তার জন্য স্লোগান দেওয়া লোকগুলোকে একবার বকে দিলেই যথেষ্ট হত, সীমান্ত পাহারা দেওয়া সেনাবাহিনির দোহাই দিয়ে সিডিশনের কেস লাগানো একেবারেই আইন নিয়ে ছেলেখেলার সামিল, আর সেই ছেলেখেলাকে এখন জাস্টিফিকেশন দিতে গিয়ে একের পর এক নেতামন্ত্রীর দল আরও আরোও কুযুক্তি, কুতর্কের অবতারণা করে চলেছেন।

(২)

প্রশ্নোত্তর পর্বে আসি। বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর আমি কমেন্টের নিচেই দিয়েছিলাম, তাও একবার দেখে নিই কিছু বাকি রয়ে গেল কিনা।

snapitam লিখেছেন – একটা প্রশ্ন করার ছিল! ভারতীয় সৈন্য দের ধৈর্য বা সদিচ্ছা ছিলনা বললেন। কোনো রাষ্ট্রই কি আজ অব্ধি তাদের বোড়ে দের এই দুটো অস্ত্রর প্রয়োগ শেখায়? শিখিয়েছে এযাবৎ?
ভীষন প্রাসঙ্গিক লেখা – Kasmir Crushible বইটা ও পড়ে দেখতে পারেন…

তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কাশ্মীর নিয়ে বইটার রেফারেন্স দেবার জন্য। আমি কাশ্মীর নিয়ে এখনও পড়ছি, যত পড়ছি তত জানছি। আগের পর্বে দুটো বইয়ের নাম দিয়েছিলাম, আপনি তৃতীয় বইয়ের নাম দিলেন, আমি আরেকটা বইয়ের নাম দিচ্ছি – কাশ্মীরঃ রুটস অফ কনফ্লিক্ট, পাথস টু পীস – সুমন্ত্র বোসের লেখা, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রকাশন।

বাবু চৌধুরি প্রশ্ন করেছেন, মুসলিমরাই কেন সন্ত্রাসবাদের রাস্তা বেছে নিল? এত যে হাজার হাজার কাশ্মীরি পণ্ডিত ঘরছাড়া হয়েছেন, কই তাঁরা তো অস্ত্র তুলে নেন নি আজও?

অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা আমার জানা নেই। কোন কমিউনিটি কখন কোন পরিস্থিতিতে হিংসার পথ বেছে নেবে, সেটা বলা মুশকিল। কাশ্মীর ভ্যালির মুসলিমরা হিংসার জন্য প্রত্যক্ষ মদত পেয়েছিল পাকিস্তানের থেকে, ট্রেনিং পেয়েছিল, গোলাবারুদ পেয়েছিল। সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু একমাত্র কারণ নয়।

চাকরিক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন কমিউনিটির লোকজন আন্দোলন করছেন। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন রাষ্ট্রের কাছে। গুজরাতে পটেল সম্প্রদায়। হরিয়ানায় জাট। একদল হিংসার পথ নেয় নি। তাদের নেতা হার্দিক পটেল এখন জেলে বন্দী। অন্যদিকে হরিয়ানার অবস্থা দেখুন। এক সপ্তাহের ভায়োলেন্সে কত হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পত্তির বিনাশ, কত লোকের রোজগার চলে গেল, বাড়ি পুড়ে গেল, ব্যবসা পুড়ে গেল, জীবন চলে গেল, গণধর্ষণেরও খবর শোনা যাচ্ছে, যদিও প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

কমিউনিটি, মব, কখন সহিংস হয়ে ওঠে, কতক্ষণ অহিংস থাকে, এ বড় জটিল ক্যালকুলেশন। দশ রকমের কারণ থাকে সে সবের পেছনে। এই মানসিকতাকে কোনও বিশেষ ধর্ম বা কমিউনিটির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা তাই মুর্খামির পরিচয়। উনিশশো চুরাশি সালে যে পাইকারি হারে শিখহত্যা হয়েছিল, হত্যাকারেদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য ৫ই ডিসেম্বর ১৯৯২ যে সুবিশাল জনতা জড়ো হয়েছিল অযোধ্যায় অস্ত্র হাতে, তারা কেউই কাশ্মীরি মুসলমান বা জাট কমিউনিটি হিসেবে পরিচিত ছিল না।

সোহেল লিখেছেন – তাই কি এঁরা এখন চাইছেন কাশ্মীরের স্বাধীনতা? তাই পাকিস্তানের নারা নিচ্ছে?

সোহেল, আপনি ভুল করেছেন, কাশ্মীরের স্বাধীনতা চেয়ে চলেছে একদল লোক, কাশ্মীরে, দিল্লিতেও। ভারতের বরবাদীর স্লোগানও উঠেছে। কিন্তু কেউ পাকিস্তানের নামে “নারা” লাগায় নি। অন্তত আমি যেটুকু জানি। আর তার পরেও বলব, পাকিস্তানের নারা লাগালে তাকে একবার বকে দেওয়াই এনাফ। এত ঘেন্নার দৃষ্টিতে দেখার তো কোনও দরকার নেই! আমি যদি বলি ফ্রান্স জিন্দাবাদ বা সিঙ্গাপুর জিন্দাবাদ বা অস্ট্রেলিয়া জিন্দাবাদ, আপনার খুব খারাপ লাগবে কি? তা হলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে এত খারাপ লাগার কী আছে? বললে কী এসে যায়?

সুমন সরকার যা লিখেছেন তা বাছা বাছা গালাগালিতে ভর্তি। তাই উত্তর না দিয়েই আমি স্কিপ করে যাচ্ছি।

নীলাঞ্জন দাম লিখেছেন, তা হলে সমাধানটা কী? সব্বাই তো খারাপ, আর্মি খারাপ, পলিটিশিয়ানরা খারাপ – সমাধানটা যদি বলে দিতেন।

দামি প্রশ্ন। আসলে সমাধান আমার হাতে নেই। সমাধানসূত্র লিখব বলে আমি এ লেখা লিখিও নি। আসলে, সমাধান কোনও একজনের হাতে নেই – সমাধানের কথা চিন্তা করতে গেলে সবার আগে সমস্যাটাকে বুঝতে হবে। আমি সমস্যাটা বোঝাবার চেষ্টা করেছি মাত্র। তাও আমি প্রায় কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারি নি। কাশ্মীর সমস্যার পরিধি এত বিশাল আর এত গভীর, একটা দুটো মেড-ইজি ব্লগে এর আলোচনা করা সত্যিই সম্ভব নয়। আমার এক বন্ধু শুধু কাশ্মীর সমস্যার ওপর বাংলা ভাষায় একটা চমৎকার লেখা লিখে চলেছেন – এইখানে, উৎসাহীরা পড়ে ফেলতে পারেন। সহজ সরল ভাবে লেখা। আমি আর্মি খারাপ বা পলিটিশিয়ানরা খারাপ – এইটা প্রমাণ করতে চাই নি। আসলে আর্মি মানেই লার্জার দ্যান লাইফ একটা ভগবানসম মূর্তি যারা অতন্দ্র পাহারায় রক্ষা করে চলেছে দেশের সীমান্ত – তাই তাদের দেশভক্তি দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত, এই মিথটা আমি ভাঙতে চেয়েছি। ভালো খারাপ মিলিয়ে মিশিয়েই ইন্ডিয়ান আর্মি। দুনিয়ার যে কোনও দেশের আর্মিই তাই। বাড়তি মহান ভাবার জাস্ট কোনও দরকার নেই, গ্রাউন্ড রিয়েলিটি থেকে সমস্যাটার পর্যালোচনা করাটাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।

“রয়” লিখেছেন, আপনি তিব্বত নিয়ে কিছু লিখলেন না দেখে হতাশ হলাম। আর কাশ্মীর থেকে এসে দিল্লিতে শুধু অ্যান্টিন্যাশনাল কথা নয়, অনেকেই সন্ত্রাসবাদী কাজও করছে, তাতে ভারত নামক দেশের অনেক সাধারণ মানুষ মারাও যাচ্ছেন, আগেও গেছেন। সরকার তো সাধারণ মানুষের প্রাণহানি চাইবে না তাই কিছু অতিবিপ্লবীকে ফাঁসি দিতেই হয়।

রয়, আমি সে অর্থে ইজরায়েল নিয়ে কিছু লিখি নি, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার সমস্যা নিয়ে কিছু লিখি নি, অনেক কিছু নিয়েই লিখি নি। তিব্বত নিয়ে লেখার পরিসর এখানে ছিল না। কাশ্মীর নিয়ে এত বড় আলোচনা করে চলেছি শুধুমাত্র আফজল গুরুদের জন্মের বৃত্তান্তটা বোঝার জন্য, বোঝাবার জন্য। আর কাশ্মীর মানে, শুধুমাত্র কাশ্মীর ভ্যালির কথা হচ্ছে। জম্মু নয়, লাদাখও নয়।

আর আপনি আমার কথারই প্রতিধ্বনি করছেন। সন্ত্রাসবাদের আমি ঘোর বিরোধী। সকলেই তাই। যে বা যারা বন্দুক হাতে সন্ত্রাস চালায় এ দেশে, ইন ফ্যাক্ট যে কোনও দেশে, তাদের বন্দুক নিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। মারতে হয়, ধরা পড়লে ফাঁসিও দিতে হয়। তাই নিয়ে আপনার সাথে আমার কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু শাস্তিপ্রক্রিয়া আসে অপরাধ প্রমাণিত হবার পরে। ভারতের আইন এমনকি আজমল কাসভের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার আগে তার ফাঁসি দেয় নি। এবং তাই নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্নও তোলে নি।

আফজল গুরুর কেসটা একটা পয়েন্ট অফ ডিবেট হয়ে আছে অনেকদিন ধরে। সরাসরি কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি সংসদ হামলায় তার জড়িত থাকার। জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে রেখে, নিজের মূত্র নিজেকে খেতে বাধ্য করিয়ে, আরও নানাবিধ অত্যাচারের পরে আফজলকে দিয়ে স্বীকার করানো হয় পুলিশের হেফাজতে যে সে “যুক্ত ছিল”। পরে আদালতে সে বার বার অস্বীকার করে এবং বলে যে তাকে অত্যাচার করে এই স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে – কিন্তু আদালতে সেকথা পাত্তা পায় নি। জাতীয়তাবাদের বোধ সময়বিশেষে ন্যায়াধীশদেরও অন্ধ করে দেয়। তাই সরাসরি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ “জাতির বিবেক”-কে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আফজলের ফাঁসি হয়। ফাঁসির চিঠি আফজলের পরিবারকে পাঠানো হয় ফাঁসির কয়েক ঘণ্টা আগে, আফজলের স্ত্রী সে চিঠি পান যখন, তখন আফজলের ফাঁসি হয়ে গেছে। আফজলের মৃতদেহ তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নি, তিহাড় জেলেই সমাধিস্থ করা হয়েছে।

আগেও বলেছি, আবারও বলছি, জেএনইউয়ের সেদিনের প্রতিবাদের মূল বিষয়টাই ছিল এইটা। জুডিশিয়াল কিলিং অফ আফজল। এবং এই প্রতিবাদের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। এটা একটা জুডিশিয়াল কিলিং, যতই না সে কিলিং সুপ্রিম কোর্টের হাতে হোক। সুপ্রিম কোর্টও কোনও ভগবান নয়, কিছু মানুষই চালায়। সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত হবার পরে যুক্তিপূর্ণভাবে তার ফাঁসি হলে কারুরই কিছু বলার অবকাশ থাকত না, কিন্তু এই বিচারপদ্ধতিটাই একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন রেখে দিয়েছে আজও। ইন্টারনেটে সার্চ করলে এর ওপরে অনেক লেখা পাবেন, দেশি বিদেশী নামকরা স্কলারদের লেখা। এটা শুধু মুর্খ আমার বা জেএনইউয়ের বাচ্চাদের দৃষ্টিভঙ্গীমাত্র নয়।

shanmed লিখেছেন, “অনেকে বলছে কাশ্মীরকে স্বা—– ধীনতা দিতে হবে। তা দাও না– অসুবিধা কি আছে? এমনিতে কাশ্মীরের পশ্চিমদিকে সিয়াচেন- কার্গিল অন্যদিকে তিব্বত-চায়না। ইন্ডাস্ট্রি তেমন কিছু নেই। এখন সেনা রাখতে, রেশন দিতে কোটি – কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। আলাদা দেশ হলে তখন আমরা চড়া দামে জিনিস বেচব — ওদের। খাবারদাবার – মোটর গাড়ি , পোশাক, তেল, গ্যাস — সব কিছুই আমরা বেচব ওদের। আমাদের স্যাটেলাইট গুলো ওরা ব্যবহার করবে আর ভাড়া গুনবে। অনেক বিদেশি মুদ্রা আয় হবে।”

তাঁকে আমি সেখানেই উত্তর দিয়েছি, আর বেশি কিছু লেখার প্রয়োজন নেই। shanmedএর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে আমার, এবং সুন্দর মনোগ্রাহী আলোচনা, আপনারা প্রথম পর্বের নিচে মতামত সেকশনে গিয়ে পড়ে আসতে পারেন। যদিও শেষটা মধুর হয় নি। একই রেটোরিক এসে গেছে, বাংলাদেশে যে এত মুসলিম এই করেছে, সেখানে হিন্দুরা নির্যাতিত, তাই নিয়ে কেন কিছু লিখলেন না – ইত্যাদি।

আমার তরফে এটুকুই, দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশেই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার করে। তাদের রক্ষা করে রাষ্ট্র। আমি এই প্রবন্ধ ঠিক হিন্দুর ওপর মুসলিম বা মুসলিমের ওপর হিন্দুর অত্যাচার নিয়ে লিখছি না। ধর্মের নামে হানাহানি যুগ যুগ ধরে দুনিয়ার সর্বত্র হয়ে এসেছে। ভারতে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, বার্মায়, শ্রীলঙ্কায় – তার থেকে আলাদা কিছু হচ্ছে না। সেগুলো নিয়ে অবশ্যই কড়া নিন্দে হওয়া দরকার, আলোচনা হওয়া দরকার – ইন ফ্যাক্ট আমি ঘোর নিন্দা জানাই এই পরিকল্পত এথনিক ক্লিনসিং-এর পদ্ধতির, কিন্তু আবারও – সেটা এই লেখার পরিসরে আসে না। আমরা পরে অন্য কোনও লেখায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

এর পরে সন্দীপের বক্তব্য, তার জবাবও আমি সেখানেই দিয়ে দিয়েছি। অতনু-র বক্তব্যেও তাই।

আদৃতা কর লিখেছেন – তবে কি কাশ্মীরের স্বাধীনতা পাবার জন্য ভারতের বরবাদীকে সমর্থন করতে হবে? … আপনার জানা উচিত, যে কাশ্মীর শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্ট্র্যাটেজিক কারণেও ভারতের কাছে ইমপর্ট্যান্ট, … আজকে যদি কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে কি পাকিস্তান আর চীন বসে থাকবে? তখনও কিন্তু তাদেরকে সাহায্য করার জন্য ইন্ডিয়াকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আরও কিছু লিখেছেন, পুরোটা বাংরেজিতে লেখা, তাই টুকতে অসুবিধা হচ্ছে, তবে আমার মনে হয় তাঁর বেশির ভাগ প্রশ্নের জবাব আমি এই লেখায় দিয়ে দিয়েছি। আবারও বলি – ভারতের বরবাদী আমি সমর্থন করি না, কেউই করে না। কিন্তু যে বা যারা করেছে তাদেরকে দেশদ্রোহের দায়ে জেলে ঢোকানোও আমি সমর্থন করি না। কাশ্মীর স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনের কারণে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, কিন্তু সেটা কাশ্মীরের মানুষকে বাদ দিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। কাশ্মীরের মানুষ কিন্তু শুরু থেকেই এমন হস্টাইল ছিল না ভারতের ওপর। ওপরে একটা লিঙ্ক দিয়েছি, আমার বন্ধু কাশ্মীর নিয়ে লিখছেন, সেইটা একবার পড়ে নিতে অনুরোধ করি। কিন্তু ভারত, কাশ্মীরিদের সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ভূক্তির পথে না গিয়ে নিজের সেনাবাহিনির পেশিশক্তি আর বন্দুকের নলের ওপর বেশি জোর রাখতে গেল, সমস্যার শুরু সেইখানে হল, এটাই আমি বলতে চেয়েছি।

এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, না, কাশ্মীরকে ধরে রেখেও বিশেষ কিছু লাভ হচ্ছে না, হাজারে হাজারে হনুমন্তাপ্পার মত জওয়ান মারা যাচ্ছে সত্যিকারের কোনও শত্রুর সাথে যুদ্ধ না করেই, অন্যদিকে কাশ্মীরকে ছেড়ে দিয়েও ভারতের ক্ষতি বই লাভ হবে না। সমস্যা অনেক গভীরে চলে গেছে, এই ক্ষত সারানো এখন প্রায় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। তাই আমাদের এই কাশ্মীরে সেনার উপস্থিতি আর একইসঙ্গে ভারতবিরোধী স্লোগান, এই দুটোর মধ্যে ব্যালান্স রেখেই চলতে হবে, যতদিন না এর থেকে বেটার কোনও সল্যুশন পাওয়া যায়।

arijitakacool লিখেছেন, দেশের একপ্রান্তে অত্যাচারিত মানুষের স্বাধীনতা কামনায় দেশের রাজধানীতে (সাধারণ নাগরিকদের রক্ত-জল করা উপার্জনের টাকা থেকে সাবসিডি পাওয়া) ছাত্রদলের মুখ থেকে “ভারত কি বরবাদী, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বা ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” শুনেও শান্ত থাকব বা সহানুভূতি দেখাবো – এ আশা করেন কি করে? এ তো হুমকি ছাড়া কিছুই নয় – ছাত্ররাজনীতি না জঙ্গি-সংগঠন? আপনার কথা মানতে হলে তো সমস্ত জঙ্গি সংগঠন উত্থানের ইতিহাস পড়তে হয় – আর তাদের সমর্থন করতে হয়। পার্লামেন্ট-এ হামলা করা আফজল গুরু “শহীদ”? ভাবুন তো – আপনার পাশের বাড়ির স্বামী তার স্ত্রীর ওপর অকথ্য অত্যাচার করে; আর আপনি শান্তশিষ্ট মানুষ্, তার প্রতিবাদ করেন না। দুদিন পর কিছু লোক এসে সেই স্বামীর দোষের জন্য পুরো পাড়া জ্বালিয়ে দেব – এই হুমকি দিয়ে চলে যায়। তার জন্য আপনি তাদের পক্ষ নেবেন, না পুলিশকে ফোন করবেন?
যে দেশের ওপর আপনার সেন্টিমেন্ট কাজ করেনা, যে দেশের অস্তিত্ব কেবল আপনার কাছে মাটি আর জল বলে মনে হয়, সেই দেশের নাগরিকত্বের সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা ছাড়তে পারবেন কি? ছাড়তে আসলে হবে না – ভারত সহনশীল দেশ বলেই আপনার মত বা জে.এন.ইউ এর ছাত্রসম্প্রদায়ের মত লোকজন এই কথা বলে পার পেয়ে যান। পাকিস্তান হোক, কি বিশ্বের যে কোনো দেশ হোক, এই রকম কাজ করলে কি হাল হতে পারে সেটা একটু চোখকান খোলা রাখলেই জানা যায়।
আমাদের সত্যি কিচ্ছু বলার থাকত না – যদি এই সব কথা বিজেপি-র বিরুদ্ধে হত। আমাদের সত্যি কিছু বলার থাকত না – যদি আফজল গুরুর সন্ত্রাসবাদ না থাকত। হুমকি দিয়েছে মানেই কি সত্যি ভারত টুকরো করবে – এরকম হালকা ভাবেও তাই নিতে পারছি না – সরি। “এক আফজল মারোগে, হাজার আফজল নিকলেগা?” মারতে হয়, অত্যাচারী সেনাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিন। সাধারণ মানুষ তথা দেশের বিরুদ্ধে হুমকি কেন? আমি সন্ত্রাসবাদী মেন্টালিটি বললেই দোষ? বাহবা আঁতেল।

জঙ্গি-সংগঠন নয়, নিতান্তই ছাত্র-রাজনীতি। যদিও এখন জানা গেছে যে যারা স্লোগানগুলো দিয়েছে তারা জেএনইউয়ের ছাত্র ছিল না। আপনার বক্তব্য অনেকটাই আবেগঘন, তাই আপনি লেখেন “পার্লামেন্টে হামলা করা আফজল গুরু”। হয় লেখাটা পড়েন নি, নয় আবেগের বশে লিখেছেন। পাশের বাড়ির ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা বাইরের লোকের পাড়া জ্বালিয়ে দেবার হুমকি শুনে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি নিশ্চয়ই পুলিশের কাছে যাবো, কিন্তু আমি যদি পাড়ার কমিশনার হই তা হলে আগে চাইব পুলিশ না ডেকে ব্যাপারটা আভ্যন্তরীনভাবে মেটানোর। জেএনইউয়ের ভিসি পুলিশ না ডেকে ব্যাপারটা মেটাতে পারতেন।

সেন্টিমেন্টের কথা যেটা বললেন, সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়, সেন্টিমেন্ট একটা আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেন্টিমেন্টের বশে দেশ বা রাষ্ট্র কোনও ভুল করলে আমি সেটা নিয়ে প্রতিবাদ জানাবো না। এটা শুধু দেশ নয়, আমার বাবামায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। “দেশের নাগরিকত্বর সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা ছাড়তে পারবেন কি?” নিশ্চয়ই পারব। বেটার অপশন পেলে আরামসে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো, ইন ফ্যাক্ট শয়ে শয়ে লোকজন বিদেশে গিয়ে সেটল করে, গ্রিন কার্ড পেয়ে সে দেশের নাগরিক বনে যায়। দেশে ফেরার চেষ্টাও করে না। দেশের নাগরিকত্ব পাই, সুযোগ সুবিধা পাই (তাও ঘুষ না দিয়ে নয়) – তার মানে এই নয় যে দেশ ভুল কাজ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব না। সেটা দাসখত লিখে দেবার সামিল।

আফজল গুরুর সন্ত্রাসবাদ কতটা ছিল, কী ছিল, সেটা আরেকবার পড়ুন। তার পরে আবার আলোচনায় বসা যাবে।

শাফিনূর লিখেছেন কাশ্মীর থেকে – “কাশ্মীরে আছি গত দুবছর ধরে। কি পরিমাণ ভয়মিশ্রিত ঘৃণা বুকে একটা জনগোষ্ঠী তাদের দিন রাত কাটায় তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ৯০ এর ঘটনাগুলোর কারণে কাশ্মীরের এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না, যারা তাদের স্বজন হারায়নি।”

trijit28613 যা লিখেছেন তার মূল নির্যাস আরেক রেটোরিক। “পাকিস্তানে গিয়ে বলতে পারবেন?”

গত বছর যখন সুপ্রিম কোর্টের এক ক্রিমিনাল লইয়ার আমার ওপর খুব রেগে আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তিনিও এই এক কথাই বলেছিলেন। ছোটবেলায় আমাদের বিজ্ঞান স্যারও এই কথা বলতেন, পাড়ার মোড়ে চার্চের একটা লোক যিশুর মহিমাকীর্তন করা লিফলেট বিনামূল্যে বিলি করত জনতাকে – সেই প্রসঙ্গ তুলে উনি বলেছিলেন, পাকিস্তানে গিয়ে এ রকম করতে পারত? সেই ১৯৮৯ সালে।

না স্যার। পাকিস্তানে গিয়ে এমন করা বা বলা একপ্রকার অসম্ভব। কেন জানেন? দুটো দেশের গঠনগত কাঠামোটাই আলাদা। পাকিস্তান দেশটা ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি। সিডিশনের থেকেও মারাত্মক একটা আইন আছে সে দেশে, ব্লাসফেমি আইন। জেল টেল তো তুচ্ছ, ওখানে ব্লাসফেমি আইনে লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়, গুলি করে মারা হয়, আরেকটু পশ্চিম দিকে গেলে সেখানে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। সেটাকে তো আমরা আদর্শ সভ্যতা বলি না! ভারত একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ, এখানে সকলের ধর্মাচরণ এবং ধর্মপ্রচারের সমান অধিকার আছে, কোনও ধর্মকে এখানকার সংবিধান আলাদা প্রাধান্য দেয় না। ভারতের তুলনা ঐসব ধর্মভিত্তিক দেশের সাথে হবে কেন? গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার অভাবে জন্মের লগ্ন থেকে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কীভাবে ভেতর ও বাইরে থেকে দীর্ণ হচ্ছে ধর্মের ভেক ধরা শয়তানদের হাতে, সেটা জানেন নিশ্চয়ই? কতবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, আর কতবার নির্বাচিত সরকার এসেছে? কত শিশু, নিষ্পাপ মানুষ মারা গেছে ধর্মের ফাটানো বোমার আঘাতে? দেশ হিসেবে অসফল সেগুলো, পরধর্ম-অসহিষ্ণু, ভারত কেন সে রকম হবার চেষ্টা করবে? পাকিস্তানে এ সব বলা বা করা সম্ভব নয় বলেই তো ভারতে করছি। কিন্তু আমেরিকায় সম্ভব। ইউকে-তে সম্ভব।

আবার ভাবি, একেবারেই কি সম্ভব নয়, পাকিস্তানে? … কদিন আগে, এই জেএনইউ ঘটনার প্রেক্ষিতেই একটা চিঠির স্ক্যানড কপি পেলাম কবিতা কৃষ্ণণের ফেসবুক পোস্টে – পাকিস্তানের এক ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা সলিডারিটি জানিয়েছে জেএনইউর ছাত্রছাত্রীদের। লিখেছে, আমাদের দেশেও – আমরা যখনই দেশের বা সরকারের কোনও ভুল বা দোষ পয়েন্ট-আউট করি, আমাদের দাগিয়ে দেওয়া হয় অ্যান্টি-পাকিস্তানি, প্রো-ইন্ডিয়ান হিসেবে। আমাদেরও দেশদ্রোহী বলা হয়।

ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে, স্বাধীনতার সত্তর বছরের মাথায় এটাই তা হলে আমরা অ্যাচিভ করলাম? পাকিস্তানের সাথে অ্যাট পার হওয়া?

সুপ্রদীপ লিখেছেন – “কোনও রকম সমাধান ছাড়া, যারা সমস্যাকে খুঁচিয়ে তোলে তারা তো সমাজের সুস্থ জীবনটাকে আরও অস্বাভাবিক করে দেয়। আপনার লেখা এবং মতামত দুইই পড়লাম। কাশ্মীরে যা হয় তা কোনও শিক্ষিত মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমিও মানি না। কিন্তু এর সমাধানটা কী? এফবি ছেড়ে বাইরের দুনিয়াতে আসুন। একটা সুষ্ঠু সমাধান বলুন। তবে গিয়ে কমপ্লিট বলতে পারব আপনার লেখাকে।”

সুপ্রদীপ, কমপ্লিট লেখা লিখেছি, এমন দাবি আমি করি নি। আর এফবির বাইরেও একটা বড় দুনিয়া আছে আমার। সমাধান আমার জানা নেই, আর সমাধান বাতলে দেবার দায়িত্বও আমার নয়। এই দেশকে, এই সরকারকে সমাধান বের করতে হবে। আমার কাজ শুধু এটুকু বলা – যে পথে কাশ্মীর সমস্যাকে হ্যান্ডল করা হয়ে চলেছে গত আড়াই তিন দশক ধরে – সেটা এফেক্টিভ পথ নয়, তাতে সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না, লোকে অর্ধ ইতিহাস চর্চা করছে এবং  নী-জার্ক রিয়্যাকশনে যাকে তাকে দেশদ্রোহী চিহ্নিত করে তার ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠছে। এমন গণহারে রক্তপিপাসু হয়ে ওঠা, কোনও জাতির পক্ষেই শুভ নয়।

সুপ্রদীপ আরও লিখেছেন – “… কথা হল এই যে বিপ্লব এটাতে আপনার দাবি “ইন্ডিয়া কি বরবাদী” বা “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” না হয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে বা তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত নয় কি? মানছি এক দিনে এই আওয়াজ ওঠে নি। কোন সেন্টিমেন্ট থেকে এই আওয়াজ আসে সেটা না অনুভব করলেও করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার জন্য যে পথে আপনি বা আপনারা হাঁটা শুরু করেছেন সেটা কি আদৌ গঠনমূলক? কাশ্মীরকে আজাদি দেওয়া মানে ইন্টারন্যাশ্নাল মার্কেটে কাশ্মীর এবং ইন্ডিয়ার পরবর্তী অবস্থা কী হবে তার পরিণাম ভেবেছেন? ইন্ডিয়ান আর্মি বা গভর্নমেন্ট ভুল করেছে বলেই আপনিও ভুল স্লোগান তুলে বিদ্রোহ করলে টেররিস্ট আর আপনার মধ্যে ডিফারেন্সটা কী?”

– প্রথমেই জানাই, এটা “আমার দাবি” নয়। কতিপয় ছেলেপুলের দাবি এবং এই দাবির সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের আশির দশকে নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা, আর কাশ্মীরিদের আশি বা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠার মধ্যে এতটাই তফাত – যে আমরা কল্পনাও করতে পারব না সত্যিই, কোন সেন্টিমেন্ট থেকে এই আওয়াজ আসে। এই বিপ্লব তাই আমার নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনওদিনই তাদের সেন্টিমেন্টের সাথে একাত্ম হতে পারব না। কিছু পড়েছি, আরও পড়ছি ও পড়ার চেষ্টা করছি। যত পড়ছি ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠছি। দমনের কোন পর্যায়ে গিয়ে একটা জনগোষ্ঠী এই বিচ্ছিন্নতার আওয়াজ তোলে – সত্যিই আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

এই বিপ্লব তাই আমার নয়। এই বিপ্লব একান্তভাবেই কাশ্মীরিদের। আমি শুধু এর বিরোধিতা করতে পারি, বা সহানুভূতি জানাতে পারি। তারা কীভাবে তাদের বিপ্লবের আগুনকে ব্যবহার করবে, সেটা তাদের বললেই ভালো হয়। আমি কোনও পথেই হাঁটি নি তাদের সাথে। সে যোগ্যতাই আমার নেই। গঠনমূলক পথ নয়, সে আমি জানি। তবে কে বলতে পারে ধ্বংসের মধ্যেও গঠনের ভিত তৈরি হয় না?

শেষ কথাটা প্রসঙ্গে, আগেও বলেছি, আবার বলছি, স্লোগান তোলা মানেই বিদ্রোহ করা নয়। এখানেই টেররিস্টের সাথে “আমার” তফাত। আমার মানে, যারা স্লোগান দিয়েছে, তাদের। স্লোগান আজ নয়, বহুকাল ধরে কাশ্মীরের রাস্তাঘাটে প্রতি অল্টারনেট দিনে দেওয়া হয়ে চলেছে। কী পরিমাণ ঘৃণা নিয়ে কাশ্মীরিরা সেখানে বাস করে, সে আমি কিছুটা দেখেছি। টেররিস্ট হচ্ছে সে, যে টেরর বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিপ্লব করে। স্লোগান দিলে কেউ টেররিস্ট হয়ে যায় না। হাজারবার বলেছি, আবার বলছি, স্লোগান দেওয়াকে একজন ভারতীয় হিসেবে নিন্দা জানাচ্ছি, কিন্তু স্লোগান দেওয়ার অপরাধে কাউকে সিডিশন চার্জে জেলে পোরারও নিন্দা জানাচ্ছি। এই স্লোগান দেবার জন্য যদি কাউকে জেলে পুরতে হয়, তা হলে আজ কাশ্মীর ভ্যালির দুই তৃতীয়াংশ তরুণ জেলের ভেতরে থাকত।

এর পরে greetingsworldblog-এর কমেন্ট, নতুন কিছু নেই, একই বক্তব্য – আমি বাড়িয়ে লিখেছি সেনার অত্যাচারের কাহিনি। কারুর মনে হবার ওপরে আমার হাত নেই, তাই এর আর উত্তর দিলাম না। বইগুলো পড়ে ফেলবেন সময় পেলে। যদি মনে হয় বাড়িয়ে লেখা আছে, লেখকদের সাথে যোগাযোগ করুন। আমি সেই বই থেকেই আংশিক অনুবাদ করেছি। ইনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে কাশ্মীর সমস্যার তুলনা করা সম্ভব নয়। আমি একমত, তুলনীয় নয়। প্রত্যেকটা সমস্যাই নেচারগতভাবে আলাদা। জিও-পলিটিকাল ফ্যাক্টরগুলো আলাদা। উনি কিছু সিনেমার নাম জানতে চেয়েছেন। এখন বই যতটা প্রামাণ্য হয়, সিনেমা তো ততটা প্রামাণ্য হয় না, সিনেমা মূলত বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়। তবে হায়দার দেখতে পারেন, কিছুটা বাশারাতের বইয়ের সঙ্গে মিল পাবেন। কিছুটা, পুরোটা নয়।

অগ্নিমিত্র বিশ্বাস লিখেছেন – “আপনার আলোচনায় কয়েকটা তত্ত্বগত আর তথ্যগত অনিচ্ছাকৃত ভুল আছে বলে আমার বিশ্বাস, আমি ভুল করলে শুধরে দেবেন। আর আমার কথায় সারবস্তু আছে মানলে আমায় জানাবেন।

প্রথমত, আপনি বাংলাদেশ এর সৃষ্টি নিয়ে সাঁটে যা বলেছেন তা নিখুঁত কিন্তু যখন সেই একই গল্প আবার বলছেন, এবার কুশীলব বদল করে, তাতে আমার একটু আপত্তি আছে. কারণ, আমি যদ্দূর জানি, পূর্ব পাকিস্তান কে দখল করার প্ল্যান করে ভারত মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেনি. করেছিল – যতদূর জানি এবং বুঝতে পারি, আপামর জনতার কাছে বোধগম্য নেহাত-ই মানবিক কারণে এবং তৎকালীন ভারত সরকার-এর কাছে গ্রহণযোগ্য এবং তখনকার সময়োপযোগী রাজনৈতিক কারণে. আর আমি তাতে বিশাল ভুল কিছু দেখতে পাইনি. কাশ্মীর-এর প্রতি পাকিস্তান-এর এহেন গঠনমূলক সদিচ্ছা আছে বা ছিল বলে প্রমাণ পাইনি. নেইও.
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারত-কে ঐ এক-ই কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের ধার্মিক সুড়সুড়ি দেওয়া বিষবৃক্ষের পাতা শোঁকাতে হয়নি – কারণ যে লোহা-গলানো যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ-এর মুক্তিযুদ্ধ পরিণত হয়েছে তাতে তার লক্ষ্য এতো সাবালক যে ঐ ছেঁদো ধার্মিক সুড়সুড়ি-র পিছনের অভিসন্ধি খুব সহজেই বুঝে যেত এবং বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিত. সর্বোপরি ভারতের সেই উদ্দেশ্য ছিল-ও না. অতএব আপনার একই নাটকের অন্য চরিত্রায়ণ a bit flawed বলেই আমার বিশ্বাস.

তৃতীয়ত, কাশ্মীর-এর সাধারণ মানুষ ভারত-এর অংশ হয়ে কি কারণে খুশি ছিলেন না তা স্পষ্ট নয়, বা কি কারণে চাননি ভারত – এর অংশ হতে. আমি যতদূর জানি ভারতের কাশ্মীর-এর প্রতি বৈষম্যমূলক এবং চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব ছিল না. কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অংশ হলে কোন রাজ্য যেটুকু আভ্যন্তরীণ সার্ব্বভৌমত্ব পায় বা যতটা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ মানে (সব-ই একটা অত্যন্ত matured সংবিধান মেনে) সেইটুকুই কাশ্মীর পেত. আর তার বদলে তার নাগরিকদের জন্যে নিত পরিপূর্ণ ভাবে সভ্য ও স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার।

চতুর্থত, কাশ্মীর এর সাধারণ মানুষ রাজা হরি সিংহের ওপর নির্ভর না করে নিজেরা কোন উপায়ে পাকিস্তান – এর উদ্যত আক্রমণ প্রতিহত করতে পারতেন কি? যেরকম মুজিবর করেছিলেন? আজাদ কাশ্মীর শুনতে ভালো কিন্তু practically তা কি হবে তা সবাই জানে।”

অনেকটা একমত। আমিও তো তাই বলি। প্রথমত, না, ভারত বাংলাদেশকে আত্মসাৎ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করে নি, কিন্তু সেই ভারতই আত্মসাৎ করবার উদ্দেশ্যে কাশ্মীরকে সাহায্য করেছিল। এটাকেই আমি বলেছি দ্বিমুখী নীতি।

দ্বিতীয়ত অংশের সাথেও আমি একমত। ধর্মের সুড়সুড়ি বাংলাদেশে আসে নি, বরং ঐ ধর্মের সুড়সুড়ি এবং ধর্মের মাধ্যমে উর্দুভাষাকে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদেই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল এত সাবালক। প্রেক্ষিত আলাদা, অবশ্যই আলাদা। কিন্তু আমি যেটা দেখাতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে, ভারত দেশটি একই ধরণের কাজ দুই জায়গায় করেছে দুই সময়ে – দুই আলাদা উদ্দেশ্যে। লজিকের নীতি অনুযায়ী একটিকে মহান কাজ ধরলে অন্যটি অমহান হতে বাধ্য।

তৃতীয়ত অংশের উত্তরে জানাবো সেই ওপরে দেওয়া লিঙ্কটা পড়ে নিতে – কেন অখুশি ছিল। না, বৈষম্য ছিল না। সেটা আগেও লিখেছি, স্কটল্যান্ডের ওপরেও ইংলন্ড কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করে নি বা করে না। তবু, স্বাধীনতা হল, স্বাধীনতা। উনিশশো সাতচল্লিশ সালের আগে তো ভারত বলে কোনও “দেশ” ছিল না, ছিল কতগুলো প্রিন্সলি স্টেটের সমাহার, যেগুলো ইংরেজরা কব্জা করে রেখেছিল। তো, ভারত “দেশ” হিসেবে যখন আত্মপ্রকাশ করল, কাশ্মীরি জনজাতি মনে করল তাদের এতকালের সার্বভৌমত্বের ওপর থাবা বসাচ্ছে ভারত। মানে, এতদিন ইংরেজের অধীন ছিলাম, আজ ভারতের “অধীন” হলাম। সেই গাধার গল্প। মালিক দুঃখ করে গাধাকে বললেন, ওরা আসছে, আমাকে বন্দী করে নেবে, তোমাকেও নিয়ে যাবে ওরা। গাধা বলল, তাতে আমার কী? অ্যাদ্দিন আপনার অধীনে মোট বইতাম, এখন ওদের অধীনে মোট বইব। একই তো হল।

না, এ কথা বুন্দেলখণ্ড, অবধ, হায়দ্রাবাদ, মাইসোর ইত্যাদি প্রিন্সলি স্টেটের জনতা ভাবে নি, কাশ্মীরিরাই ভেবেছিল। কেন ভেবেছিল, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট আছে, আমি আবার বলব লিঙ্কটা থেকে পড়ে ফেলতে কাশ্মীরের গল্প।

অগ্নিমিত্র, আপনার কথামত সেদিন বইগুলোর লিস্ট পাঠাতে পারি নি, তবে আজ ওপরে একটা বইয়ের নাম দিয়েছি, আরেকটা বইয়ের নাম দিচ্ছি, আমি নিজেও পড়ি নি অবশ্য, তবে এক বন্ধুর রেকমেন্ডেশন। কাশ্মীরঃ দ্য বাজপেয়ি ইয়ার্র্স, এ এস দুলাত।  সিনেমার নাম জানতে চাইবেন না, সিনেমা দিয়ে ঠিক ইতিহাস চেনা যায় না।

প্রসেনজিত লিখেছেন – “কাশ্মীরের মানুষও কি আদৌ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান? আমার মনে হয় যে চান না। বরঞ্চ কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় পাকিস্তান, আইএসআই আর তাদের পোষা কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। আর এদের তালে তাল মিলিয়েই কিছু রাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের কারণ স্বল্প নাকি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিকল্পনা সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু সাধারণ বিচারবুদ্ধি বলে যে আদৌ যদি তারা কাশ্মীরিদের সমস্যার সমাধানে উৎসাহী হন তা হলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে সওয়ালেই চাপ সৃষ্টি করুন। কাশ্মীরের জন্য আলাদা সাংবিধানিক সুবিধে তুলে দেওয়ার কথা বলুন। কাশ্মীর যাতে মূলধারার ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে পারে সে ব্যাপারেই সরব হোন।

প্রশ্ন উঠবেই যে, কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গেই আসতে হবে কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে নয় কেন বা আজাদ কাশ্মীর নয় কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে কী হবে তা আমরা ভাল করেই জানি। আর আজাদ কাশ্মীর যে আদৌ আজাদ কাশ্মীর থাকবে না তা-ও সবাই জানি। ওটা প্রথমে আজাদ কাশ্মীর থেকে পাক নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর হবে, তার পর পাক অধিকৃত কাশ্মীর হবে আর শেষে আর একটি পাক প্রদেশ হবে। সুতরাং আজাদ কাশ্মীর চাওয়া আর কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া একই ব্যাপার।

আর এইখানেই আমার আপত্তি। আজাদ কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে নমো নমো করে সমালোচনা করেই বাড়তি উদ্যমে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের আজাদির দাবি তোলা এক মারাত্মক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের জন্ম দেবে সন্দেহ নেই। কাল দেশের অন্যান্য অংশেও আওয়াজ উঠতে পারে আজাদির। চিন্তা করার সময় এসেছে বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ফ্রিডম/আজাদি কথাটার অপভ্রংশ যেন তৈরি না হয়ে যায়।

ছাত্রসমাজের হয়তো এই দায় নেই। প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়ে কিছু পোড়খাওয়া রাজনৈতিক দল হয়তো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির হাত শক্ত করছে, কিন্তু তাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে অপরপক্ষ জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমকে ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’-এ নামিয়ে আনছেন। সামগ্রিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এটাও চিন্তার বিষয় বৈকি।

তবে দেশপ্রেম কিংবা জাতীয়তাবাদ নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে, বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে দেশের সমালোচনার অধিকার’ও আছে, কিন্তু ভারত তেরা টুকরে হোঙ্গে স্লোগানের পাশাপাশি, আজাদির স্লোগান মিশিয়ে দেওয়াকে কখনওই গঠনমূলক বলা চলে না, বরং তা যথেষ্ট ইন্ধনমূলক।

পুনশ্চ: বাবার হোটেলে খাচ্ছি বলে বাবাকে সম্মান করতে হবে, এ রকম মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। মা জন্ম দিয়েছে বলেই অকৃত্রিম মাতৃভক্ত হতে হবে এরকম দাবও কেউ করে না। কিন্তু ভাবার চেষ্টা করছি, মা-বাবা জন্ম দিয়েই ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চলে গেলে কী হত? সার্ত্র, কাফকা পড়া বাঙালির ইন্টেলেকচুয়ালিটির নিরিখে যুক্তিটা যাত্রাপালার মতো শোনাল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাস্তব আর পিলে চমকে দেওয়া চিন্তাভাবনার তফাৎটা এখানেই।”

প্রসেনজিত, আপনার মনে হওয়ার ওপর আমার হাত নেই। তবে আমি বলব সত্যি কথা বুঝতে হলে কাশ্মীরে যান, গিয়ে থাকুন ওখানে কয়েক মাস। এর বেশি সত্যি আমার কিছু বলার নেই।  আর কী হইলে কী হইত, এই আলোচনায় মনে হয় না কোনও লাভ আছে। যা হয়ে আছে, সেইটুকুকে হাইলাইট করেছি আমি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না কাশ্মীর পাকিস্তানে চলে যাক, সম্ভবত বেশির ভাগ কাশ্মীরিও তা চান না, তারা চান আলাদা একটা দেশ।

আজাদীর দাবি দীর্ঘদিন ধরে উঠছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কাশ্মীরে। আসামে। নাগাল্যান্ডে। কুচবিহারে। দার্জিলিং-এ। বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব, সন্দেহ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র এটুকু স্বাধীনতা আমাদের দেয়। সরকার আলাপ আলোচনা চালাচ্ছে, খেয়াল করে দেখুন, কাউকে কিন্তু নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় নি আজাদী চাইবার দাবিতে।

বাকি বক্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার লিখেছি, তাই আর লিখছি না। লেখা দরকার, মা বাবা জন্ম দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চলে গেলে কী হত। আমি জানি না আপনি বাবা কিনা, আমি বাবা। কোনও মা বাবাই চায় না তার সন্তানকে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করে যেতে। এটা ঠিক মায়ামমতাপ্রেম দিয়ে ডিফাইন করবার জিনিস নয়, তার থেকেও বড়, যেটা হচ্ছে, অপত্যস্নেহ। আর স্নেহ সবসময়েই নিম্নগামী। বায়োলজিকাল কারণেই মা বাবা সন্তানের দেখভাল করে। সন্তান বড় হয়ে মা বাবাকে সম্মান করবে, মা বাবার সমস্ত অন্যায় মেনে নেব, এই এক্সপেক্ট্বশন থেকে কেউই সন্তানের প্রতিপালন করে না। হ্যাঁ, ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট থেকেসন্তান চেষ্টা করে মা বাবাকে প্রোটেক্ট করার কোনও সম্ভাব্য অনিষ্ট হওয়া থেকে। অনেকেই মা বাবার অন্যায়কে মেনে নেন এই “প্রতিদান”এর চাপে পড়ে। আমি ঠিক সেই স্কুলের ছাত্র নই। ডাস্টবিনে ফেলে চলে গেলে আমি মরে যেতাম, এত কথা লিখবার সুযোগ হত না, কিন্তু ডাস্টবিনে আমাকে ফেলে না দিয়ে বড় করেছেন বলেই যে আমি কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে থাকব আজীবন – সেটা ভাবাটা আমার পক্ষে চাপ।

শেষ করব দার্শনিকের (Darshnik)কমেন্টের উত্তর দিয়ে।

সুন্দর লেখা ভাই। তবে কয়েকটা জিনিস পড়ে খারাপ লাগলো। ভাবলাম, আপনাকে জানাই…
১. আপনি আর্মি কে মহান ভাবেন না…কিন্তু শুধু কাশ্মির-এর ঘটনা গুলোই দেখলেন? তারা দেশ কে (বা দেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব) রক্ষা করছে – তার জন্য তাদের প্রতি আপনার কোনো শ্রদ্ধা নেই? তারা যে দিনের পর দিন মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে সীমান্তে দেশ কে পাহারা দিচ্ছে তার জন্য কোনো কৃতজ্ঞতা নেই? হতে পারে তারা মাইনে পান, কিন্তু সেটা তো তাদের প্রাপ্য, তাই না?
২. আফজল গুরু প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী। ঠিক আছে, সেই পরিচয় তো বহন করতেই হবে ভাই। পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো অপরাধীদের পুরোপুরি ভুলে যাবার বিধান দেয় না। সে ছিচকে চোর হোক বা খুনি সন্ত্রাসবাদী| আর আফজল গুরু দোষী হোক বা না হোক, সেটার জন্য, ভারত এর ধংস না হলেও চলে…
৩. বাংলাদেশ কে ভারত সাহায্য করেছিল বলে গালি পাড়ছেন। ভালো…তার চেয়ে ভালো হত ওটা পাকিস্তানের ই থাকত…তাহলে আর কাশ্মীরি রা যুক্তি দেখিয়ে চিল্লাতে পারত না…হবে হয়ত। National Interest বলে কিছু জিনিস আছে যেখানে নিজের সিকিউরিটি এর জন্য কিছু স্টেপ নিতে হয়, যেটা সাধারণ চোখে বারো অদ্ভূত লাগে…ভেবে নিন – ওটাও ইন্দিরা গান্ধীর সেরকম এ একটা সিদ্ধান্ত ছিল।
৪. এবারে একটা পার্সোনাল প্রবলেম বলি শুনুন – কেউ USA লেখা T-Shirt পড়লে আমার খারাপ লাগে না – কিন্তু কেউ পাকিস্তান লেখা T-Shirt পরে ঘুরলে ঠিক হাজাম হয় না…কেন জানেন? ওই দেশ তা বা দেশের সরকার আমার দেশের অসংখ্য অফিস ফেরত মানুষ কে বোমা মেরে খুন করেছে…একবার নয়…বার বার…বহুবার…ওই T-Shirt টা দেখলেই মুম্বাই ব্লাস্ট, দিল্লি ব্লাস্ট, ২৬/১১ – সব মনে পড়ে যায়…আপনি যেমন বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে যাবার পরে জাত ধর্মের উপরে খেপে গেছিলেন, আমার ও ঠিক সেই রকম খ্যাপামি চেপে বসে…ভাববেন না যে আমি বাবরি মসজিদ ধংস সমর্থন করি…একেবারেই নয়…কিন্তু আমি একটা মন্দির বা মসজিদ ভাঙলে সেরকম দুঃখ পাই না…যত টা পাই মানুষ মারা গেলে…বিশেষত সেটা ভারতের হলে আরও বেশি…
আরেক টা ব্যাপার…আমার মনে হয়, ভারত দেশ টা এখনো বেশ সহিষ্ণু…নাহলে, বলুন তো, আজহারউদ্দিন দেশের পার্লামেন্ট এ বসে সংবিধান সংশোধন করে? আর আমেরিকার কথা বলছেন? এই আমেরিকা তেই একটা ঘড়ি বানানোর জন্য একটা বাচ্চা কে ১২ ঘন্টা জেরা করা হয়েছিল…৯/১১ এর পরবর্তী সময়ে ব্লগ লেখার জন্য কত ফ্যামিলি কে দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল সেটাও তো জানেন…কাজেই, তুলনা করাটা ঠিক হবে না…

আমার উত্তরঃ
১। আশা করি এতক্ষণে আমার উত্তর পেয়ে গেছেন। আমি আর্মিকে মহান ভাবি না, আর পাঁচটা চাকরির মতই আরেকটা চাকরি করা লোকজনের সমষ্টি ভাবি। ভগবানও নয়, শয়তানও নয়। শ্রদ্ধা ব্যাপারটা খুব রিলেটিভ। আমার সবার জন্যেই শ্রদ্ধা আছে, যার যতটুকু প্রাপ্য। ওই আর্মি যাতে একটানা খাবার পায় – যাতে সে একটানা সীমান্ত পাহারা দিয়ে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে এ দেশের চাষীরা। আমার তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু প্রতি বছর অনেক চাষী ন্যূনতম খাওয়া জোটানোর পয়সা জোটাতে না পেরে আত্মহত্যা করে, কেউ তাদের মহান বলে না, কেউ তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না, সরকার ডিফেন্সে বছর বছর বাজেট বাড়ায় কিন্তু ঐ কৃষকদের ঋণ মকুব করে না।

কৃতজ্ঞতা আলাদা করে কিছু নেই ভাই। মাইনের বিনিময়ে অনেকে অনেক কাজ করেন, এবং অনেক কাজেই মৃত্যুর তোয়াক্কা না করেই কাজ করতে হয়, শুধু আর্মিই একা নয়। কৃতজ্ঞ হলে সবার প্রতিই হওয়া উচিত। খালি আর্মির জন্য কৃতজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে দেব কেন?

২। আফজল গুরু “প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী” পরিচয় বহন করেই তো চলছিল। আর একমত, আফজল দোষী হোক বা না হোক তার জন্য ভারতের ধ্বংস না হলেও চলে – ভারত ধ্বংস হয় নি তো! দিব্যি আছে। স্লোগান দিলেই ভারত যদি ধ্বংস হয়ে যেত, তা হলে ভারতের অখণ্ডতায় আমারই সন্দেহ হত।

৩। বাংলাদেশকে ভারত সাহায্য করেছিল বলে আমি গালি পাড়ি নি তো! আমি অন্য কিছুও চাই নি। আমি তো একটা তুলনা করেছিলাম, ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের।

৪। পাকিস্তানের টি শার্ট দেখলে আপনার হজম হয় না। কারণ, ওই দেশটা আমার দেশের অনেক লোককে মেরেছে। – দেশ কি মারে? সন্ত্রাসের কোনও ধর্ম হয় না, দেশ হয় না। আপনি তো খবর পড়েন, খবরের চ্যানেল দ্যাখেন। জানেন তো, সন্ত্রাসবাদের শিকার ওই দেশটিও? কত শিশু কিশোর শিক্ষক সাধারণ মানুষ সেখানে নিয়মিত মারা যাচ্ছে এই সন্ত্রাসের ফলে? … পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কিন্তু সত্যিই ইন্ডিয়াকে অতটা ঘেন্না করে না। এই ঘেন্নাটা তৈরি করা হয় মৌলবী ধর্মগুরু এবং মিলিটারি লেভেলে। তাতে জড়ানো হয় আজমল কাসভের মত কিছু নিরক্ষর ছেলেপুলেকে। জিহাদী ট্রেনিং দিয়ে এ দেশে পাঠায় তারা। আনরেস্ট তৈরি করে। সেই আনরেস্টের বলি হয় এদেশের মানুষ,  ও দেশের মানুষও। কিন্তু পাকিস্তানের আমজনতা, শিক্ষিত চাকুরিজীবি মধ্যবিতের দল, তারা ঠিক আপনার আমার মতই। আপনি ইন্ডিয়ান জানলে আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে, ঘরে দাওয়াতে ডাকবে। খাবারের দাম নিতে চাইবে না। এরাই কিন্তু পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু। এরা ঝগড়া চায় না, চায় কালচারাল এক্সচেঞ্জ। এরা ধর্মের চোখরাঙানি চায় না, চায় মুক্ত হাওয়া।

একবার ভেবে দেখুন।

৫। ভারত সহিষ্ণু কি অসহিষ্ণু – সেটা একটা রিলেটিভ ব্যাপার। আপনার অভিজ্ঞতামত ভারত সহিষ্ণু। আমেরিকা অসহিষ্ণু। আমার অভিজ্ঞতা একটু অন্য রকম। ইনটলারেন্স নিয়ে আমার কয়েক মাসের পুরনো একটা ব্লগ আছে, একটু পড়ে দেখতে অনুরোধ করি।

প্রতিবাদ হওয়া দরকার। স্লোগানের যে ভাবে প্রতিবাদ উঠেছে দেশজুড়ে, তার এক শতাংশ প্রতিবাদ দেখা যায় নি কানহাইয়ার ওপর উকিলদের আক্রমণের, সাংবাদিকদের ওপর উকিলদের আক্রমণের। গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ মিথ্যে কথা বলেছেন মিডিয়াকে, ভুয়ো টুইট দেখিয়ে যে, সন্ত্রাসবাদী হাফিজ সঈদ জেএনইউকে সলিডারিটি জানিয়েছেন। অর্ণব গোস্বামীর টাইমস নাউ, সুভাষ চন্দ্র-র জি নিউজ দিনের পর দিন ডক্টর্ড ভিডিও দেখিয়ে নির্লজ্জের মত চিৎকার করে মিথ্যেকে সত্যি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গেছেন। স্মৃতি ইরানী সংসদের অধিবেশনে বসে রোহিত ভেমুলার ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলে গেছেন। বিচারক প্রতিভারানী অর্ধশিক্ষিতের মত জাজমেন্ট দিয়েছেন কানহাইয়ার জামানতের সময়ে, ওটা যে বিচারের নামে প্রহসন, সেটা বোঝার জন্য আইন খুব ভালো না বুঝলেও চলে।

প্রতিবাদ আসুক এইগুলোর জন্য। প্রশ্ন করা হোক ক্ষমতায় আসীন লোকগুলোকে। আজকের ভিড়ে সেই শিশুটিকে দেখতে পাওয়া খুব দরকার, যে একবার সমবেত প্রশংসাবাক্যের মধ্যে গলা তুলে জিজ্ঞেস করবে, “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”

শেষ করি এখানেই। আরও প্রশ্ন উঠলে আবারও আলোচনায় বসব, সময়সুযোগমত। সবাইকার নাম নিই নি, কারণ কিছু কমেন্টের উত্তর আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি।

ও হ্যাঁ, গালাগালির মধ্যে কে যেন আমাকে কমিউনিস্ট বলছিলেন। আজ্ঞে, কমিউনিস্ট কীভাবে চেনে আমার জানা নেই, তবে যদি বলেন যে কোনও কমিউনিস্ট দলের সাথে আমার যোগসাজস আছে – না, নেই। আমি কোনও রকমের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নই। তবে আমাকে কেউ কমিউনিস্ট বললে আমি বিনয়ে অবনত হয়ে যাব, কারণ এ আমার কাছে বিরাট সম্মানের ব্যাপার, আর যদ্দূর জানি, সে সম্মানের যোগ্য আমি নই।


16 thoughts on “মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী (বাড়তি পর্ব)

  1. Nice piece.

    1. By the way, I have found a high correlation between people who follow Islam (and don’t/didn’t live in Kashmir) and their opinions on this anti-national debate/issue related to the JNU incident. And know what…I’m yet to find a single follower of Islam who supports the Government’s reaction to this issue. Let’s assume that the Government’s reaction was not right at all. Then how come all the followers of Islam think that the reaction was wrong, whereas many Hindus think that it was right and many think that it was wrong? Do you think that the Muslims, as a community, are smarter than the Hindus?!

    2. Well, I have read all your blog posts. I must say that most of them are very well-written. However, I was trying to find a dedicated post where you have criticized state’s action on the ‘victimized’ people who are Hindus by religion. And know what…I couldn’t find any. Surprising, no? As you describe yourself as someone beyond any specific religion, there shouldn’t be posts only where victims are Muslims by religion, right? I’m sure it’s a mistake. Maybe you have written dedicated posts which portray the stories of Hindu victims but forgot to post!

    Like

    1. I didn’t know that you have met “all the followers of Islam”! That’s quite an achievement.

      I have not either written any single blog criticizing state’s action on the “victimization” of Muslims, Christians, Sikhs, Buddhists. I am not representing any religion through my blogs. If needs be, I’ll surely write. This topic does not allow me write anything dedicated on Hindu victims.

      Like

  2. ভূল বললে মাপ করবেন, কিন্তু আগের মতই আবার আপনাকে কাশ্মীরের ইতিহাসটা ভালো করে জানতে বলব, কার্যত বাধ‍্য হয়েই কাশ্মীরকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত হতে হয়। বা কাশ্মীর স্টেটটাকে ৮০০০ আর্মড্ রেডার্সদের হাত থেকে বাঁচাতে ভারতকে সেনা পাঠাতে হয়েছিল, কিন্তু তাও সম্ভব ছিলনা ততক্ষন যতক্ষন না হরি সিং instrument of accession এ সই করছেন ততক্ষন, আপনি কি পড়েছেন জানিনা কিন্তু আপনাকে The Story of Kashmir টা pradhanmantri নামের ডকুমেন্টারি টা ইউটিউব থেকে দেখে নিতে বলব, একঘন্টা লাগবে। আপনি একটা দুটো বা তিনটে বই পড়তেই পারেন। কিন্তু ওর তথ‍্য সূত্র গুলো ভিডিওর শেষে পাবেন, এরকম আরো বেশকিছু থেকে তথ‍্য সংগৃহীত, হয়তো বেশকিছুই আপনার ও পড়া নেই। যেমন ধরুন The Story of Intigration of 565 Princly States , ভি পি মেনন্ এর লেখা, আপনি ওই ডকুমেন্টারির বাকি এপিসোডে বাকি princely state গুলোর গল্প ও পাবেন। আর অবশ‍্যি তথ‍্যসূত্র গুলো খেয়াল করবেন। খুব ই মেকি মেকি ডকুমেন্টারি থোড়বড়ি খাড়া করে দাঁড় করানো, আদৌ দেখার মত নয়, কিন্তু তথ‍্যসূত্র গুলো খুব ঠিকঠাক। তারপরে আমি ভূল মনে হলে যতখুশী বকুনি দিন, আমি আপনার চেয়ে অনেক অনেক ছোটো।

    Like

    1. ভুল বললেন, তাই মাপ করে দিলাম। প্রধানমন্ত্রী সিরিজটি আমি দেখেছি, ওটি নিতান্তই একটি বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম। ওতে অনেক তথ্যই হাল্কা বিকৃত করে প্রেজেন্ট করা হয়েছে। কোনও ইতিহাসবিদ ঐ সিরিজটির জন্য দশ পয়সাও দেবেন না।

      Like

  3. ভূল ধরিয়ে দেওয়াতে খুশী হলাম, কিন্তু আমি ‘বিনোদন’ নয়, তথ‍্যসূত্র গুলোর কথা বলছিলাম, আপনি ওর সবকটা এপিসোড দেখেছিলেন? আমি খুব কষ্ট করেই দেখছিলাম, বিনোদনটাও আদৌ দেখার মতো নয় বলেই, কিন্তু বাবরি মসজিদ থেকে গুজরাত দাঙ্গা কোথাওই পক্ষপাতের জায়গা থেকে কিন্তু দেখানো হয়নি, উল্টে আপনি যে কথা গুলোর কথা বলছিলেন সেগুলোর সাথেই খাপ খাচ্ছিল, অবশ‍্যি তথ‍্য সূত্র গুলোর কারণে, আমি এরকম নিউট্রাল স্ট‍্যান্ড্ কিন্তু আশা করিনি এরকম একটা নিউজ্ চ‍্যানেলের তরফে, আমি এইসব নিউজ চ‍্যানেলগুলোকে কোনোদিন ই তোয়াক্কা করিনি, বই খুব একটা বেশি পড়া হয়ে ওঠেনি, বয়সটাতো খুব কম, আমি অনেক বেশী ডকুমেন্টারির ওপর আস্থা রাখি যদিও এটা ডকুমেন্টারি নয় আদৌ। এখানে আমি শুধু ঘটনাক্রম, প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি আর তার ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত গুলোর কথা বলছিলাম। আসলে সত‍্যিটা জানতে আমিও ভীষণ আগ্রহী, যেমন Headlines Today এর Guns and Glory এর ১৯৪৮ এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কিছু গরমিল পাচ্ছিলাম, আর সব মিটে যাওয়ার পর নেহেরু নিজেই কাশ্মীরে একটা গনভোট করাতে চেয়েছিলেন united nations এর মতো সংস্থার দেখভালে, All India Radio তে তিনি তা বলেওছিলেন, কিন্তু কেন তা আর সম্ভব হয়নি তা আমি এখনো জানিনা, কিন্তু তাতেই বাত্ যায় বিগড়ে, রেডার্সদের যতদূর খেদানো গিয়েছিল তাই আন্তর্জাতিক সীমা(LOC) হয়ে যায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে। আমি ১৯৪৭ সংলগ্ন ঐ সময়ের কাশ্মীরের ইতিহাস জানতে চাই, কোনো বই থাকলে বলবেন যাতে ভারতে অন্তর্ভূক্তির ইতিহাস টা সঠিক ভাবে জানতে পারি, তার পরবর্তী সময়ের নয় কিন্তু। আর pradhanmantri সিরিজের তেইশটা এপিসোড্ ই আমার কাছে রয়েছে, কোন এপিসোডে কোন কোন তথ‍্য বিকৃত করা হয়েছে জানাবেন অনুগ্রহ করে, আমি ভূলটা নয়, ঠিকটা জানতে আগ্রহী। আপনাকে দুটো বই পড়তে বলব, আমার নিজের ফাইন্ডিংস্ – “MacMahon Line Saga” by Claude Arpi, “Great Game East” by Bertil Lintner, বই দুটো কেমন জানিনা তবে লেখক দুইয়ের সাথে পরিচিত হলাম 1962 নিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে। আরো একটা কথা, আপনার ইন্টলারেন্স নিয়ে লেখাটার একটা কথা আমাকে খুব ছুঁয়েছিল, বিশ্বাসের কমফোর্ট জোনের কথাটা, আমরা সেটাই বিশ্বাস করি যেটাতে আমরা স্বচ্ছন্দ বোধ করি- আপনার লেখায় এমন কিছু জন কমেন্ট দেন যাঁরা আপনার তামাম চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেদের কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেননা, তাদের প্রত‍্যুত্তর দেওয়ার দরকার আছে বলে আমার মনে হয়না। ও হ‍্যাঁ বলা হলনা, অন‍্য প্রসঙ্গ, তবুও বলছি যখন এখানেই বলেনি- Android এ Maruti Suzuki Care নামে একটা App আছে, ভীষন কার্যকরি। টোল ফ্রি কাজ না করলে আপনি এর মাধ‍্যমে যে লোকেশানে আটকে পড়েছেন সেই এলাকার দায়িত্বে থাকা ডিলার হোক বা অন রোড্ সার্ভিস্ এর সাথে কানেক্ট করতে পারবেন, এটা google map এর সাথে synchronized হয়েই কাজ করে,এই app টা আপনার গাড়ির যাবতীয় ডিটেলস্ sync করে রাখে সার্ভিসিং সমেত, রিমাইন্ডার ও দেয়, এককথায় অসাধারন, সংস্থার অফিশিয়াল app ও এটা। আশা করি play store থেকে নামিয়ে নেবেন

    Like

  4. এই প্রচ্ছদটি প​ড়ে আমার একটি উপলব্ধি হলো, সেটা দিয়েই শুরু করি। ছোটবেলায় আমার এক গৃহশিক্ষক বলতেন, শুধু পাঠ্যপুস্তক প​ড়লেই হবে না, কোন বিষ​য় ভালো করে জানতে হলে নোটবই অর্থাৎ প্রশ্ন উত্তরের বইও প​ড়তে হ​য়। মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী -এর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব প​ড়ার পরে বাড়তি পর্বটা যেন ওই নোট বইয়ের কাজ করলো।অনেক “কিন্তু” এবং “তাহলে” -এর উত্তর দিয়ে দিলো।
    ধন্যবাদ দেবার মতন সঠিক ভাষাজ্ঞান আমার নেই । শুধু আশা করব আমার ভাইয়েরা(স্বামী বিবেকানন্দ মুর্খ ভারতবাসীকে ভাই বলে সম্বোধন করতে বলেছেন কিনা) একদিন চোঁখ খুলে দেখতে পাবে ভারতবর্ষের ম্যাপের উপর তেরঙ্গা কাপড় পরিহিত নারী মুর্তির নাম ভারতমাতা নন​, ওটা একটা কাল্পনিক ছবি, বরং এই জমির উপর বেড়ে ওঠা সকল মানুষ পশু পাখি এমন কি কিট পতঙ্গের সমষ্টি ই হলো ভারতবর্ষ​।

    Like

  5. আপনার উত্তরের অপেক্ষাতে ছিলাম অনেকদিন। উত্তর পেলাম কিন্তু পুরপুরি মন ভরলো না। আপনার অনুরোধ মতো ব্লগ টাও পড়লাম। তাও ঠিক মনে ধরল না। তবে ধন্যবাদ উত্তর দেবার জন্য। এক এক করে কয়েকটা প্রশ্ন আবার করব:
    ১. সৈনিক হওয়া একটা পেশা – অবশ্যই – আমিও সেই এক ই কথা বলেছিলাম। তবে একটা পার্থক্য: আমি একটা ডাক্তার কসাই এর মতো কাজ করেছে বলে পুরো ডাক্তার দের গালি দেব না। কারণ সেই ডাক্তার ই আমাদের জীবন বাচায়, তাই না? কাজেই, গোটা আর্মি কে গালাগালি না দিয়ে সাধারণীকরণ না করাই ভালো। আমি যেমন ডাক্তার, ইন্জিনিআর, আর্মি, উকিল, গায়ক, নায়ক, মুচি, মেথর, মিষ্টির দোকানের কর্মচারী – সবাইকেই শ্রদ্ধা করি – আবার কেউ খারাপ কাজ করলে গালি দি বৈকি।
    ২. আমি কখনো আমেরিকা কে অসহিষ্ণু বলিনি – একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম। এটা বলার জন্য যে ভারত বা আমেরিকা কোনটাই সহিষ্ণু বা অসহিষ্ণু হয়ে যায় না কয়েকটা ঘটনার জন্য। ঘড়ি বানানোর ‘অপরাধে’ কাউকে দেশছাড়া হতে হলেও আমেরিকা এখনো যথেষ্ট সহিষ্ণু।
    ৩. টি-শার্ট এর প্রশ্নে বলি, হ্যা, আমিও জানি যে বেশির ভাগ পাকিস্তানি ভারত কে শত্রু ভাবে না। কিন্তু মনে হয়, সন্ত্রাস আর পাকিস্তান – সমার্থক হয়ে যাবার জন্য আমি মহান হতে পারি না। তবে আমেরিকার বুকে বসে যখন কোনো পাকিস্তানি কে দেখি মনে কিন্তু কখনো রাগ হয় না।
    ৪. আমি স্টিরিও-টাইপ হতে চাইনা, তবে যখনি মাথায় তিলক কাটা রাগী লোক বা গোফ কাটা দাড়ি-ওআলা কাউকে দেখলে বড্ড আস্বস্তি করে। গোড়ামি টা আমার একদম অপছন্দের। কাজী নজরুল ইসলামের একটা কথা মনে পড়ে গেল: “হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব, দাড়িত্ব অসঝ্য, কেননা ওই দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পান্ডিত্ব, তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি! আজ যে মারামারি টা বেধেছে সেটাও ভাই পণ্ডিত মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।”
    ৫. বাংলাদেশ কে ভারতের মদত দেওয়া আর পাকিস্তানের কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়া এক পঙতি তে বসাতে দ্বিধা আছে – কারণ, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, ভারত কিন্তু তাদের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলায় না – আর এটা মনে করতে বড্ড অসুবিধা হয় (প্রকল্পিত হলেও) যে পাকিস্তান (বা পাকিস্তান আর্মি 🙂 ) স্বাধীন কাশ্মির এর ব্যাপারে নাক গলাবে না। যদি এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়, আমি অপারগ – ভরসা নেই, বা খুব উদার হতে পারলাম না – কারণ ওই দেশটার ন্যাশনাল পলিসি ঠিক করে পাকিস্তানি আর্মি, পাকিস্তানি জনতা নয়, তাই না?
    ৬. আর হ্যা, আফজল গুরু আরও তৈরী হবে, তাকে সমর্থন করার লোক কম পড়বে না। ভারত -ও ধ্বংস হবে না। কিন্তু কেউ “ভারত ধ্বংস হোক” – বলুক, এটা আমি সমর্থন করতে পারব না।হতে পারে আলট্রা লেফটিস্ট রা আমাকে বিজেপি বলে গালি দেবে। তাতে আমি বিজেপি হয়ে যাব না।

    তো, যেটা ফাইনালি যেটা বলব: আপনি কমিউনিস্ট দের শ্রদ্ধা করেন, সেটা আপনার মৌলিক অধিকার। আমি কমিউনিসম বিশ্বাস করি না – সেটা আমার মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমি আপনাকে অশ্রদ্ধা করি না। তবে, প্রত্যেক টা সমাজেই কিছু নিয়ম কানুন থাকে (মানুষের তৈরী করা) – যেমন চুরি করা বাজে কাজ, মহিলাদের অসম্মান করা উচিত নয়, ঘুস খাওয়া বাজে কাজ – ইত্যাদি ইত্যাদি – সেইরকম এ আমরা ছোট থেকে এটাও শিখেছি দেশ কে (বা দেশের মানুষ কে) ভালবাসতে হয়। “আমার যা ইচ্ছে তাই করব” এটা সংবিধান মোতাবেক অনুমোদিত কি না জানি না, তবে সেটা আমার মনে হয় আমাদের সবার পক্ষেই অসুবিধাজনক হবে – আজ না হলেও, হয়ত কিছুদিন পরে। আমি বাবরি, দাদরি, মুম্বাই ব্লাস্ট, তাজ হোটেল সন্ত্রাস – সবেই দুঃক্ষ পাই। কিন্তু আজো নিজেকে ভারতীয় ভাবতে ভালো লাগে।হ্যা, জাস্ট ভালো লাগে। ভারত কে মা বলে ভাবি না ঠিক ই – তবে ভারত কে নিয়ে কেউ কিছু বললে বড্ড খারাপ লাগে।

    জানি না, বিশ্ব নাগরিক বলে কিছু হয় কি না। হবে হয় তো…

    Like

    1. আপনি লিখেছেন বটে প্রশ্ন করবেন একে একে, তবে প্রথম দিকে কয়েকটা প্রশ্নের আকারে পাই নি। তবু লিখছি।

      ১। মনে হয় দ্বিমত নেই। আমি পুরো আর্মিকে গালি দিই নি। ভালো মন্দ মিলিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনি। তাই তাদেরকে লার্জার দ্যান লাইফ “মহান” তকমা দিতে আপত্তি আছে আমার। আর্মিকে আর পাঁচটা চাকুরিজীবির মত দেখলেই সমস্যা মিটে যায়। আপনার সঙ্গে আমার বক্তব্যের তফাত নেই, কিন্তু এখন দেশ জুড়ে একটা হাওয়া চলছে, আর্মি মানেই মহান, তারা দিন রাত জেগে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে বলেই আমরা এখানে বক্কাবাজি করতে পারছি ইত্যাদি টাইপের বক্তব্য পেশ করে দেশপ্রেমিক আর দেশদ্রোহী ঝেড়েবেছে নেওয়া হচ্ছে, আমার বক্তব্য ছিল এই মাইন্ডসেটের বিরুদ্ধে।
      ২। ঠিক তাই, দেশ অসহিষ্ণু হয় না, হয় দেশের মানুষ, আর সরকার। আমেরিকা দেশের অনেক মানুষই মুসলিমদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ, কিন্তু সেখানে সরকারি মন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট সে সবের সমর্থনে বিবৃতি দেন না (আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আপাতত ধরছি না) – কিন্তু ভারতে সেইটাই হচ্ছে। মহম্মদ আখলাকের পিটিয়ে খুনকে লেজিটিমাইজ করছেন মহেশ শর্মা, সাক্ষী মহারাজ ইত্যাদি শাসক দলের সাংসদ-মন্ত্রীরা। সম্প্রতি কানহাইয়া কাণ্ডে দেশপ্রেমের ধারণাকে বিকৃত করে বিবৃতি দিয়েছেন রাজনাথ সিং, অরুণ জেটলি, রোহিত কাণ্ডে সংসদে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া মিথ্যে বলে গেছেন স্মৃতি ইরাণী। … নেতামন্ত্রী লেভেলে এই রকমের লেজিটিমাইজ করার প্রকট প্রচেষ্টা চললে তার অন্ধ অনুগামীরা দেশ জুড়ে তাদের দাপাদাপি তো বাড়াবেই, বিরুদ্ধ মত যারাই প্রকাশ করবে, তাদের পেটাও, মারো, জেলে পোরো, সিডিশনের চার্জ লাগাও, পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে ফ্যালো – অসহিষ্ণুতা এখানেই। “দেশ” আর “রাষ্ট্র”-এর তফাত অনেকেই বোঝে না, বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে “দেশদ্রোহিতা” বলে চালিয়ে একটা জনমত তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে – ঠিক একই কাজ করে গেছিলেন গত শতকের তিরিশের দশকের জার্মানিতে, হিটলার। একই কাজ নীরবে এবং সরবে করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রীরা। মোদী-শাহ এদের জুটির ইতিহাসটাও তো দেখতে হবে, কত মানুষের রক্তে স্নান করে তবে আজ এঁরা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আর বিজেপির সভাপতি হয়েছেন। অসহিষ্ণুতাকে তোল্লাই দিচ্ছেন এনারা, সরকারের তরফে, সেই অসহিষ্ণুতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা।
      ৩। সন্ত্রাস আর পাকিস্তান সমার্থক – আমি মনে করি না। পাকিস্তান নিজেও সন্ত্রাসের শিকার, অত্যন্ত বাজেভাবে। পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই ক্রমশ ফেলিওরের দিকে এগিয়ে গেছে। আজকের পাকিস্তান একটি ফেইলড স্টেট। সব দিক দিয়ে অকৃতকার্য। না আছে অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার শক্তি, না আছে আধুনিক বিদেশনীতি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে, করাপ্ট নেতাদের প্রশ্রয়ে চাড়া দিচ্ছে মৌলবাদ, তৈরি হচ্ছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। সে মারছে পাকিস্তানের বাইরেও, মারছে পাকিস্তানের ভেতরেও। বিন লাদেন পাকিস্তানেই নিরাপদে লুকিয়ে ছিল।

      কিন্তু – এই পাকিস্তানি নেতা আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনি আর পাকিস্তানি মোল্লারাই তো দেশ নয়। ভারতের মতই, এর বাইরে আছে অগণিত মানুষ, যারা এই বৈরিতা চায় না, যারা ভারতের বন্ধুত্ব চায়, শান্তি চায়, চায় স্কুলে গেলে নিজের সন্তান জীবন্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে আসুক। ঐ নেতা, সেনা আর মোল্লা – ওরা রাষ্ট্র, সরকার। ওরা দেশ নয়। পাকিস্তানেও আমাদের মত অনেক “রাষ্ট্রদ্রোহী” অনেক আছে, যাদের লাগাতার সে দেশের সরকার “দেশদ্রোহী” তকমা দিচ্ছে আর জেলে ভরার চেষ্টা করে চলেছে। নয় তো এনকাউন্টার করে মেরে দিচ্ছে।

      আমরা কি পাকিস্তান হতে চাইছি?

      ৪। স্টিরিওটাইপিং-এর প্রশ্ন নয়। আমি যেমন আমার নাস্তিকতা মাইক বাজিয়ে বা লোকের দরজায় দরজায় সংকীর্তন করে প্রচার করি না, তেমনি মনে করি যার যার ধর্মবিশ্বাস একেবারে নিজস্ব হওয়া উচিত। উচ্চকিত টুপি-দাড়ি-তিলক দেখলে আমার অশ্রদ্ধা হয়। আমি তো রাস্তাঘাটে বলি না যে ধর্ম বালবিচি কিংবা ভগবানের মূর্তি পায়ে ডলে ভেঙে দেওয়া হোক, তা হলে ধার্মিক কেন তার ধর্মবিশ্বাসের পাবলিক ডিসপ্লে করে বেড়াবে আর আমাকে সেটা সহ্য করতে হবে?

      তবু সহ্য করি। কারণ আমি সংখ্যালঘু। একবার সংখ্যালঘুর জুতোয় পা গলালে দেখবেন, গণতন্ত্রের আলোর নিচেই কত বঞ্চনা, কত অন্ধকার সমানাধিকারের বুলির পেছনে। আজও রোহিত ভেমুলাকে মরতে হয়।

      ৫। বাংলাদেশের তুলনাটা আমি খুব লুজলি দিয়েছিলাম, আলোচনা শুরু করার উদ্দেশ্যে। তুলনীয় নয় অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে কাশ্মীর, কিন্তু আপনি যে যুক্তিতে বলেছেন, সেই যুক্তিতে নয়। কাশ্মীরও একটি স্বাধীন দেশ হয়েই জন্মাতে চেয়েছিল, তাকে স্বাধীন হতে দেওয়া হয় নি। বাংলাদেশকে হতে দেওয়া হয়েছে।

      কাশ্মীর নিয়ে আমি নিজেও এখনও প্রচুর পড়াশুনো করে চলেছি। সুমন্ত্র বোসের একটা বইয়ের নাম দিয়েছি ওপরে, ওটা পড়ুন, বুঝতে পারবেন সমস্যাটা কোথায়। কেন কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মানতে আমার দ্বিধা আছে। আমিও আপনার সঙ্গেই পড়ছি, শেষ করি নি এখনও। শুধু কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে অনেক বড় করে লেখা যায়, একটা পয়েন্টে সেটা ধরানো যাবে না।

      ৬। আপনি, এত কিছু এখার পরেও আবার গুলিয়ে ফেললেন সেই একই পয়েন্টে। আফজল গুরুকে কেউ “সমর্থন” করে নি। এটা যতক্ষণ না আপনি বুঝতে পারছেন, ততক্ষণ আমরা পরের আলোচনায় যেতে পারব না।

      “ভারত ধ্বংস হোক” বলা আমিও সমর্থন করি না, লেফট হই বা না হই। কিন্তু তার শাস্তি সিডিশনের চার্জ লাগানো বা জেলএ ঢোকানো নয়। সাধারণ একবার বকে দিলেই হত। ফুল চুরিও চুরি, জুয়েলারি গয়না চুরিও চুরি। কিন্তু দুটোর জন্য জেল হয় না।

      ৭। কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধা করি কিনা জানি না, তবে কমুনিজমের ওপর আমার একটা হাল্কা ভালোলাগা আছে। আমি কমিউনিজমের ওপর কিছুই পড়ি নি প্রায়, তাই এ বিষয়ে কথা বলার অধিকারী নই। তবে যে টুকু জানি, সেই অনুযায়ী আমার মতে দুনিয়াকে অনেক ভালো জায়গা বানাবার ক্ষমতা রাখে কমিউনিজমের আদর্শ।

      আমি শুধু অন্যায়কে অন্যায় বলছি। সেটা যদি আমাকে কমিউনিস্ট বানায়, আমি কী বলতে পারি?

      ৮। ভারতকে ভালোলাগা-টা একেবারে ব্যক্তিগত অনুভব। আমারও ভালো লাগে। এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, একটা সেন্টিমেন্ট নস্টালজিয়া কাজ করে অবশ্যই। আপত্তিটা আসে যখন কেউ বাধ্য করে আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে আমাকে “ভালোবাসতে বাধ্য করে”। না স্যার, চাপের মুখে ভয় করতে পারে, ভালোবাসা আসে না। আমি “গর্বিত” নই ভারতীয় হিসেবে। গর্ব টাইপের ব্যাপারস্যাপারগুলো আমার ঠিক আসে না। আমার ভারতকে ভালোলাগে, ঠিক যেমন পাকিস্তানকে ভালো লাগে, দুবাই, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া বা ডেনমার্ক আমার ভালো লাগে। দুনিয়ায় অনেক ভালো ভালো জায়গা আছে, ভারত তার মধ্যে একটা। আমার কালচার ম্যাচ করে বাংলার কালচারের সঙ্গে – এটুকুই। এতে “গর্ব” করার ঠিক কী আছে, আমি বুঝে পাই না। ভ্যালিড কারণে যদি ভারতকে নিয়ে “কেউ কিছু বলে” – আমার খারাপ লাগে না। বলায় যদি যুক্তি থাকে, আমি মেনে নিই। আবেগে ভেসে গিয়ে তাকে দেশদ্রোহী বলি না।

      Like

      1. তবে তাই হোক। তবে ৭ আর ৮ নিয়ে কিছু বলার ছিল।
        ৭। আপনাকে কে কমিউনিস্ট বলেছিল জানি না। সব কটা রেসপন্স পড়িনি। সে সবের মধ্যে না গিয়ে বলব, কমিউনিসম এমন একটা জিনিস যেটা ব্রেন ড্রেন বাড়ায়, যেটা ল্যাদ-খোর মানুষদের আরও ল্যাদ-খোর বানায়, যেটা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ কে সেখায় সে সবাই সমান – কিন্তু আলটিমেটলি দেখা যায়, হ্যা সব্বাই সমান (কিছু শাসক শ্রেণী ছাড়া) – কিন্তু সব্বাই নিম্নবিত্ত হয়ে।বইয়ের মতাদর্শ আর বাস্তব এর মিলটা কোথাও নেই। তাই আদর্শ টা ইন্টারেষ্টিং হলেও, বাস্তবে সেটা বড্ড ইলিউসনাল।প্রকৃষ্ট উদাহরণ – কিছু এশিয়ান কান্ট্রি – নাম গুলো বলে আর কি হবে?
        ৮। বোঝো কান্ড – আপনি তো পুরোটা ঘেটে ঘ করে দিলেন। মানে আপনার কাছে সেন্টিমেন্ট বা ওই টাইপ এর জিনিস এর কোনো ভ্যালু -ই নেই। কি অদ্ভূত। তবে আর আপনাকে কি বোঝাব? অনেকদিন দেশের বাইরে, তাই হয়ত, এখনো জন গণ মন শুনলে রক্ত চাপ টা একটু বেড়ে যায়। ওসব বোঝানোর কম্ম আমার নয়। আমার মতো লোক আবার ভারত কে একটু পার্শিয়ালিটি করে। আমি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রিটেন, বা চীন কে এক সারি তে বসাতে পারব না। সেন্টিমেন্টাল ফুল ছাড়া আর কি বা বলবেন?

        ভালো থাকবেন। আরও লিখুন, আপনার মতের সাথে মিল না হলেও, পড়তে ভালো লাগে।লেখার মানের জন্যই।শুভেচ্ছা রইলো।

        Like

    2. ওহ হ্যা, আরেকটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছিলাম। ভ্যালিড কারণে অবশ্যই “কিছু” বলবে। তাতে কোনো দোষ নেই। আমি শুধু বলেছিলাম, ভ্যালিড কারণ হলেও আমার খারাপ লাগে।এটা খানিক টা খুব কাছের বন্ধু একটা বাজে কাজ করলে তাকে বুঝিয়ে ঠিক রাস্তা তে নিয়ে আসার মতো। আমি জাস্ট সমালোচনা করে ব্যাপার টা কে “ভুল” প্রমান করে লাফানোর বিরুদ্ধে।

      কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি সেই ভ্যালিড কারণ টা ইগনোর করছি। অবশ্যই ভুল হলে সেটা ঠিক করা উচিত।কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমি “দেশ নিপাত যাক” বলে লাফাব বা লাফাতে উত্সাহ দেব। বরং সেই ভুল টাকে কি করে ঠিক করা যায় সেটার দিকে মন দেব। পলিটিকাল উদ্দেশ্য সাধনে সেটার মদত দেওয়া শুধু ভুল ই নয়, অন্যায়।

      Like

  6. আবারও বলছি। সামান্য কিছু মতপার্থক্য ছাড়া আমরা আসলে দুজনেই একই কথা বলছি, কেবল উপস্থাপনাটা আলাদা।

    না, আমিও দেশ নিপাত যাক – বলে লাফাব না বা লাফাতে উতসাহ দেব না। এটা আমি কোনও দেশের জন্যেই করব না, ভারত হোক বা পাকিস্তান বা ইরাক। ভুলটাকে ঠিক করার দিকেই আমিও জোর দেব। আমার বক্তব্য এটুকুই – “লাফাব না” বলার উল্টোপিঠটা কিন্তু “লাফালেই সিডিশন চার্জে জেলে পুরব” – তা নয়। আবারও বলছি, এই অপরাধের জন্য জাস্ট একবার বকে দিলেই যথেষ্ট ছিল বা শো-কজ করলেই যথেষ্ট ছিল।

    এবার দ্বিমত যে ব্যাপারে –

    ১। বলেছে আমাকে, কমিউনিস্ট। বিভিন্ন কনটেক্সটে। আমার ব্লগের নিচে কমেন্টে বা অফলাইনে। আমি কমিউনিস্ট নই। কারণ আমি কোনও কমিউনিস্ট দলের সাথে যুক্ত নই। আমি কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, বিজেপির সাথেও যুক্ত নই। আমি কমিউনিজম নিয়ে প্রায় কিছুই পড়ি নি, সেভাবে পড়ার দরকার হয় নি। আমি শুধু রাষ্ট্রের ফ্যাসিজমকে ফ্যাসিজম বলে চিহ্নিত করেছি – তাতেই কেউ কেউ আমাকে কমিউনিস্ট বলেছেন। – যাই হোক, কমিউনিজম সম্বন্ধে আমার চিন্তাধারা একটু অন্যরকম, সেটা হয় তো আপনার সঙ্গে মিলবে না, কিন্তু আমি আজকের ভারতের সো-কলড কমিউনিস্টদের প্রতি যতটা বিরূপ, কমিউনিজমের প্রতি ততটা নই।

    ২। সেন্টিমেন্টের মূল্য আমার কাছে অবশ্যই আছে। ভালোবাসা, ভালো লাগা, মায়া মমতা এগুলো আমার কাছে অপরিসীম গুরুত্বের। কিন্তু ঐ “গর্ব” ব্যাপারটা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি দশটা অপশনের মধ্যে চয়েস নিয়ে বেছে বেছে ভারতে জন্মাই নি, এটা নেহাতই কো-ইনসিডেন্ট। আমি পাঁচটা অপশনের মধ্যে চয়েস নিয়ে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাই নি – তাই গর্বিত ভারতীয় বা গর্বিত হিন্দু টাইপের ফ্রেজগুলো শুনলে আমার জাস্ট খিস্তি পায় – গর্ব টর্ব হয় না।

    না, জনগণমন শুনলে আমার জাস্ট কোনও রিয়্যাকশনই হয় না। তিরঙ্গা দেখলেও না। র‍্যাদার “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটা আমার জনগণমন-র থেকে বেটার লাগে। বাকিটা অভ্যেসের বশে, সরকারি অনুষ্ঠানে তিরঙ্গা তোলা হলে বা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হলে উঠে দাঁড়াই। সিনেমাহল-এ দাঁড়াই না। পাবলিক ক্যালাবে সেই ভয়ে আজকাল সিনেমাহল-এও যাই না তাই। ইন ফ্যাক্ট, উঠে দাঁড়ানো = সম্মান করা বা উঠে না দাঁড়ানো = সম্মান না করা, এই ইকোয়েশনও আমার বোধগম্য হয় না। ওগুলো অ্যাকোয়ার্ড কালচার, সামাজিক নির্মাণ, শর্টে বলি সানি।

    ধর্মস্থানে ঢোকার আগে হিন্দু বা মুসলমান বাইরে জুতো খুলে রাখে, ক্রিশ্চান জুতো পরেই প্রার্থনাকক্ষে ঢোকে। সবই সানি-র মহিমা। দেশের জন্য আবেগ, গর্ব – এইগুলো সবই সানি। অ্যাকোয়ার্ড কালচার। চারপাশের অনেকেই করে বা সবাই করে, তাই করি টাইপের। কিন্তু ভালোলাগা ভালোবাসা প্রেম স্নেহ – এগুলো অ্যাকোয়ার্ড নয়। এগুলো মানুষের ইনহেরেন্ট প্রপার্টি। কাঁচা বায়োলজি, আমি বলি কাঁবা। 🙂

    এই কাঁবা আর সানি-র তফাত বুঝতে বুঝতেই দিব্যি দিন কেটে যায়, গরবিত হবার সময় পাই না।

    Like

  7. সেনার চাকরির সাথে অন্য চাকরির তফাত আছে. সবাই শুধু মাইনে পাবার জন্যে সেনার চাকরি নেয় না. আবেগ passion এগুলি কিছুটা হলে কাজ করে বই কি..শুধু মাইনে পায় বলে মৃত্যু র সামনে দাঁড়ায় না..তাহলে সবাই পিঠ বাঁচিয়ে পালাত..সেনার দোষ থাকলেও তারা কিছুটা glorified ত বটেই..আপনার লেখ চমত্কার..কিন্তু সমধান হীন.,শুধু রক্ত গরম করার উপযোগী..

    Like

    1. আপনার রক্ত গরম করতে পেরেছি জেনে ভালো লাগল। সেনা সম্পর্কে আমার কিছুমিছু নলেজ আছে, তার বেসিসেই লেখাটি লিখেছি। একমত হওয়া বা না-হওয়া, আপনার হাতে 🙂

      Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.