বড় বিষ জমে গো। বিষ জমে শরীরে, মনে। বিষ জমে দৃষ্টিতে, শ্রবণে। নাগরিক জীবন তার বুকে বসবাসের মাসুল হিসেবে চড়া দাম তুলে নেয় সুদে, আসলে। রাতের ঘুম নষ্ট হয়। চিন্তার পর চিন্তা ঢেউ খেলে যায় অবসন্ন মস্তিষ্কের মধ্যে দিয়ে। চোখ খুললেও অন্ধকার দেখি, চোখ বন্ধ করলেও। বিষেরা ঘুমোতে দেয় না, চিন্তারা ঘুমোতে দেয় না। প্রাণ হাঁসফাঁস করে, বেপরোয়া মনে মাঝেমধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায় শেষরাতের হ্যালোজেনের আলোধোয়া রাস্তা। নিঃশব্দে ডাকে। বেরোতে পারি না। হাজারটা দায়, আরও হাজারটা দায়িত্ব, চারপাশের বাস্তবেরা দাঁতনখ বের করে আমাকে ঘিরে ধরে, যেতে দেয় না। তবু, একটা সময়ে, একটা দিনের জন্য অন্তত, সমস্তকিছুকে ছুটি দিতেই হয়। ছুটি নিতে হয়, নিজের থেকে নিজের। বিষ নামাতে তো হবে – এতগুলো বছর, এতখানি জীবন কাটাতে হবে নগরসভ্যতায়, একটু করে ডিটক্সিকেশন না করলে, ভবনদীর মাঝে খেয়া বাইব ক্যামনে?
গতবছর পর পর বেশ কয়েকটা লম্বা জার্নির সিরিজ নামিয়ে দিয়েহিলাম। বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়া রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম, এবং অল্পবিস্তর ছড়ানো সত্ত্বেও, সফলভাবে যাত্রাগুলো শেষ করতে পেরেছিলাম। এতে করে যে লাভটুকু হয়েছিল, সেটা হল, কনফিডেন্স। আমিও পারি। বয়েস যদিও চল্লিশ ছুঁইছুঁই, এক ফোঁটাও ফিজিকাল এক্সারসাইজ করি না, সারাদিন চেয়ারে বসে কাজ কিংবা না-কাজ – তবু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম বাইক-রাইডিং-টা আমার প্যাশন। এই জিনিসটায় আমার ফিজিকাল ফিটনেসে এতটুকুও ঘাটতি নেই। এ বছরের গোড়াতেই নিধি তিওয়ারি আর তুষার আগরওয়ালের সাথে দেখা করে ইস্তক নতুন একটা স্বপ্ন মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, একেবারেই কি অসম্ভব, মোটরসাইকেল নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডন পাড়ি দেওয়া? স্বপ্নে ধুনো দিয়েছিল আমার ভার্চুয়াল বন্ধু কেসি-ও, জন্মদিনে আমাকে একটা ই-বুক গিফট করেছিল – দু-চাকায় দুনিয়া। সেই গত শতকের দ্বিতীয় দশকে একটা লোক সাইকেল চালিয়ে কলকাতা থেকে শুরু করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছিল – রাস্তায় দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রানাথ, আইনস্টাইন, রাসবিহারী বসের মত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। পড়লে মনে হয়, রূপকথা পড়ছি।
পড়ি, আর ভাবি, আমিও কি পারব না? অসম্ভব তো কিছু নয়।
সম্ভবও নয়। ফিজিকাল ফিটনেসটাই তো সব নয় রে দাদা – পয়সা লাগে, প্রচুর পয়সা। এদিক ওদিক খুচরো চেষ্টা করেছি, স্পনসরশিপ জোগাড় করতে পারি নি কোথাও। স্বপ্নের পরিধি কমিয়ে চেষ্টা করছি অন্তত যদি থাইল্যান্ড হয়ে কুয়ালালামপুর পর্যন্তও ঘুরে আসা যায় – কিন্তু তাতেও খরচ কম নয়, আজকের দিনে প্রায় সাত লক্ষ টাকা লাগে। অনেক হ্যাপা।
কিন্তু তাই বলে এমনি করে ঘরে বসে থাকব, আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্বপ্নই দেখে যাবো? আছে যত হাড় সবই তো শক্ত, এখনও ধকল সয় – এখনও আছে সময়। জুনে বেরিয়ে পড়েছিলাম আরেকটা যত্নলালিত ট্রিপে, অস্ট্রেলিয়া, সপরিবারে। সে নেহাতই বেড়ানো, তাতে অ্যাডভেঞ্চার কিছু ছিল না। কিন্তু আরেকবার ভোররাতে হাইওয়েতে বাইকের চাকাদুটো ছোঁয়াতে না পারলে – ই জিন্দগী ভি কনো জিন্দগী হ্যায়?
ফেসবুকে খুঁজতেও হয় না – টুকটাক বাইকার্স অ্যাডভেঞ্চার গ্রুপের সন্ধান এমনিই পাওয়া যায় – বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন দল। প্রায় প্রতি উইকেন্ডে এরা বেরিয়ে পড়ে, দিল্লিকে কেন্দ্র করে বেড়াবার জায়গার তো কমতি নেই। দল বেঁধে হেডলাইট জ্বালিয়ে ভটভটিয়ে চলে বাইকারদের গ্যাং, গন্তব্যে পৌঁছে খানাপিনা, হুল্লোড়, ফেসবুকে একে অপরকে অ্যাড –
বেরিয়ে পড়েছিলাম এই সেপ্টেম্বরেই এই রকমের একটা গ্রুপের সাথে। বেশিদূর না, সোনেপত। ব্রেকফাস্ট রাইড। ভোর পাঁচটায় স্টার্ট, মুকারবা চকে সব্বাইকার জমায়েত, সেখান থেকে আরও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। গুলশন ধাবায় ব্রেকফাস্ট করে আবার ফেরত। … বেরোলাম, বেশ অর্গানাইজড ব্যাপার স্যাপার, সুন্দর সুশৃঙ্খল, কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা কিন্তু-কিন্তু লাগছিল। এই সব লোকজনের মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পাই নি। উত্তর ভারতীয়দের একটা গ্রুপ, তাদের ভিড়ে আমি যেন কেমন বেমানান – আমারই দোষ, আমি ঠিক মিশতে পারি না সকলের সাথে। যত দিন যাচ্ছে, যত বয়েস বাড়ছে, কেমন অসামাজিক টাইপের হয়ে যাচ্ছি, নিজেও বুঝতে পারি, কিন্তু কী করব, আমি তো আমিই, নিজেকে কি আর বকেঝকে বদলে ফেলা যায় এই আধবুড়ো বয়েসে?
সেপ্টেম্বরের ওই ছোট্ট ট্রিপে এটুকুই আমার লাভ, আমি উপলব্ধি করলাম – রাস্তা আমি সবচেয়ে বেশি এনজয় করি একলা। সম্পূর্ণ একা একা চলতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। দলের আনন্দের প্রক্রিয়া, হুল্লোড়ের উপকরণ হয় তো আমাকে মানায় না। নিজের মতন নিজে চলাতে একটা আনন্দ আছে।
অফিসে কাজ বাড়ন্ত ছিল কদিন – সেই ফাঁকে কিছু লম্বা লম্বা ট্রিপের পড়াশুনো করে ফেলেছিলাম – সঙ্গে তাল মেলালো গুরুর একজন নীপা। স্বপ্ন দেখা আবার শুরু করেছি। সেই নীপা কে, বা গন্তব্য কোথায় – সে সব এখন খোলসা করছি না বাপু, জানতেও চেও না, কিন্তু সেই ট্রিপ করার খরচা আমার সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু তার আগে তো হোমওয়ার্ক করতে হয়। হোমওয়ার্কের প্রথম স্টেপ হচ্ছে, নিজের ফিটনেস চেক করা।
আগেই বলেছি, আমি একেবারে ল্যাদ খাওয়া পাবলিক। কখনও এক্সারসাইজ করি না, আসন ব্যায়াম কপালভাতি – কিস্যু না, লিফট চললে সিঁড়িও ভাঙি না। খেলাধূলোর ধারকাছ মাড়াই না, কেবল বাইকের সীটে বসলে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসে যায়। তো, বাইকের সীটে বসেই একবার দেখতে হবে সেই চমক এখনও ধরে রাখতে পেরেছি কিনা।
সারা অক্টোবর মাস জুড়ে বাইকের পেছনে মন দিলাম। প্রথমে বদলাতে হল সামনের টায়ার। অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল। এর পরে হেডলাইট। সাধারণ বালব বদলে লাগালাম জোরালো এলইডি। টার্ন ইন্ডিকেটরের তার জুড়ে একটা সুইচে লাগিয়ে ব্লিঙ্কার বানিয়ে নিলাম, কুয়াশা বা হাইওয়ে রাইডিং-এ এটা মাস্ট। আর তার সাথে একটা সার্ভিসিংও করিয়ে নিলাম।
প্রতি উইকেন্ডেই ভাবছিলাম, বেরবো, বেরবো, কিন্তু বেরনো আর হয়ে উঠছিল না – হয় এই কাজ, নয় তো সেই কাজ, সমস্ত কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে দিচ্ছিলাম, নিজের কাজটুকু বাদ দিয়ে।
অবশেষে দিওয়ালির সময়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাঃ, আর দেরি করা যায় না। গরম কমে গেছে, শীতও পড়ে নি তেমন, এই আদর্শ সময়, এখন না বেরনো হলে আর বেরোতে পারব না। দিন ঠিক করলাম, একত্রিশে অক্টোবর, সোমবার। অফিসে ছুটিই ছিল, তাই ছুটির সমস্যা নেই। একদিনই যথেষ্ট। যে ট্রিপের স্বপ্ন আমি দেখছি, সেটা সফল করতে হলে আমাকে একদিনে সাতশো থেকে সাড়ে আটশো কিলোমিটার বাইক চালাতে হবে। তো, আমাকে এমন একটা ডিসটেন্স বাছতে হবে – যেটা আসা যাওয়া মিলিয়ে ওই রকম পড়ে – সাতশো সাড়ে সাতশো। যাবো, গন্তব্য টাচ করব, চলে আসব, জাস্ট দেখার জন্য যে আমি পারছি কিনা, আর পারলে – কতক্ষণে পারছি – টাইম ম্যানেজমেন্ট।
অফিসের টিমে এক পঞ্জাবি খোকা আছে, সে-ও বুলেট চালায় এবং এই রকমই একটা গ্রুপের সাথে যুক্ত, প্রায়ই এখানে ওখানে উইকেন্ড ট্রিপে বেরিয়ে যায়, সে আমাকে খুব ডেকেছিল – পা-জি, শোগগি চলনা হ্যা? ব্রি মস্তি আয়েগি।
আমি যাই নি, কিন্তু শোগি নামটা মাথায় গেঁথে গেছিল। পঞ্জাবি গ্রুপের সাথে – তাও অত্যন্ত কমবয়েসী একগাদা ছেলেপুলের সঙ্গে, না ওরা এনজয় করবে, না আমি করব। ওরা ঘুরে আসুক, ডিটেল জেনে নিয়ে আমি পরে একদিন একা-ই বেরোব।
তা ওরা ঘুরে এসেছিল। এমনি কিছুই নেই, শিমলার কাছে একটা ছোট্ট ডাইভার্শন নিয়ে যেতে হয়, একটা ছোট ঝর্না আছে, পাবলিক ওখানে গিয়ে ঝর্ণায় চান করবে এবং ফিরে আসবে। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূর, যাওয়া আসা মিলিয়ে সাতশো।
দি আইডিয়া। শোগি দরকার নেই, ছোট ঝর্না দেখে কী করব? গন্তব্য তো আমার কাছে মুখ্য নয়, আমার কাছে রাস্তাটাই আসল। শিমলাই যাওয়া যাক। শোগি থেকে আরও দশ পনেরো কিলোমিটার।
শোগি, শিমলা যাবার পথে পড়ে, একটা ছোট গ্রাম, সেখানে একটা ওয়াটারফল আছে। গুগলে ছবি দেখে খুব সাঙ্ঘাতিক ইমপ্রেসিভ কিছু লাগল না, তার ওপরে হাতের কাছে ওয়াটারফল মানেই একগুচ্ছের লোক যাবে সেখানে, আর ক্যাঁচোরম্যাচোর করে জলকেলি করবে – গিয়ে কতটা ভালো লাগবে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তো, যা থাকে কপালে, শোগি যাবো, নয় তো শিমলা যাবো, আগে তো ওই অবধি পৌঁছে দেখি। গন্তব্য তো আসল নয়, যাত্রাটাই আসল।
৩১শে অক্টোবর, ভোর ভোর তৈরি হয়ে নিলাম। তৈরি হবার নতুন কিছু ছিল না, লম্বা বাইক জার্নিতে যে টুকু না হলেই নয়, প্লাস ঠাণ্ডাও পড়েছে অল্পস্বল্প। একটা উইন্ডচিটার, হাতে আর পায়ে গার্ড। মাথায় শিরস্ত্রাণ। এ বছর একটা ট্যাঙ্ক ব্যাগ কিনেছি – রাইনক্স অপটিমাস এম। পিঠে ব্যাগ না নিয়ে ওটাই নিলাম, বাইকের ট্যাঙ্কে লাগিয়ে কেমন চালানো যায় দেখা যাক।
ভোর চারটেয় ওঠাটা বেশ কষ্টকরই ছিল, কারণ আগের দিন ছিল দিওয়ালি, রাত্তির তেরোটা পর্যন্ত নাগাড়ে বাজিপটকা ফেটেছে, রীতিমত উৎকট শব্দ করে। উত্তর ভারতের লোকজন দিওয়ালি এলে সত্যিই কেমন পাগল হয়ে যায় – না দেখলে বোঝানো যাবে না। বললে পেত্যয় যাবে না – সকাল চারটে চল্লিশে যখন নিচে নেমে বাইকের ট্যাঙ্কে ব্যাগটা বাঁধছি, তখনও দেখি সোসাইটির সেন্ট্রাল পার্কে গোটা দশবারো লোক ঘুরছে, ছেলেছোকরা নয়, মুশকো লোক, সোসাইটিরই বাসিন্দা, ছানাপোনার বাপ, আমি চাবি ঘুরিয়ে ইগনিশন অন করামাত্র ভোর পাঁচটার নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার খানখান হয়ে গেল তাদের “হাজার কি লড়ি”-র ঔজ্জ্বল্যে। হাজার কি লড়ি আর কিছুই না, একসাথে দশবারোটা কালীপটকার প্যাকেট সিরিজে জুড়ে দেওয়া – টোটাল কালীপটকার সংখ্যা এক হাজার হয়। আর অনন্ত ফটফটফটাশ শব্দে মিনিট দুই তিন ধরে তারা ফাটে। সেইসঙ্গে আনন্দ পাওয়া লোকগুলোর মুখ থেকে ছিটকে আসা উচ্চগ্রামের হাসি – ঈষৎ জড়ানো। কোনও বোধবুদ্ধি নেই যেন। এরা সকলেই শিক্ষিত, উঁচু উঁচু চাকরি করা লোকজন।
কতটা ইনসেনসিটিভ মানুষ হতে পারে, সেটাই দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে সোসাইটির গেট ছাড়িয়ে বাইরে বেরোলাম। হ্যাঁ, অন্ধকার, হ্যালোজেন ধোয়া হাইওয়ে, এবং শান্তি, নৈঃশব্দ্য। ইতিউতি হাউসিং-এর বারান্দা থেকে ছুলছে টুনিবাল্বের মালা, লাল নীল সবুজ। গত বছর ভোরবেলা লাদাখের এরনোর কথা মনে পড়ে গেল। পাঁচটার সময়ে শুরু করেও লাগেজ বাঁধার চক্করে কতবার নাস্তানাবুদ হয়েছিলাম।
গাজিয়াবাদ পেরিয়ে আনন্দ বিহার, সেখান থেকে হসনপুর ডিপো, কড়কড়ডুমা, গীতা কলোনি পেরোলেই লালকেল্লার পাঁচিল, সোজা রাস্তা চলে গেছে উত্তর পশ্চিম দিকে। জম্মু যাও বা শিমলা কুলু মানালি, একটাই রাস্তা। একটু এগোতেই আইএসবিটি কাশ্মীরি গেট। দিব্যি এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ পেছন থেকে অনবরত পিঁপ পিঁপ পিঁপ করে হর্ন বাজার শব্দ, পেছনে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে একটা মোটরসাইকেল। সওয়ারির মাথায় হেলমেট নেই। ভোর পাঁচটা দশ, রাস্তাঘাট তখনও জনশূন্যই বলা চলে, একটু ভয় পেলাম, বাইক স্লো করে প্রথমেই দেখে নিলাম পেছনের বাইকের নাম্বারপ্লেট আছে কিনা। সাধারণত অপরাধ যারা করে হাইওয়েতে, তাদের নাম্বারপ্লেট খোলা থাকে। … না, আছে। দাঁড়ালাম, বাইক চালু রেখে এবং গীয়ার ফার্স্ট পজিশনে রেখে, যাতে দরকার পড়লেই ক্লাচ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারি। একবার দেখেও নিলাম – সামনের রাস্তাটা ফাঁকা আছে।
ছেলেটা আমার পাশে এসে দাঁড়াল, নিতান্তই ইয়ং ছেলে, চোখ দেখে মনে হচ্ছে হাল্কা নেশায় আছে, মোটরসাইকেলটা একটা ডিসকভার একশো সিসি, বাঁদিকের ইন্ডিকেটরটা ভেঙে ঝুলছে, ডানদিকের ইন্ডিকেটরে নীল রঙের টুনি লাগানো। মাথায় হেলমেট নেই। তবে কপালে লম্বা লাল রঙের তিলক। নাহ, এ আর যাই হোক, ক্রাইম করার উদ্দেশ্যে আমাকে থামায় নি, তবে উদ্দেশ্য কী?
ভাইসাব, ইধার আসপাস কোই হ্যালম্যাট কা দুকান হ্যায়? মেরেক্কো এক হ্যালম্যাট চাহিয়ে, চণ্ডীগড় জানা হ্যায়।
আশ্চর্য! ভোর পাঁচটা দশে এ আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে এখানে হেলমেটের দোকান কোথায় আছে? বাইকটা দেখলাম, হ্যাঁ, চণ্ডীগড়ের নাম্বারই বটে, কিন্তু এত সকালে কোথায় হেলমেট আমি কী করে জানব? সাধারণত দিনের বেলায় রাস্তার ধারে অনেক ভেন্ডর বসে। কিন্তু এই অন্ধকারে, তাও কাল রাতে দিওয়ালি ছিল, কে বসবে? সেটাই বললাম, বাপু, ওয়েট করো, দিনের বেলায় এই রাস্তাতেই বসবে, নয় তো আইএসবিটি ছাড়িয়ে এসেছো, সেখানেই ফিরে যাও, সেখানে যদি কোনও দোকান খোলা থাকে, আমি এই এলাকায় থাকি না, আমাকে জিগেস করে লাভ নেই। কিন্তু সে ছেলে শোনে না, কীরকম একটা ঘ্যানঘ্যান করে, বোলো না ভাইসাব, আসপাস কোই ভি হ্যালম্যাট কা দুকান …
মহা ঝামেলা, আমার বাইক রেডিই ছিল, “আইএসবিটি মে জাকে দেখো, বঁহা মিল জায়েগা” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ক্লাচ ছেড়ে দিলাম, পাঁচ সেকেন্ডে আশির স্পিডে। অনেকটা যাবার পরে পেছন ফিরে দেখলাম, অনেক দূরে সেই বাইক আসছে, নীল রঙের ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে, কিন্তু আমার দুশো সিসির বাইকের সাথে সে একশো সিসির বাইক পারবে কেন? খানিক বাদেই আর তাকে দেখা গেল না, কে জানে সে হ্যালম্যাটের দেখা পেল কিনা।
চোখের পলকে সিঙ্ঘু বর্ডার পেরিয়ে ঢুকে গেলাম হরিয়ানাতে। একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম, আমি আসলে এতক্ষণ প্রচণ্ড একটা ধোঁয়াটে অবস্থার মধ্যে দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। দিওয়ালির এফেক্ট। চারদিক এতক্ষণ ধোঁয়া-ধোঁয়া ছিল। মুরথাল আসার পরে দেখলাম সামনেটা সাফ দেখা যাচ্ছে – অবশ্য বাইকের হেডলাইটেই। চারপাশে এখনও অন্ধকার। ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলাম সোনেপত, পানিপত, কারনাল। নাহ, একটুও হাত পায়ে ব্যথা নেই, অবসাদ লাগছে না। মানে ফিট আছি এখনও। একশো কিলোমিটার তো হয়েই গেছে। বাড়ি থেকে ঠিক দুশো কিলোমিটারের মাথায় হচ্ছে আম্বালা।
সোয়া ছটায় দিনের আলো ফুটল, আমি তখন কুরুক্ষেত্র ক্রস করছি। এই ভোরের সময় আর অন্ধকার নামার সময়টাই বড় সমস্যা হয়, বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া দিনের আলোয় চোখকে অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগে। একটু দাঁড়িয়ে যাবো? দেড় ঘন্টার মধ্যে একশো কিলোমিটার করে দিয়েছি, এই রেটে চললে তো শিমলা এগারোটার মধ্যে আরামসে পৌঁছে যাবো। দিল্লি থেকে শিমলা তিনশো ষাট কিলোমিটার। নাঃ থাক, যতক্ষণ পারছি চালিয়ে যাই। টার্গেট হচ্ছে আটটার মধ্যে আম্বালা পৌঁছে দাঁড়ানো। ওটা হলে অর্ধেকেরও বেশি রাস্তা কভার করা হয়ে যাবে।
আম্বালা ঢুকলাম পৌনে আটটায়। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের সামনেই রাস্তার ধারে বাইক দাঁড় করিয়ে সিকিনীকে ফোন করে স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম। ভেবেছিলাম একটা কোথাও দাঁড়িয়ে চা খাবো, কিন্তু কাল দিওয়ালি উপলক্ষ্যে এত গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছি যে এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছেই করছিল না – আমি এমনিতে চাতাল নই-ও। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম।
আম্বালা থেকে রাস্তা আলাদা হয়ে যায়। সোজা এন এইচ ওয়ান চলছিল এতক্ষণ, সেটা সোজা চলে যায় খন্না জালন্ধর লুধিয়ানা হয়ে – জালন্ধরের পরে আবার রাস্তায় ব্র্যাঞ্চিং, একটা রাস্তা যায় পশ্চিমদিকে, অমৃতসরে, আরেকটা ডানদিকে বেঁকে যায়, পঠানকোট হয়ে জম্মু। আর এই আম্বালা থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে যায় চণ্ডীগড়ের দিকে। সেটাই আগে চলে যায় শিমলার দিকে। একদম ক্লিয়ার মার্কিং করা রাস্তা, অমৃতসরের জন্য এদিকে, চণ্ডীগড়ের জন্য ওদিকে। আম্বালা থেকে শিমলা দেড়শো কিলোমিটার। আরামসে হয়ে যাবে, চণ্ডীগড় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে, ওখানেই বরং বসে কিছু চা নাশতা করে নেওয়া যাবে।
কিন্তু চলার নেশা একবার পেয়ে বসলে থামতে ইচ্ছে করে না, খিদে পায় না, তেষ্টা পায় না, হিসিও পায় না। চোখের পলকে এগিয়ে গেলাম, চেনা চেনা সব নামগুলো চলে এল চোখের সামনে, জিরাকপুর, পাঁচকুল্লা। এখানে দাঁড়াবো? এখানে? না, থাক, আরও এগনো যাক।
চলে এলাম পিঞ্জোর। পিঞ্জোর মানে চণ্ডীগড়ের শেষ। পিঞ্জোর পেরোতেই চোখের সামনে দেখা দিল হিমালয়, আর হাল্কা পাহাড়ি রাস্তা শুরু হল। সুন্দর রাস্তা, রানওয়ের মত মসৃণ। চণ্ডীগড়ে এক সময়ে, বাইকটা কেন এত হাল্কা লাগছে ভেবে স্পিডোমিটারের দিকে তাকিয়ে দেখি একশো দুই কেএমপিএইচের স্পিডে চলছি, বাইক প্রায় উড়ে যেতে চাইছে। কী করে এত স্পিড বেড়ে গেল বুঝতেই পারি নি, তড়িঘড়ি নব্বইয়ের নিচে নামিয়ে আনলাম স্পিড।
যাই হোক, পাহাড়ে এত স্পিড তোলার কোনও মানেই হয় না, ধীরেসুস্থে তাই এগিয়ে চললাম, একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গোটাকয় ফটোও তুললাম মোবাইলে। আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরোই নি – যতটা সম্ভব হালকা বেরনো যায় আর কি। মাত্রই সাড়ে আটটা বাজে। শিমলা আর একশো কিলোমিটার। কিন্তু সমতলে একশো কিলোমিটার কভার করা আর পাহাড়ে সেটা করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
আরও খানিক গিয়ে দেখি পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে একটা একলা চায়ের দোকান। জায়গার নাম পরওয়ানু। ওখানেই গাড়ি থামালাম। শিমলা আর বাহাত্তর কিলোমিটার। নটা বাজতে পাঁচ।
চা খেলাম। বাড়িতে আরেকটা ফোন করে নিলাম। আধ ঘন্টা বাদে আবার চলার শুরু।
শিমলার রাস্তা অত্যন্ত সহজ, মানে, পাহাড়ে উঠছি সেটা বোঝা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তার ঢাল, ওই শহরের ফ্লাইওভারে যতটা ঢাল থাকে, ততটাই। তবে কপালে সুখ বেশিক্ষণ সইল না। রাস্তা খারাপ হতে শুরু করল। ক্রমশ খারাপ, আরও খারাপ, তার পরে আরও। উরেবাবা, ঝাঁকুনির চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত, পিঠে ঘাড়ে বেদম ব্যথা কচ্ছে এবার।
ধরমপুর আসার পরে রাস্তা একটু ভালো হল, তাও আর পরিষ্কার রাস্তা নয়, পটহোলে ভর্তি। কুমারহাটি এল। সোলান, কান্দাঘাট পেরিয়ে এল শোগি। এতক্ষণে রাস্তা একটু বেটার হয়েছে। শিমলা আর মাত্র পনেরো কিলোমিটার। এগিয়ে যাওয়াই মনস্থ করলাম। শেষ পনেরো কিলোমিটারটাই বেশ খাড়াই পেলাম, ধাঁই ধাঁই করে চড়াইতে তুলে দিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে শিমলা। ঘড়িতে তখন বাজে সোয়া এগারোটা।
বাইকের তেল শেষ হয়ে গেছে, আগে তেল ভরতে হবে, তার পরে মল-এ যাবার রাস্তা খুঁজতে হবে। মল-এ তো গাড়ি অ্যালাওড নয়, বাইক পার্কিং করতে হবে কোথাও কাছাকাছি। একে তাকে জিজ্ঞেস করে প্রথমে পেট্রল পাম্প, সেখান থেকে একটু এগোতেই মল-এ ঢোকার এন্ট্রি পেয়ে গেলাম, মানে নিচে পার্কিং, সেখানে গাড়ি রেখে হেঁইও হেঁইও করে দশ মিনিট হেঁটে মল-এ উঠতে হবে।
শিমলাতে মল বিনা দেখার কিছুই নেই, এ কথা যাঁরা শিমলা গেছেন এবং যাঁরা যান নি, তাঁরা সকলেই জানেন। ব্রিটিশ আমলের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী, সময় এখানে থমকে আছে। কবে এসেছিলাম শিমলায়? সে বোধ হয় দুহাজার ছয় সালে। মেয়ে তখন এক বছরের ছানা। দশ বছর বাদে এসেও সেই একই চেহারা, সেই চার্চ সেই লাইব্রেরি সেই পাথর বাঁধানো ব্রিটিশ স্থাপত্যের বাড়িগুলো। হাজারগণ্ডা সিনেমার শুটিং হয়ে গেছে এখানে। ব্ল্যাক, জব উই মেট, থ্রি ইডিয়েটস।
মল-এ পা রাখলাম যখন, তখন ঠিক পৌনে বারোটা বাজে। এক পিঠের জার্নি সমাপ্ত। হাল্কা ঘাড় টনটন ছাড়া আর কোনও সমস্যাই নেই। গুড – তা হলে খেয়ে দেয়ে ফেরার পথ ধরি। শিমলা বেড়াতে আসা আমার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য এই আপডাউন মিলিয়ে সাড়ে সাতশো কিলোমিটার আমি কতক্ষণে কভার করতে পারি – সেটা দেখা।
আমার জানা ছিল না শিমলার মলের নাম ইন্দিরা চক, আর আজ একত্রিশে অক্টোবর। সারা দেশ বল্লভভাই প্যাটেলের ছবিতে মুড়িয়ে ফেলা হলেও এই মলটুকুকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, বিশাল ইন্দিরামূর্তির গলায় গাঁদাফুলের মেলা, আর মল-এর ঠিক মাঝটিতে একখানা আখাম্বা জাতীয় পতাকা।
একটা আপেল জুস খেলাম, তার পরে একটা চাইনিজ ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে গাঁতিয়ে চিকেন চাউমিন খেলাম, এবং বেলা একটা পাঁচে আবার নেমে এসে বাইকে স্টার্ট দিলাম। এবার একশো কিলোমিটার ডাউনহিল, নামা শুধু, কিন্তু মাঝে অনেকখানি রাস্তা খারাপ আছে। তো, ফেরার গল্প আর আলাদা কিছু নেই, শুধু কুমারহাটি থেকে একটা চণ্ডীগড় লেখা বোর্ড মিস করে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলাম, প্রায় আট কিলোমিটার চলে গিয়ে কেমন সন্দেহ হওয়াতে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করে, আবার আট কিলোমিটার ফেরত। আবার কুমারহাটি, এইবারে চণ্ডীগড়ের সাইন দেখে সেই খারাপ রাস্তায় ফেরত।
আম্বালা পৌঁছলাম বিকেল পাঁচটায়। এবার দিনের আলো মরে আসছে। পাঁচ মিনিট জিরিয়ে নিয়ে আবার চলা শুরু। আর দুশো কিলোমিটার। এক বন্ধুর সাথে দেখা করার আছে সোনেপতে। ঠিকমত চললে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবোই। এমনিতে কোনও ফ্যাটিগ নেই শরীরে, বেশ এনজয়ও করলাম সারাটা দিন।
একে একে পেরিয়ে গেলাম কুরুক্ষেত্র, কারনাল, পানিপত। সোনেপতে পৌঁছে দেখলাম সে বন্ধু তখনও বাড়ি ফেরে নি, অতএব, ফোনেই কথা বলে ঠিক করা হল আমরা মিট করব মজনু কা টিলা তে। ওখানে অনেক ভালো টিবেটান রেস্টুরেন্ট আছে, কোনও একটায় বসে কফি খাওয়া যাবে।
এর পর? এর পর আর কিছু না – পৌনে আটটায় মজনু কা টিলা, খানিক কফি আর মনমাতানো স্যান্ডুইচ খেয়ে গুলতানি মেরে আটটা চল্লিশে ওঠা, আর ঠিক নটা দশে বাড়ির দরজায়। টোটাল রাইডিং হল সাতশো চল্লিশ কিলোমিটার। সময় লাগল সাড়ে চোদ্দ ঘণ্টা। মন্দ নয়।
এর পরে বড় জার্নির প্রস্তুতি। এই টেনাসিটিটুকু ধরে রাখতে পারলে – মার্চ মাসে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটা ইয়াব্বড়োসড়ো সর্ষে।