বসন্ত এসে গেছে …

গল্পটা ঠিক গুরমেহরকে নিয়ে শুরু হয় নি। শুরু হয়েছে তার দুদিন আগে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামজাস কলেজে দুদিনব্যাপী ডিবেটের অনুষ্ঠান ছিল, বিষয় ছিল প্রতিবাদের সংস্কৃতি। তো, সেই ডিবেটের দ্বিতীয় দিনে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার, উমর খালিদ।

এই অবধি পড়েই নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নিয়েছেন কেন অচল সিকি আবার এক বছর বাদে বসে গেছে মন কি বাত লিখতে? বিচ্ছিন্নতাবাদী, রাষ্ট্রবিরোধী, আফজল গুরুর সমর্থক, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” বলে স্লোগান দেওয়া “ভামপন্থী” উমর খালিদকে সেদিন বলতে না দেওয়ায় সিকি নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ব্যথিত? নিশ্চয়ই ফ্রিডম অফ স্পীচ নিয়ে সাতকাণ্ড লিখতে বসেছে আজ?

নাঃ, সেই রকমের ব্যথা পাবার মত কিছু হয় নি। তেমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আজ লিখতে বসি নি। বিজেপি যে আদর্শে দীক্ষিত রাজনৈতিক দল, তাদের জাতীয়তাবাদের ধারাপাত মহারাষ্ট্রের একটি বিশেষ শহরে যে দলটি দ্বারা রচিত হয়, তাদেরই ছাত্র সংগঠন এবিভিপি যে এর চেয়ে কোনও উন্নত প্রক্রিয়ায় ভিন্নস্বরকে চুপ করিয়ে দিতে শেখে নি, সে আমরা আজ থেকে নয়, অনেক অনেক আগে থেকে জেনে এসেছি। এর চেয়ে উন্নত শিক্ষা এদের নেই, তাই এ বিষয়ে বিশেষ কিছু না বলাই ভালো। মুশকিল হয়ে গেল মাঝখান থেকে গুরমেহর কৌরের একটি ছোট পোস্টার হাতে ছবি বাজারে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায়। এবিভিপির সুশিক্ষিত ছাত্রদের হাতে মার খেয়ে তখন দিল্লি ইউনিভার্সিটির একাধিক ছাত্রছাত্রী জখম, একজন অধ্যাপককে মাটিতে ফেলে পেটে লাথি মারা হয়েছে, তিনি এখন স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, ইন্টারনাল ইনজুরি নিয়ে – বেশ একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে ফেলা গেছে, আর কোনও শালা এই শুওরের বাচ্চা কমিউনিস্ট দেশদ্রোহীদের রামজাস কলেজে দ্বিতীয়বার আনার কথা ভুলেও ভাববে না, সেই সময়ে কিনা – মাত্র কুড়ি বছর বয়স্ক একটা মেয়ে হাতে একটা পোস্টার নিয়ে ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল – যাতে লেখা, এবিভিপি, আমি তোমাদের ভয় পাই না, আমি একা নই – সারা ভারতের ছাত্রছাত্রী আমার সাথে আছে? ভাবা যায়?

মানে, এবিভিপি বা আরএসএস – এমনিতেই অত্যধিক মাত্রায় ফিউডাল মনোবৃত্তির দল, মনুবাদকে মাথায় নিয়ে চলে, এদের দলের মেয়েরাও আদর্শ ভারতীয় নারীর সংস্কৃতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেন, যার পরিণতি হিসেবে আমরা পাই ইয়েল কলেজ থেকে পাশ করে মন্ত্রী হওয়া দুর্গাভক্ত শ্রীমতি স্মৃতি ইরানী জাতীয় রুচিশীল সংস্কৃতিবান মহিলাদের, সেখানে একটি কচি খুকি, হুট্‌ করে বলে বসল কিনা, নট অ্যাফ্রেড অফ এবিভিপি? এমনি কোনও মেয়ে বললে হয় তো ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনির নিচে  চাপা পড়িয়ে দেওয়া যেত আওয়াজটা, কিন্তু এই মেয়েটি আবার এমনি যে-সে মেয়ে নয় – রীতিমত শহিদের বেটি। এর বাবা, মনদীপ সিং ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের শহীদ। ও, ও, সরি, সরি, মাপ করবেন, ভারত সরকার “শহীদ” শব্দটি সরকারিভাবে গ্রাহ্য করে না। মৃত সৈন্য মনদীপ সিং।

ভাবছেন, ইয়ার্কি মারছি? আজ্ঞে না, ইয়ার্কি নয়, খাঁটি সত্যি কথা। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনির কোনও কর্মী, কোনও রকমের অ্যাকশনে যদি মারা যান, তাঁকে সরকারের তরফ থেকে “শহীদ” আখ্যা দেবার কোনও অবকাশই নেই – মাত্র তিন মাস আগে লোকসভায় দাঁড়িয়ে এই তথ্যটি দিয়েছেন, আর কেউ নয়, স্বয়ং গৃহরাজ্যমন্ত্রী কিরেন রিজিজু।

The ministry of defence has informed that the word ‘martyr’ is not used in reference to any of the casualties in Indian armed forces. Similarly, no such term is used in reference to the central armed police forces and Assam Rifles personnel who are killed in action or on any operation.

৬ই ডিসেম্বর, ২০১৬, লোকসভায় দাঁড়িয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এই বক্তব্য রাখেন মাননীয় মন্ত্রী শ্রী কিরেন রিজিজু, যা লোকসভার রেকর্ডে রাখা রয়েছে। তো, সেই হিসেবে কারগিল যুদ্ধে “মৃত” সৈনিক মনদীপের কন্যা গুরমেহরের এই বয়ান ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে ন্যাশনালিজমের ঠিকাদারদের, কারণ এতদিন অবিসংবাদিতভাবে তারা নিজেরাই মনে করত সেনাবাহিনির গর্ব আর দেশের সম্মান রক্ষা করার একমাত্র হর্তাকর্তাবিধাতা, ন্যাশনালিজমের দেশব্যাপী একমাত্র ঠিকাদার, সেখানে একজন মৃত সৈনিকের মেয়ে কিনা, দেখা যাচ্ছে, আরেকটা ভিডিও দিয়ে রেখেছে সোশাল নেটওয়ার্কে – যাতে সে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে দেখাচ্ছে, তাতে লেখা অনেক কিছু, তার মধ্যে লেখা ইংরেজিতে ন’টি শব্দ – বাংলা করলে দাঁড়ায়, পাকিস্তান আমার বাবাকে মারে নি। মেরেছে যুদ্ধ।

আর যায় কোথায়! কলেজ ক্যাম্পাসে এবিভিপির নিজেদের জাতীয়তাবাদী লজ্জা নিবারণের একমাত্র ডুমুরপত্র ছিল এই “ভারতীয় সেনা, শহীদ হবার জন্য বর্ডারে দাঁড়িয়ে রাত জাগছে” রেটোরিক, সেইটাও কিনা ছিনিয়ে নিয়ে গেল জালন্ধরের এক তরুণী, তাও আশপাশের রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের মরসুমে? অতএব, নামিয়ে দাও নিজেদের পুষে রাখা আইটি সেল, যারা ইদানিং “আইএসআই” স্বীকৃতি পেয়েছে – জানেন নিশ্চয়ই? এ আইএসআই ভারতীয় মানক ব্যুরো নয়, পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সাথে যোগসাজস পাওয়া গেছে বিজেপির আইটি সেলের কর্মীদের, পরপর ধরা পড়েছে তারা।

ভিডিওটি নতুন নয়। এটি প্রথম ফেসবুকে দেওয়া হয় গত বছর এপ্রিল মাসে, Voice of Ram পেজ থেকে, যেটি চালায় রাম সুব্রহ্মনিয়ম নামে এক যুবক। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তার পেজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির বার্তার আদানপ্রদান করা। সেই পিসকিপিং প্রসেসের মধ্যে দিয়েই এসেছিল গুরমেহরের এই ভিডিওটি। আমি যে হেতু শুরু থেকেই এই পেজটির ফলোয়ার, তাই ভিডিওটি তখনই আমার চোখে পড়েছিল, দেখেছিলাম, শেয়ার করেছিলাম নিজের ফেসবুক ওয়ালে, ভালো লেগেছিল বেশ। একটা মেয়ে তার নিজের জীবনদর্শনের পরিবর্তনের কথা বলছে নীরবে, যা কিনা অনেকটা আমারও মনের কথা। গত বছর মন কি বাত বাড়তি পর্বে আমি হুবহু এক কথাই লিখেছিলাম, দেশ কি মারে? দেশ মারে না। যে আতঙ্কবাদ, উগ্রপন্থার দোষে দোষী বানানো হচ্ছে পাকিস্তানকে, সেই উগ্রপন্থার বলি কি তারা নিজেরা নয়? কম রক্ত ঝরে সে দেশে? নেহাত দেশটার নাম পাকিস্তান, তাই ফেসবুকে “মার্কড সেফ” খেলা জমে ওঠে না, “জে সুইস করাচী” ট্যাগলাইনে ভরে ওঠে না ফেসবুকের প্রোফাইল। মারে কিছু স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদরা, তাদের বীরত্ব দেখানোর তাগিদে, দেশের মধ্যে “জাতীয়তাবাদ”এর সুড়সুড়ি দিয়ে দেশের লোককে ক্ষেপিয়ে তোলার তাগিদে। সেনসেশন তৈরি করা হয় দেশভক্তির নামে, দু দেশেই, ঘৃণা ম্যানুফ্যাকচার করা হয়, তার পরিণতি হিসেবে এক দিক মদত দেয় উগ্রপন্থায়, অন্যদিক বছর বছর তার সামরিক অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে চলে। যুদ্ধ হলেও সেনা মরে, যুদ্ধ না হলেও মরে। দু দিকেই।

সে কথা থাক। হচ্ছিল গুরমেহরের কথা। প্রায় ছ মাস আগের একটি ভিডিও, যাতে উনিশ বছুরে তরুণীটি বলছে, দু বছর বয়েসে বাবাকে হারিয়েছি, বাবা কী জিনিস জানতে পারি নি। খুব রাগ হত, পাকিস্তান আমার বাবাকে মেরেছে – মনে করতাম। আমার যখন ছ বছর বয়েস, একটা ছুরি নিয়ে এক বোরখা পরা মহিলাকে মারতে গেছিলাম, মনে করেছিলাম আমার বাবার মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী। তার পরে মা আমাকে বোঝায়। এখন বুঝি, পাকিস্তান মারে নি আমার বাবাকে, মেরেছে যুদ্ধ। চাইলে এই সমস্ত যুদ্ধ এড়ানো যেত, এড়ানো যায়। আমি এখন তাই শান্তির পক্ষে কথা বলি। যদি শত্রুতা ভুলে আমেরিকা আর জাপান বন্ধু হতে পারে, দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত স্মৃতি ভুলে গিয়ে জার্মানি আর ফ্রান্স বন্ধু হতে পারে, তা হলে আমরা কেন পারব না?

কেউ বিশেষ দ্যাখে নি। জাতীয়তাবাদী ভক্তের দলের চোখ এড়িয়ে গেছিল এই ভিডিওটা। কোনও শোরগোল ওঠে নি তখন, অথচ, “অ্যান্টিন্যাশনাল” শব্দটাকে কয়েন করে তখন দিল্লি সমেত গোটা দেশ উত্তাল। বেশ কয়েক মাস আগে ছাড়া পেয়েছে কানহাইয়া, উমর খালিদ, অনির্বাণ, তাদের বিরুদ্ধে সিডিশনের একটি চার্জও প্রমাণ করা যায় নি, তাতেও ভক্তদের হুঙ্কার থামানো যায় নি, এদিকে উরিতে তখন ঘটে গেছে সন্ত্রাসবাদী হামলা, কাশ্মীরে নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে মারা গেছে বুরহান ওয়ানি, মাত্র দেড় মাস আগে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো ছিল।

কিন্তু গুরমেহরকে কেউ চিনত না তখন। সমস্ত ফোকাস তখনও ছিল জেএনইউয়ের দিকে, তাই কে গুরমেহর, কী উদ্দেশ্যে তার ভিডিও বানানো হয়েছে, কেউই খোঁজ রাখে নি। আমি নিজেও ভুলে গেছিলাম নামটা। মনে পড়ল যখন এই কদিন আগে, টানা তিনদিন সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরে আমি আবার নেট কানেকশনের জগতে ফিরে এসে পুরনো ফেসবুকের স্টেটাস পড়তে শুরু করলাম, ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি। ততদিনে এবিভিপি তাদের অতিপ্রিয় মনুস্মৃতির বাতলানো পথে মেয়েটিকে “ঠোস জওয়াব” দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। শুনলাম গ্রাফিক চিত্রসহ তার কাছে মেসেজ গেছে, কী ভাবে তাকে রেপ করা হবে। এত বড় সাহস, যে তার শহীদ বাবা শুধু নয়, দেশের যাবতীয় আর্মি জওয়ানদের অপমান করে? বলে কিনা এবিভিপিকে ভয় করে না, এবিভিপির বিরুদ্ধে কথা বলে? ততদিনে ভক্তের দল খুঁজে পেয়ে গেছে সেই ছ’মাসের পুরনো ভিডিও, তার আগেপিছের কোনও কথা নিয়ে তো ট্রোল করা চলে না, তাই বেছে নেওয়া হল ন’টি শব্দ, পাকিস্তান ডিড নট কিল মাই ড্যাড, ওয়ার কিলড হিম। ট্রোলের বন্যা বয়ে গেছে, “রসিক” হিসেবে টুইটারে খ্যাত ক্রিকেটার বীরেন্দ্র সেহওয়াগ তাঁর রসবোধের পরিচয় দিয়ে দিয়েছেন টুইটারে, সেটিকে রসিকতা মনে করে শেয়ার করে ফেলেছেন আর এক বলিউডের অভিনেতা। কিরেন রিজিজু বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তখন, মেয়েটির মন কে বিষাক্ত করল, শালা লেফটিস্টগুলো করেছে নিশ্চয়ই, নইলে কেন বীর শহীদ সেনানীদের এই মেয়েটি অপমান করবে? লক্ষ্য করুন, সেই কিরেন রিজিজু, যিনি তিন মাস আগেই লোকসভায় দাঁড়িয়ে অন রেকর্ড বলেছেন, “শহীদ” শব্দটি মৃত ভারতীয় সেনাদের ক্ষেত্রে ভারত সরকার অনুমোদন করে না।

আক্রমণের লক্ষ্য যখন একটি মেয়ে, তখন তো আক্রমণ করা অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়। খানকি মাগী বল্‌, ওর শরীরের বাঁকের বিশদ বর্ণনা দে, জড়িয়ে দে ওর নাম র‍্যান্ডম কোনও একটা ছেলের সাথে, তা সে যে বয়েসের হোক না কেন, ধর্ষণের হুমকি দে, এতে যা সুখ পাওয়া যায়, সে সুখ তো অন্য কিছুতে মেলে না।

গুরমেহর আজ পরিচিত মুখ, চাপে পড়ে গুরমেহরের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয়েছে দিল্লি পুলিশ, তার পরেও সে দিল্লি ছেড়ে আপাতত চলে গেছে পঞ্জাবে নিজের বাড়িতে।

আমরা, যারা তত-পরিচিত-নই সাধারণ মানুষরা, যারা একই রকম ভাবে সোশাল নেটওয়ার্ক সাইটে বিচরণ করি, তাদের সুরক্ষার ভার কে নেয়?

গুরমেহরের খুব কাছাকাছি ধরণের একটা ঘটনা ঘটে গেল আমারই পরিচিত সার্কলে। দু বছর আগে এক ব্যক্তি রামকৃষ্ণ-সারদামণি-বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সম্ভাব্য যৌনজীবন নিয়ে একটা পোস্ট করেছিল ফেসবুকের একটা ক্লোজড গ্রুপে। যদিও ঠিক মুখরোচক কেচ্ছা বানানোর উদ্দেশ্যে সেটা সে লেখে নি, বরং সেই ধরণের কিছু লেখাপত্তর নিয়ে বাজারে ইতিমধ্যেই দু তিনটে বই আছে, কিন্তু ভক্ত তো ভক্ত। পূজ্য ভগবানের যৌনজীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া তাঁরা মেনে নেবেন কেন? এই কলকাতা শহরেই অনেকদিন আগে বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয়র শয়ে হয়ে কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, কারণ সেখানে সেই সপ্তাহের বিষয় ছিল নেতাজির বিয়ে এবং এমিলিয়া শেঙ্কলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থেকে পরিণয়ের কাহিনি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, যিনি নাকি মরেন নাই, ঘরেও ফেরেন নাই, তিনি বিবাহ করিতে পারেন, এইটা হজম করবার মত পাচনশক্তি তখনকার ভক্তদের ছিল না। নেতাজি যেমন বিয়ে করতে পারেন না, তেমনি লেনিনের নিতম্ব থাকতে পারে না (কোনও এক সিনেমায় লেনিনের চরিত্রটির পেছনদিক নগ্ন অবস্থায় দেখানো হয়েছিল, তাতে লেনিনভক্তরা খচে গেছিল বেদম), রামকৃষ্ণ বা সারদামণিরও যৌনজীবন থাকতে পারে না।

কিন্তু কেউ যদি ভুল করে লিখে ফেলে সেই সব নিয়ে? নব্বইয়ের দশকে কাগজ পোড়ানো হয়েছিল, কিন্তু এখন তো সোশাল মিডিয়ার যুগ। হরদম সেখানে বসছে ক্যাঙারু কোর্ট, নেমিং অ্যান্ড শেমিংএর আসর, আর কোনও পুরনোই এখানে পুরনো হয় না। কোনও এক ভক্তের চোখে পড়ে সেই দু বছর আগের পোস্টটি, তিনি সেটির স্ক্রিনশট নিয়ে হিংস্রভাবে শেয়ার করতে শুরু করেন, এবং এক দিনের মধ্যে শুধু ফেসবুক নয়, আরও বিভিন্ন সোশাল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মে সেই স্ক্রিনশট ভাইরাল করে দেওয়া হয়। ফলে, বিভিন্ন ধরণের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ভক্তের দল ছেলেটির মুণ্ডু চাইতে শুরু করে, কেউ অতি সাবধানে তার বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর খুঁজতে শুরু করে, এবং আক্রমণের লক্ষ্য অচিরে খুঁজে নেয় সম্ভাব্য মহিলা টার্গেটদের। তার স্ত্রী, তার মা, তার বোনকে নিয়ে মুখরোচক যৌনগন্ধী কমেন্ট চারদিকে ছড়াতে তো শুরু করেই, ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছিলাম, এ সমস্তকিছুই হয় প্রথমে গণহারে রিপোর্ট করে তার প্রোফাইল সাময়িকভাবে ডিঅ্যাক্টিভেট করানোর পরে, যখন ছেলেটির নিজের তরফে ডিফেন্ড করবার মত কোনও প্ল্যাটফর্মই আর নেই। এর পরে আক্রমণ শুরু হয় যে গ্রুপে দু বছর আগে কমেন্টটি পোস্ট হয়েছিল, সেই গ্রুপের সঞ্চালিকার ওপর। যেহেতু তিনি লিঙ্গচিহ্নে মেয়ে, অতএব, আক্রমণের পদ্ধতিটা স্বাভাবিকভাবেই সহজ হয়ে যায়। রেপ থ্রেট থেকে শুরু করে এমন সুন্দর পানু ছড়া বানিয়ে বাজারে ছাড়া হয়, যাতে আরো আরো বেশিমাত্রার লোক মজা লুটতে পারে। ভার্চুয়ালি একটা মেয়েকে যতরকম ভাবে বুলি করা সম্ভব, সবই করা হল। আর এইসব ছড়া-কবিতা, কোনও অর্ধশিক্ষিত গোঁয়ারগোবিন্দের লেখা নয়, রীতিমত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির যৌথ রচনার ফসল।

ভক্তি, অন্ধই হয়। যে জিনিস তর্কের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে, এমনকি দরকার হলে শালীন বাদানুবাদের মাধ্যমেও নিষ্পত্তি করে ফেলা যায়, ভক্তেরা সেখানে ব্যবহার করে লাঠি, ইঁট, বেল্ট, আর ভার্চুয়াল ট্রোল ব্রিগেড। ছোট করে বলতে গেলে, ভায়োলেন্স। আলোচনায় লাগে যুক্তির প্রয়োগ, ভক্তি তো যুক্তির পথে হাঁটে না।

এমন কি, এ নিয়ে সরব হবার পরে এ-ও শোনা গেছে, ইঁট ছুঁড়লে তো ভাই পাটকেল খেতেই হবে। অমন নোংরা একটা জিনিস লিখলে তো ব্যাকল্যাশের জন্য তৈরি থাকতেই হবে। ভক্তদের সেন্টিমেন্টকে আক্রমণও করবে, তারপরে পালটা গালাগাল বা রেপ থ্রেট বা ডেথ থ্রেট খেলে বা তোমার নামে পানু ছড়া লিখে শেয়ার করলে তুমি আঁচল আঙুলে পাকিয়ে নাকে কাঁদবে, দুটো তো একসাথে চলে না বাপু!

তাই হবে হয় তো। বাক্‌স্বাধীনতা, ফ্রিডম অফ স্পীচ বলে একটা শব্দবন্ধ আছে বলে জানি, কিন্তু কোনখানে, কতদূরে তার সীমারেখা, কখন সেটা বাক্‌স্বাধীনতা আর কখন সেটা অ্যাবিউজ, কে তা নির্ধারণ করবে? মানুষের ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির ওপরেই সেসব নির্ভর করে বলে জানি, তবে আজকালকার দিনে বিচারবুদ্ধিরও এত বেশিমাত্রার ভ্যারিয়েশন দেখা যায়, মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে অবাক হতেও ভুলে যাই।

ছেলেটির লেখাটি আপত্তিকর ছিল, মেনে নিলাম। সে যা লিখেছিল, সেটা রামকৃষ্ণ-সারদামণি-বিবেকানন্দ ভক্তদের আহত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, এবং সেটার প্রতিবাদ প্রতিবাদের ভাষাতেই করা যেতে পারত। ইন ফ্যাক্ট, ছেলেটি পরে জানিয়েছিল, সে কেন লিখেছিল সেই লেখাটি – ফেসবুকের সেই গ্রুপে কিছু উগ্র সদস্য মহম্মদকে নিয়ে যৌনগন্ধী কটূক্তি করে চলেছিল। এই ছেলেটি তাতে আপত্তি জানালেও তাতে লাভ হয় নি, ছেলেটি তাতে জানায় যে এতে মুসলমানদের সরাসরি অনুভূতিতে আঘাত হানা হচ্ছে। তাতেও সেই মহম্মদ-ব্যাশিং তো কমেই না, বরং চলতে থাকে। তাদের একটা শিক্ষা দেবার জন্য ছেলেটি তখন এই লেখাটি লেখে, রামকৃষ্ণ-সারদামণিকে নিয়ে, এইটা বোঝাবার জন্য যে তাদের সম্মাননীয়, আরাধ্য কাউকে নিয়ে কটূক্তি করলে সেটা কতটা আঘাত হানতে পারে অনুভূতিতে। এবং, আবারও, লেখাটি কাল্পনিক কিছু ছিল না, বাজারচলতি দু তিনটি বইয়ে এই নিয়ে বিস্তারিত চর্চাও আছে। বইগুলি খোলাবাজারেই কিনতে পাওয়া যায়।

কিন্তু ভক্তরা তো ক্রিটিসিজম পড়েন না – তাঁরা ভক্তিমার্গেই বিচরণ করেন। অতএব, যা হবার তাই হল। প্রথমে ছেলেটির বলার প্ল্যাটফর্ম কেড়ে নেওয়া হল, তারপরে শুরু হল তার পরিবারের লোকজনকে জুড়ে স্ল্যান্ডারিং, এর পরে লেখাটি “পোস্ট হতে দেওয়ার” অপরাধে সঞ্চালিকার নামে সিরিজের পর সিরিজ আদিরসাত্মক চুটকি, ছড়া। কে না জানে, এই পদ্ধতিতে একটা মেয়েকে যত সহজে “কাত” করে দেওয়া যায়, যে অনির্বচনীয় ধর্ষকাম মর্ষকাম অনুভূত হয়, তেমনটি আর কোনও কিছুতে হয় না!

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দিল্লি পুলিশও নেই, আর কিরেন রিজিজু বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালও বাংলা পড়েন বলে শুনি নি – ফলে এ রকম হাজার হাজার সাইবার বুলিয়িংএর ঘটনা ঘটে যেতেই থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে।


যাক গে। হচ্ছিল গুরমেহরের কথা, আর ছাত্রদের প্রোটেস্ট মার্চের কথা। আমি তখন একলা বেরিয়ে পড়েছিলাম আমার বাইক নিয়ে, বরফের দেশে। ফেরার পথে, ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি, যখন ফোনের নেটওয়ার্ক পেলাম, জানলাম কী কী হয়ে গেছে রামজস কলেজে, জানলাম কী কী ভাবে ছ’মাসের পুরনো পোস্ট তুলে এনে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে গুরমেহরকে, এমনকি এর পরেও নিজেদের দেশভক্তির প্রমাণ দেখাতে এক মেগা সাইজের জাতীয় পতাকা মাথার ওপর বিছিয়ে ধরে এবিভিপি এক প্রস্থ মিছিলও করে ফেলেছে ইউনিভার্সিটির নর্থ ক্যাম্পাসে। এবিভিপির হাতে আক্রান্ত শিক্ষক, প্রশান্ত চক্রবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁর শরীরের ভেতরে ক্ষত তৈরি হয়েছে ছাত্রদের লাথি খেয়ে। প্রতিবাদে দিল্লি ইউনিভার্সিটির সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা পথে নামবে ২৮শে ফেব্রুয়ারি। জমায়েত হবে এসজিটিবি খালসা কলেজের সামনে।

আমি বাড়ি পৌঁছবো ২৭ তারিখ রাতে। একদিন বাড়তি ছুটিও রয়েছে হাতে। অতএব, যেতেই হবে।

সাড়ে বারোটায় ছিল জমায়েতের সময়, তাও পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে দুটো বেজেই গেল। বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোবার পরে পরেই পুলিশের আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মত। ছাত্র মার্গ, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ক্যাম্পাসের মুখ্য এন্ট্রান্স, সেখানে প্রতিটা মোড়ে মোড়ে মোটা মোটা ভেস্ট পরা দিল্লি পুলিশ, সমস্ত রাস্তা ব্যারিকেড দেওয়া, কোনও গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, অবশ্য পায়ে হেঁটে চলে যাওয়াই যাচ্ছে। চারদিকে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের ভিড়, অভিমুখ এক দিকেই।

পরিচিত যে জনের থেকে মিছিলের খবর পেয়েছিলাম, তাকে ফোন করে জানলাম খালসা কলেজ থেকে মিছিল এগিয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে তারা আছে রামজস কলেজের সামনে।

রামজস পর্যন্তও এগোতে হল না, দেখা হয়ে গেল মিছিলের সঙ্গে। সে এক দৃশ্য বটে, দেখামাত্র বঙ্কিম হয়ে বলতে ইচ্ছে করে – এ যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবে কে? হাজারে হাজারে ছাত্রছাত্রী একজোট হয়ে স্লোগান দিচ্ছে, এবিভিপি গো ব্যাক, গো ব্যাক গো ব্যাক। খানিক এগোতেই পরের ঝাঁকের মুখে হইহই করে এই মরশুমের নতুন স্লোগান – আরে এবিভিপি, কাহে so creepy? দিল্লির ছাত্রছাত্রীদের মিছিলের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেটা সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মিছিলে দেখা যায় না – সেটা হচ্ছে ডফলি। এক একটা ঝাঁক একটা ডফলি নিয়ে তাতে তাল তোলে, আর সেই তালে তালে চলতে থাকে স্লোগান। তার সাথে চলে হাততালি। হাতের তালে তালে কয়েক হাজার তরুণ তরুণীর একটা সমুদ্র তখন ছাত্র মার্গে আছড়াচ্ছে, গর্জাচ্ছে। তারই মাঝে অন্যরকমের তাল, কান পেতে শুনলাম সেই ঝাঁকে কোরাস চলছে – দেখনা কিতনা তাকত আজ বাজু-এ-কাত্‌ল মেঁ হ্যায়, সরফরোশি কি তমন্না অব্‌ হমারি দিল মে হ্যায়।

16903530_1652772121422693_3636591896552502701_o16904730_1652768394756399_7112854522454520551_o17039271_1652766561423249_7359795930558125832_o17097545_1652766368089935_550580542141239379_o

দুদিন আগে এই রাস্তা দিয়েই লম্বা একটা জাতীয় পতাকা নিয়ে এবিভিপির মিছিল বেরিয়েছিল, নিজেদের ন্যাশনালিজম প্রমাণ করতে। কতজন ছিল সেই মিছিলে? জানি না, আমি ছিলাম না সেদিন, তবে আজকের ভিড়ের সাথে নিশ্চয় তুলনীয় নয় সেই মিছিল। আজ ধারেকাছে নেই কোনও এবিভিপির ছাত্র? …

রাস্তা জুড়ে মিছিল চলেছে, দুপাশে মোটা দড়ি নিয়ে কর্ডন করে সাথে সাথে চলেছে দিল্লি পুলিশের দল, আমি ছিলাম বাঁদিকের ফুটপাথে, সেখানে অন্যান্য সাধারণ মানুষজনের সাথে আমিও ছিলাম, পাশ থেকে মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও তুলছিলাম, হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার পেছনদিক থেকে গুটিকয় ছেলে বেশ আবেগের সঙ্গে স্লোগান লাগাচ্ছে, বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়।

স্লোগানটা আমি একা শুনতে পাই নি, আমার পাশ দিয়ে মিছিলের যে অংশটা চলে যাচ্ছিল, তারাও শুনতে পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তালির রিদমটা জোরদার হয়ে গেল – আরে এবিভিপি, কাহে সো ক্রিপি? আরে এবিভিপি, কাহে সো ক্রিপি?

ভারতমাতার সন্তানেরা একেবারে ফুস্‌ হয়ে গেল। মিছিল এগোতে থাকল, আমরা ঢুকলাম আর্টস ফ্যাকাল্টির চত্ত্বরে। সেখানে তখন মেলা বসে গেছে। হাজারে হাজারে ছাত্রছাত্রী। মাথা গুণে শেষ করা যাচ্ছে না। চত্বরের মাঝে বিবেকানন্দের মূর্তির নিচে তখন চলছে বক্তৃতা। বক্তব্য রাখছেন যাঁরা, তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না, তার মধ্যে একজনকে চিনলাম, তিনি দিল্লি ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর (DUTA) প্রেসিডেন্ট নন্দিতা নারায়ণ। হাসতে হাসতে বলছিলেন, এই এবিভিপির ছাত্ররা, এরাও তো আমার ছাত্রই, সন্তানতুল্য, বলতে বাধ্য হচ্ছি, এদের ইম্যাজিনেশন পাওয়ার বড় কম। এরা দেশপ্রেমী আর দেশদ্রোহীর বাইরে কিছুই বোঝে না, যে কোনও বিষয় নিয়ে এদের সামনে আনলে এরা সেটাকে এই দুভাবেই বিচার করার চেষ্টা করে, এর বাইরে এরা কিছুই বোঝে না, বুঝতে চায় না।

আরেকটি ছেলে, বোধ হয় আইসা বা অন্য কোনও দলের সম্পাদক, সুন্দর মার্জিত বক্তব্যে জানিয়ে গেল তার প্রতিবাদ, বার বার বলল, ওরা মারপিটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু আমরা মারপিটে যাবো না, আমরা ওদের বার বার আলোচনায় ডাকব, ওরা আমাদের আলোচনায় অংশ নিতে বাধা দিলেও আমরা ওদের আলোচনায় অংশ নিতে ডাকব। আর সবার আগে আমরা সব্বাই মিলে ওদের জানিয়ে দেব, এবিভিপি, যতই গায়ে হাত তোলো, আমরা তোমাদের ভ-য় পা-ই না। মুহূর্তে কয়েক হাজার জনতার ঠোঁট নড়ে উঠল একসাথে –

নহী ডর কিসি কা আজ
নহী ডর কিসি কা আজ
নহী ডর কিসি কা আজ, এক দিন –
ও হো, মন মে হ্যায় বিশ্বাস
পুরা হ্যায় বিশ্বাস,
হম হোঙ্গে কামিয়াব, এক দিন।

16992364_1652766044756634_5156682050176221134_o17017218_1652765368090035_8103446190333572263_o17022396_1652764621423443_4118441705020958047_n17038929_1652765721423333_2889974754832949979_o17039302_1652772841422621_2281966092396312144_o17039346_1652764708090101_3110529327795023215_o

আস্তে আস্তে কিছু চেনা মুখের দেখা পাচ্ছি এবারে। শুদ্ধব্রতদার সাথে আগে ফোনে কথা হয়েছে, ভার্চুয়ালি আমরা যুক্ত, সামনাসামনি আলাপ হয় নি কখনও, আজ ছোট করে আলাপচারিতাটা সেরে নিলাম। সামনে দেখলাম শেহলা এসেছে, কানহাইয়া এসেছে, উমর খালিদকে দেখতে পেলাম না যদিও, বিবেকানন্দ মূর্তির নিচে তখন বক্তৃতা শুরু করেছেন যোগেন্দ্র যাদব। এই মানুষটি যখন কথা বলেন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়।

কী বললেন উনি? আমি আর কী বলব? নিজেই শুনে নিন।

এর পরে বললেন ডি রাজা, সীতারাম ইয়েচুরি, সমস্ত তো শোনার সময় হয়ে উঠল না – শেহলার বক্তৃতাও শোনার ইচ্ছে ছিল, শুনে আসা গেল না – আমার ফেরার সময় হয়ে এল, আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলাম। ভিড় তখন ছড়িয়ে গেছে আর্টস ফ্যাকাল্টির চত্বরে। বেশির ভাগ জনতাই তখনও বক্তৃতা শুনছে, কিন্তু ইতিউতি ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসে গান ধরেছে –

অ্যায় শ্‌শালা –
আভি আভি
হুয়া য়কীঁ,
কী আগ হ্যায়
মুঝ মে কহিঁ
হুয়ি সুবহ্‌, ম্যায় জল্‌ গয়া
সুরজ কো ম্যায় নিগল গয়া
রু-ব-রু রোশনি …

আরেক দল তখন রঙীন চক বিলি করছে ছেলেমেয়েদের মধ্যে, আর ছেলেমেয়েরা তাদের মনের কথা উজাড় করে লিখছে চত্বরের মেঝেতে। আর খুশিতে মাথা নাড়াচ্ছে রঙীন ফুলের দল।

17038877_1652769488089623_5512714481122677469_o17016957_1652770658089506_547527839468000833_o17015990_1652767214756517_5289586613417768966_o16992331_1652766984756540_7067544858312894429_o16992195_1652772408089331_1358755626003278237_o

ফিরে আসার পরে খবর পেলাম, জমায়েত ভাঙার পরে আইসার দুজন ছাত্রকে গেটের বাইরে একলা পেয়ে বেদম পিটিয়েছে এবিভিপির দুই কীর্তিমান। প্রশান্ত আর বিনায়ক। পুলিশের সামনেই। পুলিশ অবশ্য হস্তক্ষেপ করায় বেঁচে যায় ছেলেদুটি। এবিভিপির এই দুই গুণ্ডাকে পুলিশ আপাতত গ্রেফতার করেছে, আর নিজেদের মুখ বাঁচাতে এবিভিপি তাদের পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করেছে আজ।

দিনের শেষে, এমন একটা ঢেউয়ের সাক্ষী হতে পেরে নিজেরই খুব ভালো লাগছিল। আমি নিজেই গুণগুণিয়ে গান গাইছিলাম, আমার খুব প্রিয় গান –

স্লোগান দিতে গিয়ে, আমি ভিড়ে গেলাম গানে,
গলায় তেমন সুর খেলে না,
হোক বেসুরো পর্দা বদল,
তবুও আমি সবার সাথে মিলিয়ে দিলেম গলা –
ঘুচিয়ে দিয়ে একলষেঁড়ে চলা।
জুটলো যত আমার মত
ঘরের খেয়ে বনের ধারে মোষ তাড়ানোর উল্টো স্বভাব
মোষ তাড়ানো সহজ নাকি?
মোষের শিংয়ে মৃত্যু বাঁধা
তবুও কারা লাল নিশানে
উশ্‌কে তাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে
                      স্লোগান।


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.