তেইশে ফেব্রুয়ারি, দিন ১
চারটেয় অ্যালার্ম বাজল, ঘুম থেকে উঠলাম, তৈরিও হয়ে গেলাম। এ বছর ঠাণ্ডা একটু তাড়াতাড়িই চলে গেছে দিল্লি থেকে, সোয়েটারের বিশেষ দরকার আর হচ্ছে না। তবুও, ভোররাতের হাওয়ার থেকে বাঁচতে কিছু তো গায়ে চাপাতেই হয়।
লাগেজ সবশুদ্ধ তিনটি। ভায়াটেরার স্যাডল ব্যাগ, রাইনক্সের ট্যাঙ্ক ব্যাগ আর পিঠে আরেকটি ব্যাগ, তাতে ভরা স্লিপিং ব্যাগটা। খানিক জায়গাও খালি রয়েছে, পরে বেলা বাড়লে জ্যাকেট ছেড়ে ঢোকাতে হবে।
দেড় বছর আগে লাস্ট বাঁধাছাঁদা করেছিলাম, এইবারে পার্কিংয়ে গিয়ে স্যাডল ব্যাগকে বাইকের পেছনে নতুন করে বাঁধতে গিয়ে বুঝলাম, প্রায় পুরো পদ্ধতিটাই ভুলে গিয়েছি। তাও, যতটা যা মনে আসে, সেই মত করে সব বেঁধেছেঁদে নিলাম। এবার আর আমি অত নভিস নই, সাথে প্লেনটি অফ বান্জি কর্ড রয়েছে, তাই দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে লাগেজ বাঁধলাম।
ট্যাঙ্ক ব্যাগ লাগানোটা একটা বিভীষিকা বিশেষ। সামনের বেল্টটা বাইকের মুণ্ডুর তলা দিয়ে একটা সরু জায়গা দিয়ে ঘুরিয়ে এনে বাঁধতে হয়, সে প্রায় চারবারের চেষ্টায় পেরে উঠলাম, এর থেকে ছুঁচে সুতো পরানো সহজ। সমস্ত বাঁধাছাঁদা শেষ করে যখন গাড়িতে স্টার্ট দিতে পারলাম, ঘড়িতে তখন বাজে পাঁচটা চল্লিশ, ভোর হবো-হবো করছে। আগের বারের থেকে পাক্কা এক ঘণ্টা লেট।
ঠিক হ্যায়, আগের বারে শিমলা পৌঁছেছিলাম বেলা সাড়ে এগারোটায়, এবার না হয় পৌঁছব সাড়ে বারোটায়, তাতেও খুব অসুবিধে হবার কথা নয়। জিওরি ওখান থেকে দেড়শো কিলোমিটার। বিকেল চারটে না হলে, পাঁচটাতেই না হয় পৌঁছবো, যদি ঠিকঠাক চলতে পারি।
জিওরি – ইংরেজিতে বানানটা Jeory হলেও হিন্দিতে জায়গাটার নাম লেখা হয় জ্যুরি। এখানে হিমাচল প্রদেশ পিডাব্লিউডি-র রেস্ট হাউস বুক করে রাখা আছে। হিমাচলের জায়গায় জায়গায় পিডাব্লুডির রেস্ট হাউস বানিয়ে রাখা রয়েছে, এবং যে কেউ আগে থেকে ফোন করে বুকিং করে সেখানে গিয়ে থাকতে পারে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বড়সড় কামরাওলা রেস্ট হাউস সমস্ত। … কিন্তু জিওরি কেন বুক করলাম আমি? আগে পিছে অনেক জায়গাই তো ছিল – নারকণ্ডার পরে রামপুর (পুরো নাম রামপুর বুশহর) একটা বেশ বড়সড় টাউন, সেখানে থাকার অনেক অপশন আছে, জিওরি সেই রামপুর থেকেও তেইশ কিলোমিটার আগে।
দুটো কারণ – এক, যতটা সম্ভব এগিয়ে থাকা, আর দুই, এদিক ওদিক দু চারটে ট্র্যাভেলগ পড়ে জিওরির পিডাব্লুডি রেস্ট হাউসের সম্বন্ধে বেশ পজিটিভ ফীডব্যাক পেয়েছিলাম, আর মাস্টারজিও যে প্ল্যান বানিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে উনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিলেন জিওরিতে থাকার কথা, তাই আর বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে জিওরিতেই বুক করে নিয়েছিলাম। এতই সহজ বুকিং, ফোন করলাম, বললাম, অমুক দিনে থাকব, – তো অন্যপ্রান্তের ভদ্রলোকটি বললেন, ঠীক হ্যায়, আপ আ জাইয়ে। আমি নিজেই উপযাচক হয়ে বললাম, আমি সঙ্গে আইডেন্টিটি প্রুফ হিসেবে আধার কার্ড দেখাবো, উনি বললেন, কোনও দরকার নেই, আপনি এসে নাম বললেই হবে।
তো, আজকের গন্তব্য জিওরি। পৌনে ছটায় বাইকে স্টার্ট দিয়ে সেই চেনা রাস্তায় গিয়ে পড়লাম – গাজীপুর, হসনপুর, গীতা কলোনী। এই পর্যন্ত এসে মনে হল আবার কিছু ঝাম হচ্ছে আমার পেছনে, আমার বসার জায়গাটা কেমন যেন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বাইক থামিয়ে নেমে দেখলাম – যা ভেবেছি তাই, স্যাডল ব্যাগ বাঁধা ঠিক হয় নি, সামনের দিকে সরে এসে আমার বসার জায়গা খেয়ে নিয়েছে, আর ডানদিকে হেলেও গেছে খানিক, বিলকুল সেই সতীশ শাহের মৃতদেহর মতন।
অগত্যা, সমস্ত বান্জি কর্ড খুলে আরেকবার কষে ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দিতে হল। আরও খানিক সময় নষ্ট হল, তবে এইবারে মনে হল বাঁধন বেশ পোক্ত হয়েছে। সত্যিই, সেদিন আর সারাদিনে লাগেজ নিয়ে কোনও ঝামেলা হয় নি। বাইকে আবার স্টার্ট দিলাম, এবং হাওয়ার গতিতে পেরিয়ে যেতে লাগলাম লালকেল্লা, কাশ্মীরি গেট, মজনু কা টিলা, মুকারবা চক, আলিপুর। সোনেপত থেকে হরিয়ানার শুরু, সেখানে ঢোকার আগে দিল্লির শেষ পেট্রল পাম্প থেকে বাইকের ট্যাঙ্ক ফুল করে নিলাম, তার পরে দুশো কিলোমিটার একটা ঘ্যানঘ্যানে জার্নি – আম্বালা পর্যন্ত।
নটার সময়ে আম্বালা পৌঁছলাম, আগের বারের থেকে এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট লেটে। এর পরে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে চণ্ডীগড়। দু মিনিট বিশ্রাম, বাড়িতে সিকিনীকে ফোন করে স্টেটাস আপডেট, এবং আবার বাইকে স্টার্ট।
চণ্ডীগড়ের শুরুতে জিরাকপুরে আছে আমার অফিসের সেই পাঞ্জাব-দা-পুত্তর কথিত বুলেট ক্যাফে – সে বলে রেখেছিল আমি যেন ঐখানে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করি, অনেক কষ্টে খুঁজেপেতে সেই জায়গায় গিয়ে তো পৌঁছলাম, কিন্তু বুলেট ক্যাফে আর খুঁজে পাই না, জিপিএস বলছে সে এখানেই, সামনে গলির মধ্যে, কিন্তু সামনে তো কোনও গলিই নেই। অগত্যা সেই ছেলেটিকে ফোন লাগালাম। সকাল দশটা, ব্রাহ্মমুহূর্ত – সে বেচারা তখন ঘুমোচ্ছিল, বলল, দাঁড়াও, আমি ফোন লাগাচ্ছি, ও এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
দাঁড়ালাম। পাঁচ মিনিট বাদে ফোন এল – ওর এক রিশতেদারের মা মারা গেছেন, ও গেছে লুধিয়ানা, আজ ক্যাফে খুলবে না, ভেরি সরি পা-জি, আপ কঁহি অওর ব্রেকফাস্ট কর লো।
কী বিরক্তিকর রে বাবা। অলরেডি গুচ্ছখানেক ধাবা পেরিয়ে এসেছি, আর তেমন ভালো ধাবাও নেই সামনে, সেটা জানি, তাও এগোই – যা পাওয়া যাবে – খিদে পেয়েছে বেশ জোরদার।
চণ্ডীগড় পেরিয়ে পিঞ্জোর। এখান থেকে বাঁদিকে বেরিয়ে গেছে পিঞ্জোরের রাস্তা, আর সোজা চলে গেছে শিমলা। শিমলা এখান থেকে ঠিক আর নব্বই কিলোমিটার। সেই জাংশনে একটি রোডসাইড রেস্টুরেন্ট পেলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে অগামারা ছোলে ভাটুরে আর কফি খাইয়ে একশো ষাট টাকা নিয়ে নিল। তখনই ঘড়িতে বাজে বারোটা। যখন আমার শিমলায় পৌঁছে যাবার কথা। … যাক গে, দেরি হয়েছে তো হয়েছে। বিকেলের জায়গায় না হয় সন্ধ্যেতেই পৌঁছব।
তা, শিমলা ঢুকলাম তখন বাজে বেলা দেড়টা। নিশ্চিন্ত রাস্তা, এদিক ওদিক হবার চান্স নেই, সাধারণ ট্রাফিক। শিমলায় লাঞ্চ করে নেওয়া উচিত, কিন্তু আমি সকালের খাবারটাই খেয়ে উঠেছি বেলা বারোটায়, অতএব আজ লাঞ্চ স্কিপ করে ফেলাই যায়, কিন্তু আগে বাইকটাকে খাওয়াতে হবে। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দৌড়ে ফেলেছে, পেট্রল তলানি। কিন্তু শিমলা শহরে মলএর ঠিক নিচেই যে পেট্রল পাম্পখানি, তাতে আজ পেট্রল নেই। কেলো করেছে। এখানে তো আর কোনও পেট্রল পাম্প আছে বলেও জানি না। দু একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল, চিন্তার কিছু নেই, নারকণ্ডার রাস্তাতেই অনেক পেট্রল পাম্প পড়বে, হুই যে সামনে টানেলটা দেখছো – ওটা পেরোলেই ঢাল্লি, ঢাল্লিতে দেখবে পর পর তিন চারখানা পেট্রল পাম্প, এই এখান থেকে তিন কিলোমিটার মত হবে।
ঢাল্লি পৌঁছে সত্যিই দেখলাম পর পর পেট্রল পাম্প। এটাই বোধ হয় শিমলার পেট্রল ভরার হাব, কারণ শিমলা শহরে তো আর পেট্রল পাম্প খোলার জায়গা নেই। বাইকের ট্যাঙ্ক ফুল করে নিলাম, আবার আগামী চারশো কিলোমিটারের জন্য নিশ্চিন্ত। এখান থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে নারকন্ডা, সেখান থেকে আরও নব্বই কিলোমিটার দূরে জিওরি – মাত্রই দেড়শো কিলোমিটার দূরে।
ঢাল্লি থেকে একটু এগোলেই কুফরি, সারি দিয়ে চাউমিনের দোকান আর চমরি গাই নিয়ে টুরিস্টের আশায় দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় মানুষজন, অল্পবিস্তর ভিড়ও আছে। বেশির ভাগ গাড়ির নম্বরই দিল্লি ইউপি হরিয়ানা পঞ্জাব। দেখতে দেখতে নারকন্ডা পৌঁছে গেলাম, ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে তিনটে।
নারকন্ডা শিমলা থেকে একটু ওপরের দিকে, সেখান থেকে পুরো একটা চুলের কাঁটার মত বাঁক নিয়ে রাস্তাটা আবার নিচের দিকে নামছে – রামপুরের দিকে। বাঁকটা নিতেই মনটা একেবারে গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেল – রাস্তার ধারে চাপ চাপ বরফ জমে আছে – তাই ভাবি, একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল কেন। সক্কাল সক্কাল দিল্লি থেকে বেরিয়ে দুপুরেই বরফদর্শন, হোক না কাদানোংরা মাখা কেল্টেপানা বরফ, তাও একটা ছোট স্টপ তো মাংতাই হ্যায়।
ছোট একটা ব্রেক নিয়ে আবার এগনো শুরু করলাম। এখান থেকে রাস্তা শুধুই ডাউনহিল গেছে। গড়াতে গড়াতে একদম বিকেলের শেষে গোধূলিলগ্নে রামপুরে পৌঁছলাম। জিওরি আর তেইশ কিলোমিটার। যে নম্বরে ফোন করে বুকিং করেছিলাম, সেখানে আরেকবার ফোন করে জেনে নিলাম, জিওরি পৌঁছে পিডাব্লুডির গেস্টহাউস কী করে চিনব। তো, অন্যপ্রান্তের ভদ্রলোক বললেন – ওখান থেকে সারাহানের জন্য রাস্তা উঠে যাচ্ছে ওপরে, সেই রাস্তায় একটু গেলেই পিডাব্লুডির রেস্টহাউস, জিওরিতে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।
তা দিল। সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় জিওরি পৌঁছে গেস্টহাউসটা খুঁজে বের করতে সময় লাগল ঠিক কুড়ি মিনিট। অন্ধকারে গেটটা বুঝতে না পেরে আমি বেশি ওপরে উঠে গেছিলাম, আবার আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে নেমে আসতেই গেটটা দেখতে পেয়ে গেলাম।
কেয়ারটেকার এক বৃদ্ধ সর্দারজি, ঠেঁট পঞ্জাবী ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন না। নাম বলতেও হল না, দিল্লি সে আ রহা হুঁ বলতেই – হাঞ্জি হাঞ্জি এক রুম রাক্খিয়াসি টাইপের কিছু বলে আমাকে তালা খুলে ঢুকিয়ে দিলেন এক ঢাউস রুমের ভেতর, ভেতরে অন্তত গোটাতিনেক টেবিল টেনিস বোর্ড পাশাপাশি রাখার জায়গা হয়ে যায়। ইয়া উঁচু সিলিং, ছাদ থেকে প্রায় মেঝে ছোঁয়া জানলা, স্বচ্ছ কাঁচ, তাতে মোটা পর্দা লাগানো। বাথরুমও অনুরূপ, মাইনাস পর্দা। মানে, সেখানেও একটা ঢাউস জানলা, তাতে ঝকঝকে কাঁচ লাগানো, কিন্তু পর্দা টর্দা নেই। মানে বাইরে থেকে বাথরুমের ভেতরটা পুরোটাই দৃশ্যমান।
কেলো করেছে। এ বাথরুম ইউজ করব কী করে? এদিকে তোয়ালেও দেয় নি। আবার দৌড়লাম সর্দারজির কাছে। খানিক ঘ্যানঘ্যান করার পরে একটা তোলায়ে পেলাম, সেইটা জানলার পাল্লায় ঝুলিয়ে খানিক ঢাকাঢুকি হল, তারপরে বাথরুম ইউজ করা গেল।
চান করে বেরোতেই আবার সর্দারজির মুখোমুখি – ডিনার করোগে তুস্সি? হ্যাঁ করব, অবশ্যই করব। সারাদিনে বিশেষ কিছু খাওয়া হয় নি, লেট ব্রেকফাস্ট ছাড়া। কী পাওয়া যাবে?
চাওল, রোট্টি, সবজি, দাল।
মানে, ভ্যাজ। তাই সই। বললাম, হয়ে গেলেই ডেকে নিও, আমি খেয়ে ঘুমোব।
তা ডাকলেন, নটা নাগাদ। গিয়ে তো খাবার দেখে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলার জোগাড়! কী বলব কালীদা, ভ্যাজ সবজিতে অনেক কিছু আছে, কেবল আলু নেই। বীন, বরবটি, গাজর, মটরশুঁটি এইসব দিয়ে বানানো একটা সবজি। … চোখকান বুজে চারখানা রুটি আর দুমুঠো ভাত তাই দিয়ে খেয়ে ফেললাম। আমার স্বল্পাহার দেখে সর্দারজি যারপরনাই বিরক্ত হলেন, কিন্তু কী করব, তখন তো আর আলু চাওয়া যায় না, আর চাইলেও যে রাত সোয়া নটায় জিওরিতে আলু পাওয়া যাবে, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই।
জীবনসন্ধিকে ফোন করলাম, ওরা বেরিয়ে পড়েছে ঠিক সময়েই চণ্ডীগড় থেকে, তখন নারকন্ডা পেরোচ্ছে, আমাকে বলল, পাঁচজনের টিম আসছে, রাত এগারোটার মধ্যে রামপুরে পোঁছে ওখানেই থেকে যাবে। পরদিন সকালে জিওরি এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে নেবে।
সবকিছু প্ল্যানমাফিকই চলছে। অনেকদিন বাদে সোয়া পাঁচশো কিলোমিটার একটানা চালিয়ে গায়ে কাঁধে অল্প অল্প ব্যথা।
শুয়ে পড়লাম, এবং শোয়ামাত্র ঘুম।
3 thoughts on “বরফ ঢাকা স্পিতি – দ্বিতীয় পর্ব”