দিল্লি ইউনিভার্সিটির শান্তিকামী ছাত্রী গুরমেহর কৌরের ওপর কুৎসিত অনলাইন আক্রমণ চালিয়েছিল বিজেপি এবং এবিভিপির পয়সা দিয়ে পোষা ট্রোলের দল। উপর্যুপরি আঘাতের অভিঘাত সইতে না পেরে গুরমেহর চলে গিয়েছিল সবার চোখের আড়ালে, কিছুদিনের জন্য। আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরছে। সম্প্রতি সে একটি ব্লগ শুরু করেছে – বলেছে প্রতি সপ্তাহে সে সেখানে লিখবে তার নিজের কথা, তার শান্তির সন্ধানে অভিযানের কথা।
গুরমেহরের অনুমতিক্রমে তার প্রতিটি ব্লগ-পোস্টের বাংলা অনুবাদ থাকবে এবার থেকে, আমার ব্লগে। ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া দরকার চারদিকে, বিভিন্ন ভাষায় – আমি মনে করি। আমি শুধু বাংলা ভাষার দায়িত্বটুকু নিতে পারি।
আমি কে?
এমন একটা প্রশ্ন, যার উত্তর, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও আমি বিন্দুমাত্র ভাবনাচিন্তা না করে আমার স্বভাবসিদ্ধ খুশিয়াল গলায় দিয়ে ফেলতে পারতাম। এখন, আমি অতটা আর নিশ্চিত নই।
আমি কি সেই রকম, ট্রোলেরা যেমন্টা আমাকে মনে করে?
মিডিয়া আমাকে যেভাবে দেখায়, আমি কি সে-ই?
সেলিব্রিটিরা আমাকে যা মনে করে, আমি কি তাই?
না, আমি তার কোনওটাই নই। যে মেয়েটাকে আপনারা সক্কলে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন, হাতে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে, ভুরু তুলে ছোট্ট একটা সেলফোনের ক্যামেরার দিকে চেয়ে থাকা মেয়েটা – এক্কেবারে আমার মতই দেখতে। তার চিন্তার চিন্তার যে তীব্রতা সেই ছবিতে ধরা পড়েছিল, তার মধ্যে অবশ্যই আমাকে কিছুটা খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে রাগী মনে হচ্ছিল, আমি সেটা খানিকটা ধরতে পারি কিন্তু তার পরে “ব্রেকিং নিউজ হেডলাইনস” উপস্থাপিত করল একটা সম্পূর্ণ আলাদা গল্প। সেই হেডলাইনে আমি ছিলাম না।
মার্টির্স ডটার
শহীদকন্যা
শহীদের মেয়ে
আমি আমার বাবার মেয়ে। আমি আমার পাপার গুলগুল। আমি তার আদরের পুতুল। আমি একটা দু বছরের বাচ্চা আর্টিস্ট যে শব্দের মানে বুঝত না কিন্তু তাকে লেখা চিঠিতে লম্বা লম্বা আঁচড়গুলো বুঝতে পারত। আমি আমার মায়ের মাথাব্যথার কারণ – তাঁর সবজান্তা, দুরন্ত, খামখেয়ালি বাচ্চা – আসলে তাঁরই প্রতিচ্ছবি। আমি আমার বোনের গাইড যে তাকে পপ কালচার শেখায় আর বড় বড় ম্যাচের সময়ে তার সাথে মারপিট করে। আমি আসলে সেই মেয়ে যে কলেজে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে, আসলে অধ্যাপকদের লেকচার থামিয়ে আগুনঝরা বিতর্ক শুরু করবার জন্য – যে কোনও বিষয়ের ওপর। সাহিত্যের পাঠ এর চেয়ে বেশি মজাদার আর কিছুতে হয় না। খানিকটা-কিছুটা আমার বন্ধুদের বন্ধু আমি, হয় তো। ওরা বলে আমার চুটকিগুলো বড় কাঠখোট্টা যদিও কখনও কখনও তা কাজে লেগে যায় (আমি তা মেনেও নিয়েছি)। বই আর কবিতা আমার একাকীত্বের আশ্রয়।
আমি এক বইপোকা, আমার ঘরের লাইব্রেরিতে বই রাখার আর জায়গা হয় না, আর গত কয়েক মাস ধরে আমার মাথাব্যথার কারণ হল – মা-কে কীভাবে রাজি করাব তাঁর ল্যাম্প আর ছবির ফ্রেমগুলো সরাতে, যাতে আমি সেখানে আরও একটা শেলফ জুড়তে পারি।
আমি আদর্শবাদী। আমি অ্যাথলিট। আমি শান্তিকামী। তোমরা আমাকে যেমনটি ভেবেছো, আমি তেমন রাগী, প্রতিশোধকামী যুদ্ধ-প্রেমী বেচারী মেয়ে নই। আমি যুদ্ধ চাই না কারণ আমি তার মূল্য জানি; অসীম তার মূল্য। বিশ্বাস করো, আমি এটা বেশি ভালো করে জানি কারণ এর দাম আমি দিয়েছি, প্রতিদিন। আজও দিই। কোনও রসিদ নেই, কে বলতে পারে; যদি থাকত, তা হলে হয় তো কেউ কেউ আমাকে এতটা ঘেন্না করত না। সংখ্যাগুলো হয় তো মূল্যটাকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলত।
নিউজ চ্যানেলে চিৎকৃত “পোল” হয়ঃ “ইজ গুরমেহর’স পেইন রাইট অর রঙ?“, একটা আপাতসাধারণ ভোটের অনুপাত ফলাফল হিসেবে আমজনতার কাছে বেশি অর্থ বয়ে আনে।
আর এই যে! এর সামনে আমাদের কষ্টের মূল্য কতটুকু? যদি ৫১% লোক মনে করে আমি ভুল, তা হলে আমি অবশ্যই ভুল। সেক্ষেত্রে, ভগবানই জানেন কে আমার মনকে দূষিত করছে।
পাপা আজ আর আমাদের সাথে নেই; আজ আঠেরো বছর ধরে তিনি নেই। ৬ই আগস্ট, ১৯৯৯ সালের পর থেকে আমার মাত্র ২০০ শব্দের সীমিত ভোক্যাবুলারিতে মৃত্যু, যুদ্ধ, পাকিস্তান – এই শব্দগুলো ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে। কেন এই শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থগুলো বুঝতে আমার আরও কয়েক বছর লেগেছিল, তা তো সহজবোধ্য। আমি “অন্তর্নিহিত” বলছি, কারণ, সত্যি বলতে গেলে, কেউই কি জানে, এগুলোর প্রকৃত অর্থ কী? আমি এগুলোকে সাথে নিয়ে বাঁচি আর দুনিয়ার বোধগম্যতার নিরিখে আমি এগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করে চলেছি, আজও।
আমার বাবা একজন শহীদ, কিন্তু আমি তাঁকে ঠিক সেইভাবে চিনি না। আমি চিনি একটা মানুষকে যার বড়সড় কার্গোর পকেটে সবসময়ে ভর্তি থাকত মিষ্টি লজেন্স, আমার কপালে চুমু খেতে গেলেই যার খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো আমার নাক ঘষে দিত, আমি চিনি একজন শিক্ষককে যে আমাকে স্ট্র ধরে চুমুক দিতে শিখিয়েছিল আর চিউয়িং গাম চিনিয়েছিল। আমি সেই মানুষটাকে চিনি আমার বাবা হিসেবে। আমি তাকে চিনি একটা কাঁধ হিসেবে, ছোট্ট আমি যেটা শক্ত করে ধরে ঝুলতাম আর ভাবতাম, আরও শক্ত করে ধরলে বোধ হয় সে চলে যেতে পারবে না। কিন্তু মানুষটা চলে গেল। গেল তো গেল, আর ফিরল না।
আমার বাবা একজন শহীদ। আমি তাঁর মেয়ে।
কিন্তু।
আমি তোমাদের “শহীদ-কন্যা” নই।