শব্দেরা ভিড় করে আসছে, দিনে, রাতে, ঘুমের মধ্যে, তাদের লিখে ওঠার মত নীরবতা পাচ্ছি না। কাজ আর কাজ ছিনিয়ে নিচ্ছে দিনের বেশির ভাগ সময়। শব্দেরা জমছে মাথার মধ্যে, বুকের ভেতরে, ধমনী, ফুসফুস, শিরায়। অনেক কিছু লেখার আছে, লিখব হয় তো একদিন। স্বল্প সময়ে আজ যেটুকু পারি, অন্যেরা যে চিন্তাগুলো ছড়াচ্ছেন, সেই চিন্তাটুকু শেয়ার করার চেষ্টা করি।
আউটলুকের প্রাক্তন এডিটর, কৃষ্ণ প্রসাদ গতকাল (সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৭) একটি লেখা শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তাঁর অনুমতি নিয়ে আমি লেখাটার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম। বন্ধু বোধিসত্ত্ব মাইতিকে বিশেষ ধন্যবাদ, অনুমতি জোগাড় করে দেবার জন্য।
গৌরী লঙ্কেশ খুব নিয়মিত ফোন করতেন না। কিন্তু যেদিন করতেন, বেশ রাতের দিকে করতেন আর সহজে ছাড়তেন না।
কথা বলতেন, যে সমস্ত লড়াই তিনি লড়ে চলেছেন – মনের মধ্যে কিংবা ম্যাগাজিনের পাতায়, সেই সব নিয়ে। আর সেই লড়াইগুলোর জন্য যে দাম তাঁকে দিতে হচ্ছে, সেসব নিয়ে বলতেন।
এ বছরের ১৮ই এপ্রিল, উনি যখন ফোন করলেন, বড় বিপর্যস্ত লাগছিল ওঁর কণ্ঠ। কথায় কথায় উনি স্বীকার করলেন, ডিমানিটাইজেশন তাঁর ব্যবসাকে তছনছ করে দিয়েছে।
তাঁর কাছে আর বড়জোর এক মাস টেনেটুনে চালাবার মত পয়সা আছে, জানালেন।
“য়েনু মাদোধু, মুন্ধাক্কে য়েনু দারি?”
“য়াভাগা বাদালাগাত্থে, য়েনারু গোত্থা-পা?”
(কী করি বলো তো? এর পরে কী করা যায়? কবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলতে পারো?)
তাঁর নামকরা, বিজ্ঞাপনমুক্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পূর্ণভাবে নিউজস্ট্যান্ডের বিক্রির ওপর নির্ভরশীল ছিল। নামকরা অন্যান্য ইংরেজি পত্রিকাগুলো যেমন বার্ষিক, ৩ বছর বা ৫ বছরের সাবস্ক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে তাদের নিয়মিত লাভের পথ সুনিশ্চিত করত, তেমন কোনও স্কিমই তাঁর পত্রিকার জন্য ছিল না।
নরেন্দ্র মোদীর সার্জিকাল স্ট্রাইকের খাঁড়া আম ভারতবাসীর পকেটের ওপর এসে পড়েছিল ৮ই নভেম্বর তারিখে, যার ফলে গৌরীর পত্রিকার পাঠকরাও, যাঁরা তথাকথিত উচ্চবিত্ত গোত্রের ছিলেন না এবং ধীরে ধীরে যাঁদের সংখ্যা কমে আসছিল, তাঁরাও পত্রিকার জন্য পয়সা খরচা করতে ক্রমশ অনীহা বোধ করছিলেন।
কিন্তু ডিমানিটাইজেশনের পরে তিনি শুধুমাত্র আর পত্রিকার ওপর নির্ভর করে দিন চালাতে পারেন নি। তিনি পরীক্ষার গাইডবুক পাবলিশ করতেন, বেশির ভাগই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে।
এই বইগুলো, সাধারণত তাঁর ট্যাবলয়েডের থেকে অনেক বেশি অঙ্কে প্রচ্ছদমূল্য ছাপিয়ে বিক্রি হত, যাতে লাভ বেশি হয়, আইএনএস গৌরী যাতে তাতে নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারে।
লাভ না হলে, এই যুদ্ধজাহাজ হয় তো কবেই ডুবে যেত।
আমি উপদেশ দিয়েছিলাম, গো ডিজিটাল ইত্যাদি, তার পরে আমি পত্রিকা প্রকাশনার অর্থনীতি বোঝা কয়েকজন সিইও-র সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম, যাঁরা এই টালটামাল সময়ে কীভাবে পত্রিকা চালিয়ে যেতে হয় সে ব্যাপারে কিছু অমূল্য উপদেশ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’ এর পরেও পাঁচ মাস চলেছে।
আর গৌরী লঙ্কেশ?
*****
এইসব গল্পগাছা আমি এখানে লিখছি, স্রেফ চারটে জিনিস আপনাদের বোঝাবার জন্যে, যে যে বিষয়গুলো তাঁর মৃত্যুর পরেঃ কারেকশন, তাঁর নিজের বাড়ির দালানে তাঁর পরিকল্পিত খুনের পরে – কথার পিঠে কথার ভিড়ে সম্পূর্ণ ডুবে গেছে।
একঃ যে অসম লড়াই এই সামান্য একলা মহিলাটি লড়ে গেছেন, সম্পূর্ণ নিজে নিজে এবং সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। ‘আই অ্যাম গৌরী’ শুনলে মনে হয় রূপকথার মত এক জাজ্বল্যমান অকুতোভয় জার্নালিস্টের সমস্ত অন্যায়কে হারিয়ে দিয়ে জিতে আসার গল্প, বাস্তবটা কিন্তু সেরকম ছিল না, অন্তত শেষের দিকে।
দুইঃ আত্মম্ভরিতায় পূর্ণ মূলধারার মিডিয়াগুলোর কেঁদো কেঁদো মালিকদের দাবি – যে ট্যাবলয়েডগুলো আসলে “রোল-কল”, পয়সা না দিলেই বন্ধ করে দেওয়া যায়, আর তাদের এডিটর আর জার্নালিস্টরা আদতে তোলাবাজি চালায় – সে সমস্ত প্রকাশিত হয়েছে।
তিনঃ কোনও “নক্সাল সিমপ্যাথাইজারস”, “পীসনিকস”, “জেএনইউ প্রিকস”, “র্যাডিকালস”-এরই কোনওরকমের অন্তহীন বিদেশী মূলধনের জোগান নেই এবং তাঁরা কেউই বিলাস বৈভবে ভরা জীবন কাটান না। জীবনের শেষ সময়টিতে তিনি টয়োটার ভারতে বিক্রি হওয়া সবথেকে শস্তার গাড়িটি থেকে নেমেছিলেন।
চারঃ শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত, তাঁর পরিস্থিতি, বিশেষত তাঁর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে যাকে তিনি সবরকম দিক থেকে অপছন্দ আর ঘৃণা করতেন।
তাঁর পরিবারের সঙ্গে কর্ণাটকের বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরিচিতি ছিল, বিশেষত কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। এই অবস্থায় পত্রিকা চালানোর জন্য মূলধন জোগাড় করা তাঁর পক্ষে খুব কঠিন কাজ কিছু ছিল না, কিন্তু গৌরীর সাথে আমার ফোনে কথোপকথন থেকে এটা পরিষ্কার যে তিনি কখনওই সে রাস্তায় হাঁটেন নি।
বেঙ্গালুরুতে তাঁর শেষকৃত্যের সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর মিডিয়া অ্যাডভাইসর দীনেশ আমিন মাত্তু জানিয়েছিলেন, তিনি শুনেছেন গৌরী তাঁর শেষ লাইফ ইনশিওরেন্স পলিসিটুকুও সারেন্ডার করে দিয়েছিলেন দিনের খাবারটুকু জোগাড় করার জন্য।
মাইসোরে একটি শোকসভায়, তিরিশ বছর ধরে লঙ্কেশ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা স্বামী আনন্দ জানিয়েছিলেন, তিনি ইংরেজি প্রকাশনায় লিখতেন কেবলমাত্র কন্নড় জার্নালিজমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য টাকার জোগাড় করতে।
আরেকজন কেউ জানিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে তাঁর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সম্ভবত কয়েক হাজারের বেশি নয়।
হয় তো তাইই হবে, স্বাধীনতার পরে এ দেশে নেওয়া এত ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ধাক্কায় অসহায়ভাবে মার খেয়েছেন কৃষক, তাঁতী, ছোট দোকানদার, দিনমজুর – কারা নয়!
‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকা’র কাহিনি শুনলে জানা যায় তার অস্তিত্ব কী মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল জার্নালিজমের ওপর – বিশেষত ছোট নিউজপেপার, যেগুলো স্থানীয় ভাষায় প্রকাশিত হত, তাদের ওপর।
এবং সেই সমস্ত সংস্থা যাঁরা চালাতেন এবং সেখানে কাজ করতেন, জানা যায় তাঁদের দুঃখ দুর্দশার কথা।
এবং অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক বিতর্কের পরিসরের কথা।
একমাত্র সান্ত্বনার জায়গা এই যে, যে জানোয়ারগুলো তাঁর শরীরে বুলেট ফুঁড়ে দিয়েছিল, তারা, আরবিআই যখন #DemonetisationDisaster ট্যাগটিকে অফিশিয়াল সীলমোহর দেয়, তখন, সেদিন, গৌরীর আত্মপ্রসাদের হাসি তারা মুছে দিতে পারে নি।
****
এক চক্রাকার আবর্তের মধ্যে দিয়ে, হয় তো সেটাই তাঁর শেষ অবদান হয়ে থাকবে জার্নালিজম পেশার কাছে, গৌরী লঙ্কেশ চিরভাস্বর হয়ে আলো দেখাবেন আধুনিক ভারতীয় জার্নালিজমকে।
প্রতিবাদ মিছিলের এবং সভার কভারেজ দেখে একজন সাধারণ দর্শক বা পাঠক হয় তো ভাবছেনঃ
কী করে, একজন সামান্য, অশ্রুত, আর্থিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত কন্নড় ট্যাবলয়েডের সম্পাদক, এই রকম ভাবে কাউকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা শেষমেশ লোক পাঠাল তাঁকে শেষ করে দেবার জন্য, যাতে উনি আর কোনও পরবর্তী কাজ শুরু না করতে পারেন?
উল্টোদিকে, এই হাঙরে ভরা সমুদ্রের মাঝে বাকি বড় বড় মিডিয়া হাউসগুলো কী করে আরামসে সাঁতরে চলেছে কোনওরকমের ক্ষতির আশঙ্কা না করে, যে ক্ষতি শোচনীয়ভাবে আক্রমণ করেছে গৌরী এবং ‘প্যাট্রিক’কে?
এবং ল্যুটিয়েন্স ডেলহির মাঝখানে মূলধারার মিডিয়াদের সমাবেশে দাঁড়িয়ে, অনলাইনে আর অফলাইনে তাদের কথা শুনে তরুণ সাংবাদিকরা হয় তো ভাবতে পারেনঃ
আমরা কেন স্বাধীনভাবে সেই সমস্ত স্টোরি কভার করতে পারছি না – অসাম্যের, বৈষম্যের, অবিচারের, দুর্নীতির, সাম্প্রদায়িক পোলারাইজেশনের স্টোরি – আর এইখানে এইসব বক্তারা এখন গৌরী লঙ্কেশের সম্বন্ধে বক্তৃতা ঝাড়ছে?
আমেরিকান জার্নালিস্ট ডেভিড হ্যালবারস্ট্যাম একবার একটা বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, জার্নালিজম বন্ধু বানাবার আর প্রশংসা কুড়োবার জায়গা নয়। যদি তোমার সেগুলোই লক্ষ্য হয়, অন্য কোনও পেশা বেছে নাও।
ভারতীয় মিডিয়ার সিংহভাগই আজ বালিতে মাথা গুঁজে রেখে সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত প্রতিযোগিতার লেলিহান আগুনকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে করে চলে, আর সেই ফাঁকে ড্রাগনেরা এসে ঘৃণা আর ধর্মান্ধতার বীজ বুনে দিয়ে যায় আমাদের মননের ভেতরে। সবার ভূমিকা বদলে গেছে।
শুধুমাত্র গৌরীরই হয় তো অন্য কোথাও পৌঁছবার ছিল।
****
১৯৮৪র নভেম্বর মাসে ইংলন্ডের ক্রিকেট টিম টেস্ট সিরিজ খেলতে ভারতে এসেছিল।
তার ঠিক কদিন আগেই ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেহরক্ষীদের গুলিতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
বম্বের ব্রিটিশ হাইকমিশনার, পার্সি নরিস, যিনি ইংলিশ টিমের জন্য একটা অভ্যর্থনাসভার আয়োজন করেছিলেন প্রথম টেস্টের আগে, তিনি খেলা শুরুর প্রথম দিনেই আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
তাঁর স্মৃতিচারণায়, ফক্সি, ইংলন্ডের ওপেনিং ব্যাটসম্যান গ্রিম ফাউলার লিখেছিলেন সেই খবর শোনার পরে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচে তাঁর ব্যাট করতে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা।
“স্টেডিয়ামে তখন ৫৫,০০০ লোক, তাদের যে কারুর পকেটে একটা রিভলবার থাকতেই পারে।”
আজকের দিনে জার্নালিজম ঠিক সেই রকমের অবস্থায়।
সংশোধন করে বলি। দৃঢ়চেতা, সাহসী নিউজ জার্নালিজম – যা ক্ষমতার সত্য রূপ তুলে ধরে, যা ধর্মান্ধতার চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায়, যা ঘৃণার বেসাতিদের চিবিয়ে খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে, যা দুর্নীতিবাজদের এক্সপোজ করে, অসৎ, সাম্প্রদায়িকদের জনসমক্ষে নগ্ন করে দেয় – সেই জার্নালিজম আজ ঠিক সেই রকমের অবস্থায়।
তুমি জানো না, দরজা খোলার পরেই কে তোমার বুকে পর পর বুলেট ফুঁড়ে ঢুকিয়ে দিতে পারে।
অথবা, ঠিক কখন।
ফাউলার সেদিন ২৮ রান করতে পেরেছিলেন।
গৌরী লঙ্কেশের ভাগ্য অনেক ভালো, তিনি ৫৫ ছুঁতে পেরেছিলেন।
****
গত নভেম্বরে, গৌরি আমাকে মেসেজ করেছিলেনঃ “তোমার দলে ভিড়লাম। ‘ব্যাঙ্গালোর মিরর’এর এডিটর আমার কলাম বন্ধ করে দিয়েছেন।”
আমি উত্তরে যখন আমার সান্ত্বনাবাক্য লিখে পাঠালাম, গৌরীর উত্তর এলঃ “ধুর বাল। আমরা টিকে থাকবই আর এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক জীবগুলোকে পিষে মারবই।”
থাকব কি, গৌরী?
গৌরী লঙ্কেশরা একদিন পিষে মারবেই সাম্প্রদায়িকতাকে – এ আমার স্থির বিশ্বাস
LikeLike