দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ২

প্রথম পর্বের পর

আপনারা রান্না করতে ভালোবাসেন তো? এটা তো মানেন যে শুধু রান্নার প্রসেসটা ধরলে সেটা খুব লম্বা সময় ধরে চলে না, ঝটপটই হয়ে যায়। আসল সময়টা লাগে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করতে। এই মশলা, সেই সবজি আনো রে, ছুরি বঁটি বাটি হাতা, হাঁড়ি না প্রেসার কুকার, সে কত ব্যাখ্যান। দারচিনি আছে তো ছোট এলাচ নেই, জাফরান আনতে বলেছিলেম, ব্যাটা একদম ভুলে মেরে দিয়েছে – বিরিয়ানির চাল চড়াবার পরে সে কথা মনে পড়েছে, মানে শুরুর দিকে সে বিভিন্ন রকমের গাওনা চলে। কিন্তু জিনিসপত্র একবার জায়গামত এসে গেলে রান্নাটা করতে লাগে খুব বেশি হলে আধঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট।

বেড়াবার গল্পটাও এক রকমের। শুধু ডেস্টিনেশন সেট করা আর তাতে তারিখ বসানোর কাজটুকুতেই যদি শেষ হত, তা হলে তো কোনও কথাই ছিল না। … ও হ্যাঁ, হোটেল বুকিং। সে পর্বও চুকিয়ে ফেলেছি। নিজের ক্যাপায় ড্রাইভিং টেস্ট দিয়ে চকচকে স্মার্ট কার্ড পেয়ে গেছি। গাড়িতে যা যা গয়নাগাঁটি লাগানোর তা-ও লাগানো শেষ। আর কী বাকি থাকে?

থাকে রে দাদা, থাকে। খুব সামান্য কিছু জিনিস, খিচুড়িতে নুন যতটা সামান্য, অথচ যতটা ভাইটাল, সেই রকম কিছু জিনিসে ফাঁক রয়ে যায়। এই যেমন ধরুন, প্রথম দিনের যাত্রা। যাবো দিল্লি থেকে গোরখপুর। তো, যাবার রাস্তা কী? না, দিল্লি – আগ্রা – লখনউ – রায়বেরিলি – বারাবাঁকি – ফৈজাবাদ – গোরখপুর। এখন, দিল্লি থেকে আগ্রার জন্য একটা চমৎকার এক্সপ্রেসওয়ে আছেন, আপনারা সবাই জানেন, কেউ তাকে বলে তাজ এক্সপ্রেসওয়ে, কেউ বলে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে। ইদিকে, গদি হারানোর ঠিক আগে আগে অখিলেশ যাদবও একটা চমৎকার কাজ করে দিয়ে গেছেন, সেটা হচ্ছে, আগ্রা থেকে লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে। তিনশো দুই কিলোমিটার লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ে এই মুহূর্তে দেশের দীর্ঘতম এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে, কেবল বাকি কাজকর্ম এখনও শেষ হয় নি – যেমন, টোল গেট বসে নি এখনও, ফলে এই লম্বা রাস্তা যাওয়া আসা করা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়। এটা যেমন একটা ভালো ব্যাপার, তেমনি এই পুরো রাস্তায় একটাও পেট্রল পাম্প নেই, একটাও খাবার জায়গা নেই, একটাও রিফ্রেশমেন্টের জায়গা নেই। মানে, দিল্লি থেকে লখনউ – পুরো পাঁচশো কুড়ি কিলোমিটার একেবারে নন-স্টপ। যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে অবশ্য সবই আছে, টোল, রিফ্রেশমেন্ট, পেট্রল পাম্প – কিন্তু শেষ পেট্রল পাম্প আছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবারও সত্তর কিলোমিটার আগে। মানে সেখানে তেল ভরলেও প্রথমে সত্তর কিলোমিটার, তার পরে তিনশো দুই কিলোমিটার, মোট তিনশো বাহাত্তর কিলোমিটার চলতে হবে একটানা। পেট্রল ক্যারি করতেই হবে, প্রথম দিনের জন্যেই। এমনকি এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবার কত পরে প্রথম পেট্রল পাম্প পাবো – তাও তো জানি না। সুতরাং, পেট্রল ক্যারি করতে হবে।

আরে, সে তো করতেই হবে। বাইকে ক্যারিয়ার লাগিয়েছি তো সেই জন্যেই। কিন্তু সেই ক্যারিয়ারে পেট্রল ক্যান হোল্ড করার জন্য যে চৌকো চৌকো দুটো খুপরি, তাতে তো আমার হরিদ্বার থেকে কেনা প্লাস্টিকের জেরিক্যান ঢুকছে না – বিশাল বড়। দশ দশ লিটারের এক একটা ক্যান। তা হলে কী করা যায়?

এই একটা জিনিস বাজারে খুবই আকাল। দিল্লির মত জায়গাতেও পেট্রল জেরিক্যান খুঁজতে গেলেই ঐ হরিদ্বার মার্কা প্লাস্টিক জেরিক্যান পাওয়া যায়। এর বাইরে মায়াপুরী বলে একটা এলাকা আছে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের কাছে, সেখানে শুনেছি আর্মির ব্যবহৃত বিভিন্ন সাইজের প্লাস্টিক আর মেটাল ক্যান পাওয়া যায় – তার কোনওটা আমার ক্যারিয়ারের খোপে ফিট করে গেলেও যেতে পারে।

যাওয়া যাক তবে মায়াপুরী। একদিন সময় নিয়ে গেলাম, উত্তমনগর থেকে মায়াপুরী হয়ে দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে ফেললাম, কোথাও কোনও জেরিক্যানের দোকানের সন্ধান পেলাম না, মেন রাস্তাতেও নয়, গলিঘুঁজির ভেতরেও না। … তবে যে লোকে বলে মায়াপুরীতে নাকি পাওয়া যায়?

হতোদ্যম হয়ে বাড়ি ফিরে গুগলের সামনে বসলাম আবার। কিছু দোকানের খবর পেলাম যারা পেট্রল জেরিক্যান বেচে, তবে পাইকিরি বেচে – খুচরো নয়। তিনশো টাকা থেকে সাতশো টাকা পার পিস। ঠিকানা দেখলাম পাহাড়গঞ্জ, করোল বাগ। ফোন নম্বর বের করে ফোন করতে গেলাম, ফোন গিয়ে লাগল ইন্ডিয়ামার্টের কাস্টমার কেয়ারে। এইবারে সেখানে এক গর্দভ বসে আছে, কে জানে উত্তরপ্রদেশের কোন গ্রাম থেকে এসেছে – এদিকে তাকে ইংরেজি বলতেই হবে, আমি হিন্দি বললেও সে ইংরেজিতেই দাবিদাওয়া পেশ করছে, আর সে কী মারাত্মক ইংরেজি – তাকে আমি টানা কুড়ি মিনিট ধরে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে আমার কোনও ইন্ডাস্ট্রি নেই, আমি নেহাতই এক পাপা (মানে পাতি পাবলিক), আমার শুধুমাত্র দুটোই জেরিক্যান চাই – সাইজ বলতে পারছি না, আমি মোটরসাইকেল নিয়ে দোকানের সামনে একটিবারের জন্য দাঁড়াতে চাই, যে সাইজ ফিট করবে, ঠিক সেই সাইজের জেরিক্যান দুখানি নিয়ে আমি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে চাই। সে পাবলিক বুঝতেই পারে না – খালি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, স্যার ইউ ওয়ান্ট টু-পীস, মেটাল অর ফাইবার, হাউ ফ্রিকোয়েন্টলি ডি ইউ ওয়ান্ট টু প্লেস ইওর অর্ডার স্যার –

এক সময় ক্লান্ত হয়ে ফোন রাখতেই হল। তখন আমি অফিসে, একটু পরেই কল শুরু হবে। ফোনটা পকেটে রেখে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিলাম, একটু হাল্কা হয়ে এসে কল জয়েন করব।

ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আমার পা থমকে গেল। … আমি কী দেখছি? আমার চোখের ঠিক সামনে, ওয়াশরুমের সাইডে যে একটা ক্যাবিনেট বানানো রয়েছে – যেখানে সাধারণত পরিষ্কার করার জিনিসপত্র রাখা থাকে, অফিসের সুইপাররা সেখান থেকে ঝাঁটা ন্যাতা মপার ইত্যাদি নিয়ে সর্বসময় মেঝে মুছছে, সেই ক্যাবিনেটের ঠিক সামনেই … ওটা কী পড়ে রয়েছে?

item_XL_11366010_16241634

একটা খালি প্লাস্টিকের ক্যান। সাইজটা, অন্তত চোখের আন্দাজে যা লাগছে, একেবারে খাপে খাপ! মানে, আমার মোটরসাইকেলের লাগেজ ক্যারিয়ারে যে খোপ বানানো রয়েছে, ঠিক সেই রকমেরই সাইজের লাগছে তো! এদিক ওদিক তাকালাম – একটু দূরেই একজন সুইপার এগিয়ে আসছে, তাকেই গিয়ে ধরলাম। ভাই, এটা কীসের ক্যান?

সে বলল – এটা লিকুইড সোপ, প্রতিটা ওয়াশরুমে ডিসপেন্সারের মধ্যে যে জিনিসটা ঢালা হয়, তার পাঁচ লিটারের কন্টেনার। বিশাল বড় অফিস, তার প্রত্যেক তলায় চারটে করে বড় বড় ওয়াশরুম, দুটো লেডিস দুটো জেন্টস, ফলে এ রকম প্রচুর ক্যান প্রতিদিনই আসে।

আর সাবান শেষ হয়ে গেলে কী করো?

কী আর করব, ফেলে দিই।

ক্যানটা হাতে নিয়ে দেখলাম, ভেতরে সাবান আর নেই, সদ্য শেষ হয়েছে। রীতিমত শক্তপোক্ত প্লাস্টিক, সহজে ঘা তো খাবেই না, স্ক্র্যাচও পড়বে না এমন শক্ত। … আমি এই ক্যানটা নিতে পারি?

নিন না – সুইপার ছেলেটা একগাল হাসল, এ তো শেষই হয়ে গেছে।

কথা না বাড়িয়ে সাথে সাথে জিনিসটা বগলদাবা করে প্রথমে নিজের সীটে ফিরলাম। কল ছিল, সেটা শেষ হতে হতে চল্লিশ মিনিট, সাথে সাথে একদম স্প্রিংয়ের মত আবার ছিটকে উঠলাম সীট ছেড়ে, সোজা নিচে পার্কিং লটে। … হ্যাঁ, এই ক্যানটা সম্ভবত এই ক্যারিয়ারের জন্যেই বানানো হয়েছিল, একদম খাপে খাপে ঢুকে গেল, রীতিমত টাইট, এখন বাইক উলটে পড়ুক, ছিটকে পড়ুক, হোল্ডার থেকে ক্যান বেরোবে না। মুখের ঢাকনাটাও রীতিমত টাইট, পেট্রল বেরোবার জাস্ট কোনও জায়গাই নেই।

আবার ওপরে উঠে এলাম, সুইপার ছেলেটাকে আবার পাকড়ালাম – ভাই, আমার আরেকটা এই রকমের ক্যান দরকার। শেষ হলেই আমাকে একটু এনে দেবে একখানা?

সাতশো টাকা পার পিস হিসেবে যে জিনিস বিক্রি হয় পাহাড়গঞ্জের ফ্যাক্টরিতে, সেই জিনিস আমি দু দুখানা বিনা পয়সায় বগলদাবা করে সেদিন সন্ধ্যেয় অফিস থেকে ফিরলাম। কে কে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল, আমি সে সব ফিরেও দেখি নি – এ এখন আমার প্রাইজড পজেশন, আমার লাইফলাইন। পাঁচ-পাঁচ দশ লিটার পেট্রলের সংস্থান।

দিওয়ালি তখন আর ঠিক তিনদিন বাকি। আর আমার যাওয়া, চতুর্থ দিন ভোরে।

ইতিমধ্যে টুকিটাকি কেনাকাটাযেটুকু করার, ব্যাগপত্র যা গোছাবার, সবই করে নিয়েছি। এইবারে আমি সম্পূর্ণভাবে তৈরি। বিসিএমট্যুরিং, আর হোয়াটস্যাপ ফেসবুকের কিছু বাইকার্স গ্রুপের দিকে নজর রাখছি, যদি পার্টনার জুটে যায়। দু একজনের সাথে কথাও হল, কিন্তু তাদের প্ল্যান আলাদা, আমার আলাদা। যা বুঝছি, একাই যেতে হবে। এটুকু জানি – গ্যাংটকে বা ফুন্টশোলিং পৌঁছলে অন্য বাইকার ঠিক জুটেই যাবে, সেখানে টিম আপ করে নিলেই হবে। এমনিতেও গেছোদাদার সাথে দেখা হবার কথা ছিল শিলিগুড়ি গিয়ে। গ্যাংটক তো তার একদিন পরেই পৌঁছচ্ছি। রাস্তা ডাকছে। এখন বাতাস উঠুক, তুফান ছুটুক, ফিরব না গো আর।


২০শে অক্টোবর, প্রথম দিন

অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথে উঠে পড়েছি। সকাল চারটে। আগের দিন দিওয়ালি তো ছিলই, আমার শ্যালিকার জন্মদিনও ছিল, তাই খাওয়াটা একটু বেশি মাত্রাতেই হয়েছে। বেহরুজের বিরিয়ানি, আর কী কী সব যেন। হাল্কা একটা ভুঁড়ি বানিয়ে শুতে গেছিলাম আগের রাত্রে। এনজিটি আর সুপ্রিম কোর্টের ব্যানের প্রভাব এ বারে ভালো মতনই পড়েছে। অন্যান্যবারের মত এবার দিওয়ালিতে বোম ফেটেছে বাজি পুড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পরিমাণ অনেক, অনেক কম। আওয়াজ প্রায় নেই, বাইরে সালফার আর বারুদের কটু গন্ধ নেই, ছ ঘণ্টার সলিড ঘুম দিয়ে আমি তৈরি।

তৈরি হয়ে সাড়ে চারটের মধ্যে বেরোলাম। ব্যাগ হয়েছে তিনটে, প্লাস স্লিপিং ব্যাগ, ও আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস মিলিয়ে লাগেজ হয়েছে বেএশ খানিকটা। তার সাথে আছে দু ক্যান পেট্রল। সবচেয়ে দামী। প্রথম পাঁচশো কুড়ি কিলোমিটার আশা করি নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যেতে পারব, যদি বড় কোনও অঘটন না ঘটে।

বাঁধাছাঁদা সেরে, ঠিক পাঁচটা পঁচিশে স্টার্ট দিলাম বাইকে। নিমেষের মধ্যে গাজিপুর, ময়ূর বিহার পেরিয়ে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফেললাম – সূর্য তখনও ওঠে নি। বাতাস পরিষ্কার, নির্মল, আগের দিনের দিওয়ালির কোনও রেশ তখন আর নেই, নাকে পোড়া গন্ধ লাগছে না, চোখ জ্বলছে না। ফাঁকা হাইওয়ে, স্পিড তুললাম।

গ্রেটার নয়ডাতে এসে সূর্য উঠতে দেখলাম।

DSC_0028.jpgDSC_0032.jpg

খুব তাড়াহুড়ো করে চালাবো না, আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, আর দরকার না হলে দাঁড়াবো না। এমনিতেই যতক্ষণ চালাই, আমার খিদে, বায়ো ব্রেক প্রায় কিছুই দরকার হয় না। হুশহাশ করে পেরিয়ে গেলাম সত্তর কিলোমিটার, যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে প্রথম টোল প্লাজা। এই রাস্তায় টু হুইলারেরও টোল লাগে, দুশো পাঁচ টাকা।

20171020_083015.jpgDSC_0037.jpg20171020_073305

প্রায় একশো কিলোমিটার চলার পরে একবার দাঁড়ালাম। বাইকের পেছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা সমস্ত লাগেজ একবার ভালো করে চেক করে নিলাম। না, এক চুলও হেলে নি, যেমনটি বেঁধেছি, ঠিক তেমনটিই বাঁধা রয়েছে। দেখতে দেখতে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে এলাম – দুশো কুড়ি কিলোমিটার। কিন্তু আশঙ্কা যেটা করেছিলাম, সেটাই হল। আমি ভেবেছিলাম, এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হলে সেটা এমনি হাইওয়েতে পড়বে, সেইটা দিয়ে খানিক যাবার পরে নতুন করে আগ্রা লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হবে। এখন দুটো এক্সপ্রেসওয়ের মাঝে পেট্রল পাম্প পাবো না বলে আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু অখিলেশ যাদব কী করেছে গুরু! যমুনার সাথে জুড়ে দিয়েছে লখনউ এক্সপ্রেসওয়েকে! আর সে কী মোহময় রাস্তার শুরু! এক তো যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে আদ্যোপান্ত কংক্রিটের রাস্তা – হাইস্পিডে চললে টায়ার গরম হয়ে যায় বেশি ঘর্ষণে, টায়ারের ক্ষতিও হয়, কিন্তু লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি টারড্‌, অ্যাসফল্টের রাস্তা। আর সে রীতিমত হাই কোয়ালিটির রাস্তা, অ্যাসফল্ডের মধ্যে মনে হচ্ছে রূপো বা অভ্রের কুচি মেশানো আছে, মসৃণ রাস্তার গা থেকে ঠিকরে উঠে ঝিকমিকোচ্ছে সকাল নটার রোদ্দুর। প্রতি একশো মিটারে একটা করে ছোট বোর্ড – তাতে ১০০, ২০০, ৩০০ এই রকম লেখা, আর প্রতি কিলোমিটারে একটা বড় বোর্ড, তাতে লেখা, কত কিলোমিটার বাকি আছে। তিনশো দুই থেকে শুরু।

IMG-20171020-WA0004DSC_0038.jpg

উড়িয়ে দিলাম গাড়ি। অবশ্যই আশি থেকে নব্বইয়ের মধ্যে স্পিড। তার বাইরে আমি তুলিই না। কিন্তু এক সময়ে দেখলাম আমার বাইক ছুটছে একশো চার কিলোমিটারের স্পিডে। মিনিট চারেক ছুটতে দিলাম, তার পরে আবার স্পিড কমিয়ে আনলাম নব্বইতে।

প্রায় একশো তিরিশ কিলোমিটার যাবার পর মনে হল বাইকের তেল শেষ হয়ে আসছে। বাড়ি থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার চলে এসেছি ততক্ষণে। পিঠও তখন বেশ টনটনাচ্ছে। দীর্ঘদিনের অনভ্যেস। অতএব, বাইক সাইড করলাম। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, খিদে পেয়েছে। এই রাস্তায় খাবার কিচ্ছু প্রভিশন নেই – সেটা জেনেই আমি বাড়ি থেকে হাল্কা খাবার নিয়ে এসেছি। সিকিনী এক হরলিকসের কৌটো ভর্তি চিড়েবাদামভাজা বানিয়ে দিয়েছে, কৌটোটা রয়েছে পিঠের ব্যাগে। খুলে কয়েকমুঠো ঐ খেয়ে ঢকঢক করে জল। খিদে মরল। এবার বাইককে খেতে দিতে হয়।

বানজি কর্ড খুলে একটা ক্যান বের করলাম। পাঁচ লিটারে বাকি এক্সপ্রেসওয়েটা কভার করে ফেলতে পারব। বাকি আছে আর একশো সত্তর কিলোমিটার। তার পরে দরকার হলে, পেট্রল পাম্প কাছাকাছি না পেলে আরেক ক্যান তেল ঢেলে নেওয়া যাবে।

ঠিক সাড়ে সাত ঘণ্টায় শেষ করলাম পরপর দুটো এক্সপ্রেসওয়ে। বেলা একটায় লখনউ ঢুকলাম যখন, তখন বাইকের তেল আবার প্রায় শেষ – কিন্তু এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবার ঠিক মুখেই দেখলাম একটা পেট্রল পাম্প রয়েছে। সাথে সাথে সেখানে ঢুকে বাইকের ট্যাঙ্ক আর খালি ক্যান শেষ অবধি ভরলাম। এইবার নিজের ট্যাঙ্ক ভরতে হবে। খিদে পেয়েছে, এবং জায়গাটার নাম লখনউ।

কিন্তু খাবো বললেই, একা বাইকারের পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। এমন জায়গা দেখতে হয়, যেখানে খাবার জায়গা থেকে বাইক দেখতে পাওয়া যায়, কারণ সমস্ত লাগেজ বাঁধা রয়েছে বাইকে। চোখের আড়াল করা সম্ভব নয়। এবং, এমন জায়গা দেখতে হয়, যেখানে লোকজনের ভিড় কম। জনবসতির মধ্যে অন্য জায়গার নাম্বারওলা গাড়ি, তাতে কিছু লাগেজ বাঁধা, কয়েক রকমের লাইট ইনস্টল করা, মোবাইল মাউন্ট বসানো – এসব দেখলেই স্বাভাবিকভাবে ভিড় জমে কৌতূহলী মানুষজনের। একলা বেরিয়ে অচেনা জায়গায় অপ্রত্যাশিত লোকজনের ভিড় আমি এক্কেবারে চাই না। তাই, এগিয়ে চললাম, যতক্ষণ না একটা ফাঁকা জায়গায় ধাবা টাইপের কিছু পাই।

হাইওয়ে গেছে লখনউ শহরের বাইরে বাইরে দিয়ে, ফলে শহর কিছুই দেখা হয় নি, শুধু এটুকু বুঝলাম – পুরো শহর জুড়ে সমাজবাদী পার্টির রাজত্ব। জায়গায় জায়গায় অখিলেশ মুলায়ম ইত্যাদিদের বিশাল বিশাল পোস্টার ব্যানার, আদিত্যনাথ কোথাও নেই, বিজেপিও নেই। – সে না থাক, যাচ্ছি তো আরও ভয়ঙ্কর জায়গা দিয়ে – অযোধ্যা, যেখানে হিন্দুত্বের চাষ হয়, যাবো তো গোরখপুর, যেখানে ঐ নোংরা লোকটার বাসস্থান, কে জানে কী অভিজ্ঞতা হবে। একটু নার্ভাস লাগছিল ঠিকই। কাগজে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ঘটনার কথা পড়ি টড়ি, জোর করে গাড়ি আটকে সওয়ারিকে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা – এসব প্রচুর ঘটে এই তল্লাটে।

লখনউ শহর শেষ হয়ে গেল, উপযুক্ত খাবার জায়গা পেলাম না। রায়বেরিলি এল একটু পরেই। রায়বেরিলির পাশ দিয়ে আরও শ খানেক কিলোমিটার এগিয়ে একটা জায়গাতে এলাম, যে জায়গার নাম দেখেই আমার সেই সুমহান ব্যক্তিত্বের মুখটি মনে পড়ে গেল, আমাদের জাতীয় ফেরিওয়ালা, জাতীয় কৃষক, মহামান্য শ্রীলশ্রীযুক্ত অমিতাভ বচ্চন। জায়গাটির নাম – বারাবাঁকি। কৃষকটির খেতিবাড়ি এই এলাকাতেই।

তো, সেই বারাবাঁকিতে এসে একটা ধাবা পেলাম, উপযুক্ত। বেশি লোক নেই, দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর একদম খাবার জায়গার পাশেই গাড়ি রাখার অঢেল জায়গা।

উঠোন চত্ত্বরে টেবিল চেয়ার পাতা, কিছু লোক খাচ্ছে, আমি বসে আছি তো বসেই আছি, সোয়া দুটো বাজে, কেউ আসেও না, জিজ্ঞেস করেও না। হাত তুলে একজনকে ডাকলাম, নিতান্তই গ্রাম্য দেহাতি লোকজন, কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। সে এলও না, একবার কিচেনের ভেতর ঢুকে, খানিক বাদে বেরিয়ে এল হাতে একতাড়া রুটি নিয়ে, একে তাকে দিতে লাগল।

দশ মিনিট বসার পরে ধৈর্যভঙ্গ হল, উঠে গিয়ে কিচেনে হাঁক মারলাম, কী ভাই, ডাকলেও আসো না, সমস্যাটা কী?

তখন একজন বুড়ো মতন লোক খুব ইনিয়ে বিনিয়ে ন্যাড়া স্টাইলে বলতে শুরু করল, হ্যাঁ ভাই, রাগ করবেন না ভাই, কাল অবধি দিওয়ালির খোঁয়াড়ি চলেচে কিনা ভাই, তাই আমাদের কাজের লোক সবাই আসে নি, তাই একটু দেরি হচ্চে। আমরা এক্ষুনি আপনাকে খাবার দিচ্ছি।

আরও দশ মিনিট বাদে খাবার পেলাম। খিদে জম্পেশ পেয়েছিল, তাই ভ্যাজই খেয়ে নিলাম। রুটিগুলো শক্ত হলেও গোবি-মটর, অর্থাৎ কিনা ফুলকপি আর মটরের তরকারিটা বেশ উমদা ছিল। খেয়েদেয়ে ইয়া একটা ঢেঁকুর তুলে যখন আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম, তখন সওয়া তিনটে বেজে গেছে।

মাত্রই কয়েক কিলোমিটার এগিয়েছি, হঠাৎ কড়াং করে একটা আওয়াজ, একেবারে আমার বাঁ হাতের সামনে থেকে। কী হল, কী গেল? ঝট করে তাকিয়ে নিলাম, না, মাউন্টে মোবাইলটা দিব্যি রয়েছে, কেবল বাঁ হাতে গোঁত্তা মারছে আমার বাইকের বাঁদিকের হ্যান্ডেলে লাগানো ফগলাইটটা। রাস্তা খুব সুবিধের ছিল না, আগাগোড়া কী রকম একটা অদ্ভূত টাইপের খাঁজখাটা কংক্রিটের হাইওয়ে, গাড়ি অল্প অল্প ঝাঁকুনি খেতে খেতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তাই বলে শক্ত করে বাঁধা অমন তাগড়া ফগলাইটটা ভেঙে যাবে?

বাইক থামালাম। ভালো করে ঝুলন্ত ফগলাইটটা হাতে নিয়ে দেখলাম – হ্যাঁ, ঝুলন্ত তো বটেই, তার তো খোলে নি, তার ভেতরেই লাগানো আছে। খুলে গেছে কেবল হোল্ডারে যে নাট-স্ক্রু দিয়ে লাগানো ছিল, সেইটা। নাট স্ক্রু-ও খুলে বেরিয়ে যায় নি, তারাও লুজ হয়ে ঝুলছে হোল্ডারের খাঁজে। কী করে এত শক্ত করে লাগানো জিনিস খুলে গেল কে জানে – নাট-স্ক্রু সাবধানে খাঁজ থেকে বের করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম – কোনও রিপেয়ারিং শপ পেলে লাগিয়ে নিতে হবে।

কোমর ধরে গেছিল প্রচণ্ড, বোরিং রাস্তা চূড়ান্ত, আর এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবার পর থেকেই টিপিকাল উত্তরভারতীয় ট্র্যাফিক শুরু হয়ে গেছে, উল্টোদিক থেকে যখন তখন এসে পড়ছে ট্রাক্টর, সাইকেল, মোটরসাইকেল, কুকুর, শুওর – এমনকি হাঁসমুরগিও। দিনের বেলা তাও একরকম, রাতের বেলা অন্য ঝামেলা শুরু হয়, হাই বীমের আলো। উল্টোদিক থেকে হাই বীমে আলো জ্বালিয়ে আসে, বারবার সিগন্যাল দিলেও ডিপার ইউজ করে না – মানে সে এক ক্যাডাভ্যারাস ব্যাপার হয়। উত্তরপ্রদেশ আর বিহারের প্রায় সমস্ত হাইওয়ের এই একই হাল।

যত এগোচ্ছি, বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড়ে ব্যাপার হচ্ছিল, কারণ আর একটু পরেই এসে যাবে অযোধ্যা। ফৈজাবাদ। জায়গাটার নাম শুনলেই আমার অনেক অনেক পুরনো, পঁচিশ বছর আগেকার এক ডিসেম্বর মাসের কথা মনে পড়ে যায়। … তবে সাইনেজ ইত্যাদি দেখে মনে হল অযোধ্যা শহরটা বাঁদিকে অনেকটা ভেতর দিকে, এই হাইওয়েটা শহরের বাইরে বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেছে একদম সোজা।

নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেলাম অযোধ্যা। গোরখপুর যখন আর পঞ্চাশ কিলোমিটার বাকি, তখন সন্ধ্যে হল। রাস্তা এখান থেকে ডাইভার্ট হয়ে ঢুকে গেছে গোরখপুরের মধ্যে। ঢুকতে গিয়ে প্রথম বুঝতে পারলাম হোটেল যেটা বুক করেছি, সেটা শহরের একদম সেন্টারে, বাইরে হাইওয়ের আশেপাশেই হোটেল বুক করে নিলে হত, শহরে না ঢোকাই ভালো ছিল। অনেকটা যাবার পর একটু একটু করে রাস্তা খারাপ হতে শুরু করল, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল উন্মাদের মত ট্র্যাফিক এবং ভাঙা রাস্তাঘাট। সে কী গর্ত রে ভাই, এক একটাতে চাকা পড়ছে আর লাগেজভর্তি বাইক পুউরো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। তার মধ্যে সেই হাঁ-করা জনতার ঢল আশেপাশে, খুবই, মানে খুবই অস্বস্তিকর।

জিপিএস অন করাই ছিল, কোনও ভুল রাস্তায় না ঢুকে সরাসরি আমাকে হোটেলের সামনে পৌঁছে দিল তখন বাজে রাত পৌনে আটটা। গোরখপুরের মেডিকেল কলেজ, তার পাশেই পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র, তার তিনতলায় হোটেল। বুক করাই ছিল। সুবিশাল ফাঁকা বেসমেন্টে বাইক পার্ক করে বানজি কর্ড ফর্ড খুলে লাগেজ নামানো, তার পরে সেগুলোকে ওপরে নিয়ে যাওয়াতে লেগে গেল প্রায় আরও আধ ঘণ্টা। এর পরে প্রতিটা দিনই এই সময়টা আমাকে হিসেব করেই চলতে হবে – লাগেজ বাঁধতে আধঘণ্টা, খুলতেও প্রায় তাই।

হা-ক্লান্ত, পিঠে হাতে টিমটিমে ব্যথা, সেই অবস্থায় হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে ব্যাগপত্র নিয়ে তিনতলায় উঠলাম। রিসেপশনের ছেলেটি আমাকে খুব নিরীহ মুখ করে বলল, একটা ঘর রেখেছি আপনার জন্য – কিন্তু তার আয়নাটা ভাঙা। আপনি কি সেখানে থাকবেন? যদি না চান, তা হলে অন্য ঘর দিচ্ছি।

আমি একবার হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটাকে। টিপিকাল ব্লান্ট ফেস। মানে, আমি এতদিন আগে বুক করেছি, যদি ভাঙা আয়না থেকেই থাকে সেখানে, আর যদি তার পরেও তোর কাছে অন্য ঘর থেকে থাকে, তা হলে এত কথার দরকার কী, আমাকে অন্য একটা ঘর দিলেই তো মিটে যায়, এত এক্সপ্ল্যানেশনের দরকারই হত না! আমি তো আর ভাঙা আয়না পছন্দ করে রুম বুক করি নি! কিন্তু তখন এতই টায়ার্ড, আর কথায় যাবার ইচ্ছে ছিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ, বোতলে জল শেষ, কোনওরকমে বললাম – যা ইচ্ছে তাই দাও। আমি এখানে ঘুমোতে এসেছি। শুধু দ্যাখো বাথরুমে গরম জল যেন পাওয়া যায়। চান করতে হবে।

সেই ভাঙা আয়নাই পেলাম। অবিশ্যি বাথরুমের ভেতর আরেকটা আয়না ছিল, চান করে চুল আঁচড়ানোর কাজটা মিটে গেছিল তাতেই। গরম জলে চান করে গায়ের ব্যথা অনেকটাই কমল। চাউমিন অর্ডার করেছিলাম, তাই খেয়ে পৌনে দশটার মধ্যে নরম বিছানায় ধপাস, এবং ঘুম। ঘরের এসিটা দুর্দান্ত কাজ করছিল।

প্রথম দিনের মেগা দৌড় খতম, আটশো তিন কিলোমিটার। কাল সাতশো এবং বঙ্গে আগমন।

 


7 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ২

  1. দিব্যি। পড়ছি। আচ্ছা, এর পরের বার নাট বোল্টের মাঝে পাতলা রাবার ওয়াশার মেরে দেবে। তাহলে রাস্তার ভাইব্রেশনে ঐরম ইস্ক্রুপ খুলে বা ঢিলে হয়ে যাবে না।

    Like

  2. দারুণ, দারুণ হয়েছে, এতো সহজ সরল ভাষায় আর কথায় কথায় কোটেশন ছাড়া লেখা পড়ে খুব আনন্দ পেলাম, তাকিয়ে থাকলাম পরে র লেখার জন্য।

    Like

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.