২১শে অক্টোবর, দ্বিতীয় দিন
সকালে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল। গায়ের ব্যথা আর নেই, একদম ফ্রেশ। কাল রাতেই চান অরেছি তাই আর সকাল সকাল চান করার চাপটা নিলাম না। ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বেরোলাম। পাশেই এক চিলতে রিসেপশন, সেখানে মেঝেতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে তিনটে মূর্তি, রিসেপশনে কাল রাতে যে ছেলেটা ছিল, কাল আমার লাগেজ যে ওপরে তুলে এনে দিয়েছিল, আর আরেকজন কেউ। রিসেপশনের মোটা কাচের দরজা লক করা।
অগত্যা, ডাকতেই হল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে একজন উঠে দরজাটা খুলে দিয়েই আবার ধুপুস করে পড়ে ঘুমিয়ে গেল।
আজ সমস্ত লাগেজ নিজেকেই নামাতে হবে। সাহায্য করার আর কেউ নেই। দুতিন খেপে নামাবো। ঘরে গিয়ে দুটো ব্যাগ নিয়ে ঘুমন্ত তিনজনকে সন্তর্পণে ডিঙিয়ে বাইরে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে বাইকের কাছে রেখে আবার তড়িঘড়ি ওপরে এসে বাকি লাগেজ কোনওরকমে নিয়ে আবার ঘুমন্ত তিনমূর্তিকে ডিঙিয়ে ফাইনালি নিচে। পেমেন্ট ইত্যাদি কালকেই করে রেখে দিয়েছি, সুতরাং আর কাউকে জাগানোর নেই। এই গরুর রাজ্য থেকে এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালালে বাঁচি।
গোরখপুর বা বারাণসী, এগুলো সব বিহার লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের শহর, ফলে এখানকার হিন্দিতে বিহারী অ্যাকসেন্ট অত্যন্ত স্পষ্ট। সকাল বেলায় উঠে লাগেজ বেঁধে প্রথম কাজ অতি অবশ্যই বাইকের ট্যাঙ্ক ফিল আপ করা – তা হোটেলের সামনেই একটা বড়সড় পেট্রল পাম্প আছে। সেখানে ঢুকলাম যখন, ঘড়িতে বাজে পৌনে সাতটা। পেট্রল পাম্প তখনও খোলে নি – খুলব খুলব করছে। বলল, তানিক ওয়েট কর লিজিয়েগা। আধঘণ্টা ওয়েট করতে হবে।
আধঘণ্টা? পাগল নাকি? আজকে আমার দৌড় সাতশো কিলোমিটারের, আধঘণ্টা মানে আমার কাছে অনেকটা সময়। বেরিয়ে পড়লাম, খানিক দূরেই আরেকটা বড়সড় পেট্রল পাম্প। সেটি তখন খুলেছে। ট্যঙ্কে তেল ভরলাম, জেরিক্যানে ভরলাম। এদিকে একটা ফগলাইট তখনও নাটবল্টু খোলা অবস্থায় ঝুলছে। লাগাবার জন্য একজন মেকানিক দরকার। আশেপাশে কাউকেই দেখছি না। জিজ্ঞেস করতে যাবো, তার আগেই পেট্রল ভরার ছেলেটি অন্য অক্ষত ফগলাইটটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ই কা হ্যায় বা? কেমরা বা? বললাম, না, লাইট বা। অতএব, পরের আবদার, লাইট বা? তানিক জলাকে দিখাইয়ে না – বহুত দূর সে আ রাহে হ্যায় কা?
হেসে ফেললাম, এর কাছে আর মেকানিকের কী জিজ্ঞেস করব – যে লাইট দেখে ক্যামেরা ভাবে। দেখি রাস্তায় যদি কোনও মেকানিক পাই। খানিক লাইট জ্বালিয়ে দেখিয়ে তাকে খুশি করে এগিয়েই গেলাম।
কিন্তু গোরখপুর এমনই ঘিজিমিজি এলাকা, জিপিএস আমাকে ঢুকিয়ে দিল একটা গলির ভেতর। সেখান দিয়ে খানিক এগিয়ে দেখলাম ছিমছাম সরু রাস্তাঘাট, চারদিকে পরিচ্ছন্ন কোয়ার্টার – গোরখপুর ক্যান্টনমেন্ট। তার পরে ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে একটা লেভেল ক্রশিং, সেটা পেরিয়ে দেখি রাস্তা আরও সরু। দাঁড়ালাম। জিপিএসে স্ক্রোল করে করে দেখলাম আর দেড় কিলোমিটার চললেই ন্যাশনাল হাইওয়ে সাতাশ। এবং যাবার মতন রাস্তাও দেখাচ্ছে নীল রঙে। অগত্যা, আবার এগোলাম – এবং একটু এগোটেই গিয়ে পড়লাম একটি বস্তির মধ্যে। একপাশে উঁচু পাঁচিল, পাঁচিলের অন্যপ্রান্তে রেললাইন, সারি সারি মালগাড়ি দাঁড় করানো, এটা বোধ হয় গোরখপুর জংশনের কারশেড, আর পাঁচিলের অন্যপ্রান্তে এক ফালি রাস্তা, শুধু মোটরসাইকেলই যেতে পারে, রাস্তার অন্যদিকে সারিসারি এবরোখেবড়ো ইঁটের বাড়ি, কোথাও রাস্তার ওপর চারপাই খাটিয়া নিয়ে বসে বয়স্করা গুলতানি মারছে, কোথাও রাস্তার ওপরেই বাচ্চারা খেলছে, তার মধ্যে দিয়ে হর্ন টর্ন বাজিয়ে ধীরে ধীরে এগোটে লাগলাম। এই রকমের লাগেজবোঝাই মোটরসাইকেল, কেউ যদি বেশি কৌতূহলী হয়ে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, সেই ভয়েই আমি কারুর দিকেই তাকাচ্ছিলাম না, জাস্ট চালিয়ে যাচ্ছিলাম, শেষ মুহূর্তে বাদ সাধল একটা শুওর – তার জীবনে কীসের দূঃখ ছিল কে জানে, একদিক থেকে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচঘোঁচঘোঁচ আওয়াজ করতে করতে তিরবেগে এসে পড়ল আমার বাইকের সামনের চাকার সামনে, প্রাণপণে ব্রেক মারলাম, শুওরটা বেঁচে গেল, আমি বাইকসমেত সামান্য টলে গেলাম।
আত্মহত্যার প্রচেষ্টা বিফলে গেল দেখে শুওরটা আবার অন্যদিকে ছুটে চলে গেল, আমি কি আর ওখানে দাঁড়াই? একবার বেঁচেছি, শুওরটা আজ আমার বাইকে চাপা পড়লে আমার কপালে গল্প লেখা ছিল। অবিশ্যি গোরখপুরে শুওর মারলে কিছু না-ও হতে পারে, আফটার অল, শুওর-রখপুর তো নয় ওটা।
সাথে সাথে সেকেন্ড গিয়ারে তুলে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গেলাম আর ঠিক একশো মিটার এগোতেই চোখের সামনে আড়াআড়ি দেখা দিল চওড়া হাইওয়ে। তাড়াতাড়ি হাইওয়েতে উঠে বাঁদিকে টার্ন। খাইক এগোতেই একটা আরও চওড়া হাইওয়ে শুরু হল, সামনে বড় বড় বোর্ডে লেখা পূর্ণিয়া, কিষেণগঞ্জ, শিলিগুড়ির নাম। জয়গুরু, ঠিক রাস্তায় আছি।
আধঘণ্টা চালাবার পরে রাস্তার ধারে একটা ধাবা পেলাম। সেখানে বসে খানিক পরোটা ওমলেট আর তরকারি খেয়ে নিলাম পেটপুরে। সাড়ে আটটা বাজে, এইবারে লেট লাঞ্চ করলেও চলবে। এগনো যাক।
আরেকটু এগোতেই শেষ হল উত্তরপ্রদেশের সীমা। বিহারের শুরু এখান থেকেই – সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, আর, আর –
কাশবন। দিগন্তবিস্তৃত, চরাচর ছেয়ে ফেলা কাশের সারি। যতদূর চোখ যায় – শুধু কাশ আর কাশ। চারিদিকে আর কেউ কোত্থাও নেই, কিচ্ছু নেই। এক জায়গায় বোর্ডে লেখা – গোপালগঞ্জ। দাঁড়ালাম, দাঁড়াতেই হয় এমন অপূর্ব শোভার সামনে। ছবি তোলার একটু চেষ্টা করলাম, তবে মনে হল না ক্যামেরা এ সৌন্দর্য ধরতে পারে।
আবার এগোনো। একে একে পেরিয়ে গেল গণ্ডক নদীর ওপর মাঝারি ব্রিজ, তার পর এল মুজফফরপুর। তার পর কত নাম না জানা জায়গা – রাস্তা ভালো মন্দয় মিশিয়ে, কিন্তু চারপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ, ধীরে ধেরে পূর্বভারতের চেনা মাঠঘাট খালবিল চোখে পড়ছে, তালগাছের সারি, খড়ে ছাওয়া কুঁড়েঘর ইতস্তত, তার মধ্যেই পার হয়ে যাওয়া কিছু গঞ্জ, শহর, আধা শহর। অবিরাম চলা। দারভাঙা এল, কোশী নদী পেরোবার পরে ফোর্বসগঞ্জ এল, তার পরে আরারিয়া এল, আমি এখন নেপালের বর্ডারের খুব কাছ দিয়েই যাচ্ছি। আরারিয়ার পরে রাস্তা ঘুরে গেল খানিক দক্ষিণের দিকে, পুর্ণিয়া ঢুকলাম বিকেল তখন তিনটে।
খাওয়া উচিত? নাঃ, খিদে পায় নি খুব একটা। সামনের হোর্ডিংয়ে পর পর দূরত্বগুলো দেখাচ্ছে জায়গাগুলোর – এর পরেই আসবে বারসোই, ডালখোলা, কিষেণগঞ্জ। শিলিগুড়িরও নাম আসছে, এমনকি গুয়াহাটি বা ডিমাপুরেরও নাম দেখছি কয়েকটা বোর্ডে। এই ন্যাশনাল হাইওয়ে শিলিগুড়ি পেরিয়ে আসাম হয়ে চলে গেছে সোজা নাগাল্যান্ডের দিকে। নামগুলো চোখে পড়লেই খিদেতেষ্টা সব ভুলে যাই, কেবল মনে হয় চলতেই থাকি, চলতেই থাকি। … দেখি, আরেকটু এগোই – খাবার জায়গা অনেক থাকবে নিশ্চয়ই আগে।
এর পরের রাস্তা আমার খানিক চেনা, কলেজের যখন পড়তাম, তিস্তা তোর্সা, কামরূপ, সরাইঘাট – এরা সব এই রাস্তা ধরেই আসত যেত। মানে – এখনও এই রুট ধরেই আসে যায় হাওড়া-শিয়ালদাগামী সমস্ত ট্রেন। রাস্তার পাশ দিয়েই রেললাইন থাকার কথা। কিষেণগঞ্জের সেই অখাদ্য পরোটা তরকারি যে কতবার খেয়েছি পাঁচ টাকায় দশ টাকায়। সেই খেয়েই রাত কাটাতাম, বিনা টিকিটে দল বেঁধে বাড়ি আসার সময়ে।
ডালখোলা আসার আগে রাস্তার অবস্থা বিশালভাবে খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়েই স্পিড কমাতে হল। ডালখোলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ-বিহারের বর্ডার। সুবিশাল একখানা ক্রেটার, পাশে একটা ফ্লাইওভার বানানো চলছে – কে জানে কতদিন ধরে। চতুর্দিকে অগুনতি ট্রাকের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম জ্যাম কাটার আশায়। অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না, খানিক বাদেই আমার দিকের ট্র্যাফিক খুলে গেল, এবং এই ট্রাক সেই ট্রাকের ফাঁকফোঁকর দিয়ে লাগেজসমেত নাচতে নাচতে পেরিয়ে গেলাম রাস্তাজোড়া সেই সুবিশাল গর্ত। পশ্চিমবঙ্গে চাকা রাখল আমার বাইক। প্রথমবার।
গর্তময় রাস্তার পাশেই বাজার বসেছে। বাংলা-হিন্দি মেশানো টুকটাক কথা কানে আসছে, আর চোখে পড়ছে বাজারে মাছের আধিক্য। ম ম করছে পরিবেশ মাছের গন্ধে – সেই বাজার পেরিয়ে আসার খানিক পরে আবার রাস্তা ঠিক হল। সাড়ে পাঁচটা বাজে, দিনের আলো এবার নিভে আসছে। এখন আমি পূর্বভারতে চলে এসেছি, এখানে দিল্লির থেকে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়।
বারসোইয়ের পর কিষেণগঞ্জ। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছি, তবে এ রাস্তা চলেছে খানিক বিহার, খানিক পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে – ক্ষণে ক্ষণে বর্ডারের এপার ওপার করে চলেছে রাস্তা, সে প্রতিটা মোড়ে দাঁড় করানো পুলিশের ব্যারিকেড দেখে বুঝতে পারছি, কখনও ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ, কখনও বিহার পুলিশ। চারপাশের দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলার থেকে হিন্দিভাষারই আধিক্য বেশি।
আর দেখছি, গামা গামা প্যান্ডেল। দিল্লির দিওয়ালি, বাংলায় কালীপুজো। তা সে জিনিস মিটে গেছে দুদিন আগে, উনিশে অক্টোবর, কিন্তু বাংলার বুকে উৎসবের রেশ কাটে নি এখনও। রাস্তার এদিকে ওদিকে বিশাল বিশাল কালীপুজোর প্যান্ডেল, আগেপিছে এক কিলোমিটার করে তার টেনে মাইকে চলছে বিকট উচ্চারণে শ্যামাসঙ্গীত, অথবা লাকি ড্র-এর বিজেতাদের নাম ঘোষণা।
বাংলায়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুদিনের মাথায় প্রথম বাংলা ভাষার গান, বাংলাতে ঘোষণা শুনে কেমন যেন একটা হতে থাকল মনের মধ্যে। পুরনো দিনের অনেক অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসতে থাকল। এই ভাষা বোধ হয় আমার আপনজনের থেকেও আপন। সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল। হলেই বা বিকট উচ্চারণ, নাই বা হল পান্নালাল, তবু বাংলা গান তো – প্যান্ডেলের পর প্যান্ডেলে সেইসব শুনতে শুনতে এক সময়ে এসে গেল কিষেণগঞ্জ। এর পরের জায়গাগুলো আমার ভীষণ চেনা – পাঞ্জিপাড়া, ধানতলা, ইসলামপুর। শিলিগুড়ি প্রায় এসে গেছে – জিপিএসে দেখাচ্ছে আমার হোটেল আর ঠিক পঁয়ষট্টি কিলোমিটার, আর রাস্তার ওপরে ন্যাশনাল হাইওয়ের হোর্ডিং দেখাচ্ছে শিলিগুড়ির সাথে সাথে জলপাইগুড়ি, গুয়াহাটি, গ্যাংটকের দূরত্ব। সারাদিনে যে আমি দুটি পরোটা আর একটা ডবল ডিমের অমলেট ছাড়া আর কিছুই খাই নি, খিদে পাওয়া উচিত – পুরো ভুলে গেলাম সেই মুহূর্তে।
ইসলামপুরের শেষে জিপিএস হঠাৎ করে আমাকে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, সরু রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল। এক ফোঁটা আলো নেই, চারদিকে উঁচু উঁচু গাছের দল। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি যাচ্ছে, আসছে – কিন্তু তাদের কারুরই ডিপার ব্যবহার করার অভ্যেস নেই। আমি একা বেকার বেকার হেডলাইটের সুইচ দিয়ে ব্লিঙ্ক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কেউ তাতে ভ্রুক্ষেপও করল বলে মনে হল না – সব্বাই হাই বিমে হেডলাইট আমার চোখের দিকে তাক করে এল-গেল।
রাস্তাটা আমাকে নিয়ে এল বাগডোগরা। এয়ারফোর্সের এরিয়া, মাটিগাড়া। কলেজ থেকে একবার এসেছিলাম এখানে, এয়ারফোর্সের পরীক্ষা দিতে, চান্স পাই নি অবভিয়াসলি, মানে আমাদের কলেজ থেকে কোনও বছরই কেউই চান্স পায় না, তাও বাসে করে নিয়ে আসা হত, পরীক্ষা নেওয়া হত, আর পরীক্ষার শেষে সব্বাইকে রিজেক্ট করে দেওয়া হত, প্রত্যেক বছর।
রাস্তায় এবার আলো আছে, রাস্তাটাএকটু চওড়াও হয়েছে, সামনেই ডানদিকে বাগডোগরা এয়ারপোর্টের রাস্তা, ঝলমল করছে মোড়ের মাথাটা। এয়ারপোর্ট পেরোতেই, একটা বিশাল বড় মোড়, চারপাশের দোকানপাটের সাইনবোর্ডে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, মোড়টার নাম বর্ধমান মোড়, শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি শহরের শুরু। বর্ধমানে যেমন একটা আছে দার্জিলিং মোড়, তেমনি শিলিগুড়িতে এইটা বর্ধমান মোড়। আবছা আবছা মনে পড়ল, এসেছিলাম এইদিকে বার কয়েক, কলেজ থেকে।
শহর শুরু হয়ে গেছে। আঠেরো বছর আগে যে শহর দেখে গেছিলাম – সে ছিল আধাখিচুড়ি একটা না-মফসসল না-শহর। হিলকার্ট রোড বরাবর উঁচু উঁচু পাকা বাড়িঘর, আর হিলকার্ট রোড পেরিয়ে এদিক ওদিক ঢুকলেই গ্রাম্য পরিবেশ ছিল। এখন সেই শিলিগুড়িকে রাতের আলোয় দেখে কলকাতা বলে ভ্রম হয়। রাশিরাশি গাড়ি, শপিং প্লাজা – কী নেই?
কতটা তফাত জানেন? আমি যখন উত্তরবঙ্গ ছাড়ি, সেই ১৯৯৯ সালে, তখন খোদ কলকাতা শহরেই কুল্লে দশটার বেশি এটিএম ছিল না। মোবাইল ফোন তখন সদ্য এসেছে – যাদের হাতে মোবাইল থাকত, তারা সেটিকে জামার বুকপকেটে রেখে ফ্লন্ট করত, আর সেই তখনকার মোবাইল ফোনের মাথায় টিকির মত অ্যান্টেনা থাকত। ইনকামিং কলে চার্জ লাগত। সেই জমানায় আমি শেষ দেখেছি শিলিগুড়িকে।
এখন শিলিগুড়ি অনেক বেশি রঙীন। রাস্তায় প্রচুর ট্র্যাফিক। তখন শুধু রিক্সা চলত, এখন রিক্সা আর চোখে পড়ছে না, কেবলই অটোরিক্সার সারি। তুমুল ট্র্যাফিক।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। দূরে সিগন্যালটা দেখা যাচ্ছে লাল হয়ে রয়েছে, গাড়ির লাইন পৌঁছে গেছে এই অবধি। সিগন্যাল সবুজ হতে এখনও সাতাশি সেকেন্ড – বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম। ঠিক সেই সময়েই একটা আপাচে আরটিআর চালিয়ে একজন আমার কাছাকাছিই এসে দাঁড়াল। তারও পেছনের সীটে লাগেজ বাঁধা – সেই ভায়াটেরা ক্ল (যে স্যাডল ব্যাগ নিয়ে আমি লাদাখ স্পিতি ঘুরে এসেছি)।
ট্র্যাভেলার। বাইকার। কিন্তু গ্রুপ আছে, না একা? এদিক ওদিক দেখলাম, আর কোনও বাইকারকে দেখতে পেলাম না। মনে হল একাই। তখনই দেখি – সে আমাকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করছে। আমি হেলমেটের কাচটা তুললাম – ছেলেটা জিজ্ঞেস করছে আমাকে, সোলো?
আমি তার বাইকের নাম্বারপ্লেটের দিকে তাকালাম। কর্ণাটকের নম্বর। বললাম, ইয়েস, ইউ টু?
ছেলেটা হেলমেটের ভেতর থেকেই হাসল, ইয়া, টুডে কামিং ফ্রম ক্যালকাটা, গোয়িং টু ভূটান। আর ইউ অলসো গোয়িং টু ভূটান?
বলে কী! কলকাতা থেকে এসেছে মানে, কিছু না হোক সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার চালিয়ে এসেছে। ভূটান, মানে জয়গাঁও তো এখান থেকে আরও দেড়শো কিলোমিটার। বাজে রাত পৌনে আটটা। এখন জয়গাঁও যেতে চায় – এ কি পাগল?
পাগলই বটে। সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছিল, আমি ওকে বললাম, সিগন্যালটা পেরিয়ে সাইডে দাঁড়াও, আমি যাচ্ছি, ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।
সিগন্যাল পেরিয়ে সাইডে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, সে-ও সোলো। মানে একাকী। ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছে। সেখানে একটা ছোট স্টার্টাপ সংস্থায় কর্মরত। কী রেঞ্জের পাগল, বলে ব্যাঙ্গালোর থেকে ভুবনেশ্বর নাকি একদিনে এসেছে, দেড় হাজার কিলোমিটার। মানে –
আমি যে দূরত্ব এসেছি এই দুদিনে, সেটা সে একদিনে চালিয়েছে। বললাম, তুমি কি পাগল? একদিনে দেড় হাজার কিলোমিটার – কতক্ষণে কভার করেছো?
ছেলেটা এক গাল হেসে বলল, বাইশ ঘণ্টায়।
বাইশ ঘণ্টায় পনেরোশো কিলোমিটার – মানে, গড়ে সত্তর কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়! একটানা! এ ছেলে ভূটান কেন, চাইলে আজ রাতেই চীনেও চলে যেতে পারে। ছেলেটি নিজের পরিচয় দিল, সোনি গুপ্তা, ভোপালের ছেলে, চাকরিসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। খুব করুণ মুখ করে বলল, কলকাতায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে, নইলে কখন চলে আসতাম। ভুবনেশ্বর থেকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে চালিয়ে এসেছি বলে কলকাতার বেশি এগোতেই পারি নি কাল।
কলকাতা সমেত দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি চলেছে কালীপুজোর দিন থেকে, সে আমি খবরেই দেখেছি। বললাম, সে না হয় করেছো, কিন্তু এখন ভূটান গিয়ে করবে কী? আজ তো শনিবার। কাল রবিবার, কাল ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ থাকবে। আজ পৌঁছেও তুমি কাল ভূটান ঢুকতে পারবে না, তোমাকে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
সোনি গুপ্তা এতকিছু খবর নিয়ে আসে নি, সে দৃশ্যতই হতাশ, তা হলে?
বললাম, আজ শিলিগুড়িতে থেকে যাও না, কাল চলে যেও জয়গাঁওতে।
কিন্তু সে তাতে রাজি নয়। বলল, আমি বরং আজ গ্যাংটক চলে যাই, তুমিও কি আজ রাতেই গ্যাংটক যাচ্ছো?
আমি হেসে ফেললাম, না বস, আমার কাল সকালের প্ল্যান। আমি আজ শিলিগুড়িতেই থাকব। এই সামনেই হোটেল, জিপিএস বলছে আর দেড় কিলোমিটার দূরত্বে।
– আর গ্যাংটক মাত্র দেড়শো কিলোমিটার – নো ম্যান, আই ক্যান রিচ দেয়ার টুনাইট।
যথাসম্ভব নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম, শোনো সোনি, একে রাত হয়েছে, তার ওপরে এর পরেই পাহাড়ি রাস্তা শুরু হবে, এটা তোমার প্লেনল্যান্ড নয়, যেভাবে হিসেব করছো, তোমার গ্যাংটক পৌঁছতে পৌঁছতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। কেন অত চাপ নিচ্ছো?
সোনি সে কথার উত্তরই দিল না, – ম্যান, তোমার নাম্বারটা পেতে পারি? কাল যদি তুমি গ্যাংটক আসো তো কাল দেখা হয়ে যাবে। উই ক্যান দেন প্ল্যান টুগেদার।
নম্বর দিলাম। বললাম, আরেকবার ভেবে দ্যাখো। শিলিগুড়ির পরে কিন্তু সেই গ্যাংটকেই হোটেলের অপশন পাবে। না গেলে যদি চলে, থেকে যাও। আমি কাল দুপুরের পরে গ্যাংটক পৌঁছব। তুমি কি তা হলে ভূটান যাচ্ছো না?
সোনি মহা উত্তেজিত হয়ে বলল, না না, আমি তো কালকেই গ্যাংটক থেকে ফুন্টশোলিং চলে যাবো। … আমি আবার তাকে বোঝালাম, বস, কাল রোববার। কাল তুমি জয়গাঁওই যেতে পারবে। ফুন্টশোলিং পরশু।
নম্বর টম্বর নিয়ে সোনি এগিয়ে গেল গ্যাংটকের দিকে, আমি জিপিএস দেখে দেখে পরের টার্নেই ডানদিক নিলাম। হিলকার্ট রোড শুরু হল। এখানেও বোধ হয় একটা ফ্লাইওভার বানানোর চেষ্টা চলছে, খানিক ডাইভার্সনের মধ্যেই বেশ কয়েকটা বুলেট ইত্যাদি দেখে ফেললাম, বাইকারদের একটা দল শিলিগুড়িতে ঢুকছে, ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম্বারপ্লেট, জানি না কোথা থেকে এসেছে। একটু এগোতেই জিপিএস আমাকে বাঁদিকের একটা সরু গলিতে ঢুকিয়ে দিল। হোটেলের দূরত্ব বলছে আর মাত্র পাঁচশো মিটার, সামনে গিয়ে ডানদিকে বাঁক, তার পরে আবার ডানদিকে টার্ন নিলেই হোটেল। তো, প্রথম ডানদিকের টার্ন নিতেই একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য সামনে দেখে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল।
একটা ছোট্ট কালীপুজোর প্যান্ডেল, আর তার সামনে একদল ছেলেবুড়োজোয়ানমদ্দ খুব নাচছে, খুব। অথচ গলির ভেতরটা পুরো নিঃশব্দ। কোথাও কোনও মাইক বা বক্স বাজছে না, নীরবতার মধ্যে, কারুর মুখে কোনও কথা নেই, কিন্তু নেচে যাচ্ছে সবাই। রাস্তা জুড়ে। মোটামুটি একই ছন্দে। কেসটা কী? আমি যে একটা লাগেজবোঝাই মোটরসাইকেল নিয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রায় তাদের সামনে এসে পড়েছি, তাদের জাস্ট কোনও খেয়াল নেই। একটু এগোবার চেষ্টা করতেই একটা বাচ্চা ছেলে নাচের ঝোঁকে পুরো আমার সামনের চাকার ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে উলটে পড়ল, অমনি সবাই সজাগ হয়ে গেল, এই বাপন, কী করিস? দেখতেসিস না মোটরসাইকেল আসতেসে?
আআহ্! শিলিগুড়ির বাংলা ডায়ালেক্ট। আর তখনই আমি আবিষ্কার করলাম এদের নাচের রহস্য। এদের প্যান্ডেলে লাইট চলে গেছে, বক্স বাজছে না, তাই বলে তো ফুর্তি বন্ধ করা যায় না, তাই একজন মোবাইলে গান চালিয়ে দিয়েছে, আর সেই গানের তালে সবাই নাচছে। এখন, একটু দূর থেকে আমি সেই গান শুনতে পাচ্ছি না, আমার মাথায় হেলমেট, কান চাপা, ফলে ওইটুকুনি মোবাইলের আওয়াজ তো আমার কানে আসছিল না – তাই মনে হচ্ছিল সবাই এমনি এমনি নাচছে।
বাপন নামের বাচ্চাটিকে সরিয়ে দিয়ে ছেলেরা আমাকে জায়গা করে দিল, আমি এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিতেই হোটেল দেবজ্যোতিতে পৌঁছে গেলাম।
হোটেলটা আগে থেকে বুক করে রাখা ছিল, তাই কিছু করার ছিল না, কিন্তু গতকাল রাতেই মেকমাইট্রিপে এমন একটা প্যারাগ্রাফ চোখে পড়ে গেছিল হোটেলটার বুকিং কনফার্মেশন চেক করতে গিয়ে, মাথা গরম হয়ে গেছিল। মরাল মেসোমশাই হবার অভ্যেসে বাঙালি কোনও অংশে যে কম নয়, তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ এই হোটেল দেবজ্যোতি।
হোটেলটি ভালো, ছিমছাম, পার্কিং বেশ বড়সড়। হোটেলের একটি ছেলে বলল, চিন্তা করবেন না, আমাদের সিসিটিভি লাগানো আছে, আপনার যেটুকু লাগেজ দরকার, সেটুকু খুলে নিন, বাকিটা এখানেই বাঁধা থাক, কিচ্ছু হবে না। পেট্রলের ক্যানও ছেড়ে যেতে পারেন। কেউ নেবে না।
রাতের পরার জামাকাপড় সমেত একটা ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। দক্ষিণবঙ্গ নাকি বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, শিলিগুড়িতে বৃষ্টি নেই, তবে ঠাণ্ডাও নেই। অবশ্য এখনও ঠাণ্ডা পড়ার সময় হয়ও নি।
হোটেলেই অর্ডার দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম। এর পর ঘুম। কাল তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই। এখান থেকে গ্যাংটক মাত্রই একশো দশ কিলোমিটার। বেরোলেই পৌঁছে যাবো। কাল বরং সকালে উঠে প্রথমে মেকানিক দেখে ফগলাইটটা মাউন্ট করতে হবে। ওটা এখন প্রায়োরিটি।
হোয়াটস্যাপ খুলে সোনি গুপ্তাকে মেসেজ করলাম – কোথায় পৌঁছলে?
পরদিন সকালে তার উত্তর পেয়েছিলাম, দেখুন সে কোথায় পৌঁছে গেছিল সেই রাতে।
পাগল কত রকমের হয়!
3 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৩”