প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের পর
২২শে অক্টোবর, তৃতীয় দিন
ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু এত সকালে তো করার কিছু নেই। খানিক ফেসবুক, খানিক হোয়াটস্যাপ সেরে আটটা নাগাদ মনে পড়ল উগিয়েনকে ফোন করতে হবে।
উগিয়েনের সঙ্গে আমার আলাপ, মানে ভার্চুয়াল আলাপ ভুটানের পারমিটের খোঁজখবর করতে গিয়েই। কয়েক দিন আগেই বাংলা এক কাগজে একটি মেয়ের গল্প বেরিয়েছিল, সে স্কুটিতে করে কলকাতা থেকে ভুটান ঘুরে এসেছে – খোঁজ নিয়ে জানা গেল মেয়েটি আমার এক বন্ধুর স্ত্রীয়ের বন্ধু। ফোন নম্বর জোগাড় করতে সময় লাগল না, এবং তার পরে মেয়েটির সাথে কথা বলে তার কাছ থেকেই উগিয়েনের নম্বর পেয়েছিলাম। হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ, এবং যখন আমি জয়গাঁওয়ের বিভিন্ন রকমের এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে সন্তোষজনক আশ্বাস না পেয়ে রীতিমত তিতিবিরক্ত, তখন এই উগিয়েনই আমাকে বলেছিল, আমি তোমার অনলাইন পারমিটের ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হবে টবে না, একেবারে স্মুথ হবে তোমার ভুটান এন্ট্রি। তুমি শুধু আমাকে পাসপোর্টের কপিটা পাঠিয়ে দিও।
দিয়েছিলাম। তার পরে আলাপ করে জেনেছিলাম উগিয়েন ট্রেকিং করে। বলেছিল – আমি তো কুড়ি একুশ পর্যন্ত ট্রেকিং দলের সাথে থাকব, তুমি আমাকে বাইশ তারিখে একবার হোয়াটস্যাপ করে রিমাইন্ডার দিয়ে দিও, আমি তোমার পারমিটের জন্য অনলাইন অ্যাপ্লাই করে দেব, তিন থেকে চারদিনে, তোমার ভুটান আসার অনেক আগেই তোমার হাতে পারমিট থাকবে। তুমি শুধু ফুন্টশোলিংয়ে পারমিট দেখাবে আর পারোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে।
আজ সেই বাইশ তারিখ, অতএব, উগিয়েনকে হোয়াটস্যাপ করে রিমাইন্ডার দিলাম, সাথে সাথে তার উত্তর এল, হ্যাঁ, সে আজকেই আমার পারমিটের জন্য অ্যাপ্লাই করে দেবে।
সোয়া আটটা নাগাদ দাঁত টাঁত মেজে বেরনো গেল। চায়ের নেশা আমার নেই – জাস্ট এমনিই উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটু এদিক ওদিক ঘুরে এলাম, শিলিগুড়ি জেগে গেছে অনেক আগে, চওড়া হিলকার্ট রোড তখন গাড়িতে পরিপূর্ণ, তার চারপাশে লোহাবাঁধানো ফুটপাথ হকারে ভর্তি, তারা উপচে পড়েছে রাস্তার ওপরেও, অটোওলাদের এলোপাথাড়ি দাঁড়িয়ে পড়া, তার মাঝেই দেখছি রাস্তার ধারে সারি সারি টাটা সুমো দাঁড়িয়ে আছে, তাদের গায়ে লেখা সিকিমের আর জলপাইগুড়ির বিভিন্ন জায়গার নাম – মঙ্গন, গ্যাংটক, জোরথাং, রোরাথাং, মালবাজার, বীরপাড়া, হাসিমারা। আর দেখছি এনবিএসটিসির ছোট ছোট মিনিবাস চলছে – সেখানে লেখা শিলিগুড়ি-পানিট্যাংকি, কিন্তু লেখা হিন্দিতে। পানিট্যাংকি নেপালের বর্ডার, কিন্তু জায়গাটা তো ভারতের মধ্যেই, তাও যে কেন উত্তরবঙ্গ পরিবহনের এই বাসটা হিন্দিতে বোর্ড লাগিয়ে ঘুরছে, কে জানে।
রাস্তার ধারে ছোট ছোট খাবার দোকানে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে, তাদের কেউ বেরিয়েছে ব্যবসার কাজে, কেউ ট্যুরিস্ট, কেউ ট্রেকার, কেউ বাইকার। আমিও তাদের একজন হয়ে ঢুকলাম, আহা, এত সুন্দর বানিয়েছিল ঘুগনি আর পরোটাটা – খান সাতেক খেয়ে তবে থামলাম। হোটেলে সাবান দিয়েছে, তবে শ্যাম্পু দেয় নি – অতএব পাশের দোকান থেকে দুটো শ্যাম্পুর পাতাও কিনতে হল – টানা দুদিন ধরে মাথায় হেলমেট চাপিয়ে রেখে চুল একেবারে চিটচিটে হয়ে গেছে। ফুটপাথে জনসমাগম বাড়ছে – গাঁদাফুলের মালা, খবরের কাগজ আর চুল কাটার লোক পাশাপাশি বসে তাদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ করছে – মানে, দেখে বোঝাই যাচ্ছে না এটা কলকাতার মানিকতলা না শিলিগুড়ি।
হোটেলে ফিরলাম, জম্পেশ করে চান টান সেরে এইবারে মোটরসাইকেলটা নিয়ে বেরোলাম। রিসেপশনের লোকটা বলল, এই এদিক দিয়ে সোজা চলে যান, দু নম্বর সিগন্যাল পেরোলেই সেবক মোড় পাবেন, ওখান থেকে বাঁদিকে ঘুরলে অনেক গাড়ি রিপেয়ারিংয়ের দোকান দেখতে পাবেন।
গেলাম। দোকানও দেখলাম, কিন্তু একটা দোকানও খোলা পেলাম না। কিছু খাবারের জায়গা আর ওষুধের দোকান বাদ দিলে পুরো শিলিগুড়ি বেলা দশটার সময়ে আটকাঠ বন্ধ। কারণ? কারণ আজ রোববার। টিপিকাল কলকাতা। গাড়ি রিপেয়ারিং শপগুলোও যে ঠিক কেন বন্ধ, আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা বেলা এগারোটার সময়ে খোলে। তবে আজ খুলবে কিনা শিওর নয়।
ধুত্তেরি বলে অবশেষে ফিরে এলাম হোটেলেই, বাঁদিকের ফগলাইট সেই স্ক্রু-খোলা অবস্থায় ঝুলতেই থাকল, ফেরার আগে হিলকার্ট রোডের ধারেই একটা পেট্রল পাম্প থেকে বাইকের ট্যাঙ্ক ফিল আপ করে নিলাম। হোটেলে পৌঁছে লাগেজ সমস্ত বাঁধাছাঁদা সেরে ছোট্ট করে একটা ফটোসেশন, তারপরে মোটামুটি পৌনে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ফাইনালি গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়িতে ফেরার আর গল্প নেই।
কয়েক কিলোমিটার এগোতেই জনবসতি কমে এল, আর তখনই চোখে পড়ল রাস্তার বাঁদিকে একটু ঢালু, আর সেই ঢালু জমির শেষে পর পর কয়েকটা মোটরসাইকেল সারানোর দোকান। দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই একটা ছেলে দৌড়ে এল, আর ঠিক তিরিশ সেকেন্ডে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আবার দৌড়ে গেল দোকানের ভেতর, মাপমত স্ক্রু-নাট নিয়ে চটপট ফিক্স করে দিল ফগলাইট। মাত্র কুড়ি টাকা আর দশ মিনিট সময়। ঘড়িতে বাজে বারোটা দশ। আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম এবং চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই একটা অসাধারণ সুন্দর গাছে ঢাকা রাস্তার মাঝে চলে এলাম। সেভক ফরেস্ট। চারদিক সবুজে ঢাকা, আর তার মাঝখান দিয়ে রানওয়ের মত মসৃণ রাস্তা। অল্প এঁকেবেঁকে চলেছে।
শিলিগুড়িতে এসে ইস্তক দেখছি বেশ চোখে পড়ার মত ভুটানের গাড়ি। প্রাইভেট গাড়ি, বাস, ট্রাক। লাল রঙের নাম্বারপ্লেট হয়, চেনা খুবই সহজ। আবহাওয়া দিব্যি মনোরম। কিছু বাইকারও দেখছি, বিদেশী নাম্বারপ্লেট, পেছনে ছোট্ট করে সুইটজারল্যান্ডের পতাকা লাগানো, দুই সুইস নাগরিকই হবে, দুই না, তিন – দুজন পুরুষ, একজন মেয়ে – তিনটে সুইস মোটরসাইকেলে করে তারাও চলেছে গ্যাংটকের দিকে।
একটু পরেই সেই মনোরম জঙ্গলের রাস্তা শেষ হল, পাহাড় শুরু হল। আরও খানিক বাদে বাঁক ঘুরতেই চোখের সামনে চলে এল করোনেশন ব্রিজ। গ্যাংটক যাবার জন্য ব্রিজে ওঠার দরকার নেই, পাশ দিয়ে রাস্তা বেরিয়ে গেছে রংপোর দিকে, সেই রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। সকালের পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, কিন্তু গ্যাংটক – মানে, রানীপুল দেখাচ্ছে আর মাত্র পঞ্চান্ন কিলোমিটার, একেবারে গিয়েই খাবো না হয়!
হোমস্টের মালিকটি বেশ ভাল, চলতে চলতেই একবার তাঁর ফোন পেলাম, স্পষ্ট ইংরেজিতে বেশ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন রানীপুল এলাকায় এলেই যেন তাঁকে একবার ফোন করে নিই। কারণ হোমস্টে-টা, মানে তাঁর বাড়ি, ঠিক গ্যাংটক যাবার মেন রাস্তায় পড়ে না, ওটা রানীপুল থেকে একটা এক কিলোমিটারের ডাইভার্সন আছে।
আড়াইটে নাগাদ রানীপুলে পৌঁছলাম। একবার ফোন করে ভদ্রলোকের কথামত বাঁদিকে গ্যাংটকের রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে টার্ন নিলাম। রানীপুলের বাজার এলাকা ছাড়িয়ে একটা ছোট সাদা রঙের ব্রিজ, পাতলা একটা নদীর ওপরে – এটাই রোরো নদী।
বাড়িটা নদীর অন্য পারে, কিন্তু যে জায়গায় বাড়ি, সেইখান পর্যন্ত বাইক যাবে না। তাই নদীর এইপারে বাইক পার্ক করে লাগেজ নিয়ে যেতে হবে ঐ পারে। ছবির মত সুন্দর একটা পায়ে চলার কাঠের পুল – অনেকটা আমাদের লছমনঝুলার মিনিয়েচার ভার্সন, সেইটা পেরিয়ে রাশিরাশি গাঁদা আর টিউলিপ ফুলের ঝাড়ি পেরিয়ে ছোট্ট একটা বাড়ি। লাল রঙের দোতলা বাড়ি। আশেপাশে অবশ্য আরও অনেক বাড়ি আছে, তবে এই বাড়িটা, হয় তো লাল রঙের জন্যই চোখে পড়ে। বাড়িতে ঢোকার মুখেও সুন্দর বাগান, নানা রঙের ফুল সেখানে। গৃহস্বামী আর স্বামিনী আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মধ্যবয়েসী লোকটির মাথায় নেপালি টুপি, কথায় কথায় জানালেন, এথনিসিটির দিক দিয়ে, তাঁরা নেপালিই – এই এলাকাটাই নেপালিদের।
খিদে পেয়েছে খুবই – কিন্তু সে কথা বলার আগেই ভদ্রলোক বলে বসলেন, আপনি নিশ্চয়ই এখন লাঞ্চ আর করবেন না। আমাদের দিওয়ালির কিছু মিষ্টি আছে, খান। স্ত্রীকে বললেন চা করে দিতে।
কী আর বলব, এর পরে আর লাঞ্চ চাওয়া যায় না। মনে ভাবলাম, কেন খেয়ে ঢুকলাম না একেবারে।
মিষ্টি যা এল, সে মানে, যাকে বলে নিদারুণ। কে জানে, নেপালি মিষ্টি এ রকমেরই হয় কিনা। খানিকটা ঠেকুয়া ঘেঁষা – মনে হল ছানার জিলিপিকে টানা দেড় বছর রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানালে যা হয়, সেই রকমের টেস্ট। অতি বিকট খেতে। – এ তো আর হোটেল নয়, লোকের বাড়ি, অতএব, সোনামুখ করে কোনওমতে সেই দুটো জিনিস গলার্ধকরন করলাম। এর পরে চা। একটু নোনতা কিছু দিলেও মুখটা ছাড়ত – মানে, লোকের মাথায় এত কম বুদ্ধি যে কেন হয় – মিষ্টির পরে চা দিলে কি আর চায়ে মিষ্টি লাগে?
আমার ঘর দোতলায়। সেখানে লাগেজ তুলে আবার নিচে এসে বসা গেল, একটু আলাপ করি হোমস্টে মালিকের সঙ্গে।
ভদ্রলোক এলআইসির এজেন্ট, দীর্ঘদিন সিকিমের বাসিন্দা, ভূমিপুত্রই বলা যায়। এখানে রো রো নদীর ধারে বাড়িটি বানিয়েছেন সে-ও প্রায় অনেক বছর হল, দোতলায় পর পর কয়েকটা ঘর, হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দেন, নিচের তলায় নিজেরা থাকেন। একটি ছেলে, সে ক্লাস এইটে পড়ে। তার মা জানালেন, এই রো রো নদী আসলে তৈরি হয়েছে ছাঙ্গু লেকের জল থেকে। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে গ্যাংটকের পাশ দিয়ে রানীপুল পেরিয়ে খানিক এগিয়ে এই ছোট্ট নদীটা পড়েছে গিয়ে তিস্তায়।
তরাই ডুয়ার্সে এ রকম অনেক ছোট ছোট নদী তৈরি হয়। জলপাইগুড়িতে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই এ রকম দুটো নদী আছে, – রুকরুকা আর চুকচুকা। কলেজ লাগোয়া ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সে চা বাগানে সেচ করা জল থেকে এই নদীদুটো তৈরি, খানিক এঁকেবেঁকে এগিয়েই তারা গিয়ে পড়েছে পাশের করলা নদীতে। পাহাড়ে হলে এই নদীগুলোকেই ঝোরা বলে। রো রো, সেই রকমেরই একটা ঝোরা।
ক্রমশ বুঝলাম, হোমস্টে-র মালিকের একটু অভ্যেস আছে সিচুয়েশন নিজের কন্ট্রোলে রাখার এবং সকলের হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবার। আমি চাই কিনা, সেটা না জিজ্ঞেস করেই উনি যেমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আমি লাঞ্চ খাবো না, তেমনি উনিই আমার বাকি দিনের ইটিনেরারি তৈরি করে দিলেন। – একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, তার পরে এলাকাটা একটু ঘুরে দ্যাখো, সানসেটের সময়ে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো এখানকার শিবজির মন্দিরে, এই এখান থেকে একটু আগেই, আমাদের গ্রামের মন্দির, খুব সুন্দর। … এমনিতে আমাদের গেস্টদের খাবার এই পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা তৈরি করে দেন, তবে এখন তো দিওয়ালির সিজন চলছে, আমাদের নেপালিদের কাছে দিওয়ালি খুব খুব বড় উৎসব, দেখি একবার জিজ্ঞেস করে – উনি ছেলেকে পাঠালেন পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করার জন্য, ছেলে খানিক বাদে ফিরে এসে জানালো আন্টি থাকছেন না, তাই উনি বানাতে পারবেন না – সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে বললেন, তা হলে তুমি আমাদের সাথেই রাতে ডিনার করে নিও, আমরা সাড়ে সাতটাতেই ডিনার করি, আশা করি তোমার অসুবিধে হবে না।
কী মুশকিল! এমনিতে আমার রাত সাড়ে দশটার আগে খাবার খাবার অভ্যেস নেই, তবে রাস্তায় বেরিয়ে ঘরের অভ্যেস তো চলে না, এদিকে দুপুরে পেটভরে খাওয়াও জোটে নি, তাই রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হলে এমনিতে অসুবিধে নেই, কিন্তু সাড়ে সাতটায় তো আমি সন্ধ্যের চা-ও খাই না এমনিতে! কোনওরকমে তাঁকে থামিয়ে বললাম – আটটায় করলে চলবে?
উনি বোধ হয় কাউন্টার-প্রশ্ন আশা করেন নি। দৃশ্যতই বেশ অসন্তুষ্ট মুখে বললেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
একশো দশ কিলোমিটার চালিয়ে খুব কিছু ক্লান্তি আসে না, বিশেষত যে আগের দুদিনে দেড় হাজার কিলোমিটার চালিয়ে এসেছে। দোতলায় গিয়ে পোশাক অল্প বদলে তাই ক্যামেরা নিয়ে নিচেই নেমে এলাম। ছবির মত সুন্দর জায়গাটা, ছোট্ট পুল, রো রো নদী আর আশেপাশের ঘিরে থাকা পাহাড়েরা মিলিয়ে সৌন্দর্য আপ্রাণ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করলেও বেরসিকের মত এখানে ওখানে হাইটেনশন তারের টাওয়ার আর খাপচা খাপচা বাড়িঘর, সেই সৌন্দর্যকে যথাসম্ভব নষ্ট করে ফেলেছে। কী আর করা, এ তো গ্যাংটকের গা ঘেঁষা, এখানে তো জনবসতি ঘন হবেই, আর জনবসতি বাড়লে সভ্যতার বাকি অভিশাপরাও আসবে।
ঠিক পাঁচটার সময়ে ভদ্রলোক এসে আমাকে ধরলেন। একটা ট্র্যাকস্যুট আর মাথায় নেপালি টুপি চড়িয়ে নিয়েছেন, বললেন, চলো, শিবজির দর্শন করে আসি।
এমনিতেই এই মন্দির ভগবান এসবে আমার বিস্তর অ্যালার্জি, তার ওপরে পাহাড়ের ভগবানরা দেখতে আদপেই হ্যান্ডসাম হয় না। সেই একবার আমার দুই বন্ধু – ব্ল্যাঙ্কি আর অর্পণের সঙ্গে গেছিলাম দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকিং করতে। ট্রেকিং তো ঘণ্টা করেছিলাম, হ্যাহ্যা করে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ওপর নিচ করে এসেছিলাম – তা সে ফেরার পথে একটা মন্দিরে ঢুকেছিলাম। পাইলট বাবার আশ্রম। সে গল্প আমার পুরনো লেখায় আছে – তা সেখানে চেনা অচেনা সব রকম ভগবানের আখাম্বা আখাম্বা সব মূর্তি আছে, সে মানে অতীব কদাকার দেখতে ছিল সবকটা। শিবকে বাঁদর মনে হচ্ছিল, হনুমানকে মনে হচ্ছিল হেলিকপ্টার – এই রকম। অবশ্য সিকিমের ভগবানকে অন্য রকমের দেখতে হলেও হতে পারে।
পুল পেরিয়ে অন্যপারে এলাম। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করছিলাম সিকিম সম্বন্ধে। কত পার্সেন্ট সিকিমিজ, কত পার্সেন্ট অন্য কেউ – তা উনি বললেন, ঠিক কি বেঠিক জানি না, যে সিকিমিজ বলে আলাদা কোনও জনজাতি হয় না। এটা ভুটিয়া, লেপচা, নেপালি আর তিব্বতীদের একটা মিশ্র জাতি। কে কতদিন সিকিমের বাসিন্দা, তাই দিয়ে ডোমিসাইল নির্ধারিত হয়।
প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে উনি নানা কথা শোনাচ্ছিলেন, বেশির ভাগই নিজের সম্বন্ধে – উনি দুবার দিল্লি গেছেন, দিল্লি খুবই পল্যুটেড, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক কিলোমিটারের মাথায় গিয়ে দেখলাম একটা লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর দিকে। উনি সেইদিকে ইশারা করে বললেন, নিচে, নদীর ধারে মন্দির।
আমি একটা লম্বা দম নিলাম। পাহাড়ে আমার হাঁটাহাঁটির পারফরমেন্স খুবই খারাপ। সিঁড়িটা সুন্দরভাবে বানানো, মোটেই খাড়াই নয় – আন্দাজ নেবার জন্য আমি গুনতে শুরু করলাম, কারণ ফেরার সময়ে তো এতগুলো সিঁড়িই উঠতে হবে।
একশো নিরানব্বইটা। তার পরে একটা লম্বা চাতাল, একটু এগিয়ে কংক্রিটের পথটা বেঁকে গেছে – সামনেই নদী, বড় বড় বোল্ডারের ওপর দিয়ে নেচে নেচে চলেছে রো রো নদী, আর নদীর ধারেই একটা আবার বড়সড় চাতাল, মন্দির।
নদীর জলে নেমে খানিক এগিয়ে গেলাম। হিমশীতল জল, কিন্তু ভীষণ আরামদায়ক। এখনও ঠাণ্ডা পড়ে নি তেমন। এর পরে তাঁর কথামত তাঁর পিছুপিছু ঢুকতেই হল মন্দির চত্বরে। ঢোকার মুখেই এক পাঁজা কাঁসার বাসনকোসন নিয়ে মাজতে বসেছিলেন এক মহিলা, ভদ্রলোক তার সঙ্গে নেপালিতে খানিক কী সব হাসিমজার কথা বলে আবার এগোলেন। আমিও পিছু নিলাম। একটা গুহা মতন – তার ভেতরে পাথর কেটে ঘর বানানো, সেই ঘর ছাদ থেকে মেঝে সর্বত্রই সাদা টাইল দিয়ে বসানো, মাঝে একটা বড়সড় শিবমূর্তি। ঘরে আনুষঙ্গিক যা যা থাকে, তাইই ছিল, প্রদীপ, ধূপকাঠি ইত্যাদি।
ভদ্রলোক এর পরে দাবি করলেন, ক্যামেরাটা দাও, শিবজির সাথে তোমার একটা ছবি তুলে দিই। … কী আর বলব, হাসি হাসি মুখে শিবজির কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হল, তিনি ছবি তুললেন, এর পরে দাবি পেশ হল তিলক লাগিয়ে নাও – পাশেই দাঁত টাঁত বের করে একজন পুরোহিত আলাপের ভঙ্গিতে হাসছিলেন, এইবারে তিনি একটা সিঁদুরে চোবানো দেশলাই কাঠি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং আমার কপালে একটা সরু সিঁদুরের রেখা বানিয়ে দিলেন, হল তিলক পরানো।
আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয় এইসবে, আমি একেবারে তিলক ফিলক কাটায় অভ্যস্ত নই – কপাল সুড়সুড় করছে, কিন্তু আপাতত কিছু বলে লাভ নেই, ফেরার পথে অন্ধকারে মুছে নিলেই হবে। অতঃপর অনুরোধ এল, গুহাটিকে প্রদক্ষিণ করতে হবে। বেশ, তাও করলাম, প্রদক্ষিণ করতে করতে তিনি মন্দিরের গল্প বললেন।
এই জমিটা স্থানীয় একজন ব্যক্তির। একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, মহাদেব তাঁকে আদেশ করছেন, রো রো নদীর ধারে তাঁর মন্দির গড়ে দিতে হবে। সকালে উঠে সেই ব্যক্তি রো রো নদীর ধারে আসেন এবং এই জায়গায় এই গুহাটি আবিষ্কার করেন, গুহার পাথরটা এমনভাবে লম্বা লম্বা আড়াআড়ি হাল্কা খাঁজকাটা যে ওটাকে ‘একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে’ টাইপের আইডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, এর সাথে দু ছটাক ভক্তি মিশলে তো আর কথাই নেই – সাপ মানেই মহাদেব, অতএব এইই উত্তম প্রশস্ত স্থান মহাদেবের মন্দির স্থাপনার। খুব নাকি জাগ্রত শিব, আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন এসে মানত করে যায়, সবার মনষ্কামনা পূর্ণ করেন শিবজি।
আসল কথাটি উনি বললেন সবার শেষে, তখন আমরা ফিরতি পথে সেই একশো নিরানব্বই সিঁড়ির কাছে এসে গেছি। ওনার থেকে জানলাম, শিবজির এমনই অসীম কৃপা – আলোচ্য ব্যক্তিটি সিকিম সরকারের ল্যান্ড ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। আসলে তো এটা ফরেস্ট ল্যান্ড, কিন্তু শিবজির কৃপায় উনি এই জমির নেচার সরকারি দলিল দস্তাবেজে বদলে নিতে পেরেছিলেন, কোথাও কিছু আটকায় নি – তাই শিবজি এইখানে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
এতক্ষণে গল্পটা ক্লিয়ার হল। ভদ্রলোক সরল বিশ্বাসে আমাকে মন্দিরের ইতিহাস বলে চলেছিলেন, ভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গেছিল, তিনি তাই আমার ঠোঁটে অবিশ্বাসীর তীব্র বাঁকা হাসিটা আর দেখতে পান নি।
সাড়ে ছটায় আবার আস্তানায় ফেরত। একশো নিরানব্বইটা সিঁড়ি উঠতে একটু হাঁফাতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি দিব্যি উঠতে পেরেছি, কোনও অসুবিধে তো হয় নি! তার পর আবার এক কিলোমিটার হেঁটেওছি। তা হলে বোধ হয় সমস্যা সত্যিই হয় না অতটা। এই ট্রিপে আমার একটা ট্রেক আছে কদিন পরে। খুবই খাড়াই ট্রেক। তার একটা ফিটনেস টেট হয়ে গেল আজ।
বিকেলে যে অত অনুরোধ করেছিলাম, তা মনে হয় পুরোটাই বিফলে গেল। ঠিক সাড়ে সাতটায় ছেলেকে দিয়ে ডাকিয়ে দোতলা থেকে আমাকে নামিয়ে আনলেন গৃহস্বামীবাবু। তাঁদের সঙ্গে ডিনার করতে হবে। সসঙ্কোচে তাঁদের ঘরে ঢুকলাম, অনতিবিলম্বেই খাবার ডাক এল।
ঠিক যে আশঙ্কাটা করছিলাম, সেটাই। আপাদমস্তক ভ্যাজ। মানে, যে সে ভ্যাজ নয়, সেথায় কোনও আলু নেই, মটরশুঁটি নেই, ফুলকপি নেই, তার বদলে বোধ হয় মূলো ছিল, গাজর ছিল, লাউ ছিল, আর কী কী সব মিলিয়ে মিশিয়ে দুখানা ঘ্যাঁট ছিল – এমনকি ডালেও কীসব শাকপাতা ভাসছিল, মানে, আমি যা যা খাই না, ঠিক সেই সব জিনিস চারদিকে সাজিয়ে আমাকে রুটি খেতে দেওয়া হল। হায় হায়, একে তো দুপুরে খাওয়া জোটে নি, তার ওপরে একশো নিরানব্বইটা সিঁড়ি ভেঙে পেট আরও খালি – এর পরে এইসব জিনিস খাওয়া যায়?
কুঁতিয়ে কাঁতিয়ে তিনখানা রুটি আর শাক বেছে ডাল দিয়ে খানিকটা ভাত কোনওরকমে খেয়ে উঠে পড়লাম। আপ্যায়নের কোনওরকম ত্রুটি ছিল না, কিন্তু কী করব, আমি ভ্যাজ খেতে পারি না।
অতঃপর, খেয়ে উঠে আবার ড্রয়িং রুম। আমার মন তখন পুরোপুরি বিরক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, ওপরে যেতে পারলে বাঁচি, কিন্তু গৃহস্বামীর সেদিকে কোনও নজর নেই। তিনি আমাকে শোকেসের ওপরে, অ্যালবামের র্যাক থেকে বিভিন্ন ফটো, অ্যালবাম, বই ইত্যাদি বের করে দেখিয়ে যা বোঝালেন তার মোদ্দা কথা হল এই, উনি ভূতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত (জিও-কিছু একটা বলেছিলেন, ভুলে গেছি) কোনও একটা বিষয়ের ওপরে পড়াশোনা করে পেপার লিখেছিলেন, মানে কো-অথর ছিলেন, তো সেই পেপার পড়তে তাঁকে একদা কানাডায় ডাকা হয়েছিল, মন্ট্রিয়েল শহরে। সেইখানে গিয়ে উনি পেপার সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন, এবং সেখানকার জ্ঞানীগুণীদের নেপালী উত্তরীয় নেপালি টুপি ইত্যাদি প্রদান করে আসেন।
কুড়ি মিনিট সেই সম্বন্ধে বক্তব্য পেশ করার পর তাঁর চোখ গেল তাঁরই ঘরের টেবিলের ওপর রাখা একটি ম্যাগাজিনের দিকে। ম্যাগাজিনের নাম – হিন্দুইজম টুডে। বেশ ভাবালু হয়ে ম্যাগাজিনটি আমাকে উল্টেপাল্টে দেখতে অনুরোধ করলেন।
রাত হয়েছে, এখন যদি তাড়িয়ে দেয়, আমার থাকার জায়গা জুটবে না, স্রেফ এই ভয়ে আমাকে হিন্দুইজম টুডে-র পাতা ওল্টাতে হল। অ্যাজ এক্সপেক্টেড, ফিফটি পার্সেন্ট হিন্দুধর্মসম্পর্কিত কিছু বেড়াবার জায়গার বিবরণ, ভক্তিরসে পরিপুর্ণ ট্র্যাভেলগ এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট ধর্মসংক্রান্ত বালবিচিতে ভরপুর একটি ইংরিজি পত্রিকা। শাইনিংদের জন্য আদর্শ। আমি অপেক্ষা করছিলাম, এর পরে কতক্ষণে নরেন্দ্র মোদীর কথা আসে, তা উনি সেদিকে না গিয়ে ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে গুণকীর্তন শেষ করেই প্রসঙ্গ পালটে চলে গেলেন তাঁর হোমস্টে ব্যবসার দিকে। কীভাবে শুরু করলেন, এখন কেমন লোক আসে, ইত্যাদি। জানা গেল, ওঁর হোমস্টের ওপরতলায় একটি ঘরে একজন অতিথি দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। পারকিনসনসে আক্রান্ত, জার্মান নাগরিক। প্রায় মাস ছয়েক হল আছেন। নিয়মিত বিল মিটিয়ে দেন, আর মুম্বাই থেকে প্রতি মাসে ওঁর জন্য কুরিয়ারে এক কার্টন করে ওষুধ আসে। স্ত্রী-কন্যা সবাই ছিল, আছে, কিন্তু পারকিনসনসে আক্রান্ত হবার পরে সংসার তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। কারুর নির্ভরতায় বাঁচবেন না বলে নিজে নিজেই ভারতে চলে আসেন সেই জার্মান ব্যক্তি, এবং সিকিমে এসে ওঁর এই হোমস্টে-টি খুব পছন্দ করে এখানেই থেকে গেছেন প্রায় ছ মাস হল। ঘর থেকে বিশেষ বেরোন না, লেখালিখি করেন, কারুর সাথেই মেশেন না।
পরদিন আমাকে গ্যাংটকে যেতে হবে পারমিটের জন্য, সকাল সকাল বেরোতে হবে – ভেবেছিলাম এসে একবার চান করে নেব, কিন্তু হোমস্টে-তে কোনও টাওয়েল দেওয়া হয় না, আমি নিজেও কোনও তোয়ালে বা গামছা ক্যারি করছি না, অতএব, আজকের মত চান কাটিয়ে দিতে হল। পৌনে নটা নাগাদ শুভরাত্রি জানিয়ে ওপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিলাম।
কাছেই কোথায় যেন একটা মাইকে কেউ মাঝে মাঝেই টেস্টিং করে যাচ্ছে। খুবই কাছে, বেশ জোরালো আওয়াজ। ভাবলাম, কোনও অনুষ্ঠান চলছিল হয় তো, শেষ হচ্ছে। নিচের তলা থেকে আওয়াজ পাই নি, দোতলায় আওয়াজ একদম স্পষ্ট।
কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ তো নয়, মনে হল শুরু হচ্ছে। একটা বাচ্চা ছড়া টাইপের কিছু একটা বলল মাইকে, বোধ হয় নেপালী ভাষায়। খুব সমবেত হুল্লোড়ের আওয়াজ আসছে, হাসিমজাইয়ার্কি, কমবয়েসী ছেলেমেয়ের দল। তারও খানিক পরে, মোটামুটি রাত দশটার একটু আগে থেকে মাইকে শুরু হল গান। নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। সেই ছোটবেলায় দূরদর্শনে দেখতাম, আর তারপরে আজ শুনছি।
গানগুলো বেশিরভাগই নেপালী লোকসঙ্গীতের সুর, খুব ক্যাচি আর শ্রুতিমধুর, কিন্তু আমি তখন হা-ক্লান্ত। পেট ভরে নি, ঘুম পেয়েছে প্রচণ্ড, এদিকে কানের গোড়ায় মাইকে তখন গানের তাল আরও তীব্র হয়েছে, সমবেত হাহাহিহির পরিমাণও বেড়েছে প্রচণ্ড – এ কী বিড়ম্বনা!
সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলল সেই সুমধুর অত্যাচার, তার পরে হঠাৎ করে থেমে গেল নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। আমি আর চোখ খুলতে পারছিলাম না, মাথার ভেতরে তখন কীরকম দপদপ করছিল, গানের জলসা শেষ হওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।
এক ঘুমে সকাল।
Darun dada porer lekha ta kobe pabo
LikeLike
এই উইকেন্ডেই আসছে।
LikeLike
Okk dada..
LikeLike