প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বের পর
২৩শে অক্টোবর, চতুর্থ দিন
আজ সেই অর্থে কোথাও যাওয়ার নেই, গ্যাংটকেই আজ পারমিট বানানোর দিন। গ্যাংটক এখান থেকে এগারো কিলোমিটার, কিন্তু পৌঁছতে হবে সকাল নটার মধ্যে। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে তাই বেরিয়েই পড়লাম, এমনিতেও সারাটা দিন আজ গ্যাংটকেই কাটাতে হবে, গ্যাংটকেও তো অনেক কিছু দেখার আছে – যদি পারি, দেখে নিই। হোমস্টে-তে খুব তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। আজ রাতেও সেখানেই থাকতে হবে। এখন বুঝতে পারছি, রানীপুলের কাছে হোমস্টে দেখে খুব একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি। এক তো লোকটিকে আমার পছন্দ হয় নি, দ্বিতীয়ত, দূরত্বটা বেশ খানিক দূর। এগারো কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তায় এগারো কিলোমিটার মানে খুব কম রাস্তা নয়। আজ পারমিট হয়ে গেলেই পরের দিন সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে এই এম জি মার্গে,পুলিশের পারমিট নেবার জন্য, সেইটা খুব চাপ হয়ে দাঁড়াবে। প্রপার গ্যাংটকে থাকার জায়গা হলে খালি মোটরসাইকেল নিয়ে সকালবেলায় এসে পুলিশ পারমিট করিয়ে নিতাম, তারপরে টক করে হোটেলে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে যেতাম। এখন কাল আমাকে অনেক ভোরে বেরিয়ে লাগেজ সমস্ত বেঁধে তৈরি হয়ে আসতে হবে। আবার ফিরে গিয়ে লাগেজ আনতে যাওয়া সম্ভব হবে না। … দেখি, তিন দিন বাদে আবার তো গ্যাংটকেই ফিরে আসতে হবে, বুকিং ওখানেই করা আছে, সেইটাকে ক্যানসেল করে গ্যাংটক শহরের মধ্যে কোনও বুকিং করে রাখা যায় কিনা।
মনন ভবন, গ্যাংটকে খুবই পরিচিত জায়গা। পৌনে আটটার মধ্যে গ্যাংটকে ঢুকতেই দেখতে পেলাম একটা প্রমিনেন্ট মোড়, সেখান থেকে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন রাস্তা গেছে, ওপরের দিকে, নিচের দিকে। ডানদিকের একটা রাস্তা মোড় ঘুরতেই শেষ, শক্তপোক্ত লোহার বেরিয়ার দিয়ে ঘিরে রাখা একটা এলাকা। বেরিয়ারের ওপারেও রাস্তা আছে, তবে সে যেন এক টুকরো বিদেশ। কালো পাথরে মোড়া রাস্তা, সুন্দর ডিভাইডার, একটু দূরে দূরে বসার জন্য সুদৃশ্য বেঞ্চ, আর সবার আগে একটা মহাত্মা গান্ধীর প্রমাণ সাইজের মূর্তি। খুব চেনা জায়গা, গ্যাংটকের মল্, বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ। এখানে গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ, কেবল পায়ে হেঁটে ঘোরা যায়।
আর সেই মোড়ের বাঁদিকে একটু এগোতেই বাঁদিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে একটা বেশ বড়সড় সবুজ রঙের বিল্ডিং, অ্যাপ্রোচ রোডটা একদম খাড়াই নেমে গেছে মেন গেটের দিকে। সিকিম সচিবালয়, সেক্রেটারিয়েট, এরই নাম মনন ভবন। এখানেই সিকিমের পাসপোর্ট অফিস, আর এখান থেকেই প্রতিদিন পারিমিট লেটার ইস্যু হয়।
ঘড়িতে এখন বাজে আটটা, অবশ্যই অফিস খোলে নি, অফিসের গেটও খোলে নি। মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে এলাম মলএর দিকে। সকাল বেলায় মল একেবারে জনশূন্য। দু চারজন কর্মী বড় বড় ঝাঁটা নিয়ে সাফ করছেন চত্বর। লোহার ব্যারিকেডের ঠিক সামনেই বাইকটাকে রেখে ঢুকলাম ভেতরে। সামনে আরও দু চারজনকে দেখা যাচ্ছে, হাতে পারমিটের জন্যই কাগজপত্র। এদের মধ্যে ঠিক বাইকার তো কাউকেই দেখছি না, যাই হোক, ফলো করেই দেখি কোথায় যায়।
গান্ধীজির মূর্তির ঠিক ডানদিকেই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একটা বড় লোহার গেটের সামনে, যার ওপরে লেখা, সিকিম পাবলিক সার্ভিস কমিশন। লোকগুলো সেখানেই ঢুকছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই সেই জায়গা, যেখানে প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রুটের পারমিট দেওয়া হয়। আর আমার আশেপাশে যে লোকগুলো হাতে কাগজ নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে, তারা সকলেই এখানকার ক্যাবের ড্রাইভার। টুরিস্টদের বুকিং আছে, তাদের কাগজপত্র নিয়ে পারমিট করাতে এসেছে। ক্যাবের পারমিটের জন্য মনন ভবনে যেতে হয় না, ওদের এখান থেকেই পারমিট বেরোয়। রাস্তার অন্যদিকে আরেকটা বড় বিল্ডিং, সিকিম পুলিশের সদর দফতর। গেটের মুখেই একটা ছোট খাবারের দোকান, সদ্য ঝাঁপ খুলছে, আর তার পেছনে একটা বড়সড় পার্কিং লট, কমার্শিয়াল গাড়ির, তার পেছনের পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে ধূসর রঙের মেঘ। আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে সবুজ রঙের পাহাড়টা।
খিদে পেয়েছে সাঙ্ঘাতিক। কাল সারাদিনে প্রায় কিছু জোটেনি খাবার মত। লম্বা জার্নিতে ঠিকঠাক খেতে না পাবার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু সকাল আটটার গ্যাংটক শহরে দাঁড়িয়ে খালিপেটে মনন ভবন খোলার অপেক্ষা করার কোনও মানেই হয় না। গুটিগুটি ঢুকলাম পুলিশ স্টেশনের গেটের মুখে সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্টে। কী পাওয়া যাবে?
মোমো। জয়গুরু, চিকেন মোমো তৈরি আছে। এক প্লেট মোমো আর গরমাগরম কফি অর্ডার দিয়ে দিলাম। ঝটপট এসেও গেল তারা টেবিলে। টেবিলের পাশেই জানলা, সেখান দিয়ে দেখছি, একপ্রস্থ মেঘ গড়িয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে, সবুজ পাহাড় আবার দৃশ্যমান, ওপরের দিকে আরেকপ্রস্থ মেঘ গড়িয়ে নামার তোড়জোড় করছে। সারা আকাশই মেঘে ঢাকা, রোদের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। অবশ্য, ঠাণ্ডাও নেই বিশেষ।
পেটপুরে মোমো আর কফি খেয়ে এগনো গেল মনন ভবনের দিকে। নট বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি, গেট খুলে গেছে, ভেতরে লোকজন ঢুকছে মোটরসাইকেল নিয়ে – একজন, দুজন। মোটরসাইকেল রাখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, পাশেই আরেকটা মোটরসাইকেল, দিল্লির নম্বর।
মনন ভবনের ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই, দরকারও নেই, ঠিক নটার সময়ে মূল প্রবেশপথের পাশে একট কাচের ঘরে একজন মহিলা এসে বসলেন, এবং সবাইকে একটা সাদাসিধে ফর্ম ভরতে দিলেন। নিতান্তই সহজ সরল, নাম ঠিকানা, কজন যাচ্ছে, গাড়ির নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বর, কোন কোন জায়গা যেতে চাও। মহিলার সঙ্গে একজন সহায়ক, তিনি জিজ্ঞেস করামাত্র ধৈর্য ধরে সব্বাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কী কী ভরতে হবে, লিখতে হবে, কী কী দরকার আর কী কী দরকার নেই।
আমি ফর্ম ভরলাম। একটানা নর্থ আর ইস্ট সিকিমের যাবতীয় গন্তব্যের নাম লিখে তো দিলাম, ফর্মটা সহায়কের হাতে দেওয়ামাত্র তিনি চোখ বুলিয়ে বললেন, চোলামু কেটে দাও, ওটার পারমিট পাবে না, বাকি সব ঠিক আছে।
চোলামু, গুরুদোংমার লেকের থেকে মাত্র চার পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই আরেকটা ছোট লেক। এমনিতে দেখার কিছু নেই, বিশেষত্ব হচ্ছে, এই লেকটা একেবারে যাকে বলে ব্যাং অন দা চায়না বর্ডার। সদাসর্বদা আর্মির পেট্রলিং চলে, তাই সিভিলিয়ানদের এর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। পারমিট পাওয়া যায় না।
ঠিক আছে, চোলামু না হোক, গুরুদোংমারই সই। চোলামু কেটে দিলাম, সাথে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পল্যুশন সার্টিফিকেট আর ইনশিওরেন্সের ফোটোকপি নিয়ে জমা করে দিলাম, ভদ্রলোক নিয়ে বললেন, ঠিক চারটের সময় চলে এসো, লেটার পেয়ে যাবে।
বেরিয়ে আসার আগে একটু চারদিকে চোখ বোলালাম। আমার পাশে বসেই একটি কমবয়েসী ছেলে বসে একই ফর্ম ভরছিল, হাতে একটা পলিথিনের শাড়ির দোকানের প্যাকেট, তার মধ্যে তার ডকুমেন্ট সব রাখা, ছেলেটির চোখমুখ এবং প্যাকেটের শাড়ির দোকানের নাম বলে দিচ্ছে, ছেলেটি বাঙালি। সিকিমে বাঙালি ট্যুরিস্ট এবং বাইকারের সংখ্যা সবসময়েই বেশি। – আলাপ জমালাম। বলল, বাবার সঙ্গে এসেছি। প্রতি বছরই আসি বাবাকে নিয়ে, বাবাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে একবার করে গুরুদোংমার ভিজিট করে আসি।
বেশ কথা। শুনেছি, রাস্তা খুব খারাপ ঐ রুটে, বাবাকে পেছনে নিয়ে চালাতে সমস্যা হয় না?
ছেলেটা কম কথার মানুষ। একটু হেসে বলল, অভ্যেস হয়ে গেছে।
পরমুহূর্তেই দেখি, একটি দম্পতির সঙ্গে সেই সহায়ক ব্যক্তিটির বেশ তুমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছে। দম্পতিটিকেও শুরু থেকেই দেখছি, তাঁরা বোধ হয় পুণে বা মুম্বাই থেকে এসেছেন, বারবার করে প্লিড করছেন – ইয়ার মুঝে পতা নেহি থা, ক্যায়সে পতা চলেগা, দো দিন কে লিয়ে হি আয়া হ্যায়, প্লিজ পারমিট দে দো, আর সহায়ক তাঁর বক্তব্যে অবিচল, না, পারমিট দেওয়া যাবে না।
কেসটা কী? এমনও হয় নাকি? কোনও পেপার, ডকুমেন্ট শো করাতে পারেন নি কি তাঁরা? কান পেতে শুনে যা বুঝলাম, তাঁরা পরের দিন ছাঙ্গু আর নাথু লা যেতে চান। মানে, ইস্ট সিকিম। এখন, নাথু লা-ছাঙ্গু প্রতি সোম আর মঙ্গলবার সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ থাকে, সেদিন কোনও ভিজিটর অ্যালাওড নয়। সহায়ক ভদ্রলোক বলছেন, আপনারা অন্য কোথাও ঘুরে নিন কালকের দিনটা, আমি পরশুর জন্য পারমিট করে দিতে পারব, এদিকে এনাদের পরের দিনেরই বুকিং আছে জুলুকে, এবং তার পরের দিনই ফেরার রাস্তা ধরতে হবে, হাতে এই একটা দিনই। তাই আকুতি, প্লিজ পারমিট দিয়ে দিন, আর ভদ্রলোক একটানা বলে যাচ্ছেন – কী করে দিই, এটা তো আর্মির রুল, ওরা অ্যালাও করবে না, দেবার নিয়ম নেই –
খানিকক্ষণ দেখে বেরিয়ে এলাম। পৌনে দশটা বাজে। কী করা যায়? কোথায় বেরিয়ে আসা যায়? গ্যাংটকে বেশ কিছু দেখার জায়গা আছে বটে, তবে সবই আমার দেখে আসা কলেজজীবনে। দেখা নেই একটা জিনিস – রুমটেক মনাস্ট্রি। সকালে রানীপুল থেকে গ্যাংটক আসার পথে একটা ছোট ডাইভার্সন দেখেছিলাম, লেখা ছিল, ওয়ে টু রুমটেক মনাস্ট্রি। রুমটেকের গল্প পড়েছিলাম সেই সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজে, রুমটেক মনাস্ট্রির হীরে। এর আগে গ্যাংটক এলেও তাশি ভিউ পয়েন্ট, হনুমানটক ইত্যাদি দেখেছি, রুমটেক দেখা হয় নি। তো, চলা যাক রুমটেক। বাইকের মোবাইল মাউন্টে মোবাইল লাগিয়ে ডেস্টিনেশন সেট করতেই দেখাল তেইশ কিলোমিটার।
এগোলাম। সেই মোড়েও পৌঁছে গেলাম, ওয়ে টু রুমটেক মনাস্ট্রি লেখা ফলকটার পাশ দিয়ে রুমটেকের রাস্তা নিয়েও নিলাম। এইবারে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, রুমটেকের দূরত্ব কমছে ঠিকই, কিন্তু আশেপাশে কেমন যেন জনমনিষ্যি দেখতে পাচ্ছি না, রাস্তা বলেও প্রায় কিছুই নেই, নেহাত বাইক বলে চলছে, গাড়ি বোধ হয় এ রাস্তা দিয়ে যায় না, একে তো সরু, মাঝেমধ্যে কাদা, স্লাশ, আর পাথর, এবড়োখেবড়ো।
অনেকটা চলার পর, যখন দেখাচ্ছে রুমটেক আর আটশো মিটার, তখনও নজরে কোনও মনাস্ট্রি ইত্যাদি আসছে না। কেবল দেখলাম একটা ছোট মোড় মতন, সেখানে একজন লোক বসে আছে, জিপিসে দেখাচ্ছে এখান থেকে ডানদিকে আটশো মিটার। এদিকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ডানদিকের রাস্তা একটু এগিয়েই শেষ। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম – রুমটেক মনাস্ট্রি …? সে আমাকে হাত তুলে অন্য সোজা রাস্তাটা দেখিয়ে দিল।
কী করা যায়? যা হয় হোক, সারাটা দিন তো সময় আছে, সোজাই এগিয়ে দেখি।
একটু এগোতেই রাস্তা আরও খারাপ হল, আর জিপিএস কী সব ক্যালকুলেশন করে নতুন করে দূরত্ব বের করে জানাল, রুমটেক আর চোদ্দ কিলোমিটার।
যাব্বাবা! এ কোথায় এলাম রে বাবা – কোথাও কোনও সাইনেজ নেই, শুনেছি তো খুবই বিখ্যাত মনাস্ট্রি, কেউই কি আসে না এখানে? আরও দু কিলোমিটার গেলাম – কোত্থাও কেউ নেই, একটা লোক নেই, একটা গাড়ি নেই, জাস্ট গাছপালা, আর শুঁড়িপথ, মনেও হল না এ রাস্তায় কোনও গাড়ি চলে বলে।
অগত্যা রণে ভঙ্গ দিতে হল। রুমটেক না দেখেই আবার ফিরে এলাম উল্টোরাস্তায় – বারোটার সময় আবার গ্যাংটকের মলএ। উদ্দেশ্যহীনভাবে খানিক ঘোরাঘুরি – সকালের মোমো কখন হজম হয়ে গেছে, খিদে পেয়েছে বিস্তর। এম জি মার্গের পাশেই একাধিক সিঁড়ি নেমে গেছে জায়গায় জায়গায় নিচের রাস্তার দিকে – সেই রকমই একটা সিঁড়িতে নামার মুখেই একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট, সেখানে ঢুকলাম, ম ম করছে মাছমাংসের গন্ধে।
আহা, কী খেলাম! আলুভাজা, বড়ির তরকারি, বাটা মাছের ঝাল, মাটন কষা আর শেষপাতে চাটনি। কালকের যত অখাদ্য খাওয়া খেতে হয়েছিল, সবকিছুর শোধ তুললাম গলা অবধি গিলে।
খেয়ে দেয়ে পেট তো ভরল, কিন্তু মন উঠল অভিমানে উথলে। গ্যাংটকে এত ভালো ভালো খাবারের অপশন থাকতে আমি কিনা মাত্র এগারো কিলোমিটার দূরে বসে ভ্যাজ খাবো? আর ঐ ভদ্রলোকের হ্যাজ শুনতে বাধ্য হব? কভি নেহি!
তিন দিন বাদে আমার আবারও ঐ হোমস্টে-তেই বুকিং করা আছে, নর্থ সিকিম ঘুরে এসে একরাতের জন্য গ্যাংটকে স্টে, তার পরের দিন আবার ইস্ট সিকিমের জন্য এগনো। ঝটপট সেই বুকিং ক্যানসেল করে ফেললাম। সকাল থেকে গ্যাংটকের এমাথা থেকে ওমাথা ঘোরাঘুরি করে শহরটা এখন মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে, সুতরাং একটু নেট ঘেঁটে ঝটপট একটা হোটেল সিলেক্ট করে ফেললাম শস্তা দেখে – শহরের মধ্যেই, মল থেকে জাস্ট আড়াই কিলোমিটার দূরে। ঝট করে মোটরসাইকেলটা নিয়ে ম্যাপ দেখতে দেখতে হোটেলের সামনে পৌঁছে গেলাম, নর্থ বা ইস্ট সিকিম যাবার রাস্তাতেই পড়ে হোটেলটা। ওখানে দাঁড়িয়েই অনলাইন বুকিং সেরে নিলাম।
চারটে প্রায় বাজে। পারমিটের চিঠি নেবার সময় হয়ে গেছে। অতএব ফিরে এলাম মনন ভবনে। সকালবেলার ডেজার্টেড লুক এখন আর নেই, গাড়িতে মোটরসাইকেলে বেশ জমজমাট। কাচের ঘরে মহিলাটি এখন আর নেই, তবে সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে বসে রয়েছে সকালবেলার প্রচুর চেনা মুখ। কেরালা থেকে আসা বাইকারদের একটা দল, সেই ছেলেটি যে কিনা প্রত্যেক বছর বাবাকে পিলিয়নে বসিয়ে গুরুদোংমার বেড়াতে আসে, আরও বেশ কিছু জন।
ঠিক চারটে বেজে সাত মিনিটে সেই সহায়ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন – হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে। একে একে নাম পড়ে ডাকতে লাগলেন, আর প্রত্যেকের হাতে পারমিটের চিঠি ধরিয়ে দিতে থাকলেন। আমারও নাম এল, ছখানা চিঠি পেলাম। বয়ান একই – একটা আমার নিজের কপি, আর অন্য পাঁচটা বিভিন্ন জায়গায় সাবমিট করতে হবে।
সিকিমের পারমিট পাবার পদ্ধতি এতটাই সোজা। স্রেফ ফর্ম ভরে সকালে জমা করা, আর বিকেলবেলা গিয়ে চিঠিগুলো নিয়ে নেওয়া। আলাদা করে কোনও ভেরিফিকেশনের প্রসেস নেই, মানে, আমার বদলে আমার চেনা কেউ যদি এই কাজটাই আমার হয়ে করে রাখতে পারে, তা হলে আমাকে গ্যাংটকে একটা দিন বাড়তি স্টে করারও দরকার হয় না।
চিঠি নিয়ে ফিরে আসা গেল মলএ। মলও এখন জমজমাট। সমস্ত দোকানপাট খোলা, লোকজন টুরিস্ট গিজগিজ করছে।
বসে বসে ফেসবুক ঘাঁটছি, একটা মেল এল। উগিয়েনের। আমার ভুটানের ই-ভিসা হয়ে গেছে, পিডিএফ পাঠিয়ে দিয়েছে, লিখেছে, এইটার প্রিন্ট আউট নিয়ে ফুন্টশোলিংয়ের ইমিগ্রেশনে দেখালেই আর কোনও লাইন নেই, কোনও জিজ্ঞাসাবাদ নেই, সোজা এন্ট্রি হয়ে যাবে ভুটানে।
বাঃ, খুবই ভালো কথা, কিন্তু এখন এখানে আমি প্রিন্ট আউট পাই কোথায়?
মলএর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরলাম। সব রকমের দোকান আছে, কিন্তু সাইবার কাফে নেই। একজন বলল, ওই কোণের ওই রাস্তাটা ধরে একটু ওপরে উঠে যাও, পাবে। তাও গেলাম – কিন্তু না, কোনও সাইবারকাফে টাফে নেই কোথাও। তা হলে উপায়?
উপায় এখন সেই হোমস্টে-র লোকটিই, সেই বিরক্তিকর লোকটি, যদি তার বাড়িতে প্রিন্টার থাকে, তা হলে সেখান থেকেই প্রিন্ট নিতে হবে। আশা করি তার কাছে এত তাড়াতাড়ি ইন্টিমেশন পৌঁছয় নি আমার পরের স্টে ক্যানসেল হবার।
সন্ধ্যে ছটা বাজে। পেট যদিও ভর্তি, কিন্তু রাতে তো খিদে পাবেই, একখুনি তাই ফেরার দরকার নেই। কে জানে, আজকেও সে পাড়ায় নেপালিদের দিওয়ালির উৎসব পালনের ব্যাপার আছে কিনা।
মলএই খানিক বসে রইলাম। কী আর করব, এমনিতে তো টাইম কিল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই, সন্ধ্যে হবার পরে ঠাণ্ডাও অল্পস্বল্প পড়েছে, তাই খানিক বসে থেকে আবার গুটিগুটি চলে গেলাম সেই দোকানে, যেখানে দুপুরে গাঁতিয়ে খেয়েছিলাম। খানিক মাটন কষা আর তিনটে রুটি একটা থার্মোকলের প্লেট সমেত প্যাক করে নিয়ে গ্যাংটক ছেড়ে পাকাপাকি ফিরেই চললাম রানীপুলের দিকে। কাল সক্কাল সক্কাল উঠে চলে আসতে হবে, এসে পুলিশের কাছে লাইন দিয়ে পারমিট তুলতে হবে, দিয়েই বেরোতে হবে লাচেনের উদ্দেশ্যে। তাই আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। ফেরার পথে বাইকে আর জেরিক্যানে পেট্রলও ভরে নিলাম। কাল সকালে আর ভরার জন্য থামতে হবে না।
সাড়ে সাতটার সময়ে ঢুকলাম হোমস্টে-তে, ঢুক্তেই দেখা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে, বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন – আজ আর চা-ও অফার করলেন না।আমিই যেচে বললাম, কাল সকাল সাড়ে ছটায় বেরোব, আপনাদের কাজের ছেলেটাকে একটু বলে রাখবেন আমাকে পুল পার করে লাগেজগুলো বাইক অবশি দিয়ে আসতে হবে এক দু খেপে। উনি খুব শান্ত স্বরে বললেন, বেশ, বলে দেব। – একবারের জন্যও আর রাতে খাবো কিনা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন না, খাবার অফারও করলেন না। অবিশ্যি তাতে আমিই বর্তে গেলাম। খেতে বললে না-ই বলতে হত।
এর পরে প্রিন্ট আউটের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। হ্যাঁ, ওনার প্রিন্টার আছে। তো, এই ভিসা পেপারটার তিন কপি প্রিন্ট আউট পাওয়া যাবে? দু কপি হলেও হবে। উনি আরও শান্ত স্বরে বললেন, এটা তো তোমার ভুটানের পেপার, না? তুমি তো নর্থ সিকিম সেরে আবার এখানে আসবে? তখন প্রিন্ট আউট নিয়ে নিও।
মানে, ভদ্র ভাষায়, দেবেন না। একটা প্রিন্ট আউট নিতে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট লাগে – কিন্তু যে হেতু তখন সাড়ে সাতটা বাজে, তাঁর ডিনার টাইম, তাই তিনি কিছুই আর করবেন না।
বয়ে গেছে। আমি অন্য কোথাও দেখে নেব।
একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল, কিন্তু তবু মাটন কষা আর রুটি খেয়ে মন আর পেট দুইই ভরে গেল। আজ রাতে আর কোথাও গানের আসর বসে নি – চারিদিক নিস্তব্ধ। রাত সাড়ে নটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আসল বেড়ানো কাল থেকে শুরু।
Dada,
Fb er long ta dio parle… Gurudongmar route er baypare details janar chilo..
Tilak
LikeLike
http://www.facebook.com/contactsiki
LikeLike