দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৮

সপ্তম পর্বের পরে

ছাব্বিশে অক্টোবর, সপ্তম দিন

না, লাচেনের মত ঠাণ্ডা লাচুংয়ে নেই। অথবা হতে পারে গত দুদিন ধরে লাচেনের ঠাণ্ডা সয়ে আসার পর এখন আর লাচুংয়ের ঠাণ্ডা গায়ে লাগছে না। নইলে ঘুম থেকে উঠে, দরজা খুলতেই তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি যে চারপাশে বরফঢাকা পাহাড়েরা ঝকমক করছে সকালের রোদ্দুরে। ঠাণ্ডা। গা জুড়িয়ে দেওয়া হাওয়া।

সকাল সাড়ে ছটা। সোনম উঠোনে দাঁড়িয়ে একটা গাঁটরিতে অনেক গাছের শুকনো ডাল, মানে জ্বালানী কাঠ, বাঁধছে। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, ব্রেকফাস্ট রেডি – হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও।

হাতমুখ ধুলাম। এক জেরিক্যান পেট্রল বাকি ছিল, সেটাকে ঢেলে বাইকের ট্যাঙ্ক আবার ফুল করলাম। আজকে লম্বা জার্নি আছে। গ্যাংটক অবধি যেতে হবে সন্ধ্যেবেলায়। ব্রেকফাস্ট সেরে, জ্যাকেট গ্লাভস ইত্যাদি পরছি, সোনম ঘর থেকে একটা জিনিস নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। চেস্টগার্ড। বেশ মোটা শক্তপোক্ত এবোনাইট বা ফাইবারের বর্মমত, স্ট্র্যাপ দিয়ে পিঠের দিকে আটকে নেওয়া যায়। সোনম বলল, এটা ঠাণ্ডা হাওয়া আটকায় – সরাসরি বুকে এসে লাগে না, ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে বাঁচায়।

জিনিসটা অতীব আরামদায়ক, পরামাত্র মনে হল ঠাণ্ডাটা যেন আরও অনেকটা কমে গেল। সোনমকে ধন্যবাদ জানিয়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

DSC_0196.jpg

আজ রাস্তা বেশ ভালো, আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার, নীল রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। লাচুং থেকে বেরিয়ে খানিক এগোতেই প্রথম চেকপোস্ট, কপি জমা করে আবার এগোলাম। ইয়ুমথাংয়ের জন্য কিছুদূর অন্তর অন্তর মাইলস্টোন দেখাই যাচ্ছে, মনের আনন্দে চলতে থাকলাম। বেশ খানিকটা এগোবার পর আরও বেশ কয়েকটা ট্যুরিস্ট ক্যাব চোখে পড়ল, পর পর যাচ্ছে সব – জিরো পয়েন্টের দিকেই। রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে, মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দিয়ে কিছু কাঁচা শুঁড়িপথ টাইপের রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। এমনি একটা কাট পেরোবার পরেই হঠাৎ দেখি একটা ক্যাব, মেন রাস্তা ছেড়ে নিচের দিকের কাঁচা রাস্তায় নেমে গেল। আমি সোজাই এগোচ্ছিলাম, ক্যাবটার তারস্বরে হর্ন বাজানো দেখে থামতে হল। ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, ড্রাইভার আমাকেই ইশারা করছে বার বার হর্ন বাজিয়ে। হাত নেড়ে বলল, নিচে এসে ওকে ফলো করতে।

কেন? কেসটা কী? দিব্যি পাকা রাস্তা – খামোকা নিচে নামতে যাবোই বা কেন? আর সে কোথায় যাচ্ছে আমি তো জানি না – আমি কোথায় যাচ্ছি, তারও জানার কথা নয়। … তাও, কী ভেবে বাইক ঘুরিয়ে নিচের রাস্তাতেই এগোলাম। এই সব জায়গায় খারাপ কিছু হবার চিন্তা দূর দূর পর্যন্ত মনেও আসে না, ড্রাইভারও লোকাল, ক্ষতি কিছু হবে না, একবার নেমে জেনেই আসি, কেন ডাকছে।

কিন্তু, নামতে শুরু করতেই সামনের ক্যাবটা চলতে শুরু করল ব্লিঙ্কার জ্বালিয়ে – মানে, মোটামুটি যা বুঝলাম, ও আমাকে বলছে ওকে ফলো করে চলতে। তাই চললাম।

খানিক এগোবার পরে রাস্তা একেবারেই নেই হয়ে গেল, একটা শুকনো ঝোরার খাত, বড়মেজ বোল্ডার ছড়ানো। তার ওপর দিয়ে গাড়িও চলল, আমিও চললাম। কী ভেবে যে তার পিছু নিয়েছিলাম, জানি না, কেবল এটুকু বুঝতে পারছিলাম এটা একটা অল্টারনেট রাস্তা, চলার জন্য। মূল রাস্তা কি আগে কোথাও বন্ধ আছে, তাই ডাইভার্সন? – বেশ অনেকটা যাবার পর আবার মনে হল মূল রাস্তায় এসে মিশলাম, আবার মাইলস্টোন দেখতে পেলাম রাস্তার ধারে, আর ভালো রাস্তা পেয়েই সামনের ক্যাবটা হুউশ করে স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না, কেসটা কী ছিল।

যাই হোক, আবার পরিষ্কার রাস্তা। ইয়ুমথাং দশ কিলোমিটার আর। কোনও এক শিবমন্দির সতেরো কিলোমিটার। পৌনে দশটার মধ্যে ইয়ুমথাং পৌঁছে গেলাম।

নভেম্বর মাসে সেখানে কিছুই দেখার নেই। রাস্তার দুপাশে রকমারি স্যুভেনির আইটেমের পশরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় দোকানীরা। একটা জায়গায় একটা বোর্ড বসানো, হট স্প্রিং, আর ডানদিকের জঙ্গলটা দেখে মোটামুটি আন্দাজ করা গেল এটাই রডোডেনড্রন ভ্যালি। এপ্রিল মাসে এখানে ফুলে ফুলে ভরে যায়।

দোকানীরা সকলেই মেয়ে, কেউ কেউ আবার অসম্ভব রকমের সুন্দরী। হাতছানি উপেক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ। তবুও এগোতে হবে। ছোট্ট ফটো স্টপ সেরে নিয়ে তাদের দু একজনকে জানালাম, জিরো পয়েন্ট দেখে এখান দিয়েই ফিরব, তখন কিছু কিনব। … কিনতে হবেই কিছু অফিসের সহকর্মীদের জন্য, বাড়ির লোকেদের জন্য। এখানে ভালো ভালো কিছু গিফট আইটেম পাওয়া যাচ্ছে।

DSC_0205.jpg

DSC_0204

এগোলাম। খানিক এগোতেই একটা আধভাঙা ফটক টাইপের কিছু এল, তাতে কিছু একটা স্যাংচুয়ারির নাম লেখা। ভেতরে খানিক যাবার পরেই আবার রাস্তা নেই হয়ে গেল, খানিক ভাঙাচোরা কংক্রিট, খানিক বোল্ডার, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল বয়ে যাওয়া জলের ধারা। তার মধ্যে দিয়েই বাইক চালিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে যাওয়া।

DSC_0202

আবার খানিকক্ষণ বাদে পাকা রাস্তা ফিরে এল, এবং তার পরেও খানিক এগোবার পরে দেখা গেল মিলিটারি চেকপোস্ট। জিরো পয়েন্ট আর আট কিলোমিটার।

ভেতরে বসা জওয়ানটি বেরিয়ে এলেন, পারমিটের একটা কপি নিলেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন – দিল্লি সে আয়ে হো?

ওনার বাড়ি চণ্ডীগড়ে। খানিকক্ষণ গল্প হল, তার পরে বললেন, এর পরে বাকি রাস্তাটুকু কিন্তু ক্যামেরা অন করবেন না। মিলিটারি এলাকা, এখানে ছবি তোলা বারণ, একেবারে জিরো পয়েন্টে পৌঁছে ছবি তুলবেন। আর জিরো পয়েন্টে পৌঁছে দেখবেন ওখানে এই পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেছে, ওখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ঐ কাঁচা রাস্তায় ভুলেও এগোবেন না। যদি ওখানে আপনাকে আর্মি ধরে ফেলে, কেউ ছাড়াতে আসবে না।

বাপ রে! এইভাবে ভয় দেখিয়ে দিলে আর কেউ ক্যামেরা বের করে নাকি? মানে, আলাদা করে ছবি তোলার কিছু ছিলও না – রাস্তা আগেও যতটা সুন্দর ছিল, এখনও ততটাই সুন্দর। ক্রমশ রাস্তা খারাপ হচ্ছে, গাছপালা একেবারে কমে গেছে চারদিকে, এই রকম সময়ে একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে এল একটা বিস্তীর্ণ উপত্যকার মত অঞ্চল। চারপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা পাহাড়ের চূড়োরা, সামনে দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে একটা সরু জলধারা, গ্রীটিংস কার্ডে আঁকা ছবির মত তার ওপরে কেউ একটা ছোট্ট সাঁকো বানিয়ে দিয়েছে। তার সাথে এক ঝাঁক টুরিস্ট, গাড়ির লাইন, ম্যাগি কফি কুড়কুড়ের গোটা দশেক স্টল। বাইকার কেউ নেই। আমি একাই। ফলে লোকে একটু ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে, অবভিয়াসলি।

DSC_0214.jpgDSC_0216.jpg

অসম্ভব সুন্দর জায়গা। স্রেফ ছুটে বেড়ানোর জন্য বেরিয়েছি, তাই সময় নেই। ফিরতেই হবে। আধঘণ্টা কাটালাম। এক দল গুজরাতি, এবং আরও একটা কাপলের অনুরোধে তাদের ছবি তুলে দিয়ে তাদের দিয়েই আমারও ছবি তুলিয়ে নিলাম।

20171026_110142.jpgDSC_0225.jpg

এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে ইয়ুমথাংএ একটু দাঁড়ালাম। দু চারটে দোকান ঘুরে কিছু টুকটাক জিনিস কিনলাম। এমনিতেই এই সময়ে এখানে টুরিস্ট খুব বেশি আসে না, ফলে যা হয়, আমাকে কেনাকাটা করতে দেখে আশপাশের সমস্ত দোকানীরা এসে প্রায় ছেঁকে ধরল আমাকে। যাই হোক, দু-তিনটে দোকান ঘুরে কয়েকটা জিনিস নিয়ে বাইকের ক্যারিয়ারে বাঁধছি, এই সময়ে একজন বয়স্কা দোকানী, কাছে এসে একটানা বলতে লাগলেন, ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে – আমার দোকানে এসে ম্যাগি খাও, চা খাও।

আমার একেবারে খাবার ইচ্ছে ছিল না, কারণ এক তো, সময় কম, ফিরতে হবে, দুই, সোনমের বাড়িতে দুপুরে খাবারের কথা হয়ে আছে। এখানে ম্যাগি খেয়ে আমি পেট ভরাতে চাই না, আর আমি চাতাল নই, বাড়ির বাইরে আমি সাধারণত চা খাই না। মৃদু স্বরে বললাম, নেহি জি, আভি কুছ নেহি খানা হ্যায়। মহিলা তবুও নাছোড়বান্দা, খাও না, খাও না, খাও না, আমাকে ততবারই বলতে হচ্ছে, না, খাব না, এখন খাবার ইচ্ছে নেই, পরে কখনো এলে আপনার দোকানেই খাবো।

বাঁধাছাঁদা শেষ করে আমি বাইকে যখন চড়ে বসলাম, মহিলা তখন বুঝলেন যে আর ঘ্যানঘ্যান করে লাভ নেই, এ সত্যিই খাবে না। ওনার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল, কেমন এক্কাদোক্কা খেলার ভঙ্গিতে এক পা দু পা করে নাচতে নাচতে ঘুরতে লাগলেন আমার সামনে, আর আমাকে মুখ ভেঙিয়ে ইমিটেট করতে শুরু করলেন – নেহি জি, নেহি খাউঙ্গা, কুত্তে, নেহি খাউঙ্গা, কুত্তে, হারামি, কুত্তে, হারামি …

রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, ইনি খুব ভালো হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারেন না, খালি হেসে বললাম, গাল দিচ্ছেন? কেন?

মহিলার ভ্রূক্ষেপ নেই, উনি সমানে নেচে যাচ্ছেন আর আমাকে উদ্দেশ্য করে চোখমুখ বেঁকিয়ে কুত্তা-হারামি বলে যাচ্ছেন। আমি আবারও হেসে বললাম, আমি কিন্তু ফিরে গিয়ে সবাইকে বলব আপনি আমাকে এইভাবে গাল দিচ্ছেন। কেউ আসবে না আর আপনার দোকানে চা খেতে …

মহিলা একই রকম। খুব নিচু গলায় একইরকম ভাবে বলে যাচ্ছেন, কুত্তা, হারামি, নেহি খাউঙ্গা জি বোলতা।

আমি আশেপাশের দোকানে তাকালাম। কেউ শুনতেও পাচ্ছে না, কেউ কিছু বলতেও আসছে না, ন্যাচারালি। মহিলার সম্ভবত মাথা খারাপ, কিংবা উনি হয় তো দুটো হিন্দি গালাগাল শিখেছেন, কাউকে দেবার সুযোগ পান নি, আমাকে একলা অপরাধী পেয়ে আমার ওপরেই ঝেড়ে যাচ্ছেন। ইগনোর করাই ভালো। বাইকে স্টার্ট দিলাম, এবং বেরিয়ে গেলাম। আবারও সেই জায়গা এল, যেখান থেকে আমি ক্যাব ড্রাইভারের কথামত ডাইভার্সন নিয়েছিলাম বোল্ডারের ওপর দিয়ে, কিন্তু এখন তো মেন রাস্তা দিয়েই এলাম, কোথাও কোনও অবস্ট্যাকল তো নেই! … রহস্যই রয়ে গেল।

DSC_0226.jpg20171026_123204.jpg

তিনটের সময় ফিরলাম। লাচুং ঢুকতেই ফোনে নেটওয়ার্ক এসে গেছিল, আর আসামাত্রই নীলাদ্রিদা-র ফোন। বললাম, বেরোতে বেরোতে চারটে বেজে যাবে, মঙ্গন পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে ছটা তো বাজবেই। নীলাদ্রিদা বলল, কোনও চিন্তা নেই, আমি সেই মতন অফিস থেকে বেরোব, তুই শুধু চুংথাং এলে আমাকে একবার ফোন করে দিস। আর তোর ভিসার কাগজ প্রিন্ট নেওয়া হয়ে গেছে।

সোনমের ডাইনিং রুমে বসে যে মাংসভাত খেলাম, অনেকদিন তার স্বাদ মনে থাকবে। প্রতিটা পিস তারিয়ে তারিয়ে খেলাম, এতটাই উমদা হয়েছিল। সাথে পাঁপড়, তরকারি, চাটনি, ডাল। একেবারে বাঙালি রান্না যাকে বলে। খেয়ে উঠে বাইকে এইবারে লাগেজ বাঁধাছাঁদা শুরু। তার আগে চাকায় একটু হাওয়া ভরে নিতে হবে। আমার কাছে টায়ার ইনফ্লেটরটা ছিল, সেইটা লাগাতেই সোনম কাছে ঘেঁষে এসে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল। বাইকের ব্যাটারি থেকেই পাওয়ার নিয়ে বাইকের চাকায় হাওয়া ভরা, ব্যাপারটা ওর কাছেও নতুন। খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, আমার মোটরসাইকেলেও একটু হাওয়া ভরে দেবে? লাচুংয়ে কোনও হাওয়া ভরার দোকান নেই, সেই চুংথাং গিয়ে ভরতে হয়।

ভরে দিলাম। গা থেকে ভেস্টটা খুলে ফেরত দিলাম ওকে। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে অবশেষে পৌনে পাঁচটা নাগাদ বেরোতে পারলাম। আজ গ্যাংটক পৌঁছতে যে কত সময় লাগবে, কে জানে! কাল সকালে তো আবার বেরনো।

নেমে আসাটা সবসময়েই সোজা। বেশ অনেকক্ষণ মোটরসাইকেলের স্টার্ট বন্ধ রেখেই এমনি এমনি গড়াতে গড়াতে সাড়ে পাঁচটায় নেমে এলাম চুংথাং। সেখান থেকে নীলাদ্রিদাকে আরেকবার ফোন করে আবার চলা। খানিক পরেই সন্ধ্যে নেমে এল, কিন্তু তাতে আর কোনও অসুবিধে নেই, সুন্দর রাস্তা, বাইকের সমস্ত লাইটও একদম ঠিকঠাক কাজ করছে। একমাত্র অসুবিধে হল, অন্ধকার নেমে এলে চারপাশের সৌন্দর্যগুলো আর উপভোগ করা যায় না, একমনে কেবল চলতেই হয়। চলতেই হয়।

মঙ্গনে ঢোকার মুখেই পেট্রল পাম্প পড়ে। ট্যাঙ্ক ফুল করে নিয়ে আরেকবার নীলাদ্রিদাকে ফোন করে জানানো গেল আমার অবস্থান। ঠিক সোয়া সাতটার সময়ে গিয়ে যেই দাঁড়ালাম সুনীলের সেই চিরাগ দা ধাবার সামনে। দাঁড়ানো মাত্র ফোন বাজল – ‘তুই কি এইমাত্র যে নীল রঙের মোটরসাইকেলটা যাতে নীলরঙের টুনিবাল্ব লাগানো সেইটাতে করে এসে ডানদিকের ধাবাটার সামনে দাঁড়ালি?’
– ‘হ্যাঁ। তুমি কোথায়?’
– ‘পেছন ফিরে দ্যাখ, আসছি।’

পেছন ফিরে দেখি অন্ধকার ফুঁড়ে রাস্তার অন্যপ্রান্ত থেকে বেঁটেখাটো একটা ছায়ামূর্তি ঠিক একই রকম ভাবে হেলেদুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কুড়ি বছর বাদে প্রায় দেখা, নাকি বাইশ বছর? – কিন্তু হাঁটার স্টাইল একেবারে বদলায় নি। চশমার ফ্রেমটা বোধ হয় একটু বদলেছে, চুলে পাক তো ধরেইছে, কিন্তু হাসার ভঙ্গী আর কথা বলার স্টাইলটা টিপিকাল নীলাদ্রিশেখর – অননুকরণীয়।

সুনীলের দোকানে নয়, বসা গেল উল্টোদিকের দোকানে। চা আর স্যান্ডুইচ অর্ডার করে খানিক গল্পগাছা হল। আমার ভুটানের ভিসা একেবারে তিন তিন কপি কালার প্রিন্ট আউট করিয়ে নিয়ে এসেছে, সেসব হস্তান্তরিত হল। পুরানো সেই দিনের অনেক অনেক কথা হল। তবে বিশ বছরের জমানো কথা কি কয়েক মিনিটে শেষ হয়? তাই উঠতেই হল এক সময়ে। মঙ্গনের অনতিদূরেই ডিকচুতে একটি প্রাইভেট হাইডেল প্রজেক্ট, সেখানকার তিনি সিনিয়র ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ার। বেরোবার মুখে প্ল্যান্ট থেকে ফোন এল, অন্যপ্রান্তের কথা তো শুনতে পেলাম না, নীলাদ্রিদা শুনে টুনে বলল – ও, চোদ্দশো মেগাওয়াট নিতে পারছে না? ঠিক আছে, টারবাইনের আরপিএম কমিয়ে দেখুন বারশো মেগাওয়াট করানো যায় কিনা … হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, বারোশোতে রাখুন আমি গিয়ে দেখছি।

সইত্যের খাতিতে বলতে হয়, সংখ্যাগুলো ঠিক বারোশো বা চোদ্দশো ছিল কিনা এতদিনে আর মনে নেই, কিন্তু কলেজ ছাড়ার পরে মাস স্কেলে এই রকমের ‘মেগাওয়াট’, ‘টারবাইন’ শুনে কেমন যেন লাগছিল – মানে, আমারও তো ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং ছিল, কিন্তু আজ তার আর একটা লাইনও মনে নেই, এইসব জার্গন শুনলে টুনলে কেমন গতজন্মে শোনা কথা মনে হয়।

পৌনে আটটার সময়ে উঠতেই হল। আবার কবে দেখা হবে জানা নেই, সামনে এখন অনেকটা পথ পড়ে আছে – এখনও প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। এগোলাম। অন্ধকার রাস্তা, প্রায় কোথাওই কোনও জনবসতি নেই, মাঝমধ্যে দু একটা গ্রাম পড়ছে, সাতটা বাড়ি, দুটো দোকান, তিনটে গাড়ি – ব্যস। অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে আসার পরে ফোন এল হোটেল থেকে, আপনি কতক্ষণে আসবেন স্যার? বললাম, সাড়ে নটা তো বাজবেই। অন্যপ্রান্তের মহিলাটি বললেন, আসলে আমাদের কিচেন নটায় বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি যদি এখানে ডিনার করেন তো অর্ডারটা দিয়ে দেবেন? আমরা খাবার তৈরি করে রাখব।

উত্তম প্রস্তাব। চিকেন চাউমনের অর্ডার দিয়ে আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম। ক্লান্ত লাগছে এইবারে।

পৌনে দশটায় হোটেলে ঢুকলাম শেষমেশ। এবারের হোটেলটি বেশ ভালো। সুন্দর পার্কিং লট, সুন্দর রুম। বিকেল বিকেল এলে একটু আরাম করা যাত, এখন জাস্ট আর খেয়ে ঘুমনো ছাড়া আর কিছু করার নেই।

করার অবশ্য আছে। আমার বই, যা কিনা আর কদিন পরেই প্রকাশিত হতে চলেছে – সেটি এখন প্রেসস্থ। প্রেস থেকে কিছু কারেকশন করে পাঠাতে বলেছে, অতএব, ল্যাপটপ খুলে আবার বসতে হল। প্রুফে কারেকশন সেরে টেরে মেলে ফাইনাল কপি পাঠিয়ে, অবশেষে যখন শুতে যেতে পারলাম, তখন ঘড়িতে বাজে রাত দেড়টা।

তা ভাই, প্রসববেদনা এ রকমই হয়, সে তো আর সময় বুঝে আসে না 🙂

 


One thought on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ৮

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.