দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১০

নবম পর্বের পরে

আঠাশে অক্টোবর, নবম দিন

গান শুনে ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভাঙল গানের সুরে। সকাল সাড়ে ছটা, কাচের জানলা ভেদ করে ঘুমন্ত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সকাল বেলার রোদ্দুর। আমার কিনা মুণ্ডুটাও লেপের তলায় ছিল, তাই আমি বুঝতে পারি নি।

তাড়াতাড়ি উঠে ধড়াচুড়ো পরে বাইরে এলাম। কাঁচা সোনার রঙের রোদ ছেয়ে আছেসামনের মাঠটা জুড়ে, আর আকাশের দিকে তাকালে চোখ সরিয়ে নিতে হয়, এমন চোখ-ধাঁধানো নীল। সামনে ভুলো কুকুর আপন খেয়ালে নেচে বেড়াচ্ছে  দুই মেঘবালিকার আশেপাশে, আর তারা বালতি নিয়ে জল ভরছে সামনের একটা নল থেকে, গলা বেয়ে উঠে আসছে অদ্ভূত মাদকতাময় গানের সুর, ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, ভরিয়ে দিচ্ছে আমাকে।

মোটরসাইকেলটার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। সারারাত শিশির পড়েছে, এবং তার পরে তাপমাত্রা চলে গেছে শূন্যের নিচে, ফলে সেই ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের বিন্দুরা কিছু টের পাবার আগেই জমে বরফ হয়ে গেছে, স্বচ্ছ। ট্যাঙ্ক, সীট আর ক্যারিয়ারের রড জুড়ে সেই স্বচ্ছ জমাট বাঁধা শিশিরদানারা।

প্রাথমিক মুগ্ধতার রেশ কেটে গেলে পরের চিন্তাটা মাথায় আসে। খুব ঠাণ্ডায় মোটরসাইকেলের ব্যাটারি বসে যেতে পারে, স্টার্ট নিতে সমস্যা হতে পারে। স্পিতিতে এই স্টার্ট হবার সমস্যা নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে এসে স্টার্ট দিলাম, না, মোটরসাইকেলের ঠাণ্ডা লাগে নি, সাথে সাথে সাড়া দিল। আওয়াজে পেছন ফিরল মেঘবালিকাদের একজন, চায় পিওগে স্যর?

নিশ্চয়ই খাব। মৃদু হেসে ঘাড় নাড়াবার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার সামনে এসে হাজির হয়ে গেল ধূমায়িত চায়ের কাপ। কনকনে ঠাণ্ডায় এমন উষ্ণ আতিথ্যই কি ধীরে ধীরে গলিয়ে দিল আমার মোটরসাইকেলের সীটে জমে থাকা শিশিরদের? সকালের রোদে বোধ হয় অতটা উষ্ণতা ছিল না।

কাল থেকে এই দুটি মেয়ে আর তাদের একজন বুড়ি মা (মাসি-পিসিও হতে পারেন) ছাড়া আর কোনও পুরুষকে দেখি নি এখানে। আজ দেখছি, সামনে একটা বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর তাকে একটা কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে একটা ছেলে, বেশ মিষ্টি দেখতে। আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে এগিয়ে এল, গুডমর্নিং ভাইয়া। দিল্লি সে আয়ে হো? সানরাইজ দেখনে নহি গয়ে?

সানরাইজ? মানে, এখানকার সানরাইজ কি দেখার মতন কিছু ছিল? কেউ তো বলে নি!

আরে ভাইয়া, কিছু মিস করলে তো। এখানে আমাদের গ্রামের ওই প্রান্তে একটা পয়েন্ট আছে, ওখান থেকে যে সানরাইজ দেখা যায় না, টাইগার হিলে অত ভালো সানরাইজ দেখতে পাবে না। এ হে, তুমি কি আজকেই চলে যাচ্ছো?

আমি ঘাড় নাড়লাম, হুঁ, আমাকে তো আজই চলে যেতে হবে। যাঃ, এখানকার স্পেশাল সানরাইজ দেখা হল না তা হলে – আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আবার আসব নাথাং, একদিন না একদিন। তখন সানরাইজ দেখব এসে।

মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। স্রেফ সময়টুকু দেখাচ্ছে। আর জিপিএসে পরের ডেস্টিনেশন অফলাইন সেট করা আছে, ফলে এর বেশি আর কিছু দেখার নেই মোবাইলের স্ক্রিনে।

একটু বাদেই ব্রেকফাস্টের ডাক এল। ব্রেকফাস্ট এখানে কমপ্লিমেন্টারি। গরম গরম রুটি, এবং তার সাথে একবাটি ডাল আর আলুভাজা। এবং পেঁয়াজ। পেট ভরে খেলাম। এবার বিদায়ের পালা। এত ভালো একটা এক্সপিরিয়েন্স হল, যে এক রাতের থাকার যে ভাড়া, খুবই সামান্য টাকায় বুক করেছিলাম, তার ওপরে আরও একশো টাকা ধরিয়ে দিলাম মেঘবালিকাদের হাতে। তারা তো নেবে না কিছুতেই, শেষে জোরাজুরি করতে খুব লজ্জা পেয়ে নিল, এবং খুব খুব খুশি হল। আমাকে বলল, পরের মাসেই মোবাইলের টাওয়ার ঠিক হয়ে যাবে গ্রামে, এর পর এলে আমি যেন ওদের সরাসরি ফোন করে আসি, ওরা আমার জন্য এই ঘরটাই রেখে দেবে।

বাঁধাছাঁদা সেরে, সাড়ে আটটায় স্টার্ট করলাম। আকাশে খুব কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে অল্প অল্প সাদা মেঘ। ফিরতি অনেকখানি রাস্তা আমার চেনা, আগের দিন এই গ্রামে আসার জন্য যে তিন কিলোমিটার ডিট্যুর মেরেছিলাম, সেইটা আবার ফিরতে হল, তবে আবার মেন রাস্তা। রাস্তার পাশে মাইলস্টোন দেখাচ্ছে এর পরেই আসছে জুলুক, পদমচেন ইত্যাদি জায়গারা। আর জুলুক যাবার পথে তো পড়বেই বিখ্যাত থাম্বি ভিউ পয়েন্ট।

একটু এগোতেই দেখি রাস্তার বাঁকে আমার জন্য অপেক্ষা করছে একতাল মেঘ। মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকে গেলাম তার মধ্যে। ভিজে ভিজে অনুভূতি – আকাশে সূর্য, কিন্তু এই মুহূর্তে তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা, আবার খানিক এগোলাম, মেঘের শেষে আবার ঝলমলিয়ে উঠল সূর্য। পেছন ফিরে না তাকালে মনেই হয় না যে এতক্ষণ মেঘের মধ্যে দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। আবার খানিক বাদে পাশের খাদ থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে আসে মেঘ, ঢেকে দেয় রাস্তা, দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না, তার মধ্যে দিয়ে চালানো। স্বর্গ বুঝি এখানেই – এ যে কী আনন্দের অভিজ্ঞতা, লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

DSC_0268.jpg

একটা মিলিটারি এসটাবলিশমেন্ট পেরিয়ে এলাম। কেউ দাঁড়াতেও বলল না, স্রেফ ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখল, আমি দিব্যি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এসট্যাবলিশমেন্টের পাঁচিল পেরোতেই একটা বাঁক পেরিয়ে দেখলাম সেই অসাধারণ দৃশ্য। দাঁড়াতেই হল।

DSC_0270.jpg

পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছে মেঘ, আর সেই মেঘ একটু সরে গেলেই দেখা যাচ্ছে স্তরে স্তরে জিগজ্যাগ মার্কের মত সরু সরু রাস্তা, ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচের দিকে, যে রাস্তায় একটু বাদেই আমি নামব। অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্য।

DSC_0272.jpg

খানিক সময় কাটিয়ে আবার এগোলাম, এইবারে আস্তে আস্তে নামা, অনেকগুলো আঁকবাঁক পেরিয়ে এল একটা জায়গা, যেখানে লেখা আছে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট, কিন্তু থাম্বির থেকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর ভিউ আমি আরও ওপর থেকেই পেয়ে দেখে এসেছি। সামান্য ছোট একটাস্টপ দিয়ে তাই আবারও নামতে থাকলাম। ক্রমশ মেঘের রাজ্য পেরিয়ে নেমে এলাম আরেকটু নিচে।

পদমচেন এসে গেল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় একটা সবুজ গালিচা বিছানো, সেইখানে ছোট্ট ছোট্ট খেলনার মত কিছু বাড়ি। ছবির মত সুন্দর।

DSC_0278.jpg

পদমচেন আসতেই পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। সিগন্যাল এসে গেছে। ফোন এসেছে একটা। হেলমেটে ব্লুটুথ স্পিকার সেট করাই আছে, ফোন ধরতেই দেখি গ্যাংটকের সেই হোটেলের ভদ্রলোকটি, আমি যে নর্থ সিকিম সেরে ফিরতি পথে ওনার হোমস্টে-তে দ্বিতীয়বার থাকার বুকিংটা ক্যানসেল করেছিলাম, সে খবর বোধ হয় উনি পান নি, এখন আমাকে নেটওয়ার্কে পেয়ে ফোন করেছেন, আপনি এলেন না তো?

ঝটিতি বললাম, না, আমি আটকে পড়েছিলাম, ফিরতে পারি নি লাচুং থেকে, তাই আসতে পারি নি, আর এখন আমি সিকিম থেকে চলে এসেছি – বলেই কেটে দিলাম। এনার সঙ্গে আর বেশিক্ষণ ভদ্রতা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই।

আজকে আমার গন্তব্য রোরাথাং। পশ্চিমবঙ্গ সিকিম সীমান্তে রংপো নদীর কিনারে একটি হোমস্টে, কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে। অনেক খুঁজেপেতে এদের পেয়েছিলাম। রেশিখোলায় তো সবাই যায় – আমি অফবিট লোকেশন হিসেবেই এই জায়গাটা চুজ করেছিলাম। হোয়াটস্যাপে কথাবার্তা হয়েছিল, আমি দিল্লি থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছি শুনেই হোমস্টে-র মালিক খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, তুমি তা হলে আমাদের হোমস্টে-র ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হবে। তোমার বইতে আমার হোমস্টে-র কথা লিখবে। সামান্যই খরচ এক রাতের থাকার জন্য, তাতে ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। ব্রেকফাস্টের অপশনও হোয়াটস্যাপে লিখে দিয়েছিলেন উনি – লুচি তরকারি বা চাউমিন, রাতে রুটি-চিকেন। খুবই উৎসাহী হয়েছিলাম আমিও, সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাবো, যেখানে আমার চেনাশোনা কেউ যায় নি।

বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ রংপো নদীর ধার বরাবর এগিয়ে একটা বড়সড় ব্রিজে এসে পৌঁছলাম। জিপিএস বলছে এটার নাম রোরাথাং ব্রিজ, এখান থেকে ব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকে দু কিলোমিটার গেলেই কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে। ব্রিজের নিচে রেশিখোলা নদী এসে মিশেছে রংপো নদীর বুকে। অবশ্য, নদীটার নাম বোধ হয় রেশি বা ঋষি। নেপালি ভাষায় খোলা নামেই নদী।

সকালের ঠাণ্ডার লেশমাত্র আর নেই, গায়ের জ্যাকেট ছ্যাঁকা দিচ্ছে, আমি সমতলের খুব কাছাকাছি নেমে এসেছি, কিন্তু এখন জ্যাকেট ছাড়ার উপায় নেই, একেবারে হোমস্টে-তে পৌঁছে হাল্কা হতে হবে। ব্রিজ পেরিয়ে আমি বাঁদিকের রাস্তা নিলাম।

এপারে রাস্তা বেশ বেশ খারাপ। মোটরসাইকেল চলল লাফাতে লাফাতে, ঠিক দু কিলোমিটারের মাথায় পৌঁছে দেখি জিপিএস বন্ধ হয়ে গেল, ইওর ডেস্টিনেশন হ্যাজ অ্যারাইভড। কিন্তু কোথায় সে হোমস্টে?

নদীর ধার বরাবর রাস্তা, নদীর অন্যপারে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট রিসর্ট টাইপের, বেশ কয়েকটা চালাঘর মত ছাউনি দেওয়া ঘর, সামনে একটা প্লে-এরিয়া, একটা ছাউনির ওপর বড় বড় করে লেখা – যা নদীর এপার থেকেও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, কান্নন রিভারসাইড হোমস্টে।

লে হালুয়া। জিপিএস আমাকে এনে ফেলেছে নদীর অন্য পারে। মানে ব্রিজের আগেই নিশ্চয়ই কোনও রাস্তা আছে ওখানে পৌঁছনোর, আমাকে ফিরতে হবে রোরাথাং ব্রিজের দিকেই, কিন্তু তার আগে হোমস্টের মালিককে একবার ফোন করা যাক।

প্রথমবার ফোন করলাম, কেউ তুলল না। পিঠ পুড়ে যাছে সূর্যের তাপে। তিন মিনিট অপেক্ষা করতে আবার ফোন করলাম, এইবারে ফোন তুললেন মহিলা – বললাম, আমি পৌঁছে গেছি, কিন্তু নদীর অন্য পার থেকে দেখছি, কী করে পৌঁছবো আপনাদের হোমস্টে-তে?

উনি বললেন, একেবারে চিন্তা করবেন না, আপনি ব্রিজে ফিরে আসুন, ওখানেই দাঁড়ান – আমি হোমস্টে-র ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি, ও আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। আমি বাজারে আছি, একটু পরে ফিরব।

খুব ভালো কথা। আবার সেই ভাঙা রাস্তা ধরে ফিরে এলাম ব্রিজের ওপরে। দূরে দূরে একটা দুটো গাড়ি, মোটরসাইকেল, স্থানীয় লোক, হয় ব্রিজের ধারে পা ঝুলিয়ে গল্প করছে, নয় তো গাড়ি পরিষ্কার করছে। পৌনে একটা বাজে, একটা অলসতা ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে।

দেড়টা বাজে। রোদে সারা গা তেতেপুড়ে যাচ্ছে। কারুর দেখা নেই, প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট  হয়ে গেল। আরেকবার কি ফোন করব?

আরও পাঁচ মিনিট বাদে একটা ছেলে, পনেরো ষোল বছর বয়েস হবে – এসে ইশারা করল আমার দিকে। কান্নন থেকে এসেছে। মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম। ব্রিজ পেরিয়ে এইবারে বাঁদিকের বদলে ডানদিকে বেঁকতে বলল ছেলেটা।

ব্রিজের শেষেই, ডানদিক ঘেঁষে একটা চায়ের দোকান। রাস্তা চলে গেছে এদিকেও, একই রকমের ভাঙাচোরা। ছেলেটা আমাকে বলল, এইখানে মোটরসাইকেলটা রেখে দিন।

মানে? আর লাগেজ?

ছেলেটা বলল, হোমস্টে অবধি তো গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না, হাতে হাতে নিয়ে যেতে হবে। নদীর ওপর দিয়ে হাঁটা – নদীতে তো এখন জল নেই। এইখানে মোটরসাইকেল রাখলে কোনও অসুবিধে নেই, আমার এই দোকানের লোকটাকে বলে রাখা আছে, ও দেখে, রাতেও দেখবে।

আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম। সবশুদ্ধ চার পাঁচখানা ব্যাগপত্র নিয়ে, কিছু না হোক, অন্তত চল্লিশ কিলো লাগেজ নিয়ে চলেছি আমি। এ একটা রোগাসোগা ছেলে, কত লাগেজ বইবে? আর বইতে হবে তো – কতদূর? হোমস্টে তো দেখে এসেছি, অন্যদিকে, এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে। নদীতে জল প্রায় নেই, খুবই কম – কিন্তু এই চল্লিশ কিলো লাগেজ নিয়ে দুজনে মিলে নদীর বেড ধরে দু কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে উঠতে হবে হোমস্টে-তে থাকার জন্য? আর নদীর বেড মানে, বড় মেজ বোল্ডারের ওপর দিয়ে হাঁটা। গুরু, এটা তো সিলেবাসে ছিল না! এবং এর মানে, কাল সকালে আবার এই লাগেজ নিয়ে ভোরবেলায় উঠে দু কিলোমিটার হেঁটে আসতে হবে মোটরসাইকেল অবধি, তার পরে বাঁধতে হবে? এ তো সাংঘাতিক একটা ব্যাপার! মানে, করতে চাইলে করাই যায়, কিন্তু একটা হোমস্টে-র আতিথ্য নেবার জন্য এত লেবার দিতে যাবো কেন আমি? আর এই বাচ্চা রোগাসোগা ছেলেটাকে দিয়ে বিশ পঁচিশ কিলো মাল আমি বওয়াবোই বা কেমন করে?

সম্ভব নয়। সবে পৌনে দুটো বাজে, জিপিএসে দেখে নিলাম – রংপো টাউন এখান থেকে মাত্রই দশ কিলোমিটার দূরে, সাড়ে তিনটের মধ্যে আরামসে পৌঁছে যাব। কিন্তু এইভাবে ঠা-ঠা রোদের মধ্যে লাগেজ নিয়ে নদীর ওপর দু কিলোমিটার হাঁটতে পারব না। ভাগ্যিস অ্যাডভান্স কিছু দিয়ে রাখা নেই। ছেলেটাকে বললাম, তুমি ফিরে যাও, মালিককে বোলো, আমি এখানে থাকছি না।

আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। বাঁদিকের রাস্তা। রংপো, এগারো কিলোমিটার। অসম্ভব ভাঙাচোরা রাস্তা, তার ওপর, এ আবার বাসরাস্তা। ওদিক থেকে বাস আসছে, এবং তখন প্রায় সাইডে সরে দাঁড়ানোর মতও জায়গা থাকছে না।

প্রায় আট কিলোমিটার চলার পর রাস্তা ঠিক হল। পাহাড়ের অনেকটা নিচে নেমে এসেছি, এখন আর তত সৌন্দর্য নেই, দুপাশের গাছপালায় পুরু ধুলোর স্তর, ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে এক জায়গায় এসে আটকে যেতে হল। সামনে লম্বা গাড়ির লাইন। বেশ কিছু ডাম্পার, বুলডোজার আর ট্রাক ব্যস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে।

একটু এগিয়ে বোঝা গেল সামনে ছোট করে ধস নেমেছে, রাস্তা বন্ধ, সেইটা সাফ করার তোড়জোড় চলছে। ভারী ধুলোর মেঘ পাক খাচ্ছে সর্বত্র। নাকমুখ কষে বেঁধে বসে রইলাম। কিছু করার নেই, এগনো সম্ভব নয়।

প্রায় আড়াইটে বাজে – খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। সেই সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, পেটে এখন আর কিছু নেই। সেই কুড়ি তারিখে যেদিন দিল্লি থেকে বেরিয়েছিলাম, বেরোবার সময়ে সিকিনী একটা বড় হরলিকসের বোতল ভর্তি করে চিড়ে-বাদামভাজা ভরে দিয়েছিল, রাস্তায় আপৎকালে যদি কাজে লাগে। জানিয়ে রাখা ভালো, সিকিনীর রান্নার হাতটি অতি চমৎকার, সে চিড়েভাজাই হোক বা মোচার ঘণ্ট, কিংবা মাটন রেজালা। তো, সেই চিড়ে-বাদাম্ভাজা আজ এইখানে আপৎকালে কাজে লেগে গেল। পিঠের ব্যাগ থেকে হরলিকসের বোতল বের করে গপগপ করে খানিক চিড়েভাজা খেয়ে ঢকঢক করে আধ বোতল জল। ব্যস। এখন ঘণ্টাদুয়েকের জন্য নিশ্চিন্ত।

টানা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে রাস্তা খুলল, প্রথমেই আমাদের দিকের ট্র্যাফিক। আমি, আরও কয়েকজন স্থানীয় ছেলেপুলে ছিল মোটরসাইকেলে, আমরা আগে বেরিয়ে গেলাম – এবং আর কয়েক কিলোমিটার যেতেই দস্তুরমত একটা বাজার এলাকায় এসে পৌঁছলাম, সামনেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বড় মত হোর্ডিং, রংপো ব্র্যাঞ্চ। চারদিকে দোকানপাট, পেট্রলপাম্প, ছোটমাঝারি হোটেল এবং প্রচুর প্রচুর ট্র্যাফিক। তিনমাথার মোড় একটা।

খুবই ক্লান্ত, যদিও খুব বেশি চলা হয় নি আজ, কিন্তু মূলত সকালবেলার সাথে এখনকার টেম্পারেচার ডিফারেন্সটা আমাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। পেট্রল পাম্পের ঠিক সামনেই দেখলাম সিকিম ট্যুরিজমের হোটেল। জানি, দামী হবে, কিন্তু আর শস্তা দেখে কী করব, আজই শেষ রাত আমার সিকিমে, ইন ফ্যাক্ট, এটাকে সিকিম না বলে পশ্চিমবঙ্গ বললেও হয়, কারণ, পেট্রল পাম্পের পাশেই একটা ছোট্ট ব্রিজ, রংপো নদীর ওপর, আর ব্রিজের ওপারটাই কার্শিয়াং। পশ্চিমবঙ্গ। ঢুকে গেলাম সিকিম ট্যুরিজমের হোটেলে। এগারোশো টাকায় তোফা একটা ঘর পেয়ে গেলাম। স্রেফ ঘরটা দোতলায়, ফলে মোটরসাইকেল থেকে লাগেজ বের করে ওপরে আনা নেওয়া করতে একটু সময় গেল।

লাগেজ রেখে আবার নেমে এলাম। চারপাশে অসংখ্য খাবার দোকান, বাইরে বেরিয়ে খানিক খাবার প্যাক করে নিয়ে এসে বিকেল পাঁচটার সময়ে খেতে বসলাম। এতক্ষণে মোবাইল খোলার সময় হল।

অসংখ্য মেসেজ জমা হয়েছে এই কদিনে। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। শৌভিক মেসেজ করেছে – তুই কবে জয়গাঁওয়ের দিকে আসছিস?

শৌভিক আমার হুগলির বন্ধু। আমরা একসাথে পড়তাম, ব্যান্ডেল সেন্ট জনস হাইস্কুলে, তার পরে হুগলি ব্র্যাঞ্চ হাইস্কুলে ইলেভেন টুয়েলভ। এর পরে আমি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে চলে আসি জলপাইগুড়ি, শৌভিক জেনারেল স্ট্রিমে পড়াশোনা শেষ করে এখন কাজ করে – মূলত উত্তরবঙ্গ জুড়েই ওর কাজের “ফিল্ড”। মালদা থেকে কুচবিহার। শিলিগুড়িতে অফিস আছে, ইন ফ্যাক্ট, শুরুতে আমি যখন এই জার্নির প্ল্যান করেছিলাম, তখন শৌভিক উৎসাহ দেখিয়েছিল আমার সঙ্গে অন্তত সিকিমটা করার। ও একটা বুলেট চালায়, যদিও ঠিক সেই অর্থে লম্বা রেসের ঘোড়া ও নয়, তবে আমি বেরিয়েছিলাম মাসের শেষদিকে, সেই সময়ে ওর পক্ষে ছুটি ম্যানেজ করা সম্ভব হয় নি, সেলসে কাজ করে, মাসের শেষ কয়েকদিন ওকে অ্যাকাউন্টসের সাথে বসে সারা মাসের হিসেব মেলাতে হয়, ছুটি পায় না। সেই শৌভিক মেসেজ করেছে – আমি মালবাজারের মোড়ে তোর জন্য অপেক্ষা করব, কাল কখন আসছিস জানা, ওখান থেকে আমরা একসাথে জয়গাঁও যাবো। স্কুল ছাড়ার পরে আমাদের মধ্যে আর কখনও দেখা হয় নি – ফেসবুকের মাধ্যমেই যেটুকু যোগাযোগ রয়ে গেছে।

শৌভিককে ফোন করলাম। কাল আমার জয়গাঁও পৌঁছবার দিন, মোটামুটি কোন সময়ে মালবাজারে পৌঁছতে পারি, সেই বিষয়ে একটা আইডিয়া দিয়ে কথা দিলাম, দেখা হবে।

সিকিমের পাট শেষ, মুগ্ধতার এই রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন। আমি আবার আসব, স্পেশালি এই ইস্ট সিকিম দেখার জন্য আমাকে আবার আসতেই হবে, এবার আসব আরও বেশি সময় হাতে নিয়ে।

কাল নতুন পথের যাত্রা। মোটরসাইকেলে প্রথমবারের জন্য, আমার সো-কলড “বিদেশভ্রমণ”।


4 thoughts on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১০

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.