গাড়ি চলল থানা থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে। এটুকু জেনেছিলাম আমরা ডিনার করব ফুন্টশোলিংয়ের কোনও এক রেস্তরাঁয়, কিন্তু ভুটান গেট তো ডানদিকে, এরা বাঁদিকে যাচ্ছে কেন?
খানিক এগিয়ে বুঝলাম, মেন রাস্তার প্যারালাল আরেকটা রাস্তা দিয়ে, অন্য কোনও একটা এন্ট্রি দিয়ে আমরা ভুটানে ঢুকলাম। এমনিতে সাড়ে নটার সময়ে ভারত থেকে ভুটানের দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় – কিন্তু এটা হল পুলিশের গাড়ি, জয়গাঁও থানার ওসি, তাঁর গতি অবাধ ফুন্টশোলিংয়ের সর্বত্র। ঢোকার মুখে চোস্ত ভুটানি ভাষাতেই ভুটানি নিরাপত্তারক্ষীটির সাথে কী সব কথা বলল স্বরাজ, ভুটানি পুলিশটি একগাল হেসে গাড়ি যাবার জায়গা করে দিল, কুড়ি কুড়ি বছরের পার জীবন বয়ে যাবার পরে আমি আবার ভুটানে ঢুকলাম পুলিশের গাড়িতে চেপে।
রাত হয়েছে, গাড়ির ভেতরে কথা চলছে মূলত তিনটে ভাষায় – বাংলা, বিহারি অ্যাকসেন্টের হিন্দি আর একটা অজানা ভাষায় – সেটা মদেশিয়া ভাষাও হতে পারে, ভুটানিও হতে পারে – আমি শিওর নই। আমি মূলত শ্রোতার ভূমিকায়। একজন ছিলেন গাড়িতে, বেশ হাসিখুশি, তিনি দু একটা রেস্তরাঁর অপশন দিলেন ড্রাইভারকে, ড্রাইভারটিও বেশ আমুদে, কথায় কথায় জানা গেল আরও একটি গাড়িতে করে আরও দুজন সামনে সামনেই আছে, তারা নির্দিষ্ট রেস্তরাঁটির সামনে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
পৌঁছলাম সেখানে – গাড়ি লাগিয়ে দেবার পরে ভেতর থেকে একজন খবর নিয়ে এসে বলল, ইধার কারাওকে নেহি হ্যায়। বাকিদের চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা ফুটে উঠতে দেখলাম – কারাওকে নেহি হ্যায়? তো এখানে ঢুকে আর কী হবে? অ্যায়, এখানে কারাওকে-ওলা রেস্টুরেন্ট আর কটা আছে?
আমি বেশ ঘেঁটে যাচ্ছি, এসেছি তো রাতের খাবার খেতে, তাও ভেবেছিলাম স্বরাজ আর আমিই আসছি, বাকিরা আসবেন আন্দাজ ছিল না, তাও না-হয় এলেন, কিন্তু কারাওকের সঙ্গে খাবারের কী সম্পর্ক?
গাড়ি আবার পার্কিং থেকে বেরোল পরের খোলা রেস্তরাঁর খোঁজে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। লাইসেন্সড ছাড়া এই সময়ে খাবারের দোকান খোলা থাকার কথা নয় ভুটানে। কথায় কথায় জানলাম, আমার জন্যেই আজ এত খাতিরদারি। আমি বড়বাবুর কলেজের বন্ধু, আজ তাই স্পেশাল ডিনার, সাথে স্পেশাল এন্টারটেনমেন্ট – গান, কারাওকের সাথে। হাসিখুশি লোকটি, জানা গেল, গান করেন নিজের কাজকর্মের বাইরে – তিনি কারাওকেতে গান গেয়ে আমাদের মনোরঞ্জন করবেন। মনোরঞ্জনের রঙ যেন ফিকে না হয়, তাই একটা বারএ গাড়ি থামিয়ে কিছু বোতলও তুলে নেওয়া হল, আর এইবারে আমি প্রমাদ গণলাম। রাত পৌনে এগারোটা বাজে, এবং আমাকে কাল সকালে উঠতে হবে। এমনিতেই অ্যালকোহল জিনিসটার সামনে আমি একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যাই, কিন্তু … কিছু করার নেই আপাতত। এখন ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
একটা অর্ধেক বন্ধ রেস্তোরাঁ কাম হোটেলের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। অর্ধেক শাটার নামানো ছিল, মানে, রেস্তরাঁ বন্ধ হয়েই গেছে, কিন্তু গিয়ে জানানো হল জয়গাঁও থানার বড়বাবু এখন কয়েক ঘণ্টার জন্য আতিথ্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, অতএব, খানিক অনিচ্ছে সত্ত্বেও তারা শাটার তুলে আমাদের ঢুকতে দিল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এলাম।
রেস্তরাঁ প্রায় অন্ধকার, কেউ নেই, পাশে একটা প্রাইভেট রুম। সেখানে গুটি তিনেক লম্বা সোফা লাগানো, আর সামনে রাখা একটা ইয়াব্বড়ো টিভি, দুপাশে সাউন্ড সিস্টেম। আমরা গিয়ে বসলাম, এবং বসামাত্র হুকুম হল, অ্যায়, কারাওকে অন করো।
একটি সিস্টেম, টিভির সাথেই লাগানো, অন হল, আমাদের হাতে এল একটি রিমোট, একটি ছেঁড়াখোঁড়া ক্যাটালগ আর একটি কর্ডলেস মাইক। বিস্তর চর্চার পর গান ঠিক হল, হাসিখুশি সঙ্গীটি পুরনো দিনের গান প্রেফার করেন জেনে আমিও একটু স্বস্তি পেলাম, কারণ আমার পছন্দও পুরনো দিনের গানেই, আর অন্তত পক্ষে সেগুলো লাউড হবে না বেশি। রেস্ট পেয়েছি দুপুর থেকে – তবুও রাত এগারোটায় শরীর এখন বিশ্রাম চাইছে। কাল সকালে উঠে পারমিট করিয়ে যেতে হবে পারো, অনেকটা রাস্তা – এখন আর জোরালো আওয়াজ ভালো লাগছে না।
কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলার আগেই একটি গানের জোরালো মিউজিক বেজে উঠল টিভির সাউন্ড সিস্টেমে, এবং আমাদের সঙ্গী গান ধরলেন – আজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে …
দু স্ট্যাঞ্জা গাইবার পরে বুঝলাম ইনি হাইফাই না হলেও মন্দ গান না, তবে প্রতি দু লাইনে এএএ – ব্বাবাআআআ বলে একটা চিক্কুর পাড়ার স্বভাব আছে, স্টেজে গাইতে গাইতে অভ্যেস হয়ে গেছে হয় তো। মুবারকেঁ তুমহে কি তুমমম, কিসি কি নূর হো গয়ি –এএএ-ব্বাবাআআআ, কিসি কে ইতনে পাস হো, কি হম সে দূর হো গয়ে – এএ-ব্বাবাআআআ – আজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে …
মাইক হাতফেরতা হতে থাকল, গায়কের হাত থেকে স্বরাজের হাতে, সেখান থেকে আমার হাতে, বাকিদের হাতেও, সবাই প্রাণপণে নিজেদের সুগায়ক প্রমাণিত করার চেষ্টা করে যেতে থাকল, আর আমার তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি অবস্থা – উরেবাবা, পুলিশের সাথে ডিনার করার যে এই পরিণতি, কে জানত। একটা গান ছেড়ে পরের গান, সেটার পরে আরেকটা গান – এদিকে বোতল খালি হয়ে যাচ্ছে, খাবারের নাম নেই। অর্ডার অবশ্য একটা দেওয়া হয়েছে, প্রায় সাড়ে এগারোটা – কী আর খাবো, খানিক চিকেন কারি আর রুটি বলেছি, উপরোধে এক বোতল বীয়ারও খেতে হয়েছে, তার পরে তিনবার টয়লেটেও যেতে হয়েছে, প্রত্যেকবারেই টয়লেট যাবার সময়ে মনে হচ্ছিল, আআআহ, কী শান্তি, এখানে ঐ ঘরের আওয়াজ এসে পৌঁছচ্ছে না। কিন্তু অখণ্ড নীরবতার মাঝে শরীরের ভেতর সমানে কিছু একটা জানান দিয়ে যাচ্ছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। পেটের ভেতর থেকে একদম রেকটামের কাছ পর্যন্ত কী রকম যেন একটা শিরা টেনে ধরার মত হাল্কা যন্ত্রণা, খানিকক্ষণ হচ্ছে, আবার থেমে যাচ্ছে। যখন থেমে যাচ্ছে, একেবারে কিছু নেই, কিন্তু যখন হচ্ছে, বেশ ভালোরকম অস্বস্তি হচ্ছে।
টয়লেট থেকে ফিরে এলাম আবার সেই ঘরে। গানের তেজ বেড়েছে বই কমে নি, নেশাও চড়েছে অল্পবিস্তর সকলের। গান হচ্ছে, খানিক গল্প হচ্ছে, মূলত এলাকার ব্যবসাপত্রের হাল হকিকত, কিছু পরিচিত রেফারেন্স সমেত – যেগুলোর সাথে আমি একেবারেই অপরিচিত।
একটি মেয়ে এল রাত বারোটা নাগাদ, সম্ভবত রেস্তরাঁর পরিচালক, এসে খুবই বিব্রত এবং জড়োসড়ো মুখ করে বলল, স্যারেরা যদি একটু আস্তে করেন ভল্যুমটা, হোটেলের বোর্ডারেরা কমপ্লেন করছে, তারা ঘুমোতে পারছে না …
বলামাত্র, আপাত শান্ত, হাসিখুশি গায়ক ভদ্রলোকটির মুখের চেহারা গেল পালটে। নেশা চড়েছে বোঝা যাচ্ছিল সহজেই – খুব অ্যাগ্রেসিভ এবং জড়ানো কণ্ঠে মেয়েটিকে উঠে দাঁড়িয়ে যা বললেন, তা হল এই – কোন শালার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে? তাকে নিয়ে আসো এই রুমে, বলো গিয়ে জয়গাঁও থানার বড়বাবু এসেছেন এখানে, তাঁর যতক্ষণ ইচ্ছে হবে এখানে গান চলবে, যতক্ষণ থাকবেন এখানে খাওয়াদাওয়া চলবে, কার বাপের তাতে কী? যাও – বলে দাও ভল্যুম কমবে না।
মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেছিল, স্রেফ জয়গাঁও থানার বড়বাবু সামনে বসে আছেন, হয় তো সেই জন্যেই আর কথা না বাড়িয়ে, মুখ নিচু করে মেয়েটি আস্তে আস্তে পেছন ফিরে, দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে শুধু দেখলাম। লোকটি, যেন কিছুই হয় নি, এমন ভাব করে পরের গান বাছতে লেগে গেছেন আবার।
জয়গাঁও থানার বড়বাবুর প্রতাপ তা হলে পাশের রাষ্ট্র ভুটানের একটা ছোট শহর পর্যন্ত বিস্তৃত! যে বড়বাবু একদিন আমার সাথে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তেন!
স্বরাজ বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিজেও বুঝল, তাল কেটেছে। তড়িঘড়ি সোজা হয়ে বসে বলল, না না, বহুত রাত হো গয়া। আমার বন্ধুকে কাল সকালে আবার বেরোতে হবে, খাবারটা দিয়ে দিতেই বলে দাও।
খাবার এল। খেলাম। রাত প্রায় দুটো বাজে যখন, তখন উঠলাম, আমি তখন টায়ারনেসের শেষ সীমায়। মনে মনে ঠিক করলাম, কাল অন্তত আটটা অবধি তো ঘুমোতেই হবে। ফুন্টশোলিংয়ে ইমিগ্রেশন অফিস খুলবে সকাল নটায়। তাড়াতাড়ি উঠে গোছগাছ সেরে নিয়ে বেরোব।
গাড়ি আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে এল ভারতে। স্বরাজের বাকি বন্ধুরা যথাসম্ভব আপ্যায়ন করে আমাকে হোটেলের গেট অবধি ছেড়ে দিলেন, এবং বললেন, আমি যেন কাল চলে না যাই, কাল আমরা আবার পার্টি করব। আমি কুঁইকুঁই করে জানালাম, আমার তো ছুটি লিমিটেড, আর কাল থেকে আমার পারোতে হোটেল বুক করা আছে। সেটা সেরে কলকাতা যেতে হবে, তার পরে দিল্লি – লম্বা জার্নি, একটা দিনও নষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ইত্যাদি।
বন্ধুরা খুবই মনক্ষুণ্ণ হয়ে আমাকে শুভরাত্রি জানালেন, দাবি করলেন আমি যেন আবারও জয়গাঁও বেড়াতে আসি এবং সেবারে যেন শুধু জয়গাঁওতে তাঁদের আতিথ্য নেবার জন্য আরও বেশিদিন হাতে নিয়ে আসি – আমি মিষ্টি হেসে সবাইকে ‘অবশ্যই’ বললাম এবং প্রায় টলতে টলতে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুলাম।
ধুপুস। আর কিছু মনে নেই।
তিরিশে অক্টোবর, একাদশ দিন
সকাল ছটায় ঘুম ভাঙল, তলপেটে তীব্র যন্ত্রণা সমেত। সেই এক জিনিস – নাভির কাছ থেকে কিছু একটা যেন টেনে ধরছে রেকটামের দিক পর্যন্ত। কোমর টাটিয়ে যাচ্ছে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে কষ্ট হচ্ছে।
আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোর কাটল। বাথরুমে গেলাম, ফ্রেশ হলাম, কিন্তু সমস্যা কমল না। সাথে পেনকিলার আছে, কাল রাতে খেয়ে শুলেই হয় তো ভালো হত, এখন খাওয়া একেবারেই উচিত নয়, সামনে সারাদিনের রাইডিং আছে, ইমিগ্রেশন অফিসে দৌড়ঝাঁপ আছে, রাতে মাত্র চার ঘণ্টার ঘুম সেরে এতকিছু মেকআপ দেওয়া সম্ভব নয়, অতএব এখন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে হবে। একেবারে পারোতে পৌঁছে পেনকিলার খাবো, যদি তখনও ব্যথা থাকে তো।
সকালে উঠে আমার চা খাবার একটা অভ্যেস আছে, কিন্তু নেশা নেই। আমি সাধারণত বাড়ির বাইরে চা খাই না। তাই দাঁত মেজে নিচে নেমে রাস্তায় এলাম, একটু টাকা পয়সা তুলতে হবে। … এতক্ষণে যন্ত্রণাটা খানিকটা সহ্যের মধ্যে এসেছে, মানে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। দেখি একটু হাঁটাহাঁটি করে যদি কমে।
বাইরে হাল্কা ঠাণ্ডা আমেজ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, যদিও তাতে ভিজে যাবার বিশেষ কোনও চান্স নেই। এটিএম একটু দূরেই, গেলাম, টাকা পয়সা তুলে ভাবলাম একবার ইমিগ্রেশন অফিসটা রেকি করে আসি।
থানা পেরিয়ে দু পা এগোতেই ডানদিকে ভুটান গেট। স্মৃতিরা মাঝে মাঝেই ঝাপটা দেয় – শেষ যখন এসেছিলাম, তখন স্রেফ হাতে গোনা কয়েকটা দোকানপাট ছিল, আর এই জমকালো গেটটা ছিল, গেট দিয়েই আমরা ঢুকেছিলাম বেরিয়েছিলাম। এখন চারদিকে – না, আলিপুর দুয়ার জেলা নয়, জয়গাঁও নয়, সমগ্র ভারত যেন হামলে পড়ছে তার যাবতীয় কদর্যতা নিয়ে, গায়ের ওপর গা লাগানো ঘিঞ্জি দোকানপাট, কালো ধোঁয়া বের করা কাটাতেলের অটো, সাইকেল, রিক্সা, স্কুটার, আর পিলপিল করছে অগুন্তি লোক। থানা পেরিয়ে যে রাস্তাটা একদম ভুটানের বর্ডারে এসে একটা টি জাংশনে শেষ হচ্ছে, সেইখানে একজন ভারতীয় সেনার জওয়ান মেশিনগান হাতে ছোট্ট ছাউনিতে বসে লোকজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন, তার ডানদিকে ওপরে নিচে বড় বড় বোর্ডে ভারতের জাতীয়তাবোধ একেবারে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, শহীদের বলিদান, ভারতের ম্যাপের ওপর সিংহবাহিনী ভারতমাতা তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে পোজ দিচ্ছেন, এদিকে এক দিয়া শহীদোঁ কে নাম, বন্দে মাতরম, মানে আপাতমস্তক শহীদের হাহাকারে মাখানো জিঙ্গোয়িস্টিক দেশপ্রেমে মোড়া সামনের পাঁচিলের ভারতের দিকটা।
মনে মনে হাসলাম – কতটা তফাত সেই নাথু লা পাসের বিলবোর্ডগুলোতে আর এই জয়গাঁওয়ের বিলবোর্ডগুলোতে। ওখানে সীমান্তের অন্যপারে চীন, তাই এপারে ভারত মানে ভরতনাট্যম, তাজমহল আর লালকেল্লার সুবিশাল ছবি, আর এখন সীমান্তের অন্যপ্রান্তে ভুটান, যাদের অস্তিত্বই রয়েছে ভারতের জন্য, ছোট্ট নির্ঝঞ্ঝাট বন্ধুত্বপূর্ণ একটা রাষ্ট্র, তার সামনে তাই ভরতনাট্যম নেই, তাজমহল নেই, কেবল জঙ্গী উগ্র দেশপ্রেমের ছড়াছড়ি – যা দেখে ভারত দেশটার শক্তি সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগে, সমীহ জাগে। ছোট ভাইয়ের সামনে বড়দাদা তার ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই বড় দাদাই যখন আরও বড় এক দাদার সামনে, তখন তার তেজ সেখানে দৃশ্যমান নয়।
ছবি তুললাম একটা। তার পরে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে ক্যামেরা ফোকাস করে ভুটান গেটের ছবি নিচ্ছি – এমন সময়ে ছোট্ট ছাউনি থেকে জওয়ানটি আমাকে ডাকলেন – তুমি কি এদিককার ছবি নিয়েছো?
এদিককার মানে এই – জওয়ান সমেত চারপাশের বিলবোর্ড। বেমালুম অস্বীকার করলাম, কই না তো! আমি তো এই জাস্ট ক্যামেরা অন করলাম, ভুটান গেটের একটা ছবি নেব বলে। জওয়ান বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, হাঁ, সিরফ গেট কা ফোটু লেনা, ইধর কা ফোটু লেনা অ্যালাউড নেহি হ্যায়।
মুখে বললাম, জরুর, জরুর, মনে মনে বললাম, ফোটো শালা। বলে, ভুটান গেটের ছবি নিলাম।
এইবারে একটু পায়ে হেঁটে ঢোকা যাক। কিন্তু কী আশ্চর্য, এগোতে যেতেই গেটের মুখে ভুটানি পুলিশ আটকে দিল, ইধারসে নেহি ইধারসে নেহি, উধারসে এন্ট্রি।
সে আবার কী? এখন ভুটান গেট দিয়ে ঢুকতে দেয় না? ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, তাই তো! গাড়ি বেরোচ্ছে বটে ফুন্টশোলিং থেকে ভুটান গেট দিয়ে, কিন্তু না মানুষ, না গাড়ি, কেউই তো ঢুকছে না এখান দিয়ে!
এইবারে বুঝলাম কাল স্বরাজের গাড়ি কেন আমাদের ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছিল। পেছন ফিরলাম। সেই জওয়ান যেখানে বসে ছিলেন, তার থেকে একটু এগিয়েই ডানহাতে পদযাত্রীদের জন্য এন্ট্রি। একটা সরু গেট পার হয়ে ফুন্টশোলিংয়ে ঢুকতে হয়। ঢুকলাম। ঢোকামাত্র পরিবেশ বদলে গেল। গেটের ওপ্রান্তে কেওটিক ভারত, আর এ পাশে সুন্দর, শান্ত, সাজানো, ছবির মত ভুটান, কোথাও হর্ন বাজছে না, কোথাও অটোরিক্সা কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে না, কেউ লাইন ভেঙে দৌড়চ্ছে না গাড়ি নিয়ে – সব কিছু কেমন নিয়ম শৃঙ্খলায় বাঁধা। ম্যাজিক, গেটের এপারে আর ওপারে যেন দু রকমের দুটো দুনিয়া!
রাস্তাটা একটু এগিয়ে এসে মিশেছে ফুন্টশোলিংয়ের মূল রাস্তাতেই, যেটা ভুটান গেট থেকে শুরু হয়েছে। ডানদিকে একটা ছোট একতলা বিল্ডিং, সেটা একটা ইমিগ্রেশন অফিস – ইন্ডিয়ান ব্যতীয় বাকি সমস্ত দেশের ভিসাধারীদের জন্য, তার পরে একটা ভারত পেট্রোলিয়ামের পেট্রল পাম্প, তার পরে মূল ইমিগ্রেশন বিল্ডিং, বড়সড়, এখানে ভারতীয়দের পারমিট দেওয়া হয়। এখন সাড়ে আটটা বাজে, সব বন্ধ, জাস্ট খেজুর করার উদ্দেশ্যেই ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের গেটে দাঁড়ানো পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কটায় খুলবে?
পুলিশটি, আমাকে প্রায় হতচকিত করে দিয়ে জানাল, এমনিতে নটায় খোলে, কিন্তু আজ তো খুলবে না – আজ ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ।
মানে?
মানে আজ এন্ট্রি হবে না। কাল আসুন।
কেন? মানে, কেসটা কী?
আজ চুখা ফেস্টিভাল। ফুন্টশোলিংয়ের সমস্ত সরকারি অফিস বন্ধ।
আমার অবস্থা প্রায় খাবি খবার মত। আমি তো সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে ই আমার ট্রিপের প্ল্যান বানিয়েছিলাম, আজ তিরিশে অক্টোবর তো ছুটির কোনও গল্প কোথাও লেখা ছিল না? … সরে গিয়ে মোবাইল খুলে আবার সার্চ করলাম ভুটানের ছুটির দিনের ওপর – নাঃ, পরের ছুটি পরশু দিন, রাজার রাজ্যাভিষেক দিবস, পয়লা নভেম্বর, কিন্তু আজ তো কোথাও কোনও ছুটি নেই! চুখা ফেস্টিভালটা কী?
ফিরে গেলাম আবার পুলিশটার কাছে। জানা গেল এটা শুধুমাত্র ফুন্টশোলিং ক্ষেত্রের উৎসব, জাতীয় লেভেলের নয়, তাই শুধু ফুন্টশোলিংয়েই সমস্ত সরকারি অফিস বন্ধ।
খানিকক্ষণ সময় লাগল ফ্যাক্টটা হজম করতে, যে, আজকে আমার তা হলে সত্যিই যাওয়া হবে না।
কী মনে হল, ভাবলাম, একবার পেট্রল পাম্পের অন্যপাশের ইমিগ্রেশন অফিসটাতেও কথা বলে দেখি। আফটার অল, আমার তো আম ভারতীয়দের মত পারমিট করানোর ব্যাপার নেই, আমার তো ই-ভিসা আছে!
এগিয়ে দেখি, হ্যাঁ, সেই ভুটান গেটের মুখেই ছোট ইমিগ্রেশন অফিসটা খোলা আছে, ছোট্ট একটি লাইন, কিছু সাদা চামড়ার বিদেশি এবং কিছু ভারতীয় (পরে জেনেছিলাম, তাঁরা শ্রীলঙ্কান) লাইনে দাঁড়িয়ে, এবং প্রত্যেকের হাতে আমার মতই ই-ভিসার পেপার।
খানিকক্ষণ পরেই আমারও ডাক এল একটা কাউন্টারে, উল্টোদিকে ভুটানের সরকারি পোশাক “ঘো” পরে বসে আছেন এক অফিসার। আমার ভিসাটি হাতে নিয়ে বললেন, গাইড কোথায়?
গাইড মানে, উগিয়েন। ওর নামই দেওয়া আছে ট্র্যাভেল অপারেটর গাইড হিসেবে। আমি বললাম, গাইড তো পারোতে থাকে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
অফিসার ভিসাটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, হবে না। গাইডকে এখানে ফিজিকালি উপস্থিত থাকতে হবে, নইলে ভিসা গ্র্যান্ট করা যাবে না।
আমি আবার আতান্তরে। গাইডকে কীভাবে আমি পারো থেকে ফুন্টশোলিংয়ে এনে হাজির করব? এ রকমের কোনও নিয়ম আছে, তাই তো জানি না, কোথাও লেখাও নেই। বিনীতভাবে আরেকবার অনুরোধ করলাম, অফিসার উত্তরে আরেকটু রুড হলেন, লাভ হল না কিছুই।
বেরিয়ে এলাম বাইরের ছোট্ট চাতালে। উগিয়েনকে ফোন করলাম। ফুন্টশোলিংয়ের ভেতরে খানিকদূর অবধি এয়ারটেলের কানেকশন কাজ করে। যদিও আমার কাছে এখন ভুটানের সিমও আছে। কাল স্বরাজ দিয়েছিল। উগিয়েন তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। সে-ও গল্প শুনে হতবাক – এমন তো কখনও শুনি নি, গাইডকে আসতে হয়। আমি আমার সরকারি গাইড ব্যাজ ছবি তুলে আপনাকে হোয়াটস্যাপে পাঠাচ্ছি, ওটা দেখান।
আমি বললাম, আপনার চেনাশোনা কেউ আছে এখানে, যে এসে আপনার নাম নিয়ে বলতে পারে, সে-ই আমার গাইড?
উগিয়েন কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, আমার এক ভাই সম্পর্কের একজন থাকে ফুন্টশোলিংয়ে, আপনি ওখানেই দাঁড়ান, আমি ওকে ফোন করে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে।
আধ ঘণ্টা বসে বসে দেখলাম, লোকজন কী অনায়াসে ভিসার পেপার নিয়ে ভেতরে ঢুকছে আর খুশিমনে বেরিয়ে আসছে। একটা সময়ে আরেক ব্যক্তি এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন, ঘো পরা। উগিয়েনের সম্পর্কিত ভাই, উগিয়েনের ফোন পেয়ে এসেছে।
এবং ভাই এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভেতরে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে ভুটানি ভাষায় কথা বলে তাকে কী জাদু করল, কে জানে, অফিসার এইবারে আমার ভিসার পেপারটি চেয়ে নিলেন, পাসপোর্ট চেয়ে নিলেন এবং ঘটাং করে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন “অ্যারাইভড” বলে। আমার ভিসা স্ট্যাম্পিং হয়ে গেল। ভুটানে আমার এন্ট্রি পাকা।
জয় গুরু। জয় ইয়েকীযেন। এতক্ষণে শরীরের ব্যথার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। কিন্তু না – আরেকটা কাজ বাকি আছে। মানুষের ভিসা হবার পরের স্টেপ হচ্ছে ভেহিকলের পারমিট বের করা। সেটা হয় ফুন্টশোলিংএর বাস টার্মিনাস আরএসটিএ থেকে। আরএসটিএ মানে রয়্যাল সেফটি অ্যান্ড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটি। হিসেবমত সেটাও আজকে বন্ধ থাকার কথা। এই ভিসার কাগজ দেখিয়ে আমার মোটরসাইকেলের পারমিট বের করতে হবে।
আরএসটিএ কাছেই। উগিয়েনের ভাই আর আমি মিলে পৌঁছলাম সেখানে, কিন্তু না, শেষমেশ ভাগ্য আর প্রসন্ন হল না। আরএসটিএর ভেতরে সেই ঘরটিকে লোকেট করলাম যেখানে ভেহিকল পারমিট ইস্যু করা হয়, কিন্তু সেটি পুরোপুরি বন্ধ। পাহারার দায়িত্বে থাকা আরেক পুলিশ জানালেন একই কথা – চুখা ফেস্টিভাল, অল ক্লোজড টুডে।
কিছু করার নেই। কিচ্ছু করার নেই। আজকের দিনটা নষ্ট হবেই। যাওয়া যাবে না। উগিয়েনের ভাই খুবই কাঁচুমাচু মুখে দুঃখ প্রকাশ করলেন, আমাকে তাঁর নাম্বার দিয়ে বললেন, কাল সকাল ঠিক আটটায় উনি চলে আসবেন এখানে, আমার মোটরসাইকেলের পারমিট করিয়ে দিয়ে যাবেন।
পারোতে যে হোমস্টে-তে আমার পরের তিন দিনের বুকিং ছিল, সেখানে ফোন করে বললাম, এই ব্যাপার, আজ আসতে পারছি না, ফুন্টশোলিংয়ে সব বন্ধ। আমি কাল পৌঁছব। আমার তিনদিনের বুকিংকে যেন ওঁরা দুদিনের বুকিং করে নেন।
কাল সকালটাই টাইম। কাল হওয়াতেই হবে, না হলে পরশু আবার ভুটান জুড়ে ছুটি। অন্তত একটা কাজ হয়ে গেছে – আমার পারমিট। জাস্ট মোটরসাইকেলের পারমিটটা বাগিয়ে ফেলতে পারলেই –
ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম, এবার ভুটান গেট দিয়েই। দশটা বাজে। সারাদিনে যখন আর কিছুই করার নেই, একটা পেনকিলার খেয়ে রাতের অসমাপ্ত ঘুমটা শেষ করি। অন্তত শরীরটা একদিনের রেস্ট পেলে ঠিক হয়ে যাবে।
One thought on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১২”