আগের পর্বের পর
২রা নভেম্বর, চতুর্দশ দিন
শেষরাতে ঘুম ভাঙল। কেমন একটা অদ্ভূত পরিস্থিতি, আচমকা যেন কেউ আমাকে অতল থেকে টেনে তুলল বাস্তবে। ঘর অন্ধকার, এবং মাথাও পুরো অন্ধকার – কয়েক মিনিট সময় নিল বুঝতে, আমি কোথায়। ধীরে ধীরে ব্রেনে রেজিস্টার করল ফ্যাক্টগুলো – আমি বারো-তেরো দিন ধরে বাড়ির থেকে বাইরে, এটা আমার বাড়ির বিছানা নয়, আমি এখন ভুটানে, পারোতে, কাল টাইগার্স নেস্ট সেরে আসার পর থেকে আমি ঘুমোচ্ছি, পেটে এবং তার পরে সারা শরীর প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফিরেছিলাম।
… ওয়েট, ওয়েট … ব্যথা? কোথায়? তলপেটে? শরীরের অন্যত্র? না তো! আমি তো বাঁপাশ ফিরে শুয়ে আছি পারোর এক হোমস্টে-র বিছানায় – ঠিক যে রকম ঘরের বিছানায় শুই – এই তো চিৎ হলাম, ডানপাশ ফিরলাম, হাঁটু ভাঁজ করলাম, বাঁ পা সোজা করলাম আবার – কই, কোথাও তো কোনও ব্যথা কিছু নেই!
মোবাইল জ্বালাতেই তার উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পাঁচটা কুড়ি। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। আমার ঘরটা একেবারে ভেতরদিকে, এখানে বাইরে দেখার মত কোনও জানলা নেই। বাথরুমটা বাইরে – সম্পূর্ণ কাঠের বাড়িতে কোনও অ্যাটাচড বাথ নেই।
উঠে দাঁড়ালাম বিছানা ছেড়ে। না, আর সত্যিই কোনও ব্যথা নেই। একদম ফ্রেশ লাগছে। দরজা খুলে বেরোলাম, ভোরের আলো ফুটছে বাইরে। টয়লেট সেরে নিচে নেমে এলাম। গতকালকের মতই মোটরসাইকেলের ট্যাঙ্ক আর সীটের ওপর বিন্দু বিন্দু বরফ জমে আছে, অথচ শীত তেমন কিছু নেই।
এক কুকুরী ভেতরের কোন ঘুপচি ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে পোড়া ছাইয়ের গাদায় ঘুমোচ্ছে এইটুকু টুকু তার সন্তানেরা। মা কুকুরী তাদের কাছে গিয়ে বাচ্চাদের গা শুঁকতে লাগল। একটু পরেই বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে মায়ের দুধ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমিও মোটরসাইকেলের হাওয়া ইত্যাদি চেক করে আবার ওপরে উঠে এলাম। কাল রাতে আরেকটি ফ্যামিলি এসেছে এখানে। হিন্দিভাষী। স্বামী-স্ত্রী, সঙ্গে একটি ছোট ছেলে, সে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, নামছে, আবার উঠছে। আলাপ করলাম, ভুটান বেড়াতে এসেছেন গাজিয়াবাদ থেকে।
সাতটায় ব্রেকফাস্ট এসে গেল, কালকের মতই, ব্রেড টোস্ট, মাখন আর জ্যামের সাথে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর ওমলেট। কালকের বেড়ালটাকে আর দেখতে পেলাম না।
এইবারে ছেড়ে যাবার পালা। চেক আউট করে পৌনে আটটা নাগাদ মোটরসাইকেলের পেছনে লাগেজ বাঁধাছাঁদা শেষ হল। জিপিএস চললেও, নেভিগেশন এই দেশে কাজ করে না, তাই যতটা রাস্তা মনে ছিল, সেই মত চালাতে থাকলাম, তার পরে আবার থেমে থেমে মোবাইল অন করে ম্যাপ দেখে দেখে একটু একটু করে এগনো।
একে একে পেরিয়ে গেলাম পারোর বাজার, আগের রাতে দেখা সেই প্যালেস। ক্রমশ সেই ব্রিজের কাছে চলে এলাম, যেখান থেকে সোজা গেলে হা ভ্যালি, আর ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে থিম্পু। থিম্পু আর এ যাত্রায় আমার যাওয়া হচ্ছে না। আমি ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা নিলাম – ফুন্টশোলিং।
শরীর একদম সুস্থ, আর কোনও সমস্যা নেই, জাস্ট আর একটা দিন থেকে যেতে পারলে আজ পুরো পারো আর থিম্পু ঘুরে ফেলাই যেত, কিন্তু থাকার উপায় নেই, ছেড়ে যেতেই হবে। মেঘের মধ্যে দিয়ে ভাসিয়ে দিলাম আমার মোটরসাইকেল।
ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে প্রথমে উধাও হল মেঘেরা, তার পরে ঠাণ্ডা। ফুন্টশোলিংয়ে ঢোকার আগে শেষ চেকপোস্টে আবার পারমিট দেখাতে হয়, সেখানে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন সকালের ঠাণ্ডা উধাও, রীতিমত গরম লাগতে শুরু করেছে।
শেষবারের মত পারমিটের কাগজ দেখালাম – ভেতর থেকে ভুটানি পুলিশ অফিসারটি মন দিয়ে দেখে প্রশ্ন করলেন, গাইড কোথায়?
তিন দিন আগে পারমিট পাবার সময়ে যা বলেছিলেম, এবারেও তাইই বললাম, গাইড তো এখন নেই, সে তো পারোতে ছিল, সে ওখানে অন্য টুরিস্টদের নিয়ে ঘুরছে, আমি তো বেরিয়ে আসছি। পুলিশ মাথা নেড়ে বলল, ই-ভিসায় তো গাইড ছাড়া চলার নিয়ম নেই, এনিওয়ে, ঘুরেই যখন এসেছো, ঠিক আছে, বেরোবার সময়ে পারমিট জমা করে যাবে ইমিগ্রেশন অফিসে।
পনেরো মিনিটের মাথায় ভুটান গেটের সামনে পৌঁছে গেলাম, ইমিগ্রেশন অফিসে। সাইডে, ভুটান গেটের একদম গা ঘেঁষেই বিশাল পার্কিং, কিন্তু সেখানে মোটরসাইকেল রাখতে যেতেই এক ভুটানি পুলিশ তেড়ে এল, না, এখানে রাখা যাবে না, এটা ইমিগ্রেশন অফিশিয়ালদের জন্য সংরক্ষিত। এখান দিয়ে ইউ টার্ন মেরে হুই ওদিকে যাও, সেইখানে গিয়ে পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল রেখে আসতে হবে।
আর্গু করার চেষ্টা করলাম, বস, মাত্র পাঁচ মিনিটের কাজ, ভিসার পেপারটা জমা দেব, পাসপোর্টে একটা এক্সিট স্ট্যাম্প লাগবে, বেরিয়ে আসব। আর আমার মোটরসাইকে লাগেজ আছে, এটাকে তো অন্য কোথাও রেখে আসতে পারি না, পাঁচটা মিনিটের জন্য রাখতে দাও – কিন্তু ছোট্টখাট্টো চেহারার ভুটানি পুলিশ কোনও কথাই শুনতে রাজি নয়, এটা সাধারণ মানুষের পার্কিং নয় তো, নয়।
কী আর বলব, শেষ মুহূর্তে আর বাগবিতণ্ডায় জড়াতে ইচ্ছে হল না, গেট থেকে বেরিয়ে একশো মিটার দূরেই তো জয়গাঁও পুলিশ থানার বিশাল পার্কিং, ওটা সিকিওরড, ওখানেই রেখে আবার হেঁটে ফিরে আসি।
তাই করতে হল। থানার পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল ছেড়ে আবার হেঁটে ফিরে যেতে হল ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিসে। আসার সময়ে যেটা একশো মিটার দূরে ছিল, যাবার সময়েই সেটা তিনশো মিটার হেঁটে যেতে হল, কারণ ঐ, ভুটান গেট দিয়ে বেরনো যায়, ঢোকা যায় না। পেছন দিয়ে ঘুরে ঢুকে আসতে হয়।
ইমিগ্রেশন অফিস খালিই ছিল, এখানে বোধ হয় প্রতিদিন অফিসার বদলে যায় – আগের দিনের চেনা মুখ কাউকে দেখতে পেলাম না। দু মিনিটে কাজ শেষ করে আবার জয়গাঁওতে ফেরত এলাম। স্বরাজের দেওয়া ভুটানের সিম কার্ড ফেরত দেবার ছিল, তো, স্বরাজ এখন নেই, ডিউটিতে কোথায় ঘুরছে, ওখানে থানায় আরেকজন ডিউটি অফিসারের হাতে সিমকার্ডটা ফেরত দিয়ে বেরিয়ে এসে, মোটরসাইকেলে আবার স্টার্ট দিলাম।
আজ আমার গন্তব্য জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। ১৯৯৯ সালে কলেজ ছেড়ে বেরোবার পরে আর কখনও আসা হয় নি। এমন নয় যে কলেজের প্রতি আমার খুব মায়ার টান আছে টাছে, চারটে বছর কাটিয়েছি – সেভাবে কখনও ভালোবাসতে পারি নি। স্মৃতিরা কেবল সঙ্গে রয়ে গেছে, থেকেও যাবে আজীবন, সেই স্মৃতিচারণা করতেই একবার গুরুচন্ডালির পাতায় লিখতে শুরু করেছিলাম আমার কলেজজীবনের গল্প, ধারাবাহিকভাবে, উত্তরবঙ্গ নামে। হয় তো লেখায় ভালোবাসা ছিল না বলেই, সে ধারাবাহিক আর শেষ করা হয়ে ওঠে নি।
তবু, স্মৃতি তো থেকেই যায়, সেই ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সেই কলেজ মোড়, করলা নদীর ধার, ওভালের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো এক নম্বর আর দু নম্বর হস্টেল – এরা তো ভুলতে দেয় না নিজেদের।
ফেসবুকের কল্যাণেই যোগাযোগ হয়েছিল কলেজের বর্তমান জিএসের সঙ্গে। সে বলেছিল, দাদা, একদম চিন্তা কোরো না – আমি ব্যবস্থা করে রাখব। জয়গাঁওতে বসেই ওকে একবার ফোন করে আপডেট দিয়েও দিয়েছিলাম যে, দু তারিখ বিকেলে পৌঁছচ্ছি। সে বলেছিল, কোনও অসুবিধে নেই, কলেজের কাছাকাছি এসে আমাকে একবার ফোন করে দিও।
জয়গাঁও থেকে যখন স্টার্ট করলাম, তখন প্রায় একটা বাজে, জয়গাঁওতে খেয়ে নেওয়াই যেত, সকালে পারোতে খাওয়া খাবার কখন হজম হয়ে গেছে, কিন্তু আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না, খুব সাঙ্ঘাতিক কিছু খিদেও পায় নি এখন, দেখি, যতটা পারি টেনে নিই। জয়গাঁও থেকে কলেজ ঠিক একশো কিলোমিটার, ঘণ্টাদুত্তিনে টেনে দেওয়া যায় – কলেজের কাছেই তিস্তা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে বাচ্চুদার ধাবা ছিল, যেখানে আমরা হস্টেল থেকে প্রায়ই যেতাম – যেদিনই মেসের খাবার খাদ্যোযোগ্য থাকত না। দেখি, বাচ্চুদার ধাবা যদি আজও থাকে, তা হলে সেখানে লেট লাঞ্চ করা যেতে পারে।
ভুটানের সিম আর আমার মোবাইলে নেই, এখন ভারতের এয়ারটেলের সিম কার্ড চলছে, তাও, সম্ভবত ভুটানের প্রক্সিমিটির জন্যেই এখানেও নেভিগেশন ব্লকড গুগল ম্যাপে। কেবল ম্যাপ দেখা যাচ্ছে, নিজের পজিশন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু নেভিগেট করা যাচ্ছে না। জয়গাঁও ছাড়িয়ে, ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে যখন টাউনের বাইরে চা বাগানের ধারে এসে দাঁড়ালাম – তখন মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে আরেকবার জিপিএস অন করে দেখলাম, এইবারে নেভিগেশন স্টার্ট হল। নেভিগেশনটা দরকার, কারণ জলপাইগুড়ি টাউনে যাবার জন্য বীরপাড়া আর গয়েরকাটার মাঝে একটা মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা নিতে হয়, সেই মোড়টা পয়েন্ট করা দরকার।
একই রাস্তায় ফিরে আসাটা ততটা ইন্টারেস্টিং থাকে না সব সময়ে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের তরাই আর ডুয়ার্সের অপরিসীম সৌন্দর্য কখনও বোর হতে দেয় না। ক্রমশ পেরিয়ে এলাম হাসিমারা, মাদারিহাট, ভুটানের পাহাড় আবছা নীলচে হয়ে হারিয়ে গেল আকাশের মাঝে, সঙ্গ দিতে থাকল শুধু একের পর এক চা বাগান। বীরপাড়ার পর বাঁদিকের রাস্তায় বাঁক নিলাম, সামনে স্পষ্ট করে লেখা – এই রাস্তা যাচ্ছে জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি। স্মৃতিরা সমানেই তুলনা করতে চায়। উনিশ কুড়ি বছর আগে শেষ যখন এ রাস্তায় এসেছি, তখন সে রাস্তা ছিল মোটা তিস্তা নদীর বোল্ডার ক্রাশ করা পাথরে পিচ মিশিয়ে বানানো, সরু রাস্তা। আর এখন সম্পূর্ণ ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের রাস্তা, ইয়া চওড়া। ভুটানের সাথে উত্তরবঙ্গের মিল শুধু একটাই – ভুটানে যেমন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে রাজার হাসিমুখের ছবি ছড়ানো, উত্তরবঙ্গের যেটুকু এলাকা আমি ঘুরলাম, সেখানেও একই রকমভাবে কিছুদূর অন্তর অন্তর আরেকটা হাসিমুখের ছবি, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন পোজে – মমতা ব্যানার্জির।
খিদে পেয়েছে এইবারে। বাচ্চুদার ধাবা পর্যন্ত রিস্ক নেওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছি না। দুদিকে চোখ রাখতে রাখতে চলছিলাম, আমার খাবার জন্য এমন জায়গা দরকার, যেখানে খাবার টেবিল থেকে মোটরসাইকেলের দিকে নজর রাখা যায়। ক্রমশ এগোতে এগোতে, মাগুরমারির কাছে দেখলাম ডানদিকে রাস্তার ওপরেই একটা বড়সড় খাবার জায়গা – সৈনিক ধাবা।
মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে সেইখানেই ঢুকলাম। কী পাওয়া যাবে?
বেলা আড়াইটে বাজে – খদ্দের বিশেষ কেউ নেই, তবে মাছভাতের আশ্বাস পাওয়া গেল। আলুভাজা, ডাল, ভাত আর ইয়াব্বড় মাছের পেটি আর ল্যাজা সমেত চমৎকার ভরপেট খাওয়া হল। খেতে খেতে ধাবার লোকটার সাথে গল্প করছিলাম, মানে সে-ই আমার মোটরসাইকেলে বাঁধা লাগেজ আর দিল্লির নাম্বারপ্লেট দেখে এসে আলাপ করল। বললাম, আমি শেষ এই রাস্তায় এসেছি কুড়ি বছর আগে, তখন এই রাস্তা ছিল সরু, ভাঙাচোরা, এদিক সেদিন কুপি জ্বলত, সন্ধ্যের পরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কীভাবে আমরা ফিরেছিলাম মাদারিহাট থেকে। লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, লোকালিটি অনেক পালটে গ্যাসে, আপনে এদিকে কী করতে আইসতেন তহন?’
‘ইঞ্জিন কলেজের স্টুডেন’ ছিলাম শুনেই লোকটার চোখেমুখে সম্ভ্রম জেগে উঠল। ঠিক কুড়ি বছর আগেও যে জিনিস দেখতাম, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেপুলেদের অনেক বাঁদরামির কারণে অনেক লোক অপছন্দও করত, কিন্তু সেই অপছন্দের সাথে মিশে থাকত একটা সম্ভ্রম – ‘ইঞ্জিন কলেজের স্টুডেন’।
আরও জানলাম, কয়দিন আগেই এহান দিয়া মোটরসাইকেল ৎসালায়ে বোম্বাই থিকে কয়েকডা লোক আসসিলো ভুটান যাবার জন্য, তারা এহানেই দুপুরের খাওয়া খায়ে গেসল।
গল্প শুনতে শুনতে আমার খাওয়া হয়ে গেল। খেয়েদেয়ে উঠে আবার এগনো। কলেজ আর মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার চেনা এলাকা শুরু হয়ে যাবে। এই রাস্তাটার নাম ময়নাগুড়ি বাইপাস। কলেজের দিকে যাবার পথে বাচ্চুদার ধাবা পড়ার একটু আগেই আসবে তিস্তা নদীর ওপর সেই বিশাল ব্রিজ – আপনারা আশির দশকে অমিতাবচ্চনের সুপারহিট বাংলা সিনেমা অনুসন্ধান দেখেছেন নিশ্চয়ই? যার হিন্দি ছিল বরসাত কি এক রাত? তাতে কালীরাম ওরফে আমজাদ খানের জিপের পেছনে পুলিশের জিপ নিয়ে অমিতাবচ্চনের একটা চেজিং সীন ছিল, এই তিস্তা নদীর ব্রিজটার ওপর। আর এই ব্রিজের কাছেই তিস্তার চরের পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ভবানী পাঠকের মন্দির, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের দৌলতে যা দেবী চৌধুরানীর কালীমন্দির নামে খ্যাত।
বিশাল, চওড়া তিস্তা এখানে ধীরগতি। তার বয়ে যাবার পথ রুদ্ধ করে নদীর গতিপথে শুয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় সুবিশাল সাইজের বোল্ডার। এক বোল্ডার পেরিয়ে অন্য বোল্ডারে পা রেখে অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়া যায় নদী, কদাচিৎ জলে পা ঠেকে গেলে কনকনে ঠাণ্ডায় বোঝা যায়, সে সদ্য নেমে এসেছে পাহাড় থেকে। …
…অনেকদিন আগে, তখন আমরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলেজ বাসের ড্রাইভার থাপাদাকে পটিয়ে জনাতিরিশ বন্ধুবান্ধব মিলে এই পথ ধরে গেছিলাম উত্তরবঙ্গের আরেক ক্ষীণতোয়া নদীর ধারে, চাবাগানের ধার ঘেঁষে মূর্তি নদীর চরে। সারাদিনের হইহুল্লোড়, দূর থেকে স্থানীয় মদেশিয়া কামিনদের জীবনচর্যার এক ঝলক দেখা, নবীনদার রাঁধা মাংসের ঝোল আর ভাত খেয়ে সেদিনের পিকনিক দারুণ কেটেছিল। বিকেল পেরিয়ে যখন গোধূলি নামছে, কাউবয় হ্যাট মাথায় চড়িয়ে গিটার নিয়ে নদীর ঠিক মাঝখানটায় একটা বড় বোল্ডারের ওপরে গিয়ে বসল দেবকান্তি … দেবকান্তিই নাম ছিল তো তার? সাথে আমরা সবাই – অগস্তি, আমি। অগস্তির দাদু ছিলেন মহিষাদল রাজবাড়ির সভাগায়ক, উত্তরাধিকার সূত্রে সুন্দর গানের গলা পেয়েছিল সে। সমস্বরে হাততালি দিয়ে গান শুরু হল – ইঞ্জিন কলেজের তখনকার দিনের এভার পপুলার সং, পাপা কহতে হ্যায় বড়া নাম করেগা – পেছন থেকে চা বাগানের অন্ধকার ঝোপ ভেদ করে উঠে এল থালার মত বিশাল বড় পূর্ণিমার চাঁদ …
জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার, এখনও মনে হয়, এই তো সেদিন। সেদিন জাস্ট ভাবতেও পারি নি, একদিন, কুড়ি বছর পরে আমি নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে এ তল্লাটে বেড়াতে আসব সুদূর দিল্লি থেকে। কীরকম স্বপ্ন মনে হচ্ছিল সবকিছু, সে যেন আমার গতজন্মের স্বপ্ন ছিল, আমি ঘুম ভেঙে ঢুকে পড়েছি আমার অনেকদিনের পুরনো একটা স্বপ্নের মধ্যে।
তিস্তার ব্রিজের ওপর দাঁড়ালাম। কলেজের জিএসকে একটা ফোন করতে হবে। পাঁচটা বাজে। ফোন করলাম। কেউ তুলল না। আবার ফোন করলাম – কেউ তুলল না।
পরপর তিনবার কল করলাম। অন্যপ্রান্তে কোনও জবাব নেই। কেলো করেছে – জিএস ছাড়া আমি তো আর কারুরই নাম্বার জানি না, সে যদি ফোন না তোলে তো আমি কোথায় যাবো?
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার দু-একবার চেষ্টা করলাম। নাঃ, অন্যপ্রান্ত একইরকম নীরব।
আপাতত এখানে দাঁড়িয়ে কিছু করার নেই, কলেজ পর্যন্ত তো যাই, তারপরে দেখা যাবে, জিএস যখন – কলেজের ছেলেপুলে কেউ না কেউ তো নাম জানবে। হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে রাখলাম, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, ফোন তোলো।
তিস্তা নদী পেরোতেই খানিক বাদে কলেজের মোড় চলে এল, দশ মিনিটও লাগল না। কলেজের মোড় দেখেও অবাক হতে হল, অনেকটা একই রকম আছে, তবে আগের সেই গুমটির দোকানগুলো সব উধাও, এখন পাকা দোকানঘর হয়েছে চারদিকে, সংখ্যায়ও বেড়েছে। বাঁদিকে মাষকলাইবাড়ির দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, আমরা বলতাম মস্কো – সেটা এখন বেশ চওড়া, ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা।
কলেজে ঢোকার মুখে একটা ভাঙাচোরা লজঝরে গেট ছিল, সেখানে এখন সুন্দর চওড়া লোহার গেট, আর গেটের ঠিক ভেতরে একটা অদ্ভূতদর্শন তোরণদ্বার বানানো, সেখানে নীল উর্দিপরা দুজন সিকিওরিটি গার্ড বসে আছে। না, সিকিওরিটি গার্ড ব্যাপারটা আমাদের সময়ে এক্সিস্টই করত না। চব্বিশ ঘণ্টা এই গেট খোলা থাকত, যখন ইচ্ছে যাও, এসো।
ভেতরে ঢুকে গেলাম, কেউ আটকালো না। কলেজের মেন বিল্ডিংয়ের সামনে এসে মোটরসাইকেল থামালাম, কলেজ বোধ হয় একটু আগেই ছুটি হয়ে গেছে, ইতস্তত দু একটা স্কুটি, মোটরসাইকেল এক সাইডে পার্ক করে রাখা, আর কিছু সাইকেল, ছেলেপুলে বিশেষ নেই। একজনকে পেলাম, তাকে ডেকে নাম ধরে জানতে চাইলাম – ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট, কলেজের জিএস, তাকে কোথায় পাবো বলতে পারো?
সে বেচারা কথা বলবে কি, আমার লাগেজভর্তি মোটরসাইকেল দেখেই আর চোখ সরাতে পারছে না। বোধ হয় ফার্স্ট ইয়ার, সে না চেনে জিএস-কে, না শুনেছে তার নাম। তাকে ছাড়ান দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করব। এইসময়ে মোবাইল মাউন্টে আলো জ্বলে উঠল – হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। দাদা, আমি একটা সেমিনারে আছি, তুমি গেস্ট হাউসে চলে যাও – কথা বলা আছে, তোমার জন্য ঘর রাখা আছে। আমি সেমিনার শেষ করে আসছি।
প্রাণে আশা ফিরে এল। যাক, যোগাযোগ হয়েছে তা হলে। গেস্ট হাউস আমি খুব চিনি। কলেজ ছাড়ার মুখে বাবা-মা-দিদি এসেছিল জলপাইগুড়ি আর সিকিম বেড়াতে, তখন তাদের গেস্ট হাউসেই রেখেছিলাম, মেন বিল্ডিংয়ের পেছন দিক দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে লেডিজ হস্টেল পেরিয়ে (আমরা বলতাম ‘পাকিস্তান বর্ডার’ – অবশ্যই মজা করে) প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের দিকে, সেই রাস্তাতেই পড়ে। কলেজের সোশাল হত যখন, তখন আমন্ত্রিত এলসিড্যার্জ – মানে কিনা লোরেটো কনভেন্ট দার্জিলিংয়ের সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের তো এই গেস্টহাউসেই রাখা হত। আজ সেই গেস্টহাউসে আমি অতিথি।
কলেজ বিল্ডিং নিজেও প্রস্থে বেড়েছে। আমি যখন পাস করেছিলাম এখান থেকে, তখন এই কলেজ ছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে – এখন পশ্চিমবঙ্গের বাকি সমস্ত ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজগুলোর সঙ্গে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ – আমরা যাকে ‘জলু’ নামে ডাকি ও ডাকতাম – তারা সবাই MAKAUT বা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির আন্ডারে চলে গেছে, তবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তার দাবি ছাড়ে নি। মূল বিল্ডিং যতটুকু আমাদের সময়ে ছিল, তার পেছনের দিকে দেখলাম কলেজ আয়তনে বেড়েছে, নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, আর দেখতে পাচ্ছি একটা বোর্ড লাগানো আছে, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ বেঙ্গল, জলপাইগুড়ি ক্যাম্পাস। সামনে কয়েকটি ছেলেমেয়ে একটা মুভি ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।
মেন বিল্ডিং পেরিয়ে এগোলাম গেস্ট হাউসের দিকে, বাঁদিকের উঁচু পাঁচিলটা, যেটা কলেজ ক্যাম্পাসের সীমানা নির্দেশ করে, তার চেহারা এত বছর পরেও একই রকমের আছে, কালচে মৈসে পড়া, সামনের রাস্তাটা একই রকমের সরু, কেবল চমৎকার অ্যাসফল্টের প্রলেপ পড়েছে তার ওপর, সামান্য এগোতেই ডানহাতে গেস্ট হাউস। গেটে তালা মারা, তবে ভেতরে লোক আছে মনে হল। দুটো মোটরসাইকেল আর একটা গাড়ি দাঁড় করানো।
হর্ন মারলাম দুবার। একজন লোক বেরিয়ে এল। তাকে বললাম জিএসের নাম দিয়ে – আমার নামে ঘর বলে রাখা আছে। সে তো আকাশ থেকে পড়ল, না – এহানে তো শিলিগুড়ি পলিটেকনিক থেকে আসা ছেলেরা রয়েছে, সব ঘর তো ভর্তি, আমাকে তো কেউ কিসু বলে রাহে নাই।
এবার আকাশ থেকে পড়ার পালা আমার। জিএসকে আর ফোন করলাম না, সেমিনারে ব্যস্ত আছে – লোকটাকে বললাম, একটা কাজ করো, অনেকদূর থেকে আসছি, সেই ভুটান থেকে, একটু বসি নিচের ঘরটায়, আমার নামে যে বুক করেছিল, সে মিটিংয়ে আছে, শেষ করে এখানে আসবে, তখন তার সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে নেওয়া যাবে। আমি এই কলেজের অনেক পুরনো স্টুডেন্ট, তুমি আমাকে চিনবে না।
শেষ কথাটায় কাজ হল, লোকটা সাগ্রহে আমাকে নিচের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। বসালো বলতে, দুটো টিনের খাট পাশাপাশি রাখা, এই দারোয়ান আর কুক শোয় এখানে। জিএসকে আবার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে রাখলাম, সেমিনার শেষ হলে একবার এসো – এই এই ব্যাপার।
দারোয়ান ভাই অদ্যাবধি এমন পায়ে-নীগার্ড-বাঁধা, গলায়-ক্যামেরা-ঝোলানো, মোটরসাইকেলে-লাগেজ-বাঁধা অতিথ দেখে নি, তার তাই কৌতূহলের শেষ নেই। জিজ্ঞেস করলাম, নবীনদা আছে এখনও? … নবীনদার গল্প লিখেছিলাম আমার উত্তরবঙ্গ ধারাবাহিকে, গুরুচন্ডা৯র পাতায় এখনও পাওয়া যাবে তাদের, আমাদের দু নম্বর হস্টেলের ক্যান্টিন চালাত। জানা গেল নবীনদা এখন কলেজের সামনে আলাদা ক্যান্টিন খুলেছে, সেইটা চালায়, হস্টেলেরটা অন্য কেউ চালায়।
ছটা নাগাদ জিএসের ফোন এল, সিকিদা, তুমি কোথায়? তুমি তো গেস্টহাউসে নেই! আমি আবার অবাক। আমি তো গেস্টহাউসেই আছি – কলেজে এখন কটা গেস্টহাউস?
দারোয়ানই জানাল, হ্যাঁ, বছর পাঁচেক আগে আরেকটা গেস্টহাউস হয়েছে বটে, ওয়ার্সশপের পাশে পিডাব্লুডি অফিসের সামনে। এটাতে সবসময়ে আশপাশের কলেজ থেকে আসা ছেলেপুলেদের রাখা হয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের আয়োজন হয়, আর ঐ গেস্টহাউসটা কলেজের গেস্টহাউস।
আমি জিএসকে ফোনে বললাম, এই ব্যাপার, আমি কলেজের পেছনে লেডিজ হস্টেলের কাছে যে পুরনো গেস্টহাউস আছে, সেইটাতে এসে বসে আছি – নতুন গেস্টহাউস তো আমি চিনি না, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।
পাঁচ মিনিটের মাথায় দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জিএস হাজির। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, অন্ধকার নেমে এসেছে ক্যাম্পাসের বুকে। তারা আগে আগে চলল সাইকেল নিয়ে, পেছন পেছন হেডলাইট জ্বালিয়ে মোটরসাইকেলে আমি। কলেজের পেছন দিয়ে রাস্তাটা এসে পড়েছে কলেজ ক্যান্টিনের কাছে, সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তা চলে গেছে হস্টেলের দিকে, আর সোজা রাস্তা ওয়ার্কশপের দিকে। এই কলেজের পেছনের রাস্তাটার নাম আমরা দিয়েছিলাম ভাইবোন সরণী – মানে, মূলত তখনকার ছেলেমেয়েদের প্রেম করার জায়গা, যারা কিনা স্যার দেখলেই ভাইবোন সাজার চেষ্টা করত। ছেলেমেয়েরা এখন কোথায় প্রেম করে, কে জানে! অবিশ্যি এত বড় ক্যাম্পাসে কি প্রেম করার জায়গার অভাব!
জিএসই দেখাল, কলেজের ক্যান্টিন এখন পাশাপাশি দুটো, তার একটা নবীনদা চালায়। বললাম, ঠিক আছে, আগে ফ্রেশ হয়ে আসি, তারপরে নবীনদার সাথে একবার দেখা করে নেওয়া যাবে।
পিডাব্লুডি অফিসের পাশে ফাঁকা জমিতে বানানো হয়েছে নতুন গেস্টহাউস। পুরোপুরি বানানো হয় নি বলেই মনে হল। নিচের তলায় বড়সড় একটা ঘরে দুজন লোক বসে কিছু অ্যালুমিনিয়ামের বোর্ড আর কী সবে যেন একমনে পেন্ট লাগাচ্ছে, ঘর ভরে আছে তার্পিন তেলের গন্ধে। জানা গেল, কদিন পরেই সোশাল শুরু হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে। জিএস বলল, তুমি এইখানেই ঘরের ভেতর মোটরসাইকেল ঢুকিয়ে দাও, লাগেজ এখানে সেফ থাকবে, যেটুকু দরকার, খুলে নিয়ে ওপরে চলে যাও।
ওপরের ঘর দেখতে উঠলাম। চওড়া কমন স্পেস, তার এপাশে একটা ঘর, ওপাশে আরেকটি। ঘরে একটা বিশাল বিছানা, মনে হল না চাদরটা পাতবার পরে কোনওদিন কাচা হয়েছে আর। ঘরের আনাচেকানাচে ঝুল জমে আছে, এককোণে একটি টিউবলাইট যথেষ্ট আলো দিতে পারছে না। অন্যপ্রান্তে আরেকটি ঘর, সেখানে কোনও এক ছাত্রের বাবা মা এসেছেন, স্রেফ বাবাকেই দেখলাম, খালি গায়ে একটা গামছা পরে ভুঁড়ি দুলিয়ে কমন স্পেসের মধ্যে চলেফিরে বেড়াচ্ছেন, বোধ হয় বাহ্যি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জিএস বলল, ফ্রেশ হয়ে নাও, পাশাপাশি দুটো বাথরুম আছে, তুমি বাঁদিকের বাথরুমটা ইউজ করো। আমি হস্টেলে যাচ্ছি, হয়ে গেলে ফোন কোরো – আমি এসে নিয়ে যাবো।
সঙ্গে যে লোকটি চাবি নিয়ে এসেছিল, সে এবার আমাকে একা পেয়ে বলল, দাদা, রাতে খাবেন না তো কিছু?
আমি বললাম, না – আমি বেরবো, বাইরেই খেয়ে নেব।
লোকটা এইবারে বলল, আমি এইহানেই থাকি, রাতে নিসে শুই। আপনে ঘরের ভাড়াটা আমাকেই দিয়া দিবেন।
আমি চমৎকৃত হলাম, এই ঘরেরও ভাড়া দিতে হয়? তা হলে আর কলেজে থাকতে এলাম কেন? আমাদের সময়ে তো ভাড়া লাগত না – অন্তত কলেজের ছাত্রদের মা-বাবা আর পুরনো ছাত্রদের থেকে ভাড়া নেবার কথা কখনও শুনি নি। সোশালের সময়েও বাইরের কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা আসত, গেস্টহাউস তো এমনিই পাওয়া যেত। হয় তো নিয়ম বদলে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে হবে?
লোকটা ঘাড় চুলকে বলল, দ্যান তিনশো ট্যাহা।
তিনটে একশো টাকার নোট পেয়ে লোকটা খুবই উৎফুল্ল হয়ে ঘরের কোণে একটা আলমারি দেখিয়ে বলল, এহানে লেপকম্বল সাদোর (চাদর) সব আসে, লাগলে নিয়া নিবেন। আমি নিসেই শুই, দরকার লাগলে ডাকে নিবেন। আর এই ন্যান চাবি, মেন গেটের চাবি এইটা – সকালে যহন বাইর হবেন, গেট খুল্যে বাইক বাইর করে চাবিটা ভিতরের ধাপিতে রাখে যাবেন।
টিপিকাল জলপাইগুড়ির ডায়ালেক্ট, কলেজ ছাড়ার পরে আজ প্রথম শুনছি। হেসে ফেলে বললাম, ঠিক আছে, তুমি এসো তা হলে।
বাথরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম, কোনওরকমে টয়লেটটা হয়ে যাবে, আদারওয়াইজ, বেশ নোংরা। মাকড়সার জাল, ঝুল, ধুলো – সব মিলেমিশে একাকার। পাশের টয়লেটটি বন্ধ, সেই গামছাপরা ভদ্রলোক বোধ হয় ভেতরে হালকা হচ্ছেন।
যেহেতু এটা কলেজের গেস্টহাউস, হোটেলের রুম নয়, অতএব, গামছা বা তোয়ালে পাবার কোনও আশা এখানে নেই, তাই চান আর করা হল না। কোনওরকমে মুখেচোখে একটু জল দিয়ে ঘরে ঢুকে বসলাম। এমনিতে খুব একটা ক্লান্ত নই, সন্ধে সবে সাড়ে ছটা কি সাতটা বাজে, একবার হস্টেলে ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হয় না, আঠেরো বছর আগেকার হস্টেলকে চেনা যায় কিনা দেখবার জন্য খুবই ইচ্ছে করছিল।
নিচে নেমে মোটরসাইকেল থেকে লাগেজ খুলে ওপরে নিয়ে এসে আবার জিএসকে ফোন করলাম। দশ মিনিটের মধ্যে সে তার বন্ধুকে নিয়ে সাইকেলে চেপে হাজির হয়ে গেল গেস্টহাউসে। ওদের পিছু পিছু আমি মোটরসাইকেল নিয়ে চললাম সত্যেন বোস হলএ, অর্থাৎ হস্টেল তিনের দিকে।
সুবিশাল হস্টেলের মাঠের এক প্রান্তে হস্টেল এক আর দুই, যথাক্রমে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আর জগদীশচন্দ্র বসুর নামে, আর মাঠের অন্যপ্রান্তে, চা-বাগান ঘেঁষে এই হস্টেল তিন। আমাদের সময়ে হস্টেল এক আর দুইয়ের একতলায় ভাগাভাগি করে থাকত ফার্স্ট ইয়ার, আর দোতলা আর তিনতলায় থাকত সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ার। হস্টেল তিন ফোর্থ ইয়ারের জন্য, ছোট ছোট রুম, প্রত্যেক রুমে একজন করে থাকতে পারে। খাট ওয়ার্ডরোব আর টেবিল বাদ দিলে ঘরে হাঁটাচলার জায়গা বিশেষ থাকে না। এবারে দেখলাম হস্টেল এক-দুই আর তিনের মাঝে, মাঠের আরেক প্রান্তে তৈরি হয়েছে আরেকটা হস্টেল, এখন ফার্স্ট ইয়ার সেইখানে থাকে। হস্টেল এক আর দুইয়ের একতলা থেকে তিনতলা পুরোটাই সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারের দখলে। হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ আমরা কলেজ ছাড়ার পরে নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলেছে এখানে, ফলে ছাত্রসংখ্যাও বেড়েছে।
হস্টেল তিনে ঢুকলাম। আঠেরো বছরে একফোঁটা বদলায় নি, কেবল দেয়াল, ভেতরের মাঠ – সমস্তকিছু দেখলে বোঝা যায় এদের বয়েস বেড়ে গেছে অনেকটা। এর মধ্যে, কে জানে, হয় তো নতুন করে রঙের প্রলেপ আর পড়ে নি, বিবর্ণ দেয়াল, মেসের বাইরে নোটিসবোর্ডটাও আদ্যিকালের পুরনো, আমরা যেমন দেখে গেছিলাম, তেমনটিই, বাইরে ইতস্তত সাইকেল দাঁড় করানো এদিক সেদিক।
তিন নম্বর হস্টেলটা একেবারে আইডেন্টিকাল তিনটে ব্লকে বানানো, যে কোনও একটা ব্লকে কাউকে দাঁড় করিয়ে দিলে, প্রথম বারের জন্য তার পক্ষে বলা সম্ভব নয় সে কোন ব্লকে দাঁড়িয়ে আছে – ফ্রন্ট, মিডল না ব্যাক এবং বাইরে যাবার রাস্তা কোনদিকে। এই হস্টেলের ছাদে যাবার সিঁড়ি একটা জানলার ভেতর দিয়ে পৌঁছতে হয়। হস্টেলটা তৈরি হয়েছিল নকশাল পিরিয়ডে, এবং এই অদ্ভুত স্থাপত্যের দৌলতেই এই হস্টেলের তথা এই ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক কাহিনি, নকশাল আমলের। এক সময়ে এই করলার জলে ভেসে গেছে অনেক ছাত্রের লাশ।
মনে পড়ে গেল আমার সেই প্রথম এই তিন নম্বর হস্টেলে আসার স্মৃতি। … উনিশশো পঁচানব্বই সালের আগস্ট মাস। সদ্য র্যাগিং পিরিয়ড শেষ হয়েছে। আমি র্যাগিং পিরিয়ড স্কিপ করে পৌঁছেছিলাম আমার চোখের একটা অপারেশনের কারণে। গান গাইতাম, এবং বন্ধুদের প্রথম দাবিদাওয়ার মাঝে সুমনের গান গেয়ে ফেলেছিলাম বলে আমার নিকনেম হয়েছিল জীবনমুখী, সেই থেকে শর্টে জিনু। একদিন, তখন সবে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে হপ্তাদেড়েক হবে – একজন এল আমার রুমে, এসে বলল, এই, তোর নাম জিনু? তোকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেলের ওমুকদা ডেকেছে। আজ সন্ধ্যেবেলায় একশো বারো নম্বর রুমে যাবি।
চিরকালীন ভিতু, আবার চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। ফোর্থ ইয়ার মানে একটা দূর গ্রহের ব্যাপার, তারা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে যে আমার র্যাগিং ঠিকমত হয় নি, ফোর্থ ইয়ার আমাকে ডেকেছে মানে আমাকে নিশ্চয়ই ফেলে পেটাবে এবার। শুনেছিলাম র্যাগিং স্কিপ করলে ডবল র্যাগিং করা হয়।
আমার রুমমেট অতীন, মধু, আর বৌদি মিলে যে যতরকম পারে ভয় দেখাল আমাকে, আর প্রচুর সহবৎ শেখাল, হাসবি না, কলারের বোতাম আটকে, বেল্ট আর ঘড়িটা খুলে যা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই মতো সেজেগুজে পুরো মুরগীর ছানা হয়ে সন্ধ্যেয় একা একা পৌঁছলাম ফোর্থ ইয়ারের হস্টেলে। উফ্ফ্, পুরো যেন বাঘের গুহা। সম্পূর্ণ অন্যরকম! এক আর দুই নম্বর হস্টেলের সাথে কোনওরকম মিল নেই! ভেতরে ঢুকে সব গোলকধাঁধা। কোথায় যে একশো বারো নম্বর রুম, খুঁজে বের করতে ঝাড়া কুড়ি মিনিট লাগল।
সেই ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ছ জন ফোর্থ ইয়ারের ছেলে। আজ আর তাদের নাম মনে নেই, একজন ছিল, দাড়িওলা, বেঁটে করে, সে-ই আমাকে বলল, তোর নাম অচল সিকি?
পরের প্রশ্নগুলো এল অ্যাজ এক্সপেক্টেড, কেন র্যাগিং পিরিয়ড কাটিয়ে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার প্রচন্ড আড়ষ্ট ভাব দেখে একজন এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে হাসল, ভয় পাস না রে, র্যাগিং পিরিয়ড শেষ, আমরা কেউ র্যাগ করতে ডাকি নি তোকে। তুই কাল কলেজ মোড়ে জামাইদার দোকানে বসে গান গাইছিলি?
আড়ষ্টভাবেই বললাম, হ্যাঁ। কি জানি, কলেজ মোড়ে গান গাওয়া অপরাধ কিনা! পাশের আরেকজন জানাল, ওমলেট বলল, তুই নাকি হ্যাভক গান গাস! তোর গান শুনতে ডেকেছি।
আর বলতে হল না। ফোর্থ ইয়ার হস্টেল থেকে বেরোলাম পরদিন সকাল সাতটায়। রাত আড়াইটে পর্যন্ত গানবাজনা হয়েছিল। সেই দাড়িওলা দাদা, ঝাড়া এক ঘন্টা মাউথ অর্গ্যানে বিভিন্ন গান বাজিয়ে শুনিয়েছিল। বাকিরাও যে যেমন পারে গলা মিলিয়েছিল। সময়ে সময়ে চা, পকোড়ার সাপ্লাই ছিল নিয়মিত। রাতে ওরাই আমার জন্য মেস থেকে খাবার তুলে আনল। একসাথে খেলাম, তারপর আবার গান। বাকি রাতটা একজনের ঘরে শোবার জায়গাও হয়ে গেল। এই প্রথম হস্টেল জীবনের স্বাদ পেলাম। মস্তি কা পাঠশালা। অ্যায়শ্শালা!
এ দিকে আমার রুমমেটদের হাল খারাপ। সারারাত ফিরি নি, ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে গিয়ে খোঁজ নেবার মত সাহসও কারুর ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। প্রায় প্রত্যেকে চিন্তা করেছে আমার জন্য। পরদিন সকালে যখন অক্ষত ফিরলাম, তখন সক্কলে হাঁউমাউ করে একসাথে কোশ্চেন করতে শুরু করল। নিজেকে বেশ হিরো হিরো মনে হচ্ছিল। সেই সকালটা এখনও মনে আছে।
তার পর এক সময়ে কালের নিয়মে নিজেরাই ফোর্থ ইয়ার হয়ে গেছিলাম, কলেজ থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারলাম, সব হয়েছে, ইঞ্জিনীয়ারিংটাই শেখা হয় নি। সাথে সাথে আরেকটা কোর্সে ভর্তি না হলে হয় তো জীবনে কখনওই ভালো চাকরি পাওয়া হত না।
… সেই ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে আজ আঠেরো বছর বাদে ঢুকছি আমি, সিনিয়রেরও সিনিয়র হয়ে। বর্তমান জিএস আমাকে খুব খাতিরযত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে সেই ঘরে, দোতলা ফ্রন্ট উইংয়ে, যেখানে এক সময়ে আমি থাকতাম, সেই ঘরে এখন আরেকজন রয়েছে, বর্তমান ফোর্থ ইয়ার, আমাকে দেখে সে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, আমি দেখলাম সেই খাট, সেই ওয়ার্ডরোব আর সেই টেবিলচেয়ার, এত বছরেও তারা বদলায় নি, আরও কালো হয়ে গেছে, দেয়ালে নতুন রঙ পড়ে নি কতকাল কে জানে, ছাদ থেকে ঝুলছে মোটা মোটা ঝুল, চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, টেবিলের ওপর রাখা একটা মোবাইল ফোন আর একটা ল্যাপটপ, আমাদের সময়ে যে জিনিসদুটো ভারতে প্রায় এক্সিস্টই করত না।
শুনলাম, এখন হস্টেলের ঘরে ঘরে ল্যান কানেকশন, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস আছে। সবাই আজ খুব ব্যস্ত, কারণ কদিন পরেই টিসিএসের ইন্টারভিউ হবে, আজ রাতের মধ্যে সব্বাইকে অনলাইন ফর্ম ভরতে হবে। টিসিএসের নাকি ইয়া লম্বা অনলাইন ফর্ম হয়, অনেক কিছু ভরতে হয়, যে আগে শেষ করে ফেলছে, সে বন্ধুকে সাহায্য করছে।
এই ব্যস্ততার মধ্যে গিয়ে আমার নিজেকে একটু অপরাধীই লাগছিল, কিন্তু ছেলেগুলো দেখলাম বিন্দাস – ও কোনও ব্যাপার না, আজ পুরো রাতটা তো আছেই।
গল্প হল খানিক, আমার সময়ের গল্প বললাম ওদের, ওদের মানে, ওরা তিন চারজন ছেলে – ওরাও শোনাল কলেজের বর্তমান হাল হকিকৎ। অনেক কিছুই বদলে গেছে, আমাদের সময়ের জীবনযাত্রা আর এখনকার জীবনযাত্রায় অনেক অনেক তফাৎ। আগের বারের সোশালের ভিডিও দেখাল আমাকে ইউটিউব থেকে, ওদের ব্যাচের কয়েকজন ছেলেমেয়ে অপূর্ব কোরিওগ্রাফি করে, আর একজন দারুণ ভিডিওগ্রাফি করে, সেই ভিডিওগ্রাফারের তোলা কোরিওগ্রাফির ভিডিও দেখলাম ইউটিউবে, ছেলেমেয়েরা কতকিছুতে ইনভলভড, কত ট্যালেন্টেড এখন। আমাদের সময়ে তো এসব কিছুই ছিল না।
‘দাদা, রাতে কি এখানেই খেয়ে যাবে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থমকালাম একটু। খাওয়া নিয়ে আমার গুচ্ছ চাপ আছে, আমি বললাম, না – আমি বাইরেই খেয়ে নেব ভাবছি, চলো তোমরাও, কিছু খেয়ে আসি।
ছেলেগুলো হাতে পুরো চাঁদ পেল। হস্টেল লাইফে রোজকার একঘেয়ে মেসের খাবারের জীবনের মধ্যে এই রকম কেউ এসে বললে কত ভালো লাগে, সে কি আমি জানি না? জিএস একজনকে সাথে সাথে কলেজ মোড়ে পাঠিয়ে দিল টোটো ধরার জন্য। আমরা বেরোলাম গেস্টহাউসের উদ্দেশ্যে, মোটরসাইকেলটা রেখে আসার জন্য।
টোটো চলে জলপাইগুড়ি শহরে, আর পাঁচটা মফস্বল শহরের মতই। মস্কোর রাস্তা, মনে পড়ল, সেবারে বন্যা হয়েছে জলপাইগুড়িতে, আমরা বন্যা দেখতে বেরিয়েছিলাম, এই মস্কোর রাস্তার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড তোড়ে বয়ে যাচ্ছে জল, তিস্তার দিকে, আমরা পাঁচজন ছেলে হাত শক্ত করে ধরে রেখে পায়ে পায়ে এগোচ্ছি, হাত ছেড়ে দিলেই ভেসে বেরিয়ে যেতে পারি – এত স্রোত। সেই রাস্তা এখন চকচকে, অনেক উঁচু। রাস্তার ধারে ডানদিকে একটা ভাঙা বাড়ি ছিল, জলপাইগুড়ির টিবি হাসপাতাল, এখন সেটা একটা মাল্টিস্টোরিড টিবি হসপিটাল। মস্কোর মোড় ছেড়ে বাঁদিকে বেঁকে শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড এখন ঝাঁ-চকচকে আধুনিক এক বাসস্ট্যান্ড, ইতিউতি চোখে পড়ল আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক আর স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম। প্রচুর প্রচুর দোকানপাট, বেগুনটাড়ির মোড় জমকালো হয়ে গেছে, কদমতলার মোড়কে আর চেনা যায় না, শুধু রূপশ্রী, রূপমায়া আর দয়াল সিনেমাহলেরা আজও আছে। রূপশ্রীর এক ঝলক দেখতে পেলাম। এক জায়গায় একটা হোটেল ছিল রুবি বোর্ডিং নামে, তার কাছেই এক বৌদির রেস্তরাঁ ছিল, সেখানে আমরা পিজ্জা খেতে যেতাম। এখন রাতের অন্ধকারে আর কিছুই, কিচ্ছুটি চিনে উঠতে পারলাম না। জলপাইগুড়ি টাউন বদলে গেছে বিলকুল।
আজ সকালে ছিলাম ভুটানে, রাতে ডিনার করছি জলপাইগুড়িতে, আজই আমার বেড়ানোর মোটামুটি শেষ, কাল সকালে যাত্রা শুরু হুগলির উদ্দেশ্যে, সেখানে আমার বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান হবে পরশু।
ভরপেট খাওয়াদাওয়া সেরে আবার একটা টোটো ধরে রাতে আবার ক্যাম্পাসে ফেরত। ফেরার সময়ে মনে পড়ল, নবীনদার সাথে আর দেখা হল না। অনেক, অনেক স্মৃতি নবীনদাকে নিয়ে, সেই শীতের ছুটিতে ছটি মাত্র প্রাণীর হস্টেলে টিকে থাকা নবীনদার রান্না করা খাবারের দৌলতে, সেই রংধামালি পেরিয়ে বোদাগঞ্জ ফরেস্টের বাংলোতে রাত কাটানো, তিস্তা নদীর ব্যারেজে রাতের বেলায় চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখতে দেখতে হাতির গল্প শোনা … কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হবে, এখান থেকে দক্ষিণবঙ্গে আমার বাড়ি সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার, লম্বা জার্নি।
প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে, পাশের রুমের সেই কোনও এক ছাত্রের বাবা তখনও জেগে। একই রকমের খালি গা, ভুঁড়িটা ঝুলছে, নিম্নাঙ্গে একটা গামছা – ইনি কি গামছা ছাড়া কিছুই পরেন না? – আমার দিকে জুলজুল করে দেখছেন। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম।
বিছানার চাদরটা বড্ড নোংরা, আলমারি খুলে দেখি ভালো চাদর আছে কিনা।
আলমারিটা খুলতেই ছিটকে পিছিয়ে আসতে হল। কত বছরের পুরনো লেপ, কে জানে, জীবনে কোনওদিন কাচা হয় নি, তীব্র বোঁটকা একটা গন্ধ আসছে আলমারির ভেতর থেকে, একেবারে পেটের ভেতর পর্যন্ত ঘুলিয়ে উঠল একেবারে, তড়িঘড়ি আলমারির দরজা বন্ধ করলাম।
যদিও ঘুম আসছে না, তবু ঘুমোতেই হবে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে হবে, বাড়ি পৌঁছে একেবারে চান হবে।
নোংরা চাদরটা তুলে, একটা পাশ খালি করে সেখানেই শুয়ে পড়লাম।
রূপশ্রী তো নেই রে। ওখানে Axis Bank.
LikeLike
কলামন্দিরের সামনে কোনটা ছিল? রূপশ্রী না রূপমায়া?
LikeLike