আগের পর্বের পর
৩রা নভেম্বর, পঞ্চদশ দিন
পাসপোর্টে লেখা আছে, প্লেস অফ বার্থ, জলপাইগুড়ি। তবে কথাটা আজকের দিনে আর তেমন সত্যি নয়, কারণ আমার জন্ম হয়েছিল পাহাড়ে, আলিপুর দুয়ারে। তখন সেটা ছিল জলপাইগুড়ি জেলার একটা মহকুমা, আজ সেটা আলাদা একটা জেলা। যে মহকুমা হাসপাতালে আমার জন্ম হয়েছিল, সেটা আজ জেলা হাসপাতাল। যদিও আমার তেমন কোনও স্মৃতি নেই আলিপুর দুয়ারের, কারণ আমার যখন এক বছর বয়েস, তখনই বাবা ওখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসে।
আমার ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর। তার কিছু কিছু জায়গা আজ ছুঁয়ে যাবার আছে। কলেজে পড়াকালীন এ পথে আমার কতবারের যাতায়াত হয়েছে, সমস্তই ট্রেনে যদিও, একবার উল্টোডাঙ্গা থেকে রকেট বাসে চেপেও এসেছিলাম, কিন্তু নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে উত্তরবঙ্গের একদা পরিচিত জায়গা থেকে দক্ষিণবঙ্গে আমার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার থ্রিলটা সম্পূর্ণ আলাদা। দৈর্ঘ্যে পশ্চিমবঙ্গ বেশ লম্বা, কলেজ থেকে আমার বাড়ি পাঁচশো তেষট্টি কিলোমিটারের দূরত্ব। তাই, সকাল সকাল জার্নি শুরু করতে হবে – নইলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত্তির হয়ে যেতে পারে। আগামীকাল হুগলি চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির কনফারেন্স হলএ আমার লাদাখ আর স্পিতি বেড়ানোর গল্পের বই সর্ষেদানায়, ইচ্ছেডানায় প্রকাশিত হবার দিন। হুগলিতে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু চিররঞ্জন সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে, আমাকে শুধু সেখানে উপস্থিত থেকে ধন্য করতে হবে। কলকাতা থেকে গুরুচন্ডা৯ টিমের একগুচ্ছ বন্ধুবান্ধব আসছে, সরাসরি প্রেস থেকে আমার বই নিয়ে, নিজের বই এডিট করেছি হাজারবার, কিন্তু ছেপে বের হওয়া সে বই চোখে দেখব আগামীকালই, প্রথমবারের জন্য। এ উত্তেজনার সঙ্গে হয় তো কিছুটা তুলনা করা যায় নিজের সন্তানজন্মের ক্ষণের।
ভোর পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙে গেছিল, সাড়ে পাঁচটায় তৈরি হয়ে গেলাম। বাইরের মেন গেটের চাবি আমার কাছেই রাখা রয়েছে। নিচে মোটরসাইকেলে লাগেজ বেঁধেছেঁদে স্টার্ট দিয়ে বের করলাম। বাইরে থেকে আবার তালা লাগিয়ে চাবিটা, আগের দিনের কথামত ভেতরের ধাপিতে রেখে দিলাম।
ক্যাম্পাস ঘুমোচ্ছে, লোকজন বিশেষ নেই। এক নিমেষে কলেজ ক্যাম্পাস পেছনে ফেলে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। রাস্তার এই অংশটার নাম কলেজ মোড়, বহু বহু রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের সাক্ষী, আমাদের সময়ের। বাঁদিকে চলে যাচ্ছে ময়নাগুড়ি যাবার পথ – যে পথ দিয়ে কাল আমি এসেছি, ডানদিকে শিলিগুড়ির রুট। আমাকে যেতে হবে এদিকে। শিলিগুড়ি শহরে ঢুকব না, বাইরে দিয়ে একটা বাইপাস হয়ে নেমে যেতে হবে নিচের দিকে।
কলেজ থেকে একটু এগোতেই একটা Yএর মত রাস্তার কাট আছে, যেটার নাম আসাম মোড়। না, আলাদা করে আসামে যাবার কোনও রুট এদিক থেকে শুরু হয় নি, রাস্তা একটাই, কেবল Yএর ডানদিকের রাস্তাটা ঢুকে যাচ্ছে জলপাইগুড়ি শহরের ভেতর, মাষকলাইবাড়ি, শান্তিপাড়া হয়ে কদমতলার দিকে, আর বাঁদিকের রাস্তাটা ময়নাগুড়ি বাইপাসের, জলপাইগুড়ি শহরের বাইরে দিয়ে, আমাদের কলেজের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে – হ্যাঁ, এ রাস্তা দিয়ে আসাম যাওয়া যায় বৈকি। ভুটানও যাওয়া যায়।
এই আসাম মোড়ে একটা পেট্রল পাম্প ছিল। জলুরই কোনও এক এক্স স্টুডেন্টের মালিকানায় চলত। ভাবলাম, সেখানেই মোটরসাইকেল আর জেরিক্যানের জন্য পেট্রল ভরে নেব, কিন্তু আসাম মোড়ে পৌঁছে দেখলাম পেট্রল পাম্পটি খোলে নি তখনও – বন্ধ। অতএব, আবার এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতে মোহিতনগর সাবস্টেশন, জলু কলেজের ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই লাইন গেছে এখান থেকে, একবার কলেজের প্রফেসরের সাথে এখানে এসেছিলাম ট্রান্সফর্মার আর কী কী সব যেন দেখতে, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তাম তো। তো, সেই মোহিতনগর সাবস্টেশন এখনও একইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, মৈসে পড়া একদা-হলুদ-রঙের দেয়াল নিয়ে।
মোহিতনগরের পর লোকালয় কমে এল, এর পরে শুধুই সরু রাস্তা শিলিগুড়ি যাবার জন্য। রাস্তাটা এখনও একই রকমের সরু আছে। দুদিকে ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে একটা দুটো গ্রাম পড়ে, ফাটাপুকুর, রাধাবাড়ি, ফুলবাড়ি।
একটা জিনিস মাথায় ঘুরছিল। এইটাই তো সেই সময় – তা হলে কাল দেখতে পাই নি কেন? আজ কি দেখা যাবে?
কলেজে যখন পড়তাম, নভেম্বরের গোড়া থেকে ডিসেম্বরের দশ বারো তারিখ পর্যন্ত, উত্তরবঙ্গে শীত পড়ার আগে পর্যন্ত, চারপাশের আবহাওয়া যখন একদম পরিষ্কার হয়ে যেত, এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেত আমাদের ক্যাম্পাস থেকে, বা বলা যায়, দোতলা ব্যাক উইংয়ে আমার ঘর থেকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা। সম্পূর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ সেই সময়ে প্রতিদিন দেখা যেত, কত যে দেখেছি ভোর থেকে উঠে হস্টেলের ছাদে বা টেরেসে বসে, সূর্যোদয়ের মুহূর্তে, টকটকে লাল থেকে কাঁচা সোনার রঙ, তার পরে পাকা সোনা, তার পরে রূপোলী ঝিলিক মেরে ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাওয়া কাঞ্চনের চূড়া। আবার বিকেল বেলায় রঙগুলো ফিরে আসত উলটো অর্ডারে। দিনের পর দিন দেখেছি।
আজ তেসরা নভেম্বর। এই তো সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবার, ডানদিকে চোখ রাখলেই দেখতে পাবার কথা, … হ্যাঁ, ওই তো দেখা যাচ্ছে, খুব প্রমিনেট নয় যদিও, আবছামতন, কিন্তু উত্তরবঙ্গ আমাকে নিরাশ করল না, ধানক্ষেত আর গাছপালার পেছনে ধবধবে সাদা রঙের ওই তো দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনকে। এর থেকে বেশি স্পষ্ট হবার সময় আসে নি এখনও, নভেম্বরের শেষদিকে আরও ভালো ভিউ আসে, কিন্তু আজ এই সময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার সকালের রূপ দেখে আমার মনে হল, আমার উত্তরবঙ্গ ফিরে আসা এতক্ষণে সার্থক হল। আর কোনও অতৃপ্তি নেই।
ফুলবাড়ি এখন শিলিগুড়ির আউটস্কার্টে বেশ বড়সড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব। গ্রাম পঞ্চায়েতই আছে, কিন্তু গ্রাম্য ভাবটা আর নেই, এটা শিলিগুড়ি শহরের একদম শুরু, এখান থেকে তৈরি হয়েছে বিশাল চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে – ফুলবাড়ি-ঘোষপুকুর বাইপাস, যেটা শিলিগুড়ি শহরের বাইরে দিয়ে একদম নিয়ে গিয়ে ফেলে আমাদের চিরপরিচিত এন এইচ সাতাশে, যেটা আমাকে নিয়ে যাবে দক্ষিণবঙ্গের দিকে।
ফুলবাড়ি থেকে বাইপাস ধরে উড়িয়ে দিলাম গাড়ি – দু পাশে পর পর চা বাগান, একটা শেষ হলে আরেকটা, সেটার পরে আরেকটা। ট্র্যাফিক নেই খুব বেশি, অসাধারণ রাস্তা। … একটা জিনিস বুঝলাম, আগে জানতাম চা বাগান শুধু দার্জিলিং আর জলপাইগুড়ি জেলাতেই আছে (এখন আলিপুর দুয়ারকেও ধরতে হবে) – কিন্তু আসতে গিয়ে দেখলাম উত্তর দিনাজপুর পর্যন্ত চা বাগান রয়েছে।
অনেকটা চলার পরে একসময়ে বাইপাস শেষ হল, পূর্ণিয়া কিষেণগঞ্জ লেখা বোর্ড সামনে এল। এই রাস্তাও পুরোটা চলার নয়, ইসলামপুর পেরোবার পরে ধানতলা বলে একটা জায়গা পড়বে, সেইখান থেকে ডানদিকের রাস্তা নিয়ে পরের হাইওয়ে ধরতে হবে। এমনিতে এই সোজা রাস্তা সোজা বিহার হয়ে গোরখপুরের দিকে যাচ্ছে, যে রাস্তা দিয়ে আমি তেরো দিন আগে এসেছিলাম।
ইসলামপুর পেরিয়ে জিপিএসের দিকে চোখ রাখছি, চওড়া হাইওয়ে, বাঁ পাশে ইতস্তত দুটো একটা গ্রাম, সামান্য কয়েকটা বাড়ি, গোটাদুই দোকান, তার পরে আবার ফাঁকা – ঠিক যে জায়গাটায় বাঁদিকে বেঁকতে বলল, সেখানে আমি কোনও কাটই দেখতে পেলাম না, এমনিই ইতস্তত বাড়িঘর, তার মাঝখান দিয়ে এদিক ওদিক গলি – ভাঙাচোরা খোয়া ওঠা সরু রাস্তা মত – সেগুলো কোনওমতেই কলকাতা যাবার রাস্তা হতে পারে না। জিপিএস নিশ্চয়ই ভুল কিছু দেখাচ্ছে, সোজা খানিক এগিয়ে যাই, আগে নিশ্চয়ই আবার রাস্তা আছে কোনও, জিপিএস হয় তো আগে আগেই কাট দেখাচ্ছে, কাট হয় তো পরে কোথাও আছে।
এগোতে থাকলাম, জিপিএসে দেখলাম আমি কাট পেরিয়ে চলে যাচ্ছি, এক কিলোমিটার, দুই কিলোমিটার – তার পরে দেখি জিপিএস রিক্যালকুলেট করে আমাকে বলছে চার কিলোমিটার আগে থেকে ইউ টার্ন নিয়ে আবার আগের পয়েন্টে এসে সেখান থেকেই টার্ন নিতে বলছে।
এ তো মহা মুশকিল হল। আমি তো কাট বুঝতেই পারছি না – তা হলে কি ফিরে গিয়ে ওখানে কোনও লোককে জিজ্ঞেস করে দেখব? … তাই করা যাক।
চার কিলোমিটার আরও এগিয়ে যেতে হল ইউ টার্ন নেবার জন্য – আমার ডানদিকে তখন গাইসাল স্টেশন, ঘুরে গিয়ে আবার ছ কিলোমিটার ফেরত এলাম, আবার ডিভাইডারের মাঝে পরের কাট খুঁজে সেই জায়গায় ফেরত এলাম, যেখানে জিপিএস আমাকে বলছে বাঁদিকে যেতে।
একটা ভাঙাচোরা পাথর বের করা সরু রাস্তা, সামনে একটা গার্ড রেলিং দাঁড় করানো, পাশে একটা লোক বসে আছে। মোটরসাইকেল থামিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, মালদা যাবার জন্য কি এইটাই রাস্তা?
লোকটা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, এই রাস্তা ধরে সোজা –
আমি হতবাক। এই রাস্তায় কী করে যাবো? আবার জিজ্ঞেস করলাম – রাস্তা কি আগে এই রকম ভাঙাচোরা? লোকটা আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, না না, এই দুশো মিটার মতন ভাঙা আছে, আগে একদম ফাইন রাস্তা পাবেন, ওই বাঁকের পর থেকেই ভালো রাস্তা শুরু। এই গার্ড রেলিংয়ের পাশ দিয়ে চলে যান সোজা।
সাহসে ভর করে হ্যান্ডেল ঘোরালাম বাঁদিকে। লোকটা ঠিকই বলেছিল – ঠিক দুশো মিটার বাদেই সুন্দর রাস্তা শুরু হয়ে গেল। একদম স্মুথ। খানিকটা এগোতেই মকদমপুর বলে একটা জায়গাতে গিয়ে সেই রাস্তা আবার ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ল – এটাই বোধ হয় এন এইচ থার্টি ফোর, উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের কানেক্টর রাস্তা। হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা মালদা, বহরমপুর, ফারাক্কার নাম। জয় গুরু, চালাও পানসি।
রাস্তা এখান থেকে বেশ চওড়া, ন্যাশনাল হাইওয়ে যেমন হওয়া উচিত আর কি। সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া হয় নি কিছু, কাল রাতে জলপাইগুড়িএ রেস্তরাঁয় গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়েছি, তাই দিয়েই চলছে এখনও। মনে মনে ঠিক করলাম, ফারাক্কা পেরিয়ে একেবারে লাঞ্চ করব, দেখি না, ওদিকে কোনও লাইন হোটেলে যদি ভালো মাছভাত পেয়ে যাই। ঠিকঠাক এই স্পিডে চললে বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে মালদা টাউন, আর দেড়টার মধ্যে তো ফারাক্কা পৌঁছে যাবই।
রাস্তা মোটের ওপর ভালো, কখনও কখনও বড়সড় গর্ত, কোথাও কোথাও রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে, কোথাও বা রাস্তা আবার সরু হয়ে গেছে লোকালয়ের মধ্যে – তাই সেইমত স্পিড বাড়িয়ে কমিয়ে চলতে থাকলাম। রায়গঞ্জ এসে গেল এক সময়ে। মালদা আর ষাট কিলোমিটার মত দেখাচ্ছে।
এর পরে এল গাজোল। আমার খুব পরিচিত একজন এই গাজোলে ল্যান্ড রেভিন্যু অফিসার হিসেবে কাজ করতেন এক সময়ে। অনেক গল্প শুনেছি গাজোলের, তাঁর কাছ থেকে, সেই গাজোলে এখন আমি দাঁড়িয়ে – এখান থেকে মালদা টাউনের দূরত্ব আরও কম – আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার।
চাপটা শুরু হল সেখান থেকে। মালদা শহরের ওপর দিয়ে গেছে এই ন্যাশনাল হাইওয়ে, রথতলা হয়ে – আর মোটামুটি গোটা শহরটা এই হাইওয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। রাস্তাও এখানে সরু, এলোপাথাড়ি ট্র্যাফিক, জাস্ট এগোবার কোনও রাস্তা নেই, এ ওর গায়ে সে তার ওপর দিয়ে – সে মানে বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। তার ওপরে দেখলাম মালদায় একটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়েছে, একেবারে হাইওয়ের পাশে, সেখানে জ্যাম আরও ভয়াবহ, দুর্বিষহ।
স্রেফ মালদার কয়েক কিলোমিটার পার করতে আমার চল্লিশ মিনিট খরচা হয়ে গেল। দেড়টা বাজে। ফারাক্কা এখান থেকে এখনও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূর। এ জ্যাম কতক্ষণে কাটবে, কে জানে!
কাটল, রথতলার সেই ভয়াবহ মোড় থেকে আরেকটু এগিয়ে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এসে ট্রাফিক একটু হালকা হল। মোটরসাইকেলে আবার স্পিড তুললাম।
খিদের চোটে মাথা ঘুরছে প্রায়, ফারাক্কা ব্যারেজ আসব আসব করছে, ঠিক সেই সময়েই বাঁদিকে দেখলাম বেশ খোলা চত্বরের পাশে একটা ধাবা, ঠিক যেখানে বসে খেতে খেতে মোটরসাইকেলের দিকে নজর রাখা যায়।
গোগ্রাসে খেলাম মাছ আর ভাত। শেষে মাংস আছে জানতে পেরে একবাটি খাসির মাংসও চেয়ে নিলাম, আর তিনবার করে ঝুরো ঝুরো আলুভাজা চাইতে হল। গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়ে আবার বেরিয়ে যখন গাড়িতে স্টার্ট দিলাম, তখন আড়াইটে বাজে। আর ঠিক এক কিলোমিটার দূরেই শুরু হচ্ছে ফারাক্কা ব্যারেজ। যখন জলুতে পড়তাম, আসা যাওয়ার পথে এই পর্যন্ত জেগে থাকতেই হত, চারদিকে উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করা ফারাক্কা ব্যারেজ আর তার পাশে এনটিপিসির এলাকা দেখার জন্য।
সেই ব্যারেজ আজ দিনের আলোয় পার করছি, নিজের মোটরসাইকেলে চেপে। কী নিদারুণ সে অভিজ্ঞতা! রাস্তা বলে কিছু নেই, এবড়োখেবড়ো খোয়া ওঠা একটা পথ, এত আস্তে যেতে হচ্ছে তাতেও ঝাঁকুনি কমছে না, এদিকে এত খেয়েছি যে সামান্য ঝাঁকুনিও অসামান্য হয়ে দেখা দিচ্ছে – রাস্তা এত সরু যে সোয়া দু কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ব্রিজের ওপর আমি একবারের জন্যও একটা গাড়িকে ওভারটেক করতে পারলাম না, পনেরো কুড়ির স্পিডে পুরোটা চলে তবে ভালো রাস্তা পেলাম আবার।
আমার ছোটবেলার এলাকা, আবার। উনিশশো তিরাশি থেকে পঁচাশি আমি থাকতাম রঘুনাথগঞ্জে। বাবার অফিসের জীপগাড়িতে চেপে আমি বোধ হয় কতবার এসেছি ফারাক্কা ধূলিয়ান আহিরণ বহরমপুর খাগড়া নিমতিতা। পুরো স্মৃতি নেই, কারণ তখন আমার বয়েস ছিল নিতান্তই পাঁচ সাত বছর, কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি রয়ে গেছে, যাদের সঙ্গে আজকের মুর্শিদাবাদকে মিলিয়ে দেখার আর কোনও উপায় নেই।
আমার ছোটবেলা পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সেরা জায়গা ছিল এই মুর্শিদাবাদ। পেটি পেটি আম আসত ঘরে, লিচু আসত, কাঁঠাল আসত, আর একটা কিছু আমাদের পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হত না – সব এর ওর তার বাগানের ফল। খেয়ে খেয়ে গরমকাল ফুরিয়ে যেত, ফলের স্টক শেষ হত না। … আর, ইলিশ। বাবা অফিসের কাজে যেত ধূলিয়ান, একদিন রাত এগারোটার সময়ে ফিরল, হাতে ঝোলানো এক মা ইলিশ আর খোকা ইলিশ, পদ্মা থেকে ধরে আনা। তখন ফ্রিজ ছিল না, গ্যাস ওভেন ছিল না, মা আবার কয়লা বসিয়ে ঘুঁটে ধরিয়ে উনুন সাজাল – অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকালে উঠে ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েছিলাম, আর যখন তখন ইলিশ মাছের পার্বণ তো তখন নিত্যিকার ব্যাপার ছিল – এতটাই ইলিশ পাওয়া যেত।
অনেক, অনেক মণিমুক্তো ছড়ানো আছে আমার মুর্শিদাবাদে, রঘুনাথগঞ্জ স্কুলের হেডস্যার, আমাকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন – বাবার আবার যেদিন বদলি হয়ে যাবার দিন এল, আমরা বাক্স তোরঙ্গ গোছাচ্ছি, হেডস্যার সাইকেল চেপে এলেন আমাদের কোয়ার্টারে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডস্যারের দু চোখে জল দেখে বাচ্চা-আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম, আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন দুটো বই – যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে আর ফটিকচাঁদ – আর একটা দামী আর্টেক্স পেন, স্যার আর্টেক্স পেনের দিওয়ানা ছিলেন, ওই পেন কিনিয়ে দিনের পর দিন আমার পেছনে লেগে থেকে আমার হাতের লেখা সুন্দর করে ছেড়েছিলেন। স্যারের দুই মেয়ে ছিল, আমাকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন। … এত ভালোবাসা পেয়েছি, এত ভালোবাসা – আমার তবলা শেখার শুরু সেখানে, অনিলদা, আমার তবলার প্রথম গুরু, সর্বক্ষণ হাসি ফাজলামি ইয়ার্কি আর মুক্তোর মত হাতের লেখায় তবলার বোল লিখে দিত আমার খাতায়, আমি তো বাচ্চা ছিলাম, সে খাতার যত্ন রাখতে পারি নি, তিন বছরে ছিঁড়ে গেছিল, আমরা চলে আসার দিন সেই অনিলদা কেঁদেছিল, নতুন একটা বাঁধানো খাতায় – তখন পত্রালি, বঙ্গলিপি, নবলিপি – এইসব নামের খাতা পাওয়া যেত, সেই রকম কোনও একটা খাতায় আমার তিন বছরে শেখা সমস্ত তবলার বোল আবার প্রথম থেকে যত্ন করে লিখে দিয়েছিল তার সবুজ রঙের কালির পেনে। … বড় হয়ে কতবার ভেবেছি একটিবার মুর্শিদাবাদে যাবো, সেই হেডস্যার আর অনিলদার সাথে আরেকবার দেখা করব – আজও যাওয়া হয় নি।
হুড়মুড়িয়ে মাথা বেয়ে নেমে আসছে পুরনো স্মৃতিরা, আর আমি ফারাক্কা ব্রিজ পেরিয়ে চলেছি আরও দক্ষিণে, ধূলিয়ান, নিমতিতা, সুতি, ঔরঙ্গাবাদ, আহিরণ – ইতিহাসের জায়গা সব, নামগুলো দেখছি বোর্ডে – আর কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার। কেমন ছিল তখনকার রাস্তাঘাট – মনে পড়ে না, বাবার অফিসের জীপগাড়ির চারপাশ খোলা ছিল, খুব ধূলো মাখতাম গাড়িতে বসে বসেই, এটুকু মনে আছে।
রঘুনাথগঞ্জের খুব কাছেই উমরপুর। আমরা প্রথম যখন মুর্শিদাবাদে আসি – বাবার ট্রান্সফার হয়েছিল বর্ধমান থেকে, তখনও রঘুনাথগঞ্জে আমাদের ডেজিগনেটেড কোয়ার্টার খালি হয় নি, একমাস মত আমাদের থাকতে হয়েছিল এই উমরপুরে পিডাব্লুডির বিশাল বড় বাংলোতে। বড়রাস্তার ওপরেই ছিল সেই বাংলোটা। উমরপুর পেরিয়ে এলাম এইমাত্র, কিন্তু বাংলোটা ঠিক কোথায় ছিল, আর মনে করতে পারলাম না।
মোরগ্রাম থেকে জিপিএস আমাকে বলল ডানদিকের রাস্তা নিতে। যদিও সামনে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা আছে সোজা রাস্তা বহরমপুর কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতা যাচ্ছে – এন এইচ থার্টি ফোর, কিন্তু জিপিএস দাবি করছে ডানদিকের রাস্তা নিতে হবে।
নিলাম। একটুখানি ডানদিকে বেঁকেই আবার বাঁদিকে টার্ন। স্টেট হাইওয়ে সেভেন। দাঁড়ালাম। কী করা উচিত? স্টেট হাইওয়েই নেব, নাকি ফিরে যাব চেনাপরিচিত এন এইচ থার্টি ফোরে?
ফোন বাজছে, বাবা ফোন করেছে, বললাম, উমরপুর পেরিয়ে এসেছি একটু আগে, সন্ধ্যে তো হবেই বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে, আমি ছটা নাগাদ ফোন করে আমার পজিশন জানিয়ে দেব।
জিপিএসে রাস্তা স্ক্রোল করে দেখলাম, অনে-কদূর গিয়ে এই রাস্তা গিয়ে পড়েছে বর্ধমানে। আর, বর্ধমান মানেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, সেখানে একবার গিয়ে পড়লে আর বাড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ! এই স্টেট হাইওয়েতে আমাকে মাত্র একশো পঁচিশ কিলোমিটার যেতে হবে।
মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম এস এইচ সেভেনের দিকে।
রাস্তাটি বড় মনোরম, টিপিকাল গাছে ঘেরা পুকুরপাড়, আধপাকা বাড়িঘর, গ্রামবাংলার রূপ ছড়ানো চারদিকে, তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি রাস্তা, পিডাব্লুডি মেনটেন করে। দুদিকে গ্রামের বাড়িঘর পেরিয়ে যতদূর চোখ যায়, শুধু ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। গাড়িঘোড়া খুব কম, চালাতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না, কেবল মাঝেমধ্যে ট্রাক সামনে চলে এলে তাকে ওভারটেক করাটা প্রায় দুঃসাধ্য কাজ হয়ে যাচ্ছে, কারণ রাস্তা বেশ সরু।
বেলুয়া, রাজমহল, বুড়াডাঙ্গা এইসব নামে গ্রাম পেরিয়ে হঠাৎ একটা বাজার মত এলাকা এল, আর রাস্তা ভয়ঙ্কর খারাপ হয়ে গেল। ইঁট বের করা, এবড়োখেবড়ো – লাগেজভর্তি মোটরসাইকেল নিয়ে তার ওপর দিয়ে চলা – সে এক বিড়ম্বনাবিশেষ। অবশ্য এক কিলোমিটার বাদে, বাজার শেষ হতেই রাস্তা আবার ভালো হয়ে গেল, আবার স্পিড তোলা গেল।
কিন্তু সুখ বেশিক্ষণ সইল না, ক্রমশ এল খড়গ্রাম বলে একটা জায়গা, আর সেইখানে সেই যে খারাপ রাস্তা শুরু হল – সে আর শেষ হতেই চায় না। লোকালয় শেষ হয়ে গেল, তবু রাস্তা আর ঠিক হয় না, মনে হল বছর কুড়ি আগে একবার রাস্তা বানানো হয়েছিল – তার পরে আর কোনওদিন তাকে রিসারফেস করা হয় নি, এদিকে বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, নভেম্বরের বিকেল – আরেকটু পরেই তো অন্ধকার নেমে যাবে, আমি মনে হচ্ছে এখনও মুর্শিদাবাদ জেলা ছেড়ে বেরোইই নি, – মরিয়া হয়ে স্পিড তোলার চেষ্টা করলাম, … না, সম্ভব না, মোটরসাইকেল সোজা রাখাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, অতএব, আবার আস্তে আস্তে, পনেরো-কুড়ির স্পিডে।
শেষরক্ষা হতে গিয়েও হল না, কোনও এক বাজারের মধ্যে, সরু রাস্তার প্রায় পুরোটাই জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক বড়সড় ডাম্পার। তার পাশ দিয়ে – মনে হল জায়গা আছে, বেরিয়ে যেতে পারব, সেইমত হ্যান্ডেল বাঁকিয়ে বেরোতে যেতেই ‘টং’ করে এক জোরালো শব্দ, পেছন ফিরে দেখি – লাগেজ ক্যারিয়ার সমেত মোটরসাইকেলের প্রস্থ আন্দাজ করতে ভুল করেছিলাম, ক্যারিয়ারের বাঁপাশটা ধাক্কা খেয়েছে ডাম্পারের সামনে।
পড়তে গিয়েও পড়লাম না, স্পিড বেশি ছিল না বলে, সামলে নিলাম। এবার ক্লান্ত আর হতাশ লাগছে – এই খারাপ রাস্তার কি শেষ নেই? তাও তো দিনের আলো রয়েছে এখনও, এর পরে অন্ধকার নামলে এই রাস্তায় চলব কী করে?
ভাবতে ভাবতেই দেখি আবার ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা ফিরে এল, একটা বাজার পেরোতেই – প্রায় দশ পনেরো কিলোমিটার রীতিমত এবড়োখেবড়ো খোয়া বের করা রাস্তার ওপর দিয়ে চালিয়েছি আমি। এদিক ওদিক দুএকটা সাইনবোর্ড দেখেও জায়গাটার নাম বুঝে উঠতে পারলাম না, কোনও একটা গ্রাম হবে। একটু পরেই এক সরু নদীর ওপর একটা ছোট্ট ব্রিজে উঠলাম – জিপিএসে দেখলাম, নদীটার নাম ময়ূরাক্ষী। এত সরু?
এর পর আর খারাপ রাস্তা নেই – খানিক পরে মঙ্গলকোট পেরোলাম, বর্ধমান এখান থেকে আর বত্রিশ কিলোমিটার, প্রায় মেরে এনেছি, আর সেখানেই সন্ধ্যে হল। এত সুমধুর সন্ধ্যে আমি আর কখনও দেখি নি, সরু রাস্তা, দুদিকে আদিগন্ত ধানক্ষেত আর ইতিউনি কিছু তাল নারকোল টাইপের গাছ দেখা যাচ্ছে – সেই ধানক্ষেতের পেছনে কমলা থেকে লালচে হয়ে, সারা আকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্য ম্লানমুখে ডুব দিল। একটা নির্মেঘ আকাশে স্পষ্ট সূর্যাস্ত দেখলাম, খানিকক্ষণের জন্য চলা থামিয়ে।
সূর্য ডুবতেই তাপমাত্রা কমে এল বেশ খানিকটা, তবে আমার রেনগীয়ার পরা আছে, খুব অসুবিধে কিছু হল না, ওটাই উইন্ডচীটারের কাজ করে।
মঙ্গলকোট পেরিয়ে এল ভাতার, আর তার পরেই একটা তিন মাথার মোড় এল, বাঁদিকে চলে যাচ্ছে কাটোয়ার রাস্তা, সোজা বর্ধমান। রাস্তা এখনও পর্যন্ত বেশ ভালো – বর্ধমান পর্যন্ত যদি ঠিকঠাক রাস্তা পেয়ে যাই তো আর চিন্তা নেই, তার পরেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে।
ক্রমশ লোকবসতি বাড়ছে, সরু রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে, অটো, মিনিবাস দেখা যাচ্ছে বর্ধমানগামী। বর্ধমান আসছে, আসছে, হঠাৎ কোথা হইতে কী হইয়া গেল, একটা মোড় ঘুরতেই দেখি তুমুল গাড়িঘোড়া, আমি একটা ফ্লাইওভারের ওপর উঠে গেলাম, আর নিচে একটা রেলস্টেশন, ফ্লাইওভারের পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টেশনের সাইনবোর্ড – বর্দ্ধমান জং। আমি একেবারে বর্ধমান স্টেশনের মাথায়। ফ্লাইওভার আমাকে নামাল তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডের পাশটিতে, চারপাশে অগুন্তি মিষ্টির দোকান, বারকোশে করে সীতাভোগ আর মিহিদানা বিক্রি হচ্ছে চতুর্দিকে। … কিনব একটু? না, একেবারে না, তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে যে সব মিষ্টির দোকান থাকে, তাদের থেকে নাকি আসল সীতাভোগ মিহিদানা পাওয়া যায় না, আসল সে জিনিস নাকি পাওয়া যায় বর্ধমান শহরের বিশেষ একটা দুটো দোকান থেকে। আর এই ভিড়ের মধ্যে লাগেজবাঁধা মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে দোকানে ঢোকাও রিস্কি। তিনকোনিয়া পেরিয়ে তাই এগোতে থাকলাম – মাঝে উঁচু ডিভাইডার আর রেলিং দেওয়া রাস্তা, এগোতে এগোতে হঠাৎ দেখি আমার ডানদিকে কার্জন গেট! আরে, তাই তো!
এই বর্ধমানও আমার ছোটবেলার জায়গা। মুর্শিদাবাদের আগে থাকতাম বর্ধমানে। উত্তমকুমার যে বছর মারা যান, সেই বছরে আমরা আসি এখানে, কোয়ার্টার পাওয়া যায় নি – নতুন পল্লীতে এক বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম। কার্জন গেট পেরিয়ে একটু এগোলেই বাঁ হাতে একটা সিনেমাহল ছিল – মৌসুমী সিনেমা। সেইখানে বাবামায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছিলাম, ওগো বধূ সুন্দরী। …
… তখন আমি সবে প্রথম ভাগ শেষ করেছি। সাড়ে তিন বছর বয়েস। সিনেমা শুরুর মুখে পর্দায় বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, তখনকার দিনের কাপড়ের ব্র্যান্ড – স্টানরোজ। এখন বোধ হয় আর সে ব্র্যান্ড নেই, তো যাই হোক, স্টানরোজ লেখাটা এমন স্টাইল করে লেখা ছিল, প্রথম বানান করে পড়বার মজায় আমি হল কাঁপিয়ে চীৎকার করে পড়েছিলাম – সটানরোজ, আর হলশুদ্ধু লোক হ্যাহ্যা করে হেসে উঠেছিল। আমি তখনও যুক্তাক্ষর পড়তে শিখি নি আসলে। পরের দিন বাবা আমাকে বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ এনে দিয়েছিল।
এই মৌসুমী সিনেমার ঠিক সামনেই একটা স্কুল ছিল, বাণীপীঠ বিদ্যালয়। আমার প্রথম স্কুল, কেজি টু পড়েছিলাম এখানে, উনিশশো বিরাশি সালে, তার পরে আমরা মুর্শিদাবাদ চলে যাই। গুগল ম্যাপ খুঁজেও আর সেই বাণীপীঠ স্কুল বা মৌসুমী সিনেমা হলের দেখা পেলাম না। বর্ধমানের কেউ থাকলে জানাবেন তো, তারা এখনও আছে কিনা।
বর্ধমান শহরের একদম মাঝখান দিয়ে ট্র্যাফিক ঠেলতে ঠেলতে এক সময়ে পেয়েই গেলাম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েকে – ব্যস, এইবারে আমার চেনা রাস্তা। আবার স্পিড তোলা গেল। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে, ঘণ্টা দেড়েক আরও তো লাগবেই। শক্তিগড় পেরিয়ে মেমারীতে একটা কাট আছে, যেটা দিয়ে আদি জিটি রোড ধরে পাণ্ডুয়া বৈঁচি হয়ে ব্যান্ডেল ঢোকা যায়, কিন্তু সে বড় ভয়ংকর রাস্তা – ভাঙাচোরা। তার চেয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে সিঙ্গুর দিয়ে ঢোকা ভালো, একদম টিপটপ রাস্তা, সিঙ্গুর নসিবপুর পেরিয়ে সোজা নিয়ে ফেলবে চন্দননগরের দিল্লি রোডে, সেখান থেকে আবার একটু বাঁদিকে পিছিয়ে এসে সুগন্ধ্যা হয়ে চুঁচুড়া ঢোকা ভালো। সুগন্ধ্যা থেকে চুঁচুড়া স্টেশনের তলা দিয়ে খাদিনা মোড়, সেখান থেকে আবার বাঁদিক নিলেই আদি জিটি রোড ধরে সোজা আমার বাড়ি। এ তল্লাটের প্রতিটা রাস্তা প্রায় আমার চেনা।
শক্তিগড় পেরোল, দুপাশে সেই বিরক্তিকর ল্যাংচা হাব। অগুনতি ল্যাংচার দোকান সারি সারি, লোকে গাড়ি মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে হাম হাম করে ল্যাংচা খাচ্ছে। কী বাজে খেতে – আগের বারে যাওয়া এবং আসার পথে দু বারই চারটে আলাদা দোকান থেকে খেয়ে দেখেছিলাম, অতীব জঘন্য খেতে হয়। বরং এরা সকালবেলায় কচুরি আলুরদম করে, সেইটা উমদা খেতে হয়, কিন্তু এখন তো আর সকাল নয়, আর এই ভিড়ের মধ্যে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে খাওয়ারও ইচ্ছে নেই। অতএব এগিয়ে গেলাম।
চওড়া দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে রাতের অন্ধকারেও দারুণ রঙীন। দু পাশে কিছুদূর অন্তর অন্তর ফুড জয়েন্ট, ধাবা। দুদিক দিয়ে হু হা স্পিডে বেরিয়ে যাচ্ছে বাঁকুড়া, শিলিগুড়ি কি বহরমপুর থেকে আসা রকেট বাসের দল। মেমারীর কাটও পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম, এমনিতেও, বোধ হয় রাস্তা ভালো নয় বলেই, জিপিএসও এই রুট সাজেস্ট করছে না – সোজা এগিয়ে যেতেই বলছে।
অনেকটা যাবার পরে জিপিএসের কথামত বাঁদিকের রাস্তা ধরে নিলাম। যদিও আশেপাশে কোথাও সিঙ্গুর লেখা বোর্ড দেখতে পেলাম না, এখানে একটা বড় বোর্ড থাকার কথা ছিল। যাক গে, পরিষ্কার দেখছি সোজা রাস্তা – আর বোর্ড দেখে কী হবে।
চলতে থাকলাম, গ্রামের রাস্তা, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, কিন্তু বেজায় সুন্দর, মসৃণ রাস্তা। একটা সময়ে দিল্লি রোডের কাটও পেয়ে গেলাম, সেখান থেকে বাঁদিক নিতে হবে। এবং এর পরের মোড় – সুগন্ধ্যার মোড় থেকে ডানদিক নিতে হবে।
নিলাম। এইবারে একটু এগোলেই চুঁচুড়া ধান্য গবেষণা কেন্দ্র আর তার পরেই চুঁচুড়া স্টেশন। কিন্তু রাস্তাটা কেমন অচেনা ঠেকছে কেন? চলতে চলতে একটা সময়ে হঠাৎ দেখি জিপিএস আমাকে বলছে সামনে একটা তিনমাথার মোড় আছে, সেখান থেকে ডানদিকে বেঁকতে।
এইখানে খটকা লাগল – ডানদিক কেন? ডানদিকে তো কোথাও বেঁকার কথা নয়!
এগিয়ে গেলাম – সরু সরু তিনটে রাস্তার সংযোগস্থল, মাঝখানে শরৎচন্দ্রের একটা আবক্ষ মূর্তি বসানো। … নাঃ, মিলছে না তো, সিঙ্গুর ধনেখালীর রাস্তায় কোথাও তো এমন তিনমাথার মোড়ে শরৎচন্দ্রের মূর্তি ছিল না!
তা হলে কী করব – ডানদিকে যাবো, না বাঁদিকে? যাক, জিপিএস যা বলে বলুক, আটটা পনেরো বাজে, আমি বাঁদিকেই টার্ন নিই।
নিলাম, খানিকদূর এগিয়ে আরও কেমন অচেনা লাগল। জিপিএস বারবার বলছে ইউ টার্ন নিয়ে উল্টোদিকে ফিরতে। একবার দাঁড়িয়ে স্ক্রোল করে দেখলাম মোবাইলে, আমার বাড়ি নাকি এখান থেকে আর মাত্র তিন কিলোমিটার! … ঠিক দেখাচ্ছে তো! কী করে হয়?
মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে আবার ফিরে গেলাম সেই তিনমাথার মোড়ে, আর তখনই বিদ্যুৎচমকের মত মাথায় এল, তবে কি, তবে কি আমি সিঙ্গুর পর্যন্ত যাইই নি? এটা তার আগের কাট?
জিপিএসে কথা মত ডানদিকের রাস্তাই নিলাম, এবং কিছুদূর এগোতেই রেললাইনের নিচে আন্ডারপাস পেয়ে গেলাম, খুব খুব চেনা আন্ডারপাস – কিন্তু না, এটা চুঁচুড়া স্টেশনের আন্ডারপাস নয়, ওপরে বড় করে সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, ব্যান্ডেল জংশন।
এতক্ষণে পুরো গল্পটা ক্লিয়ার হল। আমি সিঙ্গুরের কাট পর্যন্ত যাইই নি, বেলমুড়ি থেকে ধনেখালীর রাস্তা নিয়েছি, যেটা সিঙ্গুরের রাস্তার মতই সরু। সিঙ্গুর পেরিয়ে নসিবপুর পেরিয়ে যেখানে রাস্তাটা দিল্লি রোডে এসে মেশে, ধনেখালীর রাস্তাও একইভাবে দিল্লি রোডে এসে মেশে, কিন্তু সেই মোড়টাই সুগন্ধ্যার মোড়। আমি যেখান থেকে বাঁদিক নিয়ে পরের মোড়কে সুগন্ধ্যার মোড় ভেবে ডানদিক নিয়েছিলাম, সেটা আসলে ছিল পোলবার মোড়, আমি পোলবা হয়ে কোরোলা কাজিডাঙা পেরিয়ে এইমাত্র দেবানন্দপুরের মোড় থেকে ডানদিক নিলাম, তাইজন্য ওখানে শরৎচন্দ্রের মূর্তি বসানো ছিল। আর তাই চুঁচুড়ার বদলে আমি এসে পড়েছি একদম ব্যান্ডেল স্টেশনের সামনে, আর তাই তখন আমার বাড়ি দেখাচ্ছিল তিন কিলোমিটার। সুগন্ধ্যা থেকে আমার বাড়ি কিছু না হোক আট ন কিলোমিটার তো হবেই।
মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে একবার বাবাকে ফোন করে বললাম, ব্যান্ডেল স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর দশ মিনিটে বাড়িতে ঢুকছি।
দশ মিনিটও লাগল না, ঢুকে গেলাম বাড়িতে। আটটা তিরিশ।
মোটরসাইকেল চালিয়ে হুগলি অবধি চলে আসব, এমন প্ল্যান শুরুর দিকে ছিলই না – বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান আমাকে টেনে নিয়ে এল। কাল বেলা দুটো থেকে মিউনিসিপ্যালিটির কনফারেন্স হল বুক করে রাখা আছে।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, ডাউন মেমোরি লেন বোধ হয় একেই বলে। আজ সকাল থেকে এমন একটা জার্নি করে এলাম – আমার সমস্ত ফেলে আসা দিনগুলোকে ছুঁতে ছুঁতে ফেরা, ছোটবেলার স্মৃতি, কিশোরবেলার স্মৃতি – সব দেখতে দেখতে আমার আসল ঘরে ফেরা হল আজ।
One thought on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১৬”