আগের পর্বের পর
৪ঠা নভেম্বর, ষোড়শ দিন
“আমার একজন গার্লফ্রেন্ড আছে বুঝলে, আমেরিকায় থাকে। আমাকে ডার্লিং বলে ডাকে। তার কাছে চারটে হার্লে ডেভিডসন রয়েছে। মাঝে মাঝেই শখ চাপলে বেরিয়ে পড়ে। বয়েস এখন মাত্র বিরানব্বই চলছে। বয়েস ফয়েস তো জাস্ট একটা নাম্বার, বুঝলে – এখনও যে রকমের ফিট আছে না সে, ইচ্ছে হলেই যখন তখন হার্লে চেপে আমেরিকার বুক চিরে পুরো এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘুরে আসে।”
ডক্টর কুমার কৌস্তুভ রায় যখন মুখ খোলেন, তখন বাকিরা মুখ খোলার বিশেষ সুযোগ পায় টায় না। তার অবশ্য কারণও আছে, তাঁর আমেরিকান ডার্লিংয়ের মত প্রাইজড পজেশন না থাকলেও হাওড়ানিবাসী এই ভবঘুরে ডাক্তারটির আছে একটি হার্লে ডেভিডসন। এবং আছে কিছু ভিন্টেজ কালেকশন – একটি ১৯৭৫ সালের কাওয়াসাকি শেরপা মোটরসাইকেল, এখনও চলে, এবং রীতিমত চলে, আর আছে একটি আদি অকৃত্রিম অ্যাম্বাসাডর, যাতে চেপে একবার উনি বর্ডার পেরিয়ে চীনে ঢুকে ঘণ্টাখানেক ঘুরে এসেছিলেন, কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই। এর বাইরেও তাঁর ঝুলিতে আছে সম্ভব অসম্ভব নানা রকমের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে কোথায় কতগুলো সচল এবং পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ আছে, কোথায় গেলে ডাইনোসরের ডিম দেখতে পাওয়া যায়, তার লিস্টি এঁর নখের ডগায় – শুধু গুগল বা উইকি করে এ তথ্য আহরণ করা নয় – ইনি তার প্রত্যেকটি নিজের মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরে ছুঁয়ে এসেছেন। এমন লোক যখন নিঃসঙ্কোচে, বিনা অহঙ্কারে মাটিতে থেবড়ে বসে নিজের গল্পের সুটকেসটা খোলে, তখন সাধ্যি কি, বাকিরা মুখ খোলে আর?
লোনলি হাইওয়ে নামক একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, মূলত সারা দেশের বাইকারদের একটা ছোট গ্রুপ, নিজের নিজের ট্র্যাভেল প্ল্যান শেয়ার করে, প্রশ্ন থাকলে সেগুলো এই ফোরামে জিজ্ঞেস করে – যেমন হয়ে থাকে সমস্ত ক্লোজড গ্রুপেই আর কি – সেই গ্রুপ এই ডক্টর কুমার কৌস্তুভ রায়ের মডারেশনে চলে। সেই সূত্রেই আমি ভদ্রলোককে চিনতাম, এর পরে জয়গাঁওতে বসে কদিন আগে এঁর ফোন, তার পরে আজকেই প্রথম দর্শন। ইনি একা নন, লোনলি হাইওয়ে গ্রুপ থেকে আরও বেশ কয়েকজন এসেছিলেন আমার বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে। কাউকে চিনতাম না, ভার্চুয়াল গ্রুপেই যেটুকু বক্তব্যের আদানপ্রদান, আমি যখন গ্রুপে জানিয়েছিলাম, নভেম্বরের চার তারিখে হুগলিতে আমার বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান, তাঁরা জানিয়েছিলেন – আসবেন, এসেছিলেন, অনুষ্ঠানের ঔজ্জ্বল্য একসঙ্গে হাজারগুণ বেড়ে গেছিল। সেদিনের গুণীজন সমাবেশ আমার বহুকাল মনে থাকবে।
এত জায়গা থাকতে, হুগলি কেন বাছা হল বইপ্রকাশের জন্য? আসলে এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল তারও আগে। এর আগেও আমার একটা বই বেরিয়েছিল গুরুচন্ডালি থেকে, লা জবাব দিল্লি নামে, কিন্তু গুরু তখন প্রকাশনার জগতে জাস্ট হামাগুড়ি দিচ্ছে, ফলে আনুষ্ঠানিক বইপ্রকাশ তখন করার কথা মারুর মাথাতেই আসত না, শুধু আমি নয়, সেই সময়ে যাদেরই বই বেরিয়েছে, কারুর প্রকাশের জন্যই আলাদা করে অনুষ্ঠান করা হত না। গুরু এখন প্রকাশনার জগতে পাকাপোক্ত হয়েছে – বেশ পরিচিত নাম, তাই অনুষঙ্গ হিসেবে আসে এইসব অনুষ্ঠান, আর আমার বইয়ের ফাইনাল প্রুফ যখন প্রেসে জমা দেওয়া হল, তখন পিনাকী আমাকে একদিন ফোন করে বলল, আমরা তো সবাই জানি, এইসব প্রকাশ-আবরণউন্মোচন ইত্যাদি কাজ সদাসর্বদা কলকাতা শহরে হল বুক করে করা হয়ে থাকে। আমরা এই প্রোটোটাইপটা প্রথম ভাঙি না কেন? শহর কলকাতাকেন্দ্রিকতা ছেড়ে আমরা শহরতলির কাছে নিয়ে যাই গুরুকে। লোকে জানুক, মফস্সলেও এসব অনুষ্ঠান করা যায়।
সবাই এক বাক্যে লুফে নিয়েছিল প্রস্তাবটা, আমি তো নিয়েছিলামই, কারণ, যদিও আমার যাওয়া আসার প্ল্যানে প্রথমে হুগলি ছিল না – কিন্তু এই ছুতোয় একবার বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করা হয়ে যাবে, আর হুগলি আমার এলাকা, সেখানে এই অনুষ্ঠান করবার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি, ভাবতে বাধ্য করল গুরুচণ্ডা৯। সৈকত লিখে দিল একটা জম্পেশ ব্লার্ব, আর ঈপ্সিতা বার চব্বিশেক বলেছিল, ইশশ, আমিই যেতে পারব না। খুব মিস করব।
আমাদের এখানে, হুগলিতে অনুষ্ঠানের জায়গা বলতে আমার মাত্র দুটি জায়গাই জানা ছিল – এক তো হুগলি চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির হল, অন্যটা চুঁচুড়া রবীন্দ্রভবন। মিউনিসিপ্যালিটি হল আমি ছাত্রাবস্থায় বহুবার গেছি প্রাইজ নিতে, তখন সায়েন্স ট্যালেন্ট বলে একটা পরীক্ষা হত, আর ফি বছর সেই পরীক্ষার পরে একটা করে বই পুরস্কার পেতাম, আমরা সবাই। বড় লেভেলের পুরস্কার পেয়েছিলাম মাধ্যমিকের পর, ঐ পৌরসভার তরফে শহরের কৃতি ছাত্রছাত্রীদের বইটই দেয় না – তো তেমন কৃতি না হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে আমার নাম এসে গেছিল লিস্টিতে, আর একটা বইও পেয়েছিলাম। মিউনিসিপ্যালিটির পুকুরেই আমি সাঁতার শিখেছি চার বছর। তো, সেই হল বুক করার জন্য কাকে কী বলতে হয়, হুগলি ছাড়ার এত বছর পরে তো আমি সুদূর দিল্লি থেকে সে ব্যবস্থা করতে পারব না। বাবারও বয়েস হয়েছে, তাঁর পক্ষেও এই বয়েসে দৌড়ঝাঁপ করে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব নয়।
এই সময়েই মাথায় এল চিররঞ্জনের কথা।
সে এক অদ্ভুত ছেলে। তার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল রামোজী ফিল্ম সিটিতে, দু হাজার এগারো সালে। ইটিভি বাংলার একটা রিয়েলিটি শো – হাই টেনশনে অংশগ্রহণ করতে আমি গিয়ে পৌঁছেছি হায়দ্রাবাদ, সেইখানে একঝাঁক উজ্জ্বল প্রতিভাবান ছেলেপুলের মাঝে এই ছেলেটিকে আমি দেখি। এমনিতে যদি জিজ্ঞেস করেন, কে এই ছেলে, তা হলে উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় – পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন কর্মচারী। কিন্তু খোলস ছাড়ালে দেখবেন, সে পরিচয়ের আড়ালে আছে আরও কিছু পরিচয়, যার খবর সবাই জানে না।
ওরিগামি। চৌকো করে কাটা রঙিন কাগজ থেকে বানিয়ে তোলা হাতি ঘোড়া ব্যাঙ প্রজাপতি কিংবা সুদৃশ্য খেলনা অহঙ্কার-পেটিকা – আপনারা যারা ফেসবুকে চিররঞ্জনের সাথে যুক্ত আছেন, তারা দেখে থাকবেন ওর হাতের বানানো ওরিগামির কাজ।
নিউম্যাটোলজি। দেশ বিদেশের কয়েন আর কারেন্সি নোট জমাবার হবি। হায়দ্রাবাদের সেই গেস্ট হাউসে যখন চিররঞ্জনের সাথে দেখা হয়েছিল, ও নিয়ে এসেছিল ওর সংগ্রহ। তাক লাগিয়ে দেবার মত কালেকশন ছিল তখনই ওর কাছে। এতদিনে নিশ্চয়ই সে সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।
অ্যাস্ট্রোনমি। না, প্রথাগত পড়াশোনার দিক দিয়ে অবশ্য চিররঞ্জন জ্যোতির্বিদ নয়, তবে এটাও তার অন্যতম একটা হবি। চুঁচুড়া ও সন্নিহিত এলাকার বিভিন্ন অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের এই বন্ধুটি।
তালিকা আরও লম্বা করাই যায়, তবে চিররঞ্জনের পরিচয় পাবার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। চুঁচুড়ারই ছেলে; ফলে, তাকে যখন জানালাম আমার প্ল্যানের কথা, এক কথায় বলল, তুমি একেবারে চিন্তা কোরো না, আমি দু তিনটে জায়গা বেছে রাখছি, তুমি একবার বলো, কোথায় করতে চাও, আমি সেই রকম ব্যবস্থা করে দেব।
আলোচনায় মাঝে একবার ঠিক হল জোড়াঘাটের বন্দেমাতরম বাড়িটা যদি ভাড়া পাওয়া যায় – এমনিতে ওটা ভাড়া দেওয়া হয় কিনা আমি জানি না, তবে চিররঞ্জনই জানাল, ঘরটা খালিই থাকে, দিনের বেলায় ওখানে আধার বানাবার লোকেরা বসে কাজ করে, কথা বললেই একবেলার জন্য পাওয়া খুব অসুবিধে হবে না, একদম গঙ্গার ঘাটে, বসবার জায়গার অভাব হবে না, তবে মাইক প্রজেক্টার শতরঞ্চি বা চেয়ার ইত্যাদি সমস্ত আলাদা করে ভাড়া করতে হবে। সেই নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই আমি তখন ঘুরে ফেলেছি সিকিমের অর্ধেক – তার মধ্যেই চিররঞ্জন আবার একদিন ফোন করে জানাল, পৌরসভাতেই একটা নতুন কনফারেন্স হল হয়েছে, পঞ্চাশজনের মত বসার জায়গা, এসি প্রজেক্টার মেশিন চেয়ার ডায়াস পোডিয়াম সমস্ত ফিট করা, এই ধরণের অনুষ্ঠান করবার জন্য একদম আদর্শ জায়গা, নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। আমি বুক করে ফেলেছি, তারপর এখন তোমাকে জানাচ্ছি।
এই হচ্ছে চিররঞ্জন – মুখের কথাটি খসাবার আগে কাজ করে ফেলে।
কাল রাতেই বাড়ি ফিরে খেয়ে উঠে একবার চেক করলাম কে কে আসতে পারে আজকের অনুষ্ঠানে। বাবাও বলল, পাড়ায় বেশ কয়েকজনকে বলে রেখেছে – অমুক আসবেই, তমুক আসতেও পারে, এইবারে তমুক এলে অমুক নাম্বার টু আসবে না কারণ দুজনের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই – বলে একটা টেনটেটিভ লিস্ট দিল। দুদিকের লিস্ট মিলিয়ে দেখলাম মোটামুটি চল্লিশ জন হচ্ছে, আমাকে ধরে।
সকালে উঠে চিররঞ্জনকে ফোন করে জেনে নিলাম সমস্ত কিছু ঠিকঠাক কিনা। আমাদের ব্যান্ডেলের সুইটস সেন্টারের মিষ্টি ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে দিল্লি ব্যাঙ্গালোরেও সুখ্যাতি লাভ করেছে – সেখানে গিয়ে অরূপদাকে চল্লিশ প্যাকেট সামান্য জলযোগের অর্ডার দিয়ে রাখলাম, ওদিকে চিররঞ্জন চা এবং জলের বোতলের অর্ডার দিয়েই রেখেছে। সমস্ত কিছু সেট, আমরা গিয়ে পড়লেই হয়। একটা থেকে অনুষ্ঠান, রাত আটটা পর্যন্ত হল আমাদের জন্য খোলা থাকবে।
সাজোসাজো রব চলছে চারদিকে, ভার্চুয়ালি তার খবর পাচ্ছি। রৌহিন জানালো ওরা ঠিক সময়মত কলকাতা থেকে স্টার্ট করবে, প্রেস থেকে আমার বই নিয়ে সবাই মিলে একটা গাড়িতে করে আসবে। এদিকে বুনান আসবে আলাদা, লোনলি হাওওয়ের তরফে কুমার কৌস্তুভ রায় বলে রেখেছেন ঠিক একটায় পৌঁছে যাবেন, অতএব আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সাড়ে বারোটার মধ্যে তো পৌঁছতেই হয়। আর চিররঞ্জন না থাকলে আমি এই নতুন কনফারেন্স হলটা চিনতেও পারব না, ফলে ওকেও ডেকে নিতে হয়।
কাল আমার ফেরার পথে যাত্রা শুরু। যেমন হয়, প্রথম দিনের গন্তব্য বেনারস, ভোর ভোর বেরোতে হবে, ফলে মোটরসাইকেলের কাজকর্ম আজ সকালেই সেরে রাখতে হবে। চেনে লুব্রিক্যান্ট দেওয়া, টায়ারে হাওয়ার প্রেশার চেক করা ইত্যাদি মামুলি কাজ সেরে চলে গেলাম ব্যান্ডেল মোড়ে, আমাদের এলাকার পেট্রল পাম্প। দের্ঘদিন ধরে এই পেট্রল পাম্পটিকে আমি দেখেছি, কিন্তু সেখান থেকে তেল ভরতে চলেছি জীবনে এই প্রথম, কারণ এর আগে আমি তো হুগলিতে কোনওদিন গাড়িই চালাই নি।
জিটি রোডের পেট্রল পাম্পটিতে কখনওই ভিড় থাকে না, ধীরেসুস্থে গেলাম, পেট্রল ভরার সময়ে, যিনি ভরছিলেন, আর পাশে অন্য একজন খোশগল্পে মত্ত ছিলেন। বিষয়ঃ আমার মোটরসাইকেলের লাগেজ ক্যারিয়ার।
প্রথমজনঃ এই গুলো কী লাগিয়েছে বল তো?
দ্বিতীয়জনঃ আরে ওই তো, দেখিস নি আজকাল পিঠে ঢাউস ঢাউস ব্যাগ নিয়ে সব হোম ডেলিভারি দেয়, আমাজন, ফিলিপকাট, ঐ ওদেরই লোক হবে হয় তো, এতে করে বস্তা বেঁধে নিয়ে যায়।
প্রথমজনঃ আরে না না, এ নিশ্চয়ই চাল ডাল আনাজ সাপ্লাই দেয়, তাই বাক্সো বানিয়ে রেখেছে, এইখানে বস্তা বেঁধে নিয়ে যায়।
আমি চুপ করে শুনতে থাকলাম। আমাকে কেউ একবারও জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলেন না, মোটরসাইকেলের ট্যাঙ্ক ফুল করে যখন পেট্রল জেরিক্যান ভরে দিতে বললাম, তখন তাঁদের কথাবার্তা থেকেই জানলাম, তাঁরা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন, আমি গ্রামেগঞ্জে চালডালসবজি সাপ্লাই করি, গ্রামের দিকে তো বেশি পেট্রল পাম্প থাকে না, তাই পেট্রলও বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি।
মুচকি হেসে, পেট্রলের দাম মিটিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। তৈরি হবার পালা। আমাকে সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছতে হবে – বাবা মা পরে আসবে।
হুগলি এতটাই ছোট এলাকা, আমার বাড়ি থেকে পিপুলপাতির মোড়ে পৌরসভা চত্বরে পৌঁছতে সময় লাগে খুব বেশি হলে দশ থেকে পনেরো মিনিট। কনফারেন্স হলটা আমার পক্ষে লোকেট করা সম্ভব নয়, তাই নিচেই একটা ধাপিতে বসে রইলাম। আজ শনিবার, ছুটির দিন। পৌরসভা তাই বন্ধ, লোকের ভিড়ও নেই।
ঠিক একটার সময়ে ফোন এল কুমার কৌস্তুভ রায়ের, আমি ঠিক মিউনিসিপ্যালিটির গেটের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, এইবারে কোনদিকে যাবো? … তাঁকে ফোনে ডিরেকশন দিতে গিয়েই দেখতে পেলাম লম্বা একহারা চেহারাটাকে, দৌড়ে গিয়ে নিজেই ডেকে এনে বসালাম – চিররঞ্জন এসে গেল একটু পরেই। তিনজনে মিলে ওপরে উঠে আবিষ্কার করলাম কনফারেন্স রুমটাকে, সুন্দর সাজানো গোছানো দিব্যি মনোহর।
কলকাতার দলকে ফোন করতে গিয়ে জানা গেল, তারা এখনও সবাইকে তুলে উঠতে পারে নি, সবাইকে তুলে নিয়ে তবেই বেরোবে। সুতরাং, আসতে আসতে সাড়ে তিনটে তো বাজবেই।
সে বাজতেই পারে, কিন্তু ততক্ষণ কি আমরা ফাঁকা মাঠে বসে এসির হাওয়া খাবো? একজন দুজন করে লোক আসছেন, বেশির ভাগই আমার আত্মীয়স্বজন, আমার মামারা, পিসতুতো দাদা, মায়ের বন্ধু, বাবার বন্ধু, মামাদের বন্ধুরা, ধীরে ধীরে হল ভরে উঠছে, আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে কুমার কৌস্তুভ রায়ের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। সঙ্গে ধরতাই দিচ্ছেন তাঁর সঙ্গীসাথীরা, লোনলি হাইওয়েরই সদস্য সবাই, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বেড়ানোর গল্প। সে গল্পের খানিক তো ওপরেই লিখেছি।
কত যে চেনা মুখ এল, একসময়ে এল অর্পণ, সেই অর্পণ যে আমার আর বুনানের সাথে দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকে গেছিল। হঠাৎ দেখি চুপিচুপি ঢুকছে লামা আর হুতো। গুরুচণ্ডা৯র বাইরের লোকজন যাঁরা এদের চিনতে পারছেন না, তাঁদের বলি – হুতো ওরফে রবাহুত আমার বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। শুধু এই বইয়ের নয়, আমার আগের বইয়েরও। এবং, শুধু আমার বই নয়, গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত হওয়া অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ বানায় হুতো। প্রতিভাশালী এই ছেলেটির দাদা হচ্ছে লামা, সে আমাদের গুরুসভার আরেক রত্ন। লেখা, আঁকা, অ্যানিমেশন – সমস্ত সৃষ্টিমূলক কাজকর্মে সে একাই একশো। লামার লেখায় এক অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে থাকে।
সাড়ে তিনটেও নয়, প্রায় চারটের সময়ে হইহই করে একটা টেম্পো ট্র্যাভেলার এসে ঢুকল হুগলি চুঁচুড়া পৌরসভার গেট দিয়ে, আর সেইখান থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে এল টিম গুরুচণ্ডা৯, অনেকটা এই রকমভাবেঃ
বেশির ভাগই অবশ্য অচেনা মুখ, কাউকে কাউকে ভার্চুয়ালি চিনি, কেবল রৌহিন, পারমিতাদি, সব্যসাচীবাবু আর শেখরদাকে এর আগে সামনাসামনি দেখা। সব্যসাচীবাবু হাঁকপাঁক করে ঢাউস ঢাউস বইয়ের বাণ্ডিল নামাচ্ছেন, আর বাকিরা হাতে হাতে সে সব পৌঁছে দিচ্ছে ওপরে।
নিজের চোখে নিজের বই দেখলাম সেই প্রথম। রৌহিন আর শেখরদা মিলে বই সাজিয়ে রাখল টেবিলের ওপর, আর উপস্থিত দর্শকরা দিব্যি আগ্রহভরে দেদার কিনে ফেললেন আমার বই।
পরের কয়েকটা ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল, জানি না; জয়াদি, বুনান, আমার কয়েকজন আত্মীয় প্রত্যেকে নিজের নিজের মতন করে বিভিন্নরকমের বেড়ানোর গল্পের স্মৃতিচারণা করলেন, বেড়ানোর নেশাকে মূলধন করেই বুনানের একটা প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে রূপ পাচ্ছে আরও কয়েকজনের সাথে, সেই নিয়ে একটা চমৎকার প্রেজেন্টেশন দিল বুনান, জয়াদির মুখে শুনলাম ইওরোপ থেকে সাইকেল চালিয়ে তাঁর ভারতে আসার রোমহর্ষক কাহিনি, আর সঙ্গে ছিল সুইটস সেন্টারের মিষ্টির প্যাকেট, চা আর জল। সাড়ে আটটা নাগাদ যখন চৌকিদার এসে হল বন্ধ করার অনুমতি চাইল, তখন আমাদের হুঁশ ফিরল। হিসেব করে দেখা গেল, প্রায় পঁয়তাল্লিশ জনের জমায়েত হয়েছিল, ফলে আমার, চিররঞ্জনের, আরও দু একজনের ভাগ্যে মিষ্টির প্যাকেটই জোটে নি।
কিন্তু হল বন্ধ করে দিলেই কি আড্ডার মেজাজ মেটে? নিচে নেমে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা হল, ছবি তোলা হল, তার পর আস্তে আস্তে যে যার গন্তব্যে ফেরত।
বেড়ানোর সময় শেষ হয়ে আসছে, তবু তা শেষ হয়েও শেষ হয় না – লোনলি হাইওয়ের আরেক বন্ধু, তাকেও চোখে দেখি নি – বিপিন, সে ফোন করে নেমন্তন্ন করে রেখেছে। যেদিন থেকে সে জেনেছে আমি সিকিম ভুটান বেড়ানোর প্ল্যান করছি – যতরকম ভাবে সম্ভব সে আমাকে সাহায্য করেছে। সম্প্রতি কারা কারা গেছে, তারা কীভাবে পারমিট জোগাড় করেছে, কেমন ওয়েদার পেয়েছে, কী কী ডকুমেন্ট ক্যারি করতে হয় – সমস্ত তথ্য আমাকে ফোন করে হোয়াটসঅ্যাপ করে আমাকে অনবরত জোগান দিয়ে গেছে।
তার বাড়ি আসানসোলে, কাল যাবো তার বাড়ির কাছ দিয়েই, কথা হয়েছে একদম আসানসোলে গিয়েই ব্রেকফাস্ট করব। শক্তিগড়ে এবারেও আর থামার গল্প নেই।
One thought on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১৭”