সঙ্কীর্ণমনা, কাপুরুষ, উগ্র হিন্দুত্বের প্রবক্তা এবং আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকর কীভাবে জনমানসে “বীর” সাভারকর হিসেবে পরিচিত হলেন, সে গল্প আমরা আগের পর্বে পড়েছি। এই পর্বে আমরা জানব, ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে নাথুরম গডসের পিস্তল থেকে ছোঁড়া গুলিতে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর আগে যে ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল, তাতে সাভারকরের কতখানি হাত ছিল, এবং অভিযুক্ত হবার পরেও, নিশ্চিত ফাঁসির সাজা থেকে কীভাবে তিনি মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। দ্য ওয়্যার পত্রিকায় লেখা পবন কুলকার্ণির এই লেখাটির বাংলা অনুবাদ, লেখকের অনুমতিক্রমে তুলে দিলাম আমার ব্লগে।
ভারত স্বাধীন হবার পাঁচ মাস অতিক্রান্ত। চোদ্দই জানুয়ারি, ১৯৪৮। হিন্দু মহাসভার তিনজন সদস্য – নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপটে এবং দিগম্বর বাডগে (হিন্দু মহাসভাকে নিয়মিত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা একজন অস্ত্র-ব্যবসায়ী) বম্বের সাভারকর সদনে এসে পৌঁছলেন। এই সদনের ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটা গোপন চেম্বার আছে, যেখানে হিন্দু রাষ্ট্র দলের সর্বেসর্বা বসেন, সেইখানে সরাসরি প্রবেশাধিকার ছিল কেবলমাত্র আপটে আর গডসের – সমসাময়িক বিভিন্ন ব্যক্তির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আর বিভিন্ন সরকারি দস্তাবেজ, পুলিশ রেকর্ড ইত্যাদি গভীরভাবে ঘেঁটে লেখা ল্যারি কলিন্স আর ডমিনিক লাপিয়েরের বই “ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট” পড়ে সে রকমই জানা যাচ্ছে।
বাডগের এমন অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল না সাভারকরের মত। তাই তাঁকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। আপটে, গডসের সাথে ভেতরে যাবার আগে বাডগের কাছ থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে নেন যাতে ছিল গান-কটন স্ল্যাব, হ্যান্ড-গ্রেনেড, ফিউজ তার আর ডিটোনেটর। পাঁচ-দশ মিনিট বাদেই দুজনে বেরিয়ে আসেন সেই ব্যাগটা নিয়ে – এবং সেখানে উপস্থিত আরও দুজনকে বলেন এই ব্যাগ নিয়ে দিল্লি পৌঁছতে। এই দুজনের একজন ছিলেন মদনলাল পাহ্ওয়া – পাকিস্তান থেকে দেশভাগের পরে ভারতে আসা একজন মাথাগরম পঞ্জাবী রিফিউজি, আর তার “শেঠ” – মহাসভার সদস্য বিষ্ণু কারকারে।
গডসে আর আপটে সাভারকর সদনে আসার আগেই, অস্ত্রসমেত পাহ্ওয়া আর কারকারে এখানে এসে স্বয়ং সাভারকারের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। কলিন্স আর লাপিয়েরের বই থেকে জানা যাচ্ছেঃ
“গডসে, আপটে আর বাডগে সেই জানুয়ারিতে বীর সাভারকরের হেডকোয়ার্টার সাভারকর ভবনে প্রবেশ করা প্রথম দল ছিল না। এর আগেই কারকারে মদনলালকে সঙ্গে নিয়ে প্রভুর (সাভারকরের) কাছে এসেছিলেন। সেখানে কারকারে এই তরুণ পঞ্জাবীকে ‘একজন সাহসী কর্মী’ হিসেবে পরিচয় করান। প্রত্যুত্তরে সাভারকর মদনলালের দিকে তাকিয়ে একটি হিমশীতল হাসি ফিরিয়ে দেন। এর পরে, লোকে যেমন করে বেড়ালের গায়ে হাত বোলায়, তেমনি ভঙ্গীতে তিনি তরুণ পঞ্জাবীটির হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দেন, এবং বলেন, ‘এই ভাবেই কাজ করতে থাকো’।”
বাডগে সাভারকরকে ১৯৪৪-৪৫ থেকেই চিনতেন, আর নাথুরাম গডসেকে চিনতেন ১৯৪০-৪১ সাল থেকে। সেদিন সাভারকর সদন ঘুরে আসার পরের দিন আপটে বাডগেকে জিজ্ঞেস করেন তিনি দিল্লি এসে তাঁদের সাথে কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক কিনা। “আপটে আমাকে বলেছিল যে তাতিয়ারাও (সাভারকরকে এই নামেই সম্বোধন করতেন গডসে) গান্ধিজী, জওহরলাল নেহরু আর [হুসেন শহীদ] সুহ্রাবর্দীকে ‘খতম করার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদের ওপর বিশ্বাস করে, এই কাজের দায়ভার ন্যস্ত করেছেন,” বাডগের লেখা থেকে জানা যায়। পরে গান্ধীহত্যা মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচেন, কোর্টে দেওয়া তাঁর সাক্ষ্য থেকে এই তথ্যগুলো জানা যায়।
পুণাতে কিছু ব্যক্তিগত কাজকর্ম সেরে বাডগে আবার ১৭ই জানুয়ারি বম্বে ফিরে আসেন। “গডসে বলেছিল, আমাদের একবার তাতিয়ারাওয়ের (সাভারকর) শেষ ‘দর্শন’ নিতে যাওয়া উচিত” – বাডগের সাক্ষ্য। সাভারকর সদনের কম্পাউন্ডে ঢুকে আপটে একতলার ঘরে বাডগেকে অপেক্ষা করতে বলে ওপরে উঠে যান, এবং নেমে আসেন স্বয়ং সাভারকরকে সাথে নিয়ে। সাভারকর তাঁদের দুজনকেই আশীর্বাদ করেনঃ “যশস্বী হউঁ ইয়া” (সফল হয়ে ফিরো)।
আমরা আবার বাডগের সাক্ষ্য থেকে কয়েক লাইন পড়ি – সাভারকর সদন থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা দুজনে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসেন, সেখানে আপটে বাডগেকে বলেনঃ
“তাতিয়ারাও (সাভারকর) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে গান্ধীর একশো বছর পূর্ণ হয়েছে, আমাদের কাজে আমরা যে সফল হবই তাতে কোনও সন্দেহ নেই”।
কিন্তু এর ঠিক তিন দিন পরেই, ২০শে জানুয়ারি, প্রথম প্রচেষ্টায় তাঁরা বিফল হন। বিড়লা হাউসে তাঁরা গান্ধীকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন। সার্বজনিক প্রার্থনাসভা চলাকালীন গান্ধীকে খুনের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়, এবং পাহ্ওয়া, যিনি গান্ধীর খুব কাছেই রাখা একটা পোডিয়ামে বোমা রেখেছিলেন, তিনি গ্রেফতার হন। বাকি চক্রান্তকারীদের দিল্লি ছেড়ে পালাতে হয় রাতারাতি।
কলিন্স আর লাপিয়েরের বইতে লেখা আছে,
“মদনলাল (পাহ্ওয়া) এর পরেও তাঁর সহ-চক্রান্তকারীদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ করেন নি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন ওরা আবার চেষ্টা করবে। পুলিশের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন যাতে ওরা যথাসম্ভব বেশি সময় পায়, … তারপর যখন তিনি আন্দাজ করতে পারেন যে ওরা পালাবার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে, তখন তিনি পুলিশের কাছে মুখ খোলেন এবং তাঁদের কার্যকলাপের খুব সাদামাটা একটা বিবরণ দেন। এই বিবরণ দেবার সময়ই হঠাৎ করে তিনি বলে ফেলেন যে … তিনি তাঁর সঙ্গীদের সাথে সাভারকর সদনে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে তিনি সেই বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে স্বচক্ষে দর্শন করে এসেছেন।
মাঝরাত পর্যন্ত জবানবন্দী নেওয়ার কাজ চলে, এর পরে পুলিশ সেই রাতের মত মদনলালকে প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে রেহাই দিয়ে কেসের দৈনিক রেজিস্টার সেদিনকার মত বন্ধ করে। … তারা বুঝেছিল যে এর পেছনে আছে এক বড়সড় “প্লট”। তারা বুঝেছিল কতজন লোক এই চক্রান্তের সাথে জড়িত। তারা এ-ও বুঝেছিল, যারা জড়িত, তারা সকলেই বীর সাভারকরের অনুগামী।”
পুলিশ গান্ধীকে জানায় যে পাহ্ওয়া কোনও একক চক্রান্তকারী (লোন উল্ফ) নয় এবং “খুব সম্ভবত ওর দলের বাকিরা আবার তাঁকে মারবার চেষ্টা করবে”। দিল্লির তৎকালীন ডিআইজি, ডি ডাব্লু মেহরা বিড়লা হাউসের নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করার পক্ষে মত দেন এবং প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে আসা যে কোনও ব্যক্তিকে সন্দেহজনক মনে হলে, তাকে তল্লাশি করার জন্য তিনি গান্ধীর কাছে অনুরোধ জানান।
কিন্তু গান্ধী মানলেন না – “মন্দিরে গীর্জায় যাঁরা প্রার্থনা করতে যান তাঁদের আপনি তল্লাশি করবেন?”
“না স্যর”, মেহরা জবাব দিয়েছিলেন, “কিন্তু সেখানে তো এমন কেউ থাকে না যাকে খুন করার লক্ষ্যে একটা বুলেট ছুটে আসতে পারে।”
“রাম আমার একমাত্র রক্ষাকর্তা”, গান্ধী উত্তরে জানান, “… এই দেশের শাসকেরা আমার অহিংসায় বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে আপনার পুলিশ রক্ষীরা আমাকে রক্ষা করতে পারে। জেনে রাখো, আমাকে রক্ষা করবেন একমাত্র রাম, আর আমার প্রার্থনাসভায় আপনি আপনার পুলিশবাহিনি নিয়ে অনুপ্রবেশ করতে পারেন না।”
হিন্দু দেবতা রামের ওপর গান্ধীর এই বিশ্বাস, সত্যিই অন্ধবিশ্বাস ছিল। তিনি বুঝতে পারেন নি উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর এই বিশ্বাস সত্যিই ভেঙে দেবে কয়েকদিনের মধ্যেই। হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হবার তিন চারদিন পর, দিল্লি থেকে পালিয়ে, গডসে আবার বম্বে গিয়ে সাভারকরের সাথে দেখা করেন এবং দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা চালান – এবং তার পরে আবার দিল্লি ফিরে আসেন এবং ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর তিনটে বুলেট ছুঁড়ে তিনি গান্ধীকে হত্যা করেন।
সাভারকরের সরাসরি অনুগামী হিন্দু মহাসভার এক উন্মত্ত দক্ষিণপন্থী অংশ, গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে যুক্তঃ সর্দার প্যাটেল।

বাইশে ফেব্রুয়ারি, সাভারকর ততদিনে আটক হয়েছেন, ভারত সরকারের কাছে সেই একই মুচলেকা দেন, যা তিনি এক সময়ে ব্রিটিশ রাজের কাছেও দিয়েছিলেনঃ
“আমি ছাড়া পেলে সমস্ত রকমের সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংস্রব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখব, সরকার যতদিন চাইবেন, ততদিন পর্যন্ত।”
আইনজীবি এবং ইতিহাসবিদ এ জি নুরানি লিখছেন, “সরকার রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিস্থিতির বিচার করতে চাইলে সাভারকরের এই হাস্যাস্পদ এবং পুরোপুরি শর্তবিহীন এই মুচলেকাটি স্বীকার করে নিতেই পারত, কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটলেন না।” পরের মাসে দিল্লি পুলিশ সাভারকরকে গ্রেফতার করে। জাস্টিস আত্মা চরণের পৌরোহিত্যে ৪ঠা মে তারিখে এক বিশেষ আদালত গঠিত হল এই ঘটনার তদন্তের জন্য।
তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যাঁকে আজকের দিনের দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা তাঁদের নিজেদের লোক বলে দাবি করে থাকেন – তিনি ছিলেন এই কেসের মুখ্য প্রসিকিউটার, যাঁর মনে সাভারকরের অপরাধ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহই ছিল না। ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নেহরুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছেনঃ
“সাভারকরের সরাসরি অনুগামী হিন্দু মহাসভার একদল উন্মাদ সদস্য এই চক্রান্তের জাল বুনেছিল এবং হত্যাকাণ্ডটা ঘটিয়েছিল।”
যদিও, ব্যক্তিগত ধারণাকে ব্যবহার করে তিনি কোনওভাবেই আইনি পদ্ধতিকে প্রভাবিত হতে দেন নি। মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আশংকা ছিল যে সাভারকরকে “ফাঁসানো হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে”, তাঁকে আশ্বস্ত করে প্যাটেল, সাভারকরের নাম চার্জশীটে দাখিল হবার ঠিক কুড়িদিন আগে, একটি চিঠিতে লেখেনঃ
“আমি [অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং অন্যান্য আইনি উপদেষ্টা আর তদন্তকারী অফিসারদের] স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, যে সাভারকারের নাম চার্জশীটে ঢোকানো হলে তা যেন সম্পূর্ণভাবে আইনী এবং বিচারপ্রক্রিয়ার পদ্ধতি মেনেই হয়, এবং এতে কোনওরকমের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেন প্রভাব ফেলতে না পারে … আমি তাদের আরও বলেছি যে, যদি সাভারকরের নাম ঢোকানো অনিবার্যই হয়, তা হলে সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র অতি অবশ্যই আমাকে দেখাতে হবে, যে কোনও প্রক্রিয়া শুরু করবার আগে।”
এবং, সাভারকরের চক্রান্তে যোগসাজশ বিষয়ে ব্যক্তিগত ধারণাকে আইনি প্রক্রিয়ার থেকে আলাদা করতে গিয়ে, তিনি লিখলেনঃ
“এটা অবশ্যই সেই অপরাধ, আইনের চোখে যা প্রতিষ্ঠিত। নৈতিকভাবে, এ বিষয়ে কারুর ব্যক্তিগত বিশ্বাস কারুর থেকে আলাদা হতেই পারে।”
সাভারকরের আত্মপক্ষ সমর্থন

বাডগের জবানবন্দীতে সাভারকরের বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যসমূহঃ
- গান্ধীকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টার সময়ে যে সব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই সব অস্ত্রসমেত ১৪ই জানুয়ারি গডসে আর আপটের সাথে সাভারকরের দেখা হয়েছিল, এর কিছুদিন পরেই গান্ধীকে হত্যা করার প্রথম প্রচেষ্টা করা হয়।
- আপটে বাডগেকে জানিয়েছিলেন যে সাভারকর গান্ধীকে হত্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এবং এই কাজটি তিনি তাদের ওপর ভরসা করে, তাদের দিয়েই করাতে চান।
- এর পর ১৭ই জানুয়ারি আপটে আর গডসের সাথে সাভারকরের আরেকটি সাক্ষাৎকার হয়, যেখানে বাডগের চোখের সামনেই সাভারকর বাকি দুজনকে (আপটে আর গডসে) আশীর্বাদ করেন এই বলেঃ “সফল হয়ে ফিরে এসো”।
- ১৭ই জানুয়ারি সাভারকর সদন থেকে বেরিয়ে আপটে বাডগেকে বলেন যে সাভারকর তাঁকে বলেছেন – গান্ধীর একশো বছর পার হয়ে গেছে এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে তাঁদের (গান্ধীকে হত্যা করার) উদ্দেশ্য সফল হবে।
সাভারকর, তাঁর কৌশলী ডিফেন্সে দাবি করেন যে, বাডগের সাক্ষ্য অনুযায়ী ১৪ই জানুয়ারি তারিখে গডসে আর আপটের সাথে সাভারকরের সাক্ষাৎকার সন্দেহহীনভাবে প্রমাণ করা যায় না, কারণ বাডগে নিজে সেই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না। বাডগের সাক্ষ্য কেবলমাত্র আমাদের এটুকুই জানায় যে, ১৪ তারিখে তিনি আপটে আর গডসের সঙ্গে সাভারকর সদনে এসেছিলেন, তাঁকে নিচের ঘরে বসিয়ে রেখে বাকি দুজন ওপরে চলে যায়। সাভারকর দাবি করেনঃ
“প্রথমত … সাভারকর সদনে যাওয়া মানেই সাভারকরের সাথে দেখা করা নয়। গডসে আর আপটের সঙ্গে দামলে, ভিন্ডে আর কাসারেরও ভালো আলাপ পরিচিত ছিল, যারা ঐ সদনেই সবসময়ে পড়ে থাকত … তো, হতেই পারে আপটে আর গডসে এ রকমই কোনও বন্ধুর সাথে অথবা হিন্দু মহাসভার অন্য কোনও সহকর্মীর সাথে দেখা করতে গেছিল।”
এইভাবে নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে হিন্দু মহাসভার অন্যান্য সদস্যদেরও নাম নিয়ে তাদের এই তদন্তের আওতায় নিয়ে এসে, সাভারকর বলে চলেনঃ “দ্বিতীয়ত … আপটে আর গডসে এই ঘটনাটা পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং জানায় যে তারা কখনোই (অস্ত্রভর্তি) ব্যাগ আর বাডগেকে নিয়ে সাভারকর সদনে যায় নি, যা বাডগে তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেছে।”
সাভারকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে গান্ধীকে হত্যা করা হবে, বাডগের এই সাক্ষ্যের ডিফেন্সে সাভারকর বলেনঃ
“… বাডগে শুধুই সত্যি বলছে এটাই যদি ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এই কথাটা সে আপটের থেকে শুনেছিল, সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায় যে আপটে তাকে সত্যি কথা বলেছিল না মিথ্যে। গান্ধী, নেহরু আর সুহ্রাবর্দীকে খতম করে দেবার কথা আমি আদৌ কখনও আপটেকে বলেছিলাম, এর কোণও প্রমাণই নেই। হতেই পারে যে, হিন্দু সংগঠনীদের ওপর সাভারকরের প্রভাবকে কাজে লাগাবার জন্য আপটে নিজে নিজে বানিয়ে এই মিথ্যে কথা বলেছিলেন, নিজের কাজ সারবার জন্য। প্রসিকিউশনের এখন এটাই তদন্ত করে দেখা উচিত যে আপটে এই কলাকৌশল কার কথায় প্রভাবিত হয়ে চালাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আপটে হোটেলের কীপারদের নাম আর ঠিকানা ভুল দিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে … এমন কি গোপনে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করেছিল সে-ই।”
যে আপটে শেষ পর্যন্ত আদালতে দাঁড়িয়ে এটা স্বীকার করেন নি যে এই হত্যার ষড়যন্ত্রে সাভারকরের বিন্দুমাত্র কোনও অবদান ছিল, সেই আপটেকে এইভাবে আক্রমণ করবার পরে সাভারকর বলেন যে, সাভারকর গান্ধীকে হত্যা করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে সাভারকরই জানিয়েছেন তাদের, এমন তথ্য আপটে এবং গডসে দুজনেই ইতিমধ্যেই অস্বীকার করেছেন। একই যুক্তি কাজে লাগিয়ে, গান্ধীর সময় শেষ হয়ে গেছে বলে সাভারকর আপটেকে জানিয়েছিলেন, বাডগের জবানবন্দীর এই দাবিও তিনি খারিজ করে দেন।

সাক্ষ্যপ্রমাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ – ১৭ই জানুয়ারি তারিখে আপটে আর গডসের সাথে দেখা করা এবং “সফল হয়ে ফিরে এসো” বলে তাদের আশীর্বাদ করা সম্পর্কে সাভারকর নিজের সপক্ষে সওয়াল করেনঃ
“প্রথমত, আমি জানাতে চাই যে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে বা এর কাছাকাছি কোনও তারিখে আপটে আর গডসে আমার সঙ্গে আদৌ দেখা করে নি, এবং আমি তাদের “সফল হয়ে ফিরে এসো” এই ধরণের কোনও কথাও বলি নি …
দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই দেখা হবার ব্যাপারে বাডগের জবানবন্দী সঠিক, তবুও সে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে সে আমার বাড়ির একতলার ঘরে বসে ছিল, এবং আপটে আর গডসে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেছিল। তারা আমার সাথেই দেখা করেছিল কিনা, অথবা ঐ একই বাড়ির দোতলায় বাস করা কোনও ভাড়াতে বা তাদের কোনও পরিবারের লোকের সাথে দেখা করে নেমে এসেছিল, এ ব্যাপারে তার কিছুই জানার কথা নয়।”
এইভাবে কথার প্যাঁচে তিনি প্রমাণ করে দিলেন যে সেদিন আপটে আর গডসের সাথে তিনি দেখাই করেন নি সাভারকর সদনে, তারপর আরও বললেনঃ
“যদি এটাও ধরে নিই যে আপটে আর গডসে আমার সাথেই দেখা করেছিল, আমার সাথে কথাও বলেছিল, তবুও ঠিক কী বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছিল দোতলার ঘরে, সেটা বাডগের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একতলার ঘরে বসে, তার পক্ষে কোনওভাবেই জানা সম্ভব নয়। ওরা আমার সাথে কোনও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করছিল, এমনটা ওর জবানবন্দী থেকে ধরে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব। বরং এটা বলা যেতেই পারে যে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ব্যতীত অন্য কোনও বিষয়ে তারা আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।”
এর পর সাভারকর “সফল হয়ে ফিরে এসো” উক্তি প্রসঙ্গে বলেন,
“যদি এটাও ধরে নিই যে আমি সেই বাক্যটি বলেছিলাম, হতে পারে আমি অন্য কোনও বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলেছিলাম, নিজাম সিভিল রেজিস্টেন্স, অথবা দৈনিক পত্রিকা অগ্রণীর জন্য চাঁদা তোলা, ওথবা হিন্দু রাষ্ট্র প্রকাশন লিমিটেডের শেয়ার বিক্রির ব্যাপার … অথবা অন্য কোনও বিষয়। বাডগে যেহেতু কিছুই জানত না কী বিষয়ে আমার সাথে গডসে আর আপটের দোতলার ঘরে কথা হয়েছে, তার পক্ষে এটাও জানা সম্ভব নয়, কোন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি “সফল হয়ে ফিরে এসো” বলেছিলাম তাদের।”
রবার্ট পেইন তাঁর বই দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ মহাত্মা গান্ধী-তে সাভারকরের ডিফেন্স সম্বন্ধে ছোট করে লেখেনঃ
“তিনি ষড়যন্ত্রীদের সাথে কখনওই দেখা করেন নি; যদি দেখা করেও থাকেন তো ষড়যন্ত্র করেন নি; তিনি কখনওই সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসেন নি; যদি এসেও থাকেন এবং যদি বলেও থাকেন “সফল হয়ে ফিরে এসো” তা হলে ধরে নিতেই হবে যে তিনি ষড়যন্ত্রর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্করহিত কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন … সাভারকর বাডগের জবানবন্দীর প্রতিটা বাক্যকে তার প্রেক্ষিত থেকে বের করে নিয়ে দেখাচ্ছিলেন যে সে সব সাক্ষ্যর আসলে কোনও অর্থই নেই।”
“পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ বা সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স”, তিনি লেখেন, “চমকে দেবার মত ছিল, বাডগের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য ছিল”। পেইন একাই বাডগের জবানবন্দীকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন নি, জাস্টিস চরণও বাডগের সাক্ষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেছিলেন। তিনি জাজমেন্টে লেখেনঃ
“(বাডগে) তাঁর তথ্যপ্রমাণ সরাসরি পেশ করেছিলেন। তিনি কোনও ক্রস-এক্সামিনেশন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন নি, কোনও প্রশ্নকেও এড়িয়ে যান নি। নিজে অকুস্থলে উপস্থিত না থাকলে নির্ভুলভাবে বারবার একই তথ্য একই খুঁটিনাতি সমেত একই সিকোয়েন্সে বার বার উপস্থাপিত করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটে না থাকলে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যে কারুর পক্ষে ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এইভাবে মনে থাকা খুব কঠিন কাজ।”

নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি
তবে, ১৪ই এবং ১৭ই জানুয়ারি সাভারকরের সাথে দেখা হওয়া – বাডগের দেওয়া এই দুদিনের সাক্ষ্য আরও দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যের সাথে মেলে না। তাদের একজন ছিলেন শান্তাবাঈ মোদক নামে জনৈক অভিনেত্রী, যিনি ১৪ই জানুয়ারি তারিখে পুণা এক্সপ্রেসে গডসে আর আপটের সাথে পরিচিত হন এবং দাদর স্টেশন থেকে তাঁকে নিতে আসা তাঁর ভাইয়ের গাড়িতে এই দুজনকে শিবাজী পার্ক পর্যন্ত লিফট অফার করেন। তিনি কোর্টকে জানানঃ
“এই দুটি বাড়ি (তাঁর ভাইয়ের বাড়ি এবং সাভারকর সদন) রাস্তার ডানদিকে ছিল। আমরা আমার ভাইয়ের বাড়ি পার করে সাভারকর সদনের বিপরীতে গাড়ি থামাই। এই দুই ভদ্রলোক (গডসে এবং আপটে) সেখানে নেমে যান। আমরা তার পরে আরেকটু এগিয়ে গাড়ি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আমার ভাইয়ের বাড়িতে ঢুকি। আমি এই দুজনকে সাভারকর সদনের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম।”
প্রমাণের মাপকাঠিতে এটা প্রমাণ করা যায় যে সাভারকর সদনের সামনেই গডসে আর আপটে নেমেছিলেন, কিন্তু বিচারক এখানে মন্তব্য করেন যে, এই সাক্ষ্য “এইটা প্রমাণ করে না যে তাঁরা সাভারকর সদনে ঢুকে বিনায়ক ডি সাভারকরের সাথেই দেখা করতে গেছিলেন। কারণ সেই বাড়িতে শুধু সাভারকরই নন, এ এস শিন্ডে এবং গজন দামলেও এই সাভারকর সদনেই থাকতেন।”
আইতাপ্পা কোটিয়ান, সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার যিনি ১৭ই জানুয়ারি তারিখে গডসে, আপটে আর বাডগেকে সাভারকর সদন থেকে নিয়ে গেছিলেন, এই মামলার আরেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। তিনি কোর্টে বলেনঃ
“আমি … শিবাজী পার্কের দক্ষিণ দিকে সেকেন্ড রোডের ইন্টারসেকশনে ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়াই। যাত্রীরা সেইখানে ট্যাক্সি থেকে নেমে যান। আমি যতদূর দেখতে পেয়েছিলাম, তাঁরা রাস্তার মোড় থেকে দু নম্বর বাড়িটার ভেতরে (মানে, সাভারকর সদন) ঢুকে গেছিলেন।”
এই সাক্ষ্যেও, বিচারক বলেন, বাডগের জবানবন্দী পুরোপুরি সমর্থন করে না, যেখানে তিনি দাবি করেছেন সাভারকর গডসে আর আপটেকে “সফল হয়ে ফিরে এসো” বলছেন। দোতলার ঘরে গডসে, আপটে আর সাভারকরের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সে বিষয়ে যথাযথ কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় এটা কোনওমতেই ধরে নেওয়া যায় না যে সাভারকরের সেই উল্লিখিত মন্তব্য গান্ধীকে হত্যা করার প্রসঙ্গেই বলা।
“অন্যান্য ষড়যন্ত্র মামলার মতই এই মামলাতেও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কোনও সরাসরি তথ্যপ্রমাণ (ডিরেক্ট এভিডেন্স) পাওয়া যায় না। যদিও, পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ (সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স) বিচার করলে নির্ভুলভাবে এই সমস্ত ঘটনাবলী ষড়যন্ত্র ঘটিত হবার প্রতিই ইঙ্গিত করে … এই ঘটনা … পুরো দেশকে অন্তস্থল পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে এবং সমাজের সামগ্রিক বিবেক তখনই সন্তুষ্ট হবে যদি … মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় …”
যদি সেদিন জাস্টিস চরণ এই কথাগুলি লিখতেন তাঁর জাজমেন্টে, সাভারকরের ফাঁসি সেদিন কেউ আটকাতে পারত না। কিন্তু না, এই কথাগুলো তিনি লেখেন নি। এই কথাগুলো অনেক পরের, সাম্প্রতিক কালে, সুপ্রিম কোর্টের এক জাজমেন্টের অংশ, যার মাধ্যমে আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কালেক্টিভ কনসায়েন্স অফ দ্য সোসাইটি। সমাজের সামগ্রিক বিবেককে তুষ্ট করার জন্য একটি ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, সরাসরি কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও। কিন্তু সেদিন, ১৯৪৮ সালে, জাস্টিস চরণের আইনী মূল্যবোধ অন্য মাত্রার ছিল, যে মূল্যবোধ একজন বিচারককে শেখায় – দরকার হলে সরাসরি তথ্যপ্রমাণের অভাবে হাজারটা অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু বিচারব্যবস্থার ভুলে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিরও যেন জীবন না নষ্ট হয়।
তাই সেদিন, যদিও তিনি বাডগেকে একজন সত্যবাদী সাক্ষী বলে স্বীকার করেছেন, কিন্তু কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণের ক্ষেত্রে সরাসরি তথ্যের যোগসূত্র না মেলায় তিনি সাভারকরকে দোষী প্রতিপন্ন করা অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন, যদিও, পেইনের মতে, পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ সাভারকরকে দোষী সাব্যস্ত করায় কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অতএব, সাভারকর বেকসুর খালাস পেলেন, আপটে আর গডসের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হল।
“তুলনাহীন কাপুরুষ”

পি এল ইনামদার তাঁর স্মৃতিচারণা, দ্য স্টোরি অফ দ্য রেড ফোর্ট ট্রায়াল, ১৯৪৮-৪৯ -এ লিখেছেন, “নাথুরাম … তাতিয়ারাওয়ের (সাভারকরের) ইচ্ছাকৃত অপরিচিতির ভান করা এবং আদালতে বা লালকেল্লার জেলে তাঁর সাথে কোনও সম্পর্ক না রাখায় … গভীরভাবে আহত হয়েছিলেন।” যে উকিল এই দুই ষড়যন্ত্রীর সপক্ষে লড়েছিলেন এবং নাথুরাম গডসের ভাই, গোপাল গডসে – পাঠকদের জানিয়েছিলেনঃ
“তাতিয়ারাওয়ের হাতের একটি স্নেহের স্পর্শের জন্য নাথুরাম যে কী পরিমাণ ব্যাকুল ছিল, তাঁর মুখ থেকে একটি সহানুভূতির বাণী শোনার জন্য, অন্তত জেলের ভেতরে একটিবার তাঁর সহমর্মিতার দৃষ্টিপাত পাবার জন্য, সে বলে বোঝানো যাবে না। যখন শিমলা হাইকোর্টে নাথুরামের সাথে আমার শেষবার দেখা হয়, তখনও নাথুরাম আমাকে তার এই মানসিক আঘাতের কথা জানিয়েছিল।”
কিন্তু মামলা চলাকালীন সাভারকর একটিবারের জন্যেও “নাথুরামের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান নি … কথাও খুবই কম বলেছেন,” ইনামদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন।
“যখন অন্যান্য সহ-অভিযুক্তরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, হাল্কা রঙ্গ-রসিকতাও চালাচ্ছিল, সাভারকর পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল নীরব হয়ে বসে ছিলেন, এজলাসে উপস্থিত বাকি সবাইকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, নির্ভুল ডিসিপ্লিনড ভঙ্গীতে।”
মামলা চলাকালীন সাভারকরের ভাবভঙ্গী সম্পর্কে ভারতীয় রাজনৈতিক চরিত্রদের ট্রায়ালপদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এবং প্রখর জ্ঞানী নুরানি, তাঁর বই ‘সাভারকর অ্যান্ড হিন্দুত্বঃ দ্য গডসে কানেকশন’-এ লিখেছেন, “আদালতের সমস্ত স্মরণীয় বিচারপ্রক্রিয়ার আর্কাইভে এমন বিশ্বাসঘাতকতা আর কাপুরুষতার নিদর্শন দ্বিতীয়টি নেই।”
এই কাপুরুষতা, যার বশবর্তী হয়ে সাভারকর তাঁর লেফটেন্যান্টটিকে (গডসের ভাইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, গডসেকে তিনি এই নামেই ডাকতেন) সেদিন চিনতে অস্বীকার করেছিলেন, আজ – সম্ভবত নরেন্দ্র মোদী সরকারের বাকস্বাধীনতার বলে বলীয়ান হয়ে – হিন্দু মহাসভা সেই লেফটেন্যান্ট নাথুরাম গডসের মূর্তিই দেশের প্রান্তে প্রান্তে বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিষ্ঠার কথা বুক বাজিয়ে ঘোষণা করে।
গডসের ফাঁসি হবার – অথবা মহাসভার দাবি অনুযায়ী তাঁর “শহীদ” হবার – সতেরো বছর পরে, সাভারকর, প্রায় তিরাশি বছর বয়েসে, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ধীরে ধীরে খাবার আর ওষুধ খেতে অসমর্থ হন, এবং সেই মাসেই ২৬ তারিখে তিনি মারা যান। কিন্তু প্রকৃত সত্য আর গান্ধীহত্যায় তাঁর আসল ভূমিকা তাঁর দেহের সাথে সাথে সমাধিস্থ হয়ে যায় নি। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে, কাপুর কমিশন সন্দেহাতীতভাবে গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রে সাভারকরের ভূমিকা প্রমাণ করেন।
কাপুর কমিশন, ১৯৬৯ সালে, সাভারকরকে দোষী সাব্যস্ত করেন।

গডসের ভাই যখন ১৯৬৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরোন, তাঁকে সম্বর্ধনা দেবার জন্য একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে বাল গঙ্গাধর তিলকের পৌত্র, জি ভি কেতকর, দাবি করেন যে গডসের গান্ধীকে হত্যা করার সুপ্ত ইচ্ছের ব্যাপারে তিনি অবহিত ছিলেন। এই বক্তব্যের ফলে দেশজোড়া এক বিতর্কের ঢেউ ওঠে এবং ১৯৬৯ সালে এরই ফলে একটি কমিশন গঠিত হয় জাস্টিস জীবন লাল কাপুরের নেতৃত্বে, যেখানে তাঁকে অধিকার দেওয়া হয়, গান্ধীহত্যার ব্যাপারে আগে থেকেই জানত, এমন যে কারুর বিষয়ে তদন্ত করার জন্য, এবং দেখার জন্য যে এই খবর আগে থেকে জেনে তাঁরা সে কথা কাকে জানিয়েছিলেন বা কী মত/পথ/সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন।
সাভারকরের দুই সহযোগী, যাঁরা এর আগের কমিশনে সাক্ষ্য দেন নি, তাঁরা এই কমিশনে সাক্ষ্য দেন। তাঁদের জবানবন্দীতে শুধু যে বাডগে কথিত সেই দুই সাক্ষাৎকার সত্যি সত্যিই ঘটার সমর্থন মেলে, তাইই নয়, আরও জানা যায় যে এই দুটি দিন ছাড়াও জানুয়ারির ২৩ আর ২৪ তারিখে, দিল্লিতে মদনলাল পাহ্ওয়ার গান্ধীহত্যার প্রচেষ্টা বিফল হবার পরে, গডসে আর আপটে আরও দু-দুবার সাভারকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সাভারকরের দেহরক্ষী আপ্পা রামচন্দ্রের জবানবন্দী নথিবদ্ধ করে জাস্টিস কাপুর তাঁর কমিশনের রিপোর্টে লেখেনঃ
“১৩ বা ১৪ই জানুয়ারি নাগাদ, কারকারে এক পঞ্জাবী যুবককে (মদনলাল) সাথে নিয়ে সাভারকরের কাছে আসেন এবং প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। ১৫ বা ১৬ তারিখে রাত সাড়ে নটা নাগাদ আপটে আর গডসের সাথে সাভারকরের কথাবার্তা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে, সম্ভবত ২৩শে বা ২৪শে জানুয়ারি নাগাদ আপটে আর গডসে আবার সাভারকরের কাছে আসেন, এবং তাঁদের মধ্যে প্রায় আধঘণ্টা কথাবার্তা চলে।”
সাভারকরের সহকারী গজানন বিষ্ণু দামলেও তাঁর জবানবন্দীতে একই ঘটনার পুনরুল্লেখ করেন যে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আপটে আর গডসে সাভারকর আপটে আর গডসের সাথে দেখা করেছিলেন। এই দুজনের সাক্ষ্য এবং আগে দেওয়া বাডগের সাক্ষ্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আগের বারে কোর্টে দাঁড়িয়ে সাভারকর মিথ্যে কথা বলেছিলেন – “১৭ই জানুয়ারি ১৯৪৮ বা তার কাছাকাছি কোনও সময়েই আপটে আর গডসে আমার সাথে দেখা করতে আসে নি”।
এদের সাক্ষ্য থেকে শুধু যে সাভারকরের সাথে গডসে আর আপটের ১৯৪৬ সাল থেকেই একটা কাজের সম্পর্ক ছিল – সেইটা প্রমাণিত হয়, তাইই নয়, রিপোর্ট অনুযায়ী এইগুলোরও প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ
“কারকারে নিজেও সাভারকরের যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ হত। বাডগেও সাভারকরের কাছে যাওয়াআসা করতেন। ডক্টর পরচুড়েও (আরেকজন অভিযুক্ত, পি এল ইনামদারের ওকালতিতে ইনি ছাড়া পান) যাওয়াআসা করতেন। সমস্ত তথ্যই প্রমাণ করে যে মহাত্মা গান্ধীর হত্যায় যারাই অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকে কোনও না কোনও সময়ে সাভারকর সদনে গেছেন এবং সাভারকরের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথাও বলেছেন। উল্লেখযোগ্য যে কারকারে এবং মদনলাল দিল্লি যাবার ঠিক আগে সাভারকরের সাথে দেখা করেছিলেন, এবং আপটে আর গডসে তাঁর সাথে দেখা করেছিলেন গান্ধীর দিকে বোমা ছোঁড়ার আগে এবং চূড়ান্ত হত্যার দিনের আগে, এবং দুবারই তাঁরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন।”
বম্বের ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ জামশেদ নাগরভালার দায়িত্বে একত্র করা পুরনো এবং নতুন – সমস্ত তথ্যের খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে কাপুর কমিশন তার চূড়ান্ত রিপোর্টে লেখেনঃ
“সমস্ত তথ্যাবলী একসাথে বিবেচনা করে, সাভারকর এবং তাঁর দলের এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে সরাসরি যুক্ত থাকারই প্রমাণ দেয়, অন্য কোনও প্রমাণ ধোপে টেকে না।”
প্রচলিত ইতিহাসের বিকৃতি

কাপুর কমিশনের পেশ করা রিপোর্ট যাতে সাভারকরকে গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেটা প্রকাশিত হবার পরেও প্রথম বিজেপি পরিচালিত এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, ২০০৩ সালে সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলএ গান্ধীমূর্তির পাশেই সাভারকরের একটি ছবি প্রতিষ্ঠা করতে এতটুকুও পিছপা হন নি।
বিশ্বনাথ মাথুর, ভগত সিংয়ের দলের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি একসময়ে দীর্ঘকাল সেলুলার জেলেও বন্দী ছিলেন, এই খবরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। সাভারকরকে “বিপ্লবী বানিয়ে দেওয়া একজন কাপুরুষ” বলে বর্ণনা করে তিনি প্রতিবাদ জানানঃ
“এই সরকার, আমাদের জাতীয় লজ্জার প্রতীককে সরাসরি স্বীকৃতি দিতে বদ্ধপরিকর। লোকটা শুধু যে বৃটিশদের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমাভিক্ষা করেছিল তাইই নয়, মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে সে একজন অন্যতম অভিযুক্তও বটে, আর দ্বিজাতি তত্ত্বেরও সে সমর্থন করত।”
কাপুর কমিশনের তথ্যসূত্র কিংবা ব্রিটিশের প্রতি ভক্তিপূর্ণ আনুগত্যের বিভিন্ন ঘটনা – কোনওকিছুরই পরোয়া না করে নরেন্দ্র মোদী এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা সাভারকরের জন্মোৎসব পালন করেন, প্রতি বছর, এবং তাঁকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী এক দেশপ্রেমিক হিসেবে বিবৃত করেন।

হিন্দুত্ব তত্ত্বের জনকের আসল চেহারাটা তুলে ধরলে কি আর ভারতকে তাঁর স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার কাজটা সহজ হবে? না। বরং ইতিহাসকে বিকৃত করে, কল্পনার আশ্রয় নিয়ে, নামের আগে “বীর” বসিয়ে বরং সেই স্বপ্ন সাকার করার লক্ষ্যে অনেকটা এগনো যেতে পারে।
অন্যান্য বছরের মতই ২৮শে মে, ২০১৮ তারিখেও হিন্দুত্বের প্রবক্তা সাভারকরের ১৩৫তম জন্মবার্ষিকী আরেকবার তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করল – অজস্র মিথ্যে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে, সরকারের ভেতরে এবং বাইরে। গোয়েবলস একদা বলেছিলেন, “বার বার বলে এটা প্রমাণ করে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়, যে একটা বর্গক্ষেত্র, আসলে একটা বৃত্ত।” কিংবা, কাপুরুষতাই আসলে সাহসিকতা। বৃটিশ সরকারের কাছের আনুগত্য স্বীকার করাই আসলে স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবং একজন বিভেদকামী তাত্ত্বিক যিনি সমগ্র ভারতীয়কে একতাবদ্ধ করতে চাওয়া মানুষদের বিরুদ্ধে যে কোনও রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পিছপা হতেন না, তিনিই আসলে একজন দেশপ্রেমিক এবং জাতীয় নায়ক।
অজস্র তথ্য জানলাম এবং সমৃদ্ধ হলাম||
LikeLike