সিকিম ভুটানের লম্বা ট্রিপ সেরে এসেছিলাম, সে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। সিকিম ছাড়িয়ে, উত্তর পূর্ব ভারতে ঘোরার প্ল্যান মাথায় ছিল তারও আগে থেকে, সে নানা কারণে হয়ে ওঠে নি, সে গল্প তো আগেই করেছি, নতুন করে তাই আর বলছি না। স্বপ্ন ছিল মাথার মধ্যে, সাধ্য ছিল দূরত্বে। লজিস্টিকস। উত্তর পূর্ব ভারত বললে একসাথে সাতটা রাজ্যের নাম মনে আসে। সবকটা তো ঘোরা সম্ভব নয় একবারে, একটাও ঘুরতে গেলে এতদিনের ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে – যে ছুটি আমাদের চাকরিতে পাওয়া সম্ভব নয়। এবং, সেই পরিমাণ পয়সাকড়ির জোগাড়।
এই স্বপ্নের ইন্ধন জুগিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ। তাদের কাউকে আপনারা চেনেন, কাউকে নয়। সে চিনিয়ে দেওয়া যাবে সময়মত, তার আগে বলি, স্বপ্নটা কেমন ছিল। … নিতান্ত সীমিত জ্ঞান নিয়ে প্রথম ভেবেছিলাম, অরুণাচল প্রদেশ যাবো। তাওয়াং। সেলা পাস পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে, খারদুং লা পাস বা গুরুদোংমার লেকের থেকে অনেকটাই নিচে তার উচ্চতা, ফলে সারাবছরই খোলা থাকে এই পাস।
তাওয়াং যেতে হয় গৌহাটি থেকে। গৌহাটি পৌঁছনোর দু রকমের উপায় – এক, ট্রেনে মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে এনজেপি বা গৌহাটিতে নামিয়ে নেওয়া ও সেখান থেকে চালানো, আর দুই, পুরোটাই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়া – সেই হিসেবে দিল্লি থেকে গৌহাটি পৌঁছতে লাগবে তিনদিন – গোরখপুর, শিলিগুড়ি, গৌহাটি। এখন, আমি যে দ্বিতীয় পন্থাটাই বেছে নেব, এ নিশ্চয়ই বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই শিলিগুড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তাটা বড্ড বেশি ন্যাড়াবোঁচা, বোরিং। সকাল থেকে একটানা রাত পর্যন্ত সাড়ে সাতশো কি আটশো কিলোমিটার চালিয়েই যাওয়া, চালিয়েই যাওয়া, এর থেকে কি মুক্তি নেই?
মুক্তির একটা পথ পেলাম, এদিক ওদিক ট্র্যাভেলগ নাড়াচাড়া করতে গিয়ে। নেপাল। না, কাঠমান্ডু নয়, দিল্লি থেকে দুদিনে পোখরা পৌঁছে, সেখান থেকে লোয়ার মস্তাং ভ্যালি। মুক্তিনাথ মন্দির পৌঁছে আবার সেখান থেকে ফিরে আসা, তারপরে, সেখান থেকে পোখরা, কাঠমান্ডু, বিরাটনগর হয়ে শিলিগুড়ি ঢোকা পানিট্যাঙ্কি বর্ডার দিয়ে। দুদিনের রাস্তাটা সাতদিন লাগবে হয় তো, কিন্তু একটা নতুন জায়গা বেড়ানোও তো হবে। শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলে তো সেখান থেকে তাওয়াং ঘুরে আসতে খুব বেশি হলে আর ছদিন লাগবে – সবশুদ্ধ দু সপ্তাহে হয়ে যাবে।
সেই মত প্ল্যান বানানো শুরু করলাম। পড়াশোনা শুরু করলাম। কিছু টুকটাক কেনাকাটাও ছিল – সেগুলো আস্তে আস্তে করতে হল, একটা অ্যাকশন ক্যাম কিনলাম, একজোড়া গ্লাভস, বাইকে তেল ভরার বিশেষ নলযুক্ত ফানেল, ইত্যাদি এবং প্রভৃতি।
এর মধ্যে ইনপুট আসতেই থাকল। বিসিএমটি সাইটের তাপস বললেন, আরে ভাই, তাওয়াং গিয়ে কী করবা? ওখানে তো এন্ডিগেন্ডি সবাই যায়। অরুণাচল ঘুরবে তো আনএক্সপ্লোরড অরুণাচলকে এক্সপ্লোর করো। মেচুকা যাও, টুটিং যাও, কিবিঠু যাও, সেই কিবিঠু থেকে পাহাড়ি রাস্তায় চার কিলোমিটার হাঁটলে পড়ে ডং নামে একটা গ্রাম, ভারতের ইস্টার্নমোস্ট পয়েন্ট, দেশের প্রথম সূর্য ওঠে ঐখানে – সেইখানে যাও।
এসব বাড় খাওয়ালে কি কেউ স্থির থাকতে পারে? তাও আমার মত মাথায় ক্যারা-ওলা জনতা? অতএব ঝটপট আরও পড়াশোনা করে এইসব জায়গা আমার আইটিনেরারিতে ঢুকে গেল একে একে। তাপসের মাধ্যমে আরও দু একজনের রেফারেন্স পেলাম, তাঁদের ফোন করে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করলাম।
পাগল তো ছিলামই, ঝটিকা সফরে দিল্লি এসে আরও খানিক সাঁকো নাড়িয়ে দিয়ে গেল পাই। আরে, তুমি অরুণাচল যাচ্ছো, রোয়িং যাবে না? রোয়িং-মায়োডিয়া-আনিনি? সেইখানে মিশমিদের গ্রাম আছে, মিশমিদের কটেজে থাকবে না?
তাও কি হয়? অতএব, তারাও আমার লিস্টে ঢুকল। রোয়িং, মায়োডিয়া, আনিনি। পাসিঘাট থেকে কোনদিকে কীভাবে যেতে হয় – সব টুকে নিলাম আমার গুগল ডকে। এইভাবে ঢুকল তেজু, পরশুরাম কুণ্ড, জয়রামপুর পেরিয়ে পাংসাউ পাস, স্টিলওয়েল রোডের শেষমাথা ভারতের তরফে, যার পর থেকেই শুরু হচ্ছে মায়ানমার … এবং এর পরেও চিত্ত ভরিল না – মনে হল, এতটা গিয়ে শুধু শুধু অরুণাচল দেখেই চলে আসব? মেঘালয়টা যাবো না? সেই যে ডাউকি নদী? এমনই স্বচ্ছ তার জল, ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে নদীর নিচে পাথরদের পরিষ্কার দেখা যায় – আর নদীর অন্যপারেই যার বাংলাদেশ? ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তামাবিল বর্ডার?
ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক মহাশ্বেতা আরও বাড় খাওয়ালেন, ফলে তারাও আমার লিস্টে ঢুকল। এত সব মণিমুক্তো ঢুকে গেল লিস্টে, যে টোটাল প্ল্যান গিয়ে দাঁড়াল সাড়ে ছয় সপ্তাহের।
এ অসম্ভব। এতদিনের ছুটি কেউ দেবে না। কোম্পানিতে ম্যাক্সিমাম তিন সপ্তাহের ছুটি পাওয়া যায়, সে-ও বিয়ে করার জন্য।
কিন্তু, অসম্ভব ভেবে বসে থাকা কি আমার কাজ? চেষ্টা না করে তো অসম্ভব বলতে পারব না।
উপকার হল, না অপকার হল, জানি না – আগস্ট মাসের শেষাশেষি একটা ট্রেনিং নিতে চেন্নাই গেছিলাম সপ্তাহদুয়েকের জন্য, ফিরে এসে দেখলাম আমার রিপোর্টিং ম্যানেজার বদলে গেছে। নতুন একজন এসেছেন, বেশ গাবলুগুবলু ভদ্রলোক।
এমনিতেই আমার প্রজেক্টের ফাইনাল গো লাইভ ছিল তিরিশে নভেম্বর, এর পর একমাসের পোস্ট লাইভ সাপোর্ট মিলিয়ে ডিসেম্বরের একত্রিশ পর্যন্ত প্রজেক্ট ছিল, আমি ঐ লাইভের পরে ডিসেম্বর মাসটাকেই টার্গেট করে রেখেছিলাম। সেই রকম প্ল্যান সাজিয়ে নতুন ম্যানেজারের কাছে গিয়ে এ-কথা সে-কথার পর, খুব রঙ চড়িয়ে বললাম, আমি মোটরসাইকেল রাইডার। দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার আমি হেলায় মোটরসাইকেলে চড়ে পাড়ি দিই টিই। ফিরে এসে ট্র্যাভেলগ লিখি, সেই ট্র্যাভেলগ বই আকারে ছাপে কলকাতার একটা নামকরা প্রকাশনা সংস্থা, আর আমি বইমেলায় গিয়ে সেই সব বইতে অটোগ্রাফ দিই।
ভদ্রলোক খুবই ভালোমানুষ, একসাথে এতগুলো ওভারডোজ নেওয়া ওঁর পক্ষে একটু চাপই হয়ে যাচ্ছিল, ফলে ঢপ মারছি না সত্যি বলছি, এই বেসিক ব্যাপারটুকু মাথায় না এনেই দাবি শুনতে চাইলেন। বললাম, জানি, খুবই আনজাস্টিফায়েড দাবি, কিন্তু ইট ইজ মাই ড্রিম, প্রজেক্টও শেষ হয়ে যাবে, গো লাইভের পরে প্রজেক্ট ম্যানেজারের আর কী কাজ, বাকি সাপোর্ট তো ডেভেলপমেন্ট টিমই সামলে নিতে পারবে, আর পরের অ্যাসাইনমেন্ট আমি বরং জানুয়ারিতে এসেই নেব, ফির ও জিন্দগী হি কেয়া জিন্দগী হ্যায় জিসমে সপনা দেখনা মুশকিল হ্যায়, উসকো সাকার করনা মুশকিল হি নেহি, না-মুমকিন হ্যায় – পরের পর রসগোল্লা দিলাম, আর উনি গপাগপ খেয়ে নিলেন।
ব্যাপারটাকে পাঁচ সপ্তাহে নামাতে হল, ফলে লিস্ট থেকে নেপাল বাদ গেল। নেপাল দিল্লি থেকে এমন কিছু দূরে নয়, ও পরে কখনও করে নেওয়া যাবে। প্রথমে নর্থ ইস্ট।
এবং, আপনারা বললে বিশ্বাস করবেন না, এর পরেও আরও দুটো অলৌকিক রকমের ভালো ভালো ঘটনা ঘটল। এক, সেপ্টেম্বরের থার্ড উইকে জানা গেল আমার প্রজেক্ট অন্য কোনও এক ভেন্ডরের দেরির কারণে হোল্ডে চলে যাচ্ছে নভেম্বরের গোড়ায়, মানে সাময়িকভাবে স্থগিত, আবার জানুয়ারি মাসে শুরু হবে। মানে, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর, দুটো মাস আমার হাতে সে রকম কোনও কাজ রইল না। আর দুই নম্বর ভালো ঘটনাটা হল, আমার প্রজেক্টের যে অনসাইট কাউন্টারপার্ট ছিল – অনসাইট প্রজেক্ট ম্যানেজার, ট্রাম্প বাবার অসীম দয়ায় তার ভিসা আর এক্সটেন্ড হয় নি, ফলে তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে ভারতে, এবং সে এসে জয়েন করবে দিল্লিতেই। মানে, অফশোরে দু দুখানা প্রজেক্ট ম্যানেজার থেকে তো লাভ নেই, সেক্ষেত্রে আমি ছুটি নিতেই পারি, যতটা লম্বা চাই।
অক্টোবরের চার তারিখে সে এসে জয়েন করা মাত্র, আমি ছুটি অ্যাপ্লাই করে দিলাম, এবং বিনা ফলো আপে ঠিক দুদিনের মাথায় সে ছুটি অ্যাপ্রুভডও হয়ে গেল। অজ্জিত হিংসে করল, বুনান হিংসে করল, তিতাস আবাজ দিল, সোসেন হেন ভালোমানুষও প্রচুর দুঃখ বিষাদ ইত্যাদি জানাল – আমি কেন এমন ছুটি পাই না – এইসব বলে, কিন্তু তাতে তখন আমার বয়েই গেছে।
লম্বা জার্নি, প্রায় আটত্রিশ উনচল্লিশ দিনের প্ল্যান, গত প্রায় দেড় বছর ধরে আমি একটু একটু করে তৈরি হয়েছি, ফিনান্সিয়ালি, লজিস্টিকালি। বারবার ফিরে দেখলাম, শেষ মুহূর্তের বদল যা যা করবার, সবই করে ফেললাম প্ল্যানে, দেখলাম পাঁচ সপ্তাহের প্ল্যানে কষ্ট করে হলেও, তাওয়াংও এঁটে যাচ্ছে মোটামুটি। গেছোদাদা গৌহাটি থেকে অভয় দিল, ফলে তাওয়াং পেরিয়ে বুমলা পাস দেখার ব্যবস্থাও করে ফেলা গেল ঘরে বসেই।
ধীরেসুস্থে কয়েকটা জায়গায় হোটেল বুকও করে ফেললাম। অরুণাচলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবশ্য হোটেল খুঁজে লাভ হবে না, সেখানে গেলে আইবি, অর্থাৎ ইন্সপেকশন বাংলো, অথবা হোমস্টে-ই ভরসা, তাই প্রাথমিক কয়েকটা জায়গার বুকিং করে বাকিগুলো তখনকার হাতেই ছেড়ে রাখলাম। দেখা যাবে। আর যদি একান্তই না পাওয়া যায় – টেন্ট কিনেছি, তেমন দরকার হলে সেইসব জায়গায় আরামসে টেন্ট খাটিয়ে শুয়ে পড়া যাবে। কেশুয়ার খুব শস্তায় টেন্ট পাওয়া যায়, মজবুত এবং টেঁকসই।
সবকিছুই হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখারও কমতি ছিল না। অরুণাচলে ঘোরার জন্য পারমিট লাগে, মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে অনলাইনে সেই পারমিট পেয়ে যাওয়া যায়, তাও পেয়ে গেলাম সময়মত, কিন্তু এই সময়েই, অন্য কোথাও কিছু একটা বেসুরে বাজল চরমভাবে।
আর আমি, ভেঙেচুরে খান্খান্ হয়ে গেলাম।
মানুষজীবনের বিভিন্ন ইমোশনের মধ্যে যা সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে পবিত্র – সেই সুন্দর অনুভূতি হঠাৎ একদিন আমার সামনে, পরিস্থিতিবিশেষে, এমন এক কুৎসিত, বিকৃত, কদর্য রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল, আমি সে রূপ সইতে পারলাম না। মুহূর্তের আঘাতে, মনে হয়েছিল যেন আমার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, আমি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না, আমি কারুর চোখে আর চোখ রেখে কথা বলতে পারছি না – অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভুল হয়ে যেতে শুরু করল, এই আমি, যে-আমিকে নিজে এত ভালো করে চিনতাম, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেই লোকটা নিজের চোখেই অচেনা ঠেকতে শুরু করল।
ভয়ঙ্করভাবে ডিসওরিয়েন্টেড হয়ে পড়েছিলাম, অন্তত এক থেকে দেড় সপ্তাহ। সে সময়ের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যানে আমি যাবো না, যেতে চাই না, তবে ধীরে ধীরে আঘাতের ব্যথা যখন সহনীয় হয়ে এল, নিচু হয়ে নিজের খান্খান্ হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোকে একটা একটা করে তুলে জুড়তে গিয়ে দেখি, দু একটা টুকরো নিরুদ্দেশ। খুঁজে পাচ্ছি না। যে সিকি দিন রাত নেট ঘেঁটে একটা একটা জায়গার নাম ধরে ধরে তার সমস্ত ডিটেল খুঁজে বের করছিল, অফিসে বাড়িতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটানা রিসার্চ করে যাচ্ছিল গন্তব্যগুলোর ওপরে – সে আর উৎসাহ পাচ্ছে না। সে ভাবছে, কী লাভ বেরিয়ে? কেন বেরোব আর? সে কাঁদছে, লুকিয়ে লুকিয়ে। মাথা কুটছে একলা অন্ধকার ঘরে। কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখানো যায় না সে আঘাত – সে সম্পূর্ণ নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। বেরোনোর মন, বেড়ানোর মন, নতুন জায়গা দেখে আনন্দিত হবার মনটা পুরোপুরি উবে গেছে কোথাও, ভেতর থেকে আর বেরোনোর জন্য ডাক আসছে না।
কী করব তা হলে আমি? সব তৈরি, কয়েকটা হোটেলের বুকিং, পারমিট, ছুটি, অফিসে প্রয়োজনীয় ব্যাকআপ – সমস্ত তৈরি, এমন সুযোগ হয় তো আর আসবে না, সব ছেড়ে দেব? সেটা কি আমাকে সামলে উঠতে সাহায্য করবে?
দু তিন রাত। দু তিন রাত ভাবলাম। গেলে কী ক্ষতি বা লাভ, না গেলে কী ক্ষতি বা লাভ।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ততদিনে দুর্গাপুজো মিটে গেছে, লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে কালীপুজো আসব-আসব করছে, এমনি একদিন এক একলা মুহূর্তে আবার জমা করা নিজের টুকরোগুলোর দিকে একবার ভালো করে তাকালাম। দেখলাম, কিছু টুকরো হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কয়েকটা টুকরো রয়ে গেছে। তার একটা টুকরো বলছে, প্ল্যান করে পিছিয়ে আসার লোক আমি, সিকি, নই। এতদূর যখন এগিয়েছি, কাম হোয়াট মে, দ্য শো মাস্ট গো অন। … মনের গহীন থেকে অন্য একটা টুকরো ঝিলমিলিয়ে উঠল, বলল, পালাও সিকি, এই শহর, এই দূষণ, এই জায়গা ছেড়ে পালাও কিছুদিনের জন্য। নিজেকে খুঁজে পেতে চাইলে, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। এইখান থেকে বেরিয়ে যেই তুমি ভোররাতের হাইওয়ে ছোঁবে, দেখবে ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছো আবার।
তাই হবে। এ তো এর আগেও হয়েছে। অনেকদিন না বেরিয়ে মনে হত, সত্যিই কি বেরোতে পারব আবার, আছে কি সেই স্ট্যামিনা? তারপরে যখনই বেরিয়েছি, দিল্লির চৌহদ্দি পেরনো মাত্র মন বদলে যায়, তখন চলার নেশা পেয়ে বসে। তার পরে চলতেই থাকি, চলতেই থাকি, মানুষ দেখি, জায়গা দেখি, আমার ভেতরটা রঙে রঙে ভরে ওঠে। এবারেও নিশ্চয়ই তাইই হবে। সুতরাং, জার্নি ক্যানসেল করাটা কোনও কাজের কথা নয়, যেতে আমাকে হবেই। শো মাস্ট গো অন।
যাত্রার তারিখ সতেরোই নভেম্বর। জোর করে নিজেকে তৈরি করতে লাগলাম। মোটরসাইকেলে দুচারটে খুচরো কাজ করবার ছিল, করিয়ে আনলাম একদিন করোল বাগ গিয়ে। শেষমুহূর্তে অফিসে কাজের চাপ তিনগুণ বেড়ে গেল, প্রজেক্ট বন্ধ হবার মুখে ম্যানেজারকে যে সব ঝাপটা সামলাতে হয় আর কি, সেইসব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলে যাবার যখন একদিন বাকি, দেখলাম, মোটরসাইকেলটা একদিন সার্ভিসিং করানোর ছিল, সেটাই করা হয় নি।
কী আর করা, পাড়ার দোকানে নিয়ে গিয়ে চেন টেন টাইট দিয়ে, ইঞ্জিন অয়েল আর কুল্যান্ট নতুন করে ভরে, চাকার পাংচার ইত্যাদি ভালো করে চেক করিয়ে নিয়ে ঘরে এসে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। এক ফাঁকে গিয়ে জেরিক্যানে পেট্রলও ভরে নিয়েছিলাম।
দিল্লিতে এবারে ঠাণ্ডা পড়ে নি একেবারেই, তাই গরম জামাকাপড় সব ব্যাগেই ভরে নিলাম, পরবার জন্য একটা সোয়েটার রাখলাম শুধু।
আগেরবারের ট্রিপে গোরখপুর যেতে গিয়ে খুব ভুগেছিলাম, নরককুণ্ডে গিয়ে মোটেও পোষায় নি, তাই এবারে ঠিক করেছি গোরখপুর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়ে কুশীনগরে দেহ রাখব প্রথমদিনে। বুদ্ধদেবও ওখানেই রেখেছিলেন। খুব শস্তায় বুকিং হয়ে গেছে ইউপি টুরিজমের রাহী পান্থনিবাস।
অ্যালার্ম, ভোর সাড়ে তিনটেয়।

Hat’s off
LikeLiked by 1 person
তোর লেখা শুরু আর আমার পড়া । চালিয়ে যা, শুভেচ্ছা রইল ।
LikeLiked by 1 person
লেখাটা পরে নিজের অনেক কথা মনে পরে গেলো।
যাকগে , চালিয়ে যাও গুরু। কখনো সম্ভব হলে দেখা করার ইচ্ছে রইলো।
LikeLike
দেখা হবেই 🙂
LikeLike
লেখাটা পরে নিজের অনেক কথা মনে পরে গেলো।
যাকগে , চালিয়ে যাও গুরু। কখনো সম্ভব হলে দেখা করার ইচ্ছে রইলো।
LikeLiked by 1 person
খুব সুন্দর লেখা। খুব ভালো লাগলো। পুরোটা পড়ে ফেলবো দুয়েকদিনের মধ্যেই।
জার্নিটা চালিয়ে যাওয়াটাই আসল। কোন একদিন সকালে উঠে দেখবি ফাঁকগুলো আবার ভরে গেছে। 🙂🙂
LikeLike