অরুণাচলের দেশেঃ দ্বিতীয় পর্ব

প্রথম পর্বের পর

সামান আপ খুদ রাখ লিজিয়ে না …

প্রথম দিনের বাঁধাছাঁদায় অনেকটা সময় লাগে। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস। তার ওপর ন তলার ওপর থেকে সমস্ত লাগেজ পার্কিং পর্যন্ত নিয়ে আসা। এইবারে তাই এটুকু কাজ আমি আগে থেকেই এগিয়ে রেখেছিলাম – আগের দিন শুতে যাবার আগে, এক এক করে সবকটা লাগেজ নিচে নামিয়ে গাড়ির ডিকিতে রেখে দিয়েছিলাম, পরের দিন ডিকি থেকে বের করব এবং মোটরসাইকেলে লাগাব, তাতে সময় কম লাগবে। লাগেজ বলতে, মূলত দুদিকের দুটি স্যাডল ব্যাগ, পেছনে একটা টেল ব্যাগ, পিঠে একটা ব্যাগ, আর একটা টেন্ট, যেটা কোনও ব্যাগে ঢোকানো যায় নি। ও হ্যাঁ, আর গলায় ডিএসএলআর ক্যামেরা, এবং পিঠের ব্যাগের স্ট্র্যাপে আটকানো অ্যাকশন ক্যাম। প্রায় দেড় মাসের জন্য বাইরে ঘুরব, কাচাকুচির সুযোগ কম, ফলে প্রচুর জামাকাপড় নিতে হয়েছিল, সে সমস্তই স্যাডল ব্যাগে, টেল ব্যাগে পাংচার কিট, স্লিপিং ম্যাট, টেন্ট ল্যাম্প এবং অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস। আর পিঠের ব্যাগে ল্যাপটপ, যাবতীয় চার্জার, পেট্রল ভরার লম্বা নলওলা ফানেল, এবং এক কৌটো চিঁড়েবাদামভাজা। আগের বারের ট্রিপের শিক্ষা – সিকিনী বানিয়ে দিয়েছিল আগের দিনই। খিদের মুখে বেশ কাজে লাগে।

বাঁধা শেষ করে যখন ফাইনালি মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম, ঘড়িতে তখন বাজছে পাঁচটা দশ। সিকিনী এতক্ষণে নিশ্চয়ই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই ওকে একটা হোয়াটস্যাপ মেসেজ করে দিয়ে আমি এগোলাম।

নভেম্বরের ভোরে এখনও আলো ফোটে নি, রাস্তায় ট্রাফিকও নেই, ইতিউতি দু একটা লরি ছুটে চলেছে শুধু, মোটামুটি পনেরো মিনিটের মধ্যেই দিল্লি পেরিয়ে নয়ডা, আরও পাঁচ মিনিটের মাথায় যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফেললাম। এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হতেই বোঝা গেল ঠাণ্ডাটা শুধু দিল্লিতেই কম, আশেপাশে ভালোই আছে, এদিকে আমি সে রকম তৈরি হয়ে বেরোই নি আজকে, গরম জামা অবশ্যই আছে, কিন্তু সে তো ব্যাগে, দু লেয়ারের বানজি কর্ড দিয়ে বাঁধা, এখন খুলে বের করে আবার লাগাতে গেলে কিছু না হোক আবার কুড়ি মিনিট যাবে। আজকের দৌড় অনেকটা লম্বা – কুশীনগর। আটশো ছাপান্ন কিলোমিটার। প্রতিটা মিনিট এখানে দামী। অতএব, লাগুক খানিক ঠাণ্ডা, সকাল হলে, সূর্য উঠলেই ঠাণ্ডা কমে যাবে, এই ভেবে চলতে শুরু করলাম। তা ছাড়াও, লখনউতে তো থামার আছেই। সুকান্তদার সাথে এবারেও দস্তরখ্বানে লাঞ্চ করার কথা আছে, সেখানেই বরং জ্যাকেট বা উইন্ডচিটার বের করে নেওয়া যাবে।

DSC_0141

ঠিকঠাক স্পিডে চলে সওয়া নটা নাগাদ যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে শেষ করে আগ্রা লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে পড়লাম। বাড়িতে ছোট করে আপডেট দিয়ে আবার চলার শুরু।

গতবারের পর একটা বছর পেরিয়ে গেছে, লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে এখন টোলগেট বসেছে, মোটরসাইকেলের জন্য সেখানে দুশো নব্বই টাকার টোল দিতে হয়। তিনশো দুই কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তায় ঠিক একশো কিলোমিটার দূরত্বে দু জায়গায় এখন পেট্রল পাম্প এবং খাবার জায়গা, রেস্টরুম ইত্যাদিও হয়েছে। আগের বারের মত পেট্রল ক্যারি করবার দরকার খুব একটা পড়ে না। আমিও তাই জেরিক্যানের পেট্রল জেরিক্যানে রেখেই প্রথম একশো কিলোমিটার পেরিয়ে মোটরসাইকেলে পেট্রল ভরে নিলাম। এখন সমস্ত উত্তরপ্রদেশ জুড়ে পেট্রলের দাম দিল্লির থেকে কম।

তেল ভরে এগোতে যাবার মুখেই, আমার পাশ দিয়ে প্রচণ্ড হাইস্পিডে হুশ হুশ করে বেরিয়ে গেল দুটো মোটরসাইকেল – একটা ডমিনার ফোর হান্ড্রেড, আর একটা বুলেট পাঁচশো সিসি। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তারা ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। পেছনে লাগেজ বাঁধা, আমার মতই ট্র্যাভেলার।

আরও প্রায় তিরিশ কিলোমিটার মত যাবার পর দেখতে পেলাম দুজনকে, মোটরসাইকেল রাস্তার ধারে লাগিয়ে সাইডের বেরিয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। দুটো মোটরসাইকেলেরই পশ্চিমবঙ্গের নাম্বার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, আলাপ হল। কথা মূলত একজনই বলছিল, তার দেখলাম খুবই অ্যাডভাইস দেবার শখ। বহরমপুরের ছেলে দুজন, এসেছিল রাজস্থান দেখতে, জয়পুর, জয়শলমীর। এ কথা সে কথার পর আমার গায়ে ডেনিমের জ্যাকেট দেখে বলল, একটা পার্সোনাল অ্যাডভাইস দেব?

বললাম, দাও।

তুমি রাইডার্স জ্যাকেট কেনো। শীত গ্রীষ্ম সব সময়েই কাজে দেয়, সেফটি গীয়ার হিসেবেও পাকাপোক্ত, এই দ্যাখো, আমি এই – এ-ই রাইডিং জ্যাকেট পরে আছি।

খুবই মূল্যবান অ্যাডভাইস। যদিও আলাদা করে রাইডার জ্যাকেট আমার দরকার হয় না – এমনি জ্যাকেটের সাথেই আমার এলবো গার্ড ইত্যাদি আলাদা করে লাগানো থাকে। হুঁ-হাঁ বলে মাথা নাড়ালাম। তারপরে আরও দু চার মিনিট কথা হবার পর আবার তার পার্সোনাল অ্যাডভাইস পেল। মানে, কে কতটা দূরত্ব একদিনে কভার করে সেই নিয়ে কথা হতে হতেই বলল, একটা পার্সোনাল অ্যাডভাইস দেব? রাত্তিরে চালাও। রাতে ট্র্যাফিক কম থাকে, রাতে রোদ্দুরও থাকে না, অনেক কম সময়ে অনেকটা দূরত্ব এক রাতে মেরে দিতে পারবে।

আমি দেখলাম, যাবার সময় হয়েছে। রাতে রাইড করার অন্যান্য অসুবিধেগুলো আমি তাকে বোঝাতে বসলে কথা বেড়ে যাবে, তার চেয়ে এইবারে এগোনোই বেটার। ঝটপট বিদায় নিয়ে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। একটা নাগাদ লখনউ শহরে ঢুকে গেলাম।

এক বছর পেরিয়ে আমার প্রথম লং ড্রাইভের আজ প্রথম দিন। গায়ে যথেষ্টই ব্যথা মালুম দিচ্ছে, যদিও দিল্লি থেকে লখনউ টোটাল সওয়া পাঁচশো কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে মোট তিনবার দাঁড়িয়েছি, একবার পেট্রল ভরতে, একবার চিঁড়েভাজা খাবার জন্য, আর শেষবার পার্সোনাল অ্যাডভাইস শোনার জন্য, কিন্তু সেটা অবশ্যই যথেষ্ট ছিল না। বিশেষত উরুর ভেতর দিক জুড়ে একটা সাঙ্ঘাতিক ধরে-থাকা মত অনুভূতি আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না, মানে, অনেকক্ষণ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যে রকম ঝিঁঝিঁ ধরার মত একটা ভাব হয়, সেই রকম হচ্ছিল। বোধ করি পায়ে মাংস জমেছে, এ তারই ফল, সীটে অতক্ষণ বসে থাকতে সমস্যা হচ্ছে।

আয়োজন সামান্যই ছিল দস্তরখ্বানে। সুকান্তদার সাথেও সেই এক বছর বাদে দেখা – তো অনেক জমে থাকা গল্প করে এক প্লেট মাটন বিরিয়ানি, গলৌটি কাবাব দু প্লেট, আর শেষদিকে শাহী টুকরা শেষ করে উঠতে উঠতে প্রায় পৌনে তিনটে বেজেই গেল। দস্তরখ্বানের মালিক ভদ্রলোক আমাকে দেখে ঠিক চিনতে পেরেছেন, এক বছর আগে এখানেই তো খেয়েছিলাম। তিনি খুব উচ্ছ্বসিত আমি আবার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি বলে, আমার সাথে সেলফি টেলফি তুললেন আর বললেন ফেরার পথেও যেন ওঁর দোকানেই দুপুরের খাবার খেয়ে যাই।

এর পর বাকি থাকে আরেকবার তেল ভরে নেওয়া – আর তো সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। একবার ভরলেই চলে যাবে। সুকান্তদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগোলাম হাইওয়ে ধরে, খানিকক্ষণের মধ্যেই লখনউ শহরের ভিড় কমে এল, আর আমি চলে এলাম বারাবাঁকির কাছে।

বারাবাঁকিতে একটা বড়সড় ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ডানদিকে বেঁকার ব্যাপার আছে, সেইখানে কেমন মনে হল পেছনের চাকায় হাওয়া কম লাগছে। এইখানে দাঁড়িয়ে নিজের পাংচার কিট বের করার কোনও মানে হয় না, খানিক এগোতেই একটা পাংচার সারানোর দোকান পেয়ে গেলাম। লোকটা বেশ সময় নিয়ে চেক করে বলল, না, পাংচার নেই, হাওয়া কমে গেছে, বলে হাওয়া ভরে দিল।

আবার চলা। ফৈজাবাদ আসার মুখে সন্ধ্যে হল। ফৈজাবাদ জেলারই এখন তো নাম হয়ে গেছে অযোধ্যা। প্রসঙ্গত, লখনউ শহর জুড়ে দেখলাম এলাহাবাদ যাবার সমস্ত রাস্তায় সাইনেজ বদলে প্রয়াগরাজ করে দেওয়া হয়েছে। যোগীবিষ্ঠার অমর কীর্তি।

যাই হোক, অযোধ্যা এল, সন্ধ্যে হল, এবং শীতভাবটা আবার ফিরে এল। তখন মনে পড়ল, লখনউতে একটা উইন্ডচিটার বের করার কথা ছিল, সারাদিনে শীত করে নি বলে আর সে-কথা মনেও পড়ে নি। অতএব, এখন এই অবস্থাতেই চালাতে হবে। গন্তব্য আর প্রায় একশো পঁচাত্তর কিলোমিটার।

শীতে মোটরসাইকেল চালালে একটা ব্যাপার হয়, খানিকক্ষণ বাদে শরীর নিজেই একটা হীটিং সিস্টেম জেনারেট করে নেয়, ফলে পরের দিকে আর অতটা ঠাণ্ডা লাগে না। কিন্তু ঠাণ্ডা না লাগলে কী হবে, অযোধ্যা এসেছে, অঘটন না ঘটলে চলে? অতএব, ঘটল। ফুলস্পীডে চলতে চলতে হঠাৎ মনে হল আমার গা থেকে কী যেন একটা খসে রাস্তায় পড়ল, একটা ভোঁতা মতন আওয়াজ বেরোল। তড়িঘড়ি ব্রেক কষলাম, বুকে পিঠে হাত দিয়ে বুঝলাম, পিঠের ব্যাগটা ঠিক আছে, গলায় ঝোলানো ডিএসএলআরের ব্যাগটা, ক্যামেরাসমেত খসে পড়েছে রাস্তায়।

সর্বনাশ করেছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, একটু দূরেই পড়ে আছে ব্যাগটা রাস্তার ওপর, সাইডের বাউন্ডারি ঘেঁষে। এটা একটা বাইপাস, সামান্য এলিভেটেড রোড, ফলে বাউন্ডারি আছে। সাইডে পড়ায় অন্তত কোনও গাড়ির চাকার নিচে পড়ার চান্স নেই। পড়িমড়ি করে মোটরসাইকেল থেকে নেমে দৌড় মারলাম ক্যামেরার দিকে।

নাঃ, ক্যামেরা অক্ষতই আছে বলে মনে হল, অবশ্য ভেতরে কিছু ভেঙে থাকলে জানা নেই। সন্ধে ছটা বাজে, এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় নেই, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, অনেকটা রাস্তা বাকি, সন্ধ্যে হলে এমনিতেই ভিজিবিলিটি কমে যায়, স্পিড কমাতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল ক্যামেরার কোনও ক্ষতি হয় নি, ব্যাগের ভেতরে থাকার জন্য অনেকটা কুশন পেয়েছে। মূলত, ব্যাগের যে স্ট্র্যাপটা, তার প্লাস্টিকের রিংটা একদিকে ভেঙে গেছে, ফলে ক্যামেরা ব্যাগশুদ্ধু আমার গলা থেকে খুলে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।

পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে তাতে ঠেসেঠুসে ঢোকালাম ক্যামেরাটা। মুশকিল হয়ে গেল … প্রথম দিনেই যদি গলায় ক্যামেরা ঝোলানোর প্রভিশনটা নষ্ট হয়ে যায়, তো এতগুলো দিন এইবারে ঘুরব কেমন করে?

আবার স্টার্ট দিলাম মোটরসাইকেলে। একটু একটু করে দূরত্ব কমে আসছে। গোরখপুর এসে গেল, পঁচিশ কিলোমিটার … কুড়ি … আঠেরো … বারো … দশ কিলোমিটার আগে দেখলাম গোরখপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের বোর্ড, আর সেখান থেকে জিপিএস আমাকে বলল ডানদিকের রাস্তায় ডাইভার্সন নিতে, একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিন্তু চওড়া রাস্তা। গোরখপুর বাইপাস। এই রাস্তা আর ঠিক পঞ্চাশ কিলোমিটার চললেই এসে যাবে আমার আজকের গন্তব্য, কুশীনগর।

বাকি রাস্তায় আর বিশেষ কোনও অঘটন ঘটল না, গোরখপুর বাইপাস নির্বিঘ্নে পেরিয়ে কুশীনগরে ঢুকতেই আবার আলো ঝলমলে রাস্তা, হোটেল আর পাঁচ কিলোমিটার। একটু এগোতেই ডানদিকে দেখলাম বিশাল বড় তোরণ – তাতে লেখা আছে ভগবান বুদ্ধ পরিনির্বাণ স্থল, জিপিএস বলল, সামনে আরেকটু এগিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে এসে এই তোরণের নিচ দিয়ে ডানদিকের রাস্তায় ঢোকো।

ইউপি ট্যুরিজমের হোটেল স্পট করতে অসুবিধে হল না। সুবিশাল কম্পাউন্ড। রিসেপশনে একজন বেঁটেখাটো মাঝবয়েসী ভদ্রলোক বসে ছিলেন। নাম বলতেই রেজিস্টার মিলিয়ে নিয়ে বললেন, একশো তিন নম্বর কামরে মে চলা জাইয়ে, ইয়ে লিজিয়ে চাবি।

একশো তিন নম্বরটা কোথায়? আর একজন কাউকে কি পাওয়া যাবে? অনেক লাগেজ আছে, পৌঁছতে হবে।

উনি বোধ হয় প্রথমবার এই রকমের অনুরোধ শুনলেন, কেমন একটা ভ্যাবলার মতন দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ইধার সে চলা জাইয়েগা, আপকা রুম মিল জায়েগা। আউর সামান আপ খুদ হি লে জাইয়ে না, আভি তো রাত হো গয়া না, লোগ কাঁহা মিলেগা?

ঘড়ির দিকে তাকালাম, নটা তিন বাজে, রাত হো গয়া তো বটেই, সরকারি হোটেল আফটার অল। অগত্যা, সেখানেই ব্যাগ আর হেলমেট রেখে বাইরে এলাম, বানজির দড়িদড়া খুলে একটা একটা করে ব্যাগ আনতে হবে। পেট্রলের ক্যানদুটো আনতে হবে। সুবিশাল রিসেপশন এরিয়াতে তখন এক সুবিশাল বিহারী টুরিস্ট গ্রুপ রাতের খাবার সেরে বিশ্রম্ভালাপ করছে, রিসেপশনের লোকটিকেই বললাম, একটু ব্যাগ আর হেলমেট দেখুন, আমি বাকি সামান নিয়ে আসছি।

মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ব্যাগ খুলতে গিয়েই দেখলাম – ক্যারিয়ারের লোহার রড একটা জয়েন্টের কাছে ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেছে। বাঁ দিকে। ডানদিকে একই জায়গায় ক্র্যাক ধরেছে, মানে আজ না হলে কাল ভাঙবেই। যদিও তাতে বড় কোনও সমস্যা নেই, কারণ ক্যারিয়ারদুটো এমনই মজবুত, তারা অন্যান্য জায়গায় সুন্দরভাবে রড ও স্ক্রু দিয়ে ব্যালান্সড ভাবে আটকানো, কিছু হবার চান্স নেই, তবুও, টেনশন তো একটা মাথার মধ্যে ঢুকলই।

যে পরিশ্রম সকালে করতে হয় নি, সেইটা করতে হল সাড়ে আটশো কিলোমিটার উজিয়ে এসে রাত নটার পরে। রিসেপশনের লোকটি গ্যাঁট হয়ে বসে বসে দেখল, তবু একটি সাহায্য করার লোক পাওয়া গেল না। রাহী পথিক নিবাস হোটেলটি এতই বড় – পার্কিং এরিয়া থেকে একশো তিন নম্বর ঘরের দূরত্ব কিছু না হোক, চারশো মিটার, আমাকে এক এক করে ব্যাগ খুলে প্রতিটা ব্যাগ, পেট্রলের ক্যান, টেন্ট, সমস্ত বয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে ঢোকাতে হল। লাগেজ প্রচুর হয়েছে এবারের জার্নিতে। হয় তো সেটাই কারণ ক্যারিয়ারের একটা রড ভেঙে যাবার। গায়ের ব্যথা দ্বিগুণ হয়ে জানান দিচ্ছে।

ঘর থেকে একটা চিমসে বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। বাথরুমও পরিচ্ছন্ন নয়, তবে গীজারটা চলছে। টাওয়েল নেই। আমার তোয়ালে আছে অবশ্য, তবে হোটেলে এসে নিজের তোয়ালে ভেজাবো কেন?

রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম, খেয়েদেয়ে ফিরে এসে একটি পেনকিলার গিলে, তেড়ে চান করলাম। এবং বিছানায় পড়ামাত্র ঘুম …

… এসে যাবার কথা, কিন্তু ঘুম আসছে না। কী একটা যেন অস্বস্তি সমানে বিব্রত করে চলেছে মনকে, ঘুম আসতে চাইছে না। লম্বা জার্নির সবে প্রথম দিন শেষ হল, মনটা কোথায় খুশি-খুশি থাকবে, আগামী দিনের প্ল্যানগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, কিন্তু মন খালি বলছে, কেন এলাম? কী লাভ হচ্ছে এইভাবে ঘুরে, শরীরকে কষ্ট দিয়ে?

এপাশ ওপাশ করতে করতে, এক সময়ে বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কাল শিলিগুড়ি পৌঁছনো আছে, দূরত্ব আজকের তুলনায় কম, সাড়ে ছশো কিলোমিটার মোটামুটি, হয় তো ওখানে গেলে একটু ভালো লাগতে পারে। দেখি …


13 thoughts on “অরুণাচলের দেশেঃ দ্বিতীয় পর্ব

  1. বেশ লাগছে। এ্যাদ্দিন পর লিখেও এরম ডিটেলে সবকিছু, খুবই ভালো মেমরি বলতে হবে। এই পর্বে বেশ কিছু রাই (wry) হিউমার ও ফাউ পাওয়া গেলো। আগে কী হয় দেখি।

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.