আমার তখন ডাক ছেড়ে চেঁচাতে ইচ্ছে করছিল রাগে
ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙামাত্র যেটা প্রথম মাথায় এল, সেটা হল, “যাবো না”। একেবারে ইচ্ছে করছে না তৈরি হতে, অসীম একটা শারীরিক আর মানসিক ফ্যাটিগ চেপে বসেছে। কাল রাতে একটা পেনকিলার খেয়েছিলাম, কিন্তু গায়ের ব্যথার বিশেষ উপশম তাতে হয় নি, সেটা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেমন যেন মনে হচ্ছে এবারে আমার মন আমার শরীরের সাথে নেই, কিংবা উল্টোটা। আমি কি মনের কথা না শুনে ভুল করছি? সঙ্গে তো কেউ নেই, যাওয়া ক্যানসেল করে আবার ধীরেসুস্থে দিল্লি ফিরে গেলেই বা কী ক্ষতি? কেমন একটা কারণহীনতা বিশালভাবে চেপে বসছে মাথার মধ্যে, কিছুতেই এই সুবিশাল ট্রিপে যাবার পক্ষে কোনও সহজবোধ্য কারণ দিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছি না।
দশ মিনিট এপাশ ওপাশ করার পরে দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথায় এল, কাল ক্যামেরা পড়ে গেছিল, তার পরে আর খুলে দেখা হয় নি কী ক্ষতি হয়েছে ক্যামেরার।
ভাবামাত্র তড়াক করে উঠে বসলাম, আর ঝটপট বিছানার পাশ থেকে টেনে নিলাম ক্যামেরার ব্যাগটা। এটাকে গলায় ঝুলিয়ে আর নেওয়া যাবে না। ব্যাগের দুদিকেরই আংটা ভেঙে গেছে। চেন খুলে ক্যামেরাটাকে বের করলাম। না, আস্ত আছে। লেন্স ক্যাপ খুলতে গিয়ে দেখি, সে আর খুলছে না। কী রকম অদ্ভুতভাবে অর্ধেক ভেতরে অর্ধেক বাইরে হয়ে লেন্সের ডগায় বেকায়দায় আটকে গেছে।
খেয়েছে। লেন্স ক্যাপ না খুললে ছবি তুলব কী করে? … এক মিনিট বাদে মনে পড়ল, লেন্সের মুখে তো ইউভি ফিল্টার লাগানো, ক্যাপটা আটকে গেছের সেই ফিল্টারের ওপরে। ফিল্টারটা তো লেন্সের মুখে প্যাঁচ দিয়ে আটকানো, প্যাঁচ খুললাম, ক্যাপসমেত ফিল্টার খুলে এল, না, ভেতরে লেন্স একদম ইনট্যাক্ট আছে। একটা ছবি তুললাম, ছবি ঠিকঠাক উঠল। ক্যামেরা ঠিক আছে।
তা হলে এই দাঁড়াল, ছবি তুলতে গেলে প্যাঁচ ঘুরিয়ে ফিল্টার খুলে ছবি তুলতে হবে, তোলা হলে আবার প্যাঁচ লাগিয়ে বন্ধ করতে হবে। … সে না হয় হল, কিন্তু ক্যামেরা পিঠের ব্যাগে থাকলে চলতে চলতে ছবি তুলব কী করে?
আরও খানিকক্ষণ মাথা ঘামিয়ে ভেবে দেখলাম, ব্যাগের ঠিক মাঝামাঝি একটা হাতল আছে, শক্তপোক্ত কাপড়ের, ছিঁড়ে যাবার কোনও সমস্যা নেই। ওর মধ্যে দিয়ে স্ট্র্যাপটা গলিয়ে দিয়ে দুপ্রান্ত বেশ ভালো করে গিঁট দিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এইবারে ঠিক হয়েছে, এইবারে গলায় ঝুলবে। ছিটকে পড়ে যাবার ভয় নেই।
ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। সকালবেলায় একজনকে পেয়ে গেলাম, যে সানন্দে আমার ব্যাগপত্র পার্কিং অবধি পৌঁছে দিল। পার্কিংটা ঘর থেকে সত্যিই অনেকটা দূরে। জেরিক্যানের পেট্রল মোটরসাইকেলেই ভরে নিলাম, অন্তত গৌহাটি অবধি তো পেট্রল পাম্পের কমতি হবে না, রোজ জেরিক্যান আলাদা লাগেজ হিসেবে বইবার দরকার কি। থাক খালি জেরিক্যান মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ারে আটকে।
সাড়ে সাতটায় স্টার্ট করলাম, মোটামুটি পৌনে নটা নাগাদ উত্তরপ্রদেশ পেরিয়ে বিহার ঢুকলাম।
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ বা দিল্লি হরিয়ানার সাথে পূর্ব ভারতের একটা বেসিক তফাৎ আছে। সেটা হল – সকালবেলায় বাজার বসা। এটা উত্তর ভারতে, পশ্চিম ভারতে একেবারে দেখা যায় না – এই সংস্কৃতিটা শুরু হয় বিহার থেকে। রাস্তার ধারে সবজি আনাজ মাছ মাংস ফলমূল নিয়ে ঢেলে বাজার চলছে।
আজকের দূরত্ব, গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ৫৮৭ কিলোমিটার, খুব তাড়াতাড়িই হয়ে যাবার কথা, কিন্তু রাস্তায় যত সাইনেজ দেখছি, সর্বত্র শিলিগুড়ির দূরত্ব অন্তত নব্বই কিলোমিটার বাড়িয়ে লিখছে। এতটা তফাত কেন?
ভাবতে ভাবতেই ক্রমশ এক এক করে পেরিয়ে এলাম গোপালগঞ্জ, মুজফ্ফরপুর। সেখান থেকে অল্প বাঁদিকে ঘুরে দারভাঙা জেলা। একটা ধাবায় ঢুকে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ইয়াব্বড় মাছের পিস, আলুভাজা আর ফুলকপির তরকারি দিয়ে পেটপুরে খেলাম মাত্র আশি টাকা দিয়ে। আহা, সে পুরো অমৃত।
খেয়ে উঠে বিশাল একটা আড়মোড়া ভেঙে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতে হল। এখনও সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। গুগল ম্যাপের নেভিগেশনের হিসেবে। রাস্তার সাইনেজ বলছে চারশো পঁচাশি। কী কেস, কে জানে!
ফোর্বসগঞ্জ, বিহারী উচ্চারণে ফরবিসগঞ্জ পেরোলাম। তারপরে এল আরারিয়া। সেইখান থেকে জিপিএস আমাকে বলল বাঁদিকের রাস্তা নিতে। নিলাম – আর সেই হল আমার দুঃখের শুরু। মোড়ের মাথায় একটা পুরোপুরি আবছা হয়ে যাওয়া দিকনির্দেশিকা সাইনেজ ছিল, কিন্তু সেটা পড়ার কোনও উপায় ছিল না। আমি বাঁদিকে টার্ন নিলাম। শিলিগুড়ি তখন মোটামুটি একশো পঁচাত্তর কিলোমিটার।
দু চার কিলোমিটার বেশ সুন্দর রাস্তা। তারপরে হঠাৎ করে রাস্তাটা নেই হয়ে শুরু হল পাথর বিছানো পথ। মানে, রাস্তা তৈরি হবে, তার আগের কোনও একটা স্টেপ হিসেবে পাথর বিছিয়ে জমি বানিয়ে রেখেছে। হতেই পারে সামান্য একটু স্ট্রেচ খারাপ আছে, একটু এগোলেই ভালো রাস্তা পাবো।
কিন্তু ভেবে ভেবে অনেকদূর চলে এলাম, খারাপ রাস্তার কোনও শেষ নেই। এদিকে আমার স্পিড নেমে এসেছে তিরিশের ঘরে, বিকেল হয়ে এসেছে, আলো কমে আসছে দ্রুত, আমি বুঝতে পারছি, আমি বিহারের একেবারে গ্রামদেশে ঢুকে পড়েছি। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। একবার মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে জিপিএস স্ক্রোল করে দেখলাম, রাস্তা এটাই, একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার কোনও একটা স্টেট হাইওয়ে।
চলতে থাকলাম। অন্ধকার হল। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হল। রাস্তার দুধারে গাছপালা, মাঝে মাঝে লোকালয়, সন্ধের বাজার, কোথাও রাস্তার অর্ধেক জুড়ে উঁচু ইঁটের প্ল্যাটফর্ম করা, সেইখানে বাজার বসেছে, অটো চলছে, সাইকেল পারাপার করছে, তার মধ্যে দিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছে। খানিক বাদে আবার নিকষ অন্ধকার, কখনও ট্রাকের পেছনে, কখনও ডাম্পারের পেছনে, ওভারটেক করার মতও চওড়া রাস্তা নেই। হাইবীমেও আলো দেওয়া যাচ্ছে না, উল্টোদিক থেকে মাঝে মাঝেই গাড়ি আসছে, অবশ্য, দেশটার নাম ভারত, এখানে রাস্তায় নামা লোকের ৯০% হাই বীম আর ডিপারের নিয়ম জানে না, তার ওপর এ হল বিহারের গ্রাম, এখানে ওসব এক্সপেক্ট করাই উচিত নয়, অতএব, আমাকেও হাইবীমে হেডলাইট জ্বালিয়েই এগোতে হল। এক একবার গাড়ি আসছে উল্টোদিক থেকে, আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, গাড়ি থামিয়ে নিতে হচ্ছে কারণ সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দূরত্ব এদিকে কমছে খুব ধীরে ধীরে, কারণ আমি নিজেই ধীরে ধীরে চলছি, রাস্তা বলে কিছু নেই, মাঝে মাঝে টার দেওয়া, বাকিটা পুরো পাথর, নয় তো ইঁট, নয় তো কাদামাটি।
এমনিই একটা স্ট্রেচে চলছি একটা ট্রাকের পেছন পেছন আর ভাবছি কখন ব্যাটাকে ওভারটেক করতে পারব, আচমকা আমার একটু পেছন দিকেই একটা মর্মভেদী আর্তনাদ কানে এল। তড়িঘড়ি পেছনদিকে তাকিয়ে দেখি সে মানে বিচ্ছিরি দৃশ্য। নিকষ অন্ধকারে এক আধমাতাল বুড়ো সাইকেল চালিয়ে আসছিল, তার চাকার নিচে চাপা পড়েছে একটা কুচকুচে কালো কুকুর। বুড়ো হয় তো এমনিতেই সন্ধেবেলায় চোখে ভালো দ্যাখে না, সে সাইকেল থামিয়ে “কা হো গইল বা” বলছে জড়ানো গলায়, এদিকে সাইকেলটা এমন সময়েই থামিয়েছে, তার সামনের চাকা কুকুরটার পেটের ওপর, কুকুরটার পেট ফেটে গেছে সাইকেলসমেত বুড়োর চাপে, বুড়ো কুকুরকে দেখতে পাচ্ছে না অন্ধকারে, এদিকে তারই পায়ের তলায় মৃত্যুযন্ত্রণায় কুকুরটা ছটফট করছে আর আর্তনাদ করছে।
ট্রাকটা একটু সাইড হতেই আমি মোটরসাইকেল গলিয়ে দিলাম ডানদিক দিয়ে, সামনে অনেকটা ফাঁকা রাস্তা, কিন্তু স্পিড তোলার উপায় নেই, যতটা সম্ভব দ্রুত আমি এলাকাটা ছাড়িয়ে এলাম।
সন্ধে ছটা নাগাদ আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম কাদাপাথরের স্তুপের মাঝে, কোথাও একটা ব্রিজ বানানো হচ্ছে, তার নিচ দিয়ে এদিক ওদিক রাস্তা গেছে। জিপিএস যেদিকে যেতে বলছে, সেদিকে আদৌ কোনও রাস্তা আছে কিনা বুঝতে পারছি না। কালন্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি তখন, শুধু আমাকে সচল রেখে জিপিএস জানাচ্ছে, শিলিগুড়ি আর মেরেকেটে পঞ্চাশ কিলোমিটার।
সেইখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। তার কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইসলামপুর-শিলিগুড়ি যাবার জন্য কোনদিকে? সে তিনটের মধ্যে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিল। তিনটেই সামনের দিকে এঁকেবেঁকে এগিয়ে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে।
উদ্দিষ্ট রাস্তা ধরে এগোলাম, দেখলাম জিপিএসও এই রাস্তার কথাই বলছে। বেশ খানিকটা এগোবার পরে রাস্তাটা একটু চওড়া হল। জিপিএস বলল, তিন কিলোমিটার পরেই বাঁদিক।
বাঁদিক নিয়ে ভালো রাস্তা পেলাম, এবং দেখলাম রাস্তার সাইডে ব্যারিকেডে লেখা আছে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ। মানে, আমি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছি? … অবশ্য অতটাও উল্লসিত হবার কিছু নেই, এই এলাকায় হাইওয়ে একটু বাংলা, একটু বিহার, আবার একটু বাংলা, আবার একটু বিহার, এইভাবে চলে। এগোতে থাকলাম।
খানিক এগিয়ে দোকানপাট পেলাম এবং স্পষ্ট দেখলাম, সেখানে লেখা আছে, জেলা দার্জিলিং। মানে, ঐ অখাদ্য বিহারী স্টেট হাইওয়ে দিয়ে আমি সত্যিই শর্টকাট মেরে একদম শিলিগুড়িতে ঢুকতে পেরেছি? পূর্ণিয়া, কিষেণগঞ্জ, ইসলামপুর সমস্ত বাইপাস করে সোজা শিলিগুড়ি ঢুকে গেছি! জয়গুরু! আমার হোটেল আর পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে, জিপিএস বলছে, সাড়ে সাতটায় আমি ঢুকে যাবো হোটেলে।
মানে আর একঘণ্টা! পঁচিশ কিলোমিটার তো আমি তার আগেই পৌঁছে যেতে পারি। যাই হোক, এগোলাম, দু একটা লোকালিটি পেরিয়ে আবার নিকষ কালো একটা মসৃণ হাইওয়ে, সরু। ঐ আমাদের ওখানে, হুগলি চুঁচড়ো চন্দননগরের জিটি রোড যেমন সুন্দর বানিয়ে দিয়েছে, দুধারে রিফ্লেক্টর বসানো, সেই রকম রাস্তা। একটা মাইলস্টোন চোখে পড়ল, বাগডোগরা এয়ারপোর্ট, বাইশ কিলোমিটার।
আচ্ছা! এটাই তা হলে বাগডোগরার রাস্তা। আগের বছর এই রাস্তাটা ভাঙাচোরা ছিল, আগের বছরেও শিলিগুড়ি আসার সময়ে এই রাস্তাটা আমি অন্ধকারে পেরিয়েছিলাম।
রাস্তার অবস্থা এখন ভালোই, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ স্পীড ব্রেকার লাগানো, আর সেগুলো কোনও মার্কিংও করা নেই আলাদা রঙে। দু একবার জোর ঝাঁকুনি খাবার পরে আমাকে আবারও স্পীড কমাতে হল। আর তখনই নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে একটা ট্রাক এল উল্টোদিক থেকে, আর আমি এক ঝলক আলোতে দেখতে পেলাম, আমার দু পাশে চা-বাগান। আমি বুঝতেই পারি নি এতক্ষণ আমি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।
বোধ হয় মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, আচমকা সম্বিত ফিরল একটা স্পীড ব্রেকারে ঝাঁকুনি খেয়ে, স্পীড কমালাম সাথে সাথে, কিন্তু মনে হল একটা কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ পেলাম পেছন দিক থেকে, আর আমার মোটরসাইকেলের সাথে সাথে ঘষটে চলেছে কিছু। তড়িঘড়ি মোটরসাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই চক্ষুস্থির।
বাঁদিকের বানজি কর্ড আলগা হয়ে খুলে গেছে, একটি মাত্র পাকের ভরসায় বাঁদিকের স্যাডল ব্যাগ এবং তার সাথে বাঁধা টেন্ট, বাঁদিকের ক্যারিয়ার থেকে খুলে, মাটিতে ঘষটাচ্ছে।
আমার সেই মুহূর্তে ডাক ছেড়ে চেঁচাতে ইচ্ছে করছিল রাগে। দেড়শো কিলোমিটার পাথর ইঁটের ওপর চালিয়ে তখন আমার সর্বাঙ্গে দ্বিগুণ ব্যথা, ঘাড় থেকে শুরু করে পায়ের পাতা অবধি, এই অবস্থায় এখন এই লাগেজ তুলে আমাকে বাঁধতে হবে?
কিন্তু, কাজ যদি সেটুকুই থাকত, তা হলে তো কথাই ছিল না, লাগেজগুলো খসে পড়েছে এমনভাবে, বাঁদিকের সাইডস্ট্যান্ড গেছে ব্লক হয়ে, মানে স্ট্যান্ড না নামালে আমি নামতেই পারব না মোটরসাইকেল থেকে, আর স্ট্যান্ড গেছে লাগেজের নিচে ফেঁসে। আমার পায়ে অত জোর এখন আর নেই যে পায়ে করে লাগেজ সরিয়ে তার নিচ থেকে স্ট্যান্ড উদ্ধার করব।
রাস্তায় একটাও লোক নেই। মাত্র সাতটা দশ বাজে। অগত্যা। অসাধ্যই সাধন করতে হল। প্রায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া পা দিয়ে একতিল একতিল করে স্যাডল ব্যাগ সরিয়ে সাইডস্ট্যান্ড খালি করলাম, তারপরে সেটাকে পা দিয়ে নামালাম, তারপর নিজে নামতে পারলাম।
কালো রঙের স্যাডল ব্যাগ। কালো রঙের ক্যারিয়ার। চতুর্দিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, আমার দু হাত দূরে মাঠ আছে না চা বাগান, তা-ও বুঝতে পারছি না। শেষমেশ মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে খানিক আলো হল। এক হাতে মোবাইল ধরে অন্য হাতে বানজি কর্ডের জট ছাড়ালাম, লাগেজ মুক্ত করলাম। তারপরে আবার তাকে ক্যারিয়ারের ওপর বসিয়ে, তার ওপর টেন্ট বসিয়ে আবার বানজি দিয়ে কষে ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন। এতটাই অসম্ভব লাগছিল, পুরো কাজটা সারতে আধঘণ্টার ওপর লেগে গেল।
শেষ করে দুতিন মিনিট দম নিলাম মোটরসাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে। কোমর, পা, পাছু একেবারে ব্যথায় জমে আছে। একমাত্র ভরসা, জিপিএস। সে বলছে, হোটেল আর মাত্র তেরো কিলোমিটার।
স্টার্ট দিলাম। আর কোনও অঘটন ঘটল না, খানিক বাদেই বাগডোগরা এয়ারপোর্টের প্রবেশপথ, তার খানিক পরেই শিলিগুড়ি শহরের শুরু। হোটেলটাও লোকেট করতে এবার একেবারে অসুবিধে হল না, হিলকার্ট রোডের প্রায় ওপরেই হোটেল ভেঙ্কটেশ রিজেন্সি। দু তিনটে নেপালি যুবক চালায় মনে হল হোটেলটা। শিলিগুড়িতে পৌঁছেও বাংলায় কথা বলার তাই সুযোগ হল না।
ছেলেগুলো খুবই হেল্পফুল। ঝটপট আমার সাথে হত লাগিয়ে লাগেজ খুলে ঘর অবধি পৌঁছে দিল। হোটেলটায় এক একটা ঘরের নাম ভারতের এক একটা রাজ্যের নামে। … এইটা আমার ঘরের নাম।
শারীরিক আর মানসিক ক্লান্তির মধ্যে বসে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি আজ সত্যিই জার্নি শেষ করতে পেরেছি, মাথার মধ্যে তখনও খালি ধাক্কা মারছে ঐ মরতে চলা কুকুরের আর্তনাদ, আর উল্টোদিক থেকে আসা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া গাড়ির হেডলাইট। কাল সকালে আবারও বেরোতে হবে? প্লিজ, না। পারছি না। এতটুকু এনজয় করতে পারছি না।
রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম। ছেলেটি এসে বলল, স্যর, বীয়ার ওয়াইন কিছু লাগলে বলবেন।
না ভাই, ও সব আমার নন-ডিপ। তুমি শুধু রাতের খাবারটুকুই দাও।
খেলাম, খেয়ে নিয়ে আবারও একটা পেনকিলার, কোনও লাভ হবে না জেনেও, খেলাম। এবং চমৎকার উচ্চমানের বাথরুমে ঢুকে চান করে, ফ্রেশ হয়ে, ঘুম। এসিটা বাড়িয়ে দিয়ে, চাদর মুড়ি দিয়ে।
দুটো দিন গেল।
4 thoughts on “অরুণাচলের দেশেঃ তৃতীয় পর্ব”