আমি বাংলায় বললে হয় তো বেটার বুঝত, কিন্তু আসামের এই মুহূর্তে যা হালচাল, বাংলা বলা কতটা সঙ্গত বুঝতে পারছিলাম না
ঘুম হচ্ছে না আজকাল ঠিকঠাক। অ্যালার্ম বাজার আগেই তাই জেগে গেছি। উঠে শরীর নাড়িয়ে দেখলাম, না, ব্যথা একেবারে কমেনি ঠিকই, তবে এই তৃতীয় দিনে ইউজড টু হয়ে গেছি। খুব একটা অসুবিধে আর হচ্ছে না। মন যদিও সঙ্গ দিচ্ছে না এখনও পুরোপুরি, তবুও জোর করে নিজেকে বোঝালাম, গত দুদিন ছিল চূড়ান্ত বোরিং রাস্তা ধরে আসা। উত্তর প্রদেশ, বিহার, মাঝে আবার দেড়শো কিলোমিটার বিচ্ছিরি রাস্তা দিয়ে আসা। আজকের রাস্তা তো অমন নয়। সুন্দর রাস্তা, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, তদুপরি দিনের শেষে আজ আছে দেশি মুরগির ঝোল। এইবারে তো মনটকে একটু চাঙ্গা করো – তুমি অনর্থক দুঃখবিলাসী হয়ে যাচ্ছো, সিকি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আজকের গন্তব্য গৌহাটি, এবং সেথায় আজ কোনও হোটেলবাস নয়, গুরুচণ্ডা৯-র অন্যতম গুরু b-এর নেমন্তন্নে আজ তাঁর বাড়িতেই ভোজন এবং বিশ্রামের পরিকল্পনা হয়েছে। সেখানে আরও কিছু চণ্ডালের আগমন সংবাদ পেয়েছি। গুলজার হবার একটা তুমুল চান্স আছে, সেটা হয় তো আমার পরের যাত্রার জন্য একটা বুস্ট আপ ডোজের কাজ করতে পারে।
সাড়ে সাতটা নাগাদ ধীরেসুস্থে তৈরি হলাম। জিনিসপত্র নিচে নামিয়ে মোটরসাইকেলে ভালো করে লোড করা হল। গতকাল একটু বেশি কনফিডেন্সের বশে আমি দুদিকেই একটা করে বানজি কর্ড দিয়ে লাগেজ বেঁধেছিলাম, তার ফলে সন্ধেবেলায় ঐভাবে কর্ড লুজ হয়ে জিনিস উলটে পড়েছিল রাস্তার ওপর। আজ তাই আর কোনও রিস্ক নয় – প্রত্যেক দিকে দুখানা করে লম্বা লম্বা বানজি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিলাম লাগেজ। ভালো করে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেখে নিলাম, না, আজ আর কোনওভাবেই এই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন খোলার চান্স নেই।
খিদে পেয়েছে। কাল রাতের চিকেন সেজওয়ান নুডল কাল রাতেই হজম হয়ে গেছে, পেটে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়ে গেছে। এদিকে সামনেই একটা ছোট্ট দোকান, সেখানে দেখতে পাচ্ছি গরম গরম পরোটা ভাজছে। অতএব, লাগেজসমেত মোটরসাইকেল রাস্তার পাশেই দাঁড় করিয়ে রেখে গুটিগুটি ঢুকলাম দোকানে। গোটাচারেক বড় বড় পরোটা নিঃশব্দে শেষ করে যখন জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালাম, তখন বাজে প্রায় সওয়া আটটা। চাপের কিছু নেই – আজকের দূরত্ব আরেকটু কম। সাড়ে চারশো কিলোমিটার। এখান থেকে আইআইটি গৌহাটি। রাস্তা যাবে আলিপুর দুয়ারের ওপর দিয়ে, সেইটা আরেকটা উৎসাহের কারণ, আলিপুর দুয়ার আমার জন্মস্থান। তখন আলিপুর দুয়ার ছিল জলপাইগুড়ি জেলার একটা মহকুমা, আজ সে নিজেই একটা জেলা। জন্মের কয়েক মাস পরেই বাবা ওখান থেকে বদলি হয়ে চলে আসে, আটাত্তরের বন্যার মরশুমে, আমার কোনও স্মৃতিই নেই।
আজকের জার্নি অনেকখানি সুন্দর রাস্তা দিয়ে। প্রথমে সেভক ব্রিজ, সেটা পেরিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, বাঁ পাশে নীলচে পাহাড়ের শিল্যুয়েট। হিলকার্ট রোড পেরিয়ে শিলিগুড়ি শহরের প্রান্ত থেকে সেভক ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটাই এত সুন্দর – ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে যায়, ঝকঝকে নিটোল রাস্তা।
সুন্দর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে খানিকক্ষণের মধ্যে দিয়েই শুরু হল অল্প পাহাড়ী রাস্তা এবং তার পরেই এসে হাজির হল সেভক ব্রিজ। সোজা রাস্তা চলে গেছে গ্যাংটকের দিকে, আর ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা আমার গন্তব্য। সে রাস্তা দিয়ে আমি গতবছরেই গেছি, কিছুই বদলায় নি। ব্রিজে খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম, একটা মোটরসাইকেল গ্রুপ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বাঙালিই সব, কলকাতা থেকে এসেছে, তেড়ে সেলফি এবং গ্রুপফি তুলছে – আলাপ হল, ও, তুমি একা, কতদিনে এসেছো, কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে, ইত্যাদি দিল খুশ করে দেওয়া প্রশ্নের জবাব দেবার শেষে তাঁরা আমার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন, অতএব, সেলফি স্টিক নাকের ডগায় ঝুলিয়ে আমাকেও দাঁত বার করতে হল। তারপরে টা টা করে আমি আমার রাস্তা ধরলাম। একে একে পেরিয়ে গেল ওদলাবাড়ি টি এস্টেট, ডামডিম, মালবাজার, চালসা, চাপড়ামারি, নাগরাকাটা – বড় নস্টালজিক অনুভূতি হয় এই রাস্তায় এলে, একসময়ে অনেক ঘুরেছি, তখন রাস্তা এত ভালো ছিল না, ছোট ছোট গঞ্জ সব আজ চমৎকার টাউন হয়ে গেছে। এর পর বানারহাট, বিনাগুড়ি পেরিয়ে বীরপাড়া থেকে শুরু হয়ে গেল আলিপুর দুয়ার জেলা।
বীরপাড়ার খানিক পরেই পড়ে মাদারিহাট, জলদাপাড়া স্যাংচুয়ারির বাইরে দিয়ে রাস্তা, মাঝে মাঝে স্পীড ব্রেকার দেওয়া, এখান দিয়ে নাকি হাতি চলাচল করে। মাদারিহাটের পরেই হাসিমারা, এইখান থেকে জয়গাঁও ফুন্টশোলিংএর জন্য বাঁদিকে রাস্তা চলে যায়, আমি নিলাম ডানদিকের রাস্তা, যেটা দোমহানি হয়ে চলে যাচ্ছে আলিপুর দুয়ারের দিকে।
কিন্তু না, আলিপুর দুয়ার শহরের ভেতর ঢোকার উপায় হল না, হাইওয়ে চলে গেছে শহরের বাইরে দিয়ে, তাই একটা তিন মাথা জংশন, যেখানে ডানদিকে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা আছে আলিপুর দুয়ার শহর, সেটাকে পেরিয়ে আমাকে সোজা বেরিয়ে যেতে হল আসাম ছোঁবার জন্য।
বেলা একটা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসামে ঢুকলাম। এবং রাস্তার হাল খারাপ হল। এই হাইওয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্ট্রেচটুকু চমৎকারভাবে মেনটেনড, কিন্তু আসামে তার বড়ই হতশ্রী দশা। বর্ডার লাগোয়া প্রথম এলাকাটির নাম শ্রীরামপুর। সেখানে একটি নিরিবিলি ধাবা পেয়ে মোটরসাইকেল থামালাম। উপস্থিত লোকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি অগ্রাহ্য করেই ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরের খাবার কী পাওয়া যাবে। ছেলেটি অনেক কিছুরই নাম বলল, কিন্তু তাতে নন ভেজ কিছু না থাকায় জিজ্ঞেস করলাম, মাছ মাংস কিছু পাওয়া যাবে না? – ছেলেটি ঘাড় নাড়ল, না, এটা ভেজু ধাবা।
বেরিয়ে আসতে হল। চলতে চলতে লক্ষ্য রাখলাম, আর ধাবা পাওয়া যায় কিনা। ধাবা আছে অজস্র, ইন ফ্যাক্ট, আসামের এই অংশটা যেহেতু বর্ডার এলাকা, অসংখ্য, অসংখ্য ছোট ছোট ফুড জয়েন্ট মূলত উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর নামে। হরিয়ানা ধাবা, পঞ্জাব ধাবা, অথেন্টিক রাজস্থানী রসুই, ইউপি ধাবা – সবেতেই খুব যত্ন করে লেখা, শুদ্ধ শাকাহারী।
ধুত্তেরি। পশ্চিমবঙ্গেই খেয়ে আসা উচিত ছিল। ভাবতে ভাবতেই দেখলাম একটা ধাবা টাইপের জয়েন্ট, সেখানে অহমিয়া ভাষায় লেখা ভেজ ও ননভেজ। মানে এটুকু লেখা অহমিয়া আর বাংলা দুটো ভাষাতেই এক রকমের। অহমিয়া লিপিতে মূল সমস্যা হয় চ, ছ এই দুটো অক্ষর নিয়ে। কখন যে এরা চ, ছ ইউজ করে আর কখন যে স, শ – সে আমার বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছিল, পুরোটা এখনও বুঝি নি। এই ধরুন কসমেটিক্সের দোকানে লেখা আছে কচমেটিক্চ, শপ্-কে লেখা হচ্ছে চপ, সিমেন্টকে চিমেন্ট, এদিকে দেবশ্রীর নাম অসমীয়াতেও দেবশ্রী। স্পন্দন, অহমিয়াতেও স্পন্দন। অহমিয়া বানানের গল্প পরে হয় তো আরও বলব, আপাতত জানাই, সরু সরু রাস্তাঘাটের শুরুতে ছোট বোর্ডে লেখা আছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম “চড়ক” যোজনা। মানে সড়ক যোজনা।
তো, সে যাই হোক, ভেজ ও ননভেজ দেখে তো থামলাম। সেখানে সত্যিই মাছমাংস পাওয়া যায়। যদিও রাতে দেশি মুরগি আছে, তাও, চারটে পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, অনেকটা যেতেও হবে – এইসব ভেবেচিন্তে আবারও চিকেনই অর্ডার করে দিলাম।
ছেলেটি একটি বিসলেরির বোতল বের করে দিল ফ্রিজ থেকে। আমি, সাধারণত বোতল জল খাই না রাস্তায় বেরিয়ে, যেখানকার যা জল, সেটাই খাই। ছেলেটাকে তাই বললাম, ইয়ে নেহি চাহিয়ে, নর্মাল পানি দে দো।
ছেলেটি কী বুঝল কে জানে, বোতলটা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আরেকটা বিসলেরির বোতল নিয়ে এসে মটাস করে ক্যাপের সীলটা খুলে ফেলল – আমি আবার হাঁ হাঁ করে থামালাম, কী মুশকিল, বললাম না, নেহি চাহিয়ে? আমি কিন্তু এর পয়সা দেবো না। নর্মাল জল দাও, নর্মাল।
ছেলেটি চুপচাপ সেই বোতল ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল, এবং ফিরে এল আবার একটি নতুন বিসলেরির বোতল নিয়ে, সীলড, বলল, এইটা নর্মাল।
আমি তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছি – এ কী জনতা রে ভাই! খুব মাথা ঠাণ্ডা করে, আস্তে আস্তে, কেটে কেটে বললাম, বটল পানি নেহি চাহিয়ে – সামনের একটা টেবিলে জলের জাগ রাখা ছিল, সেইটা দেখিয়ে বললাম, ও পানি দে দো, নর্মাল পানি। বটল কা নেহি।
খুবই চাপ। আমি বাংলায় বললে হয় তো বেটার বুঝত, কিন্তু আসামের এই মুহূর্তে যা হালচাল, বাংলা বলা কতটা সঙ্গত বুঝতে পারছিলাম না, তাই হিন্দিতেই স্টিক করে রইলাম। যাই হোক, চারবারের বার জলের জাগ এল। তার পর এল খাবার। খাবার ঠিকঠাকই ছিল, আলুভাজা, সম্ভবত স্কোয়াশের তরকারি – সেটা টাচ করতে পারলাম না। মাংসের ঝোলটা ঝালঝাল, উমদা একদম, কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে খেতে কী যে ভালো লাগছিল।
খেয়ে উঠতে উঠতে আড়াইটে বাজল। b-কে এবং বাবাকে ফোন করে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। এক এক করে বিভিন্ন নাম না জানা জায়গা পেরিয়ে গেল – চেনা জায়গা বলতে দেখতে পাচ্ছি, লেখা আছে বঙ্গাইগাঁও অয়েল রিফাইনারি, যার দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে।
বঙ্গাইগাঁও এল বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ। রাস্তা ভালো খারাপ মিশিয়ে, তার চেয়েও বড় উপদ্রব হল উল্টোদিক থেকে চলে আসা গাড়ি, যে যেমন পারছে চলছে। b-এর সাথে বার দুয়েক কথা হয়ে গেছে এর মধ্যে, জানিয়ে দিয়েছে আইআইটির কাছে কোন মার্কেটে পৌঁছে আমাকে ফোন করতে হবে। জিপিএসের টাইমলাইন অনুযায়ী আমার সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পৌনে সাতটা নাগাদই পৌঁছে যাবার কথা।
রঙ্গিয়া পেরোলাম, খানিক বাদে এল b-বর্ণিত একটা জংশন পয়েন্ট বাইহাটা। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে, ন্যাশনাল হাইওয়ে হওয়া সত্ত্বেও রাস্তাটা একেবারেই ওয়েল মেনটেনড নয়, জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ, আর রাস্তায় আলো না থাকায় প্রায়ই সেইসব খন্দে মোটরসাইকেল পড়ে লাফিয়ে উঠছে, আমি ক্রমশ চিন্তা করে যাচ্ছি ক্যারিয়ারের ক্র্যাক না বেড়ে যায়, লাগেজ খুলে পড়বে না, সে আমি বার তিনেক মোটরসাইকেল থামিয়ে চেক করে দেখে নিয়েছি। কিন্তু ক্যারিয়ারের দুদিকেই ক্র্যাক ধরেছে। ডানদিকে তো রড দু টুকরোই হয়ে গেছে। স্ট্রাকচারের জন্য ভেঙে বেরিয়ে যাবার চান্স নেই। কিন্তু, তবুও …
বাইহাটা চৈরালি (চারমাথার মোড় বোধ হয়) থেকে ডানদিক নিলাম। আইআইটি ক্যাম্পাস এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গৌহাটি শহর ক্রমশ এগিয়ে আসছে, বাড়িঘরের সংখ্যা বাড়তে দেখেই আন্দাজ করছি।
ফাইনালি, একটা মোড় থেকে আমাকে জিপিএস বলল বাঁদিকে বেঁকতে। বাঁদিকে একটা বাজার বসেছে, কিন্তু প্রচুর চেষ্টা করেও আমি বাজারের নাম কোনও সাইনবোর্ডে দেখতে পেলাম না। এটাই কি b-বর্ণিত সেই মার্কেট? কে জানে! ক্রমশ সেই বাজারও পেরিয়ে এলাম, ডানদিকে টার্ন, তারপর খানিক গিয়ে আবার ডানদিক – একেবারে জনমানবশূন্য। আইআইটি জাতীয় কোনও কিছুরই চিহ্ন নেই আশেপাশে। এদিকে জিপিএস দেখাচ্ছে একশো মিটার দূরেই আইআইটি, সেখানে অ্যাকচুয়েলি, দেখতে পাচ্ছি, জঙ্গল।
খানিক এগোলাম, সামনে একটা দোকান। হিন্দি বলব, না বাংলা বলব, ঠিক করতে না পেরে শেষমেশ হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করলাম, আইআইটিতে ঢোকার রাস্তা কোন দিকে। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিও খুব ভাঙাচোরা হিন্দিতে জানালেন, আইআইটির গেট তো অন্যদিকে, আমি হয় তো পেরিয়ে এসেছি, এটা তো আইআইটির পেছন দিক, আমি যদি পারি তো ও-ই সামনে যে বাঁক আছে, ঐখান দিয়ে যেন আবার ডানদিকে বেঁকে যাই, তা হলেই আইআইটির পেছনের গেট পাব।
এগোলাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বাঁকের মুখে একটা আবছা হয়ে আসা সাইনবোর্ডে লেখা আছে ইন্ডিয়ান অয়েল বটলিং প্ল্যান্ট। কোথায় যাচ্ছি কে জানে – খানিক এগোতে দেখলাম একটা পাওয়ার সাবস্টেশন, আইআইটি। যাক, অন্তত আইআইটি চৌহদ্দিতে এসে পড়েছি। গিয়ে জিজ্ঞেস করতে আমাকে একজন চৌকিদার বাঁদিকের আরেকটা গেট দেখিয়ে দিলেন। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেদিকে আরো একটা বিশাল গেট, সেখানে সিকিওরিটি বসে আছে।
সিকিওরিটি তো বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি আইআইটিতে এসেছি, এই গেট দিয়ে কেউ আসে নাকি? ফ্ল্যাট নম্বর বলতেও বোঝে না। খানিক কনভিন্স করাবার চেষ্টা করার ফল হল এই – সে আমাকে আমাজনের ডেলিভারি এজেন্ট ঠাউরাল। আমি নাকি জিনিস ডেলিভারি করতে এসে ভুল গেটে পৌঁছে গেছি। সিকিওরিটির দোষ নেই – শেষে bকে ফোন করতে হল। সে তো ফোন পেয়ে পুরো হতবাক, তুমি ওখানে কী করে পৌঁছলে? ফোনটা সিকিওরিটিকে দাও, আমি কথা বলছি।
ফোনটা স্পিকারে ছিল, আমি সিকিওরিটিকে ডাকলাম, মুগ্ধ হয়ে শুনলাম b পুরো চোস্ত অহমিয়া ভাষায় ফোনে সিকিওরিটির সাথে কথা বলছে। পুরোটাই বুঝতে পারছিলাম, যদিও এক বেলায় শিখে ওঠা সম্ভব নয় – এটুকু বুঝলাম সিকিওরিটি বলছে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, আমি একে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেন গেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি ঐখানে রিসিভ করে নেবেন, আর b বলছে, না না, ও অনেকদূর থেকে এসেছে, ওকে আর কোথাও পাঠাবেন না, পাঁচ মিনিট দাঁড়ান, আমি ওদিকে পৌঁছে যাচ্ছি, ওখান থেকেই আমি ওকে রিসিভ করে নিচ্ছি। ময় আসু, ময় আসু – এইরকম কিছু একটা বলল লাস্টে, মনে আছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রায় উড়ে উড়ে চলে এল b, তার পরে গেট খুলিয়ে আমাকে ক্যাম্পাসে ঢোকানো তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল লাগিয়ে সেখান থেকে লাগেজ খুলে ওপরের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পৌঁছতেই এসে হাজির হয়ে গেল গেছোদাদা, আর তার খানিক পরেই দেবর্ষি দাস। শ্রীমতি b অনবরত সাপ্লাই দিতে থাকলেন চা, ডিমের চপ ইত্যাদি। মানে এর পরে জীবনের কাছ থেকে আর কীই বা চাইবার থাকতে পারে? অফ অল প্লেসেস, গৌহাটিতে জমে উঠল গুরুভাট। খানিকক্ষণের জন্য ভুলেই গেছিলাম যে রাতে আবার দেশি মুরগীর একটা গল্প ছিল। যতক্ষণে মনে পড়ল, ততক্ষণে বোধ হয় গোটাচারেক ডিমের চপ শেষ করে ফেলেছি।
আমি আবার বেশি খেতে টেতে পারি না – বয়েস হচ্ছে তো। গেছোদাদাকে যেতে হবে খানিক দূর, তাই সে আগেই বিদায় নিল, দেবর্ষি রয়ে গেলেন, মিতভাষী লোকটির সাথে কথা বলে সুখ আছে। খাবার টেবিলে বসে দেখি দেশী মুরগী তো আছেই, সেটা মাত্র দশ পার্সেন্ট। তার সাথে তরিতরকারি, ভাজাভুজি, মাছ, শেষপাতে আবার চাটনি – একেবারে বিয়েবাড়ির খাবার। খেয়ে নিয়ে দেখি প্রায় ওঠার ক্ষমতা নেই।
দেবর্ষি বিদায় নিলেন, এবং বাকিদের গুডনাইট করে আমিও অস্ত গেলাম। মন একটু ভালো লাগছে আপাতত। কাল অরুণাচলে ঢুকব। গেছোদাদা রুট সংক্রান্ত কিছু টিপস দিয়েছিল, সেগুলো ম্যাপ ট্যাপ দেখে মোটামুটি মুখস্ত করে নিলাম।
এক ঘুমে রাত কাবার।
ভ্রমণকাহিনী হো তো এয়সা। মনযোগ নড়তে দেয় না।
LikeLiked by 1 person
চার্টে এপিসোড কাউগ্রাসে সেশ করলাম। সইত্যের বালাই বড় বিষম বালাই – ডিমের চপগুলোর কথা পড়ে বুক একটু চিনচিন করে উঠল, তবে সাময়িক। আর চার্টে ডিমের্চপ তো নেহাতই নাবালক। ঃড
লিখে চল। এগিয়ে চল। মন আর শরীরের দ্বন্দ্ব জারি থাকুক। লেট হুইল্স রোল অন, অ্যান্ড হাউ!
LikeLiked by 1 person
পঞ্চম পর্ব বেরিয়ে গেছে। একবার উঁকি দিয়ে যাস।
LikeLike
Darun lgche Porte..
LikeLiked by 1 person