অরুণাচলের দেশেঃ পঞ্চম পর্ব

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪

দিল্লি থেকে ফরেনার এসেছে? সে আবার কী কেস? এই দিল্লির নাম্বারওলা বুলেটটা কি তাদেরই?

তিন দিনে চলে এসেছি প্রায় দু হাজার কিলোমিটার। আজ একটু বিশ্রাম নিলে ভালোই হত, কিন্তু প্ল্যান বলছে আজ আমাকে দিরাং পৌঁছতে হবে। দূরত্বটা কম – তিনশো চার কিলোমিটার, কিন্তু রাস্তাটা পাহাড়ী। তবে একটু্ দেরি করে বেরোলেও চলবে। তাই চোখ খুললাম সকাল সাড়ে ছটায়।

মোবাইল অন করে দেখি শুভ্রদীপের মেসেজ – তুমি কি গৌহাটি এসেছো?

শুভ্রদীপ আমার ফেসবুক বন্ধু – কীভাবে যোগাযোগ হয়েছিল জানি না, আমাদের কমন ফ্রেন্ড ইন্দো, এইটুকু জানতাম। বাকি তিনি কে, কী কোথায় থাকেন, কিছুই জানি না, খোঁজ নেবার দরকারও মনে করি নি কোনওদিন। প্রথমে তাই লিখলাম, হ্যাঁ, কাল রাতেই এসেছি, আজ চলে যাবো – তারপরে কী মনে হল, শুভ্রদীপ নিশ্চয়ই গৌহাটিতেই থাকে, না হলে “এসেছো” লিখবে কেন? ঝট করে শুভ্রদীপের প্রোফাইলে গিয়ে দেখি, পরিষ্কার লেখা আছে, আইআইটি গৌহাটি। যাব্বাবা! আমরা তো একই জায়গায় আছি তার মানে।

সঙ্গে সঙ্গে লিখলাম, ইন ফ্যাক্ট, তোমার খুব কাছেই আছি। b-এর বাড়িতে। কিন্তু আমি তো একটু বাদেই বেরোব। তুমি এখানেই থাকো জানলে তো কাল রাতেই ডেকে নিতাম, কত আড্ডা হল।

শুভ্রদীপ লিখল, কটায় বেরোবে তুমি?

আমি লিখলাম, সাড়ে সাতটা অ্যাপ্রক্সিমেটলি।

– তুমি তৈরি হও। আমি মেয়েকে স্কুলবাসে তুলে দিয়েই আসছি সাতটা নাগাদ। bকে বলো, আমার জন্যে এককাপ ভালো করে চা বানাতে।

সাতটা চার নাগাদ দরজায় দর্শন দিল শুভ্রদীপ, এই প্রথম সামনাসামনি দেখা, কিন্তু যেন কতদিনের আলাপ। ফেসবুক আর গুরুচণ্ডা৯র ভার্চুয়াল আলাপ পরিচিতি শুধুই ভার্চুয়াল থাকে না সামনাসামনি মানুষগুলো এসে দাঁড়ালে। সেই অর্থে b, দেবর্ষি, শুভ্রদীপ – তিনজনকেই আমার এই প্রথম চাক্ষুষ দেখা। অতএব, আবার একপ্রস্থ আড্ডা, চটজলদি চায়ের সাথে। আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম, তিনজনে মিলে হাতে হাতে ধরে ব্যাগ নামিয়ে নিচে পার্কিংয়ে আসতে আসতে আটটা প্রায় বাজে বাজে। ঝটপট আমার দৈনিক ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন বেঁধে দুজনকে টা টা বাই বাই করলাম। শুভ্রদীপ বলল, দাঁড়াও, কালকে তো তুমি পেছনের গেট দিয়ে ঢুকেছো, সামনের গেটে তো এন্ট্রি নেই, হয় তো আটকাতে পারে, আমি যাচ্ছি গাড়ি নিয়ে তোমার আগে আগে।

তাইই হল। একেবারে রাজকীয় এক্সিট হল ভোর ভোর – সামনে শুভ্রদীপ গাড়ি চালিয়ে চলেছে, পেছনে মোটরসাইকেলে বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমি। একদম মেনগেটের সামনে এসে ফাইনালি শুভ্রদীপকে বিদায় জানিয়ে আমি এগোলাম। শেষবেলায় মনে পড়ল, কারুর কোনও ছবি তোলা হয় নি।

সকালবেলার গৌহাটি আইআইটি ক্যাম্পাসের চারপাশটা বেশ নির্জন। একটা হালকা ফ্যাকাশে কুয়াশার আস্তরণ জড়িয়ে আছে চারপাশে। একটু এগোতেই বড়রাস্তা পেয়ে গেলাম। পেট্রল পাম্পে তেল ভরে নিয়ে এবার এগনো অরুণাচলের রাস্তায়। দূরে হাতছানি দিচ্ছে নীল পাহাড়ের শিল্যুয়েট।

গৌহাটি থেকে দিরাং হয়ে তাওয়াং যাবার দুটো রাস্তা। একটা সাধারণ প্রচলিত রাস্তা – যেটা যায় অল্প করে তেজপুর ছুঁয়ে ভালুকপং হয়ে বমডিলা দিয়ে। আরেকটা রাস্তা খুলেছে কয়েক বছর হল, সেটা যায় ভুটান সীমান্ত ছুঁয়ে, কালাকটাং বলে একটা জায়গা পেরিয়ে। বাইহাটা পর্যন্ত রাস্তা আগের দিনের মতই, এখান থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে যেতে হয় – সিপাঝাড় পেরিয়ে মঙ্গলদই, সেখান থেকে আরেকটু এগিয়ে খারুপেটিয়া। পুরোটাই লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, রাস্তাও খুব একটা চওড়া নয়, ভালোও নয়, অল্পবিস্তর খানাখন্দে ভর্তি।

খারুপেটিয়ার পরেই বাঁদিকে একটা সরু মতন রাস্তা আছে ম্যাপে, জিপিএস যদিও সে রাস্তা রেকমেন্ড করে না – কিন্তু গেছোদাদা বলেছিল এই রাস্তাটা একটা স্টেট হাইওয়ে, সোজা নিয়ে গিয়ে ফেলে ভুটান সীমান্তের কাছে, দূরত্ব খানিকটা কমিয়ে দেয়। তো, ঢুকে পড়লাম। খানিক ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে দেখি দিব্যি ভালো রাস্তা। একেবারে গ্রাম-আসামের (গ্রামবাংলার অনুকরণে) মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দু পাশে ছোট ছোট গ্রাম, গোলাভরা ধান, ক্ষেতভরা ফসল, গোয়ালভরা গরু এবং রাস্তাভরা গোবর – এইসব দেখতে দেখতে দু তিন কিলোমিটার চলতে না চলতেই ভালো রাস্তা ফিনিশ, এবং নেই-রাস্তার শুরু। মাটি, কাদা, ইঁট, খোয়া ইত্যাদি দিয়ে বানানো মেকশিফট রাস্তা – কোথাও বাঁকাবাঁকি নেই, সোজা বাইশ কিলোমিটার চলতে হবে এই রাস্তায়। … এই রাস্তায়?

একেকটা ঝাঁকুনির সাথে সাথে চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে, এক তো ক্যারিয়ারের দুদিকেই লোহার রড ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে, যদিও আশু পুরো ব্যাপারটা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু রাস্তার এই অবস্থা হলে দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? আর দ্বিতীয়ত, এই স্পিডে যদি এতখানি রাস্তা চলতে হয়, তা হলে আবারও দিরাং পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হবে। রাত বলতে, ভারতের এই উত্তরপূর্বদিকে এখন বিকের চারটের পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসছে। সাড়ে চারটেয় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। যেখানেই যাই, বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে জার্নি শেষ করতেই হবে, না হলে অন্ধকারে এই ধরণের রাস্তায় চলা খুবই কষ্টকর।

এইসব ভাবতে ভাবতেই আবার দেখি রাস্তা বেশ ভালো হয়ে গেল। দশ এগারো কিলোমিটার সুন্দর রাস্তা পাবার পরে আবার কয়েক কিলোমিটার খারাপ রাস্তা, তারপরে আবার ভালো রাস্তা ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছলাম উদলগুড়ি বলে একটা জায়গায়। এখান থেকে একটু এগোলেই ভৈরবকুণ্ড, ভুটানের সীমান্ত। রাস্তায় ভুটানের লাল রঙের নাম্বারপ্লেটওলা গাড়ির সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি। আমি চলেছি এইসবের মধ্যে দিয়েই, কিন্তু কেমন যেন একটা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার অনুভূতি, সমানে আমাকে ঘিরে রেখেই চলেছে। …

… ডিভাইন ডিসকনটেন্ট। আসার আগে, অফিসের একটা লিডারশিপ প্রোগ্রামে এই বিষয়ের ওপর একটা সেশন অ্যাটেন্ড করে এসেছিলাম। শব্দবন্ধটা বেশ একটু অক্সিমোরন শুনতে। ডিসকনটেন্ট, বিচ্ছিন্নতাবোধ, সে আবার ডিভাইন হয় কেমন করে? ফেসিলিটেটর বোঝাচ্ছিলেন, এ হল সেই ডিসকনটেন্ট, যা তোমাকে স্থির থাকতে দেয় না, যা তোমার স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, যা তোমাকে জাগিয়ে রাখে রাতে, যা তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে পরের পর মাইলস্টোন ছুঁয়ে চলার নেশায়।

স্থিতাবস্থা। কাকে বলে, স্থিতাবস্থা? চল্লিশ পেরিয়ে গেছি প্রায় কত যেন বছর হতে চলল, শোবার ঘরে এসি আছে, গরমকালে চলে, অফিস সেন্ট্রালি এসি, সুন্দর গদি-আঁটা চেয়ার, সেখানে একটা মাঝারি গোছের পদ আছে, প্রোজেক্ট ম্যানেজার, পোর্টফোলিও ম্যানেজার। জুনিয়র কিছু ছেলেপুলে আমাকে সম্মান করে, কেউ কেউ আমাকে স্যার বলে, বার বার বলেও তাদের কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত করাতে পারি নি এখনও। একটা গাড়িও আছে, চার চাকার। এসি চলে। মাস গেলে খুব খারাপ মাইনে পাই টাই না। আমি তো তথাকথিত সুখী মানুষদের দলে পড়ি। স্থিতাবস্থায় তো আমারও অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা এতদিনে। তবু হতে পারি না কেন? কেন রাতের পর রাত ঘুম ভেঙে যায়? ঘুম আসে না? এতোল বেতোল চিন্তা আসে? কেন শেষরাতের ঝোঁকে শেষবারের মত ঘুম আসার আগে, প্রত্যেকদিন মনে হয়, সব মিথ্যে, সবকিছু মিথ্যে, মিথ্যে একটা জীবন কাটাচ্ছি? … মিডলাইফ ক্রাইসিস?

মোটরসাইকেল নিয়ে যেদিন প্রথম নেমেছিলাম লাদাখের রাস্তায়, তখন আমার বয়েস ছিল চল্লিশের সামান্য কম। অফিস একটা বিশাল বড় ভয়েড, একটা ব্ল্যাকহোল হয়ে আমাকে গিলে খেতে আসছিল। প্রফেশনাল লাইফে চূড়ান্ত অন্ধকার সময় দেখে দেখে তখন আমি ক্লান্ত, সেই সময়ে রাতের স্বপ্নে আসত বেড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে। শেষরাতের নির্জন রাস্তা, হ্যালোজেনের আলো, আর আমি চলেছি একলা। লাদাখ ঘুরে আসার পরও সেই স্বপ্ন ছাড়ে নি, আরও জোরে ঝাঁকিয়ে বসেছিল আমার মনে। এর পর টুকটাক এদিক ওদিক গেলাম, স্পিতি গেলাম, আমার বই বেরোল, লোকে ভিড় করে এল, বই কিনল, সুন্দরী সুন্দরী বান্ধবীরা বলল, বাব্বা, সিকি, তুমি তো সুপারম্যান – একদিনে এত লম্বা চালাও? তুমি ক্লান্ত হও না? পারো কী করে?

আমি মুখে হেসেছি, বলেছি, এ আর এমন কী ব্যাপার। মনে মনে গর্বিত হয়েছি, ওঃ, আমার ফ্যানবেস বাড়ছে, আমার একটা “ইমেজ” তৈরি হচ্ছে। লোকে আমার বই কিনে নিয়ে যাচ্ছে গুরুচণ্ডা৯র স্টল থেকে, সেইখানে আমি সই দিচ্ছি, গর্ব হবে না?

কালাচাঁদ দরবেশের গল্প মনে পড়ে তখন। কল্লোলদা শুনিয়েছিল, একাধিকবার।

এইচএমভি কালাচাঁদ দরবেশের ক্যাসেট বের করতে চায়, কিন্তু দরবেশ ধরা দেন না। এদিক সেদিক বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় এক গাছতলায়। মাধুকরী করে দিন গুজরান করেন। ততদিনে কালাচাঁদের দেশ পেরিয়ে বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে, আমেরিকায় গিয়ে গান করে এসেছেন। ভক্তরা বলে, তোমার এত নামডাক – ইচ্ছে করলেই দুটো ক্যাসেট বের করে তার টাকায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেতে পারো, তুমি ভিক্ষে করো কেন?

কালাচাঁদ মিষ্টি হেসে বলেন, কেন ভিক্ষে করি, শুনবি? বোস।

ভক্ত বসে, সেই ধূলোটমূলে। কালাচাঁদের পায়ের কাছটিতে। কালাচাঁদ তাকে জিগান, বল তো, এই পৃথিবীতে কত লোক আছে?

– ধুর, তা আবার বলা যায় নাকি? সে তো অনেক!

– তাও, বল না।

– তা হবে, কোটি কোটি কোটি।

– হ্যাঁ রে, কোটি কোটি কোটি। তো এই কোটি কোটি কোটি লোকের মধ্যে কত লোক গান গাইতে পারে?

– তা কয়েক কোটি হবে।

– আর সেই কয়েক কোটির মধ্যে কত লোক এস্টেজে উঠে গান গাইবার সুযোগ পায়? এই ধর তোর আমার মতন লোক? যার গান লোকে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে আসে?

– তা তো হবেই কয়েক লাখ, কি কয়েক হাজার!

– এইবারে তুই একবারটি ভেবে দ্যাখ, এই যে দুনিয়া জোড়া কোটি কোটি কোটি মানুষ, তাদের মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ, যাদের গান লোকে খচ্চা করে শুনতে আসে, তাদের একজন হচ্ছিস তুই, আর আরেকজন হচ্ছি আমি।

– তা, সে তো বটেই।

– গব্বো হয় না?

– তা, একটু হয় বৈকি।

– অ্যায়, ওইখানটিতেই তোর পতন। যেই তোর গব্বো হয়ে গেল মনের মধ্যে, তুই গেলি। তোর সাধনা, তোর সাফল্য, সব ধূলোমাটি হয়ে উড়েপুড়ে গেল। ঐ গব্বোটি আমি হতে দিই না কিছুতেই, বুঝলি? যখনই লোকে এসে বলে – আপনার তো কত নামডাক, দেশে-বিদেশে যান, আপনে তো বিখ্যাত মানুষ, মনে গব্বো আসে, তখনই আমি ভিক্ষে করতে বেরোই। মাথা নিচু করে ভিক্ষে চাই। লোকে দয়া করে ভিক্ষে দেয়, আমি সেই দয়ার দানে পেট ভরাই। গব্বো আমায় খেতে পারে না।

……………………………………………………….

আমি তো কর্পোরেটের চাকুরে। আমি তো কালাচাঁদ দরবেশ হতে পারি না। আমি সে মেটেরিয়ালই নই। টের পাই, গর্ব হচ্ছে। গর্ব আমাকে খেয়ে নিচ্ছে। মাটির থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই কি আমি রাস্তায় নেমেছি, একলা? সাতরাজ্যের ধূলো মাখছি, ব্যথা দিচ্ছি শরীরকে, এসির আরাম ছেড়ে রুক্ষ আবহাওয়ার মধ্যে হাওয়া কেটে বেড়াচ্ছি? এইজন্যেই কি? নাকি সেই যে আমার অনুরাগীরা বলে, বাব্বা সিকি, কী করে পারো, সেই কথাটুকু শোনার জন্য জোর করে আবার বেরোই, পরের বইয়ের, পরের লেখার প্লট বানাবো বলে বেরোই, সেই মুগ্ধতার খোলসটাকে গায়ে চড়িয়ে, সেটাকেই আসল আমি মনে করে অন্য একটা আমি বেরোই। আসলে কি মনের মধ্যে আমার সেই স্বপ্নটা আজও আছে? নাকি, নেই আর?

মন তো বলছে, না, নেই। এক বছর আগের আমি আর আজকের আমি অনেকটা বদলে গেছি। সেই থ্রিল, সেই আনন্দ আর পাচ্ছি না। নিজেকে কেমন যেন, জোর করে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এইবারে মনে হচ্ছে। ডিসকনটেন্ট তৈরি হচ্ছে আবার, কিন্তু সেই ডিসকনটেন্টের মধ্যে ডিভাইনিটি নেই, কেমন যেন অভিমুখবিহীন লাগছে নিজেকে, কী করলে, কীভাবে বাঁচলে এই ডিসকনটেন্টের হাত থেকে মুক্তি পাবো, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। কেমন যেন দিনের পর দিন মনে হচ্ছে জাস্ট লোকে আমার এই বাইকার রাইডার ইমেজটা জানে, সেই ইমেজটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি চলেছি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, এটা আর ঠিক সেই রকমের প্যাশন নেই, এমনটা ছিল গত বছর পর্যন্ত।

কেন করছি এই অভিনয়? কীসের দায় লোকের কাছে ইমেজ বজায় রাখার? আমি তো চাইলেই কালকে জার্নি ক্যানসেল করে ফিরে চলে যেতে পারি। চলে যাবো? মাত্র চারদিনের রাস্তা এসেছি। চাইলে আরামসে চারদিন কি ছদিনে আমি ফিরে যেতে পারি আবার দিল্লিতে, আমার চেনাপরিচিতির ঘেরাটোপে।

… এই ধরণের চিন্তা আমার মাথায় কখনও আগে আসে নি, এইবারে আসছে। ফিরে যাওয়া, জার্নি অ্যাবর্ট করা। সবাই জানে সিকি বেড়াতে যাচ্ছে, আমি জানি, আমি বেড়াতে যাই না, আমি নিজেকে খুঁজতে যাই, খুঁজে পাই হয় তো কিছুটা – কিন্তু এইবারে আর পাচ্ছি না। নিজের কাছে আমার সত্যিকারের আমি-টা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। এ আমার কী হয়ে গেল? …

DSC_0152
অরুণাচলে ঢোকার মুখে। বাঁদিকটা ভুটান। সোজা রাস্তা চলে যাচ্ছে কালাকটাংএর দিকে।

ভুটান বর্ডারের গা ঘেঁষেই শুরু হচ্ছে অরুণাচলের সীমা। হিসেবমত এখানে আইএলপি দেখানো উচিত, কিন্তু কেউ দেখতেই চাইল না, একটা চেকপোস্ট মত ছিল, সেখানে একবার দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেসও করলাম, কালাকটাং হয়ে দিরাং যাবার পথ এটাই কিনা, মিলিটারি ছেলেটি হাসিমুখে হ্যাঁ বলল, কিন্তু আইএলপি তো দেখতে চাইল না!

বেলা প্রায় দেড়টা নাগাদ কালাকটাং পৌঁছে গেলাম, রাস্তা মোটের ওপর ভালোই, অল্প কিছু খারাপ স্ট্রেচ বাদে। এখান থেকে আরেকটু এগোলেই শেরগাঁও বলে একটা জায়গা। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রায় তিনটে বেজে গেল। দিনের আলো আর খুব বেশি হলে দেড় ঘণ্টা থাকবে, এদিকে দিরাং তখনও আরও একশো কিলোমিটার দূরে।

পাহাড়ি রাস্তায় একশো কিলোমিটার পার হতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগতে পারে, রাস্তা কেমন তার ওপর নির্ভর করছে। কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। ছোট্ট একটা দোকানে ঢুকে চা আর ম্যাগি খেয়ে খিদে মেটালাম। বাকি খাওয়াদাওয়া দিরাং পৌঁছেই করা যাবে বরং। দিরাংয়ে আমার কোনও বুকিং নেই, গিয়ে একটা হোমস্টে খুঁজতে হবে।

DSC_0156-1

শেরগাঁও থেকে দিরাং যাবার একটা শর্টকাট আছে। মোরসিং হয়ে যায়। আর লম্বা রাস্তাটা যায় রূপা, বমডিলা হয়ে। দোকানের ছেলেটা জানাল শর্ট রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যায়, যেহেতু আর একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে, তাই জঙ্গলের রাস্তা না নেওয়াই ভালো, আমি যেন রূপার রাস্তা নিই, ভালো রাস্তা আছে আগে দিরাং পর্যন্ত, আরামসে চলে যাব।

20181120_203349
মা-মুরগী ও তার ছানাপোনারা। শেরগাঁওয়ের পথে।

শেরগাঁও ছাড়ার একটু পরেই রাস্তা সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেল, একদম রানওয়ের মত মসৃণ। গতি বাড়ালাম। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমছে, আশি, সত্তর, ষাট – বমডিলা যখন ঢুকলাম, তখনই নিকষ অন্ধকার, ছটা বাজতে তখন আর দশ মিনিট বাকি। এখান থেকে দিরাং আর মাত্র পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। কী করা উচিত? বমডিলাতেও থাকার জন্য হোমস্টে পাবো। থেকে যাবো, নাকি দিরাং যাবো? পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার এমন কিছু লম্বা দূরত্ব নয় – এটুকু এগিয়ে গেলে কালকের রাস্তাতেও খানিকটা এগিয়ে থাকা হবে। আমি ক্লান্ত, দুই উরুতে রক্ত জমে যাওয়ার মত অনুভূতি হচ্ছে, তবুও আর চালাতে পারব না, এমন অবস্থায় নেই। না, কাল পেনকিলার খাই নি, তাতে ব্যথা বাড়েও নি, কমেও নি। পিঠে ঘাড়ে হাতে কোথাও কোনও অস্বস্তি নেই, কেবল পা ধরে যাচ্ছে, উরুর কাছে।

DSC_0158

এগিয়েই গেলাম। প্রায় সাড়ে ছটা বাজল দিরাং পৌঁছতে। বাঁ হাতে প্রথম যে হোমস্টে দেখলাম, সেখানেই নক করতে এক বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এলেন। হ্যাঁ, রুম আছে।

মেন গেটে তালা পড়ে গেছিল, উনি তালা খুলে দিলেন, ভেতরে একটা ছোট্ট কম্পাউন্ড মতন, তার দুদিক ঘিরে ঘর। ঘাসে ঢাকা কম্পাউন্ডে দেখতে পেলাম, একটা বুলেট রাখা আছে, মেরুন রঙের, তাতে দিল্লির নাম্বারপ্লেট। দিল্লি থেকে আরও কেউ এসেছে?

ঠাণ্ডা আছে, তবে অসহনীয় কিছু নয়। পাঁচ ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস মত হবে। বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা। হোমস্টে-র হোস্টেসকে বললাম, কাল সকালেই তো বেরিয়ে যাবো, সমস্ত লাগেজ তা হলে আর মোটরসাইকেল থেকে খুলছি না, আমি কভার করে দিচ্ছি পুরোটা। একটা ব্যাগ, যাতে আমার রাতের জামাকাপড় আর জরুরি জিনিস ছিল, সেটুকু নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঢোকার মুহূর্তেই হোস্টেস বললেন, দো ফরেনার লোগ আয়া হ্যায়। ও ভি দিল্লি সে। বাত করো।

দিল্লি থেকে ফরেনার এসেছে? সে আবার কী কেস? এই দিল্লির নাম্বারওলা বুলেটটা কি তাদেরই?

হ্যাঁ, তাদেরই। কিচেনে বসে আছে।

বেশ। ধরাচুড়ো ছেড়ে পায়ে পায়ে কিচেনে গেলাম, একটি বিদেশি দম্পতি বসে আছেন জল গরম হওয়া একটি জাম্বো সাইজের সামোভারের সামনে। সামনে আরও দুটো চেয়ার রাখা, ওটা ওম পোয়ানোর জায়গা। সামোভারে জল ফুটছে, তাতেই রান্নাবান্নার কাজ চলবে। দুজনেরই গায়ের রঙ লালের শেড পেরিয়ে একটু তামাটের দিকে, মানে অনেকদিন ধরে ঘুরছেন, মহিলাটির কোলে একটি মোটাসোটা লোমশ বেড়াল।

গিয়ে বসলাম, আলাপ হল। ফ্রান্স থেকে এসেছেন। মহিলাটি ইংরেজি বলতে ও বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী একেবারেই ফ্রেঞ্চের বাইরে কিস্যু জানেন না। শুনলাম, প্রায় এক মাস ধরে ঘুরছেন। দিল্লি থেকেই মোটরসাইকেল রেন্ট নিয়ে এসেছেন। আজই তাওয়াং থেকে ফিরেছেন। এর আগে নাগাল্যান্ড, মেচুকা, রোয়িং ইত্যাদি জায়গা ঘুরে এসেছেন। তাওয়াংয়ে তিনদিন ছিলেন, এখানে দুদিন কাটিয়ে এখান থেকে নেমে এর পরে মেঘালয় ঘুরতে যাবেন।

গল্পগুজব হল, একপ্রস্থ চা আর বাটার টোস্টের সাথে। বলার মত ঘটনা বলতে, এর মাঝে বেড়ালটি কী কারণে কে জানে, আমাকে পছন্দ করে বিনা নেমন্তন্নেই এক লাফে আমার কোলে চলে এল। আমি কুকুর বেড়াল এমনিতে অপছন্দ করি টরি না, কাছে এলে হাত বুলিয়েও দিই টিই, কিন্তু গায়ে নিয়ে ঘষাঘষি আমার একদম পোষায় না। তবে কিনা ইনি হোমস্টে মালকিনের বেড়াল, সম্ভবত গেস্টদের কোলে উঠে আদর খাওয়া এঁর অভ্যেস, এতক্ষণ ফরাসী আদর খেয়ে এখন বাঙালি দেখে হয় তো স্বাদবদল করতে এসেছেন, কী আর করা, খানিক গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, তিনি ঘ্রুর্‌র্‌ ঘ্রুরুৎ টাইপের আওয়াজ করে আদর খেয়ে খানিক বাদে নিজে থেকেই নেমে ভেতরঘরে চলে গেলেন।

যে সব জায়গায় তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়, সেখানে সময় আস্তে ধীরে চলে। অনেকক্ষণ গল্পগুজব করার পরে দেখলাম মাত্র পৌনে আটটা বাজে। ফরাসী দম্পতি বারান্দায় চলে গেলেন ফুঁকতে। আমি মালকিনের সাথেই গল্প জুড়লাম।

এঁরা মোনপা উপজাতির লোক। সম্পূর্ণ অরুণাচল প্রদেশে ছাব্বিশ রকমের উপজাতি আছে। উপজাতির ইংরেজি হচ্ছে ট্রাইব। সেই হিসেবে সাব-ট্রাইবের বাংলা কী হবে? উপ-উপজাতি? সমগ্র অরুণাচলে একশোরও ওপর সাব-ট্রাইব আছে। এঁরা মোনপা ট্রাইব, আর সাব-ট্রাইবের হিসেবে এঁরা হলেন দিরাং মোনপা। সেলা পাসের অন্যপারে তাওয়াংয়ে আছে তাওয়াং মোনপা।

জিজ্ঞেস করলাম, দিরাং মোনপা আর তাওয়াং মোনপার মধ্যে কতটা তফাত? আপনারা কি তিব্বতিদেরই বংশধর উপজাতি? মালকিন বললেন, না, তিব্বতি নই। আমরা খানিকটা ভোট (মানে ভুটানিজ), খানিকটা বার্মিজ, বাকিটা অরুণাচলীই। তাওয়াং মোনপাদের থেকে আমাদের ভাষা একটু আলাদা, কালচারও সামান্য আলাদা।

সাড়ে আটটা নাগাদ তিনি দুঃসংবাদটি দিলেন। রাতের খাবার হবে, কিন্তু নন-ভেজ নেই। পুরো লে হালুয়ে কেস। আমাকে আগে বললে আমি হারগিজ এই হোমস্টে-তে আসতাম না! বাইরে এখন কোনও দোকানপাটও বোধ হয় খোলা নেই।

আমার মুখ দেখে মালকিনের করুণা হল, উনি বললেন, একটা ডাবল ডিমের অমলেট করে দেব।

ভাগ্যিস দিয়েছিলেন, তাই দিয়েই গোটা তিনেক রুটি খেলাম, কারণ সঙ্গের যে তরকারিটা ছিল, সেটা ঠিক কীসের তরকারি ছিল – বহু চেষ্টা করেও বুঝতে পারি নি, কারণ না তাতে আলু ছিল, না মটরশুঁটি বা গাজরের মত চেনাশোনা কোনও পদার্থ ছিল।

খাবার টেবিলে আরও খানিক তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করলাম ফরাসী দম্পতির থেকে, ওঁরা আজকেই তাওয়াং থেকে ফিরেছেন কিনা। না, রাস্তা পরিষ্কার, তেমন বরফ টরফ নেই, তবে খুব কুয়াশা ছিল, খুব, সেলা লেকের সামনে দাঁড়িয়ে নাকি সেলা লেক দেখা যাচ্ছিল না এতটাই ঘন কুয়াশা। তবে এখন তো আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, কাল আমি সুন্দর রোদ ঝলমলে সেলা দেখতে পেলেও পেতে পারি।

শুভরাত্রি জানিয়ে কম্পাউন্ডে নেমে এলাম, মোটরসাইকেলের কভার ছিল, সেইটা দিয়ে বেশ ভালো করে মুড়ে দিলাম মোটরসাইকেলটাকে। বাইরের গেটে তালা দেওয়া, বেরনোর উপায় নেই, চারদিক নিঝঝুম, খানিক ওখানেই গেটের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাল তাওয়াং পৌঁছনো।

তাওয়াং আমার ইটিনেরারি থেকে ছেঁটে দিয়েছিলাম, যাবার কথা ছিল না, শেষ মুহূর্তে ঢুকিয়েছি, হতে পারে সেটার জন্য মন থেকে তেমন ইচ্ছে হচ্ছে না, তবে মূল কারণ হচ্ছে পর পর লাগাতার চলা, একেবারে বিশ্রাম হচ্ছে না, এইটাও ফ্যাটিগের একটা কারণ হতে পারে।

না, আপাতত ফিরব না। কাম হোয়াট মে, দ্য শো মাস্ট গো অন।

যাই, শুয়ে পড়ি।


4 thoughts on “অরুণাচলের দেশেঃ পঞ্চম পর্ব

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.