অরুণাচলের দেশেঃ অষ্টম পর্ব

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭

আর ঘটনাটা ঘটল তার ঠিক পরেই, এক মিনিটের মাথায়।

আসার দিন দিরাং থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় স্টার্ট করে বেলা দেড়টা পৌনে দুটো নাগাদ তাওয়াং এসে পৌঁছেছিলাম। রাস্তা ছিল বেশিরভাগটাই চড়াই। আজ বেশির ভাগটাই উতরাই, সময় কম লাগবে, যদিও আজ যাব দিরাং থেকে আরও খানিক এগিয়ে। কাল গেছোদাদার সাথে কথা হয়েছিল, বমডিলা, না রূপা – কোথায় থাকলে হোমস্টে বা হোটেল পাবার চান্স বেশি। দিরাং থেকে মোটামুটি চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বমডিলা। আর বমডিলা থেকে আরও আঠেরো কিলোমিটার রূপা – মানে মোটামুটি ষাট কিলোমিটার। এখান থেকে সকাল সাড়ে আটটায় শুরু করলেও আরামসে বিকেল চারটের মধ্যে পৌঁছে যাব। গেছোদাদা বলেছিল, রূপাতে গিয়ে থাকাই বেটার, পরের দিনের জার্নির জন্য যতটা বেশি এগিয়ে থাকা যায় – থাকার জায়গার অভাব হবে না, যদি দরকার হয় বোলো, ওখানে আমাদের ফিল্ড হসপিটাল আছে, আমি ব্যবস্থা করে দেব।

ছটায় উঠেছি। তৈরি হয়ে নিয়ে, পৌনে সাতটা নাগাদ বেরোলাম তাওয়াং মনাস্ট্রির দিকে। হোটেলের লামাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছি, যে কোনও সময়ে মনাস্ট্রিতে যাওয়া যেতে পারে, আলাদা করে কোনও ভিজিটিং আওয়ার নেই।

সত্যিই নেই, সকালের দিকে স্থানীয় কিছু মানুষজন দৈনিক পুজো দিতে এসেছেন, এদিক ওদিক লামারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ তেলের টিন কেউ বিশাল বড় প্রদীপদানি ইত্যাদি নিয়ে। কচি লামার দল ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে কোথাও – ক্যামেরার লেন্সের ঢাকনার প্যাঁচ খুলতে খুলতেই তারা হারিয়ে গেল সামনের বাঁকে। আমি আস্তে আস্তে এগোলাম। চাতালের সামনে তাওয়াং মনাস্ট্রির লাইব্রেরি। সকাল বেলায় বন্ধ। ভেতরে দেখা যাবে না কিছুই এখন। চাতাল থেকে চমৎকার ভিউ আসছে সকালবেলার তাওয়াং শহরের। প্রথম সূর্যের আলো নরম সোনালী রঙের, ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ উপত্যকার ওপর, বিভিন্ন শেডের নীল রঙের পাহাড়ের সারি, একটার পেছনে আরেকটা।

DSC_0219

বাচ্চা লামাদের ফলো করতে গিয়ে একটু এগিয়ে দেখলাম, মনাস্ট্রির ভেতরেই একটা স্কুল, লামাদের স্কুল। সেখানে সমবেত কচি গলায় প্রার্থনা চলছে। বিশাল ফাঁকা চাতাল, চারদিকে ঘর, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, গেস্টহাউস, প্রতিটা বিল্ডিং থেকে ঠিকরে পড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সকালবেলার প্রার্থনা।

DSC_0227

সবই বন্ধ, তাই বাইরে থেকেই যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু দেখে আবার ফিরে এলাম হোটেলে। দুদিনের ভাড়া মিটিয়ে, জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করে রেডি হচ্ছি, এক বাচ্চা লামা এসে হাজির। সে আমার মোটরসাইকেল দেখে খুব কৌতূহলী। হ্যান্ডেলবারের লাইট, জিপিএস মাউন্ট, বানজি কর্ড – কচি কচি হাত দিয়ে প্রত্যেকটা ধরে ধরে “কেয়া হ্যায়, কেয়া হ্যায়” টাইপের আকুল জিজ্ঞাসা। মনাস্ট্রির পাঁচিলের সামনে চমৎকার চপের দোকান বসেছে একটা, তার পাশে আঙ্কল চিপসের স্টল, পাঁচিলের ওপার থেকে লামাদের ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে দশ টাকার নোট এসে পৌঁছচ্ছে পাঁচিলের এপারে, আর এপার থেকে একটা একটা করে চিপসের প্যাকেট পৌঁছে যাচ্ছে লামাদের হাতে।

ছোট্ট লামা ভালো হিন্দিও বলতে পারে না, অনেক কষ্টে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি। আমি বললাম, দিল্লি। দিল্লি জানতা হ্যায়? লামা খুব স্মার্টলি বলল, হাঁ। দিল্লি-কলকাতা-ম্যাড্রাস জানতা হ্যায়।

20181123_075121

স্টার্ট করতে করতে আটটা বাজল। তাওয়াং শহরকে পেছনে রেখে আমি ফিরে চললাম রূপার দিকে।

শহরের চৌহদ্দি পেরিয়ে ফিরছি, আর একটু পরেই এসে যাবে জাং গ্রাম, যেখানে আসার সময়েই দেখে এসেছি নুরানাং ওয়াটারফলস। ফোন বাজল, কিন্তু হেলমেটের ব্লুটুথ বাজছে না কেন? ও হো, আজ তো তাওয়াং থেকে স্টার্ট করার সময়ে হেলমেটের ব্লুটুথ অন করতেই ভুলে গেছি!

গেছোদাদা ফোন করছে, এখন বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে ব্লুটুথ অন করতে গেলেও, সে ফোনের সাথে কানেক্ট হতে হতে ফোন বেজে শেষ হয়ে যাবে। মোটরসাইকেল থামিয়েই বরং ধরি।

কিন্তু তাতেও টাইম তো লাগেই – গাড়ি থামাও, হাত থেকে গ্লাভস খোলো, তারপরে ফোন রিসিভ করো – করতে করতে সত্যিই ফোন বেজে শেষ হয়ে গেল। ঝটপট কলব্যাক করতে গেলাম, গেছোদাদার ফোন ততক্ষণে নট রিচেবল। ধুর, দরকার থাকলে অবশ্যই আবার ফোন করবে। ফোনের সাথে ব্লুটুথ কানেক্ট করে আবার গ্লাভস পরলাম, মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। একটু পরে এসে গেল জাং। প্রায় নটা বাজে। কিছু খেয়ে নিলে ভালো হয়। রাস্তার ধারে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে থামলাম। কী পাওয়া যাবে? পুরি-ভাজি-অমলেট-মোমো-চা-কফি-আলুপরোটা … গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পুরি-ভাজি অর্ডার করলাম। খানিক বাদে এসে গেল একদম গরমাগরম ধোঁয়া-ওঠা লুচি আর ছোলার ডাল। একদম বাঙালি স্টাইলের জিনিস। আর আমায় পায় কে! লুচিগুলোর অবশ্য বিশাল সাইজ ছিল। একসাথে সাতখানা খেয়ে তবে থামলাম। এর পর এক কাপ কফি খেয়ে, আবার পথ চলা। আহা, কী সোয়াদ! দুপুরে আর কিছু না খেলেও চলবে।

আর খানিকক্ষণ বাদেই এসে গেল জশবন্তগড়। মেমোরিয়ালটা আসার সময় দেখা হয় নি, থামব কিনা চিন্তা করলাম একবার, এমনিতে দেখার খুব একটা ইচ্ছে নেই, সেই সময়ে আবার ফোন বাজল। গেছোদাদা। এইবারে ব্লুটুথেই রিসিভ করে ফেললাম – শুভ সংবাদ। রূপার কাছেই ডাহুং বলে একট গ্রামে একটা মিলিটারি হসপিটাল আছে, সেখানকার কম্যান্ডিং অফিসার কর্ণেল আগরওয়ালকে বলে সেখানকার গেস্টহাউসে আমার রাতে থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, আমি চাইলে সেখানেই থেকে যেতে পারি।

খুব ভালো প্রস্তাব। আহা, একদিনের জন্য থাকার চিন্তা নেই, এর চেয়ে আর ভালো কী হতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে ফোনেই বলে দিলাম, আমি দিব্যি চাই। ঠিক আছে, তুমি আমাকে হোয়াটস্যাপে লোকেশন পাঠিয়ে দাও, আমি পৌঁছে যাব।

কী মনে করে আর জশবন্তগড় মেমোরিয়াল দেখার জন্য থামলাম না। আর্মির মেমোরিয়াল কমবেশি একই রকমের লাগে, আমার খুব একটা ভালো লাগে না যুদ্ধসংক্রান্ত বীরত্বের প্রদর্শনী। যদিও জানি না জশবন্তগড় মেমোরিয়াল কী ধরণের, ওর ভেতর কী আছে, তবু, জাস্ট লেট ইট গো বলে এগিয়ে গেলাম।

আর ঘটনাটা ঘটল তার ঠিক পরেই, এক মিনিটের মাথায়।

রাস্তা হালকা ঢালু ছিল, কিন্তু সুন্দর মসৃণ রাস্তা, স্টার্ট করামাত্র চল্লিশে উঠে গেছিল গাড়ির স্পিড, হঠাৎই, কীরকম মনে হল, গাড়ির পেছনের চাকাটা যেন কেউ ঝট করে তুলে ধরে ডানদিকে ঠেলে দিল, গাড়ি স্পিডের মাথায় হেলে পড়ল বাঁদিকে, পড়লাম আমি, এবং টের পেলাম গাড়ি গড়িয়ে যাচ্ছে, তার সাথে গড়িয়ে যাচ্ছি আমিও, আমার বাঁ পা মোটরসাইকেলের বাঁদিকে গীয়ার শিফটারের মধ্যে আটকে গেছে, ফলে নিজের ইনারশিয়ায় মোটরসাইকেল টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।

পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল এক থেকে দেড় সেকেন্ডের মাথায়, অন্তত পাঁচ ছ ফুট মোটরসাইকেলের সাথে ঘষটানোর পর কোনওরকমে নিজের পা ছাড়িয়ে আনতে পারলাম, আমি রাস্তার ওপর শুয়ে, একটু সামনেই মোটরসাইকেল, তারও গড়ানো থেমেছে।

আপৎকালে মাথায় সবার আগে নিজের নিরাপত্তার কথাটা মাথায় আসে। আমাদের ব্রেনের তিনটে মূল লেয়ার আছে, তার একদম নিচের দিকে, শিরদাঁড়ার একদম ডগায় লাগানো অংশটাকে বলা হয় লিজার্ড ব্রেন, বা রেপটিলিয়ান ব্রেন, যেটা প্রাণীর বেসিক ভাইটাল কাজকর্ম এবং ইনস্টিংক্ট নিয়ন্ত্রণ করে, একদম প্রিমিটিভ কাজকর্ম, যেমন, বিপদ দেখলে আক্রমণ করা বা পালানো, নিজের সেফটির চেষ্টা সারভাইভালের চেষ্টা সবার আগে করা, ইত্যাদি ইনস্টিংক্ট নিয়ন্ত্রণ করে। সেই লিজার্ড ব্রেন আমাকে বলল, সবার আগে দ্যাখো, তুমি নিজে ঠিক আছো কিনা।

স্প্রিংএর মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। না, বাঁ-পা ঠিক আছে। অ্যাঙ্কলের থেকে পায়ের পাতা ঘুরিয়ে মুড়িয়ে দেখলাম, সব ঠিক আছে, জুতোটা একটু কুঁচকে গেছে ডগার দিকে, আর কিছু হয় নি। এখন পরের প্রায়োরিটি হচ্ছে, মোটরসাইকেল ঠিক আছে কিনা দেখা।

আসার আগেই মোটরসাইকেলের দুদিকে স্লাইডার লাগিয়ে নিয়েছিলাম, ফলে মোটরসাইকেলে এতটুকুও আঁচড় পড়ে নি, ঝটিতি হ্যান্ডেলে আর পেছনের দিকের শিংয়ে হাত লাগিয়ে মোটরসাইকেলটাকে চাগিয়ে তুললাম। … পা-টা কি একটু হড়কে গেল? মচকে গেছে বাঁ পা? … দু হাতে মোটরসাইকেলটাকে ব্যালেন্স করে পায়ের দিকে তাকালাম, আর তখন রহস্যটা পরিষ্কার হল।

ব্ল্যাক আইস! রাস্তার এই অংশটায় দিনের বেশির ভাগ সময়ে সূর্যের আলো পড়ে না, কোথা থেকে জল এসে জমে একেবারে কাচের মত মসৃণ আর শক্ত একটা বরফের লেয়ার তৈরি করেছে, আর তাতেই পিছলেছে আমার গাড়ি, প্রায় ফুলস্পিডে। বোঝামাত্র আমার পা-টা আরেকটু হড়কে গেল, আমি ব্যালেন্স রাখতে গিয়েও রাখতে পারলাম না, মোটরসাইকেল আবার শুয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। ওজন তো কম নয়, দুদিকে ভর্তি লাগেজ সমেত দেড়শো কিলো তো হবেই।

কী করা যায়? সাহায্য দরকার – তা এমন কিছু জনমানবশূন্য এলাকা এটা নয়, একটু দূরেই একটা ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে, এদিকেই আসছে, জশবন্তগড়ের দিক থেকে। হাত দেখিয়ে থামালাম। ড্রাইভার নেমে এলেন, এবং আমার সাথে হাতে হাতে ধরে মোটরসাইকেলটাকে খাড়া করে রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমিও দেখালাম, এখানে বরফ জমে আছে, প্রায় দশ ফুটের মত স্প্যান, খালি চোখে দেখে একেবারে বোঝা যাচ্ছে না, স্রেফ, মোটরসাইকেলটা ঘষটে গেছে বরফের ওপর দিয়ে, সাদা রঙের কটা আঁচড় পড়েছে মাত্র বরফের ওপর, এতটাই হার্ড আইস।

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোথাও লাগে নি তো?

নাঃ, লাগে নি বলেই তো মনে হচ্ছে, বাঁ পায়ের পাতাটা একটু টনটন করছে বটে, কিন্তু মনে হয় না তেমন কিছু। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাঁ পায়েই ভর দিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম, সুইচ টিপতেই একবারে স্টার্ট হয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, না, ক্ষয়ক্ষতি প্রায় কিছুই হয় নি, মোটরসাইকেল স্লাইড্রের দৌলতে একেবারে অক্ষত, লাগেজ একচুলও নড়ে নি, আমার ব্যাগে লাগানো অ্যাকশন ক্যাম, গলায় ঝোলানো ডিএসএলআর, সমস্ত ঠিকঠাক, কেবল জ্যাকেটের বাঁদিকের হাতা ওপর থেকে নিচ অবশি ফেটেফুটে গেছে। বাঁদিকে পড়ে ঘষটে গেছিলাম পাঁচ-ছ ফুট।

এগোলাম, আরও বেশ খানিকটা উতরাই আছে, দূরে দেখা যাচ্ছে, একটু পরেই চড়াই শুরু রাস্তায়। গীয়ার চেঞ্জ করতে গিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা টনটন করে উঠল। হতেই পারে, বুড়ো আঙুলটার ওপরেই মূল চাপটা পড়েছে। পরের গীয়ার, আবার ব্যথা। পরের গীয়ার, আবার।

সাবধানে চালাচ্ছি, খুব ভালো করে নজর করছি, সামনে আর কোথাও ব্ল্যাক আইস তো নেই? এখনও প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে সেলা পাস, আর পাসে পৌঁছবার পাঁচ কিলোমিটার আগে রাস্তা ভীষণ খারাপ, মানে বারবার গীয়ার নামাতে ওঠাতে হবেই। নামানোটা তেমন কোনও চাপের ব্যাপার নয়, ওঠাতে গেলেই ক্রমশ যন্ত্রণাটা বেড়ে যাচ্ছে।

ক্রমশ উচ্চতা বাড়তে লাগল, সেই সঙ্গে যন্ত্রণাও, প্রতিবার গীয়ার বদলানোর সময়ে মনে হচ্ছে পা যেন ছিঁড়ে যাবে। ক্রমশ ব্যথার দিকে আরও কনসেনট্রেট করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, যন্ত্রণার উৎস হচ্ছে বুড়ো আঙুলের হাড় যেখানে পায়ের পাতা থেকে আলাদা হয়ে বেরোয়, মানে মাংসচামড়ার ভেতরে, সেইখান থেকে হচ্ছে। চোট সেইখানে লেগেছে। ভেঙেছে? … জুতোর মধ্যেই আঙুল নাড়াবার চেষ্টা করলাম, এমন কিছু টাইট জুতো নয়, আঙুল নড়ল, হাল্কা ব্যথা, কিন্তু মনে হচ্ছে না অসাড় হয়ে গেছে বা ফুলেছে, বা ভেঙেছে। শুধু পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে গীয়ার তুলতে গেলেই চোখে অন্ধকার দেখছি।

সেলা পাস আর সাত কিলোমিটার। ক্রমশ বুঝলাম, এইভাবে চালানো চাপ, গীয়ার না বদলে, বরং চেষ্টা করি গীয়ারটাকে একটা ফিক্সড পজিশনে রেখে, থার্ড গীয়ারে রেখে, ক্লাচে চাপ বাড়িয়ে কমিয়ে এগোবার। স্পিড খুব কমে গেলে ক্লাচ বেশি টিপে, আস্তে আস্তে স্পিড বাড়িয়ে ক্লাচ ছেড়ে চড়াই। সাধারণত পাহাড়ী রাস্তায় এটা স্ট্রিক্টলি নো-নো, সবসময়ে বলা হয়, পাহাড়ে ক্লাচে নয়, গীয়ারে চালাও, কিন্তু আমার কাছে তখন আর কোনও অপশন নেই, সত্যিই।

খারাপ রাস্তা এসে গেল, এখন আমি জানি, সেলা লেক পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা বলে কিছু নেই, থার্ড গীয়ারে রেখে একটা সাধারণ স্পিড মেনটেন করে উঠতে থাকলাম। একটা সুবিধে, চড়াইটা এখানে খুব খাড়াই নয়, ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে, ফলে স্পিড মেনটেন করতে অসুবিধে হচ্ছে না।

রাস্তা খারাপ, গাড়ি লাফাচ্ছে, ঝাঁকাচ্ছে আমাকে, বাঁ পায়ের বাঁদিকেও একটা যন্ত্রণা বাড়ছে, চলতে চলতে এক সময়ে সেলা লেকের সামনে এসে পৌঁছলাম, এইখানে সেলা পাসের গেট পর্যন্ত রাস্তা সমতল, গাড়িকে নিজের গতিতে গড়াতে দিয়ে অ্যাঙ্কল থেকে বাঁপাটা একবার ঘুরিয়ে দেখতে গেলাম, বিদ্যুতের শক লাগার মত একটা তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে, একা একাই হাল্কা চিৎকার করে উঠলাম।

ভেঙেছে? নাঃ, নিশ্চয়ই ভাঙে নি। হতেই পারে না, অত জোরে পড়ি নি, আর ভাঙলে আমি এইভাবে গাড়ি চালাতেও পারতাম না। জুতোটা একবার খুলে দেখব পা ফুলছে কিনা?

নাঃ থাক। দিনের শেষে আজ একটা মিলিটারি হাসপাতালে থাকার জায়গা জুটেছে, অদ্ভূত সমাপতন বলা যেতেই পারে, একদম সেইখানে গিয়ে দেখতে হবে।

সেলা পাসের পর রাস্তা বেশ ভালো, ক্লাচ আর ব্রেকের ভরসায় গাড়ি ফোর্থ, তারপরে ফিফথ গীয়ারে তুলে দিলাম অসীম যন্ত্রণা সহ্য করে। প্রতিবারে প্রায় চীৎকার করে ফেলছিলাম, ব্যথার চোটে তখন হাঁফাচ্ছি।

আমার আজ পর্যন্ত জীবনে কখনও হাড় ভাঙে নি, প্লাস্টার হয় নি, প্রত্যক্ষ সে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা নেই। মায়ের হাত ভেঙে যাবার পর দেখেছি, সিকিনীরও পড়ে গিয়ে ফ্র্যাকচার হবার পরে ফুলে যাওয়া পা দেখেছি, আমার পা-ও কি সেই রকম ফুলেছে? … আচ্ছা, লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলেও কি পা ফুলে যায়? প্লাস্টার হয়?

উচ্চতা কমছে, নামছি, নামছি, দিরাং এসে যাবে আর খানিক পরেই – মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা ঘুরছে, যদি মাইনর চোট হয়, তাতেও কি আমি আর এই পা নিয়ে আরও পঁচিশ দিন ঘুরতে পারব? আর যদি ফ্র্যাকচার হয়? কী করব? আমার তো কাল সকালেই সেপ্পা যাবার আছে, পরশু জিরো যাবার আছে। যাবো না? দুদিন রেস্ট নিয়ে পা সারিয়ে নিয়ে বেরোব? তা হলে তো প্ল্যানে আবার বদল আনতে হবে! … মোটরসাইকেলের কী হবে? যা-ই হোক, ক্রমশ বুঝতে পারছি, পায়ের যা অবস্থা, হয় লিগামেন্ট, নয় হাড় – কিছু একটা ড্যামেজ হয়েছে। হয় চিড় ধরেছে, নয় ভেঙেছে। একেবারে কিছু হয় নি, এমনটা নয়। কোনওরকমে চলছি, পৌঁছতেই হবে আরও পঁচাত্তর কিলোমিটার। এই রকমের ডাউনহিল হলে ব্যাপারটা খুব কষ্টকর কিছু নয়। কিন্তু তার পরে কী? কী করব? অন্তত গৌহাটি না পৌঁছলে তো মোটরসাইকেলের কোনও গতি করা যাবে না!

দিরাং তখন আর বারো কিলোমিটার, হেলমেটের মধ্যে আবার ফোন বাজল, গেছোদাদা। “কতদূর পৌঁছলে? সব ঠিকঠাক?” বলতেই হল যে, না, সব বোধ হয় ঠিকঠাক নেই, গাড়ি-লাগেজ-ক্যামেরা-হেলমেট সব অক্ষত থাকলেও বাঁ পায়ের পাতায় বেজায় চোট লেগেছে, এক একবার গীয়ার বদলাতে গেলেই মনে হচ্ছে পৃথিবী উলটে পড়ছে আমার ঘাড়ে, কোনওরকমে ক্লাচ-ব্রেকে সামলে চলছি, দিরাং আর বারো কিলোমিটার দূরে।

গেছোদাদা, অ্যাজ এক্সপেক্টেড, শুনে পুরো চমকে চ। বাকি পথটাও আমি টেনে দিতে পারব জেনে আশ্বস্ত হয়ে বলল, তুমি পৌঁছও, আমি ঐ হাসপাতালেই বলে রাখছি, পৌঁছনোমাত্র তোমার পায়ের যত্ন নেওয়া হবে – এক্সরে ইত্যাদি করে যা দরকার, ওখানেই করে দেওয়া হবে। ওখানে অর্থোপেডিক সার্জন আছেন, আমি চিনি, আমি খবর দিয়ে রাখছি। তুমি শুধু ওখানে গিয়ে আমাকে একবার ফোন করে জানাবে।

কথা বলতে বলতেই আরও কিলোমিটারদুয়েক পেরিয়ে এলাম। দিরাং গ্রাম চলে এল একটু পরেই, সেই হোমস্টে-ও পেরিয়ে গেলাম যেখানে আসার দিন থেকেছিলাম, পরের স্টপেজ বমডিলা।

রাস্তা নিচের দিকেই নামছে – ডিসেন্ড, কিন্তু মাঝেমধ্যে একটু অ্যাসেন্ডও আছে বৈকি। দূর থেকে দেখতে পেলে ক্লাচ ব্রেকের সহায়তায় ফিফথ গীয়ার দিয়েই ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে স্পিড বাড়িয়ে নিচ্ছি, কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আর পারলাম না। সামান্য একটা স্ট্রেচ, সেখানে রাস্তাটা একটু খাড়াই উঠে গেছে একটা বাঁকের মুখ থেকে, ক্লাচ আর সামলাতে পারল না, গাড়ি গেল বন্ধ হয়ে।

কিচ্ছু করার নেই, আবার সেই অমানুষিক যন্ত্রণা সইতে হবে। সময় নিয়ে, একটা একটা করে গীয়ার নামালাম, ফার্স্ট গীয়ার পর্যন্ত। গীয়ার ডাউন করা তাও সহজ। আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু একটু করে এগোলাম, আবার একটা একটা করে গীয়ার আপ, পায়ের পাতা মনে হচ্ছে কেউ ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে, ঘাম জমে গেছে সারা শরীরে।

রূপা পৌঁছলাম বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ, এর মাঝে গাড়ি আরও দুবার এরকম বন্ধ হয়ে গেছে চড়াইয়ের মুখে, আর প্রত্যেকবারই আমাকে এই রকম যন্ত্রণা সহ্য করে একটা একটা করে গীয়ার আপ করতে হয়েছে।

রূপা পৌঁছে ম্যাপ ফলো করতে করতে পৌঁছলাম একটা নদীর ওপর ছোট্ট ব্রিজের ধারে, ফোর্থ গীয়ারে আছি, থামা যাবে না, গীয়ার নামানো ওঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অন দ্য মুভ বুঝতে পারছি না, ব্রিজ পেরিয়ে অন্য দিকের রাস্তা নিতে হবে, না নদী বরাবর এদিকের রাস্তা ধরেই যাব। যা থাকে কপালে, ভেবে নদী পেরিয়েই গেলাম, খানিক এগোতেই দেখলাম জিপিএস ঘেঁটে গেল, এবং আগের “বারো কিলোমিটার বাকি” বদলে গিয়ে দেখাতে থাকল “চোদ্দ কিলোমিটার বাকি”।

গেলাম প্রায় দুই কিলোমিটার – মাঝে এক জায়গায় বাঁদিকে টার্ন দেখাচ্ছে, কিন্তু সেখানে কোনও বাঁদিকের রাস্তাই নেই, ঝোপজঙ্গল। পৌনে চারটে বেজে গেছে, দিনের আলো কমে আসছে দ্রুত। কী করা যায়? … একটু পেছনেই একটা মিলিটারি এসট্যাবলিশমেন্ট পেরিয়ে এসেছি, মাত্র দুশো মিটার পেছনে, ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করব?

মোটরসাইকেল ঘোরালাম, বাঁ পা মাটিতে রাখলেই অল্প যন্ত্রণা হচ্ছে, যতটা সম্ভব ডানপায়ের ওপর ভর রেখে ঘোরালাম। সমস্যাটা জন্মগত। আমি লেফটি, বাঁ-হাতি। যদিও ছোটবেলায় “মা-সরস্বতী নাগ কব্বেন” এই অজুহাতে আমাকে জোর করেই ডানহাতে লেখা শেখানো হয়েছে, তাই লেখা বাদে বাকি সমস্ত কাজই আমি বাঁ-হাতে এবং বাঁ-পায়ে সামলে থাকি, ফলে আমার ডান হাত এবং ডান পা বাঁ-দিকের তুলনায় একটু কমজোরি। যাই হোক, ফিরে গেলাম সেই মিলিটারি এসট্যাবলিশমেন্টের সামনে। রাজপুতানা রাইফেলস, নাকি রাজস্থান রয়্যালস, কিছু একটা নাম লেখা ছিল গেটে। সামনে সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করাতে সে ডাহুং মিলিটারি হসপিটাল চিনতে পারল না, বলল, এদিকে তো কিছু নেই, সে তো নদীর ওপাড়ে।

গেছোদাদাকে ফোন করলাম, বললাম, একটু কথা বলে বুঝিয়ে দাও কোথায় আছি, আর এখান থেকে কীভাবে যেতে হবে। গেছোদাদার বোধ হয় সেদিনকার কাজকর্ম আমি একাই চৌপাট করে দিয়েছিলাম। সে ধৈর্য ধরে সেন্ট্রির সাথে কথা বলল, বুঝল অবস্থানটা। প্রতিটা মিলিটারি হাসপাতালেরই একটা নম্বর আছে, সেই নম্বরই মূলত রেফার করে আর্মির লোকজন, নম্বর বলতেই সেন্ট্রি বুঝে গেল, হাঁজি হাঁজি, ম্যায় ইনকো সমঝা দেতা হুঁ, জয়হিন্দ সার, বলে ফোন আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, যে রাস্তায় এসেছেন, সেই রাস্তায় ফিরে যান, নদী পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা নেবেন (মানে এদিক থেকে দেখলে, আমি নদীর ওপাড়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে এসেছি, আমার উচিত ছিল ব্রিজ না পেরিয়ে সোজা এগিয়ে যাওয়া নদী বরাবর)।

সেন্ট্রিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ফেরার রাস্তা ধরলাম। শেষবারের মত দাঁতে দাঁত চেপে একটা একটা করে গীয়ার তুলতে হল, কিচ্ছু করার নেই। আমার জার্নি মনে হচ্ছে এখানেই শেষ হল, মনকে তৈরি করছি ডাক্তারের মুখ থেকে সেই কথাটা ফাইনালি শোনার জন্য। ভেবেছিলাম জিরোতে পৌঁছলে হয় তো ভালো না-লাগার ব্যামোটা কাটবে, জিরো ভ্যালি শুনেছি খুব, খুব সুন্দর, যাওয়া হবে না তা হলে?

জিপিএস আর ভুল করল না, নদী পেরিয়ে ডানদিক নিতেই আবার সোজা রাস্তা দেখাতে থাকল, আর এই রাস্তা পুরোটাই ডিসেন্ডিং, ফলে চালাতে তেমন কোনও অসুবিধে হল না, একদম সোজা সেই মিলিটারি হাসপাতালের গেটে এসে দাঁড়ালাম, সামনের তোরণে বড় বড় করে লেখা হাসপাতালের নাম আর নম্বর। সেন্ট্রিকে বললাম, আমার আজ এখানে থাকার কথা আছে, সিও কর্ণেল আগরওয়ালের গেস্ট …

সেন্ট্রি শুধু জিজ্ঞেস করল, আপ কা নাম? নাম বলতেই বলল, সিধা চলা যাইয়ে, অফিসার্স ক্লাব আছে সামনে, ওর পাশেই গেস্ট হাউস। আড়চোখে দেখলাম, সেন্ট্রির হাতে একটা চিরকুট, তাতে আমার নাম আর গাড়ির নম্বর লেখা।

দিনের আলো তখন শেষবারের মত দেখা যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার জাঁকিয়ে বসছে চারদিকে, মোটরসাইকেল ফার্স্ট গীয়ারে রেখেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সামনে। একটা তিনমাথার জংশন, সেখানে একটা বোর্ডে লেখা – অনেককিছুর সঙ্গে – অফিসার্স মেস। ক্লাব তো কিছু দেখলাম না।

জশবন্ততগড়ের পর এই প্রথম, একশো পঞ্চান্ন কিলোমিটার চালাবার পর, মোটরসাইকেলের সাইড স্ট্যান্ড নামালাম। মোটরসাইকেল থেকে নামতে সাহস করলাম। নামতে হবে সেই বাঁদিক দিয়েই – কারণ সাইড স্ট্যান্ডটা বাঁ দিকেই। কোনও রকমে তো নামলাম, দাঁড়াতে গিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বাঁপায়ের পাতায় জোর পাচ্ছি না। যদিও জুতোর ভেতরে আঙুল বাঁকাতে পারছি, কিন্তু পায়ের পাতা বাঁদিকে মুড়তে গেলেই প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে। এখনও শিওর নই, হাড় ভেঙেছে, নাকি লিগামেন্ট ছিঁড়েছে।

কিন্তু, কাউকেই তো দেখছি না কোথাও – কীভাবে মিস্টার আগরওয়ালের সাথে দেখা করব?

গেছোদাদাকে আবার ফোন লাগালাম – গেছোদাদা আরেকজনের নাম নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি গুরলীনকে ফোন করছি, সে এসে তোমাকে গেস্টহাউসে বা ডাক্তার দেখাবার জন্য নিয়ে যাবে। তুমি ওখানেই দাঁড়াও।

একটা লোক সেই সময়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, অল্পবয়েসী ছেলে, সম্ভবত এই হাসপাতালেরই কেউ, ডাক্তার বা অন্য কোনও আর্মির লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আগরওয়ালজির গেস্ট হয়ে এসেছি, পায়ে চোট লেগেছে রাস্তায়, এখানে কোথায় গেস্টরুম, কোথায় ডাক্তার বসেন, কিছুই জানি না – একটু কোনও ভাবে হেল্প করতে পারবেন?

লোকটার, শুনেই কেমন থমথমে মুখ হয়ে গেল। উনকো পতা হ্যায় আপ আ গয়ে হো?

বললাম, না, তাও জানেন না, আমি আসব, এটুকুই উনি জানেন শুধু।

– তা হলে এইখানেই ওয়েট করুন, যতক্ষণ না উনি কাউকে পাঠান, গেস্টরুম এইদিকে, … বলে একটুখানি পজ দিয়ে …, আগরওয়ালজি নেহি, উনকো কর্ণেল আগরওয়াল বুলাতে হ্যায় হম। কর্ণেল আগরওয়াল বোলা কিজিয়ে।

উফ্‌ফ্‌ এই আর্মির ব্যাগেজ! কর্ণেল বলি নি বলে গোঁসা হয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই, এক ঠ্যাং খোঁড়া এখন। চুপ করে হজম করলাম, লোকটা ট্র্যাকসুট পরে ছিল, সান্ধ্য জগিংয়ে বেরিয়েছিল হয় তো, সে চলে গেল আমাকে ফেলে, আমি তখন হুব্বা হয়ে ভাবছি এইবারে কাকে ডাকা যায় – ঠিক তক্ষুনি দুটি লোক সমেত একজন পরমাসুন্দরী মহিলা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি সিকি?

হাতে চাঁদ পেলাম। সঙ্গের দুজন লোকের একজন একটা চেয়ার নিয়ে এল, বসলাম, বৃত্তান্ত বললাম, মহিলাটির নামই গুরলীন, সে বলল – অ্যাম্বুলেন্স আসছে, আপনি বসুন, এরা আপনাকে এক্সরের জন্য লেখাতে নিয়ে যাবে। জুতো খুলতে পারবেন?

জুতো খুলতে তেমন সমস্যা হল না, বাঁ পায়ের জুতো খুললাম, মোজা খুলতে চোখে দেখে বুঝলাম, পায়ের পাতা পুরো ফুলে গেছে, সামনে থেকে পেছনে গোড়ালি পর্যন্ত। লোকদুটোই বলল, আপনার বাইকের চাবি দিন, আমরা লাগেজ খুলে সব আপনার ঘরে রেখে দিচ্ছি, আপনি এক্সরে করিয়ে এসে ঘরে রেস্ট করুন।

অলিভ সবুজ রঙের একটা প্রকাণ্ড ট্রাক এসে দাঁড়াল। ওটাই অ্যাম্বুলেন্স, তাতে ওঠার খাড়াই খাড়াই তিনটে সিঁড়ি। আমি ওঠার মত অবস্থায় নেই – অতএব, সঙ্গের লোকদুজন আমার সহায় হল। জীবনে প্রথম কারুর কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করছি, চূড়ান্ত অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু আপাতত আমি নিরুপায়। হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠলাম অ্যাম্বুলেন্সরুপী ট্রাকে। ট্রাক হাসপাতাল কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে বাইরের রাস্তায় পড়েই সামনের আরেকটা বিল্ডিংয়ে ঢুকল। এইখানে অর্থোপেডিক ডাক্তার বসেন। সঙ্গের লোকদুটির একজন আমার জন্য ফাইল বানিয়ে দিল, খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ডাক্তারের কাছে গেলাম, ডাক্তার খুবই সদাশয় টাইপের ব্যক্তি, কীভাবে দিল্লি থেকে কতদিনে এসেছি, কোথায় কোথায় গেছি, কোথায় কোথায় যাবার প্ল্যান ছিল – সবই জানলেন, জেনে এক্সরে-র জন্য লিখে দিলেন।

এক্স-রে হবে মিলিটারি হাসপাতালে, যেখান থেকে আমি এলাম। অতএব, বাইরে এসে আবার ট্রাকে চড়ে বসা, ফিরে এসে আবার নামা, এইবারে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এক্স-রে রুম অবধি পৌঁছনো। সেখানে পায়ের পাতা বেঁকিয়ে মুড়িয়ে চার রকম পজিশনে ছবি তোলা হল। প্লেট দেখে বলল, হ্যাঁ, সামান্য ভেঙেছে তো বটেই।

xray

ট্যালাস নামে যে হাড়টা, পায়ের গোছের দুদিকে গোল গোল শেপে বোঝা যায় – বাঁ পায়ের বাঁদিকে সেইটা হাল্কা করে একটা চাকলা ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে।

বুঝলাম, আমার এবারের জার্নির লজিকাল এন্ড। এক্স রে নিয়ে আবার গিয়ে বসলাম অ্যাম্বুলেন্সে, অন্য বিল্ডিংয়ে সেই ডাক্তার আবার দেখলেন, বললেন, ফ্র্যাকচার একটা নয়, দুটো, বুড়ো আঙুলের যে হাড়টা, মেটাটারসাল বোন, সেটা দ্বিতীয় আঙুলের হাড়ের সাথে যেখানটায় জুড়ছে, সেইখানেও একটা চিড় ধরেছে। খানিকক্ষণ চিন্তা করে ডাক্তার বললেন, দুটো হাড়ই সেই অর্থে মুভমেন্ট হয় না, আর খুব, খুবই মাইনর ফ্র্যাকচার, ওভার দা টাইম ঠিক হয়ে যাবে, তো আমরা প্লাস্টার করছি না – একটা স্ল্যাব লাগিয়ে দিচ্ছি। ঠিক হয়ে যাবে ওতেই।

আবার অ্যাম্বুলেন্সে বসা, আবার ফিরে আসা মিলিটারি হাসপাতালের বিল্ডিংএ। খানিকটা প্লাস্টারের মতই দেখতে, একটা স্ল্যাব লাগিয়ে দেওয়া হল, মূলত আমার পা-টাকে জ্যাম করে দেওয়া হল, যাতে মুভমেন্ট না হয়।

এইবারে হুইলচেয়ার। গুরলীন আবার ফিরে এসেছে, সাহায্যকারী লোকদুজনের একজনই তখন ছিল, সে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে ঠেলতে ঠেলতে আমাকে নিয়ে চলল গেস্টরুমের দিকে। পথটা খাড়াই, ঠেলতে একটু কষ্টই হচ্ছিল লোকটার, আর আমি অপরাধবোধে একেবারে মরে যাচ্ছিলাম। এঃ, কারুর সাহায্যে চলবার অভ্যেস যে আমার একেবারে নেই। মাঝে একটা জায়গায় – ঠেলা যাচ্ছিল না বলে আমি এক পায়ে উঠেই পড়লাম হুইলচেয়ার থেকে, তুমি ভাই এগিয়ে নাও, আমি তারপরে বসছি। সে লোকটা হাঁইহাঁই করে আবার আমাকে রিকোয়েস্ট করে বসিয়ে দিল চেয়ারে।

যাই হোক, পৌঁছলাম গেস্টরুমে। পোর্টাকেবিন স্টাইলে বানানো সুবিশাল একটা রুম। তাতে বিশাল বিছানা, একপাশে সোফাসেট, টিভি, বাথরুম। আমার মোটরসাইকেল থেকে সমস্ত লাগেজ আর প্রথমে খোলা বাঁ-পায়ের একপাটি জুতোমোজা পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখা ঘরের এককোণে। টেবিলের ওপর চাবিটা রাখা। গেস্টরুমের সামনেই পার্ক করা মোটরসাইকেল।

আপাতত এক রাত নয়, অন্তত দু-তিন রাত তো থেকে যেতেই হবে। জীবনে প্রথম পায়ের প্লাস্টার জাতীয় কিছু লাগবার অভিজ্ঞতা। অবশ্য এটা “কাস্ট” নয়, “স্ল্যাব”।

সিকিনীকে মেসেজ করে বললাম, রূপা পৌঁছে গেছি, এখানে নেটওয়ার্ক খুব খুব খারাপ। কাল সকালে আবার মেসেজ করে জানাব।

গেছোদাদা প্রথম দিনের জন্য এলাহি ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছে। খানিক বাদেই এসে গেল একথালা পকোড়া আর চা। ডিনার আসবে একটু পরে। তবে খাবারের দিকে মন নেই … জানি না, এর পর কী হবে। অনেক, অনেক চিন্তা মাথার মধ্যে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে।


2 thoughts on “অরুণাচলের দেশেঃ অষ্টম পর্ব

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.