পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার অভ্যেস আমার একেবারেই নেই, এবারে সে অভিজ্ঞতাটাও হয়ে যাবে।
আজ শনিবার। ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত শনিবার ভোররাতে আমি দিল্লি থেকে বেরিয়েছিলাম। আজ অষ্টম দিনে, আমি মিলিটারি হাসপাতালের গেস্টহাউসের ঢাউস খাটে শুয়ে। ওঠবার তাড়া নেই। সেপ্পা যাবার ছিল – আর যাবার নেই। দীর্ঘ এক বছর ধরে বানানো ইটিনেরারি – আপাতত মূল্যহীন। অ্যালার্ম বন্ধ করে রেখেছি। কিন্তু অভ্যেসের বশেই সকাল সাড়ে পাঁচটায় চোখ খুলেছে।
পায়ে এমনিতে কোনও ব্যথা নেই। কোনও আলাদা অনুভূতি নেই, কেবল স্ল্যাব জড়ানো আছে, ঐ প্লাস্টারের মতই, পায়ের ডগা থেকে হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত, তাই যেটুকু সমস্যা হাঁটতে চলতে।
কাল ডিনারের আগেই একটি ওয়াকার দিয়ে গেছে। একটা রুম হীটারও। এমন কিছু ঠাণ্ডা নেই যদিও, আর এই বিশাল ঘরে ঐটুকু রুম হীটার এমন কিছু গরমও করতে পারছে না। উঠে বন্ধ করলাম। এখন কী করা যায়?
ওয়াকার নিয়ে ব্যাগের কাছে গেলাম। টুথব্রাশ পেস্ট বের করে বাথরুমে গিয়ে দাঁত মাজলাম। ফিরে এলাম ওয়াকার ছাড়াই। ওয়াকারটা সুবিধের থেকে অসুবিধেই করছে বেশি – পা ফেলে হাঁটাটা বরং অনেক বেশি সুবিধেজনক।
টিং টিং টং করে একসাথে অনেকগুলো ঘণ্টি বাজল মোবাইলে। বোধ হয় অনেকক্ষণ নেটওয়ার্ক ছিল না, এইমাত্র এসেছে। খানিকক্ষণ বসে বসে মোবাইল ঘাঁটলাম। ঘরের কোণে টিভি আছে, টাটা স্কাইয়ের সেট টপ বক্স আছে। চালাতে গিয়ে খানিকক্ষণ নড়ানাড়ি করে বুঝলাম, প্লাগ পয়েন্টে সমস্যা আছে। যে কোনও একটা প্লাগ চলবে – হয় টিভি, নয় টাটাস্কাই। থাক।
বিছানায় ফিরে আসা। বসে থাকা। মোবাইলে দুচারটে বইয়ের পাতা এদিক ওদিক উল্টোনর চেষ্টা করা। বসে থাকা। ল্যাপটপ খোলা। নেটওয়ার্ক তো নেই, মোবাইলের নেটও তথৈবচ। ল্যাপটপে কিছু সিনেমা আছে। অনেকগুলোই দেখা। কিছু দেখা হয় নি।
সাড়ে সাতটায় চা দিয়ে গেল। এখানে সাহায্যকারী ছেলেটি খুব হাসিখুশি। সম্ভবত দক্ষিণ ভারতীয়। সকালে কী খাব জিজ্ঞেস করে, বেলা নটা নাগাদ জলখাবারও দিয়ে গেল। দুঃসংবাদটুকু হল এই, এখানে রোজ ননভেজ হয় না। আজ শনিবার, আজ রাতে হবে। দুপুরে হবে না। কালও হবে না। আবার হবে সোমবার রাতে।
পায়ে স্ল্যাব লাগানো থাকবে তিনদিন। শুক্রবার রাতে লেগেছে, মানে সোমবার খুলবে। মানে তিনদিন তো থাকতে হবেই।
এইভাবেই দিন কাটল। দুপুরে খাবার দিতে আসার সময়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে একটা পলিথিন প্যাকেট চেয়ে নিলাম, পা ঢাকতে হবে চান করার আগে। চান করতে গিয়ে দেখলাম, বাথরুম আছে, বালতিতে জল আছে, কলেও জল আছে, সামনে একটা ইমারশন রড ঝুলছে, কিন্তু বাথরুমে বা আশেপাশে কোথাও কানেকশন নেই ওটা লাগাবার জন্য। মানে, জল গরম করতে হলে ওটা নিয়ে আসতে হবে ঘরের ভেতর, যেখানে হীটার চলছিল, সেইখানে বালতি রেখে তাতে ইমারশন রড ডুবিয়ে জল গরম করতে হবে, এবং হয়ে গেলে বালতিটাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে। আমার পক্ষে এক পায়ে এসব করা একেবারেই সম্ভব নয়, অতএব, ছেলেটিকে আবার ডাকতে হল। সে সমস্ত করে দিল, তারপরে আমি পায়ে পলিথিন গলিয়ে, তার ওপরে বানজি কর্ড কষে বেঁধে তোফা চান করলাম।
গেছোদাদা ফোন করল, বললাম সমস্ত বৃত্তান্ত, বলল, দাঁড়াও, আমি ওখানকার সার্জনের সাথে কথা বলে তোমাকে গৌহাটি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। ওখানে থেকে এমনিতেই তুমি বোর হয়ে যাবে, দিনের অর্ধেক সময়ে নেটওয়ার্ক থাকে না।
সন্ধে সাড়ে সাতটার সময়ে লাইট চলে গেল, মোবাইলে নেট তো পরের কথা, সিগন্যালও চলে গেল, আমি ভূতের মত একলা বসে রইলাম ঘরের মধ্যে। আক্ষরিক অর্থে কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই। মোবাইল খুলে একটা বই পড়তে লাগলাম। সাড়ে আটটায় লাইট এল, রাতের খাবার এল, চিকেন সমেত, দশটার সময়ে মোবাইলের টাওয়ার ফিরে এল, কিন্তু নেট নেই তখনও। একটু বাদে খানিকক্ষণের জন্য নেট এল, একসাথে অজস্র হোয়াটস্যাপ মেসেজ ঢুকল, এবং পড়তে পড়তেই নেট চলে গেল আবার। অফিস থেকে আয়ুষ আবার মেসেজ করেছে, সে “ডিসকাস” করতে চায়, কখন কথা বলতে পারি। উত্তর দিলাম, যখনই আমার ফোনে কানেক্ট করতে পারবে, কল কোরো। সেই মেসেজটাও গেল না।
খেয়ে উঠে খানিক আবার বই পড়ার চেষ্টা করলাম, এগোতে পারলাম না একটুও। মন বসছে না। ল্যাপটপ খুলে একটা পুরনো সিনেমা চালালাম – পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস। ক্রিস গার্ডনারের নিজের জীবনের ওপর লেখা বিখ্যাত বইয়ে ক্রিসের চরিত্রে উইল স্মিথের অনবদ্য অভিনয়।
একটা দিন শেষ হল।
রবিবার। পরের দিন। আজ আমার জিরো পৌঁছবার দিন ছিল, কিন্তু ওসব এখন আর ভেবে লাভ নেই। অলস মুহূর্তগুলির প্রতিটা ঘণ্টার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েও লাভ নেই। বিকেলে পৌঁছলাম প্লাস্টার রুমের কাছে, যেখান থেকে পরশুদিন হুইলচেয়ারে করে ফিরেছিলাম। হেঁটে হেঁটেই পৌঁছলাম, ওয়াকার ছাড়াই, খুব একটা কিছু অসুবিধে হল না। স্ল্যাব কাটিয়ে দেখলাম, পায়ের ফোলা অনেকটাই কমেছে, তবে পুরোপুরি কমে নি। সার্জন এক্স রে দেখে সকালেই জানিয়েছেন, এমন কিছু সিরিয়াস চোট নয়, প্লাস্টার না করলেও চলবে, ক্রেপ লাগিয়ে রাখলেও হবে, আর আমি নাকি চাইলেই মোটরসাইকেল চালিয়েই এখান থেকে গৌহাটি ফিরে যেতে পারি – খুব যদি অসুবিধে না হয়।
তা হচ্ছে, বিলক্ষণ হচ্ছে। এমনিতে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা ট্যথা কিছু নেই, কিন্তু মোটরসাইকেলের গিয়ার শিফট করার মত জোর এখনও নেই বাঁ পায়ের পাতায়। গেছোদাদার সাথে আবার কথা হল, বলল, চিন্তা কোরো না, ওদের ওখান থেকে গৌহাটিতে আমাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়মিত জিনিসপত্রের আসাযাওয়া চলে, কনভয় চলে, আমি এর মধ্যে আনিয়ে নেব, তুমি যতটুকু লাগেজ না হলে নয়, ততটুকু নিয়ে কাল গৌহাটি ফিরে আসার প্ল্যান করো। আমি খোঁজ নিয়েছি, কাল ভোর সাড়ে চারটেয় ওখান থেকে গৌহাটির জন্য কনভয় আসবে, তাতে একটা বাসও থাকবে, আমি বলে দিয়েছি তোমাকেও ওরা নিয়ে আসবে। এসে আমার বাড়িতে দু তিনদিন থেকে যাও, এখানে ভালো অর্থোপেডিক সার্জনকে আরেকবার দেখিয়ে নাও, তারপরে কী করা যাবে, সেটা এখানে বসে ডিসাইড করা যাবে।
খুবই ভালো কথা। গেস্টরুমে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিলাম। মোটরসাইকেলের চাবি হ্যান্ডওভার করে দিলাম গেছোদাদার কথামত একটা ছেলেকে। অল সেট।
সাড়ে দশটার সময়ে সেই চাবি নেওয়া ছেলেটি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, স্যর, আপনি কালকের বাসে সীট বুক করেছেন?
না! আমি তো কিছু জানি না! শুনলাম তো কনভয় যাচ্ছে, একটা মিলিটারি হাসপাতাল থেকে আরেকটা মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে টিকিট বুক করতে হয় নাকি?
হ্যাঁ স্যর। বুক না করলে তো আপনার নাম আসবে না। নাম না থাকলে তো আপনাকে উঠতে দেবে না!
আবার গেছোদাদাকে ফোন। আমার ফোনে তখন সিগন্যালও নেই, ছেলেটার মোবাইল থেকেই কল করতে হল। গেছোদাদা মনে হয় এই নিয়মটা নিজেও জানত না – সেই ছেলেটি আর গেছোদাদা মিলে খানিকক্ষণ খুব চাপানউতোর হল – এদিকে আমি অপেক্ষা করছি, শুতেই হবে, নইলে সওয়া তিনটেয় উঠতে পারব না, সাড়ে চারটের বাসে উঠতে পারব না।
খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর রাত এগারোটা নাগাদ সারমর্ম বেরোল, যে এখন, এত রাতে যে হেতু আর আমার নাম ঢোকানো যাবে না, তাই কাল আমার কনভয়ে যাওয়া হচ্ছে না। …তা হলে উপায়?
ছেলেটিই বলল, আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, এখান থেকে শেয়ারের টাটা সুমো যায়, তেজপুর বা গৌহাটির দিকে। আমরা আপনাকে সুমোতে বসিয়ে দেব, আপনি বসে চলে যাবেন। সকাল সাড়ে সাতটায় একটা সুমো পাস করে এখান দিয়ে। আপনার জায়গা হয়ে যাবে।
সে সুমো কি গৌহাটি অবধি যাবে?
গৌহাটি অবধি সরাসরি গাড়ি এখান থেকে পাওয়া মুশকিল, তবে তেজপুর অবধি পাওয়া যায়। তেজপুর থেকে পরের সুমো বা বাস ধরে আরামসে গৌহাটি যাওয়া যেতে পারে।
তাই হোক। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার অভ্যেস আমার একেবারেই নেই, এবারে সে অভিজ্ঞতাটাও হয়ে যাবে।
পিঠের ব্যাগ, আর দুখানা স্যাডল ব্যাগে সমস্ত দরকারি জিনিসপত্র, জামাকাপড় ইত্যাদি ভরে নিলাম। রেখে যেতে হল হেলমেট, টেন্ট, আর টেল ব্যাগে ভরা কিছু তত-প্রয়োজনীয়-নয় জিনিসপত্র। সেগুলো পরে আসবে।
সোমবার ভোরবেলা উঠে ব্যাগপত্র নিয়ে ছেলেটির সহায়তায় মেনগেট পর্যন্ত পৌঁছলাম। গেস্টরুমের সামনে অসহায়ের মত আমার মোটরসাইকেল পড়ে রইল। শেষবার একবার তাকিয়ে দেখলাম, কীভাবে আসবে, কবে আবার তাকে দেখতে পাব, জানি না।
ঠিক সাড়ে সাতটায় গেটের সামনে একটা টাটা সুমো এসে দাঁড়াল। তাতে অলরেডি কিছু সওয়ারি বসে, আমার জায়গা হল ড্রাইভারের পাশের সীটটিতে।
গাড়ি চলল তেজপুরের দিকে। এইবারে উল্টোরাস্তা – এটা কালাকটাংএর রুট নয়, এটা ভালুকপং রুট। প্রায় পুরোটাই ডাউনহিল, সুন্দর চলছে সুমো, আর তার ভেতরে তারস্বরে বাজছে চেনা-অচেনা বিভিন্ন রকমের হিন্দি গান। একটা গানের লাইন আমার আজও মনে আছে – তেরি মা কি, তেরি মা কি, তেরি মা কি পূজা করুঙ্গা ইয়ার। কখনও শুনি নি এর আগে এমন গান।
বেলা বারোটা নাগাদ ঢুকে গেলাম তেজপুরের একটা বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে সিক্সটিন সীটার বেশ কতকগুলো বাস দাঁড়িয়ে ছিল। ডাহুং মিলিটারি হসপিটালের গেটেই সুমোর ড্রাইভারকে আমার পায়ের চোটের ব্যাপারে বলে রাখা ছিল, তাই সে নিজেই গৌহাটির বাসে আমার লাগেজ তুলে দিল। আমি ধীরেসুস্থে টিকিট কেটে উঠে দেখলাম, যাতায়াতের প্যাসেজ পুরোটাই ব্যাগে সুটকেসে ভর্তি, সেসব মাড়িয়ে একদম পেছনের রো-তে একটা সীট বেঁচে আছে। পুরো দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার কেস। ভাঙা পা নিয়ে পেছনের দিকে যাওয়া সম্ভব কিনা, ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, সত্যিই পৌঁছে গেছি পেছনের দিকের সীটে। পা জুতোয় ঢাকা, সেটা খানিকটা কুশনের কাজ করছিল সম্ভবত, মামুলি ব্যথার বাইরে আর কিছু হল না।
সকাল থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয় নি। ছটার সময়ে ব্রেকফাস্ট এনে দিয়েছিল মিলিটারি হসপিটালের সেই ছেলেটি, সেই শেষ। বেলা একটার সময়ে বাস গড়াল তেজপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে। মাঝে একটা জায়গায় থামল, পাশের সীটে বসা ছেলেটি প্যাসেজের ঐসব গন্ধমাদন টপকে নামল, তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট চিপ্স আর একটা জুসের প্যাকেট কিনে নিয়ে খেলাম। বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ গৌহাটি স্টেশনের কাছে একটা গলিতে বাসের জার্নি শেষ হল, সেখান থেকে একটা উবের ধরে আরও চল্লিশ মিনিট বাদে গেছোদাদার বাড়ি। দূরত্ব খুব বেশি কিছু নয়, কেবল স্টেশন এলাকা – যার নাম পল্টন বাজার – সেখানে জ্যাম ছিল প্রচণ্ড, সেখান থেকে বেরোতেই মিনিট পনেরো লেগে গেল।
এর পর? এর পর আর খুব বেশি কিছু বাকি থাকার কথা নয় – মিলিটারি হাসপাতালে কদিন ভেজ খাবার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়ে গেছোদাদার বাড়িতে কদিন দুবেলা চিকেন মাছ ইত্যাদি প্যাঁদালাম। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চমৎকার লন-ওলা কোয়ার্টার, পেছন থেকেই পাহাড় জঙ্গল শুরু, সামনের দিকে জিম, মার্কেট এরিয়া, সিনেমাহল সবই আছে, তার চেয়েও বড় কথা, মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের সিনেমাহলএ সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজে না। ফাঁকা হলএ বসে আরাম করে একদিন মুল্ক দেখলাম। যেদিন পৌঁছেছিলাম, তার পরের দিন সকালেই গৌহাটির মিলিটারি হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জনকে দেখানো হল, তিনি এক্স রে দেখেই বললেন, ফ্র্যাকচার যখন হয়েছে, প্লাস্টার লাগিয়ে নেওয়াই উচিত। তা, এখানে লাগালে তোমার মোবিলিটি কমে যাবে, এক কাজ করো, যত তাড়াতাড়ি দিল্লি ফিরে যাও, ফিরে গিয়েই কাস্ট – মানে প্লাস্টার – লাগিয়ে নিও। দুদিন পরের টিকিট বুক করে আড়াই দিনের জন্য গেছোদাদার অতিথি হয়ে বসে রইলাম।
অলস সময়, অঢেল সময়।
এইভাবে কোনও জার্নি শেষ হয় নি এর আগে। এই প্রথম। এটাও এক রকমের অভিজ্ঞতা। তাওয়াং সার্কিট আমার প্ল্যানে ছিলই না – শেষ মুহূর্তে ঢুকিয়েছিলাম। যদি না ঢোকাতাম … তাতেও কি বাকি ঘোরাটা ঠিকঠাক হত? মন বসছিল না কিছুতেই। কী ভুল হচ্ছিল? আমি তো ফিরে যাব দিল্লি, আর দুদিনের মধ্যেই। কিন্তু পুরো ট্রিপ তো বাকি রয়ে গেল – আবার প্ল্যান করতে হবে, এইভাবেই প্ল্যান করব? নাকি অন্যভাবে?
বড় হেকটিক হয়ে যাচ্ছিল এবারের জার্নি। বিশ্রামের সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। এর পর প্ল্যান বানালে আরও স্টপওভার রাখতে হবে – আরও বিস্তৃত প্ল্যানিং বানাতে হবে। জায়গার ওপর মন বসবার জন্য সময় দিতে হবে। স্রেফ সন্ধেবেলায় এলাম, আর পরদিন সকালবেলায় বেরিয়ে গেলাম, এইভাবে কি ভালোলাগা জন্মানো যায়? … যে আমি বলতাম, গন্তব্য নয়, জার্নিটিই আসল, সেই আমিই বোধ হয় এবারে খুব বেশিমাত্রায় গন্তব্যমুখী হয়ে যাচ্ছিলাম। সকালে স্টার্ট করে, এত কিলোমিটার চলে, এই জায়গায় সন্ধের মধ্যে পৌঁছতেই হবে। শুরুর দিকে এইটা খুব চ্যালেঞ্জিং লাগত, কিন্তু এখন আর এতে উত্তেজনা আসছে না। সকালে স্টার্ট করলে রাস্তার অবস্থা অনুযায়ী সন্ধ্যের মধ্যে একটা দূরত্ব পৌঁছনোই যায়, এটা আর তেমন কোনও বড় কথা নয়, কিন্তু নিজের সাথে সময় কাটানোর সময় দিই নি আমি।
যদিও জানি, এর কোনওকিছুই আমার দুর্ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। ওপরে লেখা সবকিছু মেনে চললেও এই অ্যাক্সিডেন্ট হতেই পারত, এটা নিতান্তই একটা অ্যাক্সিডেন্ট, বাই চান্স, তবু বার বার মনে হচ্ছিল, এটা হয়ে হয় তো একদিক দিয়ে অন্যরকম ভালোই হল। নিজের মুখোমুখি হতে পারলাম।
নিজের মুখোমুখি।
অনেক প্রশ্ন। অনেক ধূসরতা। উত্তর খুঁজতে হবে আমাকেই। খুঁজে চলা একটা প্রক্রিয়া।
শেষ সন্ধেয় গেছোদাদার সাথে গেলাম শঙ্করদেব কলাক্ষেত্র মিউজিয়াম। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে আসাম অঞ্চলের খ্যাতনামা স্কলার, কবি, নাট্যকার, সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। মূলত আসামে ভক্তিবাদের প্রবর্তক ইনি, বাংলার যেমন শ্রীচৈতন্য, এঁর লীলাক্ষেত্র ছিল মাজুলি দ্বীপ, পরে এই ভক্তিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র আসাম উপত্যকায়। শঙ্করদেবের আগে আসামের বিভিন্ন জাতি উপজাতির কোনও সম্মিলিত জাতিসত্ত্বা ছিল না, ইনিই প্রথম অসমীয়া জাতিসত্ত্বাকে একত্রিত করেন। সারা জীবন ধরে তিনি অসংখ্য কবিতা, নাটক, অনুবাদ, ব্যাখ্যা, টীকা ইত্যাদি লিখে গেছেন অসমীয়া, সংস্কৃত, এবং ব্রজবুলি ভাষায়। সে এক বিশাল কালেকশন, এবং মজার ব্যাপার হল এই কালেকশন আজও এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। সংরক্ষণাগারের দায়িত্বে থাকা দিদিমণিকে অনুরোধ করলে তিনি সেই পুঁথি বের করে দেন উৎসাহী পাঠকের হাতে। গাছের ছালে কালিতে লেখা পুঁথি, লাল শালুতে মোড়া।
সন্ধেটা শেষ হল চমৎকার পাটিসাপটা ভরপেট খেয়ে। আসামের পাটিসাপটা যে এত সুস্বাদু, জানা ছিল না।
বৃহস্পতিবার ভোরবেলার ফ্লাইটে দিল্লি, বাড়ি ফিরেই প্রথম হাসপাতালে গিয়ে পায়ে প্লাস্টার, শুক্রবার থেকেই অফিসে জয়েন। অফিস আমায় বিনা ভেসে যাচ্ছিল কিনা। গিয়ে হাল ধরে বুঝলাম জল আসলে গভীর ছিল না। সে যাক।
মোটরসাইকেল পরের সপ্তাহে আর্মির কনভয়ে করে ডাহুং থেকে এসেছিল গৌহাটি, গেছোদাদার বাড়িতে, সেখান থেকে গেছোদাদার লোক সেটাকে ট্রেনে তুলে দেয়, আমি গিয়ে যখন নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে সেটাকে উদ্ধার করে আনি, তখন বসে আমি ষষ্ঠ পর্ব লিখছি। সে আরেক গল্প – অন্য কোনওদিন করা যাবে।
😩😩😢😢
LikeLike
তিনটে ভ্রমণ কাহিনী শেষ করলাম। অসাধারণ কথকী ভঙ্গি। বেশ হারিয়ে যাচ্ছিলাম অনেক অনেক দূরে ।
‘Destiny’ আর ‘journey’র দ্বন্দ্ব, ‘কী করছি – কেন করছি’ প্রশ্ন গুলো নিজেকে একবার আয়নায় পরখ করে নেয়। জীবনে কিছু পেলে যেমন পাওয়ার ইচ্ছে আরো বেড়ে যায়, লেখকের কাছে পাঠকের কিছু একান্ত দাবি থেকেই যায়। মনে হচ্ছিল, ‘ছিরিন’ কিংবা ‘নাথাং’-এর মেঘবালিকাদের যদি আরও একটু জীবন্ত দেখতে পারতাম। 🙏
LikeLike
মেঘবালিকাদের বেশি কাছে যেতে নেই … রূপকথারা হারিয়ে যায়।
দেখি, অসমাপ্ত জার্নি এ বছরের শেষদিকে করা যায় কিনা।
LikeLike
কি আর বলবো. কীই বা বলা যায়.!
অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে পরে গেলো। আমার অরুণাচল যাওয়ার গল্প, অনেক টা এভাবেই ফিরে আস্তে হয়েছিল। সেই কষ্ট এখনো লাঘব করতে পারিনি।
যাইহোক, গতকাল অফিস থেকে বেরোনোর সময় তোমার লেখা টা পড়তে শুরু করেছিলাম, যথারীতি বেরোতে দেরি হয়ে যায়। আজ আবার পুরো টা পড়ে শেষ করলাম কাজ শিকেয় তুলে রেখে।
তোমার লেখনী নিয়ে বলার কিছু নেই.
এভাবেই চালিয়ে যাও, আরো চলতে থাকো। Miles to go..
তোমার সাথে একবার ফোনে কথা হয়েছিল delhi তে থাকতে, সুযোগ হলে কখনো তোমার সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে রইল।
ভালো থেকো।
LikeLike
দিল্লি এলে যোগাযোগ কোরো।
LikeLike
বাইক আছে একখানা, বেরোনোর জগঝম্পও মজুদ। কুঁড়েমির জন্য অফিস ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়না। অগত্যা আপনার লেখাগুলোই ভরসা। ‘সর্ষেদানায় ইচ্ছেডানায়’ এর পরের বইটি কবে বেরুচ্ছে? অপেক্ষায় আছি।
LikeLike
পরের বই বেরোতে সময় লাগবে। এখনো একটা লম্বা বেড়ানোর প্ল্যান মেটেরিয়ালাইজ করে নি। ওটা হয়ে গেলেই …
LikeLike