ডিব্রুগড় রাজধানীর স্টপেজ থাকে নিউ আলিপুরদুয়ার জংশনে, এখন ট্রেনে যাওয়া না হলে, আপৎকালে উপায় একটিই থাকে, সেটা হচ্ছে ফ্লাইটের টিকিট কাটা। ফ্লাইট যাবে বাগডোগরা অবধি, সেখান থেকে শিলিগুড়ি এসে, সেইখান থেকে সম্ভব হলে ট্রেন ধরে বা বাস ধরে আলিপুরদুয়ার পৌঁছনো। শিলিগুড়ি থেকে একশো ষাট কিলোমিটার। কিন্তু আজকের টিকিট আজকে কাটতে গেলে যা হয়, সর্বত্র উরিত্তারা লেভেলের দাম। ভারতের সিভিল অ্যাভিয়েশনে দামের কোনও আপার লিমিট রাখার কন্ট্রোল আজও আছে কিনা জানা নেই, মোদ্দা কথা দুতিনটে সাইট খুঁজেটুজে দুপুরবেলার যে টিকিটটা কাটতে পারলাম, তার দামে আরামসে একটা সুন্দর স্মার্টফোন হয়ে যেতে পারে।
কী করব, ঠেলার নাম বাবাজী। কাটলাম সেই দামে টিকিট। এবং দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। দেড়টার ফ্লাইট দিল্লি থেকে, বাগডোগরা নামল বিকেল সাড়ে তিনটেয়।
চেকইন লাগেজ কিছু ছিল না, পিঠের ব্যাগটুকু নিয়েই হেলেদুলে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে বললাম, এনজেপি চলুন। বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে আলিপুরদুয়ার হয়ে আসামগামী পর পর ট্রেন আছে, একটাতে উঠে বসলেই হল। কিন্তু এয়ারপোর্ট চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চালাতে চালাতেই ড্রাইভার বললেন, আপনি শিলিগুড়ি স্টেশনেও যেতে পারেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন আছে আলিপুরদুয়ারের। তবে ওটা আলিপুরদুয়ার জংশন যাবে, নিউ আলিপুরদুয়ার নয়।
বেশ কথা। ছোট্ট টাউন আলিপুরদুয়ার, তাহার কীই বা নিউ, আর কীই বা জংশন। তবে, এটা কি সেই ট্রেন, যেটাতে একবার কলেজে পড়াকালীন গেছিলাম? ড্রাইভার বললেন, না, এটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, তবে ব্রডগেজের।
এর মাঝেই স্বরাজের ফোন এসে গেছে। আমি শিলিগুড়িতে নেমে স্টেশনের দিকে এগোচ্ছি জেনে আমাকে আলিপুরদুয়ারের হোটেলের ঠিকানা মেসেজ করে দিয়েছে, বলেছে, আমি সব বলে রেখেছি, গিয়ে চেক ইন করে নিস।
পৌনে পাঁচটায় পৌঁছে গেলাম তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের সামনে। শিলিগুড়ি স্টেশনটা এর ঠিক পেছনেই – কিন্তু সেই উনিশশো সাতানব্বই সালের পর আর এ চত্ত্বরে আসি নি, তাই স্টেশনটা লোকেট করতে একটু বেগ পেতে হল। সামনের রাস্তা একেবারে গাড়িঘোড়ায় জ্যামে ভরপুর, তার মধ্যে ইয়া ইয়া ঢাউস বাস বেরোচ্ছে ঢুকছে, কেউ যাচ্ছে কোচবিহার, কেউ বহরমপুর, কেউ কলকাতা তো কেউ গৌহাটি তেজপুর।
ঠিক পেছনেই শিলিগুড়ি স্টেশন, সামনের দিকের ভিড়ের এতটুকু লেশমাত্র নেই সেখানে, ঠিক শান্ত একটা মফস্সলি স্টেশন যেমন হয়, তেমন। টিকিট কাটলাম, ভারতীয় রেলের সৌজন্যে একশো ষাট কিলোমিটার দূরত্বের জার্নির জন্য আমাকে দিতে হল মাত্র পঁয়ষট্টি টাকা। সামনেই ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে,প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের এদিকে একটা সরু রেললাইন – মিটারগেজ রেল কি এখনও চলে?
ট্রেন ছাড়বে পৌনে ছটায়। প্ল্যাটফর্মে নেমে তাই একটু কেক বিস্কুট কিনে খানিক মুখে দিলাম, সেই সকাল দশটায় খেয়ে বেরিয়েছি। আমার সামনে এক নেপালী ফ্যামিলি তাদের বাচ্চাদুটিকে নিয়ে বসে আছে। সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে তার মা খুনসুটি করছে, এমনি সময়ে মিষ্টি একটা সিটি বাজিয়ে আক্ষরিক ঝিক্ঝিক্ ঝিক্ঝিক্ শব্দ তুলে আমার সামনে সেই সরু রেললাইন ধরে স্টেশনে ঢুকল নীল রঙের একটা ছোট্ট ট্রেন, তার বগিগুলোর গায়ে ইংরেজিতে লেখা ডি এইচ আর।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে! টয়ট্রেন!! দার্জিলিং থেকে এই নামল। আমি দার্জিলিং একবারই গেছি মা বাবার সাথে, তখন আমি ক্লাস থ্রি-তে পড়তাম, টয়ট্রেন চাপা হয় নি। ট্রেনের ছবি কেবলমাত্র আরাধনা সিনেমাতেই দেখেছি, আজ প্রথম ট্রেনটা চোখে দেখলাম। বাচ্চা কোলে নেপালী মা-ও খুব উত্তেজিত, বাচ্চাকে দোলাতে দোলাতে গান জুড়ে দিল, দার্জিলিং মা ট্রেন আয়ো ছ – এই রকম কিছু বলছিল।
পৌনে ছটার সময়ে ট্রেন নড়েচড়ে চলতে শুরু করল। এসব দিকে সব সিঙ্গল লাইন হয়। খানিক পরেই একটু একটু চড়াইতে উঠতে শুরু করল ট্রেন, আর তারপরেই এসে গেল সবুজ রঙের তিস্তা নদী। সামনে দেখা যাচ্ছে করোনেশন ব্রিজ, যাকে আমরা সেভক ব্রিজ বলে জানি, এই কমাস আগেই তো এ রাস্তা দিয়ে গেছি মোটরসাইকেল চালিয়ে, আজকে আমি ট্রেনের সওয়ারী।
সেভক ব্রিজ পেরিয়ে খানিক জঙ্গল, তারপরে ট্রেন আবার চলে এল সমতলে, দুদিকে চায়ের বাগান, আর দূরে নীলচে পাহাড়। কিন্তু সন্ধ্যেও হয়ে আসছে, বেশিক্ষণ আর বাইরের দৃশ্য উপভোগ করা গেল না। বাইরের দিক ছেড়ে অতএব ট্রেনের ভেতরে ঝালমুড়িওলার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। সামনে বসা নেপালী পরিবার খুব আনন্দে গান গাইতে গাইতে আর বাচ্চাকে আদর করতে করতে চলেছে, মোটামুটি যা বুঝলাম, এরা মাদারিহাট নামবে।
ট্রেন চলল কখনও থেমে, কখনও ছুটে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মাঝে মাঝে হঠাৎ সাদা এলইডির আলোয় ঝলমলে স্টেশনরা এসে পড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত, ট্রেন সেখানে থেমে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়। মাঝে একবার বি মজুমদারকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমি আজ রাতেই আলিপুরদুয়ার পৌঁছচ্ছি, কাল সকালে ওনাকে ফোন করে দেখা করব। উনি খুবই বিনীতভাবে বললেন, ঠিক আছে, আপনি আমাকে এগারোটার পরে কল করবেন, আমি আপনাকে মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যাবো।
ট্রেন চলেছে কুঝিকঝিকিয়ে। জায়গাগুলো সবই চেনা – চালসা, বানারহাট, নাগরাকাটা, বিনাগুড়ি, দলগাঁও – তার পরেই এসে গেল মাদারিহাট স্টেশন। নেপালী ফ্যামিলিটি নেমে গেল, কামরায় এখন গোনাগুণতি আটজন লোক, তারমধ্যে একজন চা কফি বিক্রেতা।
মাদারিহাটেই ট্রেন ঢুকেছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেটে, মাদারিহাটের পর ট্রেন গেল আরোই স্লো হয়ে। এখান থেকেই ট্রেন চলবে পুরো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, প্রথমে জলদাপাড়া, তারপরে বক্সার জঙ্গল। যখন তখন রেললাইনের ওপর হাতি উঠে আসার চান্স এখনও প্রবল, তাই ট্রেনকে চলতে হয় প্রায় হাঁটার গতিতে, এগারো কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। ঢিকঢিক করে ট্রেন এগিয়ে চলল নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে, মোবাইলে নেটওয়ার্ক এখনও আছে, স্বরাজকে একটা মেসেজ করে দিলাম, পৌঁছতে রাত্তির হবে। এমনিতেই এই ট্রেনের আলিপুরদুয়ার ঢোকার সময় রাত দশটা, লেট করে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা তো বাজবেই।
মোবাইল আবার বেজে উঠল, বি মজুমদার ফোন করেছেন। খুবই অ্যাপোলোজেটিক স্বরে বললেন, ভাইটি, কালকে না, হচ্ছে না, আসলে আপনি হয় তো জানেন না, আলিপুরদুয়ারের আনাচেকানাচে বিজেপি প্রচণ্ড সন্ত্রাস চালাচ্ছে – কুমারগ্রাম, হাতিপোতা এইসব গ্রামে, আমাকে তো, বুঝতেই পারছেন, কাল সারাদিন এইসব জায়গায় চক্কর কাটতে যেতে হবে, কালকের দিনটা পারব না, আপনি কাল বিশ্রাম নিয়ে নিন, আমি পরশু আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে কাজ করিয়ে দেব।
চিন্তা বাড়লেও হাসি চাপতে পারলাম না। তৃণমূলের কাউন্সিলর আজ বিজেপির সন্ত্রাসে চিন্তিত। আট বছর আগে “বদলা নয় বদল চাই” স্লোগান দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিজেরাই সেই সন্ত্রাস চালিয়েছিল এই সেদিন পর্যন্ত। গত বছরের পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত তার সাক্ষ্য রয়ে গেছে, সেই তৃণমূল এখন বিজেপির সন্ত্রাসের কারণে চিন্তিত। পাশার দান কীভাবে উলটে যায়!
কাল বুধবার। আমি থাকব শুক্রবার অবধি। শনিবার ফেরার টিকিট কাটা আছে – অবশ্য সে-ও ওয়েটিং লিস্ট। মজুমদারবাবুকে মুখে বললাম, ঠিক আছে, আপনি কাজ সেরে নিন, মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সবার আগে।
ফোন রেখে মনে পড়ল, পাওয়ারব্যাঙ্ক নিয়ে বেরিয়েছি ঠিকই, কিন্তু বেরোবার সময়ে ফোনের চার্জারটা নিয়ে আসতে ভুলে গেছি। এখন পাওয়ারব্যাঙ্কে যতক্ষণ চার্জ আছে, তাতে করে দু তিনবার চার্জ হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু সেই চার্জ শেষ হলে আমি পড়ব বিপদে। আলিপুরদুয়ার পৌঁছে সবার আগে একটা চার্জার কিনতে হবে।
দরজা দিয়ে একবার মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, সামনে ট্রেনের ইঞ্জিনের হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। সেই হেডলাইটের সোজা আলোর সামনে শুধু একজোড়া রেললাইন, আর দুপাশে ঘন জঙ্গল। একটা বোর্ড চলে গেল পাশ দিয়ে, তাতে লেখা – বক্সা টাইগার রিজার্ভ।
আর পাঁচটা স্টেশন। হাসিমারা, হ্যামিলটনগঞ্জ, কালচিনি, রাজাভাতখাওয়া, আলিপুরদুয়ার। হাসিমারা পেরোবার সময়ে খানিকক্ষণের জন্য মোবাইলের সিগন্যাল চলে গিয়ে এসে গেল ভুটানের তাশি সেল নেটওয়ার্ক। এখান থেকে জয়গাঁও মাত্র আট দশ কিলোমিটার মত।
দশটা বেজে গেছে, ট্রেনের তবুও কোনও তাড়াহুড়ো নেই, ধীরে ধীরে চলেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এখন ঠিক এক ঘণ্টা লেট চলছে।
রাজাভাতখাওয়া ঢুকে গেল সাড়ে দশটা নাগাদ। এখান থেকে আলিপুরদুয়ার আর দশ কিলোমিটার, কিন্তু ট্রেন চলেছে এত আস্তে যে, এটুকু পেরোতেই সাড়ে এগারোটা বেজে যেতে পারে। কিন্তু না, ট্রেন একটু স্পিড তুলল, আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম একটা একটা করে কিলোমিটারের মার্কিং পেরিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক আলিপুরদুয়ারের আউটারে এসে কেউ দিল ট্রেনের চেন টেনে। ভঁপ, ভঁপ, ভোঁওওও শব্দে সে খবর সবাইকে জানিয়ে ট্রেন থেমে গেল। মোবাইলের সিগন্যাল ফিরে এসেছে, স্বরাজের ফোন আসছে। বললাম, আরেকটু বাকি আছে ঢুকতে। স্বরাজ আমাকে বলল, তুই একবার হোটেলে ফোন করে বলে দে রাতে কিছু খাবি কিনা, ওদের কিচেন বন্ধ হয়ে যাবে একটু পরেই।
ঘড়ি দেখলাম, পৌনে এগারোটা। এত রাতে আর খাবারের জন্য বিরক্ত করব? থাক।
আলিপুরদুয়ার জংশনে ট্রেন ঢুকল, রাত ঠিক এগারোটায়। বেশ বড়সড় স্টেশন, একটা হুইলার থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কসের একটা বোতল কিনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটা টোটোর সাথে দর করতে যাব, আবার ফোন বাজল। হোটেল থেকে ফোন এসেছে, স্যার, আপনি কি কিছু খাবেন?
যেচে যখন খাওয়াতে চাইছে, না আর করি কী করে – জিজ্ঞেস করলাম, কী পাওয়া যাবে এত রাতে? উত্তরে যা বলল, তার মধ্যে থেকে দুটো আইটেম ফিল্টার করে নিলাম। রুটি আর চিকেন। সেইটুকু তৈরি রাখতে বলে আমি টোটোয় উঠে বসলাম, আর হোটেলে গিয়ে পৌঁছলাম ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে।
আগামী তিনদিন আলিপুরদুয়ারে আমার বার্থ সার্টিফিকেটের অন্বেষণ।