প্রমাণপত্রের জন্ম এবং সর্ষেদানারা – পর্ব ১

নিজে থেকে উদ্যমী না হলেও আজকাল কারণে অকারণে সর্ষেরা এসে পায়ের তলায় জমা হয়ে যায়। তৈরি হয় গল্প, রাস্তার গল্প, মানুষের গল্প। চলার গল্প। সে গল্প নিয়ে দশ বারো পর্বের ধারাবাহিক হয় তো হয় না, কিন্তু যেটুকু হয়, তা-ই বা কম কী?

কাজের জগতে আবার একটা সুযোগ এসেছে বিদেশযাত্রার। ইওরোপ। তো, তার ভিসা বানাবার কাজ চলছে অফিস থেকে। এই ভিসার একটা অবশ্যম্ভাবী অংশ হিসেবে দাবি করা হয়েছে জন্মের প্রমাণপত্র, “লিগালাইজড” ফর্ম্যাটে। সেইটি না হলে সেই দেশের সেই শহরে ওয়ার্ক পারমিট বানানো যাবে না।

আমার বার্থ সার্টিফিকেট নেই। কোনওদিনই ছিল না। তার জন্য খুব বেশি কিছু অসুবিধে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। পাসপোর্ট, প্যানকার্ড, আধার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মায় সম্প্রতি ভোটার কার্ডও বানিয়ে ফেলেছি। অবশ্য, একেবারেই যে কোনও অসুবিধে হয় নি, তা নয়, আজ থেকে বছর চারেক আগে, আমার কর্মস্থল থেকেই সাউথ আফ্রিকা যাবার একটা সুযোগ এসে উপস্থিত হয়েছিল। সেটি আর বাস্তবায়িত হতে পারে নি ঐ বার্থ সার্টিফিকেটের অভাবে। তখন চেষ্টা করতে পারতাম, কিন্তু কোনও কারণে আর করা হয়ে ওঠে নি, তার মূল কারণ হল আমার জন্মের স্থান। প্লেস অফ বার্থ।

পাহাড়ের কোলে আমার জন্ম। আলিপুরদুয়ার। ভুটান পাহাড়, বক্সা পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট মফস্‌সল। কিন্তু সেখানে আমার বাড়ি নয়, সাদামাটা ইংরেজিতে যাকে বলে হোমটাউন, সে আমার হুগলি জেলা। বাবা চাকরি করত পিডাব্লুডিতে, বদলির চাকরি ছিল, কিছু বছর অন্তর অন্তরই আমাদের জায়গা বদলাতে হত, সেই সাথে স্কুলও বদলেছে বারকয়েক – কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি গুণে দেখলে, আমি মোট ছখানা স্কুলে পড়েছি। তার পরে দুখানা কলেজ ইউনি।

তো, বাবার পোস্টিং ছিল তখন আলিপুরদুয়ারে। সেই নকশাল আমল, জরুরি অবস্থার সময়ে। তখন সেটা ছিল জলপাইগুড়ি জেলার একটা মহকুমা। জরুরি অবস্থার শেষে, সত্তরের দশকের শেষদিকে আমার জন্ম হয় আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাসপাতালে। দু হাজার চোদ্দ সাল থেকে আলিপুরদুয়ার আলাদা জেলা হয়ে গেছে, সেই মহকুমা হাসপাতাল এখন নাম নিয়েছে জেলা হাসপাতাল। আজ থেকে বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর আগের কোনও জন্মের রেকর্ড সেই হাসপাতালে থাকবে, এমনটা ভাবাও অনুচিত। তাও কী ভেবে গুগলে সার্চ করতে বসলাম। জেলা হাসপাতালের নম্বরও পেলাম, কিন্তু যাঁর সাথে কথা হল, তিনি শুনেই উড়িয়ে দিলেন, ও হবে না – অত পুরনো রেকর্ড এখানে নেই। আপনাকে এখানে এসে এফিডেভিট করে বার্থ সার্টিফিকেট বানাতে হবে।

খুবই মুষড়ে পড়লাম, তা হলে কী করা যায়? এবারেও কি বিদেশ যাওয়া হবে না, স্রেফ আমার বার্থ সার্টিফিকেট নেই বলে? আলিপুরদুয়ারে আমাদের পরিচিত বলতে জাস্ট কেউ নেই। কয়েক বছরের জন্য বাবা ছিল সেখানে, আমার জন্মের পরে সেখান থেকে বদলি হয়ে আমরা আসি বর্ধমান জেলার গুশকরা বলে একটা গ্রামে। আটাত্তরের ভয়ঙ্কর বন্যায় আমাদের অনেক কিছুই ভেসে যায়, সে সব গল্প কিছু কিছু শুনেছি মা-বাবার মুখে, বর্ধমান স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নাকি তিন দিন তিন রাত কাটিয়েছিলাম আমরা।

বাবার সাথে কথা বলে একটা হাল্কা আশার আলো দেখতে পেলাম। হাসপাতাল থেকে জন্মের পরে একটা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট বা ডিসচার্জ স্লিপ দেওয়া হয়, যেটা স্থানীয় পুরসভার জন্মমৃত্যু দফতরে গিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট বানাতে কাজে লাগে। সেই ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নাকি বাবার কাছে আজও আছে। সেইটা যদি কোনওভাবে আলিপুরদুয়ার মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়ে দেখালে কিছু করা যায়।

বেশ কথা। তার মানে একবার গিয়েই চেষ্টা করতে হবে। আমার এখন নতুন প্রজেক্ট, কাজ শুরু হয় নি ফলে অফিস যাবারও তাড়া নেই, চার পাঁচ দিনের জন্য ঘুরে আসাই যায়। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র ছিলাম, জলপাইগুড়ি শহরটা আমার বেশ চেনা কিন্তু আলিপুরদুয়ারে আমি কোনওদিন যাই নি জন্মের পর। শুনেছি, কোনও এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাঠের বাড়িতে ভাড়া থাকত আমার বাবা মা।

… যাই নি বলাটা ভুল, কলেজে থাকাকালীনই একবার বন্ধুদের সাথে শিলিগুড়ি স্টেশনে গিয়ে মিটারগেজ ট্রেনে করে গেছিলাম আলিপুরদুয়ার। জাস্ট বুড়ি ছুঁয়ে এসেছিলাম। দুপুরবেলা সেখানে পৌঁছে একটু ঘোরাঘুরি করে আবার বিকেল তিনটের মিটারগেজ ট্রেনে করে কুঝিকঝিক করতে করতে রাতের বেলা শিলিগুড়ি ফেরত, সেখান থেকে জলপাইগুড়ির লাস্ট বাস ধরে কলেজ। আলিপুরদুয়ারের স্মৃতি বলতে, এই। এখন গেলে কোথায় থাকব, কার সাথে দেখা করব, কিস্যু জানা নেই।

alipurduar_jn

গুগল ম্যাপে খানিক চোখ বুলোলাম। আমার চক্কর লাগাবার মূল জায়গা দুটো। আলিপুরদুয়ার মিউনিসিপ্যালিটি, আর আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল; যেটা আমার জন্মের সময়ে ছিল মহকুমা হাসপাতাল। দেখলাম, খুব বেশিদূর নয়, হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায়। হোটেল খুঁজতে হবে এর পর, কিন্তু আলিপুরদুয়ার জেলা হলেও টাউনটি অতটা টেক স্যাভি হয় নি, ফলে ইন্টারনেটে প্রেজেন্স তার খুবই কম। এদিক ওদিক কয়েকটা বিশাল দামী হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেল, কিন্তু কতদিনের জন্য যেতে হবে জানি না, অত দাম দিয়ে থাকা তো সম্ভব নয়।

এই সময়ে, হঠাৎ মাথায় এল স্বরাজের নাম। সেই স্বরাজ, যে জয়গাঁও থানার ওসি ছিল। ভুটান যাবার পথে যার আতিথ্যে আমি দুদিন ছিলাম, সেই স্বরাজ, আমি শুনেছিলাম দুহাজার আঠেরোতেই বদলি হয়ে গেছে আলিপুরদুয়ার টাউনে। তার নম্বর কি এখনও চালু আছে?

ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপে মেসেজ ছেড়ে রাখলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্বরাজের উত্তর এল। হ্যাঁ, সে এখন আলিপুরদুয়ারেই আছে বটে। তখন সদ্য ভোটের রেজাল্ট বেরিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগটাই গেরুয়া হয়ে গেছে, তার সাথে শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। স্বরাজ একটু বিব্রত মুখে বলল, ভাই আমাকে দু চারদিন সময় দে, এখন এইসব ভায়োলেন্স নিয়ে খুব দৌড়োদৌড়ি করছি, তুই আমাকে সোমবার ফোন কর।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, তেইশে মে। সোমবার সাতাশ তারিখ। স্বরাজ কিছু করতে পারবে কিনা সেটা জানার আগেই আমাকে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে। বাবাকে ফোন করে বললাম, আমার সেই ডিসচার্জ স্লিপ আর তুমি সেই সময়ে ঐখানে ছিলে, এমন কোনও প্রমাণ যদি তোমার কাছে থেকে থাকে – তোমার সরকারি সার্ভিস বুকের কপি বা অন্য কিছু, আমাকে এক্সপ্রেস কুরিয়ার করো যাতে আমি সোমবারেই হাতে পাই।

আমার উনআশি বছরের বাবা, অশক্ত শরীর নিয়েই একদিনে স্থানীয় পিডাব্লুডি অফিসে গিয়ে বের করে ফেলল নিজের সার্ভিস বুকের সেই সব পাতার কপি, যেখানে বাবার আলিপুরদুয়ার পোস্টিংএর ব্যাপারে তথ্য লেখা আছে। সেই কপি অ্যাটেস্ট করিয়ে আমার সেই জন্মের সময়কার ডিসচার্জ স্লিপ সমেত সেদিন বিকেলেই কুরিয়ার করে দিল, ডিটিডিসি এক্সপ্রেস, সোমবার যাতে আমি হাতে পেয়ে যাই।

ইতিমধ্যে আমাকে রিজার্ভেশন করাতে হবে। কিন্তু গরমের ছুটির সময়, জনতা উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে পাহাড়ের দিকে, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। আমার জন্মস্থান হলে কী হবে, আদতে তো টুরিস্ট স্পট। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ডিব্রুগড় রাজধানীতে পেলাম ওয়েটিং লিস্ট এগারো – হয়ে যাওয়া তো উচিত। কেটে ফেললাম ঝপাঝপ।

সোমবার বেলা এগারোটায় ভয়ে ভয়ে স্বরাজকে ফোন করলাম। স্বরাজ ফোন ধরেই বলল, চিন্তা করিস না, হয়ে যাবে। তোকে একটা নম্বর পাঠাচ্ছি, বি মজুমদার, স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর, আমি ওকে সব বলে রেখেছি, সে তোর বার্থ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেবে, তুই ওকে একবার ফোন করে নে।

সোমবার বেলা বারোটায় আমার বাবার পাঠানো কুরিয়ার এসে গেল আমার হাতে। প্রথমবার নিজের চোখে দেখলাম নিজের জন্মের প্রমাণপত্র।

Discharge Certificate

দুপুরের পরে বি মজুমদারকে ফোন করলাম, ভারি অমায়িক ভদ্রলোক, প্রসঙ্গ শুনেই উত্তরবঙ্গের ডায়ালেক্টে বললেন, আসেন, আমি দেখসি।

আসেন,আমি দেখসি-র ভরসায় আমি সোমবার রাতে শুতে গেলাম। পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ডিব্রুগড় রাজধানী। রাতে শোবার আগে আরেকবার টিকিটের স্টেটাস চেক করলাম। ওয়েটিং লিস্ট এগারো থেকে দশ হয়েছে।

 

… হয়ে যাওয়া উচিত।

 

ঘুম ভাঙল মঙ্গলবার ভোর পাঁচটায়, সবার আগেই মোবাইল অন করে স্টেটাস চেক করলাম টিকিটের। চার্ট প্রিপেয়ার্ড, এবং ওয়েটিং লিস্ট দশ থেকে আর একচুলও নড়ে নি। আমার টিকিট কনফার্মড হয় নি। … এখন উপায়?


One thought on “প্রমাণপত্রের জন্ম এবং সর্ষেদানারা – পর্ব ১

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.