দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে প্রথম হাল্কাভাবে পরিচিতি হই যে বইটির মাধ্যমে, তার নাম – আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। পনেরো বছর বয়েস, ক্লাস নাইনে পড়ি। ইতিহাস বইতে ইউরোপের রেনেসাঁ পড়ে এসেছি ক্লাস নাইনে, কিন্তু আধুনিক ইওরোপের ইতিহাস নিয়ে তেমন কিছু আলাদা করে পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। নাইন থেকে তো ভারতের ইতিহাসই প্রধান, তার মধ্যে ছুটকো ছাটকা দু এক প্যারাগ্রাফ হয় তো লেখা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে।
আনা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি, বাংলা অনুবাদে পড়ে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছিলাম, সে ঘোর থেকে সম্ভবত আজ পর্যন্ত বের হতে পারি নি। আমার প্রথম কৈশোরের কাল্পনিক ভালোবাসার নাম আনা ফ্র্যাঙ্ক। ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলাম আনার দেখাদেখি, চিঠির ফর্ম্যাটে। সেই যে লেখার অভ্যেস শুরু হয়েছিল, আর ছাড়তে পারি নি।
গল্পটা আনা ফ্র্যাঙ্ককে নিয়ে ঠিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়েও নয়। ইউরোপে প্রথম যখন আসব বলে স্থির হয়, অবশ্যদ্রষ্টব্য হিসেবে একটা দুটো জায়গার নাম মাথার মধ্যে খেলছিল – দাখাউ, বারজেন-বেলসেন, অশউইৎজ।
সেই পনেরো বছর বয়েসের থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের বয়েসে এসে পৌঁছেছি। কিছু বইপত্র, কিছু সিনেমা, কিছু ডকুমেন্টারি উত্তরোত্তর আমার আগ্রহ বাড়িয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘটনাপ্রবাহের দিকে, আর আজকের ভারতের নিরিখে তো সেই ইতিহাস নতুন করে পড়তে বসেছি। কীভাবে দশকের পর দশক ধরে আস্তে আস্তে জনমত তৈরি করে একটা গোটা জাতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেবার চক্রান্ত করেছিল কুখ্যাত অ্যাডলফ হিটলার, যত পড়ি, হাড় হিম হয়ে যায়, মাথা টলতে থাকে।
“গল্পটা সবাই জানে” বলে শুরু করা খুব সোজা ছিল, কিন্তু একগুচ্ছ ভারতীয় সহকর্মীর সাথে ইওরোপে এসে দেখলাম, না, সত্যিই গল্পটা সবাই জানে না। বাঙালি, তামিল, উত্তরপ্রদেশীয় অন্তত চার পাঁচজনকে কথাচ্ছলে যখনই বলেছি, অশউইৎজ দেখতে যাচ্ছি, প্রত্যেকে কী রকম আকাশ থেকে পড়েছে। আরে, ইওরোপ এসে লোকে প্যারিস যায়, সুইজারল্যান্ড যায়, স্পেন ইটালি গ্রীস যায়, ইয়ে অশউইৎজ কৌনসা জাগা হ্যায় ভাই?
– কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
– সেটা কী?
– কোনও ইয়োগা, মেডিটেশন ইত্যাদির ক্যাম্প?
– প্রত্যেক বছর এই সময়ে বসে বুঝি?
– তুমি মেডিটেশন করো?
… শিক্ষিত তো বলা যায়ই, ভারতের অন্যতম নামকরা কর্পোরেটের চাকুরে সব, ভালো ভালো পাশ দিয়েই তো এখানে চাকরি পেয়েছে তারা। কিন্তু অশউইৎজের নাম জানে না। দাখাউয়ের নাম জানে না। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কী – তা জানে না। হিটলারের নাম শুনেছে ঠিকই, খুব অত্যাচার করত, কিন্তু কাদের ওপর অত্যাচার করত, কেন করত, কিচ্ছু জানে না। ইতিহাস সেই কবে পড়েছি, মনে থাকে নাকি?
চার মাস হয়ে গেছে ঘুরে এসেছি পোল্যান্ডের দুটো অবশ্যদ্রষ্টব্য জায়গা – অশউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, যার আরেক চালু নাম ছিল ডেথ ক্যাম্প; আর, অস্কার শিন্ডলারের অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি, যা স্টিভেন স্পিলবার্গের শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমার মাধ্যমে আজ অমর হয়ে আছে। চার মাস হয়ে গেছে ঘুরে এসেছি, অনেকবার মনে হয়েছে, লিখি, কিন্তু লিখতে হাত সরে নি। এত ভয়ঙ্কর, এত আতঙ্কের সেই দর্শনের স্মৃতি, কীভাবে লিখব, কোথা থেকে লিখব, বুঝে উঠতে পারি নি। আজ যে এতদিন বাদে অশউইৎজ নিয়ে লিখতে বসলাম, তার কারণ আছে।
কী সেই কারণ?
লেখার শেষে বলব।
ক্রাকাও শহরের এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম সন্ধ্যে পেরিয়ে, মোবাইলের ইন্টারনেটের কিছু সমস্যা হওয়াতে হোটেল খুঁজে পেতে যারপরনাই সমস্যা হয়েছিল, ফলে যখন পৌঁছেছিলাম, তখন ক্রাকাওয়ের সমস্ত খাবারের জায়গা বন্ধ, আর আমার আস্তানাটা আদতে ডর্মিটরি, খাবারের অপশন ছিল না। … কিন্তু আমার বেড়াবার গল্প লেখার জন্যে আমি বসি নি, “গল্পটা সবাই জানে” ভেবে যে লেখাটা আমি এতদিন এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, আজ সেই লেখাটাই লিখতে বসেছি আজ। আমি কীভাবে পৌঁছলাম, কী খেলাম, কেমন ঘুরলাম, তাই নিয়ে এই গল্পটা নয়। যে গল্পটা আমি শোনাতে যাচ্ছি, “সবার” না হলেও কারুর কারুর হয় তো জানা, তারা স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারে এই লেখাটা। এটা বাকিদের জন্য। যে গল্পগুলো শোনাব, আমি নিজের চোখে সেই গল্পের জায়গাগুলো দেখে এসেছি, নিজের পায়ে হেঁটে এসেছি সেই দুঃস্বপ্নের অলিগলি, আমার বেড়ানোর গল্প স্রেফ এইটুকুই।
আজকের অশউইৎজ খানিকটা ট্যুরিজমসেন্ট্রিক হয়ে পড়েছে। পোল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত হলেও তার নিজের কারেন্সি আছে, যদিও ইউরো চলে, কিন্তু বদলে পোলিশ zlotyই ফেরত পাওয়া যায় খুচরো হিসেবে। যেমন ভুটানে ভারতের টাকা নেয়, কিন্তু বদলে ভুটানের টাকা পাওয়া যায়। অশউইৎজের পার্কিং এরিয়ার কাছে যে খাবারের দোকানগুলো আছে, তারা কার্ড নেয় না, ক্যাশেই দাম দিতে হয়, আমি জানতাম না, আমার কাছে টাকা ছিল না – ফলে আমাকে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে, পকেটে কার্ড থাকা সত্ত্বেও।
মাত্র একবেলা খাওয়া জোটে নি, আর এখানে যাদের নিয়ে আসা হত, তাদের সিংহভাগ মারা গেছেন স্রেফ না খেতে পেয়ে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। কত মাস? অশউইৎজে গড়ে একজন বন্দীর আয়ু ছিল সর্বাধিক তিন মাস। হাড়ভাঙা খাটুনি আর যৎসামান্য অপুষ্টিকর খাবার খেতে খেতে যখন আপাতভাবে শক্তসমর্থ শরীরগুলো পরিণত হত জীবন্ত কঙ্কালে, তখন তাদের লাইন করে নিয়ে যাওয়া হত শেষবারের জন্য, গ্যাস চেম্বারের উদ্দেশ্যে। কোনওরকমে ধুকপুকিয়ে টিকে থাকা প্রাণগুলো পরের কুড়ি মিনিটের মধ্যে চিরমুক্তি পেয়ে যেত, গ্যাস চেম্বার সংলগ্ন ক্রিমেটোরিয়ামের চিমনির ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে।
কর্মই আনে মুক্তি। ফাইনাল সল্যুশনের অংশ হিসেবে ইওরোপ জুড়ে গড়ে তোলা সমস্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দরজার মত অশউইৎজের দরজাতেও এই লেখাটা উৎকীর্ণ করে রাখা আছে জার্মান ভাষায় – Arbeit macht frei।
সমস্ত ইউরোপ জুড়ে মূলত নাজী পার্টির উদ্যোগে কুড়িটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানানো হয়েছিল জার্মানি, পোল্যান্ড, ইত্যাদি বিভিন্ন ইওরোপিয়ান দেশ জুড়ে। যদি ডিটেনশন ক্যাম্প, ঘেটো, সাব-ক্যাম্প, ইত্যাদিদের ধরা হয় তো, সংখ্যাটা সাড়ে আটশোরও বেশি। অশউইৎজ তাদের সবার মধ্যে আয়তনে বড়। সবচেয়ে বেশি মানুষ এখানে মারা গেছিলেন। সবচেয়ে কম আয়ু হত এখানকার বন্দীদের। তাই এর আরেক নাম হয়েছিল ডেথ ক্যাম্প। এখান থেকে খুব কম মানুষ বেঁচে ফিরেছেন।
হলোকাস্ট একদিনে শুরু হয় নি। প্রথমে তা শুরু হয়েছিল বিদ্বেষমূলক ভাষণ, হেটস্পীচের মাধ্যমে। ইহুদীরা খাঁটি আর্য নয়, তারা জার্মানির সর্বনাশের মূল কারণ, তারা আদত জার্মান রক্তের বাহক নয়, এবং যে সব খাঁটি জার্মানরা ইহুদীদের বিয়ে করেছিলেন, তাঁদেরকেও মূল সমাজের থেকে নির্বাসন দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগে থেকেই। প্রথমে ইহুদীদের জন্য আলাদা স্কুল, যাতে জার্মান বাচ্চাদের সাথে তারা কোনওভাবেই মেলামেশা না করতে পারে, তারপরে তাদের জন্য দোকানবাজার করার আলাদা নির্দিষ্ট সময়, তারপরে তাদের দোকানবাজারকেই চিহ্নিত করে আলাদা করে দেওয়া, তার পরে তাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া, পার্কে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, সুইমিং পুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, সিনেমাহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, রাস্তায় হাঁটা, সাইকেল চালানো, নাচ শেখা, উচ্চশিক্ষা … একে একে সমস্ত সাধারণ জীবনধারণের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে করতে, অন্যদিকে জার্মান মূলধারার স্কুলগুলোতে ইহুদীদের ভয়ঙ্কর দানবিক অশুভ শক্তি হিসেবে দেখিয়ে বাচ্চাদের অন্য ইতিহাস পড়ানো, শুধু ইহুদী নয় – কম্যুনিস্ট, সমকামী, মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী, ফ্যাসিজম ভিন্ন অন্য রাজনৈতিক মতে বিশ্বাসী, রোমা, জিপসী ইত্যাদি আদিবাসী যারা “খাঁটি জার্মান রক্তের” বাহক নয়, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, এমনকি খাঁটি জার্মান কিন্তু যাদের বাহ্যিক চেহারায় জার্মান রূপের বহিঃপ্রকাশ নেই (নীল চোখ, সোনালী চুল, বলিষ্ঠ দেহ) – এদের সকলকে একে একে রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন করার একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প চালাতে চালাতে, হলোকাস্ট এসেছিল একেবারে শেষের ধাপে, ফাইনাল সল্যুশনের অংশ হিসেবে। (কিছু মিল কি খুঁজে পাওয়া যায়, আজকের ভারতের সাথে?)
কী এই ফাইনাল সল্যুশন?
পুরো কথাটা ছিল ফাইনাল সল্যুশন টু দ্য জিউয়িশ কোয়েশ্চেন। জার্মান ভাষায় Endlösung der Judenfrage, ১৯৪২ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাজী কর্তৃপক্ষ দ্বারা পৃথিবী জুড়ে ইহুদীদের ধ্বংস করার একটা কার্যকরী, “সিস্টেমেটিক” “এফিশিয়েন্ট” প্ল্যানের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়। কীভাবে সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে, অল্প সময়ের মধ্যে, অল্প খরচায় বেশি বেশি ইহুদীকে মেরে ফেলা যায়, তার পরিকল্পনা। কিন্তু সে সব অনেক অনেক পরের কথা।
অশউইৎজ ক্যাম্প তৈরি করা হয় ১৯৪০ সালে। অশওয়েসিম (Oswiecim) বলে ক্রাকাও শহরের দক্ষিণে একটা জায়গা ছিল। পোল্যান্ড অধিকার করার সাথে সাথে হাজারে হাজারে পোলিশ অধিবাসীকে বন্দী করে জবরদস্তি শ্রম, বা ফোর্সড লেবারের কাজে লাগানো হয়। কিন্তু উত্তরোত্তর বন্দীদের সংখ্যা বেড়ে যাবার ফলে ক্রাকাও শহরে এদের রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই অশওয়েসিমকে জায়গা হিসেবে বাছা হয়, নাম বদলে দেওয়া হয় Konzentrationslager Auschwitz, বা ইংরেজিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প অশউইৎজ। এখানে একটা জেলখানা আগে থেকেই ছিল, সেটাকে ব্যবহার করা হয় প্রথমে পোলিশ বন্দীদের রাখার জন্য, পরে বাকি বন্দীদেরও এখানে চালান করা শুরু হয়। ১৪ই জুন, ১৯৪০ সালে প্রথম পোলিশ যুদ্ধবন্দীদের দলকে এখানে আনা হয়। খুব তাড়াতাড়িই এই জেলখানা, যা আজকে অশউইৎজ ওয়ান নামে পরিচিত (কারণ অশউইৎজে দুটো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আছে), ভরে যায় পনেরো হাজারেরও বেশি বন্দীতে, ক্রমশ তা হয়ে দাঁড়ায় কুড়ি হাজার। ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের জোর করে তাড়িয়ে এলাকাছাড়া করে দখল করা হয় তাদের বাড়িঘর অফিস দোকান ওয়ার্কশপ, সেগুলোকেও জেলখানার অন্তর্গত করে নেওয়া হয়।
নাজীরা প্রকৃতিগতভাবে খুব ধ্বংসাত্মক ছিল না। পোল্যান্ড দখল করবার পরে ওরা যথেচ্ছ সিনাগগ ইত্যাদি ভাঙচুর করেছিল ঠিকই, কিন্তু বড় বড় বাড়ি অফিস কারখানা বিল্ডিং, যেগুলো ওদের কাজে লাগতে পারে, সেগুলোকে ভাঙাভাঙির চেষ্টায় যেত না। সেগুলোকে দখল করে নিজেদের কাজে লাগাত। খরচ কমানো, অপটিমাইজেশনের দিকে খুব কড়া নজর ছিল নাজী কর্তৃপক্ষের। তাই অশওয়েসিম বা অশউইৎজের আশপাশের বাসিন্দাদের তাড়িয়ে তাদের বাসস্থানগুলো না ভেঙে সেগুলোকে নিজেদের বন্দীদের ওপর অত্যাচারের কাজে লাগিয়ে ফেলেছিল খুব সুচারুভাবে, কিন্তু ১৯৪২ সাল আসতে না আসতেই অশউইৎজ ওয়ানের আর বন্দী নেবার ক্ষমতা রইল না। এখানে আসা বন্দীদের গড় আয়ু তিন মাসের হওয়া স্বত্ত্বেও বন্দীদের এতটাই ভিড় ছিল, তাই ১৯৪২ সাল নাগাদ, মূল ক্যাম্পের থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বে বির্কেনাউ নামে একটা জায়গায় ১৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বানানো হয় দ্বিতীয় অশউইৎজ ক্যাম্প। এই দুটো ক্যাম্প পাশাপাশি অশউইৎজ বির্কেনাউ নামে আজ পৃথিবী চেনে।
প্রথমদিকে, ১৯৪২ সাল পর্যন্ত, এখানে মূলত পোলিশ যুদ্ধবন্দী, রোমা, জিপসী এবং কমিউনিস্টদেরই আনা হত, ইহুদী বন্দীদের শুরুর দিকে এখানে আনা হত না খুব একটা। ইহুদীদের জন্য সিস্টেমেটিক মারণযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্যেই বির্কেনাউ তৈরি হয়, কারণ তখন সদ্য তৈরি হয়ে গেছে “ফাইনাল সল্যুশন”। সেই ফাইনাল সল্যুশনকে মাথায় রেখেই দ্বিতীয় অশউইৎজ বানানো।
প্রথমে আমাদের দেখানো হয়েছিল অশউইৎজ ওয়ান। অদ্ভূত শান্ত নিরিবিলি এলাকা, সারি সারি বিল্ডিং, ঠিক সেই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে, দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় যে এই সুন্দর ক্যাম্পাসে এক সময়ে দলে দলে মানুষকে অভুক্ত রেখে অমানুষিক অত্যাচার করে কাজ করানো হত, তারপর মেরে ফেলা হত।
সকাল চারটেয় উঠতে হত। একেকটা ব্যারাকে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে রাখা হত। প্রথমদিকে তাদের মেঝেতে শুতে হত। যেখানে কোনওরকমে তিরিশজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে শুতে পারে, সেখানে শুতে হত একশোজনকে। পোল্যান্ডের ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডায় মেঝেতে শোয়া কী কষ্টকর, কল্পনা করতে অসুবিধে হয় না। স্রেফ ঠাণ্ডা লেগে নিমোনিয়া হয়ে মারা যেতে শুরু করলেন অসংখ্য বন্দী। “লেবার”এর অপচয় রুখতে প্রথমে নাজী অফিসাররা এদের জন্য কম্বলের ব্যবস্থা করে যাতে চট করে ঠাণ্ডা না লাগে, পরে সেই কম্বলের খরচা বাহুল্য বোধ হওয়াতে কংক্রিটের মেঝের ওপর কাঠের পাটাতন লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ঠাণ্ডা “কম” লাগে।


তাতেও মৃত্যু না কমায়, অবশেষে ক্যাম্পে প্রবর্তন করা হয় কাঠের বাঙ্ক বেডের। যে বিছানায় তিনজন অতিকষ্টে শুতে পারে, সেখানে জায়গা নিতে হত ছয় থেকে আটজনকে। শীতের চারটে মাস বাদ দিয়ে বাকি সারা বছর সবাইকে উঠতে হত ভোর চারটেয়, শীতকালে সকাল পাঁচটায়। একটিমাত্র টেবিল, সেখানে একশো জনের ব্রেকফাস্ট করার জন্য সময় দেওয়া হত পাঁচ মিনিট, আর প্রাতঃকৃত্যের জন্য বরাদ্দ ছিল দশ মিনিট। কমিউনিটি আড়ালহীন টয়লেট, পাশাপাশি সার সার কমোড বসানো, প্রতি তিরিশ জনের জন্য একটি কমোড। সময়, একটা ঘরে থাকা একশো জনের জন্য দশ মিনিট। এর বেশি সময় নিলে চাবকে পিঠের চামড়া ফাটিয়ে দেওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
এর পর বাইরে লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা। ততক্ষণ, যতক্ষণ না তাদের সকালের গুনতি শেষ হয়। ভোররাতে হিমশীতল হাওয়ার মধ্যে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হত সকাল সাড়ে চারটে থেকে সকাল আটটা, কখনও কখনও সকাল নটা অবধি, যতক্ষণ না তাদের দায়িত্বে থাকা নাজী সুপারভাইজাররা ঘুম থেকে উঠে সকালের খাবার খেয়ে তাদের জন্য দয়া করে গুনতি শুরু না করেন। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হত। একটানা। বসার অনুমতি ছিল না। এ ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। কখনও গুনতি না মিললে আবার প্রথম থেকে গুনতি। তিনবারের বার গুনতি না মিললে জবাবদিহি চাওয়া হত।
প্রতিদিনই ব্যারাকের ঘর থেকে একটি দুটি দশটি মৃতদেহ বেরোত, হয় তো আগের রাতে মারা গেছেন অপুষ্টিতে, নিমোনিয়ায়, ডায়েরিয়ায়, বা অন্য কোনও কারণে, কিন্তু বাকিদের বাকি রাত সেই মৃতদেহর পাশেই শুয়ে থাকতে হত, পরের দিন ভোরে সেই মৃতদেহকে বয়ে নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হত, কারণ গুনতি না মিললে সাজা ছিল ভয়াবহ।
ধরে নেওয়া হত, কেউ পালিয়েছে। পালাতও। পালিয়ে রাতারাতি পোল্যান্ডের বাইরে চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন এমন সারভাইভারের গল্পও যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, এমন ঘটনার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যদি বোঝা যায় যে আগের রাতে এক বা একাধিক বন্দী পালিয়েছে এই ব্যারাক থেকে, তা হলে শাস্তি হত “কালেক্টিভ রেসপন্সিবিলিটি”র।
নাজীদের আরেক শাস্তিপদ্ধতি। প্রতি পালিয়ে যাওয়া বন্দীর জন্য তিনটি করে প্রাণ নিত তারা। হয় লাইনেই র্যান্ডম কয়েকজনকে আলাদা করে সাথে সাথে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি, কিংবা ফাঁসি। বাকিদের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই ফাঁসি, ছটফটিয়ে সেই মরে যাবার দৃশ্য দেখতে হত, যাতে পরে আর একজনও ব্যারাক থেকে পালিয়ে যাবার কথা স্বপ্নেও চিন্তা না করতে পারে।
(আজ যাঁরা, আজও, মৃত্যুদণ্ডের সপক্ষে সওয়াল করেন, তাঁদের যুক্তিবিন্যাস দেখলে, সত্যিই আমার নাজীদের কথা মনে পড়ে যায়)
অবাধ্য বন্দীদের জন্য ছিল আরও ভয়ঙ্কর কুঠুরি। একজন কোনওরকমে দাঁড়াতে পারে, সেই রকম একটা ছোট্ট ঘরে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হত তিনজনকে। পা বেঁধে দেওয়া হত। পায়ের কাছে জ্বালিয়ে দেওয়া হত একটা মোমবাতি। মোমবাতি আস্তে আস্তে শুষে নিত কুঠুরির সমস্ত অক্সিজেন। দম আটকে মরতে হত তিনজনকে। সেই কুঠুরি এখনও গেলে দেখতে পাওয়া যায় এগারো নম্বর ব্যারাকে।
তার পাশেই দশ নম্বর ব্যারাক। সেখানে মহিলা আর শিশু বন্দীদের ওপর নানা নারকীয় এক্সপেরিমেন্ট চালাত নাজী ডাক্তাররা। কোন গ্যাসে, কোন রসায়নে শরীরের কোন অংশে কী প্রভাব পড়ে, তার সরাসরি পরীক্ষানিরীক্ষা চলত বন্দীদের ওপর। গিনিপিগের মত ব্যবহার করা হত তাদের। যেভাবে আমরা বায়োলজির ক্লাসে জ্যান্ত ব্যাঙ কাটতাম, সেইভাবে কাটাছেঁড়া চলত। শেষ হয়ে গেলে জীবন্মৃত শরীরটাকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেই চলত।
জীবন এতটাই দুর্বিষহ করে তোলা হত ক্যাম্পে, যে দলে দলে বন্দীরা বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করতেন। বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলতেন এখানে একমাস কাটানোর পর, বেশির ভাগ বন্দী। কেউ তার পরেও পালানোর চেষ্টা করতেন, কেউ দিন গুনতেন মৃত্যুর। যদিও বন্দীদের কেউই জানতেও পারতেন না গ্যাস চেম্বারের আসল গল্প, নিজে যতদিন না গ্যাস চেম্বারে ঢুকতেন। এতটাই গোপনীয়তা মেনটেন করা হত।
কখনও কখনও টাইফাস, ডায়েরিয়া ইত্যাদি মড়কের আকার ধারণ করত। ভোররাতে একবার আর ফিরে এসে রাতে একবার টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি মিলত। কিন্তু ডায়েরিয়ার রোগীর দুবারে কী করে টয়লেটের প্রয়োজন মিলবে? তাই কাপড়ে চোপরেই মাখামাখি হয়ে যেত মলমূত্রে, সেই কাপড়ই পরে থাকতে হত। রাতের বেলায় বেগ এলে, খাবারের জন্য যে এনামেলের বাটিটা দেওয়া হয়েছিল সেই বাটিতেই কাজ সারতে হত, কারণ রাতের বেলায় ব্যারাকের বাইরে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। পরদিন সকালে পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে সেই বাটিই পরিষ্কার করে তাতে সকালের খাবার নিতে হত।
ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আর ছড়িয়ে গেলে সমাধান তো একটাই। কোনও ব্যারাকে মড়ক লেগে গেলে, একদিন সব্বাইকে ধরে নিয়ে গিয়ে গ্যাস চেম্বারে ভরে দেওয়া। এর পরে ব্যারাকটিকে জীবাণুমুক্ত করে আবার পরের দলকে থাকতে দেওয়া।
পোকামাকড়ের মত মানুষ মরেছে এখানে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
অশউইৎজ ওয়ানে একটা গ্যাস চেম্বার এখনও টিকে আছে, কারণ এই এক নম্বর ক্যাম্প চলাকালীনই এই গ্যাস চেম্বারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়, কারণ এখানে কুড়ি তিরিশজনের বেশি মানুষকে একসাথে মারা যেত না। অশউইৎজ টু, মানে বির্কেনাউতে বড় মাপের চারটে গ্যাস চেম্বার বানানোর পরে এই ওয়ানের ছোট গ্যাস চেম্বারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
গ্যাস চেম্বার কেন? গণহত্যার জন্য এই গ্যাস চেম্বারের পরিকল্পনা কীভাবে নাজীদের মাথায় এসেছিল?
খুব সহজ ব্যাপার। কম খরচায় বেশি মানুষকে মারার জন্য এর থেকে বেশি ভালো এফেক্টিভ উপায় আর ছিল না। গুলি করে মারা হত ঠিকই, কিন্তু তাতে গুলি খরচা হত, আর, আর, গুলি যদি শরীরে লাগে, সেই বন্দীর জামাটা নষ্ট হত, সেটা আর পরের বন্দীর জন্য ব্যবহার করা যেত না। রিসাইক্লিং জিনিসটা এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছিল নাজীরা, যে এই মুহূর্তে মারা যাওয়া এক হাজার বন্দীর জামাকাপড় (সেই সাদা নীল স্ট্রাইপ জামা আর পাজামা) পরের ঘণ্টাতেই চলে যেত জীবাণুমুক্ত করার জন্য, তারপর সেগুলো দেওয়া হত পরের লটে চলে আসা এক হাজার বন্দীকে। গ্যাস দিয়ে মারলে জামাকাপড় নষ্ট হয় না, সবচেয়ে বড় কথা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্দীরা জানতেও পারত না যে তারা মরতে চলেছে। লাইন দিয়ে চেম্বারের বাইরে একটা বড় হলঘরে এনে তাদের সবাইকে বলা হত জামাকাপড় ছেড়ে নগ্ন হতে। তাদের “শাওয়ার” হবে, জীবাণুমুক্ত করার জন্য। কে কোন নম্বরের হ্যাঙ্গারে নিজের জামা রাখছে সেটাও তাদের মনে রাখতে বলা হত, যাতে বেরিয়ে এসে নিজের জামা খুঁজে পেতে কোনও কনফিউশন না হয়। হত্যভাগ্য মানুষগুলো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করত যে তারা সত্যিই শাওয়ার নেবার পরে বেরিয়ে আসবে জীবাণুমুক্ত হয়ে। এর পর, এক থেকে দু হাজার মানুষকে ঠেসে ঠেসে ঢোকানো হত গ্যাস চেম্বারের মধ্যে।
বানিয়ে বলছি না, বির্কেনাউয়ের প্রতিটা গ্যাস চেম্বার এক এক বারে দু হাজার মানুষকে অ্যাকোমোডেট করার ক্ষমতা রাখত। অশউইৎজ ওয়ানের সেই পরিত্যক্ত গ্যাস চেম্বার, যা আজকের দিনে টিকে থাকা একমাত্র গ্যাস চেম্বার, তার ক্ষমতা ছিল মাত্র চারশো। বির্কেনাউয়ের একটি গ্যাস চেম্বারও আর অবশিষ্ট নেই।
গ্যাস চেম্বারের একটিই দরজা ছিল। শুধু ঢোকার জন্য। বেরিয়ে আসত না কেউই। বেরিয়ে আসার একটাই পথ ছিল। চিমনি। দরজা বন্ধ করার পর সেই চেম্বারের ছাদের দিকে একটা চৌকো মুখ খুলে যেত, সেইখান দিয়ে একটা মুখোশ পরা লোক ঢেলে দিত বিষাক্ত গ্যাস।
প্রথম দিকে কার্বন মনোক্সাইড ব্যবহার করা হত। পরে তার খরচা বাহুল্য মনে হওয়ায় নাজী রিসার্চাররা শস্তায় মারার অস্ত্র খুঁজতে থাকে। খোঁজ পাওয়া যায় জাইক্লোন বি (Zyclone B) নামে এক ধরণের কেমিক্যালের। এটি মূলত পেস্টিসাইড, কীটনাশক। অল্পমাত্রায় ক্ষেতখামারে প্রয়োগ করা হত পোকামাকড় মারতে। তা, ইহুদী বা যুদ্ধবন্দীরা পোকামাকড় বই তো আর কিছু ছিল না জার্মান নাজীদের চোখে। তাই তাদের জন্য কীটনাশকই সই। অল্প ডোজের কীটনাশককে সামান্য পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বানিয়ে ফেলা হল মারণ গ্যাস। কৌটো খুলে জাইক্লোন বি ট্যাবলেট মাটিতে ফেলে দিলেই তার থেকে গ্যাস বেরোত, ওপরের চৌকো খুপরিটা বন্ধ হয়ে যেত, আর মারণ গ্যাস ধীরে ধীরে ভরে ফেলত পুরো গ্যাস চেম্বারের প্রকোষ্ঠ।
কুড়ি মিনিট। সর্বাধিক কুড়ি মিনিট লাগত দু হাজার মানুষকে মেরে ফেলতে। শেষ মুহূর্তে বেঁচে থাকার অদম্য প্রচেষ্টায় মানুষ অশক্ত শরীরেও একে অপরের ঘাড়ের ওপরে উঠে শ্বাস নেবার চেষ্টা করত, দেওয়াল বেয়ে ওপরের সেই চৌকো কুঠুরিতে উঠে বেরোবার অক্ষম চেষ্টা করত, কিন্তু কেউই পারত না।
টিকে থাকা অশউইৎজ ওয়ানের সেই পরিত্যক্ত গ্যাস চেম্বারের দেয়ালে আজও দেখা যায় অজস্র নখের আঁচড়। মরে যাবার আগের মুহূর্তে বাঁচার শেষ চেষ্টা।

এর পর ক্রিমেটোরিয়াম। দু হাজার মানুষকে পুড়িয়ে ধোঁয়া করে ফেলতে লাগত আরো চল্লিশ মিনিট। সবশুদ্ধ একঘন্টা বাদে আবার পরের লটের দু হাজার জনকে তৈরি করে ফেলা যেত।
সারাদিন সারারাত, নিরবচ্ছিন্ন চলত এই প্রক্রিয়া। গড়ে প্রায় আট হাজার মানুষ প্রতি ঘন্টায় খুন হতেন বির্কেনাউয়ের চারটে গ্যাস চেম্বারে।
শেষ মুহূর্তে কারা সাহায্য করত এই হতভাগ্যদের? বন্দীরাই। কিছু বন্দীকে আনা হত এখানে মৃত্যুপরোয়ানা পাওয়া লোকেদের জামাকাপড় খুলে দিতে সাহায্য করা, কাজ শেষ হলে পোড়া লাশ, ছাই ট্রলিতে করে পেছনের দিকের পরিত্যক্ত জমিতে ফেলে আসার জন্য। তারা জানত, আসলে কী হচ্ছে গ্যাস চেম্বারের ভেতরে। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য তাই তাদেরকেও মাফ করা হত না। প্রতি মাসের শেষে এই সাহায্যকারীদেরও ঢুকিয়ে দেওয়া হত গ্যাস চেম্বারের ভেতরে। নিয়ে আসা হত পরের ব্যাচকে।
শিন্ডলার লিস্ট সিনেমায় আমরা যে বিশাল বড় গেট দেখতে পাই, যার মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা এসে থামল ইহুদীদের নিয়ে, সেইটা বির্কেনাউয়ের গেট। ইওরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাটল কার, গরুঘোড়া ট্র্যান্সপোর্ট করার যে রেল ওয়াগন হয়, সেই ওয়াগনে ভর্তি করে ইহুদীদের আনা শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সাল থেকে। একেকটা ওয়াগনে ভরা হত একশো জনকে, ঠিকভাবে দাঁড়াবারও জায়গা হত না সবার। ইহুদীদের বলা হত তোমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ঘেটোর বদলে তোমরা পাবে এক নতুন জীবন। নতুন জীবন শুরু করার জন্য তোমাদের যা যা প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নেওয়া দরকার বলে তোমরা মনে করো, সেইগুলো সব সুটকেসে ভরে আনবে, সঙ্গে তিনদিনের মত খাবার নেবে।
সাধারণ মানুষেরা, তাদের যা যা আপাত মূল্যবান জিনিস, প্রিয়জনের ছবিসহ ফ্রেম, জুতোর বুরুশ, কালি, চিরুনি, স্টোভ, চায়ের কাপ, রান্নার বাসন, সোনার গয়না, পুতুল, হাতঘড়ি, পকেটঘড়ি, … কী ছিল না তাদের সুটকেসে। সমস্ত কেড়ে নেওয়া হত অশউইৎজে পৌঁছবার পর।




তিনদিন থেকে দশদিন সময় নিত ট্রেনগুলো অশউইৎজে পৌঁছতে। দশদিন, বসার জায়গা নেই, খাবার নেই, একটানা দাঁড়িয়ে একটা ক্যাটল কারের ভেতরে, যার একটা মাত্র ছোট জানলা খোলা শ্বাস নেবার জন্য। শুধু অশউইৎজ পৌঁছবার আগেই অনেক মানুষ মারা যেতেন সেই ওয়াগনের ভেতর। বাকিদিন বাকিদের সেই মৃতদেহগুলির সঙ্গে বাকি যাত্রাটা সম্পূর্ণ করতে হত। দিন হোক বা রাত, যে কোনও সময়ে বন্দীভর্তি সেই ট্রেন অশউইৎজের ভেতর এসে ঢুকলেই শুরু হয়ে যেত তৎপরতা।

হাত থেকে সুটকেস, ব্যাগ সমস্ত কেড়ে নিয়ে স্তুপাকার করা হত এক জায়গায়। তাদের আশ্বস্ত করা হত, সুটকেসে নাম লেখা আছে, পরে ঠিক পেয়ে যাবে। এর পর, প্রথমে ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা করে দেওয়া হত। স্বামীর থেকে স্ত্রীকে, মায়ের থেকে ছেলেকে, বাবার থেকে মেয়েকে। আকুলি বিকুলি হাহাকার চাপা দেবার জন্য লাউডস্পীকারে চড়া আওয়াজে বাজত বিভিন্ন গান, মিউজিক। শেষবারের মত মানুষগুলো দেখতে পেতেন তাঁদের প্রিয়জনদের।
এর পর, ফাইনাল সিলেকশন। সব্বাইকে জামাকাপড় খুলে নগ্ন হতে হত। লজ্জা পেলে, ইতস্তত করলে, চড় থাপ্পড়, লাঠির বাড়ি থেকেও সবথেকে বেশি এফেক্টিভ ছিল এক দুজনকার কানে পিস্তল ঠেকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে দেওয়া। একটি বা দুটি মৃত্যু বাকিদের আতঙ্কে হিম করে দিত। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, এর পর নগ্ন হতে আর কেউ আপত্তি করার সাহস পেতেন না। ছেলের সামনে বাবাকে, মেয়ের সামনে মা-কে, বোনের সামনে বোনকে, ভাইয়ের সামনে ভাইকে নগ্ন হতে হত। এক এক করে সামনে ডেস্ক পেতে বসা “ডাক্তার”দের সামনে দাঁড়াতে হত, ডাক্তাররা তাদের এক ঝলক দেখেই সার্টিফাই করে দিত, কে বেঁচে থাকার জন্য ফিট, আর কে নয়। বলা বাহুল্য, এই পুরো পদ্ধতিতে উপস্থিত অফিসার, পুলিশ, সিকিওরিটি, ডাক্তার – নাজী কর্মীদের নিরানব্বই শতাংশ ছিল পুরুষ।
মূলত চোদ্দ বছরের নিচে শিশুরা, গর্ভবতী মহিলা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, বা অসহনীয় যাত্রায় মরণাপন্ন মানুষরা “সিলেক্টেড” হত না। তাদের আলাদা লাইনে দাঁড় করানো হত। আর বাকিদের, অন্য লাইনে। তাদের বলা হত জামাকাপড় পরে নিয়ে ব্যারাকের দিতে যেতে।
সিলেক্ট না হওয়া প্রথম দলটিকে নিয়ে নাজী অফিসাররা রওনা হত সামনে পাঁচশো মিটার দূরের গ্যাস চেম্বারটিতে। দলটিকে পাহারা দেবার জন্য ও সমানে ভয় দেখিয়ে রাখার জন্য তাদের সাথে থাকত একদল ক্ষুধার্ত গ্রে হাউন্ড কুকুর। এর পর এক ঘন্টায়, সব শেষ করে দেওয়া হত। গ্যাস চেম্বারের বাইরের ঘরটাতে পড়ে থাকত শেষ মুহূর্তে আঁকড়ে থাকা কোনও বাচ্চার পুতুল, বৃদ্ধের লাঠি, সোনার দাঁত, প্রতিবন্ধীর নকল পা, চশমা, ঘড়ি, কিংবা অন্য কিছু, যা আর পরলোকে নিয়ে যাওয়া যায় না।
সিলেক্টেড হওয়া দলটিকে, মূলত চোদ্দ বছর থেকে পঁয়ষট্টি বছর বয়স্ক পুরুষ ও নারীদের নিয়ে যাওয়া হত আলাদা আলাদা ব্যারাকে। প্রথমে তাদের চুল কেটে ফেলা হত। মেয়ে পুরুষ, সব্বাইকে ন্যাড়া করে দেওয়া হত। সেই চুল পরে পাঠানো হত বার্লিনে, কমার্শিয়ালি বিক্রি করে তাই দিয়ে টাকা রোজগার করার জন্য।


এর পরে আসত “ক্যানাডা”র দায়িত্বে থাকা বন্দীরা। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে তখন পড়ে আছে রাশি রাশি সুটকেস। সেই সুটকেসের রাশি তাদের নিয়ে যেতে হত বির্কেনাউয়ের পেছনদিকে একটা এলাকায়, সেখানে আলাদা করা হত জামাকাপড়, চশমা, ঘড়ি, গয়না, টাকাপয়সা। বন্দীদের দিয়েই এই কাজ করানো হত, কোনও জিনিস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে শাস্তি ছিল সাথে সাথে মৃত্যু, তবুও তার মধ্যেই তারা চুরি করত। পরে সেইসব চুরির জিনিস বার্টার সিস্টেমে তাদের পাইয়ে দিত ক্ষণস্থায়ী কিছু সুবিধে – হয় তো এক প্যাকেট সিগারেট, একটু বাড়তি স্যুপ, একটা বাড়তি আলুসেদ্ধ, একটা পেঁয়াজ, বা অন্য কিছু।
সেই সময়ে উত্তর আমেরিকার কানাডা ছিল পৃথিবীর অন্যতম ধনী সম্পদশালী রাষ্ট্র। তাই ইহুদীদের বয়ে নিয়ে আসা ধনরাশি বাছাবাছি করার জায়গাটার বন্দীরাই নাম দিয়েছিল “কানাডা”। বির্কেনাউয়ের কানাডা এলাকা ঘুরে দেখতে গিয়ে এখনও মাটির ভেতর থেকে ইতস্তত খুঁজে পাওয়া যায় ভাঙা বোতাম, চিরুনির টুকরো, চশমার কাচ।
অশউইৎজ ওয়ানে গেলে দেখতে পাওয়া যায় উদ্ধার হওয়া সেইসব “সম্পদ”। কিলো কিলো মাথার চুল, হাজারে হাজারে বাচ্চাদের জুতো, শয়ে শয়ে জুতোর কালি বুরুশ, হাজারে হাজারে রান্নাঘরের বাসন, শয়ে শয়ে সুটকেস, শয়ে শয়ে প্রস্থেটিক লিম্ব, যা শেষের দিকে আর নাজীরা বার্লিনে পাঠিয়ে উঠতে পারে নি। প্রতিটা সুটকেস, প্রতিটা জুতো, প্রতিটি চুলের গুছি এক একজন হতভাগ্য মানুষের কাহিনি বলে। লাখ লাখ মানুষের শেষ নিশ্বাস আজও ভেসে বেড়ায় এখানকার বাতাসে, যাদের শুধুমাত্র “ইহুদী” পরিচয়ের কারণে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু, মনুষ্যত্বের ন্যূনতম সম্মানটুকু হারাতে হয়েছিল।
১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে, আমস্টারডামের গোপন আস্তানা থেকে ধরা পড়ার পর, আনা ফ্র্যাঙ্ক পরিবারকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় অশউইৎজেই, পরে আনা আর তার দিদি মারগটকে নিয়ে যাওয়া হয় বারজেন-বেলসেন ক্যাম্পে। সেইখানে, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে, টাইফাস রোগে ভুগে প্রথমে মারগট, পরে আনা মারা যায় কিছুদিনের ব্যবধানে। আনা মারা যাবার ছ মাস বাদে বারজেন-বেলসেন ক্যাম্প নাজীদের দখলমুক্ত হয়। আনার মা, এডিথ ফ্র্যাঙ্ক, সম্ভবত অশউইৎজেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রতিটা ধুলোর কণা, প্রতিটা ঘাসের কণা বহন করছে সেই দুঃস্বপ্নের সময়ের স্মৃতি, অ্যান্টি-সেমিটিজম, দক্ষিণপন্থা মানুষজাতির ওপর কী বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ এই ক্যাম্প।
প্রথমদিকে গর্ভবতী মহিলাদের সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হত গ্যাস চেম্বারে, কারণ তারা কর্মক্ষম নয়। পরের দিকে, অনেক গণনার পরে স্থির হয়, এই অক্ষমতা সাময়িক। তাই গর্ভবতীদের বাঁচিয়ে রাখা হয়, সন্তান প্রসব করার পরের মুহূর্তে, সদ্য মায়ের চোখের সামনেই আছড়ে, অথবা গলা টিপে সদ্যোজাতকে খুন করে মা-কে বলা হত কাজে যোগ দিতে। শোক করার ন্যূনতম সময়টুকুও দেওয়া হত না। পোকামাকড়ের আবার শোক কীসের?
শোক সহ্য করতে না পেরেই অনেক মহিলা এক মাসের মধ্যে উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতেন, ফলে গ্যাস চেম্বারে যাবার দিন এসে যেত খুবই তাড়াতাড়ি।
অনেক সময়ে গ্যাস চেম্বারের সামনে মৃত্যুপথযাত্রীদের লম্বা লাইন লাগত, ফলে পরের দিকে আসা পরোয়ানাপ্রাপ্ত মানুষদের অপেক্ষা করতে হত, দু থেকে তিনদিন। তাদের আর কোনও যত্ন নেওয়া হত না, ততদিনে তারা সবাই কঙ্কালসার। শুধু লাইনে দাঁড়িয়েই কতজন মরে যেতেন, যারা এর পরেও বেঁচে থাকতেন, তাঁরা দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিনে সুযোগ পেতেন গ্যাস চেম্বারে ঢুকে মরার।
এমনি এক মা আর ছেলের গল্প শুনছিলাম গাইডের কাছে। ফাইনাল সিলেকশনের পরেই মা আর ছেলেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। মা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাই তিনি জোর করে নিজেই ছেলেকে পুরুষদের দিকে ঠেলে দেন। অপরিণত মন, বুঝতে না পেরে অপরিসীম অভিমানে চোদ্দ বছরের ছেলে চেঁচিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ফেলে, আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না, তুমি মরে যাও!
মা সিলেক্টেড হন নি। তাই তাঁর গন্তব্য নির্ধারিত হয়, গ্যাস চেম্বার। পরের আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি শান্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছন গ্যাস চেম্বারে, এবং তার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি মারা যান।
এর দেড় মাসের মাথায় অশউইৎজ মুক্ত করে সোভিয়েত লালফৌজ। ছেলেটি অশউইৎজের অন্যতম একজন সারভাইভার। বেঁচে যাবার পর সে জানতে পারে, তার মা সত্যিই গ্যাস চেম্বারে মারা গেছেন তারা আলাদা হয়ে যাবার এক ঘন্টার মধ্যেই। বাকি গোটা জীবন সেই ছেলে কাটায় আত্মধিক্কারে, আত্মগ্লানি নিজের বুকের ওপর চাপিয়ে। মৃত্যুপথযাত্রী মা-কে সে অভিমানভরে বলেছিল, তুমি মরে যাও।
১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ যখন জার্মান বাহিনির অপ্রতিরোধ্য গতি প্রতিহত হল মস্কোর খুব কাছে, যুদ্ধের গতিপথ তখন থেকে বদলাতে শুরু করল। হিটলার তখনও বুঝতে পারেন নি যে পরাজয়ের আর বেশি দেরি নেই। যখন বুঝতে পারেন, অপ্রতিরোধ্য জার্মান বাহিনি ততদিনে দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত। ১৯৪৪ সালের শেষদিকে জার্মান নাজী বাহিনির অন্যতম সফল ফিল্ডমার্শাল রোমেল আত্মহত্যা করেন। ডিসেম্বর মাসেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অশউইৎজ সমেত সমস্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিত্যাগ করে চলে যাবার নির্দেশ আসতে থাকে নাজী বাহিনির কাছে। আসার আগে যতখানি সম্ভব হলোকাস্টের প্রমাণ মুছে দেবার চেষ্টা চলতে থাকে। নির্বিচারে ইহুদীদের যত বেশি পরিমাণে সম্ভব গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়, সমস্ত ডকুমেন্ট নষ্ট করে দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক এক করে ভেঙে দেওয়া হয় বির্কেনাউয়ের চারটি সুবিশাল গ্যাস চেম্বার, যাতে কোনও প্রমাণ না থাকে। পুরো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প উড়িয়ে দেবার প্ল্যান ফাইনাল করা হয়, তার আগে বাকি বন্দীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় কাছেপিঠের অন্যান্য ক্যাম্পে। সেই উদ্দেশ্যে কঙ্কালসার, অভুক্ত, অশক্ত সমস্ত বন্দীদের হুকুম দেওয়া হয় বরফ ভেঙে মার্চ করতে।
দশদিনের সেই মার্চ ডেথ মার্চ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। কয়েক হাজার বন্দী শুধু বরফ ভেঙে চলতে না পেরে মারা গেছিলেন, মারা গেছিলেন খেতে না পেয়ে, মারা গেছিলেন এলোপাথারি গুলি খেয়ে। যাঁরা রেলস্টেশন অবধি পৌঁছতে পেরেছিলেন, তাঁদের চালান করে দেওয়া হয় জার্মানির অন্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।
১৯৪৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি রাশিয়ার রেড আর্মি বা লালফৌজ এসে প্রথম দখল করে অশউইৎজ-বির্কেনাউ। সেখানে তখনও মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন আরও কয়েক হাজার বন্দী, যাঁরা চলবার অবস্থায় ছিলেন না, যাঁদের মেরে ফেলার মত গুলিও নাজী সৈন্যদের অবশিষ্ট ছিল না। নাজী সৈন্যরা অবশ্য তার কয়েক দিন আগেই সেখান থেকে চম্পট দিয়েছে বাকি বন্দীদের নিয়ে।
সেদিনের বেঁচে যাওয়া অশউইৎজ ক্যাম্পের সারভাইভারদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন সেদিনের কাহিনি বারবার পৃথিবীকে শোনাতে, তবু হয় তো পৃথিবী শোনে না, তাই আমেরিকায়, ভারতে জন্ম নেয় ডিটেনশন ক্যাম্পেরা। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়।
বির্কেনাউয়ের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের সবথেকে কাছের যে গ্যাস চেম্বারটা নাজীরা যাবার আগে ভেঙে দিয়ে গেছিল, সেইখানে বানানো হয়েছে মেমোরিয়াল, ইংরেজি সমেত চব্বিশটি ভাষায় সেখানে লেখা আছে ফ্যাসিজম মানবসভ্যতার কতখানি ক্ষতি করে দিয়ে গেছে এই জায়গাটিতে। চার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত অশউইৎজ ওয়ান আর বির্কেনাউ (টু) এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

আজ, ২৭শে জানুয়ারি ২০২০, অশউইৎজ লিবারেশনের ৭৫ বছর পূর্তি। সারা দুনিয়া থেকে অন্তত ১২০ জন অশউইৎজ হলোকাস্ট সারভাইভার এসে যোগ দিচ্ছেন আজকের অনুষ্ঠানে। আসছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেয়ার, আরও বাকি সমস্ত দেশের রাষ্ট্রনায়করা, যাঁদের দেশ একসময়ে নাজী জার্মানির অধীন ছিল। একসঙ্গে তাঁরা স্মরণ করবেন সেই ষাট লক্ষ ভাগ্যহত আত্মাকে, আর শপথ নেবেন যেন এই ভুল পৃথিবীর আর কোথাও, কখনও না হয়।
আমন্ত্রিতদের তালিকায় ভারত নেই অবশ্য।
খুব ভালো লেখা। মনে হলো একটা ডকুমেন্টারি দেখছি। ছবিগুলো যেমন জীবন্ত তেমনই যন্ত্রণাদায়ক।
ইতিহাসের এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে এরম ডিটেলড একটা লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। লেখাটা পড়তেই যখন এতটা কষ্ট হচ্ছিল, এটা বসে লিখতে না জানি লেখকের কতটা মানসিক চাপ হয়েছে। ডিটেলসগুলো একইসাথে হাড়হিম করে দিচ্ছিল, আবার ঘেন্না হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল। তবুও আর্টিস্টের প্রাইমারি ও একমাত্র দায়, সত্যের প্রতি। সেই নিরিখে, এ লেখা সসম্মানে উত্তীর্ণ।
আর পাঠক পাঠিকা হিসেবে আমাদের দায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার। ফ্যাসিজমের ন্যক্কারজনক পরিণতি – কনসেনট্রেশন ক্যাম্প যে কী জিনিস – তা যেন আমরা প্রতি মূহুর্তে মাথায় রাখি।
জান থাকতে ভারতবর্ষে যেন আমরা এনআরসি সিএএ বিরোধী লড়াই না ছাড়ি।
LikeLiked by 1 person
তথ্য সমৃদ্ধ অতি চমৎকার একটা লেখা, সুগভীর লজ্জার ইতিহাস যদিও।এমন লেখা আরও পড়তে চাই।
LikeLiked by 1 person