না, আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
না, আমি এতটুকুও আইসোলেটেড, ডিপ্রেসড ফীল করছি না।
না, আমি “কলকাতার” কোন্ জায়গাকে মিস করছি, কোয়ারান্টিন স্পেশাল কোন্ পদ রান্না করছি, অফিস যেতে না পেরে কীভাবে স্কাইপে মীটিং সারছি – তাই নিয়ে কোনও ফেসবুক গ্রুপে যেতে, কমেন্ট করতে উৎসাহী নই।
আমি, আইসোলেশনেই বাঁচি। ঐ সোশাল ডিসট্যান্সিং যাকে বলেন আপনারা, আসলে তো ফিজিকাল ডিসট্যান্সিং, সোশাল বন্ডিং বজায় রেখেই চলেছেন আপনারা, জমায়েত এখন বিপজ্জনক, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও, আইনি দিক থেকেও – তাই ভার্চুয়ালিই সোশাল বন্ডিং হইহই করে বজায় রেখে চলেছেন, বুঝতে পারছি। খুবই দরকারি এই সময়ে। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, সোশাল ডিসট্যান্সিং, বা আইসোলেশন আসলে যে জিনিসটা – সেটার সাথে আমি অভ্যস্ত অনেক অনেক দিন থেকেই। আমার কাছে ওটা ঠিক নতুন বা চ্যালেঞ্জিং কিছু না।
যে অফিসে চাকরি করি এখন, সেই অফিসেই অন্ধকারতম একটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমি। দু হাজার তেরো থেকে দু হাজার সতেরো পর্যন্ত, তিন খেপে সবশুদ্ধ প্রায় চৌত্রিশ মাস, আমি ঘরে বসে থেকেছি। লকডাউন ছিল না, কোনও বিধিনিষেধও ছিল না, কিন্তু কোনও কাজও ছিল না। চাকরি চলে যাবার ভয় ছিল না, আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে যেটা সবচেয়ে বড় ভয়, বেঞ্চে থাকা, অ্যালোকেশন না থাকা, ফলে একটা সময়ের পর পিঙ্ক স্লিপ দেখার সম্ভাবনা – না, সে রকম কিচ্ছু ছিল না, বরং সেদিক দিয়ে সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে ছিলাম।
কিন্তু, কোনও কাজ ছিল না। অনেকেরই মনে হতে পারে, ধ্যাঃ, এ রকম আবার হয় নাকি? বিশ্বাস করুন, পেছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয়, হ্যাঁ, এ রকম আবার হয় নাকি? কিন্তু হয়েছিল।
কীরকম জানেন?
দুহাজার তেরো সাল। এই দোকানে জয়েন করার তখনও এক বছরও পূর্ণ হয় নি। দুবাই থেকে দু মাসে লাথি খেয়ে ফিরে এসে গান্ধীনগরে সাড়ে তিনমাস কাটিয়ে দিল্লি ফিরেছি। হাতে চাঁদ পাবার মত পেলাম বেলজিয়াম যাবার একটা লং টার্ম অফার। ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখে আমার কনফার্মেশন হল সেই প্রজেক্টে। ভিসা প্রসেস হবে। তাতে লাগে চার পাঁচ সপ্তাহ সময়। শেঙ্গেন ভিসা হবে, ইওরোপ, আহা!
তখন মেডিকেল টেস্ট দেশেই করাতে হত ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য। আপনাদের অনেকেই হয় তো জানেন, আমার ফুসফুসের এক তৃতীয়াংশ পারমানেন্টলি ক্ষতিগ্রস্ত। যতবার ভিসার অ্যাপ্লিকেশন করাতে যাই, বাকিদের যদি তিন সপ্তাহে হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রে লাগে সাত থেকে দশ সপ্তাহ। আড়াই মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়েছে, মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট বেরোবার জন্য। আমি প্রত্যেকবারই জানি, রিপোর্ট ঠিকঠাকই আসবে, কিন্তু প্রতিবার, প্রতিটি বারেই আমাকে কিছু বাড়তি টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এটা প্রমাণ করার জন্য, যে, আমার শরীরে অ্যাকটিভ ইনফেকশন নেই।
তো, ভিসা প্রসেসিং ও তৎসহ মেডিকেল শুরু হল। ফাইনালি আমার পাসপোর্টে শেঙ্গেন ওয়ার্ক পারমিটের স্ট্যাম্প লেগে যখন এল, তখন মার্চ মাসের আঠাশ তারিখ। প্রোজেক্ট চেন্নাইয়ের, অনসাইট ব্রাসেলস। ভিসা এসে গেলে ট্র্যাভেল রিকোয়েস্ট রেইজ করতে হয়। সেইটা করতে গিয়ে জানতে পারলাম, একটু অপেক্ষা করতে হবে, আমার পজিশনটা কিছুদিনের জন্য হোল্ডে রাখা হয়েছে।
অপেক্ষা শুরু হল। মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল, এপ্রিল পেরিয়ে মে, মে পেরিয়ে জুন, জুন পেরিয়ে জুলাই, জুলাই পেরিয়ে আগস্ট। মাঝে মাঝে খবর নিই, স্যার, আর কদ্দিন? উত্তর আসে, আমরা চেষ্টা করছি, চিন্তা কোরো না, হোল্ড উঠলেই পজিশন তোমার, তুমি যাচ্ছোই। অ্যালোকেশন আছে আমাদের প্রোজেক্টেই, তুমি টাইমশীট ভরে যেতে থাকো।
কোনও কাজ নেই, কোনও অফিস নেই, কোনও টিম নেই। থাকার মধ্যে ছিল গুরুচণ্ডালি। আমার ভার্চুয়াল সোশাল গ্রুপ। ফেসবুকে তখনও সড়গড় হই নি, হোয়াটস্যাপও বোধ হয় ছিল না তখন।
একা।
মেয়ে সকাল সাতটায় স্কুলে বেরিয়ে যায়, স্ত্রী সকাল আটটায় অফিস, সারাটা দিন আমি একা। গুরুচণ্ডালিতে ভাট মারব? কতক্ষণ? টিভি দেখব? কতক্ষণ? ইন্টারনেট ঘাঁটব? কতক্ষণ? মে জুন জুলাই মাসের গরমে দিল্লির রাস্তায় ঘুরে বেড়াব? কতক্ষণ?
সাপোর্ট পেয়েছিলাম কিনা, সেটা মনে করার আগে এটা বলে রাখা দরকার, সাপোর্ট চাই নি। (শুরুর দিকে একবার চেয়েছিলাম অবশ্য, তবে ঐ একবারই।) কখনও কারুর কাছে মানসিক সাপোর্ট চাই নি। সে যাত্রায় আগস্ট মাসে জানতে পেরেছিলাম আমার পজিশনটা আমার দোকানের হাতছাড়া হয়ে গেছে, ওটা আইবিএম পেয়েছে। বেলজিয়ামের ভিসা পাসপোর্টের পাতাতেই রয়ে গেল, তাতে আর ইমিগ্রেশনের স্ট্যাম্প পড়ল না। তারপর কিছুদিন আবার ব্যাঙ্গালোর বাস, এক ঠগবাজ জোচ্চোর “ম্যানেজারের” পাল্লায় পড়ে, সে-ও একলা দিনযাপন, সে যাত্রায় একসাথে তিন মাস, তারপর …
এই রকম। আলাদা আলাদা, বিভিন্ন গল্প। সবকটা যোগ করলে ঐ চৌত্রিশ মাস মত দাঁড়ায়।
ডিপ্রেশন কাকে বলে, ডেফিনিশনওয়াইজ, আমি ঠিক জানি না। হ্যাঁ, ডিপ্রেসড ফীল করতাম, কিন্তু ক্রিয়েটিভ কোনও কাজকর্মে মন দেবার যে কথা সবাই বলে থাকেন এই সময়গুলোতে, সেগুলো আমার ক্ষেত্রে কাজ করে না। অলস সময়ে আমার মস্তিষ্কও ছুটি নেয়। আমার যত লেখাজোখা – যা গুরুর সাইটে বেরিয়েছে বা বই হয়ে বইমেলায় বেরিয়েছে, আমার যত গান গাইবার শখ, গান শোনার শখ, আমার ব্লগের যত লেখাজোখা – সমস্ত, সমস্ত বেরিয়েছে সেই সব সময়ে, যখন আমি প্রচণ্ড কাজের চাপে।
এ অভ্যেস চিরদিনের। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পড়াশোনার চাপে যখন দিনরাত এক করে নাভিশ্বাস উঠছে, তখন আমি পাগলের মত পড়ে যাচ্ছি নানারকমের গল্পের বই, ডায়েরি লেখা শুরু করছি আনা ফ্র্যাঙ্ক পড়ে, আনাকে কল্পনায় প্রোপোজ করছি, সুমনকে চিঠি লিখছি, নিজে গান লেখার চেষ্টা করছি, মানে টিন বয়েসের যত পাগলামো আর কি, সমস্ত, সমস্ত হয়েছে চাপের মধ্যে। আর যখন কলেজবেলার অলস সময়, সারাবছর তো পড়তাম না, ঐ পরীক্ষার আগের এক দু মাসের মেহনত, মনে করতে পারি না কিছু লিখেছি, কিছু পড়েছি, বা নিদেন কিছু মনে রাখার মত কাজ করেছি বলে। কিচ্ছু করি নি। কিন্তু, একলা ছিলাম না।
একাকীত্ব অনুভব করতে শুরু করা সেই দু হাজার তেরো থেকে। ক্রমে ক্রমে সেই অনুভূতি আমার অস্তিত্বের সাথে এক হয়ে যেতে শুরু করল। আস্তে আস্তে অনুভব করলাম, আমি একলাই বেশি স্বচ্ছন্দ। হ্যাঁ, বাড়িতে থাকতাম, বিকেলের পর মেয়ে ফিরে আসত, সন্ধ্যের পরে স্ত্রী, কিন্তু কেন জানি না, আমার একাকীত্বের সমস্যাটা আমি প্রথমদিকে তাদের সঙ্গে ভাগ করেই নিতে পারতাম না, তারপর এক সময়ে বুঝলাম, আমি আসলে এটাকে আমার সমস্যা বলেই মনে করছি না, আমি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি একাকীত্বে, আইসোলেশনে।
ডিপ্রেসড মনোভাবটা অবশ্যই ছিল, উত্তরোত্তর বাড়ছিল। অফিসের নোংরা রাজনীতি ততদিনে আমি বুঝেছি, কেন আমাকে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখা হচ্ছে, কীভাবে আমার কেরিয়ারকে বেস করে আরেকজন নিজের কেরিয়ার বানাচ্ছে, কিন্তু ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। পাগল পাগল লাগত, নিজেকে একটা গুটিয়ে রাখা স্প্রিংয়ের মত লাগত। ছাড়া পেলেই আমি তিরবেগে ছিটকে বেরিয়ে পড়ব, কিন্তু কোথায়, কোন দিকে, কোন দিশায়, জানতাম না। ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে চলেছিল, যার থেকে মুক্তি পাবার উপায় আমি জানতাম না। কতবার ভেবেছি, এই আইটি ইন্ডাস্ট্রি আমার জন্য নয়, আমার হয় তো অন্য কিছু, অন্য কোথাও করার কথা, আমি দিন নষ্ট করছি, মাস নষ্ট করছি, বছর নষ্ট করছি আমার জীবন থেকে; কিন্তু কী করব? অন্য কী স্কিল আছে আমার? যে মাইনে, যে স্থায়িত্ব আমি পাচ্ছি এই হোয়াইট কলার জবে, বেরোতে চাইব বলেই কি বেরোতে পারা যায়?
খাদের কিনারার দিকে সরতে সরতে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম মোটরসাইকেল নিয়ে, লাদাখের দিকে। দু হাজার পনেরো সাল। ঐ, গুটিয়ে রাখা স্প্রিংয়ের স্থিতিজাড্য। ততদিনে ফ্রাস্ট্রেশন আরও বাজে রূপ নিয়েছে। রাতে ঘুম আসত না, অকারণে মাথা গরম করে চেঁচামেচি করে ফেলতাম নিজের নিকটজনদের সাথে। দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছিল। সেই সময়ে মনে হয়েছিল, নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা দরকার। আমি হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। তিরিশে মে, যখন পুরো উত্তর ভারত ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রায় ফুটছে, তখন আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম, বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে।
একলা। একজন সঙ্গী হবার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে সে জানায়, যেতে পারছে না, সেটা আমি বাড়িতে জানাই নি। জানিয়েছিলাম ফিরে আসার পর। রাস্তায় সঙ্গী পেয়ে গেছিলাম, সে অন্য গল্প, তাদের সাথে আজও যোগাযোগ আছে।
অসম্ভব কষ্টকর ছিল প্রথম দু দিনের জার্নি, সেসব গল্প আমার বন্ধুদের অনেকেই পড়েছেন আমার বইতে বা ব্লগে, কিন্তু একবারের জন্যেও মনে হয় নি, যাওয়া থামিয়ে ফিরে আসাটা আমার কাছে কোনও অপশন। অপশন ছিল না। সাতচল্লিশ ডিগ্রির গরমে তখন ঝলসাচ্ছি, কিন্তু একটা ঘোর আমাকে চালিয়ে নিয়ে চলছিল। আমাকে যেতে হবেই। ফিরে আমি কোনও মতেই যাবো না সেই চেনা ছকে।
একলা চলার নেশাটা সেই যে পেয়ে বসল, আর ছাড়তে পারি নি তারপরে। সঙ্গী বানাবার মানসিকতা একেবারেই হারিয়ে গেল। এর পর একে একে স্পিতি, সিকিম, ভুটান, অরুণাচল, সবই করেছি – একা। আপনারা যারা আমার বইতে বা ব্লগে পড়েছেন, বরফ-সাদা স্পিতির গল্প, জেনে রাখুন, ওটা টোটাল বানানো গল্প। আমি একেবারে একলা গেছিলাম, কোনও গ্রুপ ছিল না আমার সঙ্গে, যাবার কথাও ছিল না। আমি বাদে আর স্পিতির ছবিগুলো বাদে, বাকি সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক।
দু হাজার সতেরো থেকে অবস্থাটা একটু বদলাতে শুরু করল। অফিসে অন্য অ্যাকাউন্টে কাজ পেলাম, নয়ডাতেই অফিস, রোজ যাওয়া আসা, নতুন টিম, নতুন ছেলেমেয়ের দল, কয়েক মাস বাদে সেটা বদলে আবার নতুন অ্যাকাউন্ট, নতুন টিম, সেখানে দু বছর একটানা – কিন্তু একলা হবার খোলসটা ছেড়ে আর বেরোতে পারলাম না। কারণ ততদিনে আমি এটাকে আর সমস্যা বলেই মনে করছি না, খোলস আর নেই, সেটাই আমি হয়ে গেছি। এই ধরণের লোকগুলোকে লোনলি বলে না, বলে লোনার। আমি লোনার। আমি টিমের ম্যানেজার, তাদের সঙ্গে সুন্দর অফিশিয়াল সম্পর্ক বজায় রাখি, কিন্তু লাঞ্চ করতে যাই একা, কারুর সঙ্গে টেবিল শেয়ার করতে আমার প্রচণ্ড অনীহা, অস্বাচ্ছদ্য, আজও।
সবার থেকে দূরে, একলা, আজও। আট না নমাস হল। কারুর একটা বাড়িতে থাকি, কিন্তু একলাই থাকি। দিনে কয়েক মিনিটের বেশি কথাবার্তা হয় না। এখানে বসে দেশের সমস্ত দুঃসংবাদে মন বিচলিত হয়, একলা রাগে মাথা কুটি, কাঁদি, কিন্তু দেশের কোনও “মানুষ”কে মিস করি না, কারুর সঙ্গ মিস করি না। কারুর সঙ্গ চাইতেও ইচ্ছে করে না আর।
কোয়ারান্টিনে আমি বেশ আছি। দু সপ্তাহ হল সবাই হোম কোয়ারান্টিনে রয়েছি, ঘর থেকে বেরোচ্ছি না, সপ্তাহে একদিন বাজার যাওয়া ছাড়া, টিমস আর স্কাইপেই সমস্ত কাজ চলছে, সমস্ত ঠিক চলছে বলা ভুল, সমস্যা তো রয়েইছে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে কোনও সমস্যা অনুভব করছি না। এটাই আমার কমফর্ট জোন।
একা থাকাটাই নর্মালসি আমার, আমি লোনার। এতটাই যে, কেউ আমাকে “কেমন আছিস” জিজ্ঞেস করলেও ভালো লাগে না, কোনওরকমে উত্তর দিয়ে কম্যুনিকেশন শেষ করি। উল্টোদিকে কাউকে “কেমন আছো” জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না। নিজের বাবা-মা-কেও না। … করি ফোন, এই প্রশ্নটাই করি, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি না। আমি জানি এই পৃথিবীতে সবার লড়াই নিজেকে নিজেকেই লড়তে হয়, একজনকার ক্রুশ অন্যজন বয়ে দেবে না, দেয় না, তাই এসব কথাবার্তা অর্থহীন লাগে আমার। কুশলসংবাদ। আয়্যাম ফাইন, থ্যাংকিউ।
বাইরে একা অনেকবার থেকেছি। সবজি কাটা রান্না করা বাসন মাজা কাপড় কাচা ঘর পরিষ্কার করা – সব নিজের হাতেই করি, মানে এগুলো আমার দৈনিক রুটিন। আমার মত কোটি কোটি মানুষের। রান্নার শখ নেই, যদিও আলুভাতে থেকে বিরিয়ানি, সবই রাঁধতে পারি, কিন্তু আমি ঠিক খাদ্যরসিক নই, মাঝেমধ্যে বানিয়ে ফেললেও বাকি সময়ে চিকেনের ঝোল আর ভাত খাই। তাও ইচ্ছে না করলে ম্যাগি খাই। তাও ইচ্ছে না করলে চিপসের প্যাকেট থাকে, তাইই খাই। সমস্যা হয় না।
আমি বুঝতে পারছি এইসব ভার্চুয়াল কার্নিভাল অনেককেই একলা থাকা বা ঘরে বসে থাকার স্ট্রেস থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে সাহায্য করে। আমাকে করে না। কারণ আমি একলা থাকা বা ঘরে বসে থাকার কারণে আদৌ স্ট্রেসড হই না। দু সপ্তাহ সময় আমার কাছে কিছুই না, যদি দরকার হয়, আমি বাকি বছরটাও এইভাবেই কাটিয়ে দিতে পারব, এততুকু সমস্যা হবে না।
এগুলো আসলে লেখার কোনও দরকারই ছিল না। কেন লিখলাম, নিজেও জানি না – খুব কাজের চাপ থাকলেই লেখা আসে, তাই হাবিজাবি লিখে গেলাম। ইয়ে, মানে, ঐ গ্রুপগুলোর ইনভাইট আমি ডিলিট করতে বাধ্য হয়েছি, কারণ আমি একেবারেই উৎসাহী নই এইসব গ্রুপে রান্নার ছবি পোস্ট করতে বা অন্যের রান্নার ছবি লাইক করতে। খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে, অনেকের সাথে কমিউনিকেশন চালাতে চালাতে হঠাৎ করে মাঝপথে বন্ধও করে দিয়েছি, অপরাধবোধ মনের মধ্যে কাজ করে।
কিছু মনে করবেন না, আমি লোনার। কোয়ারান্টাইন বা আইসোলেশনের দিনগুলো আমাকে আমার আমি-কে খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অন্যরকম কিছু হলে, আমার অস্বস্তি হয়। মানে বাকি সব মানুষের ক্ষেত্রে যেটা খুব স্বাভাবিক, চারদিকেই দেখছি, ফেসবুকে, টিভি চ্যানেলে, অফিসের ইন্ট্রানেটে, লোনলিনেস, আইসোলেশন থেকে মুক্তি পেতে নানা টোটকার কথা আলোচনা হচ্ছে, রান্না করুন, স্কাইপ করুন, হোয়াটস্যাপে পুরনো বন্ধুদের সাথে গল্প করুন, মেন্ট্রাল স্ট্রেস থেকে মুক্তি দিতে হেল্পলাইন খুলেছে আমার অফিস, কিন্তু বিশ্বাস করুন …
… আমার এসবের কিচ্ছুর দরকার নেই।
আয়্যাম ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ।