অস্ট্রিয়ার উত্তরদিকে ছোট্ট এক জনপদ, সেন্ট র্যাডগুন্ড। পাহাড়ের কোলে, ঢেউখেলানো প্রকৃতির মাঝে এক গ্রাম। কয়েক ঘর কৃষকের বাস সেখানে, মুখ্য জীবিকা চাষ আবাদ, গ্রামের এক প্রান্তে আছে একটা চার্চ, রবিবার রবিবার মিষ্টি গমগমে ঘণ্টা বাজে, সবাই জড়ো হয়ে প্রার্থনা করে সেই চার্চে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার জলে তেষ্টা মেটায় সেই গ্রাম, চাষ আবাদের কাজকর্মও চলে। দিনের শেষে হুল্লোড়ের জায়গা বলতে একটা ছোট্ট পাব, গাঁয়ের মোড়ল থেকে সবাই সেখানে আসে, বিয়ার গ্লাসের ঠোকাঠুকি আর হাসির ফোয়ারায় সন্ধ্যে নেমে আসে।
সে ছিল সেই গ্রামেরই এক চাষী। একখানি ছোট ঘর, বাবা মারা গেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈন্য হিসেবে, বিধবা মা রয়েছেন, আর রয়েছে ঘর আলো করা তার প্রিয়তমা বৌ, আদর করে চাষী তাকে ফ্যানি বলে ডাকে।
রোজ সকালে চাষী আর চাষী-বৌ বেরিয়ে যায় তাদের ক্ষেত নিড়ানোর কাজে, বীজ বোনার কাজে। ঘরে গরু আছে, মুরগি আছে, শুওর আছে, ক্ষেতের ফসল আছে – খাবারের তেমন অভাব কিছু হয় না।
চাষী চাষী-বৌয়ের তিন মেয়ে। তিনটি দেবশিশু যেন, তাদের সাথে খেলে, তাদের দিকে চেয়ে, তাদের আদর করেই সময় কেটে যায় দম্পতির। সুখের সংসারে এর বেশি কী চাই?
কিন্তু হাওয়া যেন বদলে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। বীয়ারের গ্লাসে ভেসে আসে নতুন গল্প, কিছু বহিরাগত নাকি দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে, অস্ট্রিয়ায় আসছে, বসবাস করছে, ঠিক যেমন ঘুণপোকা বা উই বসতি গাড়ে তোমার আমার বাড়িতে, সুখের পালঙ্কে, তারা সংখ্যায় বাড়ছে, টারমাইটস, ওদের বড্ড বাড় বেড়েছে, ওদের ঢিট করতে না পারলে একদিন ওরা আমাদের এক সেন্ট র্যাডগুন্ড গ্রাম দখল করে নেবে, সালজবুর্গ দখল করে নেবে, মিউনিখ ওদের হাতে চলে যাবে। …
কারা এই বহিরাগতরা?
সে কেউ জানে না, কেউ দেখে নি, কিন্তু তারা আছে। অন্তত ফুয়েরার হিটলার জানিয়েছেন যে তারা আছে। তিনি তো আমাদের সকলের থেকে বেশিই জানেন, নাকি? তাদের বলে রোমা, জিপসি, জিউ। সব বহিরাগত, সব। ওরা কেউ অস্ট্রিয়ান নয়, ওরা কেউ জার্মান নয়। ফুয়েরার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এদের বিরুদ্ধে। চতুর্দিক থেকে এদের তাড়ানো হবে, আমাদের দেশকে বাঁচাতে হবে। হিন্দু … না না, অস্ট্রিয়ান খতরে মে হ্যায়। ফুয়েরার শিগগিরই শোনা যাচ্ছে, সেনাবাহিনীতে রিক্রুটমেন্ট শুরু করবেন। আমাদের গ্রামের জান কবুল। আমরা দেশ বাঁচাবো, আমরা ফুয়েরারের সেনাবাহিনীতে যোগ দেব। জয় শ্রীরা … ধুর, কী সব লিখছি, হাইল হিটলার!
চাষীর মাথায় ঢোকে না এসব। বোকার মত চেয়ে থাকে দেশপ্রেমের হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মোড়লের মুখের দিকে। তুমি যাদের চেনো না, দ্যাখো নি, ফুয়েরার বললেন বলে তুমি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে? তাদের মারবে? তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? তারা যদি পালটা অস্ত্র না ধরে, তা হলেও তুমি তাদের মারবে? পুরুষ, স্ত্রী, বৃদ্ধ, বাচ্চা – সবাইকে?
মোড়ল বুঝতে পারে না চাষীর প্রশ্ন। এ আবার কী বুঢ়বক! শত্রু তো শত্রুই। তার জন্য আবার মায়াদয়া কী!
চাষী মাথা ঘামায় না আর। সে তার আদরের ফ্যানিকে নিয়ে চাষের কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকে। একে একে গ্রামের পুরুষরা স্বেচ্ছায় চলে যায় জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে, শত্রু নিকেশ করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ এসেছে, এমন মওকা কেউ ছাড়ে? গ্রামে ক্রমশ পুরুষ কমে যায়, সেনা ব্যারাক থেকে তাদের চিঠি নিয়ে এসে গ্রামে বিলি করে একমাত্র পোস্টম্যান, সে-ও কেমন ঘুরে ঘুরে দ্যাখে চাষীকে। এ কেমন লোক, যুদ্ধে যেতে চায় না, গ্রামের ভালো চায় না?
চাষী যায় না। গ্রামের লোকে প্রথমে অবাক হয়, তারপরে ঠারেঠোরে কথা শোনায়। আস্তে আস্তে চাষীর পরিবার গ্রামের মধ্যে একঘরে হয়ে যায় – কেউ ওদের কথা শোনে না, কেউ ওদের মুরগির ডিম কেনে না, জমি নিড়ানোর কাজে উটকো মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়, চাষী প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে মেরে ধুমসে দেওয়া হয়, তার বৌয়ের সামনেই।
তারপরে শুরু হয় বাচ্চা মেয়ে তিনটির সাথে অভদ্রতা। যুদ্ধে যাওয়া দেশভক্ত গর্বিত পুরুষদের সন্তানরাও হিটলারের আদর্শে উদ্বুদ্ধ, গর্বিত। তারা চাষীর মেয়েদের দেখতে পেলেই গালাগাল দেয়, ঢিল ছোঁড়ে, চাষী-বৌ এসে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের বাঁচায়।
গ্রামে আজকাল নতুন এক কালচারের আমদানি হয়েছে। পথচলতি একে অপরের সাথে দেখা হলেই টুপি খুলে সাধারণ অভিবাদনের বদলে লোকে মুঠো করা হাত তুলে বলছে, ভারত মাতা কী … ওঃ, আবার কী সব বলছি, … বলছে, হাইল হিটলার।
চাষী কিছুই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না এদের গর্বের কারণ। মানুষ, অসহায় নিরস্ত্র মানুষকে মারার মধ্যে গর্বের কী আছে! মানুষকে মেরে কীভাবে দেশকে রক্ষা করা যায়!
সে ছুটে যায় চার্চের বিশপের কাছে। বিশপও তাকে বলেন, এ ঈশ্বরের আদেশ, এখন তোমার দেশের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করা উচিত। ফ্র্যাঞ্জ তর্ক করে – ঈশ্বর আমাকে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছেন, সেই ঈশ্বরপ্রদত্ত চিন্তাশক্তি যদি আমাকে বলে, যা হচ্ছে, তা ঈশ্বরের ক্ষমার আদর্শের, ভালোবাসার আদর্শের বিরোধী, তা হলেও কি আমি যুদ্ধে না গেলে ঈশ্বরবিরোধী হয়ে যাবো?
বিশপের কাছে উত্তর মেলে না। ফেরার পর তার ঘরে এসে রাগে ফোঁসফোঁস করে মোড়ল। সে নিজে কিন্তু যুদ্ধে যায় নি, কিন্তু বাকি সব পুরুষ চলে গেলেও চাষী কেন যেতে চাইছে না, তাই নিয়ে তার রাগের সীমা নেই। চাষী তার মানে এই গ্রামকে ভালোবাসে না! দেশটাকে ভালোবাসে না? রেগে গিয়ে চাষীকে হুমকি দেয়, তুমি জানো, এর পরিণতি কী হতে পারে? তোমাকে জেলে বন্দী করা হবে যদি কেউ কমপ্লেন করে দেয়, ইউএপিএ চার্জ লাগিয়ে দেবে … না না, আবার ভুলভাল বকছি। মোড়ল বলে, তোমাকে ফাঁসিতেও চড়ানো হতে পারে। ভেবে দেখেছো, তখন তোমার বুড়ি মায়ের কী হবে? তোমার বউ-বাচ্চার কী হবে?
চাষী তাতেও অনমনীয়। না, ঐ লোক, ফুয়েরার হিটলার, ঘেন্নার রাজনীতি করছে। আমি ওর আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারব না, ওর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মানুষ মারতে পারব না।
মোড়ল চেঁচিয়ে ওঠে, কী জানো, চাষী, শত্রুদের তো তাও বোঝা যায়, ওরা শত্রু, ওদের নিকেশ করাই কাজ, কিন্তু তোমাকে, তোমাকে … তুমি হচ্ছো আসল ঘুণপোকা, টারমাইট। এই গ্রামে যদি কখনও শত্রুদের আক্রমণ হয়, তা হলে একমাত্র দায়ী থাকবে তুমি। তুমি! ভেবে রেখো, সেদিন কী সাফাই দেবে।
টেনশনের পারদ চড়ে, বাইরের অশান্তি ঘরে বয়ে আসে। চাষী তবু অনড়, অনমনীয়। নিজের বিবেকের কাছে সে জেনেছে, যা হচ্ছে অস্ট্রিয়া জুড়ে, জার্মানি জুড়ে, তা অন্যায়, হিটলার যা করছে, তা অপরাধ। বিবেকের বিরুদ্ধে সে যেতে পারবে না। সে যাবে না যুদ্ধে।
কিন্তু যাবে না বললে, কতদিন আর না গিয়ে থাকা যায়? একদিন এল চিঠি, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার আদেশ জানিয়ে। এ আদেশ অগ্রাহ্য করা যায় না। কী হবে? আতঙ্কে চিঠিটা হাতে নিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে চাষী।
বিবর্ণ মুখ নিয়ে চিঠিটা পড়ে চাষী-বৌ। দূরে আল্পসের গায়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা জঙ্গলে পালিয়ে যাই না? ঠিক বেঁচে যাবো, যুদ্ধ শেষ হলে না হয় আবার ফিরে আসব গাঁয়ে?
মতলবটা কারুরই মনঃপূত হয় না। মেয়েগুলোর মাথায় হাত বোলায় চাষী, এ আদেশ অগ্রাহ্য করার মানে এক রকমের মৃত্যুই। এদের ছেড়ে চলে যেতেই হবে? যে লোকটাকে মনেপ্রাণে অপছন্দ করে, তার নামে তাকে লড়তে হবে? কাল্পনিক শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে?
চাষী-বৌয়ের মাথায় বুদ্ধি আসে। যুদ্ধে সবাইকেই তো সৈনিক হতে হয় না। তুমি কোনও সেনা হাসপাতালেও চাকরি নিতে পারো। আহত, অসুস্থর সেবা করবে। তোমাকে কাউকে মারতে হবে না। গিয়ে রিকোয়েস্ট করেই দ্যাখো না।
নিমরাজি হয়ে পোঁটলা বাঁধে চাষী। মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল আটকাবার চেষ্টা করে, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপরে এক সময়ে সেনা ব্যারাকের দিকে পাড়ি দিতে হয় তাকে, রিপোর্টিংয়ের জন্য।
রিপোর্টিংয়ে যাবার পরে পরেই তাকে জেলে ঢুকতে হয়। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে আনুগত্যের প্রথম পাঠ ছিল, ডান হাত সামনে তুলে বলতে হবে, হাইল হিটলার। সেনাবাহিনীতে জোর করে ঢুকতে গিয়ে চাষী এইখানে প্রথম ধাক্কা খায়। সে হিটলারের নামে জয়ধ্বনি দিতে পারবে না।
জেল শুরু হয় তার। অসহনীয় জীবন, অকথ্য মারধোর, তবু তার মুখ থেকে ‘হাইল হিটলার’ বের করাতে পারে না কেউ।
এক সময়ে সহানুভূতিশীল হয়ে জেলার তাকে ডাকেন নিজের ঘরে। জানতে চান, কী পাচ্ছো তুমি এই একগুঁয়েমি করে? তুমি একা বিরোধিতা করে হিটলারের জয়যাত্রা থামাতে পারবে? আয়েগা তো মোদী হি – ইয়ে, হিটলার হি। যে কাজে তোমাকে ডাকা হয়েছিল, সেটাকে একটা চাকরি হিসেবেই নাও না, আমিও তো এখানে চাকরিই করছি, আমি মানি কি না মানি – ত্যাই দিয়ে কি আমি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারব?
চাষী তবু একবগ্গা। না, প্রাণ চলে গেলেও সে হাইল হিটলার বলবে না। বলতে পারবে না।
জেলখানা থেকে সে চিঠি লিখত তার প্রিয়তমা বৌ-কে। আশার কথা শোনাত। বলত, আর কিছুদিন বাদেই তার ট্রায়াল শুরু হবে। সে তো কোনও অপরাধ করে নি, তার মুক্তি পেতে নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধে হবে না।
চাষী-বৌও চিঠি লিখত। সে চিঠি এসে পৌঁছত চাষীর কাছে। এন্স জেলের কুঠুরিতে, স্যানিটি আর ইনস্যানিটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই চিঠিই তাকে শক্তি জোগাত, বেঁচে থাকার রসদ জোগাত।
এক সময়ে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় বার্লিনের জেলে। সে খবর আর তার বৌয়ের কাছে পৌঁছয় না – চিঠির আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বরের চিন্তায় পাগল হতে বসে চাষী-বৌ। একে ধরে, তাকে ধরে। গ্রামের কাছাকাছি শহর সালসবুর্গ, সেখানে গিয়ে ধরাধরি করেও তার বরের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না।
মাসের পর মাস কেটে যায়। একটা সময়ে তার ট্রায়াল হবার সময় আসে। উকিল আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। সব শুনে সে তো হাঁ – নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এমন পাগলামি কেউ করে নাকি? তুমি … তুমি তো বলেছিলে, হাসপাতালে কাজ করতে ইচ্ছুক। একটা চিঠি লিখে দাও, আমি এক্ষুনি তোমাকে জেল থেকে বের করে বার্লিনের হাসপাতালে কাজের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। দ্যাখো দিকি, এইটুকুনির জন্য তোমাকে জেলে কাটাতে হল দেড় বছরের ওপর?
অ্যাপ্লিকেশনের কাগজ আর পেন হাতে নিয়ে, চাষী স্থির চোখে তাকায় উকিলের দিকে। বলে, কোনও কথা দিতে পারেন, সেখানে গিয়ে আমাকে কখনো জয় শ্রীরা … ইয়ে, হাইল হিটলার বলতে হবে না?
উকিল কিছুতেই বুঝতে পারে না, হাইল হিটলার বলাতে এই পাগলের এত আপত্তি কেন। চারপাশের সবাইই তো যখন তখন বলছে, সে তো নিজেও বলে, এমন স্ট্রং রাষ্ট্রনেতা, জার্মানিকে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দিচ্ছেন, আচ্ছে দিন নিয়ে আসছেন, তার নামে জয়ধ্বনি করতে এমন কী সমস্যা?
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বোঝাতে নারে আপনায়। একদিকে দক্ষিণপন্থা, অন্যদিকে র্যাশনালিটি, মাঝখানে ফ্যাসিস্ট জার্মানির কড়া নিয়ম, আনুগত্য দেখাতেই হবে বিকাশপুরুষকে। জার্মানি খতরে মে হ্যায়।
কীভাবে খবর পেয়ে, ঘটিবাটি বেচে চাষীর বৌ একটিবার চোখের দেখা দেখতে বার্লিন এসে পৌঁছয়। চারপাশে পুলিশের কড়া পাহারা, উকিলের শ্যেনদৃষ্টি, তার মাঝে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে যায়, তার হাতের টিফিনবাক্সো, রান্না করে আনা খাবার সে তার বরের কাছ অবধি পৌঁছে দিতে পারে না। কথাটুকু বলার আগেই তার বিস্ফারিত চোখের সামনে তার বরকে হিঁচড়ে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে যায় গেস্টাপো পুলিশ।
কোর্টে কেস ওঠে। জুরিরা সাব্যস্ত করেন, সুপ্রিম কম্যান্ডারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে অস্বীকার করা দেশদ্রোহিতার সামিল। আর, ঈগল ক্রস আর পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্নের ছায়ায় নতুন করে গড়ে ওঠা হিন্দুরাষ্ট্র, সরি, সরি, জার্মান রাষ্ট্র দেশদ্রোহিতার একটাই শাস্তি জানে। না, পাকিস্তানে তো পাঠানো যায় না ওখান থেকে, শাস্তি একটাই – মৃত্যু।
মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা নিয়ে ফিরে আসে চাষী, তবু তার ঘাড় বেঁকে না। শেষ সুযোগ দেওয়া হয় তাকে, আনুগত্য দেখালে এখনও মৃত্যুদণ্ড মাফ করে দেওয়া যেতে পারে। চাষীর চোখের সামনে ভাসে তার প্রিয়তমা বৌয়ের মুখ, তার মেয়েদের মুখ, তার বিধবা বুড়ি মায়ের মুখ, তার গ্রামের ক্ষেত, চার্চের ঘন্টা … মুহূর্তের জন্য কি দুর্বল হয় তার মন?
না, তার মুখ দিয়ে হাইল হিটলার বের করানো যায় না তবু। মাথা উঁচু করে নিজের আদর্শকে সামলে রাখে চাষী।
১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে, কালো ভ্যানে করে আরও পাঁচজনের সাথে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বার্লিন শহরের প্রান্তে এক পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসে। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে শোনে একজন একজন করে বন্দীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সামনের বিল্ডিংয়ের ভেতরে, বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে আসছে প্রাণভেদী আর্তনাদ, তারপর সব চুপ। তারপর পরের জনের পালা।
সে ছ নম্বর। সবশেষে তার সময় আসে। সে চেঁচায় না। প্রাণভিক্ষা করে না। শান্তভাবে গলা পেতে দেয় গিলোটিনের নিচে। পরমুহূর্তে তার মাথা ছিটকে পড়ে মাটিতে, দেহ থেকে আলাদা হয়ে। তখন তার বয়েস ছিল ৩৬ বছর।
বারাণসী শহরে নয়, বার্লিন শহরে, স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা অসংখ্য লাল-সাদা পতাকার আলোড়নে তখন গর্জন ভেসে আসছিল, ডয়েশল্যান্ড উইলবার আলেস। কিংবা, ভারতমাতা কি জ্যায়।
সালটা ১৯৪৩ কি ২০০০, দেশটা জার্মানি কি আর্যাবর্ত, কিছু ম্যাটার করে না। কিচ্ছু না। গল্প তো গল্পই।
====================
২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া “A Hidden Life” সিনেমা থেকে নেওয়া কাহিনি। অস্ট্রিয়ান চাষী ফ্র্যাঞ্জ (Franz Jägerstätter) আর তার বৌ ফ্যানি বা ফ্র্যাঞ্জিস্কাকে নিয়ে তৈরি হওয়া সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে এক অতুলনীয় সিনেমা।
ফ্র্যাঞ্জকে তার গ্রাম স্বীকার করে নি তার মৃত্যুর পরেও। সেন্ট র্যাডগুন্ড গ্রামে যুদ্ধের পরে তৈরি হওয়া ওয়ার মেমোরিয়ালে রাখা হয় নি ফ্র্যাঞ্জের নাম, তার পরিবারকেও পেনসন দিতে অস্বীকার করে অস্ট্রিয়ার সরকার। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সমস্ত রকমের সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ছিল ফ্যানি আর তার তিন মেয়ে।
১৯৬৪ সালে এক আমেরিকান সোসিওলজিস্ট, গর্ডন জাহ্ন, প্রথম খুঁজে বের করেন ফ্র্যাঞ্জের ফাইল, তার বায়োগ্রাফি লেখেন In Solitary Witness নামের বইতে। ১৯৭১ সালে অস্ট্রিয়ান টেলিভিশন ফ্র্যাঞ্জের জীবন নিয়ে একটা ছোট ফিল্ম বানায়। ছবির নাম ছিল, দ্য রিফিউজাল।
১৯৯৭ সালের ৭ই মে, বার্লিনের কোর্ট তার মৃত্যুদণ্ডকে নালিফাই করে। ২০০৭ সালে, পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট প্রথমে ফ্র্যাঞ্জকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেন, এবং তারপরে ‘বিটিফাই’ করেন। অস্ট্রিয়ান চাষী ফ্র্যাঞ্জ জেগারস্টেটার সন্ত ফ্র্যাঞ্জে পরিণত হন, মৃত্যুর ৫৪ বছর পরে।
One thought on “নিছকই এক চাষীর গল্প”