ব্লগে অনেকদিন কিছু লেখা হয় নি, এখন সত্যিই আর লেখার মত কিছু বিষয় পাই না, তাই ভাবলাম একটা পুরনো লেখাই ঘষেমেজে নতুন করে তুলি।
‘উত্তরবঙ্গ’ নামে এক ধারাবাহিকে অনেক বছর আগে লেখা শুরু করেছিলাম আমার কলেজ – জলপাইগুড়ি সরকারি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের গল্প। গত শতাব্দীতে ছাত্র ছিলাম সেখানকার। ‘আমার কলেজ’ লিখলেও আমার ঠিক সেই অর্থে কলেজটা নিয়ে তেমন কোনও মোহ-মায়া-অ্যাটাচমেন্ট-নষ্টলজি কিছুই নেই, আছে কিছু স্মৃতি। অন্য রকমের স্মৃতি। লিখতে শুরু করেছিলাম গুরুচন্ডালি ওয়েবজিনে, শেষ করা হয় নি।
এবার তাই শুরু করলাম আবার। দেখি, শেষ করতে পারি কিনা।
কোনও ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ হিসেবে রাখতে চাইছি না আমার এই লেখা, কারণ এই লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কোনও গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে নেই। নিছকই কিছু সুদূর অতীতের স্মৃতিচারণ, লিখতে গিয়ে যখন যা যেমন মনে আসবে, লিখে ফেলব, তাতে করে পরের ঘটনা আগে আসতে পারে, আগের ঘটনা পরে। অনুচ্ছেদের পরে আরেকটা অনুচ্ছেদ ঠিকই আসবে, পড়তে গিয়ে পাঠক হয় তো খেইও হারিয়ে ফেলবেন না, তবে কোনওরকমের ক্রোনোলজিকাল অর্ডার মেইনটেইন করতে চাইছি না আমি।
এই স্মৃতিচারণ, বা ফিরে দেখা, আমার চার বছরের উত্তরবঙ্গ বাসের। যা আমি ছেড়ে এসেছি আজ থেকে বাইশ বছর আগে। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গেছিলাম সেখানে, উত্তরবঙ্গে অবস্থিত তখনকার একমাত্র ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে। জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। তখন এটা ছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত।
জন্ম হয়ে ইস্তক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বড় হয়েছি আমি, আজও ঘুরে চলেছি, কিন্তু আলাদা করে ফিরে দেখার জন্য উত্তরবঙ্গকেই কেন বেছে নিলাম, কোনও যুক্তি দিতে পারব না। হতে পারে আমার বড় হবার বিশেষ সময়গুলো সেইখানেই রেখে এসেছি বলে, হতে পারে নিজেকে চিনতে শেখা সেখানেই শুরু হয়েছিল বলে। হতে পারে অন্য কিছু। কোনও অহেতুক স্মৃতিচারণা। উত্তরবঙ্গে যাবার আগে পর্যন্ত যেখানে যেখানে থেকে এসেছি, সবই বাবার চাকরির সূত্রে, বাবা-মায়ের নিরাপদ ছত্রছায়ার আড়ালে। এক জায়গায় গড়ে ওঠা সংসার ভেঙে ফেলে নতুন জায়গায় আবার নতুন করে সংসার গড়ে ওঠা, নতুন করে বাজার দোকান প্রতিবেশি চিনতে শেখা, ছেলেমেয়ের ইস্কুল আইডেন্টিফাই করা, এ রকমের কোনও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় নি এর আগে। সবসময়েই দুপুর বেলায় লাঞ্চ পেয়েছি, রাতের বেলায় ডিনার। আর কিছু ভাবার দরকারও পড়ে নি কখনও। এই প্রথম, জয়েন্ট এন্ট্রান্সে একটা ভুলভাল র্যাঙ্ক করে যখন জলপাইগুড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম, বুঝলাম, এ বারের স্থান পরিবর্তন অন্য রকম। এ বার আমাকে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, একা। কোনও ছত্রছায়া তো জুটবেই না, উপরন্তু স্বাগতসম্ভাষণ হিসেবে জুটতে পারে র্যাগিংয়ের হলকা। স্বাভাবিকভাবেই হস্টেল সম্বন্ধে কোনও রকমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা তখনও পর্যন্ত ছিল না, ফলে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় অচেনা একদল ছেলে কল্পনাতীত নোংরা নোংরা ভাষা বলতে বলতে আমাকে উপর্যুপরি চড় থাপ্পড় মারবে, ছাদের কার্নিস দিয়ে হাঁটাবে, এমনকি মেয়েদের সামনে আমাকে ন্যাংটো করে প্যারেডও করাতে পারে, এই সব স্ব-সৃষ্ট কল্পনার ভারে আমি লজ্জায় আর ভয়ে, যাবার আগেই এত কুঁকড়ে গেলাম, যে সেই লজ্জা-ভয় আমার জয়েন্টে প্রথম অ্যাটেম্পটেই চান্স পেয়ে যাবার আনন্দকে পুরো গ্রাস করে ফেলল।
সে বছরে কী হয়েছিল কে জানে, রেসের ঘোড়া আমি ছিলাম না, অঙ্কের স্যার সত্যসাধনবাবু আমার হাতে অমিতাভ মিত্রের বই দেখে বলেছিলেন, তুমি আগে এমনি অঙ্ক করে টুয়েলভটা পাস করার চেষ্টা করো, ওসব জয়েন্ট ফয়েন্ট নিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টাও তুমি কোরো না।
স্যার ভুল কিছু বলেন নি, কারণ ততদিনে আমি ইলেভেনের হাফইয়ার্লিতে অঙ্ক, ফিজিক্স আর বায়োলজিতে ফেল করেছি, অ্যানুয়ালে অঙ্ক আর ফিজিক্সে। হুগলি ব্র্যাঞ্চ স্কুলে সেই সময়ে ‘ফেল’ করা ব্যাপারটাকে খুব গর্হিত অপরাধ বলে মনে করা হত না, তাই আমার মতন বাকি ফেল করা ছাত্রদেরকেও ‘কনসিডারেশনে’ পাস করিয়ে টুয়েলভে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে অঙ্কের স্যার সত্যসাধনবাবু বা ফিজিক্স পড়ানো মোহনদা আমাকে নিয়ে যা কটুকাটব্য করতেন, আমি সেগুলোকে আমার প্রাপ্য হিসেবেই মেনে নেওয়া অভ্যেস করে ফেলেছিলাম।
শুধু মনের মধ্যে এক কোণে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে রেখেছিলাম। আমি শুধু পাস করব টুয়েলভে, তাইই নয়, আমি স্যার আপনাকে জয়েন্ট পেয়েও দেখাব।
মফস্বলে সেই দিনগুলোতে সায়েন্স পড়া ছেলেপুলেদের কাছে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার একমাত্র শর্টকাট ছিল ঐ জয়েন্টই। আর কোনও লাইন বেছে নেওয়া, বা অন্য কিছু এক্সপ্লোর করার মত মানসিকতা বা ইনফরমেশনও ছিল না সেই সময়ে। সেই সময় অর্থে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন সবে টিভিতে মেট্রো চ্যানেল এসেছে, সে চ্যানেলও আমাদের হুগলিতে ঝিরঝিরে ছবিসমেত আসত, বুস্টার ফুস্টার লাগিয়ে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের চ্যানেল চলে আসত, কিন্তু ডিডি মেট্রোর ঝিরঝিরানি কমত না।
নিজের জীবনে পরে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, কিছু জিতেছি, কিছু হেরেছি, কিছু লড়াই এখনও চলছে, কিন্তু সে ছিল আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ জেতা। ইলেভেনে ফেল, হেডুর দয়ায় টুয়েলভে ওঠা, বাংলার কোচিংএ যে মেয়েটিকে দেখে হাবুডুবু খেতাম, তাকে একদিন সাহস ভরে তুতলেমুতলে প্রোপোজ করতে গিয়ে জোরদার প্রত্যাখ্যান পাওয়া, অঙ্ক ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির কোচিংয়ে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে আবিষ্কার করা অন্যদের থেকে আমি কতটা পিছিয়ে আছি, দিন রাত এক হয়ে যাচ্ছে পড়ার ব্যাকলগ ক্লিয়ার করতে, তার মধ্যে হাতে আসছে আনা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি, তার মধ্যে ঠিক সময় করে বন্ধুদের সাথে হ্যাহ্যাহিহি করাও চলছে, আর মাথার মধ্যে সমানে ঘুরছে – সত্যসাধনবাবু একঘর বন্ধুবান্ধবীর সামনে আমাকে বলেছিলেন, তুমি অমিতাভ মিত্র দেখে কী করবে, জয়েন্ট ফয়েন্ট তোমার দ্বারা … আর আমি পড়ার মাঝে কেবল বিড়বিড় করছি, আমি পেয়ে দেখাব আপনাকে স্যার, আমি ঠিক পেয়ে দেখাব।
একদিন আমি টেস্ট পরীক্ষায় বসলাম, পাস করে গেলাম সেকেন্ড ডিভিশনের নম্বর পেয়ে। পড়াশোনা পুরোদমে চালিয়ে, কয়েক মাস পরেই দিলাম হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা, আর তার কদিন পরেই, জয়েন্ট। জেদ এতটাই তীব্র ছিল, বায়োলজি স্যারের অনুযোগে কান না দিয়েই আমি তুলেছিলাম শুধু ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ফর্ম, মেডিকেলের নয়। বায়োলজি আমার ভালো লাগত না। বাবা অনেকবার বুঝিয়েছিল, যদি অঙ্কটা না করতে পারিস, তোর তো বায়োলজিটা বেটার তৈরি আছে – কারুর কথা শুনি নি।
পরীক্ষা দিলাম, আর তার কয়েক মাস পরে অবাক হয়ে দেখলাম, হায়ার সেকেন্ডারিও পাস করে গেছি, একটুর জন্য সাতশো ছুঁতে না পারা সত্ত্বেও আত্মীয় স্বজনের সুবিশাল খানদানের মধ্যে প্রথম ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে সকলের চোখের মণি হয়ে গেছি।
বন্ধুমহলেও তখন ছুঁচো গেলার মত অবস্থা, সংখ্যাগরিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবী জয়েন্ট পায় নি, যাদের ওপর এত স্যারের এত আশা ভরসা ছিল, তারা প্রায় কেউ পায় নি, পেয়েছি আমি, আর তার জন্য আমিই অপরাধবোধে মরে যাচ্ছি, তাদের দিকে চোখ তুলে কথা কইতে পারছি না, কোনওরকমে তাদের চোখের আড়াল হয়ে যেতে পারলে স্বস্তি পাই। অতএব, মনের সমস্ত আশঙ্কা চিন্তা মনের মধ্যেই লুকিয়ে রেখে জনসমক্ষে নিজের পৌরুষ প্রকাশ করলাম। সবাই জানল, আমি জয়েন্টে চান্স পেয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে পেয়ে বেশ খুশি, যাবার দিন গুনছি।
মিষ্টির বাক্স নিয়ে গিয়ে সত্যসাধনবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সেদিন সেই কথাটা বলেছিলাম, যেটা বলার জন্য আমি গত দেড় বছর ধরে প্র্যাকটিস করেছি। আঠেরো বছরের আমি প্রৌঢ় স্যারকে বলছি, স্যার, আর কখনও বলবেন না – আমি পারবো না, আর স্যার হাসতে হাসতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন, তাঁর চোখ দিয়ে জলের ধারা নামছে, এ দৃশ্য আমার আজও মনে আছে।
সত্যসাধনবাবুর সাথে পরে যোগাযোগ হয়েছিল, উনি দিল্লি এসেছিলেন মেয়ের কাছে, আবার গেছিলাম দেখা করতে, তার কয়েক বছরের মধ্যেই উনি মারা যান।
** ** **
প্রসপেক্টাসে লেখা ছিল, কলেজে পৌঁছতে গেলে নামতে হবে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে। ব্যান্ডেল স্টেশনের কাউন্টারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সেটা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আরও এক ঘন্টা দূরের রাস্তা। এখান থেকে ট্রেন যায় দুটো, কামরূপ আর তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস।
তখন কম্পিউটার তো ছিলই না, কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশনও ছিল না। প্রতিটা স্টেশনের আলাদা আলাদা কোটা থাকত। ব্যান্ডেলে তিস্তা তোর্সা আর কামরূপের কোটা থাকত, একটা বা দুটো কম্পার্টমেন্ট। তিস্তা তোর্সায় টিকিট কাটা হল। কীভাবে কীভাবে যেন খবর এসে গেল ব্যান্ডেল সাহাগঞ্জের সঞ্জয় সরকার জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজেই পড়ে, অতএব, তাকে আগে থেকে খবর পাঠিয়ে দিলে সে কোনও রকম দরকারে সাহায্যও করতে পারে। খবর পাঠিয়েও রাখা হল।
স্মৃতিচারণায় এ সব খুব উল্লেখযোগ্য বিবরণ না-ও হতে পারে, তবে জাস্ট লিখছি বলেই লিখে রাখা, সঞ্জয়দার মা নিজে আমাদের বাড়ি এসে আমাকে অভয় দান করে গেছিলেন এই বলে, গিয়েই সঞ্জয়ের সাথে দেখা কোরো, তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। ও তোমাকে সব রকম হেল্প করবে। আমি এই চিঠিতে সমস্ত লিখে দিলাম। এটা গিয়ে সঞ্জয়কে দিয়ে দিও।
নির্দিষ্ট দিনে সমস্ত গুছিয়ে রাখা লাগেজ এবং সঞ্জয়দার জন্য চিঠি নিয়ে উঠে পড়লাম তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে, বাবার সঙ্গে। পরদিন সকালে পৌঁছবে জলপাইগুড়ি রোড।
** ** **
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনটা হচ্ছে প্রধান গেটওয়ে টু উত্তরবঙ্গ ট্যুরিজম। কলকাতা, দক্ষিণবঙ্গ তথা বাকি ভারত থেকে যত ট্যুরিস্টযাত্রীর দল রেলপথে বেড়াতে আসে দার্জিলিং কার্শিয়াং কালিম্পং নেপাল ভূটান গ্যাংটক ইত্যাদির উদ্দেশ্যে, সক্কলকে এই স্টেশনেই নামতে হয়। এখান থেকেই বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনের দিকে বিভিন্ন রাস্তা বেরিয়ে গেছে। নামে নিউ জলপাইগুড়ি হলেও স্টেশনটা আসলে দার্জিলিং জেলায় পড়ে। শিলিগুড়ি মহকুমায়।
সেই নিউ জলপাইগুড়ি, যা এনজেপি নামে অধিক পরিচিত, সেখানে প্রথমবারের জন্য যখন এসে পৌঁছলাম, তখন সবে ভোর হয়েছে। বাতাসে একটা ঠান্ডা আমেজ। জংশন স্টেশনের ভেতরে আলাদা করে মাঝরাত কি ভোর কি দুপুর বোঝার উপায় নেই, এনজেপিও তাই, সবসময়েই অসংখ্য যাত্রী আর হকারের সম্মিলিত হাঁকডাকে সরগরম, তবু তার মধ্যেই কিছু কিছু নতুন জিনিস চোখে পড়ে গেল, যা পরবর্তী চার বছর ধরে আরও বহুবার দেখতে দেখতে চোখে বসে গেছিল। চোখে পড়ল এই কারণে, এর আগে আমার দেখা দুই মাত্র জংশন স্টেশন, হাওড়া আর ব্যান্ডেলে এ সব চোখে পড়ে নি।
এক, মিলিটারির আধিক্য। প্রচুর জলপাই উর্দি পরা সেনাবাহিনীর লোক ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে, কিংবা নিজেদের পাহাড়প্রমাণ লাগেজ নিয়ে বসে আছে ট্রেনের অপেক্ষায়। আর দুই, ক্ষুদে চোখ, চ্যাপ্টা নাকের আধিক্য। নেপালি টাইপের দেখতে প্রচুর লোক একসাথে, সেই আমার প্রথম দেখা।
ট্রেন এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়াবে। নেমে জানলার পাশেই দাঁড়ালাম, এবং দাঁড়াতেই এক অপূর্ব বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম।
কী দেখলাম? কী আবার, দার্জিলিংয়ে লোকে যা দেখতে আসে। পাহাড়। নীলচে সবুজ পাহাড়, অর্ধেক আকাশ ঢেকে রেখেছে, যেন স্টেশনের টিনের ছাউনির ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কলকাতা শহরতলীর সমতলবাসীর অনভিজ্ঞ চোখে অনেকটা এই রকমই মনে হল। পরে জেনেছিলাম, আসলে সেখান থেকে পাহাড় অনেকটা দূর।
তো যাই হোক, ঠান্ডা হাওয়া আর পাহাড়ের সিল্যুয়েট দিয়ে তরাই প্রথম স্বাগত জানাল আমাদের। এই রকম একটা জায়গায় হবে আমার কলেজ! ভাবা যায় না!!
এই বার প্ল্যাটফর্মের দিকে চোখ পড়ল। দেখলাম, ট্রেনের একমাথা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা অল্পবয়েসী ছেলে খুব উদ্গ্রীব হয়ে প্রতিটা জানলায় জানলায় কী যেন জিজ্ঞেস করতে করতে আসছে। কেন জানি না, তাদের ভাবভঙ্গীটা খুব একটা সুবিধেজনক মনে হল না। পেটের মধ্যে তখনও র্যাগিংয়ের ভয় গুড়গুড় করছে, কে জানে, তারা এইখান থেকে র্যাগিং শুরু করে দেয় কিনা! অপরিচিত ছেলেদের হাতে বাবার সামনে অপদস্থ হব, বাবা কিছুই করতে পারবে না, সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার। অগত্যা, মনে জোর আনার জন্য উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়ালাম। … তাতেও মনে জোর এল না, অতএব, অগতির গতি, ট্রেনে উঠে লক্ষ্মী ছেলের মতো বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।
জোর করেই উল্টোদিকের জানলায় চেয়ে আছি, হঠাৎ কাঁধে একটা হাত পড়ল, ‘এই যে ভাই, জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক?’
হৃৎপিন্ড পুরো গলায় চলে এসেছে আমার তখন। আর রক্ষা নাই। ফ্যাকাশে মুখে ফিরে দেখলাম এক কিশোর, মুখটাকে যথাসম্ভব নির্মম করে আমার দিকে চেয়ে আছে, সাথে আরও পাঁচজন সঙ্গী। বাবাও ঘাবড়ে গেছে। আমিই মুখ খুললাম, বললাম, না।
‘না’টা যথেষ্ট জোরালো হয় নি অবশ্যই। ছেলেগুলো বিশ্বাস করল না। জলপাইগুড়িতে যে একটা পলিটেকনিকও আছে, সে-ও তো আমরা কেউই জানি না। পলিটেকনিক বলতে ছেলেটা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজকেই রেফার করছে কিনা, তা-ও বুঝতে পারছি না।
ছেলেগুলো নড়ল না। তিনজন চলে গেল, দুজন সেখানেই বসে রইল, আর পর্যায়ক্রমে আমার মুখ আর সীটের নিচে রাখা ট্রাঙ্ক দেখে যেতে লাগল। যাত্রী আর লটবহর দুটোই প্রমাণ দিচ্ছে আমি মূর্তিমান কোথাও হস্টেলবাস করতে যাচ্ছি, বাবা তাকে ছাড়তে যাচ্ছে, অতএব সেই জায়গাটা তাদের মতে জলপাইগুড়ি পলিটেকনিকই হতে হবে। কেন হতে হবে, তা যদিও বুঝতে পারলাম না। বুঝেছিলাম পরে।
ছেলেদুটো বসে বসে আমাদের মাপতে লাগল। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার যদিও, কিন্তু কিছুই করার নেই। ট্রেন চলতে শুরু করল। আমরা দুজনেই বেশ অস্বস্তি বোধ করছি। কেবলই ওদের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে, নিজের ব্রেকফাস্টের দিকেও মন দিতে পারছি না। গলার ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। হবে, এইবার র্যাগিং শুরু হবে। এরা কি রাস্তা দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যায় নকি?
ছোকরাদ্বয় এইবার বাবাকে প্রশ্ন করতে শুরু করল, কাকু কোথা থেকে আসছেন? কোথায় যাচ্ছেন ইত্যাদি। বাবা খুব ঠান্ডা মাথায় উত্তরগুলো দিল। ছেলেদের তাতেও বিশ্বাস হল না। বাবা উল্টে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি কাউকে খুঁজছো? তোমরা কোথাকার? তারা আবারও জানাল, তারা জলপাইগুড়ি পলিটেকনিকের। সেখানে এখন ইনটেক চলছে, তাই ছাত্রদের এনজেপি থেকে রাস্তা চিনতে সাহায্য করতে তারা এখানে এসে পড়েছে। ভাবভঙ্গী দেখে তাদের খুব একটা সাহায্য করতে উৎসুক বলে মনে হল না।
এক সময়ে এল রাণীনগর জংশন। এখানে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস দু টুকরো হয়ে যায়। একটা পার্ট, তিস্তা, যায় জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনের ওপর দিয়ে হলদিবাড়ি পর্যন্ত, আরেকটা জলপাইগুড়ি রোড দিয়ে, যেখানে আমাদের নামতে হবে, যায় নিউ কোচবিহার পর্যন্ত। রাণীনগর থেকে, বেলাকোবা, আমবাড়ি ফালাকাটা পেরিয়ে ছোট্ট একটা চা বাগান পেরিয়েই জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন।
ছোট্ট স্টেশন, জলপাইগুড়ি রোড, একটা মাত্র প্ল্যটফর্ম। কোনও ইলেকট্রনিক সিগন্যাল নেই, ফিঙে পাখির মত ল্যাজঝোলা নীল লাল রংয়ের সিগন্যাল, কখনও দেখি নি আগে।
সেই ছেলেদুটোই সাহায্য করল আমাদের ট্রাঙ্ক নামাতে। কিন্তু কেন জানি তাদের উপস্থিতি আমাদের মোটেই স্বাভাবিক হতে দিচ্ছিল না। জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক যাবো না বলা সত্ত্বেও কেন পিছু ছাড়ছে না?
স্টেশনের বাইরে রিক্সাই একমাত্র বাহন। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ যাবো বলে একটা রিকশায় চড়ে বসলাম, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম আমাদের আগে পিছে পাশে সেই দুটো ছেলে সমেত প্রায় দশ বারোজনের একটা দল সাইকেলে করে চলেছে আমাদের পুরো কর্ডন করে।
পুরো দিশেহারা লাগছিল, পাশে বাবা থাকা সত্ত্বেও। হঠাৎ একটা ছেলে আমাদের রিক্সার পাশে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই তুমি কিসে এলে?
হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হয়ে গেল। কী ভেবেছেটা কী এরা? আর কতক্ষণ এইভাবে চলবে? গম্ভীর মুখে উত্তর দিলাম, ‘ট্রেনে’।
ছেলেটা অবশ্যই এই উত্তর আশা করে নি, সে জানতে চেয়েছিল বোধ হয় তিস্তা তোর্সা না কামরূপ। ব্যাটা আমার সাথেই স্টেশন থেকে আসছে, খুব ভালো করে জানে কোন ট্রেন থেকে নেমেছি, ওরই বন্ধু আমাদের ট্রাঙ্ক নামিয়েছে, এখন ন্যাকামো হচ্ছে?
আমার উত্তরটা পেয়েই ছেলেটা সাইকেলে ব্রেক মারল, ‘ট্রেনে?’ তারপর পুরো খুনীর দৃষ্টি দিয়ে, ‘আচ্ছা চল্’। বাবা পাশ থেকে চাপা গলায় বলল, ‘কেন ট্যারাব্যাঁকা উত্তর দিতে যাস। এখন দ্যাখ আবার কী ঝামেলা করে, অচেনা অজানা জায়গা।’ অর্থাৎ, বাবাও ডবল নার্ভাস।
পরিস্থিতি সে রকমই ছিল। হঠাৎ, একটা তেমাথার সামনে এসে সাইকেলগুলো এসে রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে ফেলল, অ্যাই অ্যাই, পলিটেকনিকের ভেতর দিয়ে নিয়ে চলো, ভেতর দিয়ে চলো।
বাবা পুরো হতবাক অবস্থাটা কাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল প্রায়, কী ব্যাপার বলো তো তোমাদের? তখন থেকে আমাদের সাথে লেগে আছো কেন? আমরা তো অনেকবার বলেছি তোমাদের পলিটেকনিকে আমাদের যাবার নেই, আমরা যাচ্ছি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে, কেন তোমরা আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাধাতে চাইছো?
এক সাইকেলওলা চোখ সরু করে বলল, কাকু, চুপ করে রিক্সায় বসে থাকুন। আপনার সাথে পরে কথা বলছি।
জীবনে এই প্রথম কাউকে আমার বাবার সাথে এই রকম ব্যবহার করতে দেখলাম। কারুর মুখে কোনও কথা সরল না। কী বলব, কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না, কেবল বুঝলাম, জোর খাটবে না।
রিক্সা এসে পৌঁছলো একটা ছ্যাতলা পড়া হলদে রংয়ের বিল্ডিংয়ের সামনে, সামনে লেখা জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক ইনস্টিট্যুট। একগাদা ছেলে সাইকেল থেকে নেমে এসে সেখানে অপেক্ষমান আরও অনেকগুলো ছেলেকে নিয়ে আমাদের রিক্সা পুরো গোল করে ঘিরে ধরল। রিক্সা দাঁড়িয়ে গেল।
সেই নেতা গোছের ছেলেটি আমাকে হুকুম করল, এই, নেমে আয়।
… চলবে
পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। পরবর্তী অংশের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ।
LikeLiked by 1 person
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনটা জলপাইগুড়ি জেলায় পড়ে বন্ধু; শিলিগুড়ি শহরের ষাট ভাগ জলপাইগুড়ি জেলা।
LikeLike